.
তারিখটা ডাইরিতে নোট করে রাখলেন তুলসীবাবু। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৮০। গত মাসেই কেনা সাড়ে চার ফুট উঁচু নতুন খাঁচায় রাখা সাড়ে তিন ফুট উঁচু পোষা পাখি বৃহচ্চঞ্চু গতকাল মাঝরাত্রে একটা কাণ্ড করে বসেছে।
একটা সন্দেহজনক শব্দে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল তুলসীবাবুর। কটকট কটাং কটাং কটকট…। ঘুম ভাঙার মিনিট খানেকের মধ্যেই শব্দটা থেমে গেল। তারপর সব নিস্তব্ধ।
মন থেকে সন্দেহটা গেল না। তুলসীবাবু মশারিটা তুলে খাট থেকে নেমে পড়লেন। জানালা দিয়ে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। তারই আলোতে চটিজোড়ায় পা গলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়।
টর্চের আলো খাঁচাটার উপর পড়তেই দেখলেন নতুন খাঁচার মজবুত তার ছিঁড়ে দিব্যি একটা বেরোনোর পথ তৈরি হয়ে গেছে।
খাঁচা অবিশ্যি খালি।
টর্চের আলো ঘুরে গেল বারান্দার উলটো দিকে। চঞ্চু নেই।
সামনে সিঁড়ির মুখটাতে বারান্দা ডাইনে ঘুরে চলে গেছে তড়িৎবাবুর ঘরের দিকে। একটা শব্দ–তুলসীবাবু রুদ্ধশ্বাসে বারান্দার মোড়ে গিয়ে আলো ফেললেন বিপরীত দিকে।
যা ভেবেছিলেন তাই। তড়িবাবুর হুলো চঞ্চুর ডাকসাইটে ঠোঁটের মধ্যে অসহায় বন্দি। মেঝেতে টর্চের আলোয় যেটা চিকচিক করছে সেটা রক্ত ছাড়া আর কিছুই না। তবে হুলোটা এখনও জ্যান্ত সেটা তার চার পায়ের ছটফটানি থেকেই বোঝা যাচ্ছে।
আশ্চর্য এই যে আলো চোখে পড়া এবং তুলসীবাবু ধমকের সুরে চঞ্চু বলার সঙ্গে সঙ্গে পাখি ঠোঁট ফাঁক করে হুলোটাকে মাটিতে ফেলে দিল। তারপর বড় বড় পা ফেলে ও-মাথা থেকে এ-মাথা এসে মোড় ঘুরে সটান গিয়ে ঢুকল নিজের খাঁচার ভিতর।
এই বিভীষিকার মধ্যেও তুলসীবাবু হাঁফ না ছেড়ে পারলেন না।
তড়িৎবাবুর ঘরের দরজায় তালা। সারা ডিসেম্বর ও জানুয়ারি স্কুলপাঠ্য বই ছাপানোর ঝামেলা মিটিয়ে ভদ্রলোক দিন তিনেক হল চলে গেছেন কলকাতার বাইরে বিশ্রামের জন্য।
হুলোটাকে ঘরের জানালা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলেই নিশ্চিন্ত। কত গাড়ি যায় রাতবিরেতে রাস্তা দিয়ে কলকাতা শহরে দিনে রাতে কত কুকুর বেড়াল গাড়ি চাপা পড়ে মরে তার কি কোনও হিসেব আছে?
বাকি রাতটা ঘুম হল না তুলসীবাবুর।
পরদিন আপিস থেকে ঘণ্টা খানেকের ছুটি নিয়ে রেলওয়ে বুকিং আপিসে গেলেন। একজন চেনা লোক ছিল কেরানিদের মধ্যে, তাই কাজ হাসিল হতে বেশি সময় লাগল না। প্রদ্যোতবাবু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার চঞ্চুর খবর কী মশাই? তাতে তুলসীবাবু ঘাড় নেড়ে জবাব দিয়েছিলেন–ভালই। তারপর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলেছিলেন, আপনার দেওয়া ছবিটা ভাবছি বাঁধিয়ে রাখব।
.
চব্বিশে ফেব্রুয়ারি তুলসীবাবু দ্বিতীয়বার বিজয়নগরম হয়ে জগদলপুর হাজির হলেন। সঙ্গে ব্রেকভ্যানে এল একটা প্যাকিং কেস, যার গায়ে ফুটো থাকায় তার ভিতরের খাঁচার পাখির নিশ্বাস-প্রশ্বাসে কোনও অসুবিধা হয়নি।
জগদলপুর থেকে একটি টেম্পো ভাড়া করে সঙ্গে দুজন কুলি নিয়ে তুলসীবাবু রওনা দিলেন দণ্ডকারণ্যের সেই জঙ্গলের সেই বিশেষ জায়গাটির উদ্দেশে, যেখানে চঞ্চুকে শাবক অবস্থায় পেয়েছিলেন তিনি।
চেনা জায়গায় গাড়ি থেকে নেমে কুলির মাথায় বাক্স চাপিয়ে আধঘণ্টার পথ হেঁটে সেই ঝলসানো নিম গাছের ধারে গিয়ে তুলসীবাবু থামলেন। কুলিরাও মাথা থেকে বাক্স নামাল। তাদের আগে থেকেই ভাল বকশিশ দেওয়া ছিল, আর বলা ছিল যে প্যাকিং কেসটা তাদের খুলতে হবে।
পেরেক খুলে কাঠ চিরে ফেলে খাঁচা বাইরে বার করার পর তুলসীবাবু দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যে পাখি দিব্যি বহাল তবিয়তে আছে। এ হেন জীবের দর্শন পেয়ে কুলি দুটো স্বভাবতই পরিত্রাহি ডাক ছেড়ে পালাল। কিন্তু তাতে তুলসীবাবুর কোনও উদ্বেগ নেই। তাঁর কাজ হয়ে গেছে। খাঁচার ভিতর চঞ্চু একদৃষ্টে তাঁর দিকে চেয়ে আছে। তার মাথা এখন সাড়ে চার ফুট উঁচু, খাঁচার ছাত ছুঁই ছুঁই করছে।
আসি রে চঞ্চু!
আর মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। তুলসীবাবু একটা ছোট্ট দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে টেম্পোর উদ্দেশে রওনা দিলেন।
তুলসীবাবু কোথায় যাচ্ছেন সেটা আপিসে কাউকে বলে যাননি। এমন কী প্রদ্যোতবাবুকেও। পাওনা থেকে পাঁচদিন ছুটি নিয়ে মাঝ সপ্তাহে বেরিয়ে পড়ে সোমবার আবার আপিসে হাজিরা দেবার পর প্রদ্যোতবাবু স্বভাবতই জিজ্ঞেস করলেন এই অকস্মাৎ অন্তর্ধানের কারণ। তুলসীবাবু সংক্ষেপে জানালেন নৈহাটিতে তাঁর এক ভাগনির বিয়ে ছিল।
এর দিন পনেরো পরে প্রদ্যোতবাবু একদিন তাঁর বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে খাঁচা সমেত পাখি উধাও দেখে ভারী অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করে উত্তর পেলেন, পাখি আর নেই।
প্রদ্যোতবাবুর মনটা খচখচ্ করে উঠল। তিনি নেহাতই হালকা ভাবে বলেছিলেন পাখি মরে যাবার কথা; এভাবে এত অল্প দিনের মধ্যেই কথাটা ফলে যাবে সেটা ভাবতে পারেননি। দেয়ালে তাঁরই তোলা চঞ্চুর ছবি টাঙানো রয়েছে; তুলসীবাবুরও কেমন জানি নিঝুম ভাব সব মিলিয়ে প্রদ্যোতবাবুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। যদি বন্ধুর মনে কিছুটা ফুর্তি আনা যায় তাই বললেন, অনেকদিন মনসুরে যাওয়া হয় নি মশাই। চলুন কাবাব খেয়ে আসি।
ওসবে আর রুচি নেই, বললেন তুলসীবাবু।
প্রদ্যোতবাবু আকাশ থেকে পড়লেন।–সে কী মশাই, কাবাবে অরুচি? আপনার কি শরীর-টরীর খারাপ হল নাকি? আপনার তো এতরকম ওষুধ জানা আছে–একটা কিছু খান!–সেই সাধু যে পাতার সন্ধান দিল, তাতে ফল হয় কি না দেখেছেন?