ভাল কথা–পাখির ডাক সম্বন্ধে কিছু বলা হয়নি। এই ডাক শুনেই একদিন সকালে সান্যাল মশাই বারান্দার ওপারে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে বিষম খেলেন। এমনিতে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বাক্যালাপ নেই বললেই চলে; আজ কোনওমতে কাশির ধাক্কা সামলে নিয়ে তড়িৎ সান্ন্যাল তুলসীবাবুর উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন,–খাঁচায় কী জানোয়ার রেখেছেন মশাই যে, ডাক ছাড়লে পিলে চমকে যায়? পাখির ডাক শুনে জানোয়ারের কথাই মনে হয় তাতে ভুল নেই।
তুলসীবাবু সবে কলঘর থেকে বেরিয়ে অফিসে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিলেন; হাঁক শুনে দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে তড়িৎবাবুকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, জানোয়ার নয়, পাখি। আর ডাক যেমনই হোক না কেন, আপনার হুলোর মতো রাত্তিরে ঘুমের ব্যাঘাত করে না।
হুলোর কান্না আগে শোনা যেত না, সম্প্রতি শুরু হয়েছে।
তুলসীবাবুর পালটা জবাবে বাকযুদ্ধ আর এগোতে পারল না বটে, কিন্তু তড়িত্ত্বাবুর গজগজানি যামল না। ভাগ্যিস খাঁচাটা থাকে তড়িৎবাবুর গণ্ডির বাইরে; পাখির চেহারা দেখলে ভদ্রলোকের
প্রতিক্রিয়া কী হত বলা শক্ত।
এই চেহারা তুলসীবাবুকে বিস্মিত না করলেও, তাঁর বন্ধু প্রদ্যোতবাবুকে করে বই কী। আগে অফিসের বাইরে দুজনের মধ্যে দেখা কমই হত। মনসুরের দোকানে গিয়ে কাবাব পরোটা খাওয়াটা ছল সপ্তাহে একদিনের ব্যাপার। প্রদ্যোতবাবুর স্ত্রী আছে, দুটি ছেলেমেয়ে বাপ মা ভাই বোন আছে, সংসারের অনেক দায়দায়িত্ব আছে। কিন্তু দণ্ডকারণ্য থেকে ফেরার পর থেকেই তাঁর মনটা বার বার চলে যায় তুলসীবাবুর পাখির দিকে। ফলে তিনি আজকাল প্রায়ই সন্ধ্যায় চলে আসেন মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের এই ফ্ল্যাটে।
পাখির দ্রুত আয়তনবৃদ্ধির সঙ্গে তার চেহারার পরিবর্তনও প্রদ্যোতবাবুকে বিস্মিত করে। এটা তুলসীবাবুর দৃষ্টি এড়ায় কী করে, বা না এড়ালেও তিনি এই নিয়ে কোনও উদ্বেগ প্রকাশ করেন না কেন, সেটা তিনি বুঝতে পারেন না। কোনও পাখির চোখের চাহনি যে এত নির্মম হতে পারে সেটা প্রদ্যোতবাবু ভাবতে পারেননি। চোখ দুটো হলদে, আর সেই চোখে এক ভাবে একই দিকে মিনিটের পর মিনিট চেয়ে থাকাটা তাঁর ভারী অস্বস্তিকর বলে মনে হয়। পাখির দেহের সঙ্গে সঙ্গে ঠেটিটিও স্বভাবতই বেড়ে চলেছে। কুচকুচে কালো মসৃণ ঠোঁট, ঈগলের ঠোঁটের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে, তবে আয়তনে প্রায় তিন গুণ বড়। এ পাখি যে ওড়ে না সেটা যেমন ডানার সাইজ থেকে বোঝা যায়, তেমনি বোঝা যায় বাঘের মতো নখ সমেত শক্ত, সবল পা দুটো থেকে। অনেক পরিচিত লোকের। কাছে পাখির বর্ণনা দিয়েছেন প্রদ্যোতবাবু, কিন্তু কেউই চিনতে পারেনি।
আজ রবিবার, এক ভাইপোর একটি ক্যামেরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন প্রদ্যোতবাবু। খাঁচার ভিতর আলো কম, তাই ফ্ল্যাশের প্রয়োজন। ছবি তোলার অভ্যাস ছিল এককালে। তারই উপর ভরসা করে খাঁচার দিকে তাগ করে ক্যামেরার শাটারটা টিপে দিলেন প্রদ্যোতবাবু। ফ্ল্যাশের চমকের সঙ্গে সঙ্গে পাখির আপত্তিসূচক চিৎকারে তাঁকে তিন হাত পিছিয়ে যেতে হল, আর সেই মুহূর্তেই মনে হল যে এর গলার স্বরটা রেকর্ড করে রাখা উচিত। উদ্দেশ্য আর কিছু না–ছবি দেখিয়ে এবং ডাক শুনিয়ে যদি পাখিটাকে চেনাতে সুবিধে হয়। তা ছাড়া প্রদ্যোতবাবুর মনে একটা খচখচানি রয়ে গেছে যেটা তুলসীবাবুর কাছে এখনও প্রকাশ করেননি; কবে বা কোথায় মনে পড়ছে না, কিন্তু কোনও বই বা পত্রিকায় প্রদ্যোতবাবু একটি পাখির ছবি দেখেছেন যেটার সঙ্গে তুলসীবাবুর পাখির আশ্চর্য সাদৃশ্য। যদি কখনও সেই ছাপা ছবি আবার হাতে পড়ে তা হলে মিলিয়ে দেখতে সুবিধা হবে।
ছবি তোলার পরে চা খেতে খেতে তুলসীবাবু একটা কথা বললেন যেটা আগে বলেননি। চঞ্চু আসার কিছুদিন পর থেকেই নাকি এ বাড়িতে আর কাক চড়ই বসে না। খুব লাভ হয়েছে মশাই, বললেন তুলসীবাবু, চড়ইগুলো যেখানে-সেখানে বাসা করে উৎপাত করত। কাকে রান্নাঘর থেকে এটা-সেটা সরিয়ে নিত। আজকাল ওসব বন্ধ।
সত্যি বলছেন?-প্রদ্যোতবাবু যথারীতি অবাক।
এই যে রইলেন এতক্ষণ, দেখলেন একটাও অন্য কোনও পাখি?
প্রদ্যোতবাবুর খেয়াল হল যে সত্যিই দেখেননি। কিন্তু আপনার চাকরবাকর টিকে আছে? চঞ্চবাবাজিকে বরদাস্ত করতে পারে তো?
জয়কেষ্ট খাঁচার দিকে এগোয়-টেগোয় না, বললেন তুলসীবাবু, তবে নটবর চিমটে করে মাংসের টুকরো ঢুকিয়ে দেয়। তার আপত্তি থাকলেও সে মুখে প্রকাশ করেনি। আর পাখি যদি দুষ্টুমি করেও, আমি একবারটি গিয়ে দাঁড়ালেই সে বশ মেনে যায়। ইয়ে, আপনি ছবি তুললেন কী কারণে!
প্রদ্যোতবাবু আসল কারণটা চেপে গেলেন। বললেন, কোনদিন মরেটরে যাবে, একটা স্মৃতিচিহ্ন থাকা ভাল নয় কি?
প্রদ্যোতবাবুর ছবি প্রিন্ট হয়ে এল পরদিনই। তার মধ্যে থেকে ভালটা নিয়ে দুটো এনলার্জমেন্ট করিয়ে একটা আপিসে তুলসীবাবুকে দিলেন, অন্যটা নিয়ে গিয়ে হাজির হলেন মালেন স্ট্রিটে পক্ষিবিদ রণজয় সোমের বাড়ি। সম্প্রতি দেশ পত্রিকায় সিকিমের পাখি সম্বন্ধে একটা প্রবন্ধ লিখেছেন সোম সাহেব।
কিন্তু তিনি পাখির ছবি দেখে চিনতে পারলেন না। কোথায় পাখিটা দেখা যায় জিজ্ঞেস করাতে প্রদ্যোতবাবু অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বললেন। –ছবিটা ওসাকা থেকে আমার এক বন্ধু পাঠিয়েছে। সেও নাকি পাখির নাম জানে না।