পায়ের তলায় ভিজে ভিজে ঠেকছিল বটে তুলসীবাবুর, কিন্তু সেটা অস্বাভাবিক বলে মনে হবে কেন? কলকাতা শহরের মধ্যেই এ পাড়া ও পাড়ায় তাপমাত্রার ফারাক হয়–যেমন ভবানীপুরের চেয়ে টালিগঞ্জে শীত বেশি। তা হলে বনের এক অংশ থেকে আরেক অংশে তফাত হবে না কেন? এ তো প্রকৃতির খেয়াল।
তুলসীবাবু কাঁধ থেকে ঝোলা নামিয়ে গাছের দিকে উপুড় হয়েছেন, এমন সময় প্রদ্যোতবাবুর বিস্ময়সূচক প্রশ্ন তাঁকে বাধা দিল।
ওটা আবার কী?
তুলসীবাবু দেখেছেন জিনিসটা, কিন্তু গ্রাহ্য করেননি। বললেন, কিছুর ডিমটিম হবে আর কি!
প্রদ্যোতবাবুর প্রথমে পাথর বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু একটু এগিয়ে যেতেই বুঝলেন ডিম ছাড়া আর কিছুই না। হলুদের উপর চকোলেটের ডোরা। তারই ফাঁকে ফাঁকে নীলের ছিটেফোঁটা। এত বড় ডিম কীসের হতে পারে? ময়াল সাপ-টাপ নয় তো?
ইতিমধ্যে তুলসীবাবু গাছের খানিকটা তাঁর ঝোলায় পুরে নিয়েছেন। ডাল সমেত আরও কিছু পাতা নেবার ইচ্ছে ছিল; কিন্তু সেটা হল না। ডিম বাবাজি ঠিক এই সময়ই ফুটবেন বলে মনস্থ করলেন।
খোলা চৌচির হবার শব্দটা শুনে প্রদ্যোতবাবু চমকে পিছিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর কৌতূহল সামলাতে না পেরে এগিয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, ডিম ফুটেছে, এবং শাবকের মাথা বাইরে বেরিয়ে এসেছে। সাপ নয়, কুমির নয়, কচ্ছপ নয়–পাখি।
এবার ছানার সমস্ত শরীরটা বেরিয়ে এসে দুটি শীর্ণ ঠ্যাঙে ভর করে এদিক ওদিকে চেয়ে দেখছে। আয়তন ডিমেরই অনুযায়ী; শাবক অবস্থাতেও দিব্যি একটা মুরগির সমান বড়। প্রদ্যোতবাবুর এককালে নিউ মার্কেটে পাখির সন্ধানে যাতায়াত ছিল। বাড়িতে পোষা বুলবুলি আছে, ময়না আছে। কিন্তু এত বড় ঠোঁট, এত লম্বা পা, গায়ের এমন বেগুনি রঙ আর জন্মানো মাত্র এমন সপ্রতিভ ভাব তিনি কোনও পাখির মধ্যে দেখেননি।
তুলসীবাবুর কিন্তু ছানা সম্বন্ধে মনে কোনও কৌতূহল নেই। তিনি ইতিমধ্যে গাছের আরও বেশ খানিকটা অংশ ঝোলায় পুরে ফেলেছেন।
প্রদ্যোতবাবু এদিক ওদিক চেয়ে পাখিটা সম্বন্ধে একটা মন্তব্য না করে পারলেন না।
আশ্চর্য! ছানা আছে অথচ মা নেই, বাপ নেই। অন্তত কাছাকাছির মধ্যে দেখছি না।
ঢের আশ্চর্য হয়েছেন ঝোলা কাঁধে নিয়ে বললেন তুলসীবাবু।–তিনটে বাজে, এর পর ঝপ করে সন্ধে হয়ে যাবে।
প্রদ্যোতবাবু কিছুটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পাখি থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে তুলসীবাবুর সঙ্গে হাঁটা শুরু করলেন। তাঁদের গাড়ি অপেক্ষা করছে যেখানে, সেখানে পৌঁছাতে লাগবে প্রায় আধ ঘণ্টা।
পিছন থেকে শুকনো পাতার খসখসানি শুনে প্রদ্যোতবাবুই থেমে ঘাড় ঘোরালেন।
ছানাটা পিছু নিয়েছে।
ও মশাই!
এবার তুলসীবাবুও থেমে পিছন ফিরলেন। শাবকের দৃষ্টি সটান তুলসীবাবুর দিকেই।
গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে ছানাটা তুলসীবাবুর সামনেই থামল। তারপর গলা বাড়িয়ে তার বেমানান রকম বড় ঠোঁট দিয়ে তুলসীবাবুর ধুতির কোঁচার একটা অংশে কামড়ে দিয়ে সেই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।
প্রদ্যোতবাবু কাণ্ড দেখে এতই অবাক যে তাঁর মুখ দিয়ে কথা বেরোল না। শেষটায় যখন দেখলেন যে তুলসীবাবু ছানাটাকে দুহাতে তুলে নিয়ে ঝোলায় পুরলেন, তখন আর চুপ থাকা যায় না।
কী করছেন মশাই! একটা নামগোত্রহীন ধেড়ে পাখির ছানাকে থলেতে পুরে ফেললেন?
একটা কিছু পোষার শখ ছিল অনেকদিন থেকে, আবার হাঁটতে শুরু করে বললেন তুলসীবাবু। –নেড়িকুত্তা পোষে লোকে দেখেননি? তাদের গোত্রটা কি খুব একটা জাহির করার ব্যাপার?
প্রদ্যোতবাবু দেখলেন পাখির ছানাটা তুলসীবাবুর দোলায়মান ঝোলাটা থেকে গলা বার করে মিটিমিটি এদিক ওদিক চাইছে।
.
তুলসীবাবু থাকেন মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে দোতলার একটি ফ্ল্যাটে। একা মানুষ, একটি চাকর আছে, নাম নটবর, আর জয়কেষ্ট বলে একটি রান্নার লোক। দোতলায় আরও একটি ফ্ল্যাট আছে। তাতে থাকেন নবরত্ন প্রেসের মালিক তড়িৎ সান্ন্যাল। স্যান্ন্যাল মশাইয়ের মেজাজ এমনিতেই খিটখিটে, তার উপর লোড শেডিং-এ ছাপাখানাতে বিস্তর ক্ষতি হচ্ছে বলে সব সময়ই যেন মারমুখো ভাব।
দুমাস হল তুলসীবাবু দণ্ডকারণ্য থেকে ফিরেছেন। সঙ্গে পাখির ছানাটিও এসেছে, আর আসার পর দিনই একটি তারের খাঁচা কিনে পাখিটিকে তার মধ্যে পুরে বারান্দার এক কোণে রেখে দেওয়া হয়েছে। পাখির নামকরণও হয়েছে। তুলসীবাবু ম্যাট্রিকে সংস্কৃতে লেটার পেয়েছিলেন, তাই সংস্কৃত নামের উপর তাঁর একটা দুর্বলতা আছে। নাম রেখেছিলেন বৃহচ্চঞ্চু; শেষ পর্যন্ত সেটা চঞ্চুতে এসে দাঁড়িয়েছে।
জগদলপুরে থাকতে পাখিকে ছোলা ছাতু পাঁউরুটি খাওয়াবার চেষ্টা করে তুলসীবাবু শেষে বুঝেছিলেন যে পাখিটি মাংসাশী। তার পর থেকে রোজ উচ্চিংড়ে আরশোলা ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে। তাকে। সম্প্রতি যেন তাতে পাখির খিদে মিটছিল না। খাঁচার জালের উপর দিয়ে ঘন ঘন ঠেটি চালিয়ে খড়াং খড়াং শব্দ তুলে তার ক্ষোভ জানাতে শুরু করেছিল। শেষটায় বাজার থেকে মাংস কিনে এনে খাওয়াতে শুরু করে তুলসীবাবু তার খিদে মিটিয়েছেন। এখন নিয়মিত মাংস কিনে আনে। নটবর, আর সেই মাংস খেয়েই বোধহয় পাখির আয়তন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তুলসীবাবু গোড়াতেই বুদ্ধি করে পাখির অনুপাতে খাঁচাটা বড়ই কিনেছিলেন। তাঁর মন বলছিল এ পাখির জাত বেশ জাঁদরেল। খাঁচাটা মাথায় ছিল আড়াই ফুট। কালই ভদ্রলোক লক্ষ করেছেন। যে চঞ্চু সোজা হয়ে দাঁড়ালে তার মাথা তারে ঠেকে যাচ্ছে। অথচ বয়স মাত্র দুমাস। এইবেলা চটপট একটা বড় খাঁচার ব্যবস্থা দেখতে হবে।