তুলসীবাবু উঠে গিয়ে আকাশপানে চেয়ে বললেন, কীসের কথা বলছেন।
কেন, ডবল রেনবো! অবাক হয়ে বললেন জগন্ময়বাবু। আপনি কি কালার ব্লাইন্ড নাকি মশাই?
তুলসীবাবু জায়গায় ফিরে এলেন। –এ জিনিসও কাজ ফেলে উঠে গিয়ে দেখতে হবে? একটার জায়গায় দুটো কেন, পঁচিশটা রামধনু উঠলেও তাতে আশ্চর্যের কী আছে জানি না মশাই। লোয়ার সারকুলার রোডে জোড়া গিজা আছে তো; তা হলে তো তার সামনে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে। দেখতে হয়।
অবাক হবার ক্ষমতাটা সকলের সমান থাকে না ঠিকই, কিন্তু তুলসীবাবুর মধ্যে আদৌ আছে কি না সে বিষয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন। আশ্চর্য বিশেষণটা তিনি কেবল একটি ব্যাপারেই প্রয়োগ করেন; সেটা হল মনসুরের দোকানের মোগলাই পরোটা আর কাবাব। অবিশ্যি সে খবরটা তাঁর সহকর্মী ও বন্ধু প্রদ্যোতবাবু ছাড়া আর কেউ জানেন না।
এমনিধারা লোক বলেই হয়তো দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে কবিরাজি গাছগাছড়া খুঁজতে গিয়ে একটা অতিকায় ডিমের সন্ধান পেয়েও তুলসীবাবু অবাক হলেন না।
কবিরাজিটা তুলসীবাবু ধরেছেন বছর পনেরো হল। বাবা ত্রৈলোক্য সেন ছিলেন নামকরা কবিরাজ। তুলসীবাবুর আসল রোজগার আরবাথনট কোম্পানির মধ্যপদস্থ কর্মচারী হিসেবে। কিন্তু পৈতৃক পেশাটাকে তিনি সম্পূর্ণ এড়াতে পারেননি। সম্প্রতি ঝোঁকটা একটু বেড়েছে, কারণ কলকাতার দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর ওষুধে আরাম পাওয়ার ফলে তিনি কিঞ্চিৎ খ্যাতি অর্জন করেছেন।
এবারে দণ্ডকারণ্যে আসার পিছনেও ছিল কবিরাজি। জগদলপুরের মাইল ত্রিশেক উত্তরে এক পাহাড়ের গুহায় এক সাধু বাস করেন। তাঁর সন্ধানে নাকি আশ্চর্য ভাল কবিরাজি ওষুধ আছে এ খবর তুলসীবাবু কাগজে পড়েছেন। বিশেষত রক্তের চাপ কমানোর জন্য একটা ওষুধ আছে যেটা নাকি সর্পগন্ধার চেয়েও ভাল। তুলসীবাবু মাঝে মাঝে ব্লাডপ্রেসারে ভোগেন। সর্পগন্ধায় বিশেষ কাজ দেয়নি, আর অ্যালোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি তিনি মানেন না।
এই অভিযানে তুলসীবাবুর সঙ্গে আছেন প্রদ্যোতবাবু। তুলসীবাবুর বিস্ময়বোধের অভাবে প্রদ্যোতবাবুর যে ধৈর্যচ্যুতি হয় না তা নয়। একদিন তো তিনি বলেই বসলেন, মশাই, কল্পনাশক্তি থাকলে মানুষ কোনও কোনও ব্যাপারে অবাক না হয়ে পারে না। আপনি চোখের সামনে ভূত দেখলেও বলবেন–এতে আর আশ্চর্যের কী আছে। তুলসীবাবু শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলেন, অবাক না হলে অবাক হবার ভান করাটা আমার কাছে আদিখ্যেতা বলে মনে হয়। ওটা আমি পছন্দ করি না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও দুজনের পরস্পরের প্রতি একটা টান ছিল।
জগদলপুরের একটা হোটেলে আগে থেকে ঘর ঠিক করে নবমীর দিন গিয়ে হাজির হলেন দুই বন্ধু। কলকাতা থেকে মাদ্রাজ মেলে বিজয়নগরম, সেখান থেকে আবার ট্রেন বদলে জগদলপুর। মাদ্রাজ মেলের থ্রি-টায়ার কামরায় দুটি বিদেশি ছোঁকরা উঠেছিল, তারা নাকি সুইডেনের অধিবাসী। তাদের মধ্যে একজন এত ঢ্যাঙা যে তার মাথা কামরার সিলিং-এ ঠেকে যায়। প্রদ্যোতবাবু হাইট জিজ্ঞেস করাতে ছোঁকরাটি বলল, টু মিটারস অ্যান্ড সিক্স সেন্টিমিটারস। অর্থাৎ প্রায় সাত ফুট। প্রদ্যোতবাবু বাকি পথ এই তরুণ দানবটির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারেননি। তুলসীবাবু কিন্তু অবাক হননি। তাঁর মতে ওদের ডায়েটে এমন হওয়াটা নাকি কিছুই আশ্চর্যের না।
প্রায় মাইল খানেক পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে শ পাঁচেক ফুট পাহাড় উঠে তবে ধুমাইবাবার গুহায় পৌঁছতে হয়। বিশাল গুহা, দশ পা ভিতরে গেলেই দুর্ভেদ্য অন্ধকার। সেটা যে শুধু ধুমাইবাবার ধুনুচির ধোঁয়ার জন্য তা নয়; এমনিতেই গুহায় আলো প্রবেশ করে না বললেই চলে। প্রদ্যোতবাবু অপার বিস্ময়ে দেখছিলেন গুহার সর্বত্র স্ট্যাল্যাকটাইট-স্ট্যাল্যাগমাইটের ছড়াছড়ি। তুলসীবাবুর দৃষ্টি সেদিকে নেই, কারণ তাঁর লক্ষ্য কবিরাজি ওষুধ। ধুমাইবাবা যে গাছের কথা বললেন তার নাম চক্রপর্ণ। এ নাম তুলসীবাবু কোনওদিন শোনেননি বা পড়েননি। গাছ নয়, গাছড়া–আর সে গাছড়া নাকি কেবল দণ্ডকারণ্যের একটি বিশেষ জায়গায় ছাড়া আর কোথাও নেই, আর সেই জায়গাটারও একটা বিশেষত্ব আছে সেটা তুলসীবাবু নাকি গেলেই বুঝতে পারবেন। কী বিশেষত্ব সেটা আর বাবাজি ভাঙলেন না। তবে কোন পথে কী ভাবে সেখানে পৌঁছানো যায় সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
গুহা থেকে বেরিয়েই গাছের সন্ধানে রওনা দিলেন তুলসীবাবু। প্রদ্যোতবাবুর সঙ্গ দিতে কোনও আপত্তি নেই; তিনি নিজে এককালে শিকারের ধান্দায় অনেক পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরেছেন। বন্যপশু সংরক্ষণের হিড়িকের পর থেকে বাধ্য হয়ে শিকার ছাড়লেও জঙ্গলের মোহ কাটাতে পারেননি।
সাধুবাবার নির্দেশ অব্যর্থ। আধঘণ্টা অনুসন্ধানের পরেই একটা নালা পড়ল আর নালা পেরিয়ে মিনিট তিনেকের মধ্যেই যেমন বর্ণনা ঠিক তেমনি একটা বাজ পড়ে ঝলসে যাওয়া নিম গাছের গুঁড়ি থেকে সাত দক্ষিণে চক্ৰপর্ণের সন্ধান মিলল। কোমর অবধি উঁচু গাছ, আধুলির সাইজের গোল। পাতাগুলির মাঝখানে একটি করে গোলাপি চাকতি।
এ কোথায় এলাম মশাই? প্রদ্যোতবাবু মন্তব্য করলেন।
কেন, কী হল?
এখানের অধিকাংশ গাছই দেখছি অচেনা, বললেন প্রদ্যোতবাবু।–আর জায়গাটা কীরকম স্যাঁতসেঁতে দেখেছেন? বনের বাকি অংশের সঙ্গে যেন কোনও মিলই নেই।