আপাতত অনেক বছর আমাদের এমনি করে মাঝে মাঝে বাড়ি পালিয়ে শহরের এই সব প্রান্তসীমায় এমনি সব অদ্ভুত সময়ে চলে আসতে হবে, কারণ চলে না এসে পারব না। একটা চিঠি লেখা কি দূর থেকে দেখে একটু মুচকি হাসার পর্যায় আমরা অনেক আগেই পেরিয়ে
এসেছি। আমাদের মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়েই গেছে, যেদিন একটা চাকরি পাব, ঠিক তার একমাস পরেই বিয়ে করব। কোনও ঘটা-টটা নয়। নিতান্তই সাদামাটা নিম্ন মধ্যবিত্তের বিয়ে। সানাই নয়, ভোজ নয়, তবে হ্যাঁ, হিন্দুমতে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে অগ্নি সাক্ষী করে। বিয়ে। কল্পনার দীর্ঘ শরীর বেনারসীর আবরণে সেদিন কেমন দেখাবে যেদিন আমরা গাঁটছড়া বেঁধে সাতপাক ঘুরব। কল্পনার দিকে আড়চোখে চেয়ে আমার মনে হল, এখন যেমন দেখছি, এতটা স্নিগ্ধ নয় আর একটুদীপ্ত, কারণ উপোস আর হোমের আগুনে সেদিন তার মধ্যে একটা অন্য দীপ্তি আসবে! দৃশ্যটা চিন্তা করে তখনই একটা ইচ্ছে হল। ডান হাতটা তখন কল্পনার। কোমরের উপর একফালি অনাবৃত মসৃণ জায়গার উপর খেলা করছিল। আমি তাকে আর একটু কাছে টেনে এনে তার গালে একটা চুমু খেলাম। বৃষ্টি ভরা সেই ফাঁকা মাঠে ঝাঁকড়া গাছের তলায় ভেজা ভেজা কপোত-কপোতীর মতো আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে। জলের ঝাপটা আর পশ্চিমের হু হু হাওয়ায় আমাদের শীত করছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা একটু আশ্রয় খুঁজছিলাম মনে মনে। যতটা সম্ভব ঘনিষ্ঠ হয়ে একে অন্যকে বৃষ্টির ছাঁট থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলুম। যদিও ব্যাপারটা ছিল খুব দুঃসাধ্য।
ইতিমধ্যে মনে হল বৃষ্টিটা যেন হঠাৎ একটু কমে গেল। যেন কোনও এক অদৃশ্য প্রান্তে জলের সুতো ছিঁড়ে গিয়ে একটু ফাঁক পড়ে গেল। এই সুযোগে ছুট ছুট করে আমরা দুজনে প্রিনস অফ ওয়েলসের জন্যে কোনও এক সময়ে তৈরি মেমোরিয়ালের তলায় আশ্রয় নিলাম। কল্পনার। শাড়ির নীচের দিকটা ভিজে সপসপে হয়ে গিয়েছিল। ছুটতে বেশ অসুবিধে হচ্ছিল। পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছিল। শাড়িতে, সায়াতে সপ সপ শব্দ। মনে আছে কল্পনা খুব হাসছিল। তার চটি পা থেকে। খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মেয়েরা যে কেন বৃষ্টিতে ভিজে এত আনন্দ পায়!
গোটাকতক বিশাল স্তম্ভের উপর একটা ছাদ। চারদিক ফাঁকা, মাথাটাই কেবল আবরণে ঢাকা। ভিতরে কয়েকটা সবার-আসন পাতা। জায়গাটাকে আগে কখনও এত ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি। এ জায়গাটা প্রায়ই বিশেষ একধরনের লোকের দখলে থাকে। আজ আর এত ভাবলে চলে না। কে ভিজবে গাছতলায়। আকাশের অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। চারদিক ঝাপসা যেন মধ্যাহ্ন আঁধার। আজ অবশ্য বেশি লোক ছিল না। বেশি বলি কেন আদৌ কোনও লোক ছিল না। আমি আর কল্পনা। একটা কুকুর তার একরাশ ছানাপোনা। ঢুকতে না ঢুকতেই আবার বৃষ্টি এল। এবার আরও জোরে। সঙ্গে এলোমেলো প্রচণ্ড হাওয়া।
শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে কল্পনা বলল, যাক আর ভয় নেই, এবার শালা কত বৃষ্টি আসবি আয়।
কল্পনা খুব খুশি থাকলে মাঝে মাঝে শালা বলে।
তুমি তো একদম ভিজে গেছ। এক কাজ করো না, এখানে তো কেউ কোথাও নেই, শাড়িটা খুলে এসো আমি একটা দিক ধরি, তুমি একটা দিক ধরো লম্বা করে। যা হাওয়া এক্ষুনি শুকিয়ে যাবে।
যাঃ কী যে বলো তুমি, একেবারে ছেলেমানুষ। চারদিক উদোম খোলা। আমি এখানে সায়া আর ব্লাউজ পরে শাড়ি খুলে শুকোব। হিন্দি ছবি পেয়েছ না!
হিন্দি ছবিরই তো বিষয়বস্তু আমাদের এই দুজনের বেরোনো, এই স্ট্যান্ডে ঘুরে বেড়ানো। এখন এই শাড়ির দৃশ্যটা জুড়ে এসো ডুয়েট গাই—হাওয়া মে উড়তা যায় মেরে লাল দুপাট্টা মলমল।
উঃ কত দিনকার গান। তোমার মনে আছে। নার্গিস, রাজকাপুর। কথাটি বলেই কল্পনা হাত দুটো মাথার উপর তুলে একটা নাচের ভঙ্গি করল। দৃশ্যটা এত দুর্লভ মনে হল মুহূর্তটাকে মুক্তো করে হাতে রাখি। পকেটে তোয়ালে রুমাল ছিল তাই দিয়ে কল্পনার ঘাড়ের গলার বুকের কাছের জল মুছিয়ে দিলাম। মেয়েরা শুধু সেবা করে না, মাঝে মাঝে একটু সেবা পেতে চায়। সেই। সময়টা ওরা কীরকম আদুরে বেড়ালের মতো হয়ে যায়, কেবল ঘর্ঘর শব্দটাই করে না, বাকি সব এক।
চলো না বসি ওই খালি বেঞ্চিটায়—ঝেড়েঝুড়ে।
চলো।
গঙ্গার দিকে মুখ করে দুজনে বসলাম পাশাপাশি। বেশি দূর দেখা যাচ্ছে না, ঝাপসা হয়ে আছে। ওপার মাঝে মাঝে পরিষ্কার হচ্ছে, আবার বৃষ্টির আঁচলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। কল্পনার ঘাড়ের কাছে গালটা রাখলুম, জলে ভিজে হাওয়ার ঝাপটায় কী সুন্দর ঠান্ডা হয়েছে, যেন পাথরের বাঁধানো বেদি। ঠিক বুকের কাছ থেকে একটা মৃদু, দেহের উত্তাপ মেশানো সুন্দর গন্ধ উঠছে। এই বয়েসের মেয়েদের কারুর কারুর নাভির কাছে মৃগনাভি থাকে না কি?
শব্দটা প্রথমে কল্পনারই কানে এল! বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে সে ঠিকই শুনেছে মৃদু হলেও বোঝা যায় স্পষ্ট কে যেন ফিশফিশ করে বলছে—জল জল।
কে বলো তো। কে যেন জল চাইছে। কোথাও কাউকে দেখছি না।
চলো উঠে দেখি। কে জল চাইছে।
ভিতরে কোথাও কেউ নেই। আওয়াজটা আসছে পশ্চিম দিক থেকে। কল্পনাই প্রথম দেখল। লোকটি মধ্যবয়সি। চেহারা বেশ ভালোই। একটা হাত বুকের কাছে। নিজের গায়ের জামাটা সেই হাতে জড়ানো, রক্তে লাল হয়ে গেছে। আঘাতটা ঠিক কোথায়—মাথায় না বুকে বোঝা গেল না। মাথাটা একটা উঁচু ধাপের উপর। চোখ দুটো ফুলে গেছে, ভিতরের সাদা অংশ অল্প বেরিয়ে আছে, ঠোঁট দুটো মাঝে মাঝে নাড়ছে—জল, জল।