- বইয়ের নামঃ ২৫টি সেরা ভূত
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আয়নার মানুষ
শক্তপোক্ত মানুষ হলে কী হয়, গদাধর আসলে বড়ো হা-হয়রান লোক। তিন বিঘে পৈতৃক জমি চাষ করে তার কোনোক্রমে চলে, বাস্তুজমি মোটে বিঘেটাক। তাতে তার বউ শাকপাতা, লাউ-কুমড়ো ফলায়। দুঃখেকষ্টে চলে যাচ্ছিল কোনোক্রমে। কিন্তু পরানবাবুর নজরে পড়েই তার সর্বনাশ।
পরানবাবু ভারি ভুলো মনের মানুষ। জামা পরেন তো ধুতি পরতে ভুলে যান, হাটে পাঠালে মাঠে গিয়ে বসে থাকেন, জ্যাঠামশাইকে ছোটোকাকা ডেকে বিপদে পড়েন। লোকে আদর করে বলে পাগলু পরান। তবে পরানবাবু মাঝে-মাঝে অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলে ফেলেন। একদিন গুরুপদকে বললেন, ওরে সাধুচরণ, চারদিকে চোর। খুব চোখ রাখিস বাপু।
তা সত্যিই সেই রাতে গুরুপদর বাড়িতে চোর ঢুকে বাসনপত্র নিয়ে গেল।
আর একদিন লক্ষ্মীকান্তকে বলে বসলেন, রজনীকান্ত যে! তা বিষ্ণুপুরে বেশ ভালো আছো তো ভায়া!
লক্ষ্মীকান্তর বিষ্ণুপুরে যাওয়ার কথাই নয়, যায়ওনি কোনোদিন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এর কিছুদিনের মধ্যেই বিষ্ণুপুরে একটা মাস্টারির চাকরি হয়ে লক্ষ্মীকান্ত চলে গেল। যাওয়ার আগে সবাইকে বলে গেল, পরানবাবু ছদ্মবেশী মহাপুরুষ।
অনেকেরই সে কথা বিশ্বাস হল। গাঁয়ের মাতব্বর শশিভূষণ একবার পরানবাবুর খোঁড়া কুকুর ভুলুকে প্রকাশ্যে ল্যাংড়া বলায় খুব রেগে গিয়ে পরানবাবু বলেছিলেন, দ্যাখো নিশিবাবু, সব দিন সমান যায় না। ভুলু যদি ল্যাংড়া হয় তো তুমিও ল্যাংড়া।
অবাক কান্ড হল, দিনসাতেক বাদে শশীবাবু গোয়ালঘরের চালে লাউ কাটতে উঠে একটা সবুজ সাপ দেখে আঁতকে উঠে চাল থেকে পড়ে বাঁ-পায়ের গোড়ালি ভাঙেন। মাসটাক তাঁকে নেংচে-নেংচে চলতে হয়েছিল।
তা সেই পরানবাবু একদিন গদাধরকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, তুমি যেন কে হে! মুখখানা চেনা-চেনা ঠেকছে!
আজ্ঞে, আমি গদাধর লস্কর। চেনা না-ঠেকে উপায় কী বলুন! এই গাঁয়েই জন্মকর্ম, ছেলেবেলা থেকেই দেখে আসছেন। আপনার বাড়ির বাগান পরিষ্কার করতে কতবার গেছি, মনে নেই? পথেঘাটে হরদম দেখাও হচ্ছে।
খুবই অবাক হয়ে পরানবাবু বললেন, বটে! তা তুমি করো কী হে বাপু?
আজ্ঞে, এই একটু চাষবাস আছে। তিন বিঘে জমিতে সামান্যই হয়।
নাক কুঁচকে পরানবাবু বললেন, এঃ, মোটে তিন বিঘে! ছ্যা: ছ্যা:, ও বেচে দাও।
বলেন কী বাবু! বেচলে খাব কী?
ভারি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুঁচকে পরানবাবু বললেন, খাবে? কত খাবে হে হলধর? খেয়ে শেষ করতে পারবে ভেবেছ! হু:, খাবে!
কথাটা অনেকের কানে গেল। গাঁয়ের মুরুব্বিরা বললেন, ওরে গদাধর, পরান হল বাকসিদ্ধাই। যা বলে, তাই ফলে! ভালোয় ভালোয় জমিজমা বেচে দে বাবা।
শুনে ভারি দমে গেল গদাধর। শুধু একটা খ্যাপাটে লোকের কথা শুনে এরকম কাজ করাটা কি ঠিক হবে? জমি সামান্য হোক, বছর বছর সামান্য যে ফসলটুকু দেয়, জমি বেচলে যে তাও জুটবে না!
তার বউ ময়না ভারি ধর্মভীরু মেয়ে। ঘরে লক্ষ্মীর পট বসিয়েছে, ষষ্ঠী, শিবরাত্রি ব্রত-উপবাস সব করে। সেও শুনে বলল, পরানবাবু কিন্তু সোজা লোক নয়। যা বলে তাই হয়।
এসব শুনে ভারি ধন্দে পড়ে গেল গদাধর। তার মাথায় যথেষ্ট বুদ্ধি নেই, দূরদর্শিতা নেই, জমি চাষ করা ছাড়া আর কোনো কাজও সে পারে না। একটা পাগল লোকের কথায় ঝুঁকি নেওয়াটা ভারি আহাম্মকি হয়ে যাবে নাকি?
কিন্তু গাঁয়ের পাঁচজনের তাড়নায় আর বউ ময়নার তাগাদায় অবশেষে সে জমি বেচে এক পোঁটলা টাকা পেল। তারপর মাথায় হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। এই কটা টাকা কয়েক মাসের মধ্যেই ফুরোবে। তারপর কী যে হবে! ভেবে বুক শুকিয়ে গেল তার।
বিপদ কখনও একা আসে না। জমিবেচা কয়েক হাজার টাকা বালিশের নীচে রেখে রাতে ঘুমিয়ে ছিল গদাধর। খাঁটিয়ে পিটিয়ে মানুষ, ঘুমটা বটে একটু গাঢ়ই হয় তার। কিচ্ছু টের পায়নি। সকালে উঠে বালিশ উলটে দেখল, তলাটা ফাঁকা। দরজার খিলও ভাঙা।
ফের মাথায় হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে পড়ল সে।
থানা-পুলিশ করে কোনো লাভ নেই। থানা পাঁচ মাইল দূর। তার মতো চাষাভুসো থানায় এত্তেলা দিলে কেউ পুঁছবেও না। তার কাছে টাকাটা অনেক বটে, কিন্তু পুলিশ শুনে নাক সিঁটকোবে।
ময়নারও মুখ শুকিয়ে গেছে। সে মোলায়েম গলায় বলল, ভেঙে পড়ার কী আছে! আমার লক্ষ্মীর ঘট ভেঙে দু-দিন তো চলুক।
নুন-ভাত, শাক-ভাত খেয়ে কটা দিন কাটল বটে, কিন্তু তারপর আর চলছে না।
ময়না বলল, চলো, অন্য গাঁয়ে যাই। দরকার হলে তুমি মুনিষ খাটবে। আমি লোকের বাড়িতে কাজ করব। এ গাঁয়ে ওসব করলে তো বদনাম হবে।
বাপ-পিতেমোর গাঁ ছেড়ে যাব?
তবে কি মরবে নাকি?
কাহিল গলায় গদাধর বলল, তাই চলো।
পাছে কেউ দেখতে পায়, সেই ভয়ে সন্ধের পর দুটি পোঁটলা নিয়ে দুজন গাঁ ছেড়ে রওনা হল।
গাঁ ছেড়ে বেরোতে-না-বেরোতেই প্রচন্ড কালবোশেখির ঝড় ধেয়ে এল। আকাশে ঘন বিদ্যুতের চমক, বাজ পড়ার পিলে চমকানো আওয়াজ আর তুমুল হাওয়া। দুজনে হাত ধরাধরি করে পড়ি কি মরি ছুটতে লাগল। অন্ধকারে পথের মোটে হদিশই পেল না। শুধু টের পাচ্ছিল, হাওয়া তাদের প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলেছে। ঝোঁপ, জঙ্গল, মাঠঘাট পেরিয়ে তারা দিগবিদিকশূন্য হয়ে ছুটছে। বৃষ্টির তোড়ে তাদের জামাকাপড়, পোঁটলাপুঁটলি ভিজে জবজব করছে। দমসম হয়ে যাচ্ছে তারা। বাতাসের শব্দে আর বাজের আওয়াজে কেউ কারও সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ পাচ্ছে না। হাঁ করলেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে বাতাস।