- বইয়ের নামঃ বটুকবুড়োর চশমা
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. কর্তাবাবু, একটা কথা ছিল
বটুকবুড়োর চশমা
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
“কর্তাবাবু, একটা কথা ছিল।”
“কী কথা?”
“বলছিলাম কী, এই লম্বা লোকেরা মানুষ কেমন হয়?”
“এ আবার কেমন ধারা কথা, লম্বা লোকেরা আবার আলাদা করে ভাল বা খারাপ হতে যাবে কেন?”
“একটা ধাঁধায় পড়েই জানতে চাইছি আর কী!”
“তা লম্বা লোক নিয়ে তোর সমস্যা হচ্ছে কেন? এই তো আমিই তো একজন লম্বা লোক। আমার তিন ছেলে লম্বা, পুরুতমশাই ব্রজ ভটচাজ লম্বা, সাত্যকি বাঁড়ুজ্যে লম্বা, দারোগা পরেশ ঘোষ লম্বা, নব মিত্তির লম্বা, তা আমরা কি খারাপ লোক?”
বটু ওরফে বটকেষ্ট গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “আপনারা তার কাছে নস্যি। আপনাদের মাথা তার কোমরের কাছ বরাবর হবে বড়জোর। তার বেশি নয়।”
“বটে! তা এ তল্লাটে তেমন লম্বা কে আছে? হরিপুরে বৃন্দাবন পাল অবশ্য বেজায় লম্বা, আর নবগঞ্জের বিষ্ণু পাঠকও বটে বিশাল ঢ্যাঙা…!”
“আজ্ঞে, তাঁরাও তার বুক পর্যন্ত হবেন কি না সন্দেহ।”
“অ, কিন্তু লম্বা লোক তুই পেলি কোথায়? আর তাকে নিয়ে তোর সমস্যাই বা হচ্ছে কেন?”
বটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে কাছেপিঠেই আছে। বাড়ির পিছনের ফটকে একটু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল কিনা!”
“দাঁড়িয়ে ছিল মানে? ফটকে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? হয় ভিতরে আসবে, না হয় বিদেয় হবে। লোকটা কে, কী চায় জিজ্ঞেস করেছিস?”
“আজ্ঞে, ঠিক সাহস হয়নি।”
“কেন, লোকটা কিষণ্ডাগুন্ডা গোছের?”
“বলা মুশকিল।”
“পোশাক আশাক কেমন?”
“আজ্ঞে, পোশাক তেমন খারাপ কিছুও নয়। পরনে বোধহয় একটা পাতলুনের মতো দেখলুম, গায়ে একটা জামাও মনে হয় ছিল, গলায় একটা মাফলার জড়ানো ছিল কি না ঠিক মনে পড়ছে না, গায়ে একটা কোট থাকলেও থাকতে পারে।”
“বুঝলাম। এখন দয়া করে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো লোকটা কী চায়, কোথা থেকে এসেছে, এ বাড়ির আত্মীয়-কুটুম কি না, আর যদি ভিখিরি হয় তো সোজা বলে দিয়ো, কানাখোঁড়া ছাড়া আমরা কাউকে ভিক্ষে দিই না।”
“আজ্ঞে, আমারও সেই সব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু লোকটা এমন ভেকুড়ি কাটল যে, ঠিক সাহস হল না।”
“ভেচকুড়ি! সেটা আবার কী?”
“আজ্ঞে, ভেচকুড়ি খুব ভয়ের জিনিস। বড় বড় চোখ করে মুখটা ভেংচি কেটে এমন একখানা ভাব করা যাতে লোকে ভড়কে যায়।”
“তুই তো ভড়কেই আছিস। পাগল দেখলে ভড়কাস, মাতাল দেখলে ভড়কাস, পুলিশ দেখলে ভড়কাস। তোর হল রজ্জুতে সর্পভ্রম!”
“আজ্ঞে কর্তাবাবু, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে হয়তো। তবু বলি, ভয়ভীতি থাকা কিন্তু ভাল। ধরুন সর্পে রঞ্জুম হওয়াই কি তা হলে ঠিক হত?”
“দ্যাখ, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। তা তুই যদি এতই ভেড়ুয়া যে একটা লোক খানিকটা লম্বা বলে তার কাছেই ঘেঁষতে পারলি না, তখন না হয় নব, হরেন আর কানুকে জুটিয়ে দলবেঁধে গিয়ে লোকটার উপর চড়াও হতিস।”
“আজ্ঞে, নবর কথা আর কবেন না। সে সেই সাতসকালে গিন্নিমার কাছ থেকে বাজারের পয়সা নিয়ে বেরিয়েছে। এখন দেখুন গে, বাজার ফেলে কালীস্যাকরার সঙ্গে দাবা খেলায় মশগুল হয়ে আছে। রোজ সকালে এক পাট্টি দাবা না খেললেই তার নয়।”
“বলিস কী, নব আবার দাবাড়ুও নাকি? তাজ্জব ব্যাপার তো!”
“তবে আর বলছি কী? আর হরেন? তার কথা আর কী বলব কর্তাবাবু। যত কম বলা যায় ততই ভাল। বুড়োকর্তার জন্য রোজ ডাব পাড়তে নারকোল গাছে উঠে কী করে জানেন? নারকোল গাছের সঙ্গে কোমরের গামছাখানা কষে বেঁধে নিয়ে আরামসে ঘুম লাগায়।”
“ওরে বাবা! নারকোল গাছের উপর উঠে ঘুমোয়? কী সব্বোনেশে কথা!”
“গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালে তার নাকের ডাকও শুনতে পাবেন।”
“বটে! একদিন পড়ে মরবে যে!”
“আর কানুর কথা শুনতে চান? না শুনলেই ভাল হত।”
“কেন রে? সে আবার কী করল? দিব্যি তো ভালমানুষের মতো চেহারা, চোখ তুলে কথা কয় না।”
“কর্তাবাবু, আপনার মেলা গুণ আছে বটে, আর সেকথা আমরা বলাবলিও করি। এই যেমন আপনার দয়ার শরীর, আপনার বেজায় বুকের পাটা, সুজনবাবুর ছেলের বিয়েতে আপনি বাহান্নটা রসগোল্লা খেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি মানুষ চেনেন, একথা আপনার বন্ধু কেন, শ্যুরেও বলবে না।”
“এ তো বড় চিন্তায় ফেলে দিলি! কানু করেছেটা কী?”
“গত কদিন ধরে সকালের দিকে অঘোরখুড়ো যে তাঁর চশমাটা খুঁজে পাচ্ছেন না, সেকথা কি আপনি জানেন? না, জানার কথাও নয়। রোজই সকালে চশমা হারানো নিয়ে খুডোমশাই চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় করেন। কিন্তু একটু বেলার দিকে চশমাজোড়া ঠিকই আবার খুড়োমশাইয়ের টেবিলেই পাওয়া যায়। ঠিক কিনা কর্তাবাবু, বলুন?”
“হু। ঠিকই বলছিস বলেই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু চশমার সঙ্গে কানুর কী সম্পর্ক?”
“গভীর সম্পর্ক কর্তাবাবু, গভীর সম্পর্ক। আর শুধু খুড়োমশাইয়ের চশমাজোড়াই তো নয়, ব্ৰজবিহারী ঠাকুরমশাইয়ের নামাবলিখানা আর বিজয়বাবুর ল্যাবরেটরির আতশ কাঁচখানাও সেই সঙ্গে গায়েব হয়ে যায়, একটু বেলার দিকে অবশ্য ফিরেও আসে।”
“দ্যাখ বটু, তোর কথা বুঝবার চেয়ে চিনেম্যানের কথা বোঝা বরং সহজ।”
“কথায় একটু মারপ্যাঁচ না থাকলে ঠিক জুত হয় না কিনা। তবে আসল কথাটা হল, কানু সকালে এ বাড়ির চারটে দুধেল গাইকে নিয়ে গোচারণের মাঠে চরাতে যায়, জানেন তো?”