- বইয়ের নামঃ বটুকবুড়োর চশমা
- লেখকের নামঃ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ আনন্দ পাবলিশার্স (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
১. কর্তাবাবু, একটা কথা ছিল
বটুকবুড়োর চশমা
অদ্ভুতুড়ে সিরিজ
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
“কর্তাবাবু, একটা কথা ছিল।”
“কী কথা?”
“বলছিলাম কী, এই লম্বা লোকেরা মানুষ কেমন হয়?”
“এ আবার কেমন ধারা কথা, লম্বা লোকেরা আবার আলাদা করে ভাল বা খারাপ হতে যাবে কেন?”
“একটা ধাঁধায় পড়েই জানতে চাইছি আর কী!”
“তা লম্বা লোক নিয়ে তোর সমস্যা হচ্ছে কেন? এই তো আমিই তো একজন লম্বা লোক। আমার তিন ছেলে লম্বা, পুরুতমশাই ব্রজ ভটচাজ লম্বা, সাত্যকি বাঁড়ুজ্যে লম্বা, দারোগা পরেশ ঘোষ লম্বা, নব মিত্তির লম্বা, তা আমরা কি খারাপ লোক?”
বটু ওরফে বটকেষ্ট গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “আপনারা তার কাছে নস্যি। আপনাদের মাথা তার কোমরের কাছ বরাবর হবে বড়জোর। তার বেশি নয়।”
“বটে! তা এ তল্লাটে তেমন লম্বা কে আছে? হরিপুরে বৃন্দাবন পাল অবশ্য বেজায় লম্বা, আর নবগঞ্জের বিষ্ণু পাঠকও বটে বিশাল ঢ্যাঙা…!”
“আজ্ঞে, তাঁরাও তার বুক পর্যন্ত হবেন কি না সন্দেহ।”
“অ, কিন্তু লম্বা লোক তুই পেলি কোথায়? আর তাকে নিয়ে তোর সমস্যাই বা হচ্ছে কেন?”
বটু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সে কাছেপিঠেই আছে। বাড়ির পিছনের ফটকে একটু আগেই দাঁড়িয়ে ছিল কিনা!”
“দাঁড়িয়ে ছিল মানে? ফটকে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? হয় ভিতরে আসবে, না হয় বিদেয় হবে। লোকটা কে, কী চায় জিজ্ঞেস করেছিস?”
“আজ্ঞে, ঠিক সাহস হয়নি।”
“কেন, লোকটা কিষণ্ডাগুন্ডা গোছের?”
“বলা মুশকিল।”
“পোশাক আশাক কেমন?”
“আজ্ঞে, পোশাক তেমন খারাপ কিছুও নয়। পরনে বোধহয় একটা পাতলুনের মতো দেখলুম, গায়ে একটা জামাও মনে হয় ছিল, গলায় একটা মাফলার জড়ানো ছিল কি না ঠিক মনে পড়ছে না, গায়ে একটা কোট থাকলেও থাকতে পারে।”
“বুঝলাম। এখন দয়া করে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো লোকটা কী চায়, কোথা থেকে এসেছে, এ বাড়ির আত্মীয়-কুটুম কি না, আর যদি ভিখিরি হয় তো সোজা বলে দিয়ো, কানাখোঁড়া ছাড়া আমরা কাউকে ভিক্ষে দিই না।”
“আজ্ঞে, আমারও সেই সব জানতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু লোকটা এমন ভেকুড়ি কাটল যে, ঠিক সাহস হল না।”
“ভেচকুড়ি! সেটা আবার কী?”
“আজ্ঞে, ভেচকুড়ি খুব ভয়ের জিনিস। বড় বড় চোখ করে মুখটা ভেংচি কেটে এমন একখানা ভাব করা যাতে লোকে ভড়কে যায়।”
“তুই তো ভড়কেই আছিস। পাগল দেখলে ভড়কাস, মাতাল দেখলে ভড়কাস, পুলিশ দেখলে ভড়কাস। তোর হল রজ্জুতে সর্পভ্রম!”
“আজ্ঞে কর্তাবাবু, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাবে হয়তো। তবু বলি, ভয়ভীতি থাকা কিন্তু ভাল। ধরুন সর্পে রঞ্জুম হওয়াই কি তা হলে ঠিক হত?”
“দ্যাখ, দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। তা তুই যদি এতই ভেড়ুয়া যে একটা লোক খানিকটা লম্বা বলে তার কাছেই ঘেঁষতে পারলি না, তখন না হয় নব, হরেন আর কানুকে জুটিয়ে দলবেঁধে গিয়ে লোকটার উপর চড়াও হতিস।”
“আজ্ঞে, নবর কথা আর কবেন না। সে সেই সাতসকালে গিন্নিমার কাছ থেকে বাজারের পয়সা নিয়ে বেরিয়েছে। এখন দেখুন গে, বাজার ফেলে কালীস্যাকরার সঙ্গে দাবা খেলায় মশগুল হয়ে আছে। রোজ সকালে এক পাট্টি দাবা না খেললেই তার নয়।”
“বলিস কী, নব আবার দাবাড়ুও নাকি? তাজ্জব ব্যাপার তো!”
“তবে আর বলছি কী? আর হরেন? তার কথা আর কী বলব কর্তাবাবু। যত কম বলা যায় ততই ভাল। বুড়োকর্তার জন্য রোজ ডাব পাড়তে নারকোল গাছে উঠে কী করে জানেন? নারকোল গাছের সঙ্গে কোমরের গামছাখানা কষে বেঁধে নিয়ে আরামসে ঘুম লাগায়।”
“ওরে বাবা! নারকোল গাছের উপর উঠে ঘুমোয়? কী সব্বোনেশে কথা!”
“গাছের নীচে গিয়ে দাঁড়ালে তার নাকের ডাকও শুনতে পাবেন।”
“বটে! একদিন পড়ে মরবে যে!”
“আর কানুর কথা শুনতে চান? না শুনলেই ভাল হত।”
“কেন রে? সে আবার কী করল? দিব্যি তো ভালমানুষের মতো চেহারা, চোখ তুলে কথা কয় না।”
“কর্তাবাবু, আপনার মেলা গুণ আছে বটে, আর সেকথা আমরা বলাবলিও করি। এই যেমন আপনার দয়ার শরীর, আপনার বেজায় বুকের পাটা, সুজনবাবুর ছেলের বিয়েতে আপনি বাহান্নটা রসগোল্লা খেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি মানুষ চেনেন, একথা আপনার বন্ধু কেন, শ্যুরেও বলবে না।”
“এ তো বড় চিন্তায় ফেলে দিলি! কানু করেছেটা কী?”
“গত কদিন ধরে সকালের দিকে অঘোরখুড়ো যে তাঁর চশমাটা খুঁজে পাচ্ছেন না, সেকথা কি আপনি জানেন? না, জানার কথাও নয়। রোজই সকালে চশমা হারানো নিয়ে খুডোমশাই চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় করেন। কিন্তু একটু বেলার দিকে চশমাজোড়া ঠিকই আবার খুড়োমশাইয়ের টেবিলেই পাওয়া যায়। ঠিক কিনা কর্তাবাবু, বলুন?”
“হু। ঠিকই বলছিস বলেই তো মনে হচ্ছে। কিন্তু চশমার সঙ্গে কানুর কী সম্পর্ক?”
“গভীর সম্পর্ক কর্তাবাবু, গভীর সম্পর্ক। আর শুধু খুড়োমশাইয়ের চশমাজোড়াই তো নয়, ব্ৰজবিহারী ঠাকুরমশাইয়ের নামাবলিখানা আর বিজয়বাবুর ল্যাবরেটরির আতশ কাঁচখানাও সেই সঙ্গে গায়েব হয়ে যায়, একটু বেলার দিকে অবশ্য ফিরেও আসে।”
“দ্যাখ বটু, তোর কথা বুঝবার চেয়ে চিনেম্যানের কথা বোঝা বরং সহজ।”
“কথায় একটু মারপ্যাঁচ না থাকলে ঠিক জুত হয় না কিনা। তবে আসল কথাটা হল, কানু সকালে এ বাড়ির চারটে দুধেল গাইকে নিয়ে গোচারণের মাঠে চরাতে যায়, জানেন তো?”
“তা জানব না কেন? কানু তো আমাদেরই রাখাল।”
“আজ্ঞে, তাই বলছি। মাঠে গোরুগুলোকে খোঁটায় বেঁধে দেওয়ার পর কিন্তু সে আর রাখাল থাকে না। গায়ে নামাবলি জড়িয়ে চোখে চশমা এঁটে হাতে আতশ কাঁচ নিয়ে সে তখন কানাইপণ্ডিত জ্যোতিষার্ণব।”
“বলিস কী?”
“আজ্ঞে, আপনি যদি এখনই বটতলায় গিয়ে হাজির হতে পারেন, তা হলে কানাইপণ্ডিতের চেহারা দেখে তাকে কানু বলে চিনতেও পারবেন না। টিকিতে কল্কে ফুল বেঁধে কম্বলের আসনে বসে লোকের কুষ্টি আর হস্তরেখা বিচার করে গড়গড় করে নিদান আউড়ে যাচ্ছে। তার সামনে অন্তত বিশ-পঁচিশজন লোকের লাইন।”
“বাপ রে! আমাদের বাড়িতে একটা আস্ত জ্যোতিষী ঘাপটি মেরে বসে আছে, কখনও টেরটিও পেলাম না তো! ভাল কথা, আমার বাহান্ন বছর বয়সে নাকি একটা ফাঁড়া আছে। কানু ফিরলে একটু বলিস তো, আমার হাতটা যেন একটু দেখে দেয়।”
“যে আজ্ঞে। সে না হয় হল, কিন্তু ওই লম্বা লোকটার কী করা যায় তা একটু ভেবে দেখবেন কি কর্তা?”
“ও হ্যাঁ, তাই তো! তোর গল্পের চোটে তো ঢ্যাঙা লোকটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তা নব, হরেন আর কানু নেই বলে কি এ বাড়িতে লোকের অভাব? আমার তিন-তিনটে সোমত্ম ছেলে রয়েছে, তা ছাড়া অঘোরখুড়ো, বিরাজজ্যাঠা, একচন্দ্রদাদা, ব্রজঠাকুর, বিজয়মামা…!”
“আর কবেন না কর্তা। আপনার তিন ছেলের মধ্যে বড়জন নীলকান্তদাদাবাবু এ সময়ে লেখাপড়া নিয়ে গম্ভীর মুখে বইপত্তরে ডুবে থাকেন। মেজদাদাবাবু অয়স্কান্ত হাপুস-হুঁপুস করে ব্যায়াম করে যাচ্ছেন, এ সময়ে কথা কন না। আর ছোটদাদাবাবু কৃষ্ণকান্ত তানপুরা সাপটে গলা সাধছেন। কাউকে ডেকে সাড়া পাওয়ার উপায় নেই। অঘোরখুড়ো এ সময় তাঁর কবিরাজি গাছগাছড়ার খোঁজে বেরিয়ে যান। বিরাজজ্যাঠার কথা তো সবাই জানে। গতবার হালদারদের পুকুরের সেই অতিকায় কাতলা মাছটা জ্যাঠাকে লেজে খেলিয়ে তাঁর ছিপ সমেত পালিয়ে গিয়েছিল। সেই থেকে মাছটাকে ধরার জন্য রোজই ছিপ নিয়ে সাতসকালে হালদারপুকুরে হানা দেন। একচন্দ্ৰদাদা রোজ সকালে নিয়ম করে গঞ্জের মোট তিনশো তেইশজনকে কুশল প্রশ্ন করতে বেরিয়ে যান, এতক্ষণে বোধহয় একশো বাইশজন পর্যন্ত হয়েছে। ফিরতে তাঁর বেলা হবে। ব্রজঠাকুরের পাঁচবাড়ির নিত্যপূজা আছে। আর বিজয়মামা তাঁর জাদুইঘরে বসে নুনের সঙ্গে চুন মেশালে কী হয় তাই হাঁ করে ভাবছেন।”
“নুনের সঙ্গে চুন! তা মেশালে কী হয় বল তো?”
“আজ্ঞে, ওটা কথার কথা। জাদুইঘরে বসে তিনি যে নানা সাইজের কাঁচের পাত্রে কোন বিটকেল জিনিসের সঙ্গে কোন বিঘুঁটে জিনিস মেশান, তা কে জানে বাবা! তবে এমন সব কিম্ভুত
গন্ধ বেরোয় যে, নাকে চাপা দিয়ে পালানোর পথ পাই না।”
“বুঝলাম। তা হলে লম্বা লোকটাকে তাড়ালি কী করে?”
“তাড়ালাম? তাড়ালাম আর কোথায়? সে দিব্যি এখনও পিছনের ফটকের কাছে ঝুপড়ি আমগাছটার তলায় গ্যাট হয়ে বসে আছে।”
“এখনও বসে আছে? আগে বলবি তো! চল তো গিয়ে দেখি।”
“তা হলে বরং বন্দুকটা নিয়ে নিন সঙ্গে। দিনকাল ভাল নয়, বলা তো যায় না।”
“দুর পাগল! এই সকালে তো আর চোর-ডাকাত আসবে না।”
“অন্তত মোটা লাঠিগাছটা হাতে থাকলে ভাল হয়।”
“দুর-দুর। ওসবের দরকার নেই।”
“আপনার কর্তা, বড্ড সাহস।” বীরেন রায় ডাকাবুকো মানুষ, লম্বা-চওড়া চেহারা। ইজিচেয়ার থেকে উঠে বীরদর্পে পিছনের ফটকের দিকে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। তাঁর পিছনে একটু তফাতে বটু ওরফে বটকৃষ্ণ।
পিছনের ফটকের বাইরে ঝুপসি আমগাছটার তলায় সত্যিই একটা লোক বসে বসে ঝিমোচ্ছিল। পরনে আধময়লা হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা সুতির মোটা জামা, গলায় একটা গামছা জড়ানো, মাথা ন্যাড়া এবং টিকি আছে। পাড়ায় নেড়িকুকুরগুলো অচেনা লোক দেখে একটু দুরে দলবেঁধে দাঁড়িয়ে খুব ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছে।
বীরেনবাবু তাকে দেখেই একটা বাঘা গর্জন ছাড়লেন, “অ্যাই! ওঠো তো, উঠে দাঁড়াও। তুমি নাকি বেজায় লম্বা! দেখি তো তোমার হাইটটা!”
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে হাতজোড় করে বলল, “আজ্ঞে না কর্তা, আমি তেমন কিছু লম্বা নই। গরিবের কি আস্পদ্দা সাজে? লম্বা হতেও তো মুরোদ চাই কর্তা!”
বীরেনবাবু এই বিনয়বচনে একটু নরম হয়ে বললেন, “আহা, লম্বা হওয়ার সঙ্গে গরিব-বড়লোকের কথা উঠছে কেন? গরিবেরা কি আর লম্বা হয় না? একটু উঠে দাঁড়াও দেখি বাপু, হাইটটা একটু দেখে নিই।”
লোকটি ভারী অনিচ্ছের সঙ্গে দাঁড়াল। দেখা গেল, বটু যতটা বলেছিল ততটা না হলেও লোকটা বেশ লম্বাই!
ভ্রূ কুঁচকে খুব মন দিয়ে লোকটার মাথা থেকে পা পর্যন্ত জরিপ করে নিয়ে বীরেনবাবু বটুকে উদ্দেশ করে বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “তোর সব তাইতেই বাড়াবাড়ি। এমনভাবে বললি যে মনে হল, লোকটা বুঝি দু’পেয়ে তালগাছ। তা ছাড়া পরনে পাতলুন নেই, কোট নেই, মাফলারের জায়গায় গামছা। এবার হরডাক্তারকে দেখিয়ে চোখে চশমা নে।”
বটু মাথা চুলকে লজ্জিত হয়ে বলল, “মাপজোকে একটু ভুল হয়ে গিয়েছে বটে।”
বীরেনবাবু লোকটাকে বললেন, “ওহে বাপু, ভেকুড়ি কাটতে পারো?”
লোকটা ভয় খেয়ে বলল, “আজ্ঞে, না বাবু।”
“এই বটু যে বলছিল তুমি নাকি এমন ভেচকুড়ি কাটতে পারো যে, দেখে লোকে ভড়কে যায়!”
“কক্ষনও নয়। আমি জীবনে কখনও ভেকুড়ি কাটিনি। কাকে ভেচকুড়ি বলে তাই জানি না।”
“আহা, সে তো আমিও জানি না। ওরে বটু, ভেচকুড়ি ব্যাপারটা যেন কী?”
“ভেচকুড়ি খুব ভয়ের জিনিস কর্তাবাবু। চোখ দুটো বড় বড় গোল্লা গোল্লা করে তাকিয়ে মুখটায় বিকট রকমের ভেংচি কেটে… উরে বাপ রে, সে বলা যায় না।”
লোকটার দিকে চেয়ে বীরেনবাবু বললেন, “কিছু বুঝলে?”
লোকটা সবেগে মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে, না বাবু। ভেচকুড়ি কথাটাই জন্মে শুনিনি। আর অন্যকে ভয় দেখাব কী, নিজেই আমি সর্বদা ভয়ে মরছি।”
“কেন বাপু, তোমার ভয়টা কাকে?”
“আজ্ঞে, কাকে ভয় না পেলে চলে বলুন? চোর, ঠ্যাঙাড়ে, ডাকাত, পুলিশ, গুন্ডা, বদমাশ, ফাজিল ছেলেছোঁকরা, ভূত-প্রেত, সবাইকেই সমঝে চলতে হয় আজ্ঞে। সবাইকেই ভয়।”
“আহা, সেসব তো আমরাও ভয় পাই।”
লোকটা ঘাড় চুলকে লজ্জা পেয়ে বলল, “কী যে বলেন বাবু, কোথায় আপনারা আর কোথায় আমি? এই যে দেখুন না, ঈশেন দাস মাত্র তিনটি হাজার টাকার জন্য আমাকে ভিটেমাটি ছাড়া করে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করল, ভেচকুড়ি টেচকুড়ি জানা থাকলে কি আর পারত ওরকম?”
বীরেনবাবু বললেন, “কিন্তু বাপু, বটু যে স্বচক্ষে তোমাকে ভেচকুড়ি কাটতে দেখেছে সেটাও তো মিথ্যে নয়। আর ভেচকুড়ি দেখে ভয় খেয়েই না সে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল।”
“কী যে বলেন কর্তা! ও ভেচকুড়ি টেচকুড়ি নয়, তখন বোধহয় একটা হাই তুলেছিলুম, তাই দেখেই উনি ভয় পেয়েছিলেন।”
“হাই আর ভেচকুড়ি কি এক হল বাপু? কী বলিস রে বটু?”
“আজ্ঞে, না কর্তা। হাই এক জিনিস আর ভেকুড়ি অন্য জিনিস। ভেচকুড়ি হল ভেচকুড়ি, আর হাই হল হাই। জলের মতো সহজ ব্যাপার।”
বীরেনবাবু লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, “বুঝলে তো! ভেচকুড়ি হল ভেকুড়ি, আর হাই হল হাই। তা তুমি যখন ভেচকুড়িটা পেরে উঠলে না, তখন বরং একটা হাই তুলেই দেখাও।”
লোকটা ভারী দুঃখের সঙ্গে বলল, “কর্তা, হাই কি আমার বাপের চাকর যে, ডাকলেই এসে হাজির হবে? নাঃ, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন বগলা হাইতের মুখ দেখেছিলুম, তখনই বুঝেছিলুম দিনটা আজ খারাপই যাবে।”
বীরেনবাবু অবাক হয়ে বললেন, “বগলা হাইত! সে আবার কে?”
“তাকে আর চিনে আপনার দরকার নেই বাবুমশাই। শুধু খেয়াল রাখবেন, প্রাতঃকালে ঘুম ভেঙে যেন বগলা হাইতের মুখ আপনাকে দেখতে না হয়। দিনমানে দেখুন, ঠিক আছে, রাতবিরেতে দেখুন, তাতেও ক্ষতি নেই। কিন্তু প্রাতঃকালে দেখেছেন কী হয়ে গেল।”
বীরেনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, “ওরে বাপু, অত সাঁটে বললে কি কিছু বোঝা যায়? কে বগলা হাইত, কী তার বৃত্তান্ত, প্রাতঃকালে তার মুখ দেখলে কী হয়, সব খোলসা করে বলবে তো?”
“প্রাতঃকালে তার মুখ দেখলে কী হয় তা এই আমাকে দেখেই কি অনুমান হচ্ছে না কর্তা? কাল সন্ধেবেলা মদন প্রামাণিকের বাড়িতে সত্যনারায়ণের কাটা ফলের পেসাদ আর একটি সিন্নি খেয়েছিলুম। তারপর চার পো রাত গিয়েছে, এত বেলা অবধি দানাপানি জোটেনি মশাই। এর পরও কি প্রাতঃকালে বগলা হাইতের মুখ দেখলে কী হয় তা বলার দরকার আছে?”
বীরেনবাবু তেরিয়া হয়ে বলেন, “তা এ বাড়িতে কি খ্যাটনের আশায় এসে জুটেছ নাকি?”
“না মশাই, না। আপনার মতো হাড়কেনের বাড়িতে যে এক ঘটি জলও জোটার আশা নেই, তা সবাই জানে। খালি পেটে গাছতলায় বসে একটু জিরেন নিচ্ছিলাম, অমনি এসে আপনি নানা বায়নাক্কা শুরু করলেন। ভেকুড়ি দেখাও, হাই তুলে দেখাও, বগলা হাইতের খতেন দাখিল করো। তা মশাই, খালি পেটে কি ওসব হয়?”
বীরেনবাবু একটু মিইয়ে গিয়ে বললেন, “আমি কেন একথা তোমাকে কে বলল বলো তো বাপু? খগেন তপাদার নয় তো? ওর কথা মোটেই বিশ্বাস কোরো না বাপু। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, আমার ছোট মেয়ের বিয়ের সময় খগেন লুচি-মাংস, পোলাও কালিয়া ঠেসে খাওয়ার পর দশ হাত পায়েস সাঁটায়। তারপর আরও পায়েস চাইছিল বলে আমি ওর ভালর জন্যই বলি, খগেন, আর পায়েস খেয়ো না, পেটে সইবে না। এই তো ক’দিন হল রক্ত আমাশায় ভুগে উঠলে! এই কথাতেই খগেন রেগেমেগে উঠে গেল, আর চারদিকে রটাতে লাগল আমি নাকি হাড়কেপ্পন।”
লোকটা মাথা চুলকে বলল, “কর্তাবাবু, ভুল শুনছি কি না জানি। আপনি তো বললেন হাতা, কিন্তু খগেন তপাদারদাদা তো বলে বেড়াচ্ছেন সেটা নাকি একটা চায়ের চামচ ছিল।”
“আরে না, না। হাতাটা একটু ছোট ছিল ঠিকই। তা বলে অত ছোট নয়। তা বাপু, তোমার মুখোনা তো দেখছি শুকিয়ে গিয়েছে! ওরে বটু, আহাম্মকের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? লোকটাকে নিয়ে গিয়ে দক্ষিণের দাওয়ায় বসিয়ে একটু জলটল দে। একধামা মুড়ি বাতাসা, কয়েকটা শশা, যা যা শিগগির। অতিথি হল নারায়ণ!”
বীরেনবাবু শশব্যস্তে ভিতরবাড়িতে চলে যাওয়ার পর লোকটা নাক কুঁচকে বলল, “মুড়ি, বাতাসা আর শশা! ছ্যাঃ, কোনও ভদ্দরলোকে খেতে পারে ওসব? একধামা মুড়ি শেষ করতে তো বেলা গড়িয়ে যাবে।”
বটু বলল, “হু, তবু তো বাপু তোমার বরাত ভাল যে, অন্তত মুড়ি-শশার হুকুম হয়েছে। আর ধামা নিয়ে ভেবো না, এ বাড়ির ধামার সাইজ হল নারকোলের মালার মতো।”
“তা হলে তোমরা সব বেঁচেবর্তে আছ কী করে? চেহারাও বেশ নধরই মনে হচ্ছে।”
“ওরে বাপু, বীরেনবাবু পাষণ্ড বলে তো আর গিন্নিমাও পাষণ্ড নন। তার একটু মায়াদয়া আছে। আর বলতে নেই, আমরাও তো আর লক্ষ্মীছেলে নই রে বাপু, হাতযশে কিছু কম যাই না। কাটা মুলোটা, নাড়ুটা-মোয়াটা, দুধটা-ক্ষীরটা সবই নিয়ম করে হাপিস করি, নইলে উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে কি শরীর টিকত? ওই যে দক্ষিণের দাওয়া, গিয়ে চুপ করে বসে থাকো, তোমার মুড়ি শশার ব্যবস্থা দেখছি।”
২. আশ্বিন মাসে পুজোর পর
আশ্বিন মাসে পুজোর পর থেকেই নিমাদের মনে হতে লেগেছে যে, সে বুড়ো হচ্ছে। বয়সের হিসেব সে জানে না। কিন্তু বুড়ো যে হচ্ছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তা বলে কি নিমচাঁদ এক প্যাকেট তাস একসঙ্গে ধরে দু’হাতে এক টানে ছিঁড়ে ফেলতে পারে না? পারে। দু’মন লোহার বারবেল কি এক ঝটকায় মাথার উপর তুলে ফেলতে পারে না? পারে। হাতের কানা দিয়ে এখনও কি সে নারকোল ফাটাতে পারে না? খুব পারে। মোটা নাইলনের দড়ি দু’হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতে কি তার খুব কষ্ট হচ্ছে আজকাল? হচ্ছে বোধহয়, তবে ছিঁড়েও ফেলছে। আর রাজবাড়ির বড় কামানটা যে সেদিন বাগানের উত্তর দিক থেকে তুলে নিয়ে দক্ষিণ দিকে বসাতে হল, তাতে কি গা ঘামাতে হল তাকে? তেমন কিছু নয়।
তবু নিমাদের ক’দিন হল মনে হচ্ছে, বুড়ো হতে আর বিশেষ বাকি নেই। তার বুড়ো বয়স এসে দরজায় কড়া নাড়ল বলে!
সকালে কথাটা তার ছেলে ভীমচাঁদকেও বলল। ভীমচাঁদের বয়স মোটে বারো।
“বুঝলি রে ভেমো, আমি বোধহয় শেষ অবধি বুড়োই হয়ে গেলুম।”
ভীমচাঁদ জানলার কাছে বসেইসকুলের পড়া করছিল। ভারী অবাক হয়ে বলল, “তাই নাকি বাবা? তা হলে তো বড় মুশকিল হল?”
“কেন রে? মুশকিলটা কীসের? বয়স হলে মানুষ তো বুড়োই হয়।”
“কিন্তু নোয়াপাড়ার ছেলেরা যে তা হলে দলবেঁধে আমাকে পেটাবে?”
“তোকে পেটাবে! কেন, তুই কী করেছিস?”
“ওদের ক্লাবের সেক্রেটারি গোবিন্দ নতুন সাইকেল কিনে খুব কায়দা করে চালাচ্ছিল দেখে আমি হিংসের চোটে ঢিল মেরে গোবিন্দর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলুম যে! তখনই ওরা শাসিয়ে রেখেছে, তোর বাবার গায়ে তো আর চিরকাল জোর থাকবে না। যখন বুড়ো হবে, তখন দলবেঁধে তোকে পেটাব। দেখব, তোর বাবা কী করতে পারে?”
নিমচাঁদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে হাটুরে মার খাওয়ার জন্য তৈরি হ’ রে ভেমো। আমি সত্যিই বুড়ো হতে চললুম।”
“তোমার গায়ে কি আর একটুও জোর নেই বাবা?”
দুঃখের সঙ্গে মাথা নেড়ে নিমচাঁদ বলল, “না রে বাবা, জোর বল খুবই কমে যাচ্ছে। পরশু দিন শিবাইচণ্ডীতলা দিয়ে আসছিলুম, দেখলুম, আমাদের দাগি ষাঁড় ভোলা বটতলায় শুয়ে আছে। শিং ধরে কতবার ভোলার ঘাড় মুচড়ে দিয়েছি। তা ভাবলুম, আজও একটু মুচড়ে দিই। ঠেলাঠেলি করে তাকে তোলার পর ভোলা রেগেমেগে তেড়ে এল বটে, আর আমিও তার ঘাড় মুচড়ে দিলুম ঠিকই। কিন্তু নাঃ, ঠিক আগের মতো হল না। ভোলাও যেন সেটা টের পেয়ে মিচিক মিচিক হাসছিল।”
ভীমচঁদ খুব চিন্তিতভাবে বলল, “তা হলে তো বড় মুশকিল হল বাবা। ইসকুলের নগেনমাস্টারমশাই পড়া না করলে সবাইকেই খুব বেত মারেন, শুধু আমাকে ছাড়া। তুমি বুড়ো হয়েছ জানলে যে নগেনস্যার আমাকে মেরে পাট পাট করবেন।”
“তা হলে বরং লেখাপড়াতেই মন দে রে ভেমো। আর আমার ভরসায় বসে থাকিস না।”
ভীমচাঁদ কাদো কাঁদো হয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, তা হলে যে এখন থেকে লবঙ্গলতা স্টোর্সের বিশে আর বিনা পয়সায় লজেন্স বা চকোলেট দেবে না! গদাইয়ের দোকান থেকে খাতা-পেনসিল বিনা পয়সায় তুলে আনাও চলবে না। ইসকুলে বন্ধুরা পালা করে টিফিনের ভাগ দেবে না।”
নিমাদ দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “হাতি কাদায় পড়লে কী হয় জানিস তো? না না, এখন থেকে তোরা সব ন্যায্য পয়সা দিয়েই জিনিসপত্তর কিনিস বাপ! আর গাজোয়ারি করে তুলে আনিস না।”
“ইস, তুমি আর কটা দিন পরে বুড়ো হলে আমি ততদিনে ক্লাস পরীক্ষাটাও পাশ করে যেতাম!”
“উঁহু, আর ওসব নয়। তিন-চার বিষয়ে ফেল মেরেও নতুন ক্লাসে ওঠা আর চলবে না। এখন থেকে সব বিষয়ে পাশ নম্বর পেতে হবে।”
নিমাদের বউ খবর পেয়ে হুলস্থূল হয়ে এসে ঘরের মধ্যে আছড়ে পড়ল, “ওগো, এ কী সব্বোনেশে কথা শুনছি! তুমি নাকি বুড়ো হয়েছ?”
“আহা, তাতে চেঁচামেচির কী আছে? বয়স হলে বয়সের নিয়মেই বার্ধক্য আসে। হুঁ হুঁ বাবা, এ হল অঙ্কের হিসেব।”
“কিন্তু আমার কী দুর্দশা হবে ভেবে দেখেছ? পাশের হাজরাবাড়ির কুঁদুলি বউটা পাড়ার সকলের সঙ্গে নেচে নেচে ঝগড়া করে বটে, কিন্তু আমি কিছু বললে বা দু’কথা শোনালে চুপ করে থাকে, রা-টি কাড়ে না। এখন তো সে আমারও বিষ ঝেড়ে দেবে রোজ। গলার হার ভেঙে এই যে বালা গড়িয়েছি, স্যাকরা কথাটি কয়নি। কিন্তু এখন সে কি মজুরি আদায় না করে ছাড়বে? আমি পাড়ায় বেরোলে লোকে কত খাতির করে রাস্তা ছেড়ে দেয়, রিকশাওয়ালা বিনা ভাড়ায় খেপ দিয়ে দেয়। আর কি ওসব হবে? এখন যে দুধওয়ালাও দুধের দাম চাইবে গো।”
নিমাদ গম্ভীর হয়ে বলল, “ওসব ভুলে যাও গিন্নি। এখন থেকে লোকের সঙ্গে ভাবসাব রেখে চলো। মনে রেখো, গয়না গড়ালে মজুরি দিতে হবে, রিকশায় উঠলে ভাড়া মেটাতে হবে, দুধ খেলে দাম দিতে হবে। আর এটাও যেন খেয়াল থাকে, সেইদিন আর নাই রে নাতি, থাবা থাবা চিনি খাতি।”
না, সেই দিন আর নেই-ই বটে। নিমচাঁদ যে বুড়ো হল! খুব চিন্তিত মুখে পাড়ায় বেরিয়ে খুব ধীরে ধীরে টুকটুক করে হাঁটছিল নিমচাঁদ। বয়স হয়েছে, এখন হুড়দৌড় করে হাঁটাচলা ঠিক হবে না। বুড়ো বয়সের নিয়মকানুন সব মেনে চলতে হবে। অধিক উত্তেজনা বারণ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ, হাঁকডাক করা নিষেধ।
সে রাস্তায় বেরোলে চারদিকটা ভারী শুনশান হয়ে যায়, লোকজন সিঁটিয়ে থাকে, বাচ্চারাও কাঁদে না, লোকের কথাবার্তা, চায়ের দোকানে আড্ডা সবই যেন থেমে থাকে। আজও সেরকম হচ্ছে।
তবে এ আর ক’দিন? এরপর একদিন রাস্তায় বেরোলে তাকে দেখে আশপাশের লোকেরা টিটকিরি দেবে, বক দেখাবে, ছেলেপুলেরা পিছনে লাগবে, কেউ আর ফিসফিস করে একে অন্যকে বলবে না, “ওই দ্যাখ, নিমেপালোয়ান যাচ্ছে।’
রাস্তার ধারে একটা নধর ঝুপসি সজনেগাছ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নিমচাঁদ। নিজের গায়ের জোর-বল নিয়ে আজকাল প্রায়ই তার খুব সংশয় হচ্ছে। তার ঘোর সন্দেহ, আগের মতো ক্ষমতা তার আর নেই। দোনোমনো করে সে গুটি গুটি সজনেগাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে তার দু’খানা মজবুত হাতে গাছটাকে সাপটে ধরে ‘হেঁইও’ বলে একটা হ্যাঁচকা চাড় দিতেই গাছটা কেঁপে উঠে যেন মানুষের গলাতেই চাপা স্বরে বলে উঠল, “বাপ রে! তবে গাছটা ওপড়াল না। নিমাদ আর-একবার দম নিয়ে ফের গাছটাকে সাপটে ধরে চাড় দিতেই গাছটা যেন একটা মর্মর ধ্বনি তুলে বলে উঠল, “হচ্ছেটা কী?’ নিমাদ আর-একবার গভীরভাবে শ্বাস টেনে গাছটাকে শক্ত করে ধরে চাড় মারতেই ঝুম্বুস করে শেকড়বাকড় আর মাটির চাঙড় সমেত গাছটা বিঘতখানেক উপরে উঠে পড়ল। নিমচাঁদ একটা স্বস্তির খাস ছেড়ে গাছটাকে আবার জায়গামতো বসাতেই উপর থেকে হুড়মুড় করে ডালপালা সমেত একটা লোক, “ভূমিকম্প হচ্ছে! ভূমিকম্প হচ্ছে।” বলে চেঁচাতে চেঁচাতে মাটিতে চিতপাত হয়ে পড়ে গেল।
নিমাদ ভারী অপ্রস্তুত! তাড়াতাড়ি লোকটাকে তুলে দাঁড় করিয়ে ধুলোটুলো ঝেড়ে বলল, “অঘোরখুড়ো যে!”
অঘোরখুড়ো কঁকালের ব্যথায় মুখ বিকৃত করে বললেন, “ভূমিকম্প হচ্ছে যে! টের পাসনি?”
নিমাদ আমতা আমতা করে বলল, “ভূমিকম্প হচ্ছিল নাকি?”
“তোর কি ভীমরতি হল যে, এত বড় ভূমিকম্পটা টের পেলি না! একটা ব্লাডপ্রেশারের ওষুধ তৈরি করব বলে সজনে ফুলের সন্ধানে গাছে উঠেছি কী, অমনি সে কী কাঁপুনি আর দুলুনি রে বাবা! ওঃ, মাজাটা বুঝি ভেঙেই গিয়েছে রে, ডান হাতের কনুইটাও যেন অসাড়। বুড়ো বয়সে হাড় ভাঙলে কি আর জোড়া লাগবে রে বাপ!”
নিমাদের ভারী মনস্তাপ হল। গাছের গোড়ায় ছেড়ে রাখা হাওয়াই চটিজোড়া সে দেখেও তেমন খেয়াল করেনি। বুড়ো বয়সের চিন্তায় ভারী মনমরা হয়েছিল তো! লজ্জিত মুখে সে বলল, “চলুন, আমি বরং কাঁধে করে আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
“দিবি? তাই দে বাবা! হাঁটাচলা ক’দিনের জন্য বন্ধ হল কে জানে?”
অঘোরখুড়োকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিমচাঁদ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা খুড়োমশাই, আপনি তো মস্ত কোবরেজ! মানুষের বুড়ো বয়সটা ঠিক কবে থেকে শুরু হয় বলুন তো?”
“ও বাবা, সে বলা খুব শক্ত। কেউ কুড়িতেই বুড়োটে মেরে যেতে থাকে, আবার কেউ নব্বইতেও বুড়ো হতে চায় না। ওর কোনও নিয়ম নেই যে! কেন রে, তোর হঠাৎ বুড়ো বয়সের চিন্তা কেন?”
“না, এই জেনে রাখা ভাল কিনা! তা বুড়ো হওয়ার কি কোনও নিয়ম নেই খুড়ো?”
“তা আছে বই কী, তবে সে বড় জটিল জিনিস, তুই বুঝবি না। এই যে আমি, এই আমাকেই দ্যাখ দেখি, চুরাশি বছর বয়সেও আঁদাড়ে-পাঁদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, গাছগাছালিতে উঠে পড়ছি, দাঁতে চিবিয়ে মাংসের হাড় গুঁড়ো করে ফেলছি।”
“তা বটে। তবে বুড়ো হওয়ার একটা নিয়মও তো আছে। ধরুন, বুড়ো বয়সেও কেউ যদি বুড়ো হতে না চায়, তা হলে কি সেটা ভাল দেখায় খুড়ো? লোকে নিন্দেমন্দও তো করতে পারে? বুড়োদের মধ্যে একটু বুড়োমি না থাকলে কি মানায়?”
“দুর আহাম্মক! তোর মাথায় বুড়ো বয়সের পোকা ঢুকেছে দেখছি। বলি, সত্যিই কি তোর ভীমরতি হল?”
“তা না হবে কেন বলুন? মা ষষ্ঠীর কৃপায় বয়স তো কম হল না! বেশ বুড়োই তো হয়েছি।”
“বটে! তা বুড়ো যে হলি টের পেলি কীসে?”
“আজ্ঞে, গায়ের জোর-বল কমে যাচ্ছে, সেই আগের মতো চটপটে হাত-পা নেই। তারপর ধরুন ক্ষুধামান্দ্যও হতে লেগেছে। দিনমানে এককাঠা চালের ভাত পথ্য ছিল, জামবাটি ভরতি ডাল, তিনপো মাছ, রাতে আশিখানা রুটি, সঙ্গে সেরটাক মাংস। তা এখনও খোরাক কমাইনি বটে, কিন্তু খেয়ে যেন আইঢাই হচ্ছে। তারপর ধরুন, চোখেও কি আর আগের মতো নজর আছে? ওই যে দুরে নারকেল গাছের ডগায় গাছের সঙ্গে গামছা দিয়ে কোমর জড়িয়ে লোকটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ও যে হরেন তা কি আর সত্যিই ঠাহর করতে পারছি? অনুমান করছি ওটা হরেনই হবে। তারপর ধরুন, আপনাদের দক্ষিণের দাওয়ায় যে একটা ন্যাড়ামাথাওলা লম্বাপানা লোক বসে মুড়ি আর শশা খাচ্ছে, তাও কি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি! আন্দাজে বলা! তারপর ধরুন, ওই যে গোচারণ মাঠের ওধারে বটতলায় নামাবলি গায়ে, চোখে চশমা এঁটে একটা লোক হাটুরেদের হস্তরেখা আর কুষ্ঠি বিচার করছে। ও যে আসলে কানু সেটা জানি বলেই বলতে পারছি।”
অঘোরখুড়ো আঁতকে উঠে বললেন, “কানু! কানু চশমা পেল কোথায়? অ্যাঁ! এ নিশ্চয়ই আমার চশমা! ওরে আমাকে নামা! নামা! এক্ষুনি ছুটে গিয়ে পাজিটাকে বমাল ধরতে হবে।”
“উত্তেজিত হবেন না খুড়ো! এই বয়সে উত্তেজনা ভাল নয়। কত চশমা যাবে, কত চশমা ফের আসবেও। কিন্তু উত্তেজনার বশে প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেলে তাকে কি আর হাতে-পায়ে ধরেও ফেরাতে পারবেন?”
অঘোরখুড়ো খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “আমার প্রাণবায়ু নিয়ে তোকে মাথা ঘামাতে হবে না। প্রাণবায়ু তো বিনি পয়সার জিনিস, কিন্তু চশমার যে অনেক দাম!”
“কানুও তাই বলছিল বটে!”
“কী বলছিল?”
“চশমাটা পরলে নাকি ও ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।”
“বলিস কী সব্বোনেশে কথা? ওই চশমা পরে আমি বুড়ো হলুম, কখনও তো ভূত-ভবিষ্যৎ দেখতে পাইনি।”
“কিন্তু কানু পায়। নইলে এত লোকের ভূত-ভবিষ্যৎ গড়গড় করে বলে দিচ্ছে কী করে? আর সব ঠিকঠাক মিলেও তো যাচ্ছে।”
“কীরকম?”
“এই তো দিন সাতেক আগে নগেন বৈরাগীকে বলল, “মনে হচ্ছে তোমার কোমরে দড়ি পড়বে হে।’ শুনে ইস্তক নগেন তো গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে মরে। শেষে দারোগাবাবুর কাছে গিয়ে কান্নাকাটিও করে এল। দারোগাবাবু অভয় দিলেন, “ভয় নেই, তোকে গ্রেফতার করলেও কোমরে দড়ি পরাব না। তারপর কী হল জানেন? নগেন বৈরাগী জল তুলতে গিয়ে পা হড়কে কুয়োয় পড়ে গেল। তারপর সেই কোমরে দড়ি বেঁধেই কুয়ো থেকে তুলতে হল তাকে। তারপর মহেশ প্রামাণিকের কথাই ধরুন। ক’দিন আগে মহেশ প্রামাণিককে বলল, “যার নাম ‘ন’ দিয়ে শুরু তেমন জিনিস থেকে সাবধান। কী মুশকিল বলুন তো! মহেশের বাপের নাম নবীন, মা নগেন্দ্ৰবালা, বউ নলিনী, ভাই নরেশ, ছেলে নবকুমার, মেয়ে নীপবালা। মহেশ এখন যায় কোথায়? ভয় খেয়ে সে তার বড় শ্যালকের বাড়িতে গিয়ে ক’দিনের জন্য ঘাপটি মেরে রইল। তা একদিন বারান্দায় বসে পাকা কাঁঠালের ফলার সারছে, হঠাৎ বাড়ির কেলে গোরুটা ধেয়ে এসে মহেশকে গুঁতিয়ে সাত হাত দূরে ছিটকে ফেলে কাঁঠাল খেয়ে গেল। মাজা ভেঙে মহেশ সাতদিন শয্যাশায়ী। পরে জানা গেল সেই গোরুর নাম নাকি ‘নিশিপদ্ম। বুঝুন কাণ্ড!”
“তাই তো রে! তুই যে ভাবিয়ে তুললি! আমার চশমার যে এত গুণ তা তো আমিই এতকাল টের পাইনি!”
“আজ্ঞে, স্বাতী নক্ষত্রের জল, পাত্রবিশেষে ফল। সকলের কি সব কিছু সয় খুড়ো? নীলার আংটি যেমন, কারও হাতে গেলে পৌষমাস, কারও হাতে সর্বনাশ।”
অঘোরখুড়ো খুব চিন্তিত গলায় বললেন, “কথাটা বোধহয় খুব একটা মন্দ বলিসনি। চশমাটার মধ্যে কিছু অশৈলী ব্যাপার থাকলেও থাকতে পারে। ওটা চোখে দিলে মাঝে মাঝে কিম্ভুত সব জিনিস দেখা যায় বটে।”
“কীরকম খুড়ো?”
“আগে ভাবতুম বয়সের দোষে ভুলভাল দেখছি। কিন্তু এখন তলিয়ে ভেবে দেখলুম, সেটা চশমার গুণেও হতে পারে।”
“তা কী দেখতে পান খুড়ো? ভূতটুত নাকি?”
“ভূতও হতে পারে। তবে মাঝে মাঝে চশমাটা খুব আবছা হয়ে যায়। তারপর হঠাৎ আবছায়া কেটে গিয়ে হয়তো দেখলুম, ঘরের মধ্যে একটা খুব ঢ্যাঙা লোক উবু হয়ে কী যেন খুঁজছে। সাড়া দিতেই ফুস করে কোথায় যেন সটকে পড়ল। তারপর ধর, আমার জানলার ওধারে কদমতলার মাঠ। জ্যোৎস্না রাতে মাঝে মাঝে দেখতে পাই কয়েকটা খুব ঢ্যাঙা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের গায়ের রং যেন কেমন সবজে সবজে।”
“তা হলে ও চশমা আপনি কানুকেই দান করে দিন খুড়ো। ও আপনার সইবে না।”
“দান করে দেব কী রে? ও যে খাঁটি সোনার চশমা! বটুকবুডোর বাতব্যাধির চিকিৎসা করেছিলুম। বটুক খুশি হয়ে মরার আগে চশমাজোড়া আমাকে দিয়ে যায়। আমার চোখেও দিব্যি ফিট হয়ে গেল। দিনের বেলা দিব্যি সব স্পষ্ট দেখা যায়। রাতের দিকেই যা একটু গন্ডগোল হয়।”
“চশমা ছাড়াই যখন আপনি সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, তখন ওই অলক্ষুনে চশমা চোখে দেওয়ার দরকার কী আপনার?”
“তা বটে, তবে কী জানিস, চশমা পরলে একটা ভারিক্কি ভাব আসে। লোকে একটু মান্যিগন্যি করে। চশমা একটা কেতার জিনিস তো! চোখে দিলে বাহারও হয় খুব!”
“যদি অভয় দেন তো একটা কথা কব?”
“কী কথা?”
“বলছিলুম কী, এখন কি আর আমাদের সেই বয়স আছে? এই জাগতিক তুচ্ছ জিনিসপত্রের উপর লোভ করা কি আমাদের শোভা পায়? আমাদের এই বুড়ো বয়সে তো জাগতিক বস্তু ছেড়ে পরমার্থেরই খোঁজ করা উচিত? কী বলেন?”
অঘোরখুড়ো খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তুই বুড়ো হচ্ছিস তো যত খুশি হ। কিন্তু তোর দলে আমাকে ভেড়াচ্ছিস কেন? আমি মোটেও বুড়ো হইনি।”
নিমচাঁদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “হননি? কিন্তু বয়সকালে বুড়ো হলে যে বড় সমস্যা হবে খুড়োমশাই!”
কথায় কথায় বাজারের কাছেপিঠে এসে পড়ায় লোকজন হাঁ করে দেখছিল তাঁদের। খগেন তপাদার বাজার সেরে ফিরছিল, দৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, “বলি ও অঘোরখুড়ো, ভোটে জিতলেন, না ডবল সেঞ্চুরি করলেন?”
অঘোরখুড়ো খ্যাক করে উঠে বললেন, “তার মানে?”
“আজকাল তো দেখি ভোটে জিতলে, আর ডবল সেঞ্চুরি করলেই লোকে কাঁধে নিয়ে নাচানাচি করে। তা আপনার কোনটা?”
অঘোরখুড়ো ভারী অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “দ্যাখ খগেন, সব সময় রঙ্গ-রসিকতা ভাল নয়। কত বড় ভূমিকম্পটা হয়ে গেল দেখলি না? তার ধাক্কায় গাছ থেকে পড়ে মাজাটা ভেঙে দ’ হয়ে গেলুম, আর তুই রসিকতা করছিস?”
“তা ভূমিকম্প তো হয়েছিল এক বছর আগে, আপনার পড়তে এত সময় লাগল কেন বলুন তো? কত উঁচু গাছ যে, পড়তে এক বছর সময় লাগে?”
অঘোরখুড়ো খেপে গিয়ে বললেন, “তোরা কি নেশা করেছিস নাকি যে, এত বড় ভূমিকম্পটা টের পেলি না! মাত্র দশ মিনিট আগেই তো উপর্যুপরি ঝাঁকুনির চোটে আমি গাছ থেকে পড়লুম।”
বাজারের লোকজন মুখ তাকাতাকি করে বলতে লাগল, “না মশাই, ভূমিকম্প তো মোটেও হয়নি!”
খগেন তপাদার বলল, “ও ভূমিকম্প নয় খুড়ো, ও হল আপনার হৃৎকম্প।”
বিপদ বুঝে নিমচাঁদ ডবল গতিতে হাঁটা দিয়ে বলল, “সবার কথায় কান দেওয়ার দরকার কী আপনার বলুন তো খুড়োমশাই?”
অঘোরখুড়ো কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, “হারে, তুই না বুড়ো হয়েছিস? তোর নাকি হাতে-পায়ে আর আগের মতো জোর নেই! তা হলে এখন এই টাটুঘোড়ার মতো ছুটছিস কী করে?”
“ছুটছি নাকি?”
“আলবাত ছুটছিস!”
“ওইটেই বুড়ো বয়সের দোষ খুড়োমশাই, বয়সটা সব সময় খেয়াল থাকে না কিনা! ভীমরতিই হচ্ছে বোধহয়।”
“তোকে যে ভীমরতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে তা এখন আমি দিব্যি বুঝতে পারছি। ভেবে দেখলুম, যখন সবাই একই কথা বলছে, তখন একটু আগে যেটা হয়ে গেল সেটা মোটেও ভূমিকম্প নয়।”
নিমচাঁদ ভারী অবাক হয়ে বলল, “নয়! তা হলে কী হল বলুন তো?”
“কেউ গাছটা ঝাঁকিয়ে আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছিল।”
“এ তো ভারী অন্যায়।”
“তা তো বটেই। তা ভাবছি, অত বড় মজবুত একটা গাছকে ঝাঁকুনি দিয়ে নড়ানো তো যার-তার কম্মো নয়। মস্ত পালোয়ানের পক্ষেই সম্ভব। কী বলিস?”
কাঁচুমাচু হয়ে নিমচাঁদ বলল, “আজ্ঞে, ঠিক ইচ্ছে ছিল না খুড়োমশাই। কী করে যেন হয়ে গেল! বুড়ো বয়সের দোষ বলেই ধরে নিন।”
“বুড়ো বয়সের দোষ হবে কেন রে? এ সব নষ্টামি-দুষ্টামি কি বুড়ো মানুষের কাজ? এ তো করে বাচ্চা বখাটে ছেলেরা! তোর বয়স মোটেও বাড়ছে না, বরং কমছে। তুই আসলে ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছিস।”
চিন্তিত হয়ে নিমচাঁদ বলল, “এ তো বড় ধন্দে ফেলে দিলেন খুড়ো! বয়স বাড়ছে না কমছে, সেটাই যে এখন ঠিক ঠাহর পাচ্ছি না।
৩. যারা রটিয়ে বেড়ায়
যারা রটিয়ে বেড়ায় যে, হরেন রোজ নারকোল গাছে উঠে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়, তারা মোটেও সত্যি কথা বলে না। তবে হ্যাঁ, এ কথাও ঠিক যে, নারকোল গাছের মাথাটা ভারী ভাল জায়গা। সেখানে উঠলে গায়ে মিঠে মোলায়েম হাওয়া এসে লাগে! মিষ্টি রোদ আর নারকোল পাতার ঝিরিঝিরি ছায়া, আর সেইসঙ্গে গাছের মৃদুমন্দ দোলে যদি ঘুম এসেই যায়, তা হলে কাউকে দোষও দেওয়া যায় না। আর তাই হরেন গাছের সঙ্গে কোমরটা গামছা দিয়ে কষে বেঁধে নিয়ে খানিকটা ঘুমিয়ে নেয় বটে। তবে আসলে সে গাছের ডগায় বসে এই গঞ্জশহরের চারদিকটা নজরে রাখে বই তো নয়! নজরদারি করার মতো কিছু ঘটনাও আজকাল ঘটতে লেগেছে। আর সেইসব ঘটনা গাছের ডগা থেকে যতটা দেখা যায় মাটিতে দাঁড়িয়ে তার সিকিভাগও দেখার উপায় নেই।
আজও ঘুম ভাঙার পর গোটা কয়েক হাই তুলে আর আড়মোড়া ভেঙে চারদিকটা দেখছিল হরেন। ওই তো চিমসে চেহারার মিতব্যয়ী নিশাপতিবাবু দেড়শো গ্রাম চাল, দুটি আলু, একচিমটি ডাল আর দুটি পুঁটিমাছ কিনতে বাজারে চলেছেন। থানার হোঁতকা সেপাই লাটু হাজারি চৌপথির বটতলায় ইটের উপর বসে উপেন নাপিতের কাছে বিনা পয়সায় আরামসে খেউরি হচ্ছে। নধরকান্তি চিন্তামণি সমাদ্দারের মিষ্টি খাওয়া বারণ বলে, ওই যে বলরাম ঘোষের মিঠাইয়ের দোকানের পিছনে দাঁড়িয়ে শালপাতায় মুখ আড়াল করে টপাটপ জিলিপি খাচ্ছে। এসব রোজকার চেনা দৃশ্য। না, নতুন কিছু দেখা যাচ্ছে না।
কোমর থেকে গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছে গাছ থেকে নামবার তোড়জোড় করছিল হরেন। এমন সময় তার নজর গিয়ে পড়ল দেওয়াল-ঘেঁষা জায়গাটায়। ওখানটায় মেলা গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল। কামিনী ঝোঁপের লাগোয়া একখানা ফাঁদালো গন্ধরাজ লেবুর ছড়ানো গাছ। নীচেটায় ভারী অন্ধকার। সেইখানে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে কার যেন দু’খানা ঠ্যাং একটুখানি বেরিয়ে আছে। পায়ের পাতা দুটো উপর দিকে ওলটানো, তার মানে লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে।
দৃশ্যটা দেখে হাত-পা একটু ঝিমঝিম করে উঠল হরেনের, সর্বনাশ! কার আবার কী হল রে বাবা! তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে গাছের ঘষটানিতে বুকের নুনছাল উঠে গেল হরেনের। নেমেই হাঁফাতে হাঁফাতে সে লেবুতলায় হাজির হয়ে যাকে দেখতে পেল, সে মোটেও চেনা মানুষ নয়। মাথা ন্যাড়া, তাতে আবার টিকিও রয়েছে, পরনে হেঁটো ধুতি, গায়ে একটা জামা। কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপারটা হল, জামাটা উলটে আছে বলে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, লোকটার কোমরের কষিতে একটা ঝকঝকে পিস্তল।
হরেনের চেঁচামেচিতে লহমায় লোক জড়ো হয়ে গেল।
বীরেনবাবু কাহিল গলায় বললেন, “কী সব্বোনেশে লোক! পিস্তল নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে! দেখে তো মনে হয়েছিল ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না!”
বটু গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি তখনই বলেছিলাম কিনা কর্তাবাবু, ভেচকুড়ি-কাটা লোককে মোটেও বিশ্বাস নেই।”
বীরেনবাবু আরও গম্ভীর হয়ে বললেন, “কিন্তু কাজটা কি তুই ভাল করলি বটু?”
“কোন কাজটা?”
“এই যে লোকটাকে খুন করে ফেললি? খুনটুন নিজের হাতে করা কি ভাল রে? বরং পুলিশকে জানালেই তো হত!”
বটু আকাশ থেকে পড়ে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “কী বলছেন কর্তাবাবু? জীবনে মশা-মাছিটা অবধি মারিনি, আর আমি অমন দশাশই লোককে খুন করতে যাব? দক্ষিণের দাওয়ায় বসিয়ে শশা আর মুড়ি খেতে দিয়ে আমি তো ঘানি থেকে সরষের তেল আনতে গিয়েছিলুম। ফিরেই চেঁচামেচি শুনে এসে দেখি এই কাণ্ড!”
বীরেনবাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, “তা হলে একে মারল কে?”
একচন্দ্র নিবিষ্ট মনে হাঁটু গেড়ে বসে লোকটার নাড়ি দেখছিল। মাথা নেড়ে বলল, “না হে, মরেনি। তবে মাথায় আর ঘাড়ে চোট হয়েছে দেখছি। চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দিলে জ্ঞান ফিরতে পারে।”
বিজয়বাবু বললেন, “দাঁড়াও বাপু, জ্ঞান ফেরার আগেই ওর অস্ত্রটা সরিয়ে নেওয়া দরকার। জ্ঞান ফেরার পর কোন মূর্তি ধরে তার ঠিক কী?” এই বলে তিনি গিয়ে লোকটার কোমর থেকে সাবধানে পিস্তলটা খুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, “এ তো বেলজিয়ামে তৈরি অত্যাধুনিক জিনিস। এরকম একটা পেঁয়ো টিকিধারী লোক এটা পেল কোথায়?”
বীরেনবাবু বললেন, “হয়তো কুড়িয়ে টুড়িয়ে পেয়েছে।”
বিজয়বাবু মাথা নেড়ে বললেন, “এ জিনিস রাস্তায়-ঘাটে কুড়িয়ে পাওয়া শক্ত। লোকটা হয় ডাকাত, না হয় ছদ্মবেশী পুলিশ।”
ব্রজবিহারী সভয়ে বললেন, “ও বাবা! তা হলে জ্ঞান ফেরার আগেই ওর হাত-পা বেঁধে ফেলা হোক। সাবধানের মার নেই!”
বিজয়বাবু মৃদু হেসে বললেন, “তার দরকার নেই। মূর্ছা ভাঙলেও লোক চট করে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠার অবস্থায় থাকে না। তার উপর এর মাথায় আর ঘাড়ে চোট রয়েছে। বটু বরং গিয়ে বনবিহারী ডাক্তারকে ডেকে আনুক।”
চোখে-মুখে বেশ কিছুক্ষণ জলের ছিটে দেওয়ার পর লোকটা চোখ চাইল বটে। কিন্তু চোখের চাউনি ভ্যাবলা আর ফ্যালফ্যালে। যেন কিছুই বুঝতে বা চিনতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ টালুমালু করে চারদিকটা দেখার চেষ্টা করে হঠাৎ ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “লোকটা কোথায় গেল? অ্যাঁ! লোকটা?”
সবাই মুখ তাকালাকি করে অবশেষে বিজয়বাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কে হে, কার কথা জিজ্ঞেস করছ?”
“ওই যে সবুজ রঙের লোকটা!” সবুজ রঙের লোক শুনে একচন্দ্র মাথা নেড়ে বলল, “মাথায় চোট হলে অনেক সময় লোকে ভুলভাল বলে। সবুজ লোক কোথা থেকে আসবে? ওহে বাবু, সবুজ পোশাক পরা কাউকে দেখেছ নাকি?”
লোকটা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চেটে বলল, “একটু জল দেবেন? বড্ড তেষ্টা পেয়েছে।”
জল খেয়ে লোকটা যেন একটু ধাতস্থ হল। হাতে ভর দিয়ে উঠে বসবারও চেষ্টা করতে লাগল।
বীরেনবাবু বীরের গলাতেই বলে উঠলেন, “উঁহু, পালানোর চেষ্টাও কোরো না, পুলিশে খবর দিতে লোক গিয়েছে। এই এল বলে। পিস্তল নিয়ে দিনেদুপুরে লোকের বাড়িতে ডাকাতি করতে ঢোকা বের করছি তোমার।”
বটু আর হরেন গিয়ে ঘরে লোকটাকে বসানোর পর লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “ডাকাত নই মশাই!”
“তবে তুমি কে?”
“বলা বারণ আছে।”
“ওসব চালাকি করে পার পাবে না হে। শক্ত পাল্লায় পড়েছ।” লোকটা জবাব দিল না। মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর দুর্বল গলায় বলল, “আমার পিস্তলটা কি ফেরত দেবেন?”
বীরেনবাবু আঁতকে উঠে বললেন, “পিস্তল! পিস্তল ফেরত চাও? তুমি তো বিপজ্জনক লোক হে! পিস্তল নিয়ে নিজের মূর্তি ধরবে বুঝি?”
লোকটা ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি খুব ভাল লোক নই বটে। কিন্তু আপনাদের কোনও ক্ষতি করতে আসিনি।”
বিজয়বাবু ঠান্ডা মাথার মানুষ। নরম গলায় বললেন, “তুমি কে তা না হয় না বললে। কিন্তু ঘটনাটা কীভাবে ঘটল, কে তোমাকে মারধর করল, সেটা তো বলতে পারো?”
“একজন সবুজ মানুষ।” হরেন বলে উঠল, “ও তো…।”
কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না, বিজয়বাবু একটা ধমক দিয়ে বললেন, “বেশি কথা না বলে দৌড়ে গিয়ে এক কাপ গরম দুধ নিয়ে আয় তো৷”
হরেন মিইয়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
বীরেনবাবু সখেদে বললেন, “চোর-ডাকাতকে গরম দুধ খাওয়ানোটা কি ঠিক হচ্ছে বিজয়দাদা? এরকম আপ্যায়ন হলে যে ঘনঘন তারা এসে এ বাড়িতে চড়াও হবে? ওদের সঙ্গে কুটুম্বিতা কি ভাল?”
বিজয়বাবু উত্তেজিত না হয়ে মৃদু হেসে বললেন, “দ্যাখো বীরেন, লোকটা চোর-জোচ্চোর কি না তা এখনও জানা যায়নি। লোকটা উন্ডেড, অসুস্থ। শুশ্রূষা দরকার। চোর-ডাকাত বলে মনে হচ্ছে না আমার।”
এ বাড়িতে বিজয়বাবুকে সবাই একটু খাতির করে। একসময় বড় কলেজে বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। বিয়েটিয়ে করেননি। এখন এই বাড়িতে নিজের মতো একটা ল্যাবরেটরি করে গবেষণা নিয়ে আছেন। কিন্তু তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনা আর কাণ্ডজ্ঞান অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যক্তিত্বও সাংঘাতিক। চাপা স্বভাবের মানুষ বলে কেউ তাঁকে বড় একটা ঘটায় না।”
গরম দুধটুকু লোকটা এক চুমুকে শেষ করে বলল, “এবার আমাকে ছেড়ে দিন।”
বীরেনবাবু বললেন, “ছেড়ে দেব মানে? তুমি কে, কোন মতলবে এখানে উদয় হয়েছ, নামধাম, ইতিবৃত্তান্ত কী, এসব
জেনেই ছেড়ে দেব নাকি? পুলিশ আসুক, তারপর যা ব্যবস্থা হওয়ার হবে।”
বিজয়বাবু নরম গলাতেই বললেন, “উঠে দাঁড়াতে পারবে?”
“পারব।”
“তা হলে এই ভেজা মাটিতে বসে না থেকে ওই দাওয়ায় গিয়ে বসবে চলো।”
“আমি চোর-ডাকাত নই, আবার ভিখিরি-কাঙালও নই। এখানে একটা জরুরি কাজে এসেছিলাম।”
“কাজটা কী?”
“সবুজ মানুষ।”
“সবুজ মানুষ বলে কিছু নেই। ওটা আষাঢ়ে গল্প।”
“আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমি ওই বারান্দাটায় বসে মুড়ি খাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি, এই ঝোঁপঝাড়ের ভিতর অন্ধকার থেকে একটা লম্বা, ঘন সবুজ রঙের মানুষ উঁকি দিচ্ছে। যা শুনেছিলুম, হুবহু সেইরকম।”
হঠাৎ বিজয়বাবুর চোখ দুটো যেন ধক করে জ্বলে উঠল। চাপা হিংস্র গলায় বললেন, “কী শুনেছিলে?”
“এখানে সবুজ রঙের মানুষ আছে।”
“এরকম অবাস্তব গল্প কে তোমাকে বলেছে? সবুজ মানুষ থাকলে আমরা দেখতুম না? আর তুমি কোমরে পিস্তল নিয়ে সবুজ মানুষ খুঁজতে এসে ভয়ংকর অন্যায় করেছ। যদি ভুল দেখে গুলি চালিয়ে দিতে তবে একজন নিরীহ মানুষ মারা পড়তে পারত?”
“গুলি চালানোর হুকুম নেই। আমি চালাইওনি গুলি।”
“তবে পিস্তল নিয়ে এসেছিলে কেন?”
“আত্মরক্ষার জন্য।”
“আত্মরক্ষার নামে দুনিয়ায় অনেক খুনখারাপি হয়ে থাকে। ওই অজুহাতটা আমি বিশ্বাস করছি না। ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে আমি মেনে নিচ্ছি যে, তুমি একটা সবুজ রঙের মানুষ দেখেছ। কিন্তু সে কি তোমার কোনও ক্ষতি করেছে?” ৪০
“ক্ষতি করেছে কি না সেটা তো নিজের চোখেই দেখছেন। আমার মৃত্যুও হতে পারত।”
“বিনা কারণেই কি লোকটা তোমাকে অ্যাটাক করেছিল?” লোকটা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমি সবুজমানুষ দেখে মুড়ির বাটি ফেলে ছুটে আসছিলাম। লোকটার কাছে পৌঁছোনোর আগেই একটা লম্বা হাত এসে আমার মাথায় হাতুড়ির মতো একটা ঘুসি মারল। আমি অজ্ঞান হওয়ার আগে দেখতে পেলাম, সবুজ লোকটা দৌড়ে গিয়ে এক লাফে ওই প্রায় দশ ফুট উঁচু দেওয়ালটা পার হয়ে গেল।”
একচন্দ্র বলল, “ওরে, হাইজাম্পের বিশ্বরেকর্ড যেন কত ফুট, একটু খোঁজ নিয়ে দ্যাখ তো!”
বিজয়বাবু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, “তোমার মাথার ঠিক নেই। তুমি ভুল দেখেছ এবং ভুল খবর পেয়ে এসেছ। এখন যা জিজ্ঞেস করছি তার জবাব দাও।”
“বলুন?”
“এই পিস্তলের লাইসেন্স কি তোমার আছে?”
“আছে।”
“না থাকলে কিন্তু বিপদে পড়বে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, তুমি কি ছদ্মবেশ পরে এসেছ? তোমার পোশাকের সঙ্গে কথাবার্তা মিলছে না।”
“হ্যাঁ, ছদ্মবেশ।”
“ছদ্মবেশ ধরার কারণ কী?”
“হুকুম হয়েছিল গাঁয়ের মানুষ সেজে আসতে।”
“কারা তোমাকে পাঠিয়েছে সেটা তুমি বলতে চাও না?”
“না।”
“আমাদের কাছে বলতে না চাইলেও পুলিশ কিন্তু তোমার কাছ থেকে কথা বের করবে।”
“আমি আপনার সঙ্গে একটু প্রাইভেটলি কথা বলতে চাই।”
বীরেনবাবু সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠে বললেন, “খবরদার না। ওসব প্রাইভেট কথা বলার নাম করে নির্জন, নিরিবিলিতে গিয়ে একটা হামলা করে পালানোর মতলব তো? সে হবে না।”
বিজয়বাবু শান্তভাবেই বললেন, “না রে, হামলা করার মতো অবস্থা এর এখনও নয়। তা ছাড়া আমার কাছে ওর পিস্তলটা তো আছেই। তোরা বরং আমার ঘরের বাইরে পাহারায় থাকিস। এসো হে, তোমার প্রাইভেট কথাই শোনা যাক।”
বিজয়বাবু লোকটাকে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাড়ির লোকেরা বাইরে পাহারায় রইল।
দরজা বন্ধ করে লোকটাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে বিজয়বাবু মুখোমুখি বসে বললেন, “এবার বলো কী বলতে চাও?”
লোকটা বলল, “আমাকে দয়া করে পুলিশে দেবেন না। আমি তেমন কোনও অপরাধ করিনি।”
“ট্রেসপাসিং এবং ছদ্মবেশে ঘোরা কি অপরাধ নয়?”
“প্রথম কথা আমি ট্রেসপাস করিনি। বাড়ির কর্তা বীরেনবাবুই আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিয়েছেন। আর ছদ্মবেশ অপরাধ হলে বহুরূপীদের ধরে ধরে জেলে পোরা হত।”
“বুঝলাম। কিন্তু তোমার উদ্দেশ্য কী? খুলে বলো!”
“সবটা বলার উপায় নেই। তবে আমার নাম অগ্নি। এই অঞ্চলে যে মাঝে মাঝে অদ্ভুত ধরনের সবুজ রঙের মানুষ দেখা যাচ্ছে, এই খবরটা পেয়েই আমার আসা। গত সাতদিন ধরে আমি এখানকার মাঠ, ঘাট, জঙ্গল চষে বেড়িয়েছি। কোনও সবুজ মানুষের দেখা পাইনি। বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি। কেউই সবুজ মানুষ দেখেছে বলে স্বীকার করেনি। আমার ক্রমে বিশ্বাস হচ্ছিল যে, এটা একটা গুজব ছাড়া কিছুই নয়। আমি ফিরে গিয়ে সেই কথাই কর্তৃপক্ষকে জানাব বলে ঠিক করেছিলাম। আর আজই আমার ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজকেই ভাগ্যক্রমে আমি এই বাড়িতে
একজন সবুজ মানুষের দেখা পেয়ে গিয়েছি।”
“তুমি ভুল দেখেছ।”
লোকটা মাথা নেড়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, “না মশাই, আমি একটুও ভুল দেখিনি। লোকটা বেজায় লম্বা, অন্তত সাড়ে সাত ফুট তো হবেই। রোগাটে কিন্তু জোরালো চেহারা, গায়ে আঁট করে পরা কালচে রঙের পোশাক। অনেকটা ডুবুরিদের পোশাকের মতো।”
“ডুবুরিদের সর্বাঙ্গ পোশাকে ঢাকা থাকে, গায়ের রং বোঝার উপায় নেই।”
“এ লোকটার মুখ, দুটো হাত আর হাঁটুর নীচের অংশ খোলা ছিল।”
বিজয়বাবু হাসলেন, বললেন, “তোমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। সাড়ে সাত ফুট লম্বা সবুজ রঙের কোনও লোক যদি এখানে থাকত, তা হলে গ্রামদেশে একটা হইচই পড়ে যেত। এরকম অদ্ভুতদর্শন কোনও লোককে এখানে কারও কখনও চোখে পড়েনি। পড়লে অবশ্যই আমাদের কানে সে খবর আসত।”
“আপনার কি মনে হচ্ছে আমি মিথ্যে কথা বলছি?”
“না। তাও মনে হচ্ছে না। কারণ, মিথ্যে করে এ গল্প বলে তোমার কোনও লাভ নেই। কিন্তু আমি তোমাকে বলতে চাইছি যে, তুমি যা দেখেছ তা একটা ইলিউশন মাত্র। গাছের ছায়ায় কেউ হয়তো দাঁড়িয়ে থাকলেও থাকতে পারে। ওই ঝোঁপঝাড়ের অন্ধকারে কারও গায়ের রং বোঝা সম্ভব নয়। তা ছাড়া তুমি একজন সবুজ রঙের লোককে খুঁজছিলে বলে তোমার ভিতরে একটা অটো সাজেশন তৈরি হয়েছিল। তাই বলছি, ওটা চোখের বিভ্রম ছাড়া কিছু নয়।”
লোকটা যেন একটু ধন্দে পড়ে গেল। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে একটু ভেবে তারপর মুখ তুলে বলল, “আপনি বিচক্ষণ মানুষ, তাই আপনাকে একটা ঘটনার কথা বলতে চাই।”
“বলো।”
“দিনতিনেক আগে রাজবংশীদের পোডড়া বাড়ির মাঠে একজন দেহাতি বুড়ি খুঁটে দিচ্ছিল। অনেক খুঁটে।”
“হ্যাঁ জানি। ও হল দুধওলা রামভরোসার মা গিরিজাবুড়ি।”
“অত খুঁটে দেওয়া দেখে আমি একটু অবাক হয়েছিলুম। কারণ, আজকাল কয়লা বা গুলের উনুনে রান্না করা একরকম বন্ধই হয়ে গিয়েছে। গাঁয়ের লোকও এখন গ্যাস বা কেরোসিনে রান্না করে। আমি তাই সেই বুড়িকে গিয়ে বললাম, এত খুঁটে কার জন্য দিচ্ছ গো মাসি? কে নেবে? তখন বুড়িটা একটুফুঁসে উঠে বলল, তোরা লা লিবি তো লা লিবি। হমার ঘুটিয়া হারা আদমিরা লিবে।”
“তার মানে?”
“হারা আদমি মানে সবুজ মানুষ। তখন আমি বুড়িকে ধরে পড়লাম। কিন্তু আমার আর একটি কথারও জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে ঘুঁটে দিয়ে যেতে লাগল। তার মানে কি এই নয় যে, ওই গিরিজাবুড়ির সঙ্গে সবুজ মানুষদের একটা যোগাযোগ আছে?”
বিজয়বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তুমি কি জানো যে, গিরিজাবুড়ি রোজ ভূত দেখতে পায়, রাজবংশীদের বাড়িতে পরিদের আনাগোনা টের পায় এবং তার দৃঢ় বিশ্বাস যে, জলার ওধারকার জঙ্গলে একটা রাক্ষসও বসবাস করে?”
“বুড়োবুড়িদের কথায় নানা অসংগতি থাকে একথা ঠিক। কিন্তু সবুজ মানুষের কথা বলেছিল বলে আমার একটু বিশ্বাস হয়েছিল।”
“গিরিজাবুড়ি রোজ আমাদের বাড়িতে শাক তুলতে আসে। সারাক্ষণ বকবক করে যায়, যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই।”
অগ্নি নামের লোকটা কিছুক্ষণ নিজের করতলের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “তা হলে আপনি বলছেন যে, এখানে সবুজ মানুষের অস্তিত্ব নেই?”
“না, নেই।”
“আপনি কি একজন বৈজ্ঞানিক?”
“দুর পাগল! বৈজ্ঞানিক বললে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তবে কলেজে বিজ্ঞান পড়াতাম। আমার গবেষণার খুব শখ ছিল বলে একটা ছোট ল্যাবরেটরি করেছি। সেটা আমার খেলাঘর বলতে পারো। কাজের কাজ কিছুই হয় না।”
“আমি কি এখন যেতে পারি?”
“অবশ্যই। পুলিশে সত্যিই খবর দেওয়া হয়েছে কি না তা অবশ্য আমি জানি না। তুমি বরং আর বেশি দেরি না করে রওনা হয়ে পড়ো। এই নাও তোমার পিস্তল।”
“ধন্যবাদ।”
“পিস্তলটা দেখে মনে হচ্ছে খুব দামি।”
“হ্যাঁ। পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা পিস্তলগুলোর একটা।”
“তুমি কি খুব বিপজ্জনক জীবনযাপন করো?”
“আমার কাজ কিছুটা হ্যাঁজার্ডাস। তা হলে আমি…!”
“এসো গিয়ে।” বিজয়বাবু অগ্নিকে সঙ্গে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। উদ্বিগ্ন মুখে সবাই বাইরে অপেক্ষা করছে দেখে বললেন, “একে তোমরা ছেড়ে দাও। এ কোনও বদ মতলবে এ বাড়িতে আসেনি।”
অগ্নিকে ফটক পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন বিজয়বাবু। অগ্নি চলে যাওয়ার পর তাঁর কপালে জাকুটি দেখা দিল।
বীরেনবাবু বললেন, “লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে ভাল কাজ করলে না দাদা।”
“ছেড়ে দিয়েছি কে বলল?”
“এই যে গটগট করে হেঁটে চলে গেল?”
“ও আবার আসবে। এবার অন্য মূর্তি ধরে। ওর সন্দেহ যায়নি।”
“কিন্তু পুলিশে তো দেওয়া যেত!”
“কোন আইনে? অপরাধ তো কিছু করেনি। তুই ওকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিস, সুতরাং ট্রেসপাসার নয়, চুরি-ডাকাতি করেনি, কারও উপর হামলাও করেনি। বরং নিজেই মারধর খেয়েছে।”
“কিন্তু বেআইনি পিস্তলটা?”
“আমার যতদূর ধারণা, পিস্তলের লাইসেন্স ওর আছে। তা তুই-ই বা ওকে রাস্তা থেকে ডেকে ঘরে আনতে গেলি কেন?”
বীরেনবাবু বললেন, “সব দোষ ওই বটুর। ও এসে বলল, লোকটা নাকি ওকে ভেকুড়ি দেখিয়েছে।”
বিজয়বাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, “ভেচকুড়ি! সেটা আবার কী?” বীরেনবাবু মাথা নেড়ে বললেন, “আমি জানি না, বটু জানে।”
বটু তাড়াতাড়ি বলল, “ওঃ, ভেকুড়ি বড্ড ভয়ের জিনিস মশাই। চোখ দুটো তাড়াং তাড়াং হয়ে যায়, মুখোনা যেন দুনো ফুলে যায়, আর হাঁ-এর ভিতর দিয়ে যেন আলজিভ অবধি দেখা যায়…! না, সে বলা যায় না।” বিজয়বাবু বললেন, “বাচ্চারা তো ওরকম করেই এ-ওকে ভ্যাঙায়। তাতে ভয় পাওয়ার কী আছে?”