- বইয়ের নামঃ সঞ্জীবের সেরা ১০১
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অঙ্কই ভগবান
দু মাইলের মতো জঙ্গল। তারপর একটা মিষ্টি নদী। সুইট রিভার। তার ওপর বন্ধুর মতো একটা সেতু। সেতু পেরোলেই ছবির মতো সেই গ্রাম। কুতুবপুর। ইতিহাস। কুতুবুদ্দিন আইবক এই গ্রামের বটতলায় বসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার শান্তি। যুদ্ধ করবে বলবান গিয়াসুদ্দিন বলবন। মরুক বাঁচুক দেখার দরকার নেই আমার। মাথার টুপি খুলে বাতাসে উড়িয়ে দিল। অলৌকিক ব্যাপার! টুপিটা পায়রা হয়ে উড়ে গেল নীল আকাশে। সেই থেকে পায়রার নাম হল ‘কবুতর।’ সেই পায়রা দেড় মাইল দূরে যে গ্রামে গিয়ে বসল সেই গ্রামের নাম হল কবুতর গঞ্জ। যত ভালো ভালো পায়রা, বনেদি পায়রা একমাত্র ওই গ্রামে পাওয়া যায়। দেশ-বিদেশের শান্তি উৎসবে চালান যায়। অর্ডার আসে সেন্ড আস এ পেটি অফ শান্তির শ্বেত পারাবত। কুতুবুদ্দিন বিরাট একটা মসজিদ তৈরি করলেন জরির কাজ করা। নাম হল ঝিলমিল মসজিদ। সেখানে বসে বাকি জীবন শুধু গান লিখে নিজের সুরে গাইতে লাগলেন। সেই ধারার গানের নাম হল ‘কাওয়ালি’।
এমন একটা ঐতিহাসিক জায়গা অবশ্যই যাব। যাবই যাব। কেউ আটকাতে পারবে না। আমি আর শংকর রেডি। শঙ্কর শুধু সাহসী নয় দুঃসাহসী। ভূত ছাড়া কারওকে ভয় পায় না। টেরিফিক, ডেঞ্জারাস এই সব বিশেষণ ওর জন্যেই তৈরি হয়েছে। কুতুবপুরেই শঙ্করের মামার বাড়ি। বড়মামা একসময় শিকারি ছিলেন। বেজায় বড়লোক।
মাইল দুয়েক ঘুটঘুটে জঙ্গল। বাঘ আছে। থাকা উচিত। বাঘ না থাকলে জঙ্গলের ইজ্জত থাকে না। শঙ্কর বললে, কোনও ভয় নেই, আজ শুক্রবার, বাঘদের ফাস্টিং ডে।
‘কে বললে?’
‘ব্যাঘ্রপুরাণে আছে।’
হাঁটছি, হাঁটছি। বিউটিফুল লাগছে। দু-পাশে ছোলাখেত। কয়েক আঁটি ছিঁড়েছি। কাঁচা সবুজ। ছোলা। ফ্যান্টাসটিক। জঙ্গল শুরু হল। প্রথমে পাতলা। তারপর দু-পাশ থেকে চেপে এল। পথ বলে কিছু নেই। পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে কচমচ করে হাঁটছি। দুঃসাহসী সব গাছ চারপাশে। রোদ পড়ে আছে বাইরে।
হঠাৎ! যাঃ পথ নেই। পাহাড়ের গুহা যেমন হয়, এ দেখি তেমন বিশাল ঝোপের গুহা। জঙ্গলের টানেল। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকব কি ঢুকব না! বলের মতো বড় বড় দুটো লাল আলো পাশাপাশি। ধকধক করছে। ‘ওরে বাঘ রে!’
বাঘটা কীরকম একটা শব্দ করে বিশ্রীভাবে বেরিয়ে এল অসভ্যের মতো। পেছন ফিরে দে ছুট করতে গিয়ে অবাক। পেছনে একটা বাঘ। ডান পাশে একটা, বাঁ পাশে একটা। চারটে কেঁদো, ঘিরে ধরেছে।
প্রথম বাঘটা একটা থাবা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়টা বুক কাঁপানো শব্দে প্রথমটার থাবাটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল। নিমেষে আমাদের দুজনকে নিয়ে চারটে বাঘের মধ্যে ঝটাপটি বেঁধে গেল–রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
আমরা পালিয়ে এলুম।
শঙ্কর বললে, ‘কীভাবে বাঁচলুম বল তো?
‘ভগবান!’
‘ধূত! অঙ্ক! ম্যাথেমেটিক্সের জোরে বাঁচলুম। চারটে বাঘ, দুটো মানুষ। চারটে বাঘ চারটে মানুষ হলে এতক্ষণে বাঘের পেটে। একটা বাঘ একটা মানুষ। ভাগের গোলমালে বেঁচে গেলুম রে। চারটে বাঘ দুটো মানুষ। চল, এবার অন্য পথে যাব। নদী পথে।’
অঞ্জলি
স্নান করে ঠাকুরঘরে ঢুকেই প্রভাত অবাক হয়ে গেল। গত পাঁচ বছরে এরকম ব্যতিক্রম তার কখনও চোখে পড়েনি। পুজোর সব আয়োজন ঠিক রয়েছে কিন্তু ফুল কোথায়? ফুলের থালা গঙ্গাজলের ঘটির ওপরে বসানো, কিন্তু থালা শূন্য। এক থালা ভর্তি লাল আর সাদা ফুল—সেই পরিচিত পবিত্র দৃশ্য আজ অনুপস্থিত! এই সময়টা তার খুব তাড়া থাকে। ৮টা পঞ্চান্নর ট্রেন ধরে তাকে কলকাতায় ছুটতে হবে। দশটায় অফিস। এক মিনিট এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। অথচ অফিস বেরোবার আগে কুলদেবতার পুজো করতেই হবে। ঠাকুরঘর থেকে গলা বাড়িয়ে প্রভাত চিৎকার করতে লাগল—কল্যাণী, আমার পুজোর ফুল কই? কী যে করো বুঝি না। একে দেরি হয়ে যাচ্ছে! কল্যাণী আঁচলে রান্নার হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এল। কী হয়েছে কী, চেঁচাচ্ছ কেন? ফুল নেই?
থাকলে চেঁচাই, নেই বলেই তো চেঁচাচ্ছি।
সে কী, পুতুল সেই সাতসকালেই ফুল তুলতে গেল! এখন বাজে ক’টা?
ক’টা আর সাড়ে সাতটা হবে, রেডিয়োয় খবর হচ্ছে।
সে কী গো, মেয়ে তো সেই ছয়টায় বাগানে গেল ফুল তুলতে। কোনওদিন তো এত দেরি করে না! দাঁড়াও দেখছি কী হল!
দেখতে দেখতেই বাজিমাত। বিনা ফুলেই পুজো করি। প্রভাত খুঁতখুঁত করতে করতে পুজোর আসনে বসল। কল্যাণী তাড়াতাড়ি মেয়েকে খুঁজতে গেল। উনুনে ভাত ফুটছে। একটু পরেই প্রভাত খেতে বসবে। তার আবার সাত্বিক ব্যাপার। নিরামিষ ভাতে ভাত খাওয়াই তার অভ্যাস। কোনওদিন একটু ঘি থাকে, কোনওদিন থাকে না। খাওয়ার ব্যাপারে প্রভাতের কোনও দৃকপাত নেই। কিন্তু পুজোর আয়োজনে সামান্য ত্রুটিও তার সহ্য হয় না।
আজ দশ বছর কি তারও বেশি হবে, পনেরো বছরও হতে পারে, কল্যাণীর ঠিক মনে পড়ছে না
তাদের বিয়ে হয়েছে। সুখের সংসারই বলা চলে। কোনও ঝামেলা নেই, নিঝঞ্চাট। একটি মাত্র মেয়ে বারো-তেরো বছর বয়স। ফুটফুটে সুন্দর। প্রভাতের বিয়ে করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। জোর করে ধরে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় দু-ভাই সন্ন্যাসী। পরিবারে অন্তত এই ভাইও যদি বিয়ে না করে বংশরক্ষা হয় কী করে?
এঘর-ওঘর পড়ার ঘর, সব ঘর খুঁজে দেখল কল্যাণী। না, সারা ঘরবাড়ির কোথাও পুতুল নেই। কী হল মেয়েটার? সেই সাতসকালে বাড়ির পিছনের বাগানে ফুল তুলতে গিয়েছিল। রোজই সে যায়। ফুল তোলা এমন কিছু শক্ত কাজ নয়। ফুল তোলার মতো বয়স তার হয়েছে। সকাল থেকে কল্যাণীকে এত ব্যস্ত থাকতে হয়—চা, জলখাবার, খাবার! পুতুল তাই ইদানীং মাকে ফুল তোলার কাজ থেকে ছুটি দিয়ে নিজেই সে কাজ করে। তার ভালো লাগে। ভোরের পাখি গাছে গাছে। ফুলে ফুলে চারিদিক সাদা হয়ে থাকে। গ্রীষ্মের সকাল যেন এক অসাধারণ কিছু। ঠিক রোদ উঠার আগের মুহূর্তে, পৃথিবী আর আকাশের মাঝখানে একটা হালকা কুয়াশার চাদর কাঁপতে থাকে। ফুল তোলার ফাঁকে ফাঁকে সে একটু আকাশ দেখে নেয়। কখনও নাম না-জানা কোনও পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে অবাক হয়ে।
বাড়িতে যখন কোথাও মেয়েকে পাওয়া গেল না, তখন কল্যাণী পিছনের দিকে দরজা খুলে বাগানে চলে গেল। একবার মনে হল উনুনে ভাত ফুটছে, বোধহয় বেশি সিদ্ধ হয়ে গেল। প্রভাত আবার গলা ভাত খেতে পারে না। তারপর ভাবল একদিন না হয় খাবে, আগে দেখি মেয়েটা। কোথায় গেল। কল্যাণী ভেবেছিল বাগানের কোথাও হয়তো দেখবে গাছের তলায় কি পুকুরঘাটে বসে আছে চুপ করে, কি ঘুমিয়েই পড়েছে হয়তো কিংবা কোনও বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মত্ত।
খুব একটা বড় বাগান নয়। এ-কোণ ও-কোণ ঘুরে দেখতে বেশি সময় লাগল না। না, কেউ কোথাও নেই। পুকুরঘাটেও কেউ নেই! টলটলে জলের ওপর গাছের ছায়া দুলছে। পোষা মাছটা ঘাটের ধারে এসেছে খাবার আশায়। এসব দেখার সময় কল্যাণীর নেই। এইবার সে খুব ভাবনায় পড়ল। কোথায় গেল মেয়েটা? কখনও না বলে বাড়ির বাইরে যায় না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে উনুন থেকে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে রাখল—ফ্যান গালার কথা তার মনেই রইল না। হাত দুটো কোনওরকমে আঁচলে মুছেই ঠাকুরঘরে দৌড়োল। দরজার বাইরে থেকে দেখল প্রভাত আসনে স্থির হয়ে বসে আছে, দু-চোখের কোল বেয়ে জলের বিন্দু নেমেছে। খুব পরিচিত দৃশ্য। ওই দৃশ্য কল্যাণীর মনে কেমন একটা নির্ভরতার ভাব আনে। তার মনে হয় যার স্বামী এত ভক্ত, যে বাড়িতে এত পুজোআচ্চা, সে-বাড়িতে কোনও অমঙ্গল আসতে পারে না। কল্যাণীর মন থেকে কিছুক্ষণের জন্যে পুতুলের চিন্তা চলে গেল।
প্রভাত আসন ছেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণী তাকে খবরটা জানাল। বাড়ির কোথাও পুতুলকে পাওয়া যাচ্ছে না। ধ্যানের পর প্রভাতকে কেমন প্রশান্ত সুন্দর দেখাচ্ছিল! প্রভাতের মুখে কোনও বিকৃতি দেখা গেল না। শুধু জিগ্যেস করল, কটা বেজেছে। কল্যাণী বলল, ঘড়ি দেখিনি। প্রভাত
অনুমানের ওপর সময় ঠিক করে নিল। বলল, ঠিক আছে, আমি দেখছি, কোথায় আর যাবে, হয়তো আশেপাশে কোনও বাড়িতে গেছে।
কিন্তু এমন তো কোনওদিন করে না।
আহা ছেলেমানুষের খেয়াল। কী ভেবেছে, কোথায় কার বাড়িতে গিয়ে বসে আছে।
বলে যাবে তো!
ঠিক আছে, তুমি রান্নার কাজে যাও আমি দেখছি।
কল্যাণী রান্নাঘরে গেল। প্রভাত পুজোর চেলি ছেড়ে বাড়ির বাইরে বেরোল মেয়েকে খুঁজতে।
দূরে রেলের লাইন পাতা। সিগন্যাল পড়েছে। ডাউনের দিকে কোনও ট্রেন আসছে। প্রভাত বাড়ির বাইরে এসে একবার ভেবে নিল, এখন সে কী করবে! প্রথমে সে বিনোদবাবুর বাড়ি গিয়ে খোঁজ করল। সকালে প্রভাতকে দেখে সকলেই আশ্চর্য হলেন; বিনোদবাবুর মেয়ে ফুলা বলল— না, পুতুল তো আসেনি। আজ কেন সে গত দুদিন আসেনি। বিনোদবাবু প্রভাতকে বসতে বললেন।
না, এখন আর বসব না। বেরোতে হবে। তার আগে মেয়েটাকে খুঁজে দেখি!
কোথায় আর যাবে? কাছাকাছি কোথাও আছে।
প্রভাত একে একে পাড়া-প্রতিবেশী সকলের বাড়ি দেখল! না কোথাও পুতুল নেই এবং আসেওনি। সকাল থেকে তারা কেউ দেখেনি।
প্রভাতের মুখে বেশ ভাবনার রেখা পড়ল। মোক্ষদা পিসি বলেলেন—সে কী বাবা, দিনকাল বড় খারাপ। শুনছি, একটা করে ফুল শুঁকতে দিচ্ছে, তারপর ছেলে আর মেয়েগুলো সুড় সুড় করে। ছেলেধরার পিছু পিছু গ্রামের বাইরে চলে যাচ্ছে।
প্রভাত এসব বিশ্বাস করে না। পিসি কেমন আছ? বলে পাশ কাটিয়ে চলে এল।
কী হল একবার খবরটা দিয়ে প্রভাত? বড় চিন্তায় রইলুম। প্রভাত ‘আচ্ছা’ বলে বাড়িমুখো হল।
কল্যাণী মুখে একরাশ চিন্তা মেখে দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল প্রভাতের খবরের আশায়।
ভেবেছিল পুতুলের হাত ধরেই হয়তো সে এসে হাজির হবে আর কল্যাণী পুতুলকে খুব বকবে। এতক্ষণের উৎকণ্ঠা বকুনিতে ভেঙে পড়বে। স্বামীকে দেখে মাথায় ঘোমটা তুলে দিল।
পুতুল কোথাও নেই, কোনও বাড়িতেই সে যায়নি। সকাল থেকে তাকে কেউই দেখেনি।
সে কী?
এখন কী করা যাবে?
প্রভাতও জানে না, এর পর কী করার আছে। শুনেছে এর পর পুলিশে খবর দিতে হয়। খোঁজার পরিধি তখন আরও বেড়ে যাবে। গ্রাম থেকে গ্রামে, জেলা থেকে জেলা শহরে, কলকাতায়। সারা বাংলা কিংবা সারা ভারতবর্ষে থানায় থানায় খোঁজপত্র চলে। এসব তার শোনা আছে। নিজের জীবনে এইরকম একটা সমস্যা নেমে আসবে তার ধারণার অতীত।
আজ আর অফিস যেয়ো না।
সে তো বটেই।
এর পর চুপচাপ দুজন মুখোমুখি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। কোনও কথা মুখে জোগাল না। সব কথা যেন হঠাৎ ফুরিয়ে গেছে। প্রভাত হঠাৎ বলল—চলো তো আর একবার বাগানটা দেখি। কল্যাণী আর প্রভাত বাগানে এল। স্থলপদ্মের গাছে বড় বড় ফুল ফুটেছে! টগর গাছ সাদা হয়ে আছে ফুলে। ছোট ছোট গোটাকতক প্রজাপতি ছটফট করে উড়ে বেড়াচ্ছে। সব জায়গা তারা। খুঁজল, আর একবার খুঁজল। যেন খুব ছোট একটা জিনিস হারিয়েছে। একবারের খোঁজায় হয়তো চোখ এড়িয়ে গেছে। হয়তো পুতুল দুষ্টুমি করে চোর চোর খেলছে, গাছের আড়ালে আড়ালে। লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। দুজনে দুদিক থেকে খুঁজল। না পুতুল নেই।
প্রভাত এসে ঘাটের বাঁধানো রকে একটু বসল। জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে লাগল —এর পর কী করবে? সত্যি থানায় যেতে হবে? না হঠাৎ পুতুল এসে ‘মা, মা’ করে ডাকবে। জলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রভাত একটা জিনিস লক্ষ করল, পশ্চিম পাড়ে যেখানে জবাগাছের একটা ডাল জলের ওপর ঝুঁকে এসেছে তার একটু দূরে একরাশ ফুল জলের ওপর ভাসছে। জবা গাছ থেকে একটা-দুটো ফুল জলে পড়া বিচিত্র নয়। কিন্তু টগর এল কোথা থেকে? টগর গাছ তো। জল থেকে অনেক দূরে। জলের ওপর সাদা আর লাল একরাশ ফুলের অঞ্জলি কে ছড়িয়ে দিল?
স্বামীর পাশে এসে কল্যাণীও বসল।
প্রভাত শুধু বললে, দেখেছ। একটা জায়গাতেই কত লাল আর সাদা ফুল একসঙ্গে ভাসছে! কে যেন অঞ্জলি দিয়ে গেছে।
কল্যাণী অন্যমনস্ক। জিগ্যেস করে বসল, কেন?
প্রভাত বললে, কেন? মনকে শক্ত করো কল্যাণী। এই কেন-র উত্তর বড় সাংঘাতিক। মাঝপুকুরে ওটা কী ভাসছে দেখেছ? একটা সাজি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুকুরে জাল নামানো হল। সামান্য অনুসন্ধানেই জালে জড়িয়ে উঠে এল পুতুলের দেহ। ফুল ছাপ ফ্রক পরা এক সুন্দরী কিশোরী। যেন এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে, সে ঘুম আর ভাঙবে না কোনওদিন।
প্রভাত শুধু এই বলতে পারল, মা, এই ক’টা বছরের জন্যে মায়ার বাঁধনে কেন বাঁধতে এসেছিলিস! কার পুজো করছিলিস, বিরাটের? সে যে বড় নিষ্ঠুর!
তারপর কত বছর গড়িয়ে গেল রেলগাড়ির মতো জন্ম-মৃত্যুর জোড়া লাইন ধরে। প্রভাতের। ঠাকুরঘর এখন ওই দিঘির পাড়। রোজ সকালে সে নিজে ফুল তোলে, লাল আর সাদা। সাজি ভরে। প্রভাত আর কল্যাণীর বয়েস বেড়েছে। চুলে পাক ধরেছে, কপালে সময়ের রেখা পড়েছে। বয়েস বাড়েনি পুতুলের। সে এখনও সেই কিশোরী। প্রভাত যখন ফুল তোলে, গাছের আড়ালে। সে ঘোরে। প্রভাত তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, ‘বাবা! এদিক এসো, এদিকে। দেখ, এই ডালে কত ফুল!’ সাজি ভরতি ফুল আর ঠাকুরঘরে যায় না। প্রভাত প্রণামের ভঙ্গিতে দিঘির পাড়ে বসে সেই সমস্ত ফুল অঞ্জলি দেয় জলে। ভাসতে থাকে লাল আর সাদা ফুল। এই তো তোমার পূজা! আছ অনল, অনিলে, চির নভোনীলে। ভূধর সলিল গহনে।
আকাশ
মনীশ সান্যাল নীরবে বেশ কিছুক্ষণ সিগারেট টানলেন। মাথার ওপর ধোঁয়ার একটা চন্দ্রাতপ তৈরি হয়ে গেল। দু-পাশে দুটো বড় বড় জানলা। ভীষণ ঝোড়ো বাতাস বইছে বলে শার্সি বন্ধ। ঘরটা দশতলায়। বাইরে কলকাতার রাতের আকাশ। নীচে বিত্তবান মানুষের পল্লি। আলোর বাহার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চোখে পড়ছে। আলোয় উদ্ভাসিত। মনীশ তাকিয়েছিলেন মেমোরিয়ালের দিকে। হঠাৎ যেন ঘরে ফিরে এলেন। সিগারেট অ্যাশট্রে-তে গুঁজে দিয়ে বললেন, হয়নি। আপনার এই পরিশ্রমের পুরোটাই বরবাদ হয়ে গেল। মৌলিক কোনও চিন্তা নেই।
টেবিলের উলটোদিকে বসেছিলেন সুধেন্দু মুখার্জি। মধ্যবয়সি সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। মুখে একটা জ্যোতি। সোনার ফ্রেমের চশমায় জ্বলজ্বল করছে। কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে সুধেন্দুমুখ তুলে তাকালেন মনীশের দিকে। এতটুকু আহত না হয়ে বললেন, আমারও তাই মনে হয়েছে। ধরতাইটা ভালোই হয়েছিল। তারপর আর প্রলোভন জয় করতে পারলুম না। ফাঁদে পা। দিয়ে ফেললুম। ইমাজিনেশানের দারিদ্র। তুমি ঠিকই ধরেছ। একটা সময়ে আমার মনে হল, ধরতে হবে। কেউ যেন পালাতে না পারে। সব দিক থেকে ঘিরে ফেলতে হবে। একেবারে অভিমন্যু করে ফেলতে হবে। একের পর এক আসে আর যায়। একটাও স্ট্র্যান্ড করে না। সব ডিগবাজি।
মনীশ বললেন, সে আমি বুঝেছি, আপনি একটা বোম্বাই-বাংলা পাঞ্চ করতে চেয়েছেন। বিদেশি বোতলে বাংলা মদ।
সুধেন্দু বললেন, আমি ঠিক তা চাইনি। আমার একটা সলিড থিম ছিল; কিন্তু পায়ে পায়ে চলে গেল সেই গতানুগতিক দিকে। কিছুতেই আর ফেরাতে পারলাম না। জানো তে সৃষ্ট চরিত্র নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে। কাগজের ওপর অক্ষরমালায় জন্ম। প্রাণ থাকা উচিত লেখকের হাতে। লেখক হঠাৎ আবিষ্কার করে তারা নিজেরাই প্রাণ পেয়ে, নিজেরাই চলতে শুরু করে। লেখকের কাজ তখন হয় অনুসরণ করা। যেমন চালাও তেমনি চলি।
সুধেন্দুদা, আপনার থিমটা কী ছিল?
থিমটা ছিল, ফ্ল্যাটে যেসব শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মানুষ একালে বাস করে, তারা যে কী সাংঘাতিক আত্মকেন্দ্রিক, সেটা আমি দেখাব। তারা কেউ কারওর খবর রাখে না। সকলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আর দেখাতে চেয়েছিলুম, জেনারেশন-গ্যাপ। সেকাল আর একালের মূল্যবোধ কতটা। পালটে গেছে। একালে একজন বৃদ্ধ, ডাইনসোর কী টেরোড্যাকটিলের মতোই অবাক প্রাণী। মিসফিট, সর্বত্র সমালোচিত।
থিমটা তো খুব সিরিয়াস। তাহলে ডাকাতি দিয়ে শুরু করলেন কেন?
আমি প্রথম থেকেই অ্যাকশান দিয়ে জমিয়ে দিতে চেয়েছিলুম। যাতে ঝুলে না যায়।
বেশ, তাই! ওই মধুকে কেন কিডন্যাপ করালেন? ওইখানেই তো বাঁশ দিলেন নিজেকে। ডাকাতি হতেই পারে। ভেঙে পড়া প্রাচীন শহরের আইন-শৃঙ্খলার শিথিল দিক সেটা। কেউ সাহায্যের জন্যে এল না, সেটা হল আত্মকেন্দ্রিক মানুষের ভীরুতা। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু কিশোরী মধুকে উধাও করলেন কেন?
সাম্প্রতিক একটা ঘটনার প্রভাব। ওই যে এক পুলিশ অফিসারের মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে, আজও যার সন্ধান মেলেনি। ওই মেয়েটি এসে গেল কাহিনিতে।
সেখানে তো ডাকাতি, মারধোর এইসব ছিল না। ওখানে একটা প্রেমও থাকতে পারে।
আমিও একটা টিন-এজ লাভস্টোরি ঢোকাতে চেয়েছিলুম। আজকাল কিশোর-কিশোরী প্রেম খুব হিট করছে। কিন্তু ভাই ডাকাতিটাই সব বারোটা বাজিয়ে দিলে।
বিমল করের বালিকা বধূ, খড়কুটোর পর ওই চেষ্টাটা না করলেই পারতেন।
আমি একটু অন্য ধান্দায় ছিলুম। প্রেমহীন-আত্মকেন্দ্রিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা কত অসহায়, ইমোশন তাদের কীভাবে শিকার করে এইটা আমি দেখাতে চেয়েছিলুম। পারলুম না, ফেল। করলুম। মেয়েটাই বেরিয়ে চলে গেল হাত ফসকে। ডাকাতিটাই হয়ে উঠল কাহিনির নিয়তি।
ডাকাতিটা নিয়তি নয়, নিয়তি হল মধু অপহরণ। ডাকাতি হল, মাল-মশলা নিয়ে পালাল, মিটে গেল মামলা। আপনার অবচেতনে থ্রিলারের একটা থিম ছিল; কিন্তু আপনি জানেন না বাঙালির হাতে থ্রিলার জমে না। ডাকাতির কারণ খুঁজতে গিয়ে একেবারে লেজে-গোবরে হয়ে গেলেন। কল্পনা কাজ করল না।
তুমি পাকা লোক। ধরেছ ঠিক। একসঙ্গে অনেক সাম্প্রতিক ঘটনা আমাকে তালগোল পাকিয়ে
দিয়েছে। ব্যারাকপুর, বেহালা, মেহতা মার্ডার। মানুষ একালে হঠাৎ বড়লোক হয় কী করে! আমার তো ঠিক জানা নেই। শোনা আছে, কালো টাকা, স্মাগলিং, ড্রাগস এইসব। সব একসঙ্গে এসে গেল। ভয়ংকর একটা রহস্য-কাহিনি তৈরি করার বাসনা হল।
কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন। একবারও ভাবলেন না, এ দেশ থেকে সোনা বিদেশে যেতে পারে না। এ-দেশ সোনার দেশ নয়। গোল্ড বিস্কিট বিদেশ থেকে এ-দেশে আসে। গল্পের গরুকে গাছে ওঠালে হয়? সোনা যাচ্ছে মিউজিয়ামের আর্ট অবজেক্টের কেসে। সে-কেস আবার কাস্টমস চেকিং হয় না। এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি। এইবার সোনার বদলে ড্রাগস আসছে। কী। করে আসছে? কীভাবে আসছে? কার কাছে আসছে? ব্যাপারটাকে আপনি এত সহজ করে নিয়েছেন যে ছেলেমানুষির পর্যায়ে চলে গেছে। এই পয়েন্ট থেকেই আপনার স্টোরি ঝলঝলে, খলখলে। তার ওপর দুটো গ্যাং ঢুকিয়েছেন যার একটার নাম ব্ল্যাক-প্যান্থার। সুধেন্দুদা, কোথায় আছেন আপনি ভুলে গেছেন। এটা পশ্চিমবাংলা! তা ছাড়া সেই পুরোনো আমলের ডিটেকটিভ স্টোরি-রাইটারদের আদলে আপনি পুলিশকে ফানি করে তুলেছেন। পুলিশ এলেই আপনাদের রসিকতা করতে ইচ্ছে করে। তাঁরা খিকখিক করে হাসেন। অকারণে মানুষকে হ্যারাস করেন। জ্যান্ত পুলিশ দেখেছেন আপনি?
দূর থেকে।
পড়েছেন?
হ্যাঁ। হেমেন্দ্রকুমার, নীহাররঞ্জন, শশধরবাবু।
তাঁরা এখনও আপনার ঘাড়ে চেপে আছেন। সব কাহিনির একজন হিরো-হিরোইন থাকে। আপনার হিরো কে?
সমস্যায় ফেললে। কে যে হিরো!
আমি স্টোরিটাকে যখন সেলুলয়েডে নিয়ে যাব, আমার হিরো কে হবে? বিমান?
বিমানের হিরো হওয়ার একটা চান্স আছে। মনে হচ্ছে সে-ই কন্ট্রোল করবে স্টোরির পরের পার্ট।
তাকে তো আপনি একটা স্পাইয়ের মতো খাড়া করেছেন। তার জীবন ও জীবিকা অস্পষ্ট। বিমান কে? সে ছাত্র? সে বেকার? তার বয়েস কত? বাড়ি কোথায়? তার কে আছে! সবই
ঘোলাটে।
ইনফ্যাক্ট আমিও জানি না।
আপনার চরিত্র, আপনি জানেন না?
না জানালে কী করে জানব। একালের স্টোরির তো কোনও প্ল্যান থাকে না। এ তো প্রি-প্ল্যান্ড মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং নয়। যতদূর মনে হয় বিমান ড্রপআউট। ফ্যামিলির অবস্থা খুব একটা। খারাপ নয়।
বিমানের সঙ্গে মধুর আলাপ হল কী করে?
হয়ে গেল। যেভাবে হয়।
বাঃ, কোনও অগ্রপশ্চাৎ নেই! ফ্রি স্টাইল রেস্টলিং-এর মতো। হিরোইন কে?
ধরো মধু।
মধুর বয়স কত?
ধরো চোদ্দো-পনেরো।
চোদ্দো-পনেরোর প্রেমে আমি কী দেখাব? নাচ-গান?
ও-কথা বোলো না। চতুর্দশীর প্রেমের আবেগ জানো? ওইটাই তো ভুল করার বয়স। ভেসে যাবার বয়েস। তুমি বোঝো না কেন, মধু তো একটা প্রবলেম চাইল্ড।
মধুর বয়েস আপনি জানেন না!
সে কী?
হ্যাঁ। স্বপ্ন দৃশ্যে মধুকে খাটের তলায় ঢুকিয়েছেন। সেখানে বহুক্ষণ সে থেকেছে। ছবি এঁকেছে।
ওটা স্বপ্ন নয়, হ্যালুসিনেশান।
আধুনিক খাটের হাইট সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে? তার তলায় চোদ্দো বছরের বাড়ন্ত একটা মেয়ে ঢুকতেই পারে না। ঢুকলেও সর্বক্ষণ তাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হবে।
কল্পনায় সবই হয়।
মনীশ হা হা করে হেসে উঠলেন। আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কোনও একটা জায়গায় কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিলন প্রয়োজন। ফাউন্ডেশান ছাড়া বাড়ি দাঁড়ায়? শুয়ে পড়ে।
তুমি খাটের তলায় ঢোকাটাকে এত ইমপর্টেন্স দিচ্ছ কেন?
নিশ্চয় দেব। স্টোরির প্রতিটি ইঞ্চ মূল্যবান। তাৎপর্যপূর্ণ। মধুকে যদি প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন বিমানের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। বিমান না থাকলে, হিরো কে? দুটো তো ভিলেন তৈরি করে ফেলেছেন, সীতেশ আর ভাস্কর।
আচ্ছা ত্রিদিবেশকে হিরো করলে কেমন হয়?
খুব খারাপ হয়। ত্রিদিবেশকে আপনি বাংলা আর্ট ফিলমের টিপিক্যাল বুড়োর আদলে। ফেঁদেছেন। আত্মহত্যা করার জন্যে কামপোজ না কী যেন কিনতে ছুটছেন। ওই চরিত্রের সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু ছাড়া আর কোনও ভ্যালু নেই।
তাহলে এখন যাই কোথায়! আমার এতদিনের পরিশ্রম, ভাবনা সব জলে যাবে?
আমি সুধেন্দুদা আপনার কাছে টাইট, মিষ্টি একটা কাহিনি চেয়েছিলাম উপবাসী বাঙালি দর্শকদের চেয়ারের সঙ্গে একেবারে সেঁটে রাখার জন্যে। এ আপনি কী করলেন! থিমটা ভালোই ছিল। ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে পারলেন না। ফার্স্ট দুটো চ্যাপ্টার রেখে বাকিটা জলে ফেলে দিন।
ডাকাতি হবে?
হোক। অ্যাকশান দিয়ে শুরু হোক।
মধু থাকবে, না কিডন্যাপড হবে?
ইয়েস, দ্যাটস দি পয়েন্ট। কিডন্যাপড হওয়া মানেই, রং্যানসাম আদায়ের জন্যে চিঠি। সেই জেমস হ্যাডলি চেজ মার্কা অ্যামেরিকান থ্রিলার। থ্রিলার আমরা পারি না সুধেন্দুদা। আমাদের। হাতে খোলে না। অকারণে হাতড়ে বেড়াবেন। কল্পনা ছুটবে বাঁধা পরিচিত রাস্তায়—পাড়ার গুন্ডা, সমাজবিরোধী, স্মাগলার, খুন, রেপ আপাতত নিরীহ মানুষের গোপন অপরাধ জীবন। এর বাইরে কিছুতেই আপনি বেরোতে পারবেন না। সুধেন্দুদা অন্যভাবে এগোন। মধুর চরিত্রটাই বাদ দিয়ে দিন।
বুঝেছি। আবার নতুন করে লেখার চেষ্টা করে দেখি। ধরতে পারি কি না! আচ্ছা আজ আমি তাহলে আসি।
সুধেন্দুমুখার্জি লিফটে করে নীচে নামবেন। করিডরে দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে ফাঁকা। রাত তো কম হল না। ফিলমের লোকেদের মাঝরাতেই দিন শুরু হয়। মনীশের এটা সন্ধে। সুধেন্দু করিডরের ঘোলাটে আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। লিফটের ইন্ডিকেটার প্যানেলে লাল। আলোর অক্ষর ভীষণ জ্বলজ্বলে। জ্বলছে, নিবছে। লিফট উঠছে। সুধেন্দুর সামনে এসে হুস করে দরজাটা খুলে গেল। দুধের মতো আলোয় ভেতরটা ভাসছে। কেউ নেই। কেউই উঠে এল নানীচ থেকে ওপরে। ভেতরটা নীল। সুধেন্দু এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। এক ধরনের অস্বস্তি। একটা। ভয়। এ যেন এক জগৎ থেকে আর এক জগতে প্রবেশ। সুধেন্দুক করে ঢুকে বোতাম টিপলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ। লিফট নামছে। দশ, আট, সাত। পাঁচে একবার থামল। দরজা খোলা মাত্রই এক সুন্দরী আধুনিকা ঢুকলেন। সুগন্ধে লিফট ভরে গেল। সুধেন্দু একপাশে জড়সড়ো। লিফটের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলার চপ্পল নজরে আসছে। খুবই দামি পাদুকা। দামি সিল্ক। দামি জীবনের যাবতীয় আভরণ। মনে পড়ে গেল নিজের পুত্রবধূর কথা। অনেকটা এইরকমই। সুধেন্দু এইবার মহিলার মুখের দিকে। তাকালেন। সামান্য মিল যে নেই তা নয়। তবে সব আধুনিকা মোটামুটি একই রকম দেখতে। প্লাক করা ভুরু। খাটো করে ছাঁটা চুল। সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ। পেঁচিয়ে পরা সিল্কের শাড়ি। ঠোঁটে রং। তফাত বিশেষ নেই।
লিফটের দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে এসে লাগল মধ্য শীতের এক ঝলক শীতল বাতাস। একসময় সুধেন্দুর অনেক চুল ছিল। সেই স্টকেই চলছে। পাতলা হয়ে এলেও টাক পড়েনি। স্যাইড ব্যাগ থেকে একটা হিমাচলী টুপি বের করে মাথায় চাপালেন। বয়েস হয়েছে। ঠান্ডাটা ঝপ করে মাথাতেই লাগবে। সুধেন্দু শৌখিন মানুষ। জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েই বেঁচে আছেন; কিন্তু জীবনবোধ হারাননি।
সুধেন্দুর পুরোনো আমলের একটা ছোট্ট গাড়ি আছে। বেশ শক্ত-সমর্থ। সুধেন্দুর মতোই ঘাতসহ লাজুক। নিজেই ড্রাইভ করেন। মনোহরপুকুরে পৈতৃক আমলের বাড়িটি একটা মস্ত ভরসা। নীচেটা ভাড়া দিয়েছেন। দোতলাটা তাঁর। দরজা খুলে আসনে বসলেন। বাঁ পাশে কাত হয়ে জানলার কাচটা নামিয়ে দিলেন। ঘড়ি দেখলেন, প্রায় এগারোটা। স্টার্ট দিতে গিয়ে ক্ষণকালের জন্যে থামলেন। একটা প্রশ্নের উত্তর পেলেন—সুধেন্দুই তো ত্রিদিবেশ। পাঁচ বছর আগে জীবনে একটা ক্রাইসিস এসেছিল। আত্মহননের কথাও ভেবেছিলেন। শেষে নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। হেরে যাব না। সাহায্য করেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী। একটি দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে। মহিলা বলাই ভালো। একটা নাচের স্কুল চালান দক্ষিণ কলকাতায়। মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যের মতোই দেহ-সৌষ্ঠব।
সুধেন্দুস্টার্ট দিল। হেডলাইট জ্বালালেন। সেই আলোয় দেখলেন লিফটের মহিলাটি কিছুদূরে তরতর করে হেঁটে চলেছেন। আশ্চর্য হলেন। এত রাত। গাড়ি নেই। একা কোথায় চলেছেন। পুত্রবধূ হেনার মতোই দেখতে পেছন থেকে। ছেলে প্রসূন আর হেনা এখন ব্যাঙ্গালোরে। বেশ ওয়েল টু-ডু। একটা ফর্মাল সম্পর্ক বজায় আছে এই মাত্র। কোনও ফর্মে ফাদারস নেম লিখতে হলে, প্রসূন সুধেন্দুই লিখবে; কারণ কোনও বিকল্প নেই।
গাড়িটা ধীরগতিতে এগোল। মহিলাকে পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়েও পারলেন না, সুধেন্দু থেমে পড়লেন। টিউন করা গাড়ি। ইঞ্জিন যেন নিশ্বাস ফেলছে। গাড়িটাকে পথ করে দিতে মহিলা এক পাশে থেমে পড়েছিলেন। সুধেন্দুবাঁদিকে প্রায় শুয়ে পড়ে বাঁ-পাশের জানলার কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করলেন, আপনি যাবেন কোথায়?
মহিলা একটু ইতস্তত করে বললেন, চক্রবেড়িয়া।
কীভাবে যাবেন?
যা হয় একটা কিছু পেয়ে যাব।
আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে উঠে আসতে পারেন। আমি ওই দিকেই যাব।
আমি যে আপনাকে বিপদে ফেলব না কেমন করে বুঝলেন?
আপনারও বিপদ আমারও বিপদ। বিপদে বাঘে-মানুষে বন্ধুত্ব হয়। উঠে আসুন।
সুধেন্দুদরজা খুলে দিলেন। মহিলা সামনের আসনেই সুধেন্দুর পাশে বেশ সহজভাবেই বসলেন। একালের মেয়েরা বেশ স্মার্ট। সুধেন্দুফুরফুর করে গাড়ি চালাচ্ছেন। শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলোয় চরাচর আচ্ছন্ন। পাতলা চাদরের মতো কুয়াশার আঁচল নামছে। বহুকাল পরে বেশ। রোমান্টিক লাগছে নিজেকে। কিছুই না, কলকাতা যেমন ছিল তেমনি আছে। শুধু মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। একটু বিদেশি গন্ধ। সিল্কের আঁচল। ফুরফুরে চুল। উন্মুক্ত বাহু। এইসব আর কি। সুধেন্দু বেশ ভাবেই ছিলেন। মহিলা হঠাৎ বললেন, আমরা তো পরিচিত হতে পারি?
অবশ্যই। আমার নাম সুধেন্দুমুখার্জি।
কোন সুধেন্দু? লেখক সুধেন্দু?
আমি নিজেকে লেখক মনে করি না অবশ্য। চেষ্টা করি।
বিনয় ভালো; তবে আপনি আমার প্রিয়দের অন্যতম। আমার নাম তনুকা। এয়ার ইন্ডিয়ায় চাকরি করি।
তনুকা? সুধেন্দু অবাক হলেন।
কেন, তনুকা নাম হতে পারে না?
খুব পারে। তনুকা আমারই এক চরিত্রের নাম। একটি লেখায় আমার পুত্রবধূর নাম তনুকা। তার সঙ্গে আমার সংঘর্ষ।
এই তনুকার সঙ্গে সংঘর্ষ আপনার পুত্রের। আপনার পুত্রের কী নাম?
সীতেশ।
প্রায় মিলেছিল। এই শয়তানটার নাম সীতেন।
সীতেন? তা শয়তান কেন?
সে এক বড় গল্প। এই ফ্ল্যাটে আমার উকিল থাকেন। ডিভোর্সের মামলা চলছে। জোর ফাইট। উকিলের কাছে এসেই দেরিটা হল।
আজকাল ডিভোর্স খুব হচ্ছে। কোনওভাবে মিটমাট করা যায় না?
অসম্ভব। হি ইজ এ স্কাউন্ড্রেল। আমাকে তাহলে জিমনাসিয়ামে ভরতি হতে হবে। মারলেই মারব।
থাক দরকার নেই। আবার তাহলে বিবাহ করতে হবে।
আবার বিয়ে; কোনও পুরুষকে আমার বিশ্বাস নেই। টৌয়াইস চিটেড।
চক্রবেড়িয়ার মুখে গাড়ি এসে গেল। তনুকা বললেন, আমাকে এইখানেই নামিয়ে দিন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
এই মুখ থেকে আপনার বাড়ি কত দূর?
একটুখানি।
এখানে নামলে অসুবিধে হবে না তো? বলেন তো সামনেই নামিয়ে দিয়ে আসি।
এই প্রথম মহিলা প্রাণ খুলে হাসলেন। সুধেন্দু বহুকাল মেয়েদের জলতরঙ্গ হাসি শোনেননি। বয়েস তো তাঁর এমন কিছু হয়নি। সবে ষাট। বিলেতে এই বয়সের মানুষ বিয়ের কথাও ভাবে। তনুকা হাসি থামিয়ে বললেন, বেশ ভালো লাগল আপনাকে। এক রাতের পরিচয় এক রাতেই হারিয়ে যাবে?
তা কেন? সুধেন্দু বেশ উৎসাহী হলেন, আমার ভীষণ ভালো লাগল আপনাকে। বহুকাল পরে যেন হৃদয়ের শব্দ শুনতে পেলুম। বড় একা মানুষ তো আমি। কলম থেকে যে-সব চরিত্র নামে কিছুকাল তারাই আমাকে সঙ্গ দেয়। একসময় তারাও অদৃশ্য হয়ে যায় দুই মলাটের আড়ালে। তখন এই রাত আসে, দিন আসে, দুর্ভাবনা পায়চারি করে মনের বারান্দায়। অতীত এসে কাঁদে বিধবা রমণীর মতো।
বাঃ, কী সুন্দর বললেন। আপনার কেউ নেই?
দশ বছর আগে স্ত্রী মারা গেছেন ক্যানসারে। একটি মাত্র ছেলে। ওয়ান চাইল্ড সিন। ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে করে বউ নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পালিয়েছে। আমি এখন একা।
Alone, alone, all all alone
Alone on a wide, wide sea!
And never a soul took pity on
My soul in agony?
সুধেন্দু একসময় ভালো আবৃত্তি করতেন। ইংরেজি নাটক করতেন। অর্সন ওয়েলস তাঁর মন্ত্রগুরু। গলাটা ভরাট। স্কটিশের সেই পাঁচের দশক যেন ফিরে এল।
তনুকা বললেন, আমিও একা। আপনি আমার বন্ধু হবেন?
বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত টিকবে তো?
কোনও কিছুর শেষ ভাববেন না। ধরে রাখুন, এন্ড ইজ অলওয়েজ বিটার। শুরুটা হোক না।
কিন্তু!
হ্যাঁ অজস্র কিন্তু আছে এর ভেতর। অনেক কথা, অনেক বাদ-অপবাদ।
আই ডোন্ট কেয়ার। সুধেন্দু সাহসী হলেন, বেশ, তবে তাই হোক।
এবং আজই। আমার বাড়িতে চলুন, সামান্য কিছু খেয়ে, এককাপ কফি নিয়ে ফিরবেন। আপনার বাড়ি তো খুব কাছেই।
আপনার বাড়ির লোক?
আবার কিন্তু! নিন গাড়ি ঢোকান।
নির্জন রাস্তা। চাঁদের আলো যেন হরতালের কলকাতায় ক্রিকেট খেলছে। অল্প শীত। বেশি
শীতেও মেয়েদের শীত করে না। সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে সুধেন্দু তনুকার পেছন পেছন দোতলায় উঠছেন। তনুকা দরজায় খটখট করতেই, দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন এক প্রৌঢ়া। গায়ে গাঢ় রঙের আলোয়ান। বেশ একটা বড় হলঘরের মতো। মাঝখানে ছোট্ট একটা ঝাড়লণ্ঠন। উত্তরের কোনও একটা ফাঁক দিয়ে পৌষের বাতাস আসছে। ঝড়ে মৃদু একটা টিংলিং শব্দ। ঝকঝকে। খাবার টেবিল। অসম্ভব পরিচ্ছন্ন মায়াবি এক পরিবেশ। সোফায় একটা লোমওলা সাদা বেড়াল মহা আরামে ঘুমোচ্ছে।
তনুকা বললেন, আসুন। ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার এই দুজন আর কেউ নেই।
সুধেন্দু ভেতরে ঢুকলেন। দরজাটা পেছনে ক্লক করে বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো আমলের একটা ঘড়ি কোথাও বাজাচ্ছে—এক, দুই, তিন…
২.
চিরটাকালই সুধেন্দু দেখে আসছেন তাঁর সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আলো, অন্ধকার, মানুষের মুখ, গন্ধ, মেয়েদের মাথার চুল, শরীরের গঠন, ফার্নিচার সাজাবার ধরন, ঘরের বাতাস তাঁকে অনেক অপ্রকাশিত খবর দিতে পারে। যা নেই, যা ছিল, যা আসবে, তিনি যেন জানতে পারেন। পরে অবাক হয়ে দেখেছেন, মিলে গেছে। এই শক্তিটা তিনি অর্জন করেছেন। এক মহাপুরুষ অযাচিতভাবে দান করে গেছেন। জীবনের প্রথম পর্বে টগবগে যৌবনে প্রচণ্ড এক মানসিক বিপর্যয়ে আত্মহত্যার মুখোমুখি হয়ে সুধেন্দু ছিটকে চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ে দুটি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে—হয় ঈশ্বর না হয় আত্মহত্যা। পাহাড় আর বরফের নির্জনতায় মরে পড়ে থাকলে কেউ খুঁজে পাবে না কোনওদিন। কেউ বলতে পারবে না, কাপুরুষটা আত্মহত্যা করেছে। একটা রহস্যে আবৃত থেকে যাবে সুধেন্দুর অন্তর্ধান রহস্য। সাতটা দিন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালেন তিনি। বিরাট পর্বত, হিমবাহ, ঝরনা, নদী, হাড়কাঁপানো শীত, প্রবল বাতাস, অভ্রনীল আকাশ, বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল, সুধেন্দু! ঈশ্বরের কোনও রূপ নেই, তিনি অরূপ। বিরাটেই তাঁর অবস্থান। তিনি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র আবার বৃহতের চেয়ে বৃহৎ।
আত্মহননের ইচ্ছা মিলিয়ে গেল। মনুষ্যজন্ম এক মহাভাগ্য। এমন একটা শরীর, পরতে পরতে যার রহস্য। সেই ভয়ংকর, ভয়াবহ নির্জনতায়, বাতাসের হাহাকারে বসে সুধেন্দু নিজের শরীরের রহস্যে মজে গেলেন। শক্তিশালী ক্যামেরার লেন্সকে হার মানায় এমন দুটো চোখ। সূক্ষ্ম বেতার যন্ত্রের মতো দুটো কান। কয়েক কোটি স্পর্শকাতর স্নায়ু। বিন্দুর মতো একটি কীটের চলাফেরা। টের পায় এমন প্রাণবন্ত দেহত্বক। আঙুলের কী অদ্ভুত ছন্দ, কাজ করার কী করণকৌশল। দেহসন্ধির কী অসাধারণ কারিগরি! পাদুটো মোড়ে পেছন দিকে, হাত দুটো সামনে। সর্বোপরি মাথা। অতীত সেখানে স্মৃতি। বর্তমান সেখানে বিচার, ভবিষ্যৎ এক আশঙ্কা।
হিমালয়ের সেই হতাশ দিনে সুধেন্দু দেখা পেলেন তাঁর গুরুর। সন্ধ্যা নামছে। আর একটি অসহ্য শীতসন্ধ্যা। ভাবছেন, রাতটা কাটবে কী করে! অনাহারে দুর্বল শরীর। এমন সময় তিনি সামনে। এসে দাঁড়ালেন, সাক্ষাৎ মহাদেব। হাতে ত্রিশূল। বড় বড় চোখ, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। পিতার স্নেহে বললেন, আও বেটা।
দুজনে একটা গুহায় গিয়ে ঢুকলেন। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। তেমনি ঠান্ডা। সাধু আদেশ করলেন, বয়ঠো বেটা। সুধেন্দু আন্দাজে বসলেন। একটা কিছুর ওপর বসেছেন। স্পর্শে বুঝলেন, কম্বল। সাধু বললেন, চোখের আলো জ্বালাবার চেষ্টা করো। আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই।
সুধেন্দু মনে মনে ভেবেছিলেন, আপনি মহাযোগী, মহাসাধক, আপনি তো দেখতে পাবেনই। আমার সে শক্তি কোথায়! আমি তো রাতের পাখি। অন্ধ।
সাধু বলেছিলেন, তোমার চিন্তা আমি পড়তে পেরেছি বেটা। আমি পারি। আগে পারতুম না, এখন পারি। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। অন্ধকারে আগে আমিও দেখতে পেতুম না, এখন পারি। আমার চোখ দুটো পোলারাইজড হয়ে গেছে। সুধেন্দু অবাক হয়েছিলেন, সাধু শিক্ষিত। ইনফ্রা রেড, শর্ট ওয়েভ লেংথ, রাডার সবই জানেন। ফিজিক্সের লোক। সংসারে থাকলে বিজ্ঞানী হতেন। অনেক টাকা রোজগার করতেন। কার টানে সব ছেড়ে এই ভীষণ জায়গায়!
সাধু বলেছিলেন, বিজ্ঞানে ভগবানকে টের পেয়ে, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে এখানে এসে বসে আছি। যতদিন যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে, আলাদা করে ভগবান বলে কিছু নেই। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন। তিনি জলে, তিনি স্থলে, তিনি অন্তরীক্ষে তিনি সর্বঘটে। আমার ক্ষুদ্র আমিটাকে মারতে পারলেই সেই বৃহৎ আমির অনুভূতি আসবে।পাওয়ার হাউস থেকে। বিদ্যুৎ আসে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে, আমি যেদিন সেই পাওয়ার হাউস হব, সেদিন আমি নিজেই আলো জ্বালাব, কল চালাব, আমাকে স্পর্শ করলে মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ঘটাবার ইচ্ছাশক্তি আমার নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমি মারতে পারব, আবার বাঁচাতেও পারব।
সুধেন্দু ঠিক বুঝতে পারেননি সেই সব কথা; কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেয়েছিলেন, শীত আর। করছে না, জিভে অপূর্ব একটা স্বাদ লেগেছে, খিদে আর নেই, মনে ভীষণ একটা সুখের ভাব। মৃত্যু বলে পৃথিবীতে একটা কিছু যে আছে, সেই বোধটাই চলে গেছে। গীতার সেই শ্লোকটি মনে ঘুরছে, যেখানে ভগবান বলছেন,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বাভবিতা বান ভূয়ঃ
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।
এই আত্মা কখনও জন্মগ্রহণ করেন না বা মৃত্যুমুখে পতিত হন না। আত্মা অন্যান্য জাতবস্তুর মতো জন্মগ্রহণ করে অস্তিত্ব লাভ করেন না, কারণ সদরূপে আত্মা চিরবিদ্যমান। আত্মা। জন্মরহিত, নিত্য শাশ্বত এবং পুরানো, শরীরের নাশে আত্মার নাশ হয় না।
সেই মহাত্মার কাছে প্রায় তিন মাস ছিলেন সুধেন্দু। অসাধারণ, অলৌকিক সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শরীরটা যে কিছুই নয়, সেই ধারণাও ধারণ করতে পেয়েছিলেন। কারণ সেই মহাসাধক কোনও কিছুই আহার করতেন না। সুধেন্দুকে সপ্তাহের একদিন একটি করে পাকা হরিতকি খেতে দিতেন। সুধেন্দুর ক্ষুধা-তৃষ্ণা এক সপ্তাহের মতো নিবৃত্ত হয়ে যেত। একাসনে দিনের পর দিন বসে থাকার অভ্যাস হয়ে গেল। সন্ন্যাসী প্রণব মন্ত্র জপ করতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মনকে এমনভাবে নিবিষ্ট করবে যে, সময়ের কোনও জ্ঞান তোমার থাকবে না। দিন আসবে, রাত আসবে, তুমি কিছুই টের পাবে না। তোমার শরীর, জীবকোষ সব পালটে যাবে। নতুন একটা শরীর, জপের শরীর তৈরি হবে। আনন্দের সাগরে পদ্মফুলের মতো ভাসতে থাকবে। শ্বাসপ্রশ্বাস আর নাক দিয়ে পড়বে না, সুষুম্নায় বইতে থাকবে। তোমার সমস্ত শরীর শিরশির করবে। স্বেদ, পুলক, হর্ষ, কম্প হবে। আকাশ-বাতাস জুড়ে শুনবে নাদধ্বনি। সমুদ্রের গর্জন, মেঘের শব্দ, বাতাসের শীকার, কাঁসর-ঘণ্টা, পিনাক, ডমরু সব একসঙ্গে বাজতে থাকবে। নাকে পাবে ব্রহ্মকমলের গন্ধ। শিব-দর্শন হবে। রুপোলি আলোয় চরাচর ভেসে যাবে। দিব্যায় দেবায় দিগম্বরায়।
পাঁচ মিনিট, দশমিনিট, পনেরো মিনিট এইভাবে সময় বাড়তে লাগল। সুধেন্দু ক্রমশ ত্রিকাল থেকে মহাকালের দিকে এগোতে লাগলেন। সেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নেই। গতি নেই, কম্পন নেই, আন্দোলন নেই, উদয় নেই, অস্ত নেই। প্রথমে ভীষণ একটা ভয়—নির্জন বনপথে যেতে বালকের যে ভয়, সেইরকম একটা ভয়। মনে মনে চিৎকার করেছিলেন কোথায় আমার মধুসূদন দাদা! সঙ্গে সঙ্গে মনের চোখে ভেসে উঠল একটি রথ। সারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, আসনে। স্বয়ং অর্জুন। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ কানে এল, চাকার ঘর্ষণ। বলগার আন্দোলন। ভয়টা কেটে গেল।
এর পরে যে দৃশ্য এল, সেটাও কম ভয়ের নয়। সুধেন্দু হঠাৎ একটা বিন্দুতে পরিণত হলেন, উজ্জ্বল একটি আলোক বিন্দু। সরু একটা নলের মধ্যে দিয়ে চলেছেন, সেই নলের গা বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, যেমন খনিতে জল চুইয়ে পড়ে। বিন্দুটা কমে একটা বেলুনের মধ্যে ঢুকে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রাস করে নিল শ্লেষ্মার মতো একটা পদার্থ। আবত হয়ে বিন্দুটির উজ্জ্বলতা। কমে শ্বেত শুভ্র একটি মুক্তোয় পরিণত হল। সুধেন্দু দেখতে পেলেন সেটি একটি মানুষের মুখ। তার হাত-পা সবই আছে। ক্ষুদ্র একটি মনুষ্যকীট। কোথা থেকে কলকল শব্দে জল এসে বেলুনের মতো সেই থলেটিকে ভরে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যকীটটি হেঁটমুণ্ডু, ঊর্ধ্বপদ অবস্থায়, সেই জলে ভাসতে লাগল। তার নাভিতে সংলগ্ন সরু সূক্ষ্ম একটি নালিকা, অনেকটা পদ্মের ডাঁটার মতো। ধ্যানস্থ সুধেন্দুর মনে হল, ভারহীন অবস্থায় সে টলটল করছে। যে গুহায় বসে আছে, সেটা জলে ভরে গেছে। কিন্তু কোনও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। বেশ একটা আরাম বোধ হচ্ছে। বেশ একটা। নিরাপত্তার ভাব। সুধেন্দু ডেকে উঠলেন—মা। সঙ্গে সঙ্গে একটি চিত্র হল চোখের সামনে কারণ সলিলে শ্রীবিষ্ণু যোগনিদ্রায় শায়িত। তাঁর নাভিকমলে চতুর্মুখ ব্রহ্মার অবস্থান।
এর পরেই সুধেন্দুর মনে হল, সেই মনে হওয়াটা আরও অদ্ভুত, মোমবাতির মতো তার দেহটা গলে যাচ্ছে। সমস্ত দেহটাই ক্রমে গলে গলে, শুধু শিখাটা জ্বলতে লাগল ভাসমান অবস্থায়। দেহ নেই, কিন্তু চেতনা-দীপটি আছে। এইভাবে ক-দিন গেল কে জানে! চোখ মেলে তাকালেন। গুহার গোলমুখের বাইরে সাদা দুধের মতো থকথকে আলো। তারই একটু আভা ভেতরে আসছে। গুহায় তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি ডাকলেন, সাধুজি, সাধুজি আপনি কোথায়! কোনও উত্তর নেই। তাঁর নিজের মাথার চুল বড় হয়ে গেছে। একমুখ দাড়ি। বাইরে এলেন। চারপাশে বরফ আর বরফ। চাঁদের আলোয় ধবধবে সাদা। দূরে পাহাড়ের চূড়া ঝলসাচ্ছে।
সুধেন্দু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিরাট কত বিরাট হতে পারে তাঁর ধারণা ছিল না কোনও। সেই রাতে হয়েছিল। লোকালয়ের বাইরে এই তো সেই স্রষ্টার সৃষ্টিশালা। ক্ষুদ্রকে গড়িয়ে দিয়েছেন নীচে সমতলে। গড়ে উঠেছে লোকালয়। কিলিবিলি মানুষ। প্রেম, ভালোবাসা, হিংসা, ষড়যন্ত্র, হত্যা, জন্ম, মৃত্যু, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি।
গুহায় ঢুকতে গিয়ে দেখলেন বরফের ওপর সাধুর ত্রিশূলটি পড়ে আছে। মনই বলে দিল, সন্ন্যাসী, মহাত্মা আরও কোনও উচ্চলোকে চলে গেছেন। ত্রিশূলটা স্পর্শ করতে গিয়েও করতে পারলেন না। সেইখানেই পড়ে রইল। সুধেন্দু ফিরে এলেন অন্য মানুষ হয়ে। ছিলেন শ্যামবর্ণ হয়ে গেছেন ফরসা। চোখের জ্যোতি বেড়ে গেছে। কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। শরীর শীতল হয়ে গেছে। ঘাম চলে গেছে। ভেতরটা আনন্দে ভরে গেছে।
বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়েদের মধ্যে একটা খাবলা-খাবলি হচ্ছিল। বউদের তাণ্ডব নৃত্য। পিতার বিষয়-সম্পত্তি কিছু কম ছিল না। সেকালের নামকরা আইনজীবী ছিলেন। ফৌজদারি বিভাগে। চুটিয়ে প্র্যাকটিস করেছেন, দু-হাতে রোজগার করেছেন। প্রভূত ভোগ করেছেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। তারা শিক্ষিত হয়েছে, মানুষ হয়নি। বড়বোন সিনেমার হিরোইন হয়েছিল। খুবই জনপ্রিয়; কিন্তু চরিত্রের আঁট ছিল না। জীবনে মদ ও পুরুষ দুটোই ছিল। বছরে বছরে সঙ্গী পালটে যেত। সবাই বড়লোকের বেহেড ছেলে। দিদি সব কটাকেই ছিবড়ে করত। এই বিপজ্জনক খেলায় শেষদানে হারতেই হয়। দিদির শেষটা ছিল প্যাথেটিক। বাঁচেওনি বেশিদিন।
বিষয়-সম্পত্তির জটিলতা থেকে সুধেন্দু বেরিয়ে এসেছিলেন এক কথায়। ইটের একটা খাঁচা। রুমালের টুকরোর মতো একখণ্ড জমি। মানুষের হিসেবে বিশাল একটু কিছু বিরাটের দৃষ্টিতে কিছুই না। সেই মামলার ফয়সালা আজও হয়নি। পিতার মঞ্জিল এখন রিসিভারের হাতে।
সুধেন্দু একটা ফিলম কোম্পানিতে চাকরি পেলেন। এক বড় ডিরেকটারের সহকারী। পরপর সাতখানা ছবি হিট। স্টোরি অন্যের কিন্তু স্ক্রিপ্ট সুধেন্দুর। নাম, চাহিদা, খ্যাতি তিনটেই বেড়ে গেল। সুধেন্দুর হাতে সোনা ফলে। ব্যর্থ প্রেমিকের হাতে প্রেমের গল্পই খোলে ভালো। সুধেন্দু কলেজজীবন থেকেই বিশাখাকে ভালোবাসতেন। পাগলের মতো প্রেম। তাকে সুখী করার জন্যে জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ঝড়, গ্রীষ্ম, বর্ষা কিছুই মানতেন না। পুলিশের গুলি চলছে, কারফু; সুধেন্দুবিল্বমঙ্গলের মতো। বিশাখার কাছে হাজির। বিশাখা একদিন স্পষ্ট মুখের ওপর বলেই দিলে, আই ডোন্ট লাভ ইউ, রেদার আই হেট ইউ। তোমাকে দেখলে আমার ইরিটেশান হয়, নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। ক্লিয়ার অফ, ক্লিয়ার অফ।
সুধেন্দুর এখন ধারণা হয়েছে, মেয়েদের জোর করে ভালোবাসা যায় না, তারা যাকে ভালোবাসবে তাকেই ভালোবাসবে। অধিকাংশ মেয়েই যাকে বিয়ে করে তাকে ভালোবাসে না। প্রেমহীন একটা চুক্তির সংসার গড়ে ওঠে। ছেলেরা দেহ ছাড়া কিছুই পায় না। পাশাপাশি শুয়ে থেকেও টের পায় না, মাঝখানে অদৃশ্য পাশ বালিশের মতো আর একজন শুয়ে আছে। সে তার প্রেমিক। সে কোনও হতদরিদ্র ছেলে হতে পারে, ভয়ংকর এক মস্তান হতে পারে, একজন বয়েসে বড় গুণী মানুষ হতে পারে। মনের দখল কে নিয়ে রেখেছে বোঝা শক্ত। মেয়েরা অভিনয় করতে জানে। ফিলমে এসে সুধেন্দু সেটা আরও ভালো বুঝেছে। নায়িকা যত সহজে তৈরি করা যায় তত সহজে নায়ক তৈরি হয় না। ছেলেরা চিরকালই একটু মাথামোটা, দামড়া টাইপ। সূক্ষ্মবোধ, সূক্ষ্ম সেন্টিমেন্ট—এসবের বড়ই অভাব। খেলতে জানে না, খেলাতেও জানে না। মেয়েরা না কেঁদেও কাঁদতে পারে, না হেসেও হাসতে পারে, ভালো না বেসেও ভালোবাসতে পারে। অক্লেশে মনটাকে বের করে নিয়ে দেহটা দিয়ে দিতে পারে। ছেলেদের বেশিরভাগই শিবঠাকুরের ষাঁড়।
সুধেন্দু মেয়েদের মধ্যেই থাকেন; কিন্তু নারীর দেহের প্রতি তাঁর আর কোনও আকর্ষণ নেই। উন্মোচিত নারী দেহ, ছবিতে সামান্য অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষায় দেহদানের ঘটনা দেখে ধারণা। হয়েছে, কাম একটা জড়বস্তু। ওতে চেতনা নেই। চৈতন্যময় জগৎটাই জগৎ, বাকিটা ছোবড়া, যেমন নারকোলের জল আর শাঁসটাই আসল।
সুধেন্দু অক্ষত থাকার জন্যে বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটি ছিল সহজ, সরল, ধার্মিক, সংসারী। প্রেম, রোম্যান্স এসব বুঝত না। মাথাও ঘামাত না। সুধেন্দুকে আর সংসারটাকে সামলানোই ছিল তার প্রধান কাজ। আধুনিক খেলে সেকালের পুর। আদর্শই বড় ছিল। প্রবল ধর্মবোধ ছিল। হঠাৎ পরিচয়, হঠাৎ বিবাহ। পিতা ছিলেন সংস্কৃতে নামকরা পণ্ডিত। সারাজীবন স্বপাকে আহার করতেন আর মাঝেমধ্যেই কাশীতে চলে যেতেন মা-আনন্দময়ীর আশ্রমে। গোপীনাথ কবিরাজের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় দিন কাটত। এই কাশীতেই সুধেন্দুর পরিচয় ঘটেছিল পরিবারটির। সঙ্গে। সুধেন্দুকে ভাগ্যই নিয়ে এসেছিল কাশীতে। ন্যায়তীর্থমশাই সুধেন্দুকে পছন্দ করেছিলেন। সুধেন্দুর ভালো লেগেছিল সহজ, সরল, সুন্দর বৈশালীকে। নবনীতের মতো একটি শরীর, পৌরাণিক মন, তন্ত্রের লক্ষ্মণযুক্ত একটি শ্রীমণ্ডিত দেহছন্দ। কোমর পর্যন্ত ছাপিয়ে পড়া ঘন কালো চুল। আয়ত দুটি চোখ, দীর্ঘ আঁখিপল্লব। যে-প্রেম যক্ষিণীর মতো কলেজ সহপাঠী প্রত্যাখান করেছিল, সেই প্রেমই সুধেন্দু উজাড় করে দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। বিয়ের পর সুধেন্দুর ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। একের পর এক সাফল্য। আনন্দময়ী মা দুজনকেই অযাচিত দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্য, অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, সবই হল। তারপর বাজল ঘণ্টা। যেতে নাহি দিব। তবু যেতে দিতে হয়। এক বৈশাখী পূর্ণিমায় বৈশালী চলে গেল। সেই বছরই হিট করল সুধেন্দুর সপ্তম ছবি। একদা নামকরা নায়িকা, তখন পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী এক যায় যায়-যৌবন মহিলা খুব চেষ্টা। করলেন শূন্যস্থান পূর্ণ করতে। সুধেন্দু পাত্তা দিলেন না; কারণ সুধেন্দু রাতে আসনে বসলেই বৈশালীকে দেখতে পেতেন। প্ল্যানচেটের প্রয়োজন হত না। দেহ হল কপূর, উবে যায়; কিন্তু বায়ুমণ্ডলে থাকে অণু-পরমাণু হয়ে। সেই স্তরে নিজেকে তুলতে পারলে পরলোকগতকে পাওয়া যায়।
৩.
গরম কফি এসেছে। তনুকাই নিয়ে এল। পোশাক পালটেছে। সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। সুধেন্দু প্রশংসা করলেন, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার কোনও ছবিতে নামিয়ে দিই।
তনুকা কফিতে ছোট্ট চুমুক মেরে বললেন, আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল নিজের ভুলে।
নষ্ট মনে করলেই নষ্ট। আমি তো আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে এসেছি। বরং আমার ফিরতি পথটাই ভালো হল। ধাক্কা না খেলে বড় জোর ছাপোষা একটা কেরানি হতুম। যত না আয় তার চেয়ে বেশি ব্যয়। এখন দিব্যি আছি। এখন আমি বলতে পারি, এই দুনিয়া মজার কুটির, খাই দাই আর মজা লুটি। আপনিও তাই করুন, কোনও কিছুই কিছুনয়। রামপ্রসাদ বলেছিলেন, ভবে। আসা খেলতে পাশা। কিছু হল না, কিছু হল না, সবসময় এই ভাবলে বারুদ ভিজে যাবে। আমার মতো করুন। আমি রোজ ভোরে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বলি, যা হয়েছে বেশ হয়েছে, এর বেশি আর কী হবে!
আপনি সাহিত্যিক, আপনি পুরুষ। আমি মেয়ে। জনঅরণ্যে একা। নেকড়ের পাল পেছনে ঘুরছে।
অবশ্যই সেটা একটা সমস্যা। মানুষ এখন আরও পশু। নারী এখন আরও ভোগের সামগ্রী। এর জন্যে আমরা ছবিওলারা কম দায়ী নই। পর্দায় মেয়েদের খোলা শরীর দেখিয়ে যৌনতা আরও বাড়িয়ে তুলেছি।
যখন যেখানেই যাই, যার কাছেই যাই, সে এমন চোখে তাকায়, কয়েকদিনের মধ্যেই এমন প্রস্তাব দেয় ছিটকে সরে আসি। আমি একটা সেক্স অবজেক্ট, ভাবলেই হতাশা আসে। মনে হয়, কোন পৃথিবীতে বাস করছি! বেড়াল, কুকুরের পৃথিবী না কি!
সুধেন্দু ঘড়ি দেখলেন। পৃথিবীকে পালটানো যাবে না। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির দৌলতে মানুষ যত। বিত্তবান হবে, পরিশ্রম বিমুখ হবে, ভোগের ইন্দ্রিয় তত প্রবল হবে। মুখে বলি হরি, কাজে অন্য করি। পুলিশ রেপ করবে, ধর্মগুরু ব্যভিচার করবে। শিক্ষক ছাত্রীর দেহ সম্ভোগ করবে। প্রবল একটা ভাঙচুর না হলে পৃথিবী সুন্দর হবে না।
সুধেন্দু বললেন, এত সহজ জিনিস, এমন জটিল হচ্ছে কেন? ডিভোর্স দিচ্ছেন না কেন?
অনেক প্যাঁচ আছে। আমাকে ছাড়তে তার আপত্তি নেই; কিন্তু আমার বিষয়সম্পত্তি ছাড়া কি সহজ! সেই লোভেই ধরে রেখেছে আমাকে। কিছুতেই মুক্তি দিচ্ছে না। মেন্টাল টর্চার করে মেরে ফেলতে চাইছে। একদিন ছঘণ্টা আমাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। কেলেঙ্কারির ভয়ে। চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারিনি। আর একদিন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সেন্সলেস করার চেষ্টা করেছিল। উদ্দেশ্যটা ছিল সেক্স, ভালগার সেক্স। আপনি বলুন, লোকটা একটা বর্ন ক্রিমিন্যাল কি না!
এমন একটা ক্যারেটার জীবনে এল কী করে!
প্রথমে তো বোঝা যায় না। আপনার উপন্যাসের মতো। ক্রমশ প্রকাশ্য।
সুধেন্দু জানে, মানুষ এক দুর্বোধ্য প্রাণী। কখন কে কী করে বসবে বলা যায় না। সাধুর ভেতর শয়তানের বাসা থাকতে পারে। প্রেমিকের আড়ালে থাকতে পারে খুনি। খুব মিঠে গলায় একটা ঘড়ি জানান দিল, রাত একটা। সুধেন্দু দিনের পৃথিবীর চেয়ে রাতের পৃথিবী বেশি পছন্দ করে। সর্বত্র রহস্য। পুণ্যও যেমন গভীর হয়, পাপও সেইরকম থকথকে।
সুধেন্দু বললেন, এইবার আমি বিদায় হই। আপনি বিশ্রাম করুন।
সুধেন্দু উঠে দাঁড়ানো মাত্রই কেমন যেন একটা অনুভূতি হল। একটা শীত শীত ভাব। অনুভূতিটা পায়ের দিক থেকে উঠছে। সুধেন্দু জানেন, কী হতে চলেছে! আগেও কয়েকবার এমন হয়েছে। একটা সতর্কবাণী আসছে। কোনও একটা জরুরি খবর আসছে। কোথা থেকে আসছে, কী ভাবে আসছে জানা নেই। সুধেন্দুর মনে হয় হিমালয়ের সেই মহাত্মা, তিনি যেখানেই থাকুন, যে-ভাবেই থাকুন, সুধেন্দুকে জানিয়ে দেন, সাবধান হও। বিপদ আসছে। একবছর আগে একটা শুটিং-এর সময় এইরকম হয়েছিল। দৃশ্যটা ছিল, নায়ক রেগে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবে। সব রেডি, ক্যামেরা রেডি, লাইট, সাউন্ড রেডি। সুধেন্দু বলতে যাচ্ছেন—টেক—হঠাৎ সেই অনুভূতি। সুধেন্দু শুনতে পেলেন অদৃশ্য সেই শক্তি বলছে রিভলভারে গুলি আছে। সুধেন্দু সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। যথার্থই তাই। চেম্বারে গুলি। অর্থাৎ ঘোড়া টেপা মাত্রই অবধারিত মৃত্যু! কার কীর্তি, কে মারতে চেয়েছিল বাংলা সিনেমার টপ হিরোকে কোন স্বার্থে, অনুমান করা গেলেও কেউ অ্যারেস্ট হল না। যে প্রপার্টি সাপ্লায়ার সুধেন্দুকে মাল সাপ্লাই দিতেন, সুধেন্দু তাকে বাতিল করে দিলেন। চক্রান্তটা ওইদিকেই হয়েছিল, কারণ সুধেন্দুর সহকারীরা সবাই পুরোনো ও বিশ্বস্ত। নায়কের মৃত্যু হলে সুধেন্দুর জেল হত।
আর একবার একটা ক্রেন ছিঁড়ে নায়িকার ঘাড়ে পড়ত। সেবারেও সুধেন্দু এইভাবেই সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। একবার নয়, বারবার এমন ঘটনা ঘটতে থাকায় সুধেন্দু বুঝে গেছেন একটা শক্তি কাজ করছে। আজও সেই কারণে সোফায় বসে পড়লেন চোখ বুজিয়ে।
তনুকা ভয় পেয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হল! শরীর খারাপ লাগছে! একটুব্র্যান্ডি দোব?
সুধেন্দু ইঙ্গিতে থামতে বললেন।
মিনিট পাঁচেক পরে চোখ খুলে জানতে চাইলেন, টেলিফোন আছে?
ওই তো আপনার পাশেই।
তনুকা দেখছেন, সুধেন্দু একটা নম্বর ডায়াল করছেন। কোথায় করছেন জিগ্যেস করার সাহস হল না। মানুষটা কেমন যেন বদলে গেছেন কয়েক মিনিটে। মুখে-চোখে অদ্ভুত একটা উত্তেজনার ভাব।
সুধেন্দু লাইন পেয়েছেন, হ্যালো লালবাজার! কে বিকাশ বলছ; আমি সুধেন্দু। শোনো, তোমাকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে। তোমার কয়েকজন টাফ ম্যানকে, প্লেনের কথা বলছি না, প্লেন। ড্রেসে, যে ঠিকানাটা বলছি সেইখানে পাঠাও। প্রত্যেকেই যেন আর্মড থাকে।
সুধেন্দু তনুকাকে জিগ্যেস করলেন, আপনার ঠিকানা?
তনুকা একটু ইতস্তত করছেন। লালবাজার কেন? ঠিকানা কেন?
সুধেন্দু বললেন, কুইক, কুইক। টাইম ইজ রিয়েলি শর্ট।
তনুকা যথেষ্ট অবাক হয়ে বললেন, বাষট্টি।
সুধেন্দু আবার টেলিফোনে ফিরে গেলেন, শোনো বিকাশ, তোমাকে যা করতে হবে মন দিয়ে শোনো, খুব সাইলেন্টলি, স্টিলদিলি আসতে হবে। একেবার চোরের মতো, বেড়ালের মতো। তোমাদের গাড়িটা অনেক দূরে রাখবে। গাড়ির যেন কোনও শব্দ না হয়। এইবার বাড়িটাকে। নিঃশব্দে ঘিরে ফেলবে, আর চারজনকে যে ভাবেই হোক ছাদে পাঠাবে। সেখানে দেখবে দুটো আর্মড লোক বসে আছে, তাদের ইনটেনশান হল মার্ডার। এই বাড়িতে একজনই থাকে, মহিলা, তাকে মার্ডার করবে। আমি কেন এখানে? এর উত্তর আমিও জানি না। প্রভিডেনসিয়াল বলতে পারো। জাস্ট আই কেম। জাস্ট লাইক এ টম ক্যাট। পরে বলব। পরে বলব। আমার আসার মধ্যে রহস্য কিছু নেই, আবার আছেও।
সুধেন্দু ফোন রেখে ঘরের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। ফিলম ডিরেকটারের সন্ধানী। চোখ। তিনটে জানলা, দুটো বাইরের দিকে, একটা ভেতর দিকে। বাইরের দুটোর একটা রাস্তার ওপর, আর একটার ওপাশে সংলগ্ন বাড়ি। সেখানে একটা বারান্দা। বাড়িটার কোথাও আলো জ্বলছেনা। ভূতের মতো অন্ধকারের স্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দশ বিশ গজ দূরে। বাড়িটার। চারপাশ বাগান দিয়ে ঘেরা। সুধেন্দু যে বাড়িতে বসে আছেন, সেটারও তিন দিক বাগান ঘেরা। পেছনের অনেকটা জমি, সেখানে একটা গ্যারেজ আছে। গাড়িও একটা আছে, কালেভদ্রে চলে। পেছনে বিশাল গেট আছে। গাড়ি সেই পথেই বেরোয়-ঢোকে। ওদিকে একটা কুখ্যাত বস্তি আছে। যত রকম পাপ আছে, সবই ওখানে অভ্যাস করা হয়।
সুধেন্দু নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বাইরের দিকের জানলা দুটো সাবধানে বন্ধ করে ছিটকিনি দিয়ে দিলেন।
তনুকার মুখ-চোখ দেখলে মনে হবে ভয় পেয়েছেন। সুধেন্দুর বুকের কাছে সরে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, চাপা গলায়।
কী হয়েছে?
তোমাকে খুন করার প্ল্যান হয়েছে।
কে করেছে?
তোমার স্বামী।
সুধেন্দু তুমিতে নেমে এসেছেন। আর আপনি বলতে পারছেন না। তনুকা এখন তার কেয়ারে। তার প্রপার্টি। অন্তত এই রাতটুকুর জন্যে। সুধেন্দু বললেন, ভয় পেয়ো না। একটা কথা, ছাদ থেকে নেমে আসার কোনও দরজা খোলা আছে কি?
না, সব বন্ধ।
দরজাগুলোর স্ট্রেংথ কেমন?
ভালোই।
তনুকা একটু জোরে কথা বলে ফেলেছিল। সুধেন্দু বললেন, আস্তে। তোমাদের বাড়ির পেছনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে তিনতলার ছাদ পর্যন্ত?
আছে। বাথরুমে ঢোকার জন্যে। বাবার আমলে জমাদাররা আসত।
ওপর আর নীচের বাথরুমের দরজা বন্ধ?
নীচেরটা বন্ধ, ওপরেরটা মনে পড়ছে না।
দেখে আসতে হবে।
আমার ভয় করছে, ভীষণ ভয়!
চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। আলো জ্বালবে না। অন্ধকারে পা টিপে টিপে।
দুজনে সন্তর্পণে সিঁড়ি গুনে গুনে দোতলায় উঠলেন। অন্ধকার থইথই। বড় বড় ঘর তালাবন্ধ। কেবলই মনে হচ্ছে, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে কেউ বসে আছে, এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে। বাথরুমের দরজাটা হাটখোলা। সুধেন্দু ফিশফিশ করে বললেন, দেখছ কাণ্ড! এর চেয়ে ভালো এন্ট্রি পয়েন্ট আর কী আছে! ঘোরানো সিঁড়ির দিকের দরজাটাও খোলা।
সুধেন্দু এক মুহূর্ত দেরি না করে তনুকার হাত ধরে বাথরুমে টেনে নিয়ে দু-পাশের দরজাই বন্ধ করে দিলেন। বাথরুমের আলোর সুইচ বাইরে।
তনুকা বললেন, কী ব্যাপার!
কেউ একজন দোতলায় আছে ঘাপটি মেরে। দোতলার সব ঘরই কী তালা বন্ধ?
না, দুটো ঘর খোলা আছে।
এই সার্ভিস ডোরটা খোলা কেন?
জানি না।
জমাদার আসে এখানে?
না।
তাহলে?
কাল একজন এসেছিল, ইলেকট্রিশিয়ান, গিজারের লাইন দেখতে।
তুমি আসতে বলেছিলে?
না, নিজের থেকেই এসেছিল।
কত দিনের লোক!
ওর পরিচিত।
আই সি।
আমাদের এখানে কতক্ষণ থাকতে হবে?
যতক্ষণ না পুলিশ এসে বাড়ি ক্লিয়ার করছে। তুমি এই গিজার ব্যবহার করবে না। আমার লোক এসে যতক্ষণ না ওকে বলছে।
বাথটবের পাড়ে দুজনে কোনওক্রমে বসলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত। কোথাও সামান্য শব্দ হলেও শোনা যাচ্ছে। বাথরুমের বাইরে খুব সন্তর্পণে চলাফেরার শব্দ হল। তনুকা ভয়ে সুধেন্দুকে জড়িয়ে ধরলেন। জমাদার আসার দরজাটা বাইরে থেকে কে যেন ঠেলল একবার। লোহার সিঁড়িতে জুতোর তলায় বালি মাড়াবার শব্দ। দুটো প্রাণী আবদ্ধ খাঁচায়, বাইরে হায়নার দল। শুকছে, আঁচড়াচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে না–পুলিশের দল, এল কি এল না। টাইমিং ঘড়িতে দুটো বাজল। পুলিশের তো এসে পড়া উচিত। বাড়িটা সার্ভে করবে। তখন ঘোরানো লোহার সিঁড়িটানজরে পড়বেই। তনুকার শরীরটা ক্রমশ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে সুধেন্দুর শরীরে এলিয়ে আসছে। সুধেন্দুর খুব। মায়া হল। মেয়েদের জীবন বড় কষ্টের। বড় হলে বাবা, মা ভাবে পর, আর স্বামী যদি শয়তান হয় ঘাটে ঘাটে ভেসে বেড়ানো। প্রকৃত বিশুদ্ধ ভালোবাসা দেওয়ার কেউ নেই। না ঘরকা, না ঘাটকা। এর ফলে মেয়েরা ক্রমশই মারমুখী, তিরিক্ষি স্বভাবের হয়ে উঠছে।
সুধেন্দুর প্রখর শ্রবণশক্তি। বহু দূরে একটা গাড়ির শব্দ হল। শব্দটা শুনেই মনে হল, একটা ভ্যান। বাঁধুনী আলগা। বহু ব্যবহারে পুলিশের গাড়ি যেমন হয়। সুধেন্দু আশ্বস্ত হলেন। বিকাশের ফৌজ এসেছে, এখন দেখা যাক অপারেশনটা কীভাবে চালায়। দেখা তো যাবে না, শব্দ শুনে বুঝতে হবে।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পরপর কয়েকজন ছাদের দিকে গেল। শব্দে তাই মনে হল। বাথরুমের মাথার ওপর ছাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ। বাথরুমের বারান্দার বাইরে একটা শব্দ হল। কেউ একজন পালাচ্ছে নীচের দিকে। সুধেন্দু সার্ভিস ডোরটা সাবধানে খুললেন, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অন্ধকারে দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। সুধেন্দু বললেন, বিকাশ কোথায়!
এই তো আমি। কে সুধেন্দু?
হ্যাঁ উঠে এসো, ভেতরে একজন আছে।
দাঁড়াও, নীচের ব্যারিকেডটা তৈরি করি। সে ব্যাটা বাথরুমের জমাদারদের দরজা দিয়েই পালাবার চেষ্টা করবে।
বিকাশ মল্লিক অবশেষে দোতলার বাথরুমে এসে উঠলেন।
শেষে এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলে? জায়গাটা বেশ ভালোই।
কী করব, তা না হলে মেয়েটাকে মেরে ফেলত। তুমি দরজাটা খুলে ভেতরে যাও। আমি নীচের দিকে পালাবার শব্দ শুনেছি।
পুলিশের পাকা অফিসার বিকাশ বললেন, তোমরা দুজনে বাথটাবে শুয়ে পড়ো। ফায়ার করলেও সেফ থাকবে। সুধেন্দু আর তনুকাকে আদেশ মানতেই হল। বিকাশদরজার পাল্লাটা খুলতে খুলতে পাশে সরছেন। হঠাৎ গুলি করলেও গায়ে লাগবে না। বাইরে বেরিয়ে করিডরের আলো সব জ্বেলে দিলেন। কেউ কোথাও নেই। নীচে নেমে এলেন। পেছনে তাঁর সতর্ক প্রহরী।
সব শেষে তাঁরা এলেন বাইরের ঘরে। ফটফট করছে আলো। ফনফন করে পাখা ঘুরছে। সোফায় দিব্যি আরামে ঠ্যাং তুলে একজন স্বাস্থ্যবান লোক বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
বিকাশ তাঁর সহকারী, সুধেন্দু আর তনুকা ঘরে। সোফায় আরাম করে বসে আছে যে, সে কে!
বিকাশই প্রশ্ন করলেন, আপনি কে?
আলোর দিকে ধোঁয়া ছেড়ে লোকটি বললে, প্রশ্নটা তো আমারই করা উচিত, আমার বাড়িতে এই শেষ রাতে আপনারা কারা?
বিকাশ বললেন, মানে? আপনার বাড়ি মানে?
স্ত্রীর বাড়ি মানে স্বামীরই বাড়ি। সব দেশের আইনে সেই কথাই বলে মিস্টার পুলিশ অফিসার!
বিকাশ তনুকাকে জিগ্যেস করলেন, এঁকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ, একসময় আমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, তবে আমি ডিভোর্স চেয়ে মামলা করেছি। সেই মামলা চলছে।
আপনারা যখন বাথরুমে ছিলেন, তখন ইনি কোথায় ছিলেন? এইখানে?
না।
তাহলে কোথায় ছিলেন?
জানি না।
সুধেন্দু এগিয়ে এসে বললেন, আমি বলছি, ইনি বাড়ির ছাদ দিয়ে দোতলায় ঘাপটি মেরে বসেছিলেন। উদ্দেশ্য খুব একটা সাধু ছিল না বলে মনে হচ্ছে। তুমি ছাদে যে-দুটোকে ধরেছ তাদের জেরা করলেই জানতে পারবে। যে লোকটা দোতলায় ঘুরছিল সেই তোমার তাড়া খেয়ে নীচে এসে না পালিয়ে এইখানে এসে জমিয়ে বসে পড়েছেন।
ধীরে-সুস্থে আর একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে সেই লোকটি বললেন, আপনারা বসুন না, দাঁড়িয়ে কেন চা কফি কিছু খাবেন কি!
বিকাশ বললেন, সে পরে হবে, আপাতত আমরা আপনাকে একটু কষ্ট দেব, আমাদের সঙ্গে লালবাজারে যেতে হবে। সেখানেই আমরা আপনাকে চা খাওয়াব!
কোন অপরাধে! নিজের স্ত্রীর কাছে থাকার অপরাধে? যে স্ত্রী একটা আধবুড়ো লোককে এনে নিজের শোবার ঘরে তোলে তার স্বামী বাইরের ঘরে ব্রথেল কীপারের মতো বসে বসে সিগারেট টানে।
ছাদের লোক দুটো কোথা থেকে এল? ওরা কার অপেক্ষায় ছিল?
আমার অপেক্ষায়।
মানে?
মানে খুব সহজ, আজ এখানে আমাকে আসতে বলা হয়েছিল। অ্যান্ড দে লেভ আউট এ নাইস মার্ডার প্ল্যান অর ট্র্যাপ। প্রফেশনাল মার্ডারারকে ছাদে মজুত রেখেছিল।
বিকাশমল্লিক বললেন, আমার কাছে খবরটা গেল কী করে! হু ইনফর্মড মি?
বিকাশ সুধেন্দুর হাতে একটা চিমটি কাটলেন; অর্থাৎ চুপ থাকো।
লোকটি একটু নার্ভাস হলেন। একটু ইতস্তত করলেন, সিগারেট ধরা হাত একটু কাঁপল। বিকাশের নজর এড়াল না। অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসাররা এই মুহূর্তে অপরাধীকে চেপে ধরেন। দুর্বল মুহূর্ত।
লোকটি বললেন, দ্যাটস মাই গুড ফরচুন। আপনি খবর পেয়েছিলেন বলে আমি এখনও বেঁচে আছি।
আপনার সব খবর, আপনার আসল উদ্দেশ্য সব আমরা জেনে গেছি। আপনি যাদের ওপর। নির্ভর করেছেন তারা খুব বেসামাল মানুষ। আপনার এই যুক্তি আদালত মানবে তো!
লোকটি আধখাওয়া সিগারেট অ্যাশট্রে-তে চেপে রেখে বাঁ দিকে একটু কাত হলেন। সেই অবস্থা থেকে সোজা হতে হতে বললেন, এই যুক্তিটা তো মানবে যে, আমি সত্যিই তনুকাকে। ভালোবাসি। আর, ভালোবাসা আর ঘৃণার খুব তফাত নেই মিঃ অফিসার। আমি যে গভীরতায় যে ইনটেনসিটিতে ঘৃণা করি, ঠিক সেই ইনটেনসিটিতে ভালোবাসি। আমি পাইলট, আকাশ আমার ঠিকানা।
লোকটি চকিতে রগে রিভলভার চেপে গুলি করলেন। সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েও কিছু করা গেল না।
তনুকা ছিটকে সামনে এসে দাঁড়ালেন। একেবারে স্থির পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তির তলায় একটি নিহত মানুষ। আকাশযার ঠিকানা। দুর্বোধ্য মানব সংসারের মাথার ওপর বিশাল এক ছাদের মতো। কখনও নীল, কখনও কালো।
আজ আছি কাল নেই
কে, দীনবন্ধু নাকি? এখানে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছ?
আরে ভবেশনাকি? তুমি এ সময়ে! কোথায় চললে? বাড়ি ঢুকলে না? আমার পাশ দিয়েই তো দুরমুশ করতে করতে গেলে, বেরিয়ে এলে কেন? অফিস থেকে ফিরলে, চা-জলখাবার খাবে। কুশল বিনিময় করবে সারাদিনের পর। এমন আধলা ইট-খাওয়া লেড়ি কুকুরের মতো মুখ কেন গো?
তোমার পাশে একটু স্থান হবে ভাই?
হবে, বারোয়ারি রক, ধুলো ঝেড়ে বোসো। বেশি ওপাশে যেয়ো না। কেলো এইমাত্র বেপাড়ার এক মস্তান কুকুরের সঙ্গে চুলাচুলি করে এসে সবে ন্যাজ গুটিয়ে শুয়েছে। মেজাজ চড়ে আছে। ঘাঁক করলেই তলপেটে চোদ্দোটা। ফুঁ হুঁ করে ধুলো উড়িয়ে ভবেশ বসে পড়ল। বসার সময় হাতের আঙুলে কী একটা ঠেকল। দীনবন্ধুর বাজারের ব্যাগ। কপি, মুলো, ভিজে ভিজে পালংশাক চারপাশে ছেদরে আছে। দীনবন্ধু অফিস থেকে ফেরার পথে রোজই বাজারটা সেরে আসে। অভ্যাসটা মন্দ নয়। শীতের ছোট্ট সকালে খানিক সময় বেরোয়। একটু তারিয়ে তারিয়ে দাড়ি কামানো যায়। নয়তো তাড়াহুড়োয় ধরো আর মারো টান। ছাল-চামড়া গুটিয়ে সাফ।
ভবেশ বলল, একী, বাজার নিয়ে বসে আছ? দু-কদম এগোলেই তো বাড়ি। বাজারটা রেখে এলেই পারতে। এই নোংরায় ফেলে রেখেছ? পালং-এ ইনফেকশান ঢুকবে।
দীনবন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাতে ঘড়ি নেই, কটা বাজল তোমার ঘড়িতে?
আটটা বাজতে দশ।
উঃ এখনও ঝাড়া দেড় ঘণ্টা।
বুঝতে তাহলে পেরেছ কেন বসে আছি?
হ্যাঁরে ভাই পেরেছি একটু চা হলে মন্দ হত না।
এখান থেকে হেঁকে বিভূতিকে বলো, ভাঁড়ে দুটো চা। দুটো লেড়ো বিস্কুটও দিতে বলো।
দীনবন্ধু আর ভবেশ খানছয় বাড়ির ব্যবধানে থাকে। দুজনেই ভালো চাকরি করে। নির্বিরোধী ভদ্রলোক বলে পাড়ায় যথেষ্ট সুনাম আছে। এ তল্লাটে সস্তায় জমি পেয়ে দুজনেই বাড়ি তৈরি করে। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সংসারধর্ম পালন করছে। সেই কথায় আছে, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তাঁতির হেলে গরু কিনে। দুজনেরই বাড়ির ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে পাঁচটি করে অ্যালুমিনিয়ামের আঙুল আকাশের গায়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ খুঁজছে। চ্যাটালো তার বেয়ে সেই আশীর্বাদ ভেন্টিলেটার গলে কাচের পর্দায় কখনও নৃত্যে, কখনও কথকতায়, কখনও সংগীতে গলে গলে পড়ে। সবচেয়ে মারাত্মক দিন শনিবার। সেদিন হয় বাংলা, না হয় হিন্দি ছায়াছবি। গেরস্থের আর্তনাদ, পাঁচু প্রাণ যায়।
অদ্য সেই শনিবার। বাংলা ছায়াছবির আসর, অশ্রুসিক্ত ছবি। খটখটে ছবি হলেও দর্শকের অভাব হয় না। পালে পালে পিলপিল করে আসতে থাকেন নেণ্ডিগেণ্ডি, পুঁচিপেঁটকি নিয়ে। দীনবন্ধু টিভি কিনেছিল এরিয়ারের টাকায় স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে। আহা। একা একা বাড়িতে থাকে, সন্ধেটা তোমার ভালোই কাটবে। স্ত্রীও খুব নেচেছিল। টিভি আসবে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে কচুরি ভেজে স্বামীকে খাইয়েছিল। জুট কার্পেট পাতা লবিতে টিভি সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ছাদে ফোঁস করে ফুঁসে উঠল টিভিঙ্গুলি। সারা পাড়াকে জানান দিতে লাগল, আমি এসেছি, আমি এসেছি। তোমরা এসো হে। একবার বুঝিয়ে দিয়ে যাও, কত ধানে কত চাল।
ভবেশ টিভি কিনেছিল গৃহবন্দি, অবসরভোগীবৃদ্ধ পিতার সান্ধ্যসঙ্গী হিসেবে। দোতলায় পিতার সুবৃহৎ শয়নকক্ষে নীল পর্দা আঁটা সেই যন্ত্র এখন শক্তিশালী যন্ত্রণা। ডজনখানেক বিভিন্ন স্বভাবের বুদ্ধের পীঠস্থান। তাঁদের হাঁচি, কাশি, নাসিকাঝর্তন, কলহ, মতামত প্রকাশের ঘনঘটায় প্রতিটি। সন্ধ্যা ভবেশকে স্মরণ করিয়ে দেয়, য পলায়তি স জীবতি।
দুই কৃতকর্মভোগী কৃতী পুরুষ পাঁচুবাবুর রকে বসে ভাঁড়ের চা খাচ্ছে। মশা তাড়াচ্ছে। নর্দমার চাপা গন্ধ শুকছেন আর মনে মনে বলছেন, একেই বলে, বাঁশ কেন ঝাড়ে আয় মোর হিন্দিস্থানে। ভাঁড়টাকে সাবধানে পায়ের তলার বদ্ধ নর্দমায় বিসর্জন দিয়ে ভবেশ বললে, ভট করে চা খেয়ে। ফেললুম, বড় বাইরে পেলে মরব।
মরবে কেন? বাড়িতে গিয়ে নামিয়ে আসবে।
বাথরুম খালি পেলে তো! বারোটা শর্করারোগী মিনিটে মিনিটে ছুটছেন, আর প্রতিবার হাতে জল নিয়ে সেইখানে আর গোড়ালিতে শাস্ত্রসম্মত ঝাপটা মারছেন। চোখ বুজিয়ে বাথরুমের অবস্থাটা একবার অবলোকন করার চেষ্টা করো ভাই। কর্পোরেশনও লজ্জা পাবে।
তোমার বাথরুম? আমি মানসচক্ষে আমার বসার ঘর দেখছি আর আঁতকে আঁতকে উঠছি।
দীনবন্ধুর বসার ঘর ঠেসে গেছে। অনাহূতরা সারি সারি বসে আছেন বিশিষ্ট অভ্যাগতদের মতো। কাউকেই ফেরাবার উপায় নেই। শত্রুতা বেড়ে যাবে। বলে বেড়াবে বেটার অহংকার হয়েছে। ভগবানের গুনছুঁচ যেদিন বেলুন ফুটো করে দেবে সেদিন চামচিকির মতো চুপসে গাবগাছের তলায় পড়ে থাকবে। দীনবন্ধুর স্ত্রী শাপশাপান্তকে ভীষণ ভয় পায়। লাল আলোয়ান গায়ে ওই যে বসে আছেন মিনুর দিদিমা। দু-হাঁটুতে বাত। অন্য সবাই মেঝেতে কার্পেটের ওপর থেবড়ে আছেন, তিনি বসেছেন সোফায়। মুখপোড়া বাত আর জায়গা পেলে না, ধরল এসে হাঁটুতে। কত্তা যাবার সময় ওইটি দিয়ে গেলেন। গোবিন্দের মা কোণের দিক থেকে বললেন, ওকথা বলছেন কেন, কত্তা একটা বাড়ি রেখে গেছেন, তিনটি ছেলে দিয়ে গেছেন, চার মেয়ে। আর কী চাই?
আ মোলো কথার ছিরি দেখ। আমরা আজকালের বিবি ছিলুম না তোদের মতো। সারা জীবন পেটে একটা কিছু না থাকলে আমাদের কালো শরীরটা খালি খালি মনে হত। কত্তা গর্ব করে বলতেন, সুখদা আমার দুরকল, একটু ঠুকরেছ কী অমনি ঝপাং। হাত ঠেকালেই সোনা। তোমরা হলে ফাঁকিবাজ। একটা কি দুটো, অমনি ছুটলে। কাটিয়ে কুটিয়ে ফাঁকা হয়ে ফিরে এলে।
দীনবন্ধুর স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলল, কী হচ্ছে দিদিমা? বাচ্চারা বসে আছে।
তুমি আর সাউকুড়ি করতে এসো না। ওরা সব বাচ্চার বাবা। দেখলে না ঠুলির বিজ্ঞাপনের সময়। কীরকম হাসাহাসি করছিল! তুমি মা এযুগের মেয়ে। তুমি ওসব বুঝবে না। তোমরা হলে মেয়েমানুষ। আমাদের কালে মুতের কাঁতা শুকোতে পেত না। দাও এক গেলাস জল দাও। আ মর, সিনেমা বন্ধ করে মাগি সেই থেকে বকেই মরছে। আহা কী রূপের ছিরি! চুলে বব করে বসে আছেন। বুকের দিকে না তাকালে ছেলে কি মেয়ে বোঝে কার বাপের সাধ্য!
বুলডগের মতো মুখ করে মিনুর দিদিমা পাগলে পাগলে হাওয়া খেতে লাগলেন।
একেবারে লাগোয়া বাড়ির চার বউ রেলের পিস্টনের মতো আসা-যাওয়া করছেন! স্থির হয়ে বসার উপায় আছে কি? পাশে ছড়ানো সংসার। টিয়াপাখির ঠুকরে ঠুকরে পেয়ারা খাওয়ার কায়দায় চার বউয়ের টিভি দেখা চলেছে। ব্যোমে পায়রা বসার মতো। বড় বউ যেন দিশি গোলাপায়রা। বয়সের মাঝসমুদ্রে বয়ার মতো শরীর। তিনি একটি বেতের মোড়া দখল করেছেন।
তাঁর সন্তান-সন্ততিতে চারপাশে গোল করে মাকে ঘিরে রেখেছে। বসতে-না-বসতেই তাঁর খেয়াল হল, আলমারির গায়ে চাবিটা ঝুলিয়ে রেখে এসেছেন। সৃষ্টি পড়ে আছে আলমারিতে। দিনকাল ভালো নয়। বড়মেয়েকে বললেন, চাবিটা নিয়ে আয় তো। বড়মেয়ে ছবিতে মশগুল। প্রেমিক প্রেমিকাকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে গান ধরেছে, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন। হত? লাল্লা লালা লালা। বড় বললে, থাক না। মা একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়লেন, টিভি দেখা ঘুচিয়ে দেব তোর। মেয়ে অন্যমনস্কে উত্তর দিল, যাও যাও, সব করবে। মা হুঙ্কারে বললেন, দেখবি?
মিনুর দিদিমা বললেন, দুটোকেই বের করে দাও।
বড়বউ মুখ বেঁকিয়ে ভেংচি কেটে বললেন, কত বড় সাহস! যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই। আপনি বের করে দেবার কে?
মিনুর দিদিমা হুঙ্কার ছাড়লেন দীনবন্ধুর স্ত্রীকে, বউমা, বউমা।
বড়বউ ততোধিক জোরে বললেন, বউমা কী করবে? বউমা এসে আমার মাথা কেটে নেবে?
টিভির পর্দায় নায়ক-নায়িকারা তখন কোরাসে চেল্লাচ্ছেন, লা লালা, লাল্লা, লাল্লা।
মেজোবউটি যেন সিরাজু পায়রা। লাট খেতে খেতে এলেন, এসেই বললেন, যাও, দেখগে যাও, তোমার নতুন সুজনিতে হোটর ছেলে পেচ্ছাব করেছে।
তোশক ভিজছে, তোশক ভিজেছে? বড়বউ মোড়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেই, ধাক্কায় মোড়া কাত হয়ে মহাদেবের ডম্বরুর মতো গড়াতে গড়াতে গদাইয়ের মার কোলের ছেলেটার মাথায় গিয়ে খোঁচা মারল। আঁচলচাপা ছেলে চুকুর চুকুর দুধ খাচ্ছিল। অষ্টপ্রহর তিনি চুষতে না পেলে চিল্লে বাড়ি মাথায় করেন, মোড়ার খোঁচায় বোঁটা ছেড়ে তিনি হাইফাই স্পিকারের মতো ওঁয়া ওঁয়া, হোঁয়া…ওঁয়াও করে মিউজিক ছাড়লেন। প্রেমিক-প্রেমিকার তুমি, তুমি, হুইসপার চাপা পড়ে গেল। মেজো পুতুলনাচের ধসে-পড়া পুতুলের মতো জমির হাতখানেক ওপর দিয়ে লাট খেয়ে একপায়ে ঝপাৎ করে বসে পড়ে বললেন, কার মিউজিক? কার মিউজিক রে?
পম্পা, শম্পা, চম্পা তিন বোন। বাপ-মা দুজনেই চাকুরে। মাথায় মাথায় তিন বোন। পম্পা শরীরের চেয়েও ঘেরে বড় ম্যাক্সি পরে, একবার করে আসছে, বসছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। আসা আর যাওয়ার পথে পোশাকের ধাক্কায় সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। প্রথমে উলটে গেল। টেবিলল্যাম্প। শেডফেড ছিটকে চলে গেল। মিনুর দিদিমা বললেন, দীনুর কাণ্ড দেখ। মাথার ওপর এত আলো, তাতে হচ্ছে না। ব্যাঙের ছাতার মতো আলো গজিয়েছে মেঝে থেকে।
দ্বিতীয়বার ছিটকে পড়ল কাটগ্লাসের অ্যাশট্রে। সিগারেটের টুকরো, ছাই, দেশলাই কাঠি কার্পেটের ওপর ছত্রাকার। তার ওপর থেবড়ে বসলেন পাশের বাড়ির সেজোবউ। বসতে বসতে। বললেন, বেশিক্ষণ বসব না। ডাল চাপিয়ে এসেছি। যেন সমবেত মহিলামণ্ডলী তাঁর কাছে। জানতে চেয়েছিল তিনি কতক্ষণ বসবেন। কেন বসবেন না।
হঠাৎ সামনের সারির এক বাচ্চা আর একটা বাচ্চার ঝুঁটি ধরে বেশ বারকতক ঝাঁকিয়ে দিল। লেগে গেল দুজনের ঝটাপটি। তার-ফার ছিঁড়ে লন্ডভন্ড হওয়ার আগেই দীনুর বউ দৌড়ে গিয়ে দু-পাশে সরিয়ে দিল। এ বলে তুই বাপ তুললি কেন, ও বলে তুই বাপ তুললি কেন? দিনুর বাড়ি যে মহিলা কাজ করেন, এরা তার বংশপরম্পরা। কান ধরে বার করে দিলে কাল থেকে তিনি আর কাজে আসবেন না। দুজনকে দু-কোণে বসাতে হল। সেখান থেকেই তারা মুখ ভ্যাঙাভেঙি করতে লাগল। একজনের বই ভালো লাগেনি, সে হাত-পা ছড়িয়ে ফ্ল্যাট হয়ে পড়ে আছে। ঠ্যাং ধরে টেনে সরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। এখুনি বাড়ি ঘেরাও হয়ে যাবে। দীনুর বন্ধুরা এসে দীনুর মাথা কামিয়ে, ঘোল ঢেলে ছেড়ে দেবে।
বড়বউ লাফাতে লাফাতে ফিরে এসে মেয়েদের হুকুম করলেন, যা, ঘোটর বিছানায় করে আয়। ভাসিয়ে দিয়ে আয়। মেজো হাতের তালুতে চিবুক রেখে দাঁতচাপা সুরে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, করে আয়, যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেঁতুল।
যে মেয়ে চাবি আনতে রাজি হচ্ছিল না, ঝগড়ার গন্ধ পেয়ে সে তিরবেগে ছুটল। ছোট-মেয়ে বোকা, সে ক্রমান্বয়ে জিগ্যেস করতে লাগল, দিদি কী করতে গেল মা? ওপাশ থেকে কে একজন বলে উঠল, হিসি।
দিনুর স্ত্রী থাকতে না পেরে রাগ রাগ গলায় বললে, টিভি বন্ধ করে দিই।
মিনুর দিদিমা বললেন, বাড়িতে বায়োস্কোপি বসালে অমন একটু হবেই মা! অধৈর্য হলে চলে?
নায়ক নায়িকাকে একটু আদর-টাদর করছিলেন। কোণের দিকে বখা বাচ্চাটা সিক করে সিটি মেরে উঠল। ওরই মধ্যে প্রবীণা একজন আপত্তি করলেন, এতটা বাড়াবাড়ি ভালো নয়। ভদ্দরলোক ছোটলোক এক হয়ে গেলে যা হয়।
ব্যস, লেগে গেল ধুন্ধুমার। ছোটলোক! কথার ছিরি দ্যাখো। নিজে ভারী ভদ্দরলোক। ছেলে তো ছ-মাস বাইরে ছ-মাস ভেতরে।
মিনুর দিদিমা হঠাৎ বলে উঠলেন, হ্যাঁগা, এই বুঝি তোমাদের উত্তমকুমার?
পম্পা পাল তুলে ফড়ফড় করে চলে গেল। বাতাসে দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডার খসে পড়ল।
পম্পা হ্যাট্রিক না করে ছাড়বে না জানা কথা। দৃকপাত নেই। বসেই একগাল হেসে বললে, কী সুন্দর!
বড়র মেয়ে ফিরে এসে বললে, ওদের চাদরে হলুদের হাত মুছে দিয়ে এসেছি। গোদা পায়ের ছাপ মেরে এসেছি।
সেজোবউ বললে, কাজটা ভালো করোনি।
মেজো বললে কেন করেনি? বেশ করেছে। ওদের সঙ্গে ওইরকমই করা উচিত। যেমন কুকুর তেমন মুগুর। শাস্ত্রে আছে।
সেজো বললে, বাচ্চা ছেলে শীতের সময় একটু করে ফেলেছে। তোমরা দুজনে আদাজল খেয়ে মেয়েটার পেছনে লেগেছ।
তোমাকে যে উল দিয়ে হাত করেছে। তুমি তো বলবেই।
দীনবন্ধু ভবেশকে বললে, আর তো পারা যায় না। সময় যে চলতে চায় না। বাজল ক-টা?
প্রায় মেরে এনেছি।
কুকুরটা উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়া দিল। দীনু বললে, ব্যাটাও পেছনে লেগেছে। সেই থেকে খ্যাচর খ্যাচর গা চুলকাচেচ্ছ আর ভটাস ভটাস গা ঝাড়া দিচ্ছে।
ভবেশ ঘড়ি দেখে বললে, এবার ওঠা যেতে পারে। শেষ হয়েছে সিনেমা।
বাড়ি ঢুকে দীনবন্ধু প্রথমে গেট বন্ধ করল। দুটো পাল্লাই হাট খোলা ছিল। সদরে ঢোকার মুখে ধেড়ে পাপোশ পায়ের ধাক্কায় মাতালের মতো কাত হয়ে পড়েছিল। দীনু ধুলোসমেত টেনেটুনে সেটাকে যথাস্থানে নিয়ে এল। টেবিল ল্যাম্পটাকে সোজা দাঁড় করাতে করাতে বললে, এটা কী হয়েছে! হকি খেলছিলে নাকি?
দীনুর স্ত্রী বললে, ওইরকমই হবে।
একী! দামি অ্যাশট্রে, এখানে উলটে পড়ে আছে! তোমরা সত্যি! মিনুর দিদিমা সিগারেট খাচ্ছিল?
দীনুর স্ত্রী বললে, ওইরকমই হবে।
একী! এখানে কে চিনাবাদামের খোসা জড়ো করেছে? তুমি সত্যি একেবারে কাছাকোঁচা খোলা।
ওইরকমই হবে।
তার মানে? সামনের শনিবার স্ট্রেট বলে দেবে, হবে না, ঢুকতে দেওয়া হবে না।
আমি পারব না, পারলে তুমি বোলো। দীনু চাপা গলায় বললে, আপদ।
তোমারই আমদানি।
দীনু কার্পেটের ওপর ঝাড়ু চালাতে চালাতে বললে, ধূপ জ্বালো, ধূপ। সারা ঘর ভেপসে উঠেছে।
টিভির সামনে এসে মনে মনে সেই প্রার্থনা আবার জানাল, হে পিকচার টিউব, দয়া করে বিকল হও।
এদিকে ভবেশবৃদ্ধ সিধুজ্যাঠাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে দিতে একই প্রার্থনা বিধাতার দরবারে পেশ করল। বৃদ্ধ কাশতে কাশতে বললেন, চোখে ছানি, দেখতে পাই না, তবু সময়টা বেশ কাটে। একটা হিসেবও পাওয়া যায়, কে রইল কে গেল। আজ আছি কাল নেই।
আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল
আমার কেউ কোথাও নেই। একেবারে নিঃসঙ্গ। আমি আছি আর আমার সামনে বৈরী এক পৃথিবী। মুদিওলার মতো টাটে বসে আছে সামনে পাল্লা ঝুলিয়ে। মুখে লেখা আছে, ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল, আমি কি তোমার পর।’ আমার শিক্ষা নেই, দীক্ষা নেই, তেমন কোনও বংশ পরিচয় নেই। এমন কোনও পুঁজি নেই যা আমি ভাঙিয়ে খেতে পারি। শুধু একটা শরীর আছে, আর সেই শরীরে আছে একটি মন। আছে আর পাঁচজনের মতো বেঁচে থাকার ইচ্ছা। দুটো চলতে পারে। আমাকে চালাতে পারে। হাত দুটো ভাঙতে পারে, গড়তে পারে। সহজাত একটা বুদ্ধিবৃত্তি আছে, যা পড়ে শিখছে না, দেখে শিখছে।
এমন একটা অবস্থার কথা ভাবতেও ভয় লাগে। বুক কেঁপে ওঠে। আমি বেড়াল, কি কুকুর হলে এসব ভাবতুম না। নির্জন দুপুরে আমাদের গলিতে লম্বা, লম্বা ছায়া পড়েছে। শুকনো জলের কল। জল আসার আগেই সার সার রংচটা প্লাস্টিকের বালতির লাইন পড়ে গেছে। দুহাত, তিন হাত অন্তর অন্তর ছাই আর আবর্জনার টিবি চড়া আলোয় ক্যাট ক্যাট করছে। হঠাৎ কোথা থেকে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে একটা কুকুর এসে ছাই ঢিবি শুঁকতে লাগল। দেখেই মনে হল বহুদিন তেমন আহারাদি হয়নি। শীর্ণ হয়ে গেছে। সারা দেহ ক্ষতবিক্ষত। চোখে অদ্ভুত এক ভীত দৃষ্টি। হঠাৎ কোথা থেকে তেড়ে এল হোমদা হোমদা আরও গোটা দুই কুকুর। শুরু হয়ে গেল তর্জন-গর্জন। সমবেত আক্রমণ। কামড়াকামড়ি। কুকুরটা ন্যাজ গুটিয়ে পালাল।
কুকুরের পৃথিবী আর মানুষের পৃথিবীতে বিশেষ তফাত নেই। প্রায় একই নিয়মে চলেছে। কুকুরের ভাষা নেই, মানুষের ভাষা আছে। মানুষ বেরোও বলতে পারে। শুয়োরের বাচ্ছা বলতে পারে। কোটে কেস ঠুকে মায়ের পেটের ভাইকে ভিটেছাড়া করতে পারে। একজন আর একজনের পেছনে লেগে জীবিকাচ্যুত করতে পারে। কলের সামনে জলের লাইনে শক্তিমান ঠ্যাঙা হাতে এসে একজনের লাশ ফেলে নিজের বালতিটিকে শেষ থেকে প্রথম আনতে পারে। এই নাকি ‘রুল অফ দি গেম।’
এক মানব আর মানবী কোনও এক শ্রাবণের রাতে জৈব নিয়মে শরীরে শরীর রেখেছিল। আর ঠিক দশটি মাসের ব্যবধানে কেঁদে উঠল আর এক মানব সন্তান। রাজারও ছেলে হয়, ভিখিরিরও হয়। কেউ ঠেকাতে পারে না। অসংখ্য যোনি জীব যন্ত্রণায় ছটফট করছে। জন্মের ওপর জাতকের নিজস্ব কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। কে কোথায় এসে পড়ব একেবারেই অজানা। আমাদের শৈশব বড় অনিশ্চিত। নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কত কী ঘটে যেতে পারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও ভাগ্যকে মানতেই হয়। যে সংসারে জন্মেছি বড়লোকের খেয়ালে সে সংসার ভেঙে যেতে পারে। জমিদার কি শিল্পপতি পিতা, মদ আর মেয়েমানুষের পেছনে সব উড়িয়ে দিলেন। উত্তরপুরুষের জন্যে নীলরক্তের অহংকার ছাড়া আর কিছুই রইল না। শৈশব চলে গেল
অবহেলায়। যৌবন জীবনের সঙ্গে লড়াইয়ের নামটি গলায় তকমা হয়ে ঝুলছে। কারু করুণা নয়, ঘৃণাই তখন জীবনের সম্বল। হতাশাই তখন ভূষণ। মধ্যাহ্নেই আঁধার ঘনিয়ে এল। বীরভোগ্যা। পৃথিবীর যাবতীয় আয়োজনের মাঝে শুষ্ক, শীর্ণ, পত্রবিরল একটি বৃক্ষের ডালপালায় নীল আকাশ অতি ধূসর। পাখি আসে না। পায়ের তলায় পথিকের জন্যে ছায়া পড়ে থাকে না। বর্ষার সঞ্চিত। জলধারা তুলে নিতে পারে না। অপ্রস্তুত শিকড়।
এমনও হতে পারত মাতা তার অবাঞ্ছিত শিশুটিকে আবর্জনায় নিক্ষেপ করে মাতৃত্বের দায় মুক্ত হলেন। ক্রন্দনই যার পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণে একমাত্র ক্ষমতা, সে হয়তো সেই কান্না দিয়েই একটি প্রাণের উপস্থিতির কথা জানাল কোনও দয়ালুর কাছে, আবর্জনা থেকে উঠল গিয়ে। দোলায়। এমন আর কটি পরিত্যক্ত শিশুর বরাতে ঘটে! অন্ধকার এলাকার পরিসর অনেক বেশি। অন্ধকারের নায়করা আলোর সেনাপতিদের অতি সহজেই কিনতে পারে। সংসার-স্নেহে যারা সুরক্ষিত তারাও তো ছিটকে বেরিয়ে যায়! আর যারা একেবারেই অসহায় অপরাধ জগতের অক্টোপাস তাদের তো ধরবেই। অমৃতের পুত্র গরল-পুত্র হয়ে মানুষের শুভ প্রচেষ্টাকে বানচাল করে দিতে চায়।
পৃথিবী বড় অনিশ্চিত স্থান। আকস্মিকতায় ভরা। কার ভাগ্যে কখন কী ঘটে যাবে কিছুই জানা নেই। উত্তরপুরুষ পূর্বপুরুষের অবস্থার দিকে তাকিয়ে কোনও দিনই বলতে পারে না, তুমি নিজেই পরাজিত, ক্রীতদাসের সংখ্যা, পথের পাশে পড়ে থাকা ভিখিরির সংখ্যা আর না-ই বা বাড়ালে। পৃথিবীর ভাগ-বাঁটোয়ারা বহু বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। রাজা থেকে রাজা বেরোবে। প্রজা থেকে প্রজা। ভূস্বামীর বীজ থেকে অঙ্কুরিত হবে আর এক ভূস্বামী। দিনমজুর সংখ্যায় বেড়ে দিনমজুরই হবে। দার্শনিক অথবা সমাজ সংস্কারকের হাতে কিছু নেই। অক্ষরের মালা গেঁথে পৃথিবীর পুরোনো চেহারা পালটান যাবে না। অসিমুখে পৃথিবী ফালাফালা হয়ে গেছে। পাট্টা আর পত্তনি নিয়ে যে যেখানে ঘাঁটি আগলে বসে আছে, সে সেখানেই বসে থাকবে। পুরুষানুক্রমে। বিনা রণে সূচ্যগ্র স্বার্থ কেউ ছাড়বে না। তুমি কিছু চাও! একখণ্ড রুটি তোমার মুখের সামনে ছুড়ে দিতে পারি—দয়ার দান। কিন্তু খানার টেবিলটি আমার। কে বলে এটা মানুষের পৃথিবী! পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদকে মানুষের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে যে ভাগফল বেরোবে তা প্রতিটি মানুষের ভাগ্যফল হতে পারে না। প্রশ্ন কোরো না, কে তোমাকে ঐশ্বর্যের অধিকার দিয়েছে! ঈশ্বর! না ইতিহাস?
অধিকার থেকে গড়িয়ে চলেছে উত্তরাধিকারের স্রোতধারা। ইতিহাস হল অধিকারের ইতিহাস। অধিকার হারাবার ইতিহাস। শোণিতের ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে ভয়। তক্তে বসিয়ে যাই। উত্তরপুরুষকে। জীবনভর তারই প্রস্তুতি। আমি অধিকার করেছি। তুমিও অধিকার করো। আমার অধিকার মানে তোমার বঞ্চনা। ইতিহাসের দুটি ধারা—অধিকারের ইতিহাস, বঞ্চনার ইতিহাস। তোমার প্রতি আমার যত দয়া আর করুণা সবই হল অধিকারীর অহংকার। পৃথিবীর দুটি মাত্র খেতাব হওয়া উচিত, অধিকারী আর অনধিকারী। উইলসন, নেলসন, রকিফেলার, চট্টোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায়, ঘোষ, বোস, মিত্তির নয়।
অনধিকারীরা আছে বলেই, অধিকারীদের এত বিলাস। চায়ের দোকানের বয়, গৃহের গৃহভৃত্য। আমার সম্পদ ঠাসা সুদশ্য ব্যাগ তোমার মাথায়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমার পুত্রের হাত। তোমার হাতে। আমার মোজাইক করা মেঝেতে তোমার হাতের ন্যাতার দুবেলা ঘর্ষণ। আমার স্ত্রী-র ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রূপচর্চা তোমারই শ্রমের দান। আমার। সন্তুষ্টিই তোমার বেঁচে থাকার প্রাণরস। আমার অতীত ছিল বলেই বর্তমান আছে। বর্তমান আছে বলেই ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। তোমার বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎও নেই। আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল।
যুগে যুগে অনেকেই এলেন, পৃথিবীর আদি বিলিব্যবস্থা কিন্তু বদলানো গেল না। এখানে নয়, কোথাও নয়। কত ইজম এল আর গেল। ছাপাখানা কোটি কোটি অক্ষর প্রসব করে গেল। লক্ষ লক্ষ কথামালা ইথার তরঙ্গে ভেসে গেল। হল না কিছুই।
আকাশছোঁয়া ইমারত উঠে গেল আকাশের দিকে। ফোর্ড থেকে ডাটসন। ভল্ল আর বর্ম থেকে মিরাজ, ফ্যান্টম, আণবিক ক্ষেপনাস্ত্র। বিদেশি শোষকের বদলে স্বদেশী শোষক। টিবির বদলে ক্যানসার। কলেরার বদলে জন্ডিস। অনাহার নাম পালটে সভ্য ম্যালনিউট্রিশান।
লাখ লাখ পিএইচডি, ডি লিট তবু বধূর গায়ে কেরোসিন, গলায় শাড়ি। নাটকে বিস্ফোরণ, যাত্রায় রণহুঙ্কার, সংগীতে সমুদ্রের দোলা, গণনৃত্য, গণমিছিল আবার গণধর্ষণ। টাই আঁটা সেমিনার ফাইলবাঁধা রিপোর্ট। সাপের সেই একই সর্পিল চলন, লাঠির সেই একই উদ্যত ভঙ্গি। কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। আমসত্ব দুধে ফেলি /তাহাতে কদলি দলি/ পিপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে। অধিকারীর জগতে অধিকারীর আইনই সাব্যস্ত। অনধিকারীদের শুধু মেনে নেওয়া আর মানানো। পৃথিবী এক অদ্ভুত স্থান।
এই সবুজ শ্যামল ভূখণ্ড
আর অগাধ জলরাশি,
অথবা ধু ধু মরু
আর শিলা সারি সারি
ঞ্চল আলোকিত জনপদ
অন্ধকার গ্রাম আর নিবিড় বনানী
আমরা সবাই জানি।
পর্যটক ঘুরে ঘুরে সবই দেখেছে।
পৃথিবীতে আর কোনো স্থান নেই
যেখানে কলম্বাস দিতে পারে পাড়ি।
এইবার!
আর এক পৃথিবীর খবর
আমি দিতে পারি
এই গোলকেরই আদলে
কায়ার পাশে ছায়ার মতো
মহাশূন্যে ভাসছে।
এই পৃথিবীরই এক ছায়া ছায়া
বিষণ্ণ বীভৎস রূপ
সেখানে হায়নারা ধরেছে
মানুষের কায়া
তস্কর পরেছে সাধুর বেশ,
জননী ডাকিনী সেজে
সন্তানের শোণিতে করে
তৃষ্ণা নিবারণ।
সে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল
দূষিত বাষ্পে ভরা
সেখানে চুম্বন শুধু
মৃত্যুর নিশানা
আমি সেইনভোচর
মহাশূন্যে নভোযান থেকে
রাতে,
দেখেছি সেই ছায়া ছায়া
বিষাক্ত দ্বিপদে ভরা
ধূমায়িত আর এক পৃথিবী।
আলো
সেকালটাই ছিল মজার কাল। সবেতেই মজা। বাড়িতে চোর পড়লেও মজা। চোরেরাও ছিল অন্যরকম। প্রকৃতই অভাবী মানুষ। পেটের দায়ে চোর। ছিচকে চোর। ঘটি, বাটি, গামছা, জামা, লোহার বালতি, তোলা উনুন, কেরোসিন তেলের বোতল, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাইতেই সন্তুষ্ট। কোনওক্রমে রান্নাঘরে ঢুকতে পারলে সেই মাঝরাতেই হাপুসহুপুস করে খানিক পায়েস খেয়ে নিলে।
কোনও ইজ্জত ছিল না তাদের। চরিত্রে আত্মসম্মান বোধটাই অনুপস্থিত। সেকালের চোর ধরা পড়লে গণপিটুনিতে মরত না। ভোর হওয়ার আগেই চড়চাপড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। সে ছিল শান্তির কাল।
একদিন মাঝরাতে চোর এসেছে! জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে। খাটের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখছে, ঘুম কতটা গভীর! জ্যাঠামশাইয়ের ভরাট মুখে অসাধারণ এক জোড়া গোঁফ ছিল, ইংরেজিতে। যাকে বলে, ‘হ্যান্ডলবার মুস্ট্যাশ।’ গোঁফ জোড়া দেখে চোর মুগ্ধ। আলতো করে টেনেছে।
জ্যাঠামশাই ঘুমোতে-ঘুমোতেই বলছেন—আসল, আসল। বিরক্ত না করে ডিবেতে কাশীর জর্দা দেওয়া পান আছে, দুটো খিলি মুখে পুরে চলে যা।
চোর বললে—কত্তা, রাতে খাওয়াই জোটেনি। শুধু-শুধু পান খেয়ে কী করব!
খুব রেগে গিয়ে জ্যাঠামশাই বলছেন—হতচ্ছাড়া! রাতের খাবারটাও জোটাতে পারিস না, চুরি করতে এসেছিস!
বালিশের তলা থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে চোরকে দিয়ে বললেন—নে ধর।
পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে চোখ বুজিয়ে।
চোর বললে কত্তা, মাথাটা একটু তুলুন না, দেখি বালিশের তলায় আর কী আছে!
জ্যাঠামশাই বললেন—সমান দুভাগ করেছি। বউয়ের তবিল থেকে দশ ঝেড়েছিলুম, তোর পাঁচ আমার পাঁচ। একেবারে ন্যায়বিচার। ওই পাঁচ-ও দিতে পারি যদি আমার পা-দুটো টিপে দিস!
সে আমি দিচ্ছিখন। তোমার ঘরে খাবারদাবার কিচ্ছু নেই?
গাছপাকা দুটো আতা আছে তাকে। খবরদার ঘরের মেঝেতে বিচি ফেলবি না।
রাত আড়াইটের সময় আতা খেয়ে চোর পা টিপতে বসল। আবার জিগ্যেস করল কাল কী এই টাইমে আসব?
দুঃখ মেশানো গলায় জ্যাঠামশাই বললেন—সুখের দিনের আজই শেষ রাত্তির। কাল সকালেই ফিরে আসছেন বাপের বাড়ি থেকে। তুই বরং একটা কাজ করতে পারিস, এক ফাঁকে এসে বলে যেতে পারিস, টাকা দশটা তুই নিয়েছিস।
চোর বলল—মাপ করো কত্তা। মা ঠাকুরুনকে আমরা খুব চিনি। টাকা তুমি ফিরিয়ে নাও।
আর আতা!
কত্তা! সে তো খেয়ে ফেলেছি। এই লাইটারটা কাল চুরি করেছিলুম। তুমি রাখো। যা হয় কোরো।
আর একদিন চোর মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়োচ্ছে, পেছন-পেছন আমার বলশালী কাকাবাবু ছুটছেন, ব্যায়ামবীর। তার পেছনে আমরা। ওপাশে চোর মুখ ঘুরিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে, এপাশে আমার কাকাবাবু। মাঝখানের ব্যবধান হাত পঞ্চাশ। এতক্ষণ হচ্ছিল দৌড়ের অলিম্পিক। এবার রেস্টলিং।
দুজনেই দুজনকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছে।
চোর বলছে–কী হল! হিম্মত থাকে এসে ধরো।
কাকাবাবু বললেন—হিম্মত থাকে তো তুই আয় না।
চোর বললে—কোনও দিন শুনেছ, চোর এসে সাধ করে ধরা দিচ্ছে! চোর সবসময় পালায়, আর চোর পালালে তোমাদের বুদ্ধি বাড়ে।
তা পালা, থামলি কেন হঠাৎ! চোর আর ছুঁচো এই দুটোকে আমি ধরি না। আমার ঘেন্না করে। নে নে, ছোট-ঘোট।
আর কত ছুটব! প্রায় এক মাইল হল, সেই গজার মোড় থেকে দৌড় শুরু হয়েছে।
কাকাবাবু বললেন—তুই তো ব্যাটা আচ্ছা অধার্মিক। চোরের ধর্মই হল পালানো।
এতক্ষণে এটা তো বুঝেছ, আমি তোমার চেয়ে জোরে দৌড়োই। ইচ্ছে করলে পালাতে পারি।
তা পালাচ্ছিস না কেন?
কী করে পালাব? তোমাদের বাগানে কৃষ্ণকলির ঝোপে আমার মাল পড়ে আছে যে!
তোর চোরাই মাল আমাদের বাগানে! নিয়ে যা, নিয়ে যা।
চোর আর কাকাবাবু দুজনে গল্প করতে-করতে ফিরে এলেন, যেন হলায়-গলায় বন্ধু। দাওয়ায় বসে কাকাবাবু বললেন—আয় বোস, একটু জিরিয়ে নেওয়া যাক। দৌড়টা বেশ ভালোই হল কী বল? তামাক সাজতে পারিস?
তা আর পারি না!
যা, ওইধারে সব আছে। টিকে, দেশলাই, দুটো-কো, অম্বুরি তামাক। ভালো করে সেজে আন।
দুজনে আয়েস করে তামাক খেতে লাগলেন। ওদিকে ভোর হতে শুরু করেছে। এই চোর কালু কিছুদিনের মধ্যেই কাকাবাবুর ব্যবসায় কাকাবাবুর ডান হাত হয়ে গেলেন। আরামবাগে। কাকাবাবুর বিরাট কাপড়ের আড়ত। কালীবাবু বিশ্বাসী ম্যানেজার। ভীষণ খাঁটিয়ে।
বেশ কিছুদিন পরে কাকাবাবু বললেন কালু, এইবার একটি ভালো মেয়ে দেখে তোর বিয়ে দেবো।
কালু বলল—আবার! ওই চক্করে আর পা দিচ্ছি না।
সে কী রে! বিয়ে করিছিলি? বউ কোথায়?
চুরি হয়ে গেছে।
এখন তাই ভাবি, এই হাইটেক যুগে এইরকম সৎ চোর আর দেখতে পাওয়া যাবে না। আর রসিক গৃহস্থ! আমার দাদু, চোরের কাঁঠাল কাঁধে করে চোরের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছেন!
.
২.
দাদু আমাদের পরিবারে সবচেয়ে মজার মানুষ। নাম করা আইনজীবী। খুব ‘পপুলার’। যখন গম্ভীর তখন ধারেকাছে যাওয়ার সাহস থাকে না কারুর। মারাত্মক চেহারা। ছ’ফুটের ওপর লম্বা। সেই রকম স্বাস্থ্য। ভোরবেলা দমাদ্দম ব্যায়াম করেন। মুঠো-মুঠো ভিজে ছোলা হল ব্রেকফাস্ট। গায়ে সরষের তেল ডলে গঙ্গাস্নান। কথায়-কথায় গরিলাদের মতো বুকে দুমদুম চাপড় মেরে সঘোষে নির্ঘোষ—শরীরম আদাম খলু ধর্ম সাধনম। আই অ্যাম এ হোয়াইট গরিলা। আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে, সকলের সামনে, স্কুলের বন্ধুদের সামনেও ‘টিকটিকি’ বলে ডাকেন। হুইচ ইজ সো ইনসাল্টিং। মাকে বহুবার বলেছি—মা, তোমার বাবাকে সাবধান করে দিও।
মা বললে–বাবাকে সাবধান! আমার নাম রেখেছে ঘৃতকুমারী। তোর বাবার নাম হয়েছে মুষল। জ্যাঠামশাইয়ের নাম রেখেছে হাবিলদার। কাকাবাবু চৌকিদার। কী করবি বল!
দাদু একদিন রাতে খাওয়ার আগে খানাঘরে আসনে বসে বললেন—তোমাদের ভোজের আসরে আমার একটি সারস্বত নিবেদন আছে। ইদানীংকাব্যরচনায় মনোনিবেশ করেছি। লিখেও। ফেলেছি কয়েকছত্র। এতে মহাকাব্যের গুণ দেখতে পাচ্ছি। অনেক-অনেক দিন মহাকাব্য কেউ লিখলেন না। তার কারণ মুনি-ঋষিরা কেউ নেই। অবশেষে আমাকেই হাত দিতে হল। এই কাব্যের নাম, ‘টিকটিকিকাব্য’।
আমার ভীষণ প্রতিবাদ—এই কাব্য পাঠ করলে, আমি খাবার ঘর ছেড়ে চলে যাব। দাদু বললেন—সেটা অবশ্যই খুব বোকামির কাজ হবে; কারণ আজ শনিবার। তুমি স্পেশ্যাল ভোজ মিস করবে। পোলাও, মালাইকারি, রসনাসিক্তকারী সুখাদ্য যাবতীয়। বৎসে! ইংরেজরা আইন করেও কলমের স্বাধীনতা হরণ করতে পারেনি। সুতরাং শান্ত হয়ে বসে শ্রবণ করো। এটি পরে। নানাভাষায় অনূদিত হবে। চতুর্দিক থেকে মানুষ আসবে এই টিকটিকি কুঞ্জে অবতার দর্শনে।
এ অতি সুস্বাদু জীবন কাহিনি
অবতরিলেন এক সুদৃশ্য টিকটিকি।
মাথা ভরা কৃষ্ণ কেশ কৃষ্ণের মতো।
সারাদিন নানাভাবে পরিচয্যারত।
আর এগোলো না। খাবার এসে গেল। পোলাও-এর সুগন্ধে মহাকাব্য চাপা পড়ে গেল। খেতে খেতে দাদু বললেন—জানো তো, আমার আর ভালোমন্দ খেতে ইচ্ছে করে না। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সেদিন ভোলানাথের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। অত বড় গুণী মানুষ; কিন্তু নেগলেকটেড। একসময় মানুষটা খেয়ে আর খাইয়ে আনন্দ পেত। আমাকে বলছে—ধোঁকা খেতে কী ভালোই বাসতুম। স্ত্রী চলে যাওয়ার পর কাকেই বা বলব, কে-ই বা শুনবে! কারই বা সময় আছে!
আমার খুব ইচ্ছে!
সকলেই উন্মুখ! জ্যাঠামশাই বললেন সামনের রবিবার নেমন্তন্ন করা যাক। ধোঁকা এমন একটা কিছু হাতি-ঘোড়া ব্যাপার নয়!
দাদু বললেন—আমি সমস্যার গভীরে যেতে চাই।
বাবা বললেন—ডিপ ইনসাইড।
দাদু ভীষণ খুশি হয়ে বললেন—অ্যায়! তুমি ঠিক বাঙলাটা বলেছ—ডিপ, ডিপ, ডিপ ইনসাইড দা প্রবলেম।
জ্যাঠামশাই বললেন—বিস্তারিত জানতে ইচ্ছে করছে। বাংলা করলে, ইন ডিটেলস।
বাড়ির বাইরে লাল রঙের আলাদা একটা লেটার বক্স প্লেস করব। তার গায়ে লেখা থাকবে— ভোজন বক্স।
জ্যাঠামশাই বললেন—ওয়ান্ডারফুল। তার মধ্যে ধোঁকা থাকবে। ভোজন বক্স না লিখে ধোঁকার বাক্স লিখলে কেমন হয়?
আমার আইডিয়া আরও সুদূরপ্রসারী। এই পাড়ায় যার যা খেতে ইচ্ছে করছে, বিশেষ কোনও পদ, অতীতে খেয়েছে, স্মৃতিতে আছে, যেমন ধরো কচুরলতি, কি ইলিশপাতুরি, কি কইমাছের গঙ্গা-যমুনা, ভাপা ভেটকি, জাস্ট একটা স্লিপে লিখে ভোজন বক্সে ফেলে যাবে। শনিবার আমরা খুলে দেখব, রবিবার দুপুরে সার্ভ করা হবে।
বাবা বললেন—শুধু একটা আইটেমে তো হবে না, রীতিমতো খাওয়াতে হবে পাতা পেড়ে।
অফকোর্স। এতে আমাদেরও লাভ, আমরাও খাব। আমরা তো অনেক সময় আইটেম খুঁজে পাই না। আর আমাদের মেয়েরাও খুব উৎসাহ পাবে। আমাদের রবিবারগুলো উৎসবের চেহারা নেবে। সবাই লাইন দিয়ে আসছেন, কচুরলতি, মোচা, দই-করলা, ভাপা ইলিশ। সব পিলপিল করে আসছেন। হাঁচতে-হাঁচতে। কাশতে-কাশতে। লাঠি ঠকঠক করতে-করতে। কেউ কোমর সোজা করতে পারে না, কারও হাঁটু মোড়ে না। সকলেরই ওপরে যাওয়ার নোটিশ এসে গেছে।
জ্যাঠামশাই মুগ্ধ হয়ে বললেন—পৃথিবীর কোথাও এমন হয়নি। বাঙলায় বললে, দিস ইজ দি ফাস্ট টাইম ইন দি ওয়ার্লড।
বাবা এতক্ষণ একটাও কথা বলেননি, এইবার বললেন—তাহলে দক্ষিণ পাড়ারটা।
দাদু বললেন—দক্ষিণ পাড়ারটা মানে?
প্রথমে দক্ষিণ পাড়ার জমিটা বিক্রি করা যাক, তারপর চাঁপাডাঙ্গা, তারপর মধুপুরের বাগানটা।
কেন-কেন, জমিজায়গা বিক্রি করবে কেন? খুব অর্থাভাব! আমাকে বললেই হয়। মক্কেলরা সব টাকা নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আপনার এই পরিকল্পনা কার্যকরী হলে মাসে কী পরিমাণ টাকা লাগবে ধারণা আছে?
পুঁইশাক, কচুরলতি, মোচা, ডুমুর, পেঁপে, এসবের আর কী এমন দাম!
জ্যাঠামশাই বললেন—প্রজেক্ট কস্টটা তুই বের করে ফেল ছোট। এটা তোর সাবজেক্ট।
বাবা সায়েনসের। গণিতজ্ঞ। অঙ্ক নিয়ে খেলা করেন। জ্যাঠামশাই আর্টসের। ইংরিজি কেটে জোড়া দেন। সাহেবরা ইংরিজি শিখতে আসেন। দাদু আইনের। যার কেস ধরেন সেই মামলা জেতে। পাড়ার অনেকেই আমাদের হিংসে করে।
জ্যাঠামশাই অনেকক্ষণ ধরে একটা মাংসর হাড় নিয়ে কসরত করছেন। চুষে কিছুতেই ম্যারোটা বেরোচ্ছে না। থালায় ঠকাস-ঠকাস করে ঠুকছেন। বাবা বললেন—হয় তবলা ঠোকা হাতুড়িটা চেয়ে নাও, না হয় ওটার মায়া ত্যাগ করো।
বাবার কথায় কান না দিয়ে জ্যাঠামশাই বললেন—কিছু লিফলেট ছাপিয়ে বাড়ি-বাড়ি বিলি করতে হবে। তাতে লেখা থাকবে, নিমন্ত্রণের তারিখ আমরা জানাব। তাহলে হবে কী, ব্যাপারটা আমাদের কন্ট্রোলে থাকবে। সপ্তাহে একজন। জমিজমা বিক্রির প্রয়োজন হবে না।
দাদু বললেন—যদি দেখা যায় তিনজন কী চারজন একই আইটেম খেতে চাইছে, আমরা একই দিনে সেই ক’জনকেই আমন্ত্রণ জানাব।
জ্যাঠামশাই বললেন—গুড আইডিয়া, ভেরি গুড আইডিয়া।
বাবা বললেন—সমস্ত ব্যাপারটাই ভেরি রিস্কি। কিছু লোক পেয়ে বসবে। শুধু তাই নয়, তাদের বাড়ির লোককে অপমান করা হবে। তাঁরা বলবেন—কী আমরা খাওয়াতে পারি না? মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি! ফলে হবে কি, সেই লোকটির বাড়িতে তিষ্ঠানো দায় হবে। গাল বাড়িয়ে চড় খাওয়ার মানে হয় না।
দাদু বেশ চিন্তিত—অতি যুক্তিপূর্ণ কথা। তাহলে আমরা কী করব? অভিনব একটা কিছু। তোমরা সবাই ভাবো।
জ্যাঠামশাই বললেন,—আপাতত আমরা মন দিয়ে খাওয়াটা সেরে ফেলি; কারণ আমরা উঠলে তবেই মেয়েরা খেতে বসতে পারবে। অলরেডি আমরা অনেকটা সময় নিয়ে ফেলেছি।
দাদু বললেন—ঠিক-ঠিক। এ ব্যাপারটা আমাদের মনে ছিল না। রান্না তো উপাদেয় হয়েছে। অ্যাজ উপাদেয় অ্যাজ পসিবল। আচ্ছা আমি কি আর এক রাউন্ড চাটনি পেতে পারি!
অফকোর্স, অফকোর্স!
জ্যাঠামশাই সেই হাড়টার মায়া ছাড়তে পারেননি। আবার বারকতক ঠকঠক করলেন।
বাবা বললেন—ওরে কে আছিস, মেজদাকে দেখেশুনে একটা সহজ হাড় দে না।
জ্যাঠামশাই বললেন—ছোটু! খাওয়াটা বড় কথা নয়, বড় কথা হল বের করা। প্রশ্ন হল— বেরোবে না কেন?
ওটা আর্টের পথে বেরোবে না। বেরোবে বিজ্ঞানের পথে। আমার হাতে দাও।
তোর এখনও খাওয়া হয়নি। আমার এঁটোটা হাতে নিবি!
জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা পিতৃতুল্য।
শোন ছোটু, সামনের বার আবার আমরা একসঙ্গে জন্মাব। তোর কোনও আপত্তি নেই তো?
একটুও নেই। তবে একটা কথা, চ্যাটাস-চ্যাটাস করে যখন-তখন মারতে পারবে না।
তাহলে আমারও একটা কথা আছে। যখন-তখন আমার তলপেটে তোমার মাথা দিয়ে ভেড়ার মতো ঢুঁস মারা চলবে না।
আমাকে গরু, ভেড়া, ছাগল, না বললেই হল। মাঙ্কি বলা তো একেবারেই চলবে না। তাহলেই মারব ঘাড়ে লাফ।
বাবা একটা কায়দা করে নলিটার পিছন দিকে ছোট্ট একটা ফুটো করে দিলেন।
নাও, এবার টানো।
ফুড়ুত করে একটা শব্দ হল। জ্যাঠামশাই আধ-বোজা চোখে বললেন—স্পেলনডিড!
মনে রেখো, এই হল টেকনিক।
পরের জন্মে এই জন্মের কিছু মনে থাকবে না রে ছোটু!
সদরে গাড়ি থামার শব্দ হল। ছোট কাকা মার্চ করে ঢুকলেন, পিছনে কালীদা। দু-হাতে দুটো পেল্লায় ইলিশ ঝুলছে।
কাকাবাবু বললেন—যাঃ, খাওয়া ফিনিশ! বউদি দুটো গেল কোথায়?
দাদু বললেন হয়ে গেল। চারটে নাগাদ আবার আমাদের খেতে বসতে হবে। কোনও উপায় নেই।
কাকাবাবু আরামবাগ থেকে মাঝে-মাঝেই হুট করে চলে আসেন, তখন বাড়ি একবারে জমজমাট। খেতে আর খাওয়াতে ভালোবাসেন। ব্যায়ামবীর। ফুটবল পাগল এখনও। মাঝে মাঝে আমার কাঁধে হাত রেখে তেপান্তরের মাঠে বেড়াতে-বেড়াতে কত গল্প। সব কথাই শেষ হয়ে একটি কথায়—ঘনশ্যাম, আমিও বিয়ে করিনি, তুইও বিয়ে করিস না। তোর বাবাকে অনেক বারণ করেছিলুম, অবশ্য এটাও ঠিক, তোর বাবা বিয়ে না করলে তোকে তো পেতুম না। আই। লাভ ইউ ভেরি মাচ বাদশা খান।
যেটাকে আমরা তেপান্তরের মাঠ বলি, সে এক বিশাল মাঠ। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে চারটে পাড়া। পশ্চিমে কুমোর পাড়া। সুন্দর-সুন্দর চালা বাড়ি। মাঝখান দিয়ে মোটামুটি চওড়া একটা পথ, সোজা চলে গেছে নদীর ধারে। ওই নদীপথেই আসে এঁটেল মাটি বোঝাই নৌকো, পুজোর আগে। বিশ্বকর্মার মূর্তি তৈরির ফাঁকে-ফাঁকেই মা দুর্গা গড়ার কাজ শুরু হয়ে যায়। রাত্তির বেলায় দাওয়ায়-দাওয়ায় লণ্ঠন ঝোলে। ঘরে-ঘরে দেব-দেবীর মূর্তি। সেই আলো-আঁধারিতে হঠাৎ হাজির হলে মনে হয় স্বর্গে এসেছি।
আমার এক বান্ধবী আছে এই পটুয়াপাড়ায়। তার নাম সৌরভী। ঠিক যেন মা দুর্গা, ফ্রক পরে। হাঁটছে। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। আমার বাবা লেখাপড়ার ভীষণ ভক্ত। কেউ ভালো লেখাপড়া করছে জানতে পারলে, ডেকে পাঠাতেন। তার প্রায় সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতেন। তাকে নিজেই পড়াতেন। সৌরভী বাবার প্রিয় ছাত্রী। সৌরভীর ঠাকুরদার বাবা কৃষ্ণনগর থেকে। আমাদের গ্রামে এসেছিলেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সব কাজ এঁরাই করতেন। রাজপটুয়া। সবাই লেখাপড়া জানা। সৌরভীর ঠাকুরদা ছিলেন সংস্কৃতে পণ্ডিত। আমি তাঁর কাছে সংস্কৃত পড়েছি। সৌরভীর মা খুব ভালো কীর্তন করেন। মা আর মেয়েকে প্রায় একরকম দেখতে। কালীবাবুর কাঁধে এক গাঁট কাপড়, আমার মাথায় একটা বড়সড় পোঁটলা। কাকাবাবুর দু-হাতে দুটো পেল্লায় ব্যাগ। তেপান্তরের মাথার ওপর ঝুলছে তেপান্তর আকাশ। শরৎ-নীল। হালকা-হালকা, সাদা পালতোলা মেঘ। এক সার বক তিরের ফলার মতো উড়ে যাচ্ছে। মাঠ পেরিয়ে যাচ্ছি আমরা পটুয়াপাড়ার দিকে। যেখান থেকে পাড়ার শুরু সেখানে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বট। পটুয়াপাড়ার যেসব দেব-দেবী কোনও কারণে পূজা পায় না, সেইসব মূর্তি বটতলায় বেড় দিয়ে সাজানো। মহাদেব হাঁটছেন। মা শীতলার গাধা দাঁড়িয়ে গেছে। বিশ্বকর্মার হাতে হাতুড়ি। প্রতিমাদের ফাঁকে-ফাঁকে কাঠবিড়ালির ভীষণ লুকোচুরি। আর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাছের মাথায় এক ঝাঁক টাটকা টিয়া প্রচণ্ড আলোচনায় ব্যস্ত। আকাশ ফেটে পড়ছে।
পটুয়াপাড়ায় ঢুকেই একটা অঙ্গন, চারপাশ ঘিরে পরিচ্ছন্ন চালা কয়েকটি। সেই জায়গায় চলেছে জোর কপাটি খেলা। সৌরভীও রয়েছে সেই খেলায়। সে যেন নায়িকা। তার ফ্রক উড়ছে, বিনুনি দুলছে। ফরসা মুখ ঘাম-চকচকে।
কাকাবাবু ডাকলেন—সৌরভী।
সঙ্গে-সঙ্গে সে দৌড়ে এসে কাকাবাবুর কোমর জড়িয়ে ধরল।
দাও, একটা ব্যাগ আমার হাতে দাও।
পারবি? বেশ ভারী!
দাও না।
আমরা মিছিল করে এগিয়ে চলেছি। সামনে সৌরভী। তারপর আমরা। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে, কলাবাগান, তালপুকুর, প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরা সবাই মিলে পাড়াটাকে এত সুন্দর করে রেখেছে, হাঁ করে তাকিয়ে দেখার মতো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিক পিছন দিকে সৌরভীদের সুন্দর বাড়ি। ছোট সংসার। বাবা, মা আর ওই মেয়ে। ঝামেলা নেই ঝঞ্চাট নেই। বিদ্যালয়টা চালান বাবা আর মা। তকতকে নিকোনো দেয়ালে অপূর্ব আলপনা। দরজার মাথায় ঝুলছে শোলার ফুলের মালা। সৌরভীদের বাড়িটা যেন মন্দির। দালানের সামনে দাঁড়ালেই দেখা যায় ঘরের ভেতর মা সরস্বতীর অপূর্ব মূর্তি।
দাওয়ার ওপর কাপড়ের গাঁট, পোঁটলা-পুঁটলি, ব্যাগ, সব নামানো হল। তিনটে খরগোশ ভয় পেয়ে ছুটে পালাল। খরগোশের দৌড় দেখতে বেশ মজা লাগে। ওঠ-বোস করতে করতে কেমন দৌড়োয়। সৌরভীর মা-বাবা বেরিয়ে এলেন। এইসব কাপড়, জামা-প্যান্ট, সোয়েটার, লজেন্স, বিস্কুট সব বিতরণ করা হবে। দুর্গাপুজো এসে গেল। আর বসে থাকলে চলবে! একটা সোশ্যাল ব্যাগ, সেই ব্যাগে সৌরভীর বাবা, মা আর সৌরভীর জামা-কাপড়। সেই ব্যাগটি মায়ের হাতে তুলে দিতে-দিতে কাকাবাবু বললেন—আমাদের বাড়িতে আজ রাতে আপনাদের নিমন্ত্রণ। একজোড়া ইলিশ—যা পেয়েছি না, আপনারা না খেলে শান্তি পাব না।’
সৌরভী আমার কানে-কানে বললে—আমরা এখানে থেকে কী করব, চলো কপাটি খেলি।
সবাই তো মেয়ে!
তোমাকে আমি মেয়ে সাজিয়ে দেব। হাসতে লাগল সৌরভী।
খুব জোর খেলা শুরু হল। শরতের মাঠে, শরতের আকাশের তলায়। পুকুরের স্থির জলে মেঘ ভাসছে। বিরাট যেন রাজহাঁস। সৌরভী আমার বিপরীত দলে। কিত-কিত শব্দ করতে-করতে ঢুকেছি। ওদের কয়েকটাকে মোর করে বেরিয়ে আসছি; জাপটে ধরল সৌরভী। কী জোর! বাপরে! মাটিতে চিত। সৌরভী আমার বুকের ওপর। আমার পিঠের তলায় নরম-নরম ঘাস। সন্ধে হল। দিনের আলো কমছে। এক ঝাঁক ফড়িং উড়ছে। প্রাণপণে কিত-কিত শব্দ করছি। দম ফুরিয়ে আসছে। আর পারছি না। সৌরভীর ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের ওপর চেপে বসল। থেমে গেল কিত-কিত।
হেরে গেছি। তবু সৌরভী আমাকে ছাড়ছে না। ফিশফিশ করে বললে—এইবার কী হবে? পালাবে? আমার কাছ থেকে পালাতে পারবে? আমি দুর্গা।
রাত্তির বেলা পড়ায় মন বসল না। কেবল সৌরভীকে মনে পড়ছে। চাঁদ উঠেছে। হু-হু চাঁদের আলো তেপান্তরের মাঠে খেলা করছে। কাকাবাবু এসেছেন, বড়রা সব গল্পে ব্যস্ত। কালীদা খাটের তলায় বালি বিছিয়ে আলু রাখছেন, সারা বছরের আলুর স্টক। রান্নাঘরে মা আর জ্যাঠাইমা ইলিশ নিয়ে ব্যস্ত। হঠাৎ মনে হল কাকাবাবু সৌরভীদের নেমন্তন্ন করেছেন, আমি যদি গিয়ে বলি, আপনাদের নিতে পাঠিয়েছেন, তাহলে কেউ কিছু মনে করতে পারবেন না। আমার যে সৌরভীকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।
মনে হওয়া মাত্রই যাত্রা শুরু। একদিন না পড়লে কী আর হবে! ফাঁকা মাঠ। কেউ কোথাও নেই। দূরে কোথাও গান হচ্ছে। সুর ভেসে আসছে। মনে পড়েছে, দক্ষিণপাড়ায় রায় জমিদারদের মন্দিরে কীর্তন হচ্ছে। প্রত্যেক পুর্ণিমায় হয়। মাঝমাঠ বরাবর যেতে না যেতেই দেখি, ওরা তিনজন ওদিক থেকে আসছে। সৌরভী বললে কোথায় যাচ্ছ?
তোমাদের ডাকতে।
সৌরভী বললে—ভালোই হয়েছে। মা, তোমরা এগিয়ে যাও, আমরা মদনমোহনের মন্দির ঘুরে যাচ্ছি।
অনেক দেরি হয়ে যাবে না?
দেরি কী গো, এই তো একটু আগে সন্ধে হল। শুনছ না, আরতি হচ্ছে!
আমরা দক্ষিণপাড়ার দিকে এগোচ্ছি। চাঁদের আলোয় মন্দিরের সাদা চূড়াটা ধকধক করছে, যেন আকাশের গায়ে কাঞ্চনজঙ্! দাদুর মুখে শুনেছি, একশো বছর আগে এই মাঠটা ছিল। ডাকাতদের, ফাঁসুড়েদের। কত মানুষ যে খুন হয়েছে এই মাঠে! কথাটা মনে হওয়া মাত্রই আমি সৌরভীর গা-ঘেঁষে হাঁটতে লাগলুম।
কী হল, ভয় করছে?
জানো, দাদু বলেছেন, একশো বছর আগে এই মাঠে ডাকাতরা মানুষ মেরে পুঁতে দিত। তারা সব ভূত হয়ে এখানে আছে।
আছে তো আছে। তাতে তোমারই বা কী, আর আমারই বা কী? আমি দুবার দেখেছি। একদিন দুপুরবেলায় দেখেছি।
দুপুরবেলায় ভূত!
ও মা, তুমি সেই কথাটা শোনোনি, ঠিক দুপুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা! একটা লোক দড়িতে বাঁধা একটা ছাগল নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে যাচ্ছে। যেই জিগ্যেস করলুম, কাকু! কোন হাট থেকে ছাগলটা কিনলে? ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে ভ্যানিশ। মানুষটা নেই, ছাগলটা আছে। এইবার শুনবে! ছাগলটা আমাদের পাড়ার বিমলাদের ছাগল। ছাগলটা পাগল হয়ে গেল।
ছাগলও পাগল হয়?
হবে না, ভূতে ধরেছিল যে! থেকে-থেকে তার চোখ দুটো সাদা হয়ে যেত। আর ভীষণ-ভীষণ সব কাণ্ড করত। পায়রা, মুরগি এইসব ধরে-ধরে খেত।
শেষে কী হল?
জলে ডুবে মারা গেল।
মন্দির যত এগিয়ে আসছে বাদ্যিবাজনার আওয়াজ তত জোর হচ্ছে। বাড়ির দাওয়া থেকে আমাদের সকলের ‘রাঙা দিদিমা’ জিগ্যেস করলেন—দুটিতে চল্লে কোথায় গো? রাধা আর কৃষ্ণ!
সৌরভী বললে রাধা আর কৃষ্ণ দেখবে দিদিমা? আমাকে বললে—বাঁশি ধরে বাঁ-দিকে বেঁকে যাও। সৌরভী আমার গায়ে-গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। দিদার কী হাসি!
নাড়ু খাবি আয়।
আজ নয় গো দিদা। আজ তোমার রাধাকৃষ্ণ ইলিশ খাবে।
মন্দিরে মদনমোহন আজ কী সেজেছেন! কীর্তনীয়া মাথুর গাইছেন ভঙ্গি করে।
প্রচুর খাওয়ার পর প্রচুর গল্প। দাদু জিগ্যেস করলেন—দুটোতে কোথায় গিয়েছিলিস? দাদুর সঙ্গে আমাদের বন্ধুর সম্পর্ক। ইয়ারকি-টিয়ারকি একটু আধটু চলে। সৌরভীটা আজকাল একটু ফাজিল হয়েছে।
সৌরভী বললে—প্রেম দেখতে।
কার প্রেম?
রাধাকৃষ্ণের।
সে ভালো। প্রেম করেছিস?
একটু। তোমার নাতিকে আজ বেশ করে চুমু খেয়েছি।
আগেই খেয়ে ফেললি? বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা সইল না?
ধুর, তার এখনও অনেক দেরি।
মদনমোহনতলায় মন্দিরের পেছনে একটা কুয়ো আছে, দেখেছিস?
না!
ওর কোনও তল নেই।
মানে?
পাতাল পর্যন্ত নেমে গেছে। ভেতর দিকে জলের কিছুটা ওপরে ডান দিকে একটা সুড়ঙ্গ আছে, সেটা সোজা চলে গেছে পাইনদের রাজবাড়িতে। একেবারে গর্ভমন্দিরে। নবাবি আমলে, যখন মন্দির ভাঙাভাঙি হচ্ছে, মূর্তি চুরমার করছে, মদনমোহন তখন ওই সুড়ঙ্গে অনেকদিন ছিলেন। পাইনদের রাজবাড়ির পুরোহিত ওই দিক থেকে রোজ দুবেলা এসে চুপিচুপি পুজো করে যেতেন। ওপরে জঙ্গল। বোঝার উপায় ছিল না, যে, তলা দিয়ে চলে আসছে একটা সুড়ঙ্গ-পথ।
সৌরভী জিগ্যেস করলে—এখনও সেই পথ আছে?
এদিকে, ওদিকে কিছুটা তো আছে। মাঝে-মাঝে নেই। জঙ্গলটাই চলে গেছে। মানুষের বসতি হয়ে গেছে। জঙ্গলের শক্র মানুষ।
এইবার সবাই এসে ঘিরে বসলেন। আমাদের লাইনের গল্প থেমে গেল। জ্যাঠামশাইয়ের প্রিয় বিষয় হল, মাছ। আসরে বসেই বললেন—আহা, এমন চাঁদের আলো, মাছ ধরতে গেলে হত। কবিতার মতো রাত। জলার ধারে এইরকম রাতে অনেক রকমের অভিজ্ঞতা হয়। আমি একবার কথা-বলা মাছ দেখেছিলুম। বিরাট মাছ। জল থেকে রুপোর তৈরি মাথাটা তুলে বললে, আমার নাম সৌরভী, তোমার নাম?
সৌরভী বললে—সৌরভী তো আমার নাম।
জ্যাঠামশাই বললেন—সে আমি কী করব। মাছ বললে, আমার নাম সৌরভী। কী সুন্দর দেখতে। নাকে নোলক। চোখ দুটো টানা-টানা। কপালে টায়রা। আর এক চাঁদের আলোর রাতে দেখি, অপূর্ব সুন্দর, রাজার মতো একজন মানুষ জলের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আর ওপারে সাদা ধবধবে একটা বক। বেশ বড়। মাথায় রুপোলি একটা ঝুঁটি। চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে। এমন বক কখনও দেখিনি! ভয়ে-ভয়ে জিগ্যেস করলুম—আপনি কে?
সে কী? আমাকে চিনতে পারছ না? মহাভারত পড়োনি?
সংক্ষিপ্ত মহাভারত পড়েছি।
যুধিষ্ঠিরকে চিনতে পারছ না? ওই দেখো ওপারে বকরূপী ধর্ম। কিছুতেই জল নিতে দিচ্ছে না। মহাভারতের সেই প্রশ্নোত্তরের ‘কুইজ কন্টেস্ট’ শুরু হয়ে গেল, আমি ছিপ হাতে চুপটি করে বসে-বসে শুনছি—
বক। বলো যুধিষ্ঠির, পৃথিবীর চেয়ে গুরুতর কী, আকাশের চেয়ে উঁচুকী, বাতাসের চেয়ে দ্রতগামী কী, ঘাসের চেয়ে বিস্তৃত কী? সৌরভী বললে—আমি জানি। বেশ, তাহলে তুমি হও যুধিষ্ঠির আর আমি বুড়ো বক। উত্তর দাও।
মা পৃথিবীর চেয়ে গুরুতর। মদনমোহন মন্দিরের লালাজি আমাকে শিখিয়েছেন, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’ আকাশের চেয়ে উঁচু পিতা। বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী আমাদের মন। আর আমাদের চিন্তা ঘাসের চেয়ে বিস্তৃত।
বক।। কোন ধর্ম শ্রেষ্ঠ?
সৌরভী।। দয়া।
কোন ধর্ম ভালো ফল দেয়?
শাস্ত্রের ধর্ম।
মানুষ কী করলে দুঃখ পাবে না?
মনকে বশে রাখলে।
কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলে মানুষ ঠিক থাকবে, নষ্ট হবে না? এই যে এইটার সঙ্গে।
সবাই গুরুজন, তাঁদের সামনে সৌরভী আমার কাঁধে হাত রেখে বললে—সৎলোক।
কাঁধ থেকে হাতটা নামল না। ঘাড়ের কাছে ঠান্ডা-ঠান্ডা চুড়ির স্পর্শ। ভীষণ লজ্জা করছে। কেউ কিছু মনে করছেন না। সবাই জানেন, আমরা দুজনে ভীষণ বন্ধু।
বকরূপী জ্যাঠামশাই প্রশ্ন করলেন–বলো যুধিষ্ঠির, বার্তা কী?
সবাই থমকে আছেন, এইবার সৌরভী কী বলে! সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। সৌরভী হাসতে-হাসতে বললে—শুনুন ধর্মরাজ! পৃথিবীর এই মায়ার কড়াতে, সূর্যের আগুনে দিন আর রাতের কাঠ দিয়ে, মাস আর ঋতুর হাতা দিয়ে ঘেঁটে রাঁধুনী কাল জীবদের পাক করছে। ধর্মরাজ! এই হল বার্তা।
সবাই চটাপট-চটাপট হাততালি দিয়ে বললেন—এ মেয়েটা কে রে! কোথায় শিখলি?
ওই লালাজি। রামায়ণ, মহাভারত পড়েন, আমি বসে-বসে শুনি।
ধর্মরাজ বললেন—সাইলেন্স, সাইলেন্স। শেষ হয়নি এখনও। বলল, আশ্চর্য কী?
রোজ মানুষ মরছে। মানুষ দেখছে, তবু ভাবছে, আমি বোধহয় অমর। এরচেয়ে আশ্চর্য আর কী আছে!
বলো, পথ কী?
‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ।’
জ্যাঠামশাই আর পারলেন না। সৌরভীকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কী পুরস্কার চাস, বল? জ্যাঠামশাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে সৌরভী বললে—একটা রাজকুমার।
রাজকুমার কোথায় পাব মা?
মুখ না তুলে, পেছন দিকে হাত ঘুরিয়ে বললে—ওই যে, ওইখানে একটা বসে আছে। দাদু এতক্ষণ মৌজ করে পান চিবোচ্ছিলেন। দাদুর পান আমার বড়মা ছাড়া কেউ সাজতে পারেন না। বড়মা জমিদারের মেয়ে। বন্দুক চালাতে পারেন। ভীষণ সাহসী। একবার কোথা থেকে ঘোড়ায় চেপে একটা লোক। দুপুরবেলা। পুরুষরা কেউ ছিল না। যেন চম্বলের দস্যু। গুলি-গুলি চোখে। আমার দিকে তাকিয়ে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছিল। বড়মাবন্দুক হাতে বেরিয়ে এলেন। একটা ফাঁকা আওয়াজ করতেই লোকটা দমাস করে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গেল। পরে জানা গেল, পাইনদের বড় ছেলে ঘোড়ায় চেপে বিয়ে করতে যাবে, তাই তারকেশ্বর থেকে ঘোড়া। আনিয়েছিল। ওদের বাড়ির একজন ডাকাত সেজেছিল।
দাদু বললেন—এই টিকটিকিকে বিয়ে করবি গিরগিটি? তোর কী পছন্দ রে! আমরা বিয়ে করে ফেলেছি।
কবে করলি?
আজ।
কোথায় করলি?
মদনমোহনের মন্দিরে গেলুম কেন? ও কৃষ্ণ আর আমি রাধা। ওই জন্যেই না তোমরা এত খাওয়ালে!
দাদু বললেন—এবারে ডাকাতদের গল্প শোনো। ভয় পাবে না তো? না, ভয় পাবে কেন!
সেকালের ডাকাতদের কোনও তুলনা একালে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকালে জমিদার, রাত্তিরে ডাকাত। আমার মেসোমশাই যথেষ্ট ধনী ছিলেন। হরেকরকম ব্যবসা করে এত টাকা করে ফেললেন যে ডাকাতদের লিস্টে নাম উঠে গেল। মাসিমা অনেকবার সাবধান করেছিলেন, আর যাই করো বিপজ্জনক রকমের বড়োলোক হোয়োনা।
মেসোমশাই করুণ গলায় বলেছিলেন—আমি কী ইচ্ছে করে হচ্ছি! জোয়ারের জলের মতো টাকা এলে আমি কী করব! টাকায় আমার অরুচি ধরে গেছে। যাতে হাত দিচ্ছি সেইটাই লেগে যাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—ভাই রে! একেই বলে কপাল!
ডাকাতের চিঠি এল:
প্রিয় ব্রজবাবু, আগামী বুধবার আমরা আপনার অতিথি হব। তা জন পঞ্চাশ। মায়ের পুজো সেরে বেরোতে-বেরোতে মধ্যরাত হবে। এর আগে সাধারণত আমরা কোথাও যাই না। ফুলকো ফুলকো লুচি আর পাঁঠার মাংসর ব্যবস্থা রাখবেন। চার-পাঁচ রকমের ভালো মিষ্টি অবশ্যই। মঙ্গলবার যে-কোনও সময় আমাদের একজন যাবে একটা সাইনবোর্ড নিয়ে। সঙ্গে-সঙ্গে বাড়ির বাইরে ঝুলিয়ে দেবেন। আপনার সম্মান বাড়বে। আমরা যেখানে-সেখানে ডাকাতি করি না। আমাদের দল, এক নম্বর বনেদি দল। আমরা তিন পুরুষে ডাকাত। কোনও ভেজাল নেই। মায়ের দিকে তিন পুরুষ, বাপের দিকেও তিন পুরুষ। একমাত্র আমাদের দলেই সাতটা ‘মসার’ পিস্তল। দশটা গাদা বন্দুক আছে। আমরা অন্যদলের মতো মরচে ধরা তরোয়াল, টিনের পাতপ্যাতে। খাঁড়া, পাকা বাঁশের লাঠি, এ-সব ব্যবহার করি না। রণপা-র প্রয়োজন হয় না। ও-সব ভড়ং। সার্কাস। নিকৃষ্ট ডাকাতরা ব্যবহার করে। আমরা রেজিস্টার্ড। পুলিশকে নিয়মিত চাঁদা দি। কমসে কম দুশো মেয়ের ভালো পাত্রে বিয়ে দিয়েছি নিজে বসে থেকে। হাজার বিধবাকে কাশী, বৃন্দাবনে পাঠিয়েছি। নিয়মিত মাসোহারা পায়। আমার পূর্বপুরুষরা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে নরবলি দিত। হিংসা আমি সহ্য করতে পারি না, তাই কুমড়ো বলি দি। আমার স্ত্রী পরে ছক্কা বেঁধে, মহাপ্রসাদ হিসেবে বাড়ি-বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে।
আমাদের বাড়িতে দোল, দুর্গোৎসব সবই হয়। নিত্য দরিদ্র নারায়ণ সেবা।
ইতি,
বিনীত, বিশ্বনাথবাবু
চিঠিটা পাওয়ার পর পাড়াসুদ্ধ লোকের সে কী আনন্দব্রজ, এতদিন তুমি একটা বড়লোকই ছিলে, আজ, তুমি জাতে উঠলে। ব্রাহ্মণ সন্তানের যেমন পৈতে হয়।
প্রায় তিন বিঘে জমির ওপর চকমেলানো বাড়ি। দু-খানা পুকুর। আম, জাম, লিচু, সবেদা, কাঁঠাল গাছ। অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে ম্যারাপ বাঁধা হল। বিশ্বনাথবাবু বসবেন। কার্পেট ঢাকা। মঞ্চ। রুপোর নল লাগান ফর্সি। অম্বুরি তামাক। সাদা পাগড়ি মাথায় মেলোমশাইয়ের কর্মচারীর দল। গোরা ব্যান্ড এসেছে। ভিয়েন বসেছে। বিরাট-বিরাট সাইজের ডাকাতে লাড়ু তৈরি হচ্ছে। যেন মেসোমশাইয়ের মেয়ের বিয়ে।
সকাল থেকেই উদবেগ। বিশ্বনাথ ডাকাতবাবুর সাইনবোর্ড তো এল না। সাইনবোর্ডে লেখা। থাকবে, ‘বিশ্বানাথবাবু কৃপা করেছেন।’ এল না কেন! ‘কৃপাবোর্ড’ এল না কেন? সকলের মুখে মুখে একই উদবেগ। ডাকাতরা যে আসছে, তার আবার সিগন্যাল ছিল। দূরে রাতের আকাশ। কুঁড়ে পরপর তিনটে তারাবাজি উঠে ফুল ছড়াবে। তিনখানা আগুনে-মালা আকাশ পথে দুলতে দুলতে যে বাড়িতে ডাকাতি হবে, সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে আসবে।
সূর্য ডুবতে-না-ডুবতেই চারপাশ আলোয় আলো। সবাই উৎসবের সাজে সেজে উঠল। মেয়েদের মাথায় বড়-বড় খোঁপা। গলায় চিকচিকে সোনার হার। রং-বেরং-এর শাড়ি। মেসোমশাই পরেছেন চুনোট করা ফরাসডাঙ্গার ধুতি। গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি। হাতে দুলছে মোষের শিঙের স্টিক। গোঁফে আতর।
রাত আটটার সময় রব উঠল, আসছে, আসছে! ঘোড়া আসছে, কৃপা আসছে। এল একটা চিঠি।
‘প্রিয় ব্রজবাবু, আমাদের ভুল হয়েছে। আপনারই গ্রামের স্বরূপ দামোদরবাবু আবেদন করেছেন। তিনি আপনার চেয়ে ঢের বড়লোক। তাঁর কাছে বাদশাহি মোহর আছে, যা আপনার নেই। আমি দুঃখিত।
ইতি’
মেসোমশাই হাত থেকে ছড়ি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন—আমি মামলা করব।
সব গল্পই যেমন হয়, মধুরেণ সমাপয়েৎ। প্রবীণদের পরামর্শে মেসোর বড় মেয়ে চম্পার সঙ্গে দক্ষিণপাড়ার বিশ্বনাথের বিয়ে হল ওই রাতে। তিনি ডাক্তার, নাম করা। ডাকাতের বদলে ডাকতার এল ঘরে।
গল্পে-গল্পে রাত এগোচ্ছে। সময় খালি হাঁটে। বসতে জানে না। তেপান্তরের মাঠের ও-মাথায়, বোসপাড়ার দিকে শেয়াল ডাকছে। প্রহর ঘোষণা করছে। সেই শজারুটা বেরিয়েছে। রোজ রাতে নাচতে বেরোয়। তেপান্তরের মাঝমাঠে গোল হয়ে ঘুরে-ঘুরে নাচে। ঝমঝম আওয়াজ হচ্ছে।
সৌরভী জ্যাঠামশাইয়ের কোলে মাথা রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। বড়মা একটা বালিশ এনেছেন। সৌরভীর মাথাটা আস্তে করে তুলে বালিশে রাখছেন, ঘুমন্ত সৌরভী বলছে,—আমার খোঁপা, খোঁপা, আমার খোঁপা।
বড়মা আস্তে একটা আদরের চাপড় মেরে বললেন—এদিকে ঘুমে ন্যাতা, ওদিকে খোঁপা ভেঙে যাওয়ার চিন্তা।
কপালে ছোট্ট করে একটা চুমু খেলেন।
দাদু বললেন—’নাঃ, পৃথিবীটা সত্যিই খুব সুন্দর। এখানে বারেবারে আসতে হবে বেড়াতে। এই গ্রুপ। একেবারে পাক্কা। দেখো, সায়েবদের বিয়ের আগে একটা ব্যাপার থাকে—’এনগেজমেন্ট’। সেই কাজটা আমি করে ফেলতে চাই। পরির মতো এই মেয়েটার সঙ্গে দেবদূতের মতো এই ছেলেটার ‘এনগেজমেন্ট’। তোমাদের আপত্তি আছে?’
কী আশ্চর্য! আমরা সবাই তো এই একই কথা ভাবছি।
তাহলে দেবদূত পরির অনামিকায় এই রুবির আংটিটা পরাও।
ঘুমোচ্ছে; কিন্তু আঙুলটা উঁচু করল।
দাদু বললেন—ভীষণ আনন্দ হচ্ছে আমার। বিয়েটা যখন হবে তখন তো আমি থাকব না। পৃথিবীর দিন ফুরিয়ে যাবে।
হালুম করে বাঘ যেমন শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সৌরভী সেইভাবে দাদুর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল
—থাকবে না মানে? থাকবে না মানে?
দুজনে জড়াজড়ি করে মাটিতে গড়াগড়ি।
আলো-অন্ধকার
এক-একটা দিন ভোলা যায় না। জীবনে সেই সব দিন যেন নোঙর করা নৌকোর মতো স্মৃতির ভারে দুলতে থাকে। একটু দেরি হল অফিসে পৌঁছোতে। আজকাল আর সময়কে কোনও কিছুতেই মাপা যায় না। সময়ের হিসেবে স্থানের দূরত্ব যেন বেড়েই চলেছে। একই যানবাহনে এই একই জায়গা থেকে আগে যে সময়ে ডালহৌসি পৌঁছোতুম এখন তার চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। এর একাধিক কারণ। আমরা যে অঞ্চলে রয়েছি সেখান থেকে অনিবার্য কারণে অনেক সুযোগ-সুবিধেই ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে। একটা বড় বা প্রধান বাসরুট উঠে গেছে। অন্যান্য বাসের সংখ্যাও অনেক কমে গেছে। দুধ পাওয়া যায় না। পোস্টঅফিস নেই। বাজারের অবস্থাও খারাপ। জিনিসপত্রের চালান নেই। স্কুল, কলেজ অনিয়মিত। মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ নেই বললেই চলে, সকলেই গৃহের গণ্ডিতে অন্তরিন। আজকাল দেরিতে অফিস পৌঁছেলে কেউ কিছু মনে করে না। কারণ সব কিছুই অনিশ্চিত! সকলেরই এক অবস্থা। বলতে গেলে—ফাদার উই আর অন দি সেম বোট।
অফিসে পৌঁছে আজকাল আর প্রস্তুতির সময় পাওয়া যায় না। ঢুকেই কাজ নিয়ে বসতে হয়। কোনও কোনওদিন এক ঘর ভিজিটার নানা সমস্যা নিয়ে মুখিয়ে বসে থাকে। পোর্টফোলিও এক কোণে ফেলেই কাজের স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দিতে হয়। এর মাঝে একমাত্র রিলিফ— মলয় এক কাপ চা যখন দিয়ে যায়। চুমুকে চুমুকে চা খেতে খেতে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকানো—পনেরো-কুড়ি মিনিটের জন্যে অন্য জগতে, কল্পনার জগতে মুক্তি। টেলিফোন বেজে উঠল। চায়ের সময় ফোন বড় বিরক্তিকর। তবুও রিসিভার তুলতে হল। ও প্রান্তে কাবেরী। কী হল! এই তো মাত্র দু-ঘণ্টা আগে তাকে ছেড়ে এলাম। কী হল কাবেরী? একটু তাড়াতাড়ি চলে আসব! আচ্ছা, তুমি যদি এইরকম করো, কাজকর্ম কী করে করব! লোকে আমাকে স্ত্রৈণ বলবে যে। আচ্ছা আজকের দিনটা। বেশ তাই হবে। কিন্তু নট বিফোর ফোর।
একটা জরুরি ডেসপ্যাঁচ ছিল। তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললুম। দুটো নোট পাঠিয়ে দিলুম বড়কর্তার ঘরে। এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এলেন তাঁর মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটির বয়স বেশিনয়। এমন করুণ চেহারা যে দেখলেই মায়া হয়। ভদ্রলোক বছরখানেক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বিপর্যয়। এখন মেয়েকে কোনও হাতের কাজ শিখিয়ে স্বাবলম্বী করতে চান। মনে যে ঝড় বইছে তা তো আর কমানো যাবে না, এখন দেহটাকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু আন্তরিক ব্যবস্থাপত্র দিলেও, কাজ কী হবে বলা শক্ত। কিন্তু বৃদ্ধ খুশি হয়ে চলে গেলেন। আশা এমন জিনিস, কিছু একটা হতে পারে এই চিন্তায় তিনি হয়তো কয়েক দিন স্বপ্ন দেখে কাটিয়ে দেবেন।
কাবেরীকে কথা দিয়েছি—একটু আগে বেরোব। সুতরাং, কাজ সারতে হবে চটপট। এর পর সামান্য কিছু কেনাকাটাও আছে। আমার সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের আকর্ষণ প্রকৃতই অসাধারণ। সাজানো-গোছানো, ছিমছাম। কাবেরীর শিল্পীমনের ছাপ সর্বত্র। পরদা থেকে শুরু করে বিছানার চাদর, টেবলক্লথ, সোফাসেটের ঢাকা এক রঙের। পালিশ করা অল্পসল্প ফার্নিচার। জাপানি। কায়দায় ফুল সাজানো। দেওয়ালে কয়েকটি নির্বাচিত জায়গায় কাবেরীর নিজের আঁকা, জল এবং তেল রঙের বিভিন্ন স্টাডি। আমার নিজের সংগ্রহশালার কিছু কিছু ছবি। শিল্পসমালোচক হিসেবে আমার নিজের সংগ্রহও বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। এই ছবি দিয়েই আমাদের পরিচয়ের শুরু। অ্যাকাডেমিতে কাবেরীর একক চিত্রপ্রদর্শনীতে আমাদের প্রথম আলাপ। শেষ আমার ফ্ল্যাটে। নিঝঞ্চাট, নির্বিবাদী মানুষ না হলেও শিল্পসত্তা একটা আছে, স্ত্রী একজন রুচিসম্পন্না প্রকৃতই যশস্বী শিল্পী। যোগাযোগ অদ্ভুত। ভাগ্য দেখে হিংসে করলে কিছু করার নেই। সবই ভবিতব্য। তবে আমি এইটুকুই জেনেছি, জীবন থেকে এই পাঠই নিতে পেরেছি সুখ আর দুঃখ চাকায় বাঁধা, জীবনে ঘুরে ঘুরে আসে। উৎফুল্ল হওয়ার কিছু নেই। একটা মুক্ত অনাসক্ত মন নিয়ে চলতে হবে।
সাড়ে তিনটে। এবার বেরোতে হবে। দিনের কাজ শেষ। কয়েকদিন দেখছি কাবেরী সঙ্গ চাইছে। ভীষণ মুডি মেয়ে। যখন ছবি নিয়ে থাকে তখন তার সেই জগতে আমার প্রবেশ নেই। আমায়। হঠাৎ হয়তো ডেকে নেবে। দেখো তো কেমন হচ্ছে সমালোচক মশাই! ইজেলের ধারে দাঁড়ানো তার দীর্ঘ শরীর, হাতে তুলি, রঙিন শাড়ি, তেলহীন অবিন্যস্ত চুলের ঢল পিঠে ভেঙে পড়েছে সে তখন নিজেই একটা ছবি। কাকে দেখব? ক্যানভাসের ছবি না জীবন্ত ছবি! তখন স্বভাবতই একটু অন্যরকম আবেগ মনের মধ্যে টগবগ করে ওঠে। দুজনের নিভৃত সংসারে স্থান, কাল, পাত্রের তো কোনও বাধা নেই। কাবেরী হয়তো একটু মৃদু আপত্তি জানায়। সে আর কিছু নয়, ব্যাপারটাকে আরও একটু আকর্ষণীয়, উদ্বেল করে তোলা। আমি তখন বলতে চাই—দিস ইস। লাইফ মাই ডিয়ার লেডি! তখন সেই অফিস অথবা জীবনসংগ্রাম কিংবা শহরজীবনের কাটাকাটি, হানাহানি, অথবা রাজনীতি ইত্যাদি অনেক দূরে। যেমন সমুদ্রের গর্জন। কানে আসছে কিন্তু যেহেতু জলে নামিনি সেইহেতু যেন একটা অন্য স্বাদ। সব মিলিয়ে জীবন।
আজকাল ট্যাক্সি কিংবা অফিসের গাড়ি পাড়ায় ঢুকতে চায় না। মানুষের নিরাপত্তা ক্রমশই কমছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন জঙ্গল এখন শহরের চেয়ে অনেক নিরাপদ। বাঘ অথবা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের গতিবিধি অথবা আচার-আচরণের একটা বাঁধা নিয়ম আছে, কিন্তু মানুষের চালচলনের নাকি আজকাল কোনও ঠিক নেই। সেই গল্পের সিংহ, যে উপকারীর উপকার মনে রেখেছিল। এরেনার সমস্ত মানুষ রুদ্ধনিশ্বাস। বন্দি আর ক্ষুধার্ত সিংহ মুখোমুখি। সিংহ বন্দির পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল। কারণ একদা এই বন্দিই তার পা থেকে কাঁটা বের করে দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ! বিদ্যাসাগরমশাই বলেছিলেন—অমুকে আমার সম্বন্ধে যা-তা বলছে কেন, কই আমি তো তার কোনও উপকার করেছি বলে মনে পড়ছে না। যুগ তো পালটায়নি। মানুষের স্বভাব সেই একই আছে।
নিউ মার্কেট থেকেই পরদার কাপড় কিছু কিনে নিই। একটা বাথ টাওয়েল। আর একটা বিলিতি সেন্ট। কাবেরীকে একটু সারপ্রাইজ দিয়ে দেব। কেনাকাটা সাধারণত বিনা দর-দস্তুরে হয় না। ভারতবর্ষে একটা জিনিসের ঠিক কী দাম, বোঝবার উপায় নেই। মুনাফার পরিমাণ কত কেউ বলতে পারবে না। বিক্রেতাদের মেজাজ অত্যন্ত চড়া পরদায় বাঁধা। বেশি কথা বলারও উপায় নেই।
কেনাকাটা শেষে একবার ট্যাক্সির চেষ্টা করে দেখতে ইচ্ছে হল যদি পেয়ে যাই। দুটো ট্যাক্সি। ফ্ল্যাগ ডাউন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে গেল। আমার মতো যাত্রীর আবেদন অথবা অনুরোধ শোনার কোনও ইচ্ছেই দেখা গেল না। একজন থামলেন, কিন্তু তিনি আমি যেদিকে যেতে চাই তার। উলটোদিকে ছাড়া যাবেন না। আর একজন বললেন তিনি খাওয়া-দাওয়া না করে এক পা-ও নড়বেন না এবং সেই আহারপর্ব কখন কোথায় শেষ হবে তিনি জানেন না। এর পর ট্যাক্সি করে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হল। যদিও সেই সপ্তাহ ছিল ট্যাক্সিচালকদের সৌজন্য সপ্তাহ।
চৌরঙ্গির মোড়ে তখন জমজমাট অবস্থা। চারদিক থেকে পতাকাধারী মানুষের মিছিল একের পর এক আসছে। কোনও যানবাহনই চলার রাস্তা পাচ্ছে না। এই শতকের মানুষ প্রায়শই। সমস্যাগুলোকে দার্শনিকের চোখে দেখে থাকেন। কোনও কিছুই আর তেমন করে মনে দাগ কাটে না। মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে না। অন্য সময় হলে আমিও এতটা ছটফট করতুম না বাড়ি যাওয়ার জন্যে। কাবেরী এখন এই সময়টা আমার সঙ্গ চায়। আমার অভিজ্ঞতা কম কিন্তু শুনেছি মেয়েদের এই সময়টায় নানারকম মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। বলতে পারে না মুখ ফুটে। শরীর অপটু হয়, মনের মধ্যে সাগরের ঢেউ আছড়া-আছড়ি করে। বাড়িতে মা, অথবা বর্ষীয়ান কোনও মহিলা থাকলে এইসময়, ঠিক এই সময়ে হয়তো অনেক সাহায্যে আসতেন। অন্য সময় হলে এই ভীষণ বিভ্রান্তিকর অবস্থা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতুম। কোনও একটা সিনেমার যে কোনও মূল্যের একটা টিকিট কেটে ঢুকে বসে থাকতুম। ইতিমধ্যে মিছিলের মানুষ, জমে থাকা অসংখ্য যানবাহন, ঘরমুখো মানুষ, সময়ের ভেলায় চেপে এই কেন্দ্রস্থরঙ্গমঞ্চ ছেড়ে যে যার দিকে চলে যেত। হয়তো বাস, ট্রাম অথবা অন্যান্য যানবাহন বন্ধ হয়ে যেত। বেশি রাতে হয় হেঁটে না হয় ভাগের ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে যেতুম।
হঠাৎ একটা প্রায়-খালি আমার রুটের গাড়ি মোড় ঘুরছে দেখে অনেকটা জীবনের মায়া ছেড়েই লাফিয়ে উঠে পড়লাম এবং একটা বসার জায়গাও পাওয়া গেল। এই সব ছোটখাটো ঝুঁকি। অনিচ্ছা সত্বেও নিতে হয় অথচ এর থেকে যে কোনও মুহূর্তে বড় রকমের বিপদ ঘটতে পারে। অবশ্য জীবন মানেই ঝুঁকি। এর পর গাড়ি চলবে শম্বুকগতিতে। জ্যামে আটকাবে। কয়েকবার রাস্তা পালটাবে। আকণ্ঠ মানুষ বোঝাই করবে। যেখানে খুশি থামবে। টিকিটের পয়সা নিয়ে। ঝগড়া হবে। যাত্রীদের মধ্যে ফাটাফাটি হবে। এ এক চলমান রঙ্গমঞ্চ। এরই মধ্যে চোখ বুজিয়ে বসে থাকা। ঝিমুনি আসতে পারে। কখনও বিরক্ত হয়ে নেমে যাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। অবশেষে নিজের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি। কিন্তু আজ আর গন্তব্যে পৌঁছোনো গেল না। তার আগেই যাত্রা শেষ। বাস যাবে না। নেমে যান। কে একজন ভয়ে ভয়ে ফিশফিশ। করে বলল—সামনেই মার্ডার হয়েছে, ভারী লিডার ছিল। অনেক আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠের প্রশ্ন—কে, কে? কী নাম? হেঁটে যাওয়া যাবে তো ভাই সামনে? এসব প্রশ্নের তো কোনও উত্তর নেই। সকলেই পালাতে চাইছে।
প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে নেমে পড়তে হল। এসব ঘটনা এই শহরজীবনে বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমি তো মরিনি, এখনও বেঁচে আছি, অতএব ভাববার কী আছে। জীবনটাকে একটা মোড়কের মতো করে সাবধানে বাড়ি অবধি নিয়ে যেতে হবে। হয়তো কোনও সময় ফসকে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেই হারাবার মুহূর্তে সাময়িক একটা আপশোশ, খুব অল্প সময়ের জন্যে। কেউ কেউ অবশ্য হারাতে হারাতেও ফিরে পেয়ে যেতে পারেন। সে এক ভীষণ অভিজ্ঞতা!
কিন্তু যতই এগোচ্ছি রাস্তা নির্জন, থমথমে, সমস্ত দোকান বন্ধ। এখনও দিনের আলো নেভেনি। দিন আর রাত্রির সন্ধিক্ষণ। ঘটনার কেন্দ্রস্থল থেকে সকলেই যেন দূরে চলে যেতে চাইছে। ভীত পশুর মতো। জানি, জিগ্যেস করলে কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। সামনে হয়তো কিছু দূরে। মানুষের কোনও প্রতিনিধি ধুলোয়, রক্তে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনও শোক নেই, কোনও করুণা নেই। কারণ আমরা এখন প্রকৃতই দার্শনিক। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করাও উচিত নয়। প্রশ্ন—আমার নিরাপত্তা আছে কি না। আমি ওই পথ দিয়ে সোজা, অক্ষত আমার সাজানো সুন্দর ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে পারব কি না, যেখানে আমার জীবনের অনেক নরম মুহূর্ত আমার অপেক্ষায় রয়েছে।
একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিয়ে, কাঁপা কাঁপা, দুরুদুরু বুকে যতটা সম্ভব দ্রুত স্থানত্যাগ। একটা টাটকা মৃত্যু। দুশ্যটা অসহনীয়। মাত্র পনেরো-কুড়ি মিনিট আগের ঘটনা। জনশূন্য স্থান। সকলেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত। সকলেই স্থান ত্যাগ করেছে। আমিও করছি। এ ছাড়া কী করার আছে! পশু হলে হয়তো মৃতদেহের পাশে এসে শুকে দেখতুম, বিলাপ করতুম। চকাচকি পাখির গল্প শুনেছি। কাকের মৃত্যুও দেখেছি। মানুষ আজকাল পথে-ঘাটে নিঃসঙ্গে মরে। মৃত্যুর আর যেন সেই গ্ল্যামার নেই।
সেই নির্জন রাস্তায় হঠাৎ কিছু চরিত্রের আবির্ভাব হল। চার-পাঁচটি ছেলে, প্রত্যেকেরই দু-হাতে গোলাকার পদার্থ। মৃতদেহের কাছাকাছি এসে, একটা গলির মধ্যে, সেই বিস্ফোরক দু-একটা ছুড়ে দিল। আমি একটু ভয় পেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম আমার শবদেহের ওপর দিয়েই চলে যেতে চাইবে। কিন্তু আমাকে তারা উপেক্ষা করল। আমার শরীর একটু ঘর্মাক্ত হল। আমার গতি দ্রুত হল। আমার কণ্ঠতালু শুষ্ক হল। এখন কি কোনও রিকশা পাওয়া যাবে? আমার পথের সঙ্গী? কোথায় কী! পথ জনশূন্য। যতদূর দৃষ্টি চলে, সরীসৃপ রাস্তা প্রসারিত। সেই প্রসারিত রাস্তায়, মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমি যেন কত যুগ ধরে চলেছি। অবশেষে পৌঁছেছি আমার সেই কোমল, কমনীয় গৃহের গণ্ডিতে।
কাবরী উৎকণ্ঠিত। তুমি আসছ না কেন? আমি ভাবছি। চারটে বলেছিলে। তারপর কী গোলমাল এইদিকে। তুমি এসেছ! কাবেরী আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও কীসব করে ফেলল আবেগের মুহূর্তে। একবার মনে হল সেই পথের চার মোহনায় যে পড়ে আছে, তারও জন্যে হয়তো এমনই কেউ জানলার গরাদে মাথা রেখে অপেক্ষা করছে। আমার অক্ষত ফিরে আসার পুরস্কার এই আদর, এই চুম্বন। অবশেষে গরম কফি, কিছু সুস্বাদু ভাজা। জীবনের ছোট ছোট অথচ গভীর সুখ।
রান্নাঘর থেকে প্রেসার কুকারের স্টিম মাংসের সুগন্ধ নিয়ে আসছে। ভাগ্যিস ওইসব গোলমাল শুরু হওয়ার আগেই কিনে এনেছিলাম। কাবেরী যেন বিজয়ীর হাসি হাসল। মানুষ কত অল্পে কত তৃপ্ত। মাংস কেনা আর রাজ্য জয় করা যেন দুটো সমান ওজনদার জিনিস। মাংস না পেলেই বাকী অসুবিধে হত! কিছুই না, ডিম ছিল। কাবেরী একটু ছড়িয়ে বসল। শরীর বেশ ভারী। হয়েছে। এই সময়টা মেয়েদের কেমন যেন ক্লান্ত অথচ পূর্ণ দেখায়। কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছে। কিছু অপ্রাসঙ্গিক। চারদিক নিস্তব্ধ। রাস্তা অন্ধকার, জনশূন্য। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও বাড়িতে একটা রেডিও বাজছে না। একটা থমথমে আবহাওয়া। কখন কী ঘটে যায়! একটু আগে জীবনকে মেডেলের মতো গলায় ঝুলিয়ে ওই পথে যে এসেছি এ যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আশে-পাশে এখনও অনেকে ফিরতে পারেনি। কিন্তু তাতে আমাদের কফি খাওয়া অথবা ছোট ছোট গল্পের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ আমি তো ফিরে এসেছি, যারা। আসেনি তারা আসবে, হয়তো আসবে না। কী করা যাবে। আজকাল আর কিছু করা যায় না। ঘটনার স্রোতকে প্রতিরাধ করা যায় না। চারদিক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। তা না হলে হয়তো গান গাওয়া যেত কিংবা রেডিওগ্রামে কিছু রেকর্ড বাজানো যেত। কিন্তু ইস্পাতের পাতের মতো এই দুর্ভেদ্য নিস্তব্ধতাকে শব্দ দিয়ে ভেদ করতে ইচ্ছে করছে না।
তোমাকে আজ সকাল সকাল আসতে বলেছিলুম, তা না হলে, কী হত বলো তো! যত রাত বাড়ত ততই গোলমাল বাড়ত। পথঘাট বিপজ্জনক হত। আর আমি একলা এই শরীরে কেবল ঘরবার করতুম। তা ঠিক। তবে কী জানো, তুমি কোনওদিন ফুটবাথ নিয়েছ? প্রথমে গরম জলে পায়ের তলা ছ্যাঁক করে ওঠে। পা তুলে নিতে হয়, তারপর সইয়ে সইয়ে আস্তে আস্তে আধখানা পা সহজেই চলে যায় জলের তলায়। এখন যদি ওই অন্ধকার ঘন রাতে, ঘাতকদের মধ্যে দিয়ে আমাকে আসতে হত, উপায় নিশ্চয়ই একটা বের করে নিতুম। ছায়ায় ছায়ায় মিশে মিশে, বিপদকে ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে রেখে, দেখতে ঠিকই এসে উঠেছি তোমার এই ঘরে। দেখবে আমার পরেও এমনিভাবে অনেকে এসেছে।
এর পর আমাদের সেই শান্ত গৃহকোণে বাইরের জগতের নানা খবর ভেসে আসতে লাগল। অনেক ঘুরে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, হাত মাথার ওপর তুলে অনেকে ফিরে এলেন। দোকান পুড়ছে। বাড়ি জ্বলছে। অসংখ্য ক্ষিপ্ত মানুষ অনেক মৃত্যু দিয়ে একটি মৃত্যুর ক্ষোভ ভুলতে চাইছে। কে যাবে, কে থাকবে বলা শক্ত। অনেকে এমন কথাও বললেন, আমরা নাকি কেউই। নিরাপদ নই। কাবেরী যেন আমার খুব কাছাকাছি এসে একটু নিরাপত্তা খুঁজতে চাইছে। সে যেন এই মুহূর্তে জানালা, ঘরের কোণে কোণে, এমনকী শিলিং-এ পর্যন্ত অসংখ্য কালো কালো মুখ দেখছে।
রান্না বেশ ভালো হয়েছে। আয়োজনে কোনও ত্রুটি নেই। সাজানো খাবার টেবল, পরিষ্কার টেবল-ঢাকা, দুগ্ধশুভ্র চিনেমাটির পাত্রে ভোজ্যসামগ্রী। ফিকে ধোঁয়ায় মৃদু গন্ধ ভাসছে। এই হল গার্হস্থ্য সুখ। পরিবেশ, বিপ্লব কিংবা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ অথবা অনেক কৃচ্ছসাধনের কথা। ভুলিয়ে দেয়। জৈবিক আর আধ্যাত্মিকের অপূর্ণ সমন্বয়। যৌবনবতী নারী উষ্ণ, কমনীয়। সুস্বাদু ভোজ্যসামগ্রী। একটা সৌন্দর্যঘেরা পরিবেশ। কিছু সৃজনী প্রতিভা, দুটো বিচারশীল মন।
কিছু মানুষ হয়তো এখনও বাইরে, মর্গে, কিংবা হাসপাতালের এমারজেন্সি বিভাগে অথবা অপারেশন টেবিলে কিংবা ক্রিমেটোরিয়ামে—এমন সমস্ত পরিবেশে যেখানে দৈহিক সুখ নেই, মানসিক স্থৈর্য নেই; কিন্তু আমরা এখন দুজনে পরম নিশ্চিন্তে একটি সুকোমল শয্যায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। এর পর ঘুম আসবে দু-চোখ জুড়ে নিঃশব্দে, একরাশ পাখির মতো, ডানা নেড়ে নেড়ে।
কাবেরী প্রথমে একটু উশখুশ করছিল। যেন ঠিক আরাম পাচ্ছে না। একটু অস্বাচ্ছন্দ্য। একবার জিগ্যেস করল কটা বাজল। এগারোটা বেজে দশ মিনিট। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কাবেরী মাথার বালিশ জড়িয়ে ধরে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। কী হল। তোমার? অসহ্য ব্যথা, অসহ্য যন্ত্রণা। তুমি যা হয় একটা কিছু ব্যবস্থা করো। আমি আর পারছি না।
কী সর্বনাশ! এখন এই ভীষণ সময়ে আমি কোথায় পাব ডাক্তার, কোথায় পাব গাড়ি! রাস্তায় বেরোবে কী করে? এ তোমার মনের আতঙ্ক। এখন ব্যথা কী? তোমার তো এখন সময় নয়। পুরো দু-মাস বাকি। এ তোমার ফলস ব্যথা। চাপ খাওয়া হয়েছে, গ্যাস হয়েছে পেটে। দাঁড়াও আমি তোমাকে একটা অ্যান্টাসিড দিচ্ছি। আমার স্টকে আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে কাবেরী বললে—কিচ্ছু হবে না। আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। এ সেই ব্যথা। তুমি যা হয় একটা কিছু করো।
হা ঈশ্বর, এ কী দুর্দিন! এখন তো সুখশয্যা ছাড়তে হয়। বলা যায় না প্রথম সন্তানের জন্ম ভীষণ বিপজ্জনক। কী হতে কী হয়ে যায়। মৃত্যু? নানা কাবেরীকে হারাতে চাই না। ঘরে মৃত্যুর ছায়া, বাইরে মৃত্যুর ছায়া। উঠতে হল। ঘরের সবুজ আলোকে জোর করতে হল। কাবেরীর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিলুম। এখন কী করি! এই সমস্যাকে কীভাবে আক্রমণ করব! কাছাকাছি। কোনও বাড়ি থেকে ডাক্তারকে ফোন করব। অথবা নার্সিংহোমে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলব। কিন্তু সমস্ত কল অফিসই তো বন্ধ। কোন বাড়িতে ফোন আছে তাও জানা নেই। প্রথমে থানায় জানাই, পুলিশের সাহায্য চেয়ে দেখি, কিন্তু কাবেরী কি একলা থাকবে? তাই বা কী করে হয়?
রাস্তা কী ভীষণ অন্ধকার! পাশের বাড়ির সাহায্য নিতেই হবে। এখন আর ভাববার সময় নেই, সমস্ত কাজ অত্যন্ত দ্রুত সারতে হবে। কলিংবেলে চাপ দিলুম, একবার, দুবার, তিনবার, চারবার—কোনও সাড়া নেই। কোনও ঘরে আলো জ্বলল না। শুধু মনে হল কারা যেন ফিশফিশ করে বললে, ওই এসে গেছে। সাড়া দিও না, কজন আছে, কে জানে। ওরা এখন হন্যে হয়ে আততায়ীকে খুঁজছে।
আমাকে ঘাতক ভেবেছে। কী সর্বনাশ, বলা যায় না কোনও অলক্ষ্য স্থান থেকে কিছু ছুঁড়ে মারতে পারে। আবার আমিও দাঁড়িয়ে আছি একেবারে উন্মুক্ত রাস্তায়। আমি চিৎকার করে বললুম।—দরজা খুলুন। কোনও ভয় নেই। আপনাদের প্রতিবেশী। আমার স্ত্রী ভীষণ অসুস্থ। আপনাদের একটু সাহায্য চাই—না কেউ দরজা খুলল না। সেই ফিশফিশ গলা—খুলো না, ওসব চালাকি। যেই দরজা খুলবে…
আমার সময় খুবই কম। ওই তো আমার জানালায় আলো জ্বলছে। কাবেরী প্রসব বেদনায় ছটফট করছে। আমি তখন ছুটছি। থানা, থানাতেই হয়তো সাহায্য পাওয়া যাবে। এই নির্জন রাস্তায় আমি একলা ছুটন্ত পথিক। আমাকে পেছন থেকে অথবা সামনে থেকে কিংবা চারপাশ থেকে আক্রমণ করতে পারে। দূর থেকে দেখলে আমাকে পলাতক মনে হবে।
অফিসার ইনচার্জ ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। ইতিমধ্যে তার এলাকায় তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। মৃতদেহ আসছে একে একে, ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত। কী সাহায্য করতে পারি আপনাকে? আমাদের গাড়ি নেই, সব টহল দিতে বেরিয়ে গেছে। তবে ফোনটা ব্যবহার করতে পারেন। ফোন, শুধু ফোনে কী হবে? একটা গাড়ি না হলে রোগীকে নার্সিংহোমে অথবা হাসপাতালে নেব কী করে?
কী যে করেন মশাই, আপনারা এই দুর্দিনে, একটু সংযম অভ্যেস করতে পারেন না। এই কি সন্তান আনবার সময় না পরিস্থিতি! দেখছেন দেশ জুড়ে লণ্ডভণ্ড চলছে। দিন থাকতে থাকতে গোলমালের আগে হাসপাতালে দেননি কেন? সেই দুঃসময়েও গল্পের ডুবে যাওয়া সেই। ছেলেটির কথা আমার মনে পড়ল। ডুবছে সে, সাহায্য চাইছে, তীর থেকে তাকে উপদেশ ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, সাঁতার না জেনে জলে নেমেছিলে কেন?
অবশেষে ফোন। গৃহ চিকিৎসক। আমি কী করব মশাই, এ তো আমার কেস নয়, কোনও গাইনোকোলজিস্টকে যোগাযোগ করুন। তাছাড়া আমার জীবন এমনিতেই বিপন্ন, আজ তো। কোনও কথাই চলে না। হাসপাতাল। একের পর এক। রোগী নিয়ে আসুন। অ্যাম্বুলেন্স নেই, কোথায় পাবো অ্যাম্বুলেন্স! প্রথমত হাউস স্টাফরা আগের মতো কাজ করে না। এছাড়া আজকের প্রেসারটা বুঝতে পারছেন না! আপনিও তো আচ্ছা ক্যালাস, এসব কেস বাড়িতে ফেলে রাখে!
বলছেন কী? রুগি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে? যাবে। কী করা যাবে! ওসব সেন্টিমেন্টাল কথা বলবেন না। এতে আর চিঁড়ে ভেজে না।
—কী করি বলুন তো। প্লিজ আপনি একটু সাহায্য করুন। আমার স্ত্রী..আমি আর বলতে পারলুম না। অফিসার ইনচার্জ সিগারেট খেতে খেতে একটি মাত্রই জবাব দিলেন—শেষ জবাব—কাঁধে করে নিয়ে যান।
আমি প্রায় উড়তে উড়তে ফিরে এলুম আমার ফ্ল্যাটে। সমস্ত বিছানার চাদর হাত দিয়ে খামচাতে খামচাতে কাবেরী যন্ত্রণায় দুমড়ে-মুচড়ে প্রায় ধনুকের মতো হয়ে গেছে। সমস্ত মুখে তার। আতঙ্কের ছায়া। না অসহ্য, এ দেখা যায় না। জীবন দিয়েও আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ভাবছি আমি। ইতিমধ্যে ঘামে শরীর ভিজে গেছে। বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি ঘোলাটে হয়ে গেছে।
দরজার কড়া নড়ে উঠল। ভারি উত্তেজিত গলার আওয়াজ। আলো নেভান। এই একটা কথায় আমি যেন আলো দেখতে পেলুম। তাড়াতাড়ি সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালুম। হাতে ধারালো অস্ত্র চারজন যুবক। আমি দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে, সরাসরি আত্মসমর্পণ করলুম—ভাই, তোমরা আমাকে বাঁচাও। আপনাকে মারতে আসিনি আমরা। আলো নেভান। আমাদের কাজের অসুবিধে হচ্ছে। না, সে কথা নয়। আমার স্ত্রী, আমার স্ত্রী আসন্নপ্রসবা। এই মুহূর্তে সে যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমি কোনওভাবেই তাকে হাসপাতালে নিতে পারছি না। তোমরাই আমার ভরসা। তোমরা বাঁচালে বাঁচবে, তোমরা মারলে মরবে।
—পন্টু, দাদা কী বলছে রে! কী করতে হবে আমাদের?
—একটা গাড়ি ভাই। কোনও রকমে আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তোমরা ছাড়া।
—ঠিক আছে, বিশু তুই ঝট করে একটা রিকশা ধরে নিয়ে আয়। শালারা এমনি আসতে চাইবে। জোর করে ধরে আনবি। কাছাকাছি যে ডাক্তাররা আছে তাদেরও তো পাবি না, সব লকার এ বসে আছে। শালা প্রাণের কী মায়া! একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে?
—ওই তো, ওই তো আমার স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
—শালা ঠিক মার্ডার করলে যেমন আওয়াজ হয় তেমনি হচ্ছে।
—পন্টু, তোর কোনও বুদ্ধি নেই, একে বলে প্রসববেদনা। আমাদের মায়েদেরও এমনই হয়েছিল, বুঝেছিস!
বিশু নামক ছেলেটি একটা রিকশা ধরে নিয়ে এল। ঘুম জড়ানো চোখ অথবা নেশার ঘোরে রিকশাওয়ালা জিগ্যেস করল কোথায় যেতে হবে? হাসপাতালে। দাদা, সময় আমাদের কম, বউদিকে নামান, গোটা কতক বালিশ আনবেন, বেশ করে সাজিয়ে বউদিকে আরামে বসান, কিংবা কোলে নিন। একলা নামাতে পারবেন?
দেখি চেষ্টা করে।
ওরা পাঁচজন নীচে দাঁড়িয়ে রইল, আর আমি একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলুম। কাবেরীর তখন অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রণা যে কত ভয়ানক! একটা প্রাণ পৃথিবীতে আসতে চাইছে, সে যে কী অসহ্য দৃশ্য, জন্ম যে এত বেদনাদায়ক, আমার জানা ছিল না।
কাবেরীকে কোনওরকমে পাঁজাকোলা করে তুলে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছি প্রচণ্ড শব্দে একটা বোমা ফাটল, কাবেরী চমকে উঠল, যন্ত্রণা যেন সাময়িকভাবে অপসৃত হল, অন্যরকম একটা আতঙ্কে। বারুদের গন্ধ এল নাকে, একটা আগুনের ঝিলিক, কিছু শক্ত কঠিন জিনিস দেওয়ালে, কাচে লাগল। সিঁড়ির শেষ ধাপে দরজার সামনে তখন ধোঁয়ার কুণ্ডলি।
কিন্তু এ কী! দরজার সামনে বিশু পড়ে আছে রক্তাক্ত। ক্ষতবিক্ষত, জীবন আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাওয়ালা নেই, নেই আর চারটি ছেলে। কাবেরীর যন্ত্রণা আবার ফিরে এল। আমার জামাটা খামচাতে লাগল, দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করল শাড়ির আঁচল। ভাবছি এখন কী করব! তারা কোথায়? হঠাৎ অন্ধকার থেকে পন্টু বেরিয়ে এল—ভাববেন না কিছু বউদিকে বসান রিকশায়।
—কিন্তু বিশু, বিশুকে তো আগে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। ও কি বাঁচবে? দৃশ্য দেখে কাবেরী তখন মূৰ্ছিত।
—আপনি কিছু ভাববেন না দাদা, আমরা মরতেই জন্মেছি, ওকে আমরা কাঁধে করেই নিয়ে যাব। আর সময় নেই, আপনি উঠে বসুন, ব্যাটা রিকশাওয়ালা ভয়ে ভেগেছে, আশেপাশেই আছে ধরে আনছি।
ইতিমধ্যে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আর তিনটে ছেলে ফিরে এল।
—শালা, ওরা তিনজন ছিল। দুটো পালিয়েছে, একটাকে খতম করেছি। শালা, কী রক্ত মাইরি, যেন পিচকারি। মানুষের শরীরে এত রক্ত থাকে! দেখ, জামা-প্যান্টের কী অবস্থা।
—তুই আর এগোসনি, বউদি ভয় পেয়ে যাবে। তোরা একজন রিকশাওয়ালাকে ধরে নিয়ে আয়, তারপর চল, বিশুটাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাই। যদি বাঁচে।
রাত তখন কটা! হাসপাতাল যেন ক্লান্ত; মৃদু আলোকিত করিডর, সারি সারি নিদ্রিত রোগী। কোথাও কোনও রোগী আধবসা, ঘুম তার আসছে না, কেউ কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়। ওয়ার্ড খালি, কোথায় নার্স, কোথায় হাউস সার্জেন। কিন্তু এতদূরে যখন আসতে পেরেছি তখন বাকিটারও ব্যবস্থা করতে হবে।
কে যেন বলল—রাত তখন তিনটে। উনিশনম্বর মারা গেছে। একটু জল, নার্স আমাকে একটু জল।
আপনি কি ডাক্তার ভাই! আমার স্ত্রী, একেবারে শেষ অবস্থা। কী কেস? ডেলিভারি কেস। এখানে কী? তবে? চলুন চলুন, ডেলিভারি ওয়ার্ডে। সার্জেন–কী হয়েছে সিস্টার? এমারজেন্সি ওয়ার্ডে আর একটা এসেছে। কিছু নেই, একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, বম্ব ইনজুরি। এখনও প্রাণ আছে। তাপসকে বলুন, অ্যাটেন্ড করতে এখুনি, স্যলাইন রেডি করুন। আমার হাতে ডেলিভারি কেস।
ডেটল, ইথার, ইউরিন্যাল, সব মিলিত, মিশ্রিত গন্ধ। বড় বড় চওড়া করিডর, খোলা-গরাদহীন জানালা, উঁচু উঁচু ছাদ, সারি সারি লোহার খাট, সরু সরু লম্বারডে পাখা ঝুলছে, ঘুরছে, হাইহিল জুতোর খটখট, চকচকে, বড় বড় বেঞ্চি, কাবেরী এখন ওই ডেলিভারি লেখা দরজার ওপাশে। কী হচ্ছে সিস্টার, এত দেরি কেন? সিস্টার, ওই যে ছেলেটি এল বললেন, সব ঝাঁঝরা, ওর নাম কি বিশু? সিস্টার তাপসবাবু কি ওকে অ্যাটেন্ড করেছে?
খবর আছে? কী হল কাবেরীর? সিস্টার—শিইজ অল রাইট। ভালো আছে সে, আপনার একটা ছেলে হয়েছে, সাড়ে ছপাউন্ড ওজন। ঠিক চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে জন্মেছে। না, এখন দেখতে পারবেন না। সকাল আটটায় আসবেন।
সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামছি। পুবের আকাশে আলোর ছোঁয়া লেগেছে। ছেলে হয়েছে! প্রথম সন্তান! কার মতো দেখতে হয়েছে কে জানে। কী নাম রাখব। সময়টা নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কেমন হবে! নিশ্চয়ই খুব বড় হবে। হাউস স্টাফদের মিষ্টি খাওয়াব, আর ওই ছেলেদের! ওরা না থাকলে কী করতুম!
—দাদা, একটা সিগারেট দেবেন?
—কে পিন্টু তুমি?
—হ্যাঁ দাদা, কী হল আপনার, বউদি ভালো আছেন তো?
—হ্যাঁ ভাই, ছেলে হয়েছে; কিন্তু বিশু? সে কেমন আছে?
পিন্টু ধোঁয়া ছেড়ে প্রচণ্ড একটা দার্শনিকের মতো বলল—নাঃ বাঁচল না, একেবারে ফর্দাফাই হয়ে গেছে, চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে সব শেষ হয়ে গেল। শালা বোমাটা বেশ জবরদস্ত ছিল। ওর মাটার বড় কষ্ট হবে; ওই একটাই তো ছেলে। যাকগে, অতসব ভাবলে চলে না।
মনটা ভারাক্রান্ত হল। পুত্রলাভের আনন্দের অনেকটাই পুত্রশোকের ব্যথায় যেন মিলিয়ে গেল।
—আমার জন্যেই হল ভাই।
—দুর দাদা, কী যে বলেন, ও তো হবেই। আমরা এই আছি এই নেই। আপনি কিছু ভাববেন না। এখন শালা ডেডবডি বার করাই মহা হ্যাপা, পোস্টমর্টেম হবে, মর্গে যাবে। সেই বডি পচে ফুলে উঠবে, তবে শালারা ছাড়বে।
—তোমরা একদিন এস ভাই একটু মিষ্টিমুখ করে যাবে।
—কী যে বলেন দাদা। আমাদের চেনেন না তাই। পাড়ার খবর তো রাখেন না। আমাদের সঙ্গে বেশি দোস্তি মানেই জানেন তো—এই। পিন্টু গলার কাছে হাতের চেটো নেড়ে একটা ভঙ্গি করল যার মানে—জবাই। পিন্টু সিগারেট খেতে খেতে করিডরের আলোছায়ায় মিলিয়ে গেল।
আহারের বাহার
মারা যাওয়ার পর জনৈক প্রখ্যাত সংগীতশিল্পীর আক্ষেপের মন্তব্য: খাওয়ার বারোটা বেজে গেল। মৃত্যু শোকাবহ নানা কারণেই। বিচ্ছেদ-বেদনার ঊর্ধে শিল্পীর মনে আর একটি শিল্পের মৃত্যুর ক্ষোভ দীর্ঘকাল জাগ্রত ছিল। সে শিল্পটি হল, রন্ধনশিল্প। প্রাচীনারা জাগতিক নিয়মেই বিদায় নিচ্ছেন। সেইসঙ্গে বিদায় নিচ্ছে রন্ধন নৈপুণ্য। কথায় বলে, শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। খাদ্যবস্তু দেখে জিভে জল না এলেও উদরপূর্তির জন্যে যে-কোনও আহার্যই গলাধঃকরণ করার উদারতায় আমরা অভ্যস্ত। আধুনিকারা হামেশাই বলেন, খোকা ডুডুও খাব টামাকুও খাব, তা তো আর হয় না। কথাটা ঠিকই। পি এইচ ডি মহিলা খোলা ছাতে পৌষের রোদে পিঠ কুঁজো করে সাদা কাপড়ে গুটি গুটি বড়ি দিচ্ছেন ভাবাই যায় না। ঝালের, ঝোলের, অম্বলের, হেঁচকির। সকালের সব কাজ ফেলে চিত্রতারকা শিফনের শাড়ি পরে বঁটিতে হোড় ডিসেক্ট করছেন আর ম্যানিকিওর করা চাঁপার কলির মতো আঙুলে কলাগাছের আঠার সুতো জড়িয়ে জড়িয়ে নিচ্ছেন। অত সময় কোথায়। সেই নাটকের ডায়ালগ, তবে আজ আসিবে খেদী, আমি বড় বিজি। প্রফেশনাল ম্যান। রন্ধনের সময় নেই, আহারেরও মেজাজ নেই। সকালে তরল কিছু কোঁত করে গলায় ঢেলে তড়াক করে লাফিয়ে রাস্তায়, রাস্তা থেকে গাড়িতে, গাড়ি থেকে লিফটে, তারপর চেয়ারে—এইরকম হলেই ভালো হয়।
শিল্পকর্মের উৎসই হল অফুরন্ত অবসর। রাঁধার যেমন তরিবাদি আছে, তেমনি সময়ও লাগে। থালার চারপাশে গোল করে বাটি সাজিয়ে খেতেও সময় লাগে, সাহসও চাই। খেয়ে মরব না তো
এই চিন্তায় খাবার ইচ্ছেও মরে যায়। চিংড়ির মালাইকারি? মন্দ না। বড়ই সুস্বাদু। কিন্তু অ্যালার্জি। কান চুলকে, ঠোঁট চুলকে, পিঠ চুলকে ফুলে ডবল সাইজ হয়ে, চেত্তা মেরে পড়ে। রইলুম তিনদিন! লাল বুলডগের মতো মুখ দেখে সকলেরই প্রশ্ন, আহা ছোকরার অমন মিঠে মুখ এরকম টেগার্ট মার্কা হয়ে গেল কী করে? আজ্ঞে, গলদা খেয়ে।
গঙ্গার ইলিশ বড়ই লোভনীয়। শ্বশুরমশাইয়ের দেওয়া ডে-ডেট, অটোমেটিক ঘড়িটি বাঁধা রেখে ভূতঘাট থেকে না হয় একটা কিনেই ফেলা গেল। তিনি কড়ায় চেপে পোয়াটাক তেল পোড়ালেন, তার ওপর পড়ল কচি সরষে বাটা, লয়া লয়া কাঁচালঙ্কা। খুবই মুখরোচক। ভাত উড়ে গেল সপাসপ। তারপর অফিসের চেয়ার তিনদিন খালি। পি এল-এর দরখাস্ত অফিসকর্তার টেবিলে। না আসার কারণ বাবুর তেলানি হয়েছে। নিজেই ইলিশ হয়ে ঘন ঘন বাথরুমের মাঝখানে খেলে খেলে বেড়াচ্ছেন। ইলিশের ইবলিশ এতকালের শুকনো পাকস্থলীতে ঢুকে ফাউন্ডেশন নাড়িয়ে দিয়েছে। এক্সপার্ট বললেন, তোমার কী করা উচিত ছিল জানো? প্রিভেনশান ইজ বেটার দ্যান কিওর। ইঞ্চি ছয়েক ব্লটিং পেপার প্রথমে কোঁত করে গিলে নিয়ে ইলিশের কাঁচা ঝাল খাওয়া উচিত। আসলে আর্ট এখন বেঁচে আছে প্রোফেশনালদের হাতে। অ্যামেচারের যুগ শেষ। হালুইকর হেলে-দুলে হেলান মেরে রাঁধবেন কারণ সেইটাই তাঁর জীবিকা। ছতারা হোটেলের শেফ, মাথায় সাদা টুপি এঁটে ছত্রিশ পদ লাঞ্চ বানাবেন কারণ ওই আর্ট ভাঙিয়েই তাঁর রবরবা। চিনের রেস্তোরাঁয় হাফপ্যান্ট পরা রন্ধন-বিশারদ পাখির বাসার স্যুপ বানাবেন, কি চিনি স্যুপ তুলে ধরবেন রসিক মানুষের টেবিলে অথবা তৈরি করবেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামি আহার্যপদ—বুদ্ধ জামপিং ওভার দি ফেনস।
এখন ব্যাপার হল যে মহিলা সকালেই ছেলেকে রুটি, মাখন, জেলি, আন্ডা আর অর্ধপক্ক কার্বাইড-পাকা কদলি খাইয়ে টানতে টানতে স্কুলে নিয়ে যাবেন, ফেরার পথে দুধের বোতল বগলে বাড়িতে এসেই স্বামীকে ডবল হাফ চা খাইয়ে স্টিম তৈরি করে বাজারে পাঠাবেন আর কান খাড়া করে শুনবেন নটার ভোঁ বাজল কি না; তাঁর পক্ষে লাউ-চিংড়ি কি ঝিঙে-পোস্ত কি। নারকেল কোরা ছড়ানো মোচার ঘণ্ট এক দুঃস্বপ্ন। ওসব অফুরন্ত অবসরের মালিক বৃদ্ধাদেরই পোষায়। অফিস বেরোবার তাড়ায় প্যান্টের বোতাম লাগাবার হুশ থাকে না। চারাপোনা আস্ত গিলে সারস পাখির সন্ধান করেন টাগরার কাঁটা বের করে দেবার জন্যে, তাঁদের যদি বলা হয় বসে বসে এক ডজন সজনে ডাঁটা চিবোন, কি এক খাবলা কাটোয়ার ডেঙ্গো থেকে ভেজিটেবল ম্যারো বের করে তারিয়ে তারিয়ে খান তাহলে তাঁরা সবিনয়ে বললেন, মাপ করো রাজা চাকরিটা আর চিবিয়ে খেতে চাই না। কোনও সাকার স্ত্রী-র কি সে সময় আছে সকালে সজনে ফুল বেছে। ভাজবেন, কি কচুডাঁটার ঘণ্ট তৈরি করবেন? বড়জোর লো-প্রেসারের কত্তার টিফিন বাক্সে দুপিস রুটি আর একটি ছানার তাল ভরে দিয়ে শাঁখা-সিঁদুর অক্ষয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। মাথা ঘুরে পড়ে গেলে দেড় হাজার টাকা চোট।
তাছাড়া ওসব হাবিজাবির কী প্রয়োজন? এ হল প্ল্যানিং-এর যুগ, ফ্যামিলি প্ল্যানিং, প্রোটিন প্ল্যানিং, ক্যালোরি প্ল্যানিং ঝোল আর ভাত মেরে যাও সপাসপ। ফান্ড পারমিট করে তো সিঁথির সিঁদুর ঠেকানোর মতো এক চামচে মাখন গুঁজে আধখানা কাঁচালঙ্কা অ্যাপেটাইজার কাম অ্যান্টি অ্যাজমা। আর সব তোলা থাক রবিবারের জন্য।
উইক ডেজে তাই ঘরে ঘরে নটরাজের নৃত্য। চা, বাথরুম, বাজার, দাড়ি, লোডশেডিং, ছুটোছুটি, ধাক্কাধাক্কি—স্ত্রী ছুটলেন, স্বামী ছুটলেন, ছেলে ছুটছে, বেড়াল ন্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছে। দুটো প্রেসার কুকার থেকে থেকে কৌসর করে উঠছে, কেউ কারওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। এ বলছে, কী বললে, ও বলছে, কী বললে, শেষে মেজাজ দু-তরফেরই ফাইভ ফর্টি ভোল্ট। কিচ্ছু বলিনি, আহা শুনতে পাইনি। বয়লেট ফাটে হেঁইও, থাক আর শুনে কাজ নেই, অন্য কেউ হলে ঠিকই। শুনতে পেত। অ্যাাঁ কে বললে? ব্যস মুখে কুলুপ পড়ে গেল। সম্পর্ক আপাতত জট পাকিয়ে থাক। রাতে দেখা যাবে। মেজাজের কোনও ভোল্টেজ স্টেবিলাইজার নেই। সকালের আহার সাধারণত চড়া ভোল্টেই হয়। বয়লার থেকে ভাত নেমেছে। ভাতের ভিসুভিয়াসের ওপর ডালের লাভাস্রোত গড়াচ্ছে। কর্তা একবার থাম্ব মারছেন আর ছ্যাঁকা খেয়ে হাত গুটিয়ে নিচ্ছেন! ওদিকে ঘড়ি পেছন থেকে খোঁচা মারছে। শেষে রেগেমেগে বললেন, কাল থেকে সকালে আমার জন্য পান্তা। ড্রাগন না হলে এ আগুন গিলবে কে? শুকনো চুলে চিরুনি চালালে স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি তৈরি হয়ে চুল ভূত দেখার মতো খাড়া খাড়া হয়ে ওঠে। আজকাল অধিকাংশ সময়ে মানুষের মনের রোঁয়াও ওইরকম শুয়াপোকার মতো, টুথব্রাশের মতো হয়ে থাকে। গতি আরও গতি। কেরিয়ারের ঘোড়সওয়ার। সেখানে রান্না ভালো হল কি খারাপ হল, পঞ্চপদ হল কি না, এ নিয়ে কেউ কখনও অনুযোগ করেন না। যা হয়েছে বেশ হয়েছে। কম মশলা, কম ঘি, তেল, একটু সেদ্ধ সেদ্ধ এইটাই তো যুগের চাহিদা। ওল খেও না ধরবে গলার মতো নুন খেয়োনা বাড়বে প্রেসার, তেলে কোলেস্টেরাল। ফলে আধুনিকারা বেঁচে গেছেন। নইলে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর সাতশো পাতার আমিষ ও নিরামিষ আহার বইটি নিয়ে বাড়িতে হাজির হওয়া যেত। আটশো আঠারো রকম শব্দর ফিরিস্তি সম্বলিত রন্ধনের মহাভারত।
আরও এক বন্ধুকে জানি যিনি স্ত্রীকে জব্দ করার জন্যে রাত দশটার সময় ইয়া এক মাছ হাতে বাড়ি ঢুকে হাসি হাসি মুখে বললেন, তোমার সিঁথির সিঁদুর অক্ষয় হোক। তোমার জননী বলেছিলেন, মেয়ে আমার মাছ খেতে বড় ভালোবাসে বাবা, রেখো তাকে মাছে-ভাতে। তা এই রোহিতটি তোমাকেই উৎসর্গ করলাম। ইওরস ফেথফুলি। ওই প্রজ্ঞাসুন্দরীকে দিয়ে অনেক সুন্দরীকেই কাত করা যায়। যেমন—তিনশো সাতাশি পাতা খুলে বললুম, আজ রবিবার মাসের প্রথম, আজ দেহেবু খাব। জানা থাকলে ভালো, না থাকে এই প্রজ্ঞাসুন্দরী নিয়ে বসলুম। মহিলামহলের কায়দায় আমি বলে যাই তুমি করে যাও। বেশ ঘি-ওলা বাগদা চিংড়ি বারোটি, দই এক পোয়া, পেঁয়াজ তিনটে, আদা আধ তোলা, আলু দুটো, ঘি আধছটাক, ছোট এলাচ দুটো, লবঙ্গ চার-পাঁচটা, দারুচিনি সিকি তোলা, জল প্রায় তিন ছটাক, নুন প্রায় আধ তোেলা, কাঁচালঙ্কা চারটি। কেষ্টদার দোকান থেকে নিক্তিটা নিয়ে আসি। ভোলা-ফোলা আছে।
এর পর আর একদিন বলতে পারি বার্মিজ ফলুয়া খাব। ওই প্রজ্ঞাসুন্দরী কালিয়া জগুরথ খাব। প্যাটে ভা পম ভেটে-র খাব। ফিরিঙ্গি মটন স্টু। পরিশিয়ান হেঁচকি, বাঁধাকপির চিমচিম, মুরগির কানিটর কাপ্তেন, ইলিশ মাছের ট্রামফ্রাড। এর পরেও তিনি যদি পিত্রালয়ে পলাতক না হন। তাহলে বলব লাগাও সেই মাল-কাঁকড়ার কলাপঠোচ, না ওটা থাক তার চেয়ে বরং বখরি পোলাও হোক—ছোট পাঁঠা একটি, চাল এক সের, ঘি তিন পোয়া, দই আধ সের। প্রথমে খানেওলার মৃত্যু। তারপর পাকানেওলার মৃত্যু। কারণ ছোট একটা পাঁঠা চাই তারপর অন্যান্য অনুষঙ্গ, ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি! তারপর যিনি পাকাবেন তাঁকে হতে হবে গুগুনোগুরের দেশের। লোক। প্রণালীটা এইরকম কচি পাঁঠা কাটিয়া মাথা ও হাঁটুর নীচের পা চারিটি এবং লেজটা কাটিয়া আলাদা রাখো। জানি না বখরি পোলাও কেমন খেতে হবে, তবে এ-মাল রাঁধতে। পারবেন কাঁপালিকের বউ। খাঁড়া চাই, হাঁড়িকাঠ চাই। ভাগ্য ভালো বইটি বাজারে আর মিলবে
। আমার এক প্রাচীন গ্রন্থকীট বন্ধু বইটিকে কয়েকদিন আগে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ থেকে। উদ্ধার করেছেন এবং তারপর থেকে ভীষণ গম্ভীর হয়ে আছেন। মনে হয় সুখের গৃহশ্মশান করি স্ত্রী নোটিশ দিয়ে সরে পড়েছেন। একই বাড়িতে প্রজ্ঞাসুন্দরী আর আমি, অসম্ভব। সেই রন্ধনপ্রণালী এখন আমার আর এক সুহৃদয়ের গৃহে। হোল ফ্যামিলিই ভোজনরসিক। ধীরে ধীরে বইটিকে হজম করেছেন।
দার্শনিকের মতো বলা ভালো কী হবে খেয়ে? কিংবা বলা যেতে পারে, এমন খাও যাতে দীর্ঘদিন খেতে পারো। রোলিংস্টোনদের জন্যে রোল কাউন্টারই ভালো। অর্ধাঙ্গ কাগজের খোলে অর্ধাঙ্গ বাতাসের মধ্যাহ্নে কিঞ্চিৎ আলুর ঘাঁটি, না হয় ভাজা মাংস। কামড়াতে কামড়াতে নীচে নামো। ওপরে একটু কফি বা চা লড়িয়ে দাও। তারপর ধীরে ধীরে অম্নরসের আধিক্যে পেটটি হয়ে উঠবে চোলাই ভরা ব্লাডারের মতো। গৃহে প্রত্যাগমন করেই বাবুর উইকেট ডিক্লেয়ার নাকিসুরে, আজ আমার নো মিল।
ইয়েস স্যার
আজ শনিবার।
হেডস্যার আজ ছুটির পর মিটিং ডেকেছেন। মিটিং-এর পর ইটিং-এর ব্যবস্থা আছে। ক্লাস নাইন। আর টেনের ছেলেরাই শুধু থাকবে। আমারে স্কুলের বিশিষ্ট দারোয়ান রামাধর দা তাঁর ছোট্ট ঘরে ডাব্বা, ডাব্বা ঝালমুড়ি তৈরি করছেন। গুড়ো মশলার গন্ধে জিভে জল আসছে। হেডস্যার
এলেন। আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালুম। মধ্যবয়সি মানুষ। বেশ মোটাসোটা। ফরসা চেহারা। সাদা পাঞ্জাবি। বোধহয় খদ্দর। মোটা ধুতি। পায়ে বিদ্যাসাগরী চটি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। কদমছাঁট চুল। আমাদের প্রায়ই বলেন—এদেশে একজন মানুষই জন্মেছিলেন, তাঁর নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমরা তাঁর পায়ের নখের যোগ্য নই। আমরা সব স্বার্থপর শয়তানের দল। আমাদের ধরে ধরে পেটানো উচিত। আমরা দেশের কলঙ্ক। রবীন্দ্রনাথ লাখ কথার এক কথা বলে গেছেন, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করোনি।
চেয়ারে বসতে বসতে স্যার বললেন বোসো, বোসো, আর সুব্রতটাকে কান ধরে টানতে টানতে নিয়ে এসো।
সে কোথায় আছে স্যার?
পেটুকরা যেখানে থাকে। রামাধরের ঘরের সামনে ছোঁক ছোঁক করছে। আমাদের যেতে হল না। সুব্রতই এল হুসহাস করতে করতে।
হেডস্যার জিগ্যেস করলেন, আপনি কোথায় ছিলেন জানতে পারি? সুব্রতর চোখ দুটো ছানাবড়ার মতো হয়ে আছে। মুখে হুসহাস শব্দ। সুব্রত খুব সহজ, সরল। একটু বোকা বোকা। বাঁকা কথা। বোঝে না। কেরিয়ার-ফেরিয়ার ধার ধারে না। নিজের জীবনের মজার মজার ঘটনা বলে সারাক্ষণ আমাদের মাতিয়ে রাখে। স্যাররাও তাকে খুব ভালোবাসেন।
সুব্রত বললে—অ্যায়সা ঝাল ছেড়েছে কেউ খেতে পারবে না। জিভের তলায় বাটি ধরতে হবে। আপনার স্যার আলসার আছে, তাই একটু টেস্ট করতে গিয়েছিলুম। ঝাল কমাও, ঝাল কমাও, মুড়ি ঢালো। আমার হেডস্যার মুখে দিতে পারবেন না। এ সেই সরস্বতী পুজোর আলুরদম-কেস। আমাদের কথা শুনলেন না। খেয়ে অসুস্থ হলেন।
স্যার সুব্রতর মন জানেন। অবিশ্বাস করলেন না। বললেন—সামনে বোস, আমার চোখের সামনে। একটা কথা জেনে রাখ এখন সব বাঙালির পেটেই আলসার।
আমরা সবাই কোরাসে বললুম-ইয়েস স্যার।
হেডস্যার সভার কাজ শুরু করলেন। ছোট্ট একটা বক্তৃতা—বয়েজ! যে ভাবেই হোক আমাদের পরোপকার করতে হবে। নিঃস্বার্থ সেবা। ঘোর দুর্দিন আমাদের সামনে। ছেলেরা বাপ-মাকে। দেখে না। ভাই ভাইকে দেখে না। নেতারা দেশ দেখে না। ফি না দিলে ডাক্তার রোগী দেখে না। মাতালে দেশ ভরে গেছে। চতুর্দিকে সন্ত্রাসবাদী। এই অবস্থায় আমাদের জীবনের একমাত্র ব্রত হবে পরোপকার। পরের উপকার। তোমরা সব গ্রুপ করে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ো। সমাজের সর্বস্তরে ঢুকে যাও। আমাদের আদর্শ হবে উইপোকা। উইপোকা যেমন বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে, খাঁজে খাঁজে ঢুকে যায়, আমাদেরও সেই সব ভাঁজে ভাঁজে সমাজের খাঁজে খাঁজে। ঢুকে যেতে হবে। উইপোকা ধ্বংস করে, আমরা গঠন করব। আমরা চটাপট, চটচট হাততালি দিয়ে উঠলুম। খুব ভালো লেগেছে আমাদের।
হেডস্যার খুব অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন—এটা কি নাট্যশালা। পায়রা ওড়াচ্ছিস! ঠিক এই সময় ঘরে প্রবেশ করলেন আমাদের বাংলার স্যার নিমাইবাবু। প্রায় ছ’ফুট লম্বা। স্বাস্থ্যবান। এমন চেহারা, কেন যে বাংলায় পড়ে আছেন আমরা বুঝতে পারি না। আবার কবিতা লেখেন। সেই সব কবিতা আমাদের ক্লাসে শোনা। মানে বুঝি না, তবে শব্দের খেলা, বেশ ভালো লাগে। মেঘলা দিনে সাংঘাতিক কবিতা আসে। কাল সেইরকম একটা দিন ছিল। ক্লাসে বসে বসেই স্যার লিখে ফেললেন,
মেঘের ফানুস উড়ছে
মানুষ কি আর দেখছে।
কাজের কথাই বলছে
ময়ূর কেবল নাচছে।
আমরা টেবিল চাপড়ে চিৎকার করে উঠলুম, ফাটাফাটি, ফাটাফাটি। স্যার বললেন— আলুকাবলি, আলুকাবলি। তার মানে আমাদের আলুকাবলি খাওয়াবেন। তৈরি করবে রামাধর।
আমাদের রামাধরের কোনও তুলনা নেই। রোজ ভোরবেলা গঙ্গায় চান করে। মহাবীরের পুজো করে। আগে কুস্তি করত, এখন আর করে না। যোগাসন করে। স্যার বললেন—আলুকাবলি নিয়ে কবিতা হবে, এক-একজন এক-একটা লাইন লিখবে। চলে এসো বোর্ডে।
আমাদের মধ্যে স্বরাজ কবিতা লেখে। বোর্ডে গিয়ে লিখে এল, ফাটাফাটি আলুকালবি।
মধুকর পরের লাইন লিখলে, সুদ চায় না এই কাবলি।
সব লেখালিখির পর কবিতাটা যা দাঁড়াল, ফাটাফাটি আলুকাবলি,
সুদ চায় না এই কাবলি,
জিভে জল, টক, ঝাল, আর মিষ্টি,
কাবুল ফেলে বাঙলায় এল এই কাবলি।
নিমাই স্যার হেডস্যারের পাশের চেয়ারে বসে বললেন—পরোপকার খুব কঠিন কাজ। আমাদের এই জায়গাটা এত হতচ্ছাড়া, না হয় বিধ্বংসী বন্যা, না হয় দুর্ভিক্ষ। এই দুটো হলে পরোপকারের কাজটা সহজ হয়। হাণ্ডা হাণ্ডা খিচুড়ি বানাও, ঝপাঝপ দিয়ে যাও, কপাকপ খেয়ে যাও। হেডস্যার বললেন—সকলের ভাগ্য কি আর ভালো হয় নিমাইবাবু। আমাদের গভীরে ঢুকে কাজ করতে হবে। বেগুন গাছে ঝোলে। মারো টান। হাতে এসে গেল, আর আলু! মাটি খুঁড়ে তুলতে হয়। কারও বেগুনের বরাত কারও আলুর বরাত। আমাদের খুঁড়তে হবে। প্রথমে সারভে।
সুব্রত বলল—স্যার! আমার একটা প্রশ্ন আছে।
একটা কেন, তুমি হাজারটা প্রশ্ন করো।
স্যার! পরোপকার জিনিসটা ঠিক কী?
জিনিস বলছিস কী রে গাধা। বল কর্ম। পরের উপকার।
উপকার কাকে বলে স্যার?
অপকারের উলটোটাই হল উপকার। যেমন মানুষের উলটো হল অমানুষ। উদাহরণ শোন—
একটা মানুষকে ঠেলে ফেলে দিলি। এটা হল অপকার। হাত ধরে টেনে তুললি এটা উপকার। একজন মানুষ খেতে পায় না, তাকে খাওয়ালি, এটা উপকার।
নিমাইস্যার বললেন—এটা উপকার নয় সেবা।
আপনি আবার নতুন কথা এনে ব্যাপারটাকে গুলিয়ে দেবেন না।
ব্যাপার নয়, বলুন বিষয়।
ব্যাপার আর বিষয় এক। এটা ভাষা শিক্ষার ক্লাস নয়। উপকার হল এমন কাজ করা যাতে সমস্যার সমাধান হয়। তোমরা ঘুরবে। ঘুরে ঘুরে দেখবে। নোট নেবে। প্রথমেই কিছু করবে না। আমাদের জায়গায় অর্থাৎ কমিটিতে এসে জানাবে, তারপর অ্যাকশান।
ঝালমুড়ি এসে গেল। রামাধর বানায় বটে! দরজা দিয়ে ঢুকছে ঘরটা গন্ধে ভরে গেল। মার মার কাট কাট। ঠোঙায় ঠোঙায় ভাগ ভাগ করে এনেছে। সুব্রত টপাটপ সব দিয়ে দিল। একটা ভাগ বেশি হয়েছে।
হেডস্যার বললেন—ওটা রামাধরের।
সুব্রত বললে—আমি স্যার বাইরে গিয়ে খাব?
কেন?
গাছতলায় বসে খেতে ভালো লাগে।
নিমাইস্যার বললেন—ঠিক বলেছিস। চল আমিও যাই।
.
২.
একটু দূরে বারুইপাড়া। ওই পাড়ায় বড় বড় কারিগরদের বাস। তাঁরা সেতার, সরোদ, তানপুরা, হারমোনিয়াম, তবলা এইসব তৈরি করেন। বড়-ছোট অনেক দোকান আছে। আমরা ওই দিকটায় যাই লোভে লোভে। একটা বড় কুলবাগান আছে।
আমি আর সঞ্জয় গেছি। বিকেলবেলা। সরস্বতী পুজো আসছে। গাছে গাছে কেমন কুল ধরেছে দেখতে হবে তো। হঠাৎ দেখি একটা দোকানের সামনে এক বৃদ্ধ মইয়ের ওপর কোনওরকমে দাঁড়িয়ে বেশ বড় একটা সাইনবোর্ড লাগাবার চেষ্টা করছেন, পারছেন না। বয়েস হয়েছে। দুর্বল শরীর।
সঞ্জয় বললে—এই দেখেছিস?
কী দেখব?
পরোপকার।
কে করছে?
কেউ করেনি। আমরা করতে পারি। ওই দেখ, দাদু সাইনবোর্ড ঝোলাচ্ছে। একা। পারছেন না। যে-কোনও মুহূর্তে মই নিয়ে পড়ে যেতে পারে। চল সাহায্য করি।
সঞ্জয় বললে—অতবড় জিনিসটা একা পারবেন?
আর একজন পাচ্ছি কোথায়?
আপনার ছেলে নেই?
ছিল। বিয়ে করে বউ নিয়ে পালিয়েছে। ছেলেরা যা করে থাকে!
কই আমার দাদা তো তা করেনি।
তোমার দাদা একটি গাধা।
সঞ্জয় আমাকে বললে—দেখছিস, দাদাকে গাধা বলছে!
এ গাধা ভালো গাধা। তোর দাদার প্রশংসা।
সঞ্জয় বৃদ্ধকে বললেন—আমরা আপনাকে সাহায্য করব।
বৃদ্ধ বললেন—মতলব?
সঞ্জয় বললে—আমরা পরোপকার করে থাকি।
আমি মরলে এসো। কাঁধ দিয়ো। বাঙালি তো একটা পরোপকারই জানে বলো হরি হরিবোল।
কথা শেষ করেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক মই, সাইনবোর্ড, সবসুদ্ধ নিয়ে দাম করে পড়ে গেলেন। সাইনবোর্ডের তলায় বৃদ্ধ। চিৎকার করছেন হিন্দিতে জানে মারা, জানে মারা। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসছে। আমি আর সঞ্জয় ছুটছি। পেছনে চিৎকার—পালাচ্ছে, পালাচ্ছে। পাকাড়া, পাকাড়ো।
আমরা কুলবাগানের মধ্যে দিয়ে, পুকুর পাড় ধরে কোনওরকমে পালিয়ে এলুম। কুলকাঁটায় শরীর ক্ষতবিক্ষত। হাপরের মতো হাঁপাচ্ছি। হেডস্যার অনেক রাত পর্যন্ত স্কুলের অফিসে কাজ করেন।
আমাদের দেখে বললেন—কী ব্যাপার? এ কী চেহারা?
সব শুনে বললেন—আমি তোদের কী বলেছিলুম, আগে এসে রিপোর্ট করবি। কমিটি মিটিং-এ পাস হবে, তারপর অ্যাকশান। তোরা যেটা করতে গিয়েছিলিস, সেটা পরোপকার নয় সাহায্য। কালই আমি মিটিং ডাকছি!
সঞ্জয় বললে—ঝালমুড়ি হবে স্যার?
না, আলুকাবলি হবে।
সঞ্জয় উল্লাসে চিৎকার করে উঠল, ইয়া হু!
হেডস্যার ভুরু কুঁচকে বললেন—এটা কী হল?
এটা স্যার আনন্দের চিৎকার।
.
৩.
সেই নিউহলে মিটিং। বাংলার স্যার আর আমাদের ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাকটারও এসেছেন। আমাদের ব্যায়াম, আসন করান বটে, নিজের অম্বলের অসুখ। দশ মিনিটের মধ্যে তিনবার ভেঁকুর তুললেন ভেউ ভেউ করে। হেডস্যার বিরক্ত হয়ে বললেন—জোয়ানের আরক খেয়েছিলেন?
করুণ মুখে বললেন—ইলিশ মাছ!
এদিক নেই ওদিক আছে। যার জল সহ্য হয় না ইলিশ মাছ! ক’টা খেয়েছেন?
খাব না, খাব না করে তিন পিস মেরে দিয়েছি।
আপনি ইলিশ মেরেছেন এইবার ইলিশ আপনাকে মারবে। গঙ্গার ধারে গিয়ে এক ডেলা মাটি খেয়ে আসুন। মিনিটে, মিনিটে এইরকম সেঁকুর তুললে সভা তো সাসপেন্ড করে দিতে হবে।
বাংলার স্যার বললেন—সভা সাসপেন্ড না করে এই ব্যায়ামবীরকে সাসপেন্ড করে দিন। বাড়ি গিয়ে বারান্দায় বসে ভেঁকুর তুলে বাড়ির লোককে মোহিত করুন।
ব্যায়ামস্যার বললেন—আমাকে আলুকাবলিটা দিয়ে দিলে এখুনি চলে যেতে পারি।
হেডস্যার অবাক হয়ে বললেন—এর ওপর আলুকাবলি চাপাবেন?
ব্যায়ামস্যার বললেন, হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে গিয়ে দেখেননি। পোর্টারকে ডেকেছেন, ভারী ভারী মাল মাথায় তুলেছে। দু-কাঁধে দুলছে দুটোব্যাগ। আপনার হাতের হাতব্যাগটা দেখিয়ে বলছে, ওটাও আমার কাঁধে ঝুলিয়ে দিন। এ আপনার সেই কেস। যাহা বাহান্ন তাহা তিপান্ন।
আমাদের মধ্যে নিমাই খুব উশখুশ করছিল। উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্যার! আমাদের পাড়ায় একটা পরোপকার পাকছে।
হেড স্যার বললেন—ভাষাটা একবার শুনুন। পরোপকার কি ফল, যে পাকবে?
না স্যার, পরোপকারের একটা সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
শুনি কীরকম সুযোগ!
আমাদের বাড়ির পাশেই থাকেন পরেশ জেঠু। সকাল থেকেই খাবি খাচ্ছেন। একটু পরেই মারা যাবেন। খিটকেল টাইপের লোক। জ্যাঠাইমা কাঁদছেন আর বলছেন—কে কাঁধ দেবে।
হেডস্যার বললেন—আমাদের ছেলেরা একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। কী সব ভাষা, খিটকেল, খিচাইন, ক্যাচাল!
ব্যায়ামস্যার বিশাল একটু ঢেঁকুর তুলে বললেন—সব ওই টিভি।
হেডস্যার করুণ গলায় বললেন,কথা বলছেন কেন! কথা বললেই ঢেঁকুর লিক করছে।
বাংলার স্যার বললেন—বড় বাজে দিকে আমাদের মন চলে যাচ্ছে। পরেশবাবুকে আমি চিনি। একটা মানুষ মারা গেলে তার যেমন প্রাণ থাকে না, সেইরকম গুণাগুণও থাকে না। আমাদের প্রত্যেকের একটা সামাজিক কর্তব্য আছে, সেই কর্তব্যবোধে ছেলেরা কাঁধ দেবে। একজন চলে যাও ওখানে। শেষ খাবিটা খাওয়া হয়ে গেলে খবর পাঠাও, আমাদের বিদ্যামন্দিরের টিম গিয়ে সল্কার করে আসবে।
হেডস্যার জনমত চাইলেন। কর্তব্য আর পরোপকার কি এক হল?
অবশ্যই হল। অত বড় একটা সমিতি তৈরি হয়ে গেল, হিন্দু সৎকার সমিতি। অসহায় মানুষ রাতবিরেতে মারা গেলে কী হবে? এ তো খালি প্যাকেট নয়, যে ডাস্টবিনে ফেলে দেবে। সেকালে কত হিতকারী সভা, সমিতি ছিল। জলে ডুবে গেলে, পাতকুয়ায় পড়ে গেলে, ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ছাত থেকে গিরে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে…।
হেডস্যার বললেন—হঠাৎ হিন্দি শব্দ ব্যবহার করলেন কেন? গিরে!
আমি যে বাতলা। সাহিত্য আমার বিষয়। তিনখানা উপন্যাস শেষ। চতুর্থটাও প্রায় শেষ। একবার পড়ে গেল বলেছি। একই ক্রিয়া আমি পর পর দুবার ব্যবহার করি না। আমার ছাত্ররা ব্যবহার করুক তাও আমি চাই না। হেডস্যার বললেন,—উপন্যাসগুলো যন্ত্রস্থ হবে কবে?
সে কি এক কথায় হয় স্যার! মেয়ের বিয়ের মতো! প্রকাশকরা সব পাত্রপক্ষ। নতুন লেখকের লেখা ছাপবে কে?
এ আবার কী? সব লেখকই তো একসময় নতুন ছিলেন। ছাপতে ছাপতে তবেই না পুরোনো হলেন।
সে কথা কে শুনছে স্যার!
যাক, আমাদের কথায় আসি। কতকগুলো জিনিস বোঝার আছে, যেমন পরোপকার, সেবা, সাহায্য কর্তব্য, পরহিত, কোনটা কী? আমাদের মধ্যে থেকে শ্যামল উঠে দাঁড়িয়ে বললে, স্যার! আমার ঠাকুমা একেবারে বুড়ি, কোমর ভাঙা। আমাকে ধরেছেন রোজ সকালে গঙ্গায় স্নান। করিয়ে আনতে হবে। এটা কি পরোপকারের মধ্যে পড়ে। যদি পড়ে, তা হলে আমাকে করতে। হবে। আর তাহলে সকালে আমার পড়া হবে না। আর পড়া না হলে আমি ফেল করব। আর ফেল করলে আমাকে বাড়ি থেকে দূর করে দেবে। আর দূর করে দিলে আমি কোথায় যাব, কী খাব!
শ্যামল বসে পড়ল।
হেডস্যার বললেন—ঠাকুমা পর নন, আপনজন। এ তোমার পরোপকারের মধ্যে পড়ছে না। আপনি কি বলেন?
বাংলাস্যার বললেন—আমার আমি ছাড়া বাকি সবাই তো পর। শ্যামলের পেট খারাপ হলে শ্যামলকেই বাথরুমে যেতে হবে। শ্যামলের ঠাকুমা গেলে হবে না। অতএব?
হেডস্যার বললেন—অতএব?
বাংলা স্যার বললেন—শ্যামলের কেসটা সেবার মধ্যে পড়ছে। আর স্বামীজি পরোপকার, দয়া এইসব কথা সহ্য করতে পারতেন না। তিনি বলতেন শিবজ্ঞানে জীব সেবা। তা হলে?
হেডস্যার বললেন—তা হলে!
তা হলে ব্যাপারটা একটা কথায় এসে দাঁড়াল—সেবা। সেবার মধ্যেই আছে।
ব্রজ উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্যার! আমার বোনের যখনই জ্বর হয় তখনই পা দুটো এগিয়ে দিয়ে বলে, পদসেবা কর।
ব্যায়ামস্যার বললেন—করবি! সঙ্গে সঙ্গে ভেউ করে ভেঁকুর।
নীলাঞ্জন উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্যার! আমার মনে হয় কামারপাড়ায় একটা প্রাইমারি স্কুল করা যেতে পারে। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েরা সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়ায়। খুব গরিব ওরা।
হেডস্যার বললেন—গুড আইডিয়া!
বাংলা স্যার বললেন—আইডিয়া গুড; কিন্তু করা যাবে না। রাজনীতি।
হেডস্যার ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন—আমরা তা হলে কী করব?
কিচ্ছু করব না, মিটিং করব।
বিষ্ণু হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢুকল।
কী রে! বাঘে তাড়া করেছে?
বিষ্ণু বললে—শিগগির, পরোপকারের মেশিন বের করুন।
সে আবার কী?
বাড়িওয়ালা গুন্ডা এনে আমাদের সব জিনিসপত্তর বাইরে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। বাবাও হাসপাতালে। মাকে মেরেছে। দিদির চশমা ভেঙে দিয়েছে।
হেডস্যার বললেন—পুলিশ।
ব্যায়ামস্যার বললেন—পুলিশ কী করবে? এসব পেটি কেস।
তা হলে কে করবে?
কেউ করবে না। দেশ এখন আইনের হাতের বাইরে।
অপরেশ উঠে দাঁড়াল—চলুন না স্যার আমরা দল বেঁধে সবাই যাই।
হেডস্যার উঠে দাঁড়ালেন—নিশ্চয় যাব।
বাংলাস্যার সাবধান করলেন—আপনার বুকে পেসমেকার। আর আমি তো যেতে পারবই না, গলব্লাডার।
ব্যায়ামস্যার বললেন—আর আমারও অম্বল! আজ এক বছর হয়ে গেল একটা শিঙাড়া খাইনি, কড়াইশুটির কচুরি খাইনি।
আমাদের মধ্যে অপরেশ অন্য ধাতুতে তৈরি। যেমন চেহারা সেইরকম সাহস। ত্রিভুবনে। অপরেশের কেউ নেই। অনেক সময় মুটেগিরি করে পয়সা রোজগার করে। খুব ভোরে বাড়ি বাড়ি দুধ বিক্রি করে। লেখাপড়ায় ভীষণ ভালো। প্রাইভেট টিউটার রাখার ক্ষমতা নেই। রামকৃষ্ণ মিশনের এক সাধু অপরেশকে পড়ান। আমরা স্বামীজি স্বামীজি করি, অপরেশ স্বামীজিকে তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে। অপরেশ বলে, ঠাকুর আমার সব কেড়ে নিয়ে খুব ভালো করেছেন। ঠাকুর, মা, স্বামীজি ছাড়া আমার আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। আমরা এসব বুঝি না, তবে এটা বুঝি অপরেশ একেবারে অন্য রকমের। যেমন দেখতে সুন্দর, সেইরকম সুন্দর মন।
অপরেশ আমাদের দিকে তাকিয়ে বললে—কেউ আসবে? সাহস আছে? আমরা চারজন এগিয়ে গেলুম। হেডস্যার আসছিলেন, অপরেশ বললে—আপনাকে চিনেছি স্যার। কথা আর কাজ এক করতে পেরেছেন। আপনি পরে আসবেন।
.
৪.
অপরেশ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে বিষ্ণুদের বাড়ি নয়।
ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম,—যাচ্ছিস কোথায়?
ফোর্স আনতে। আর একটা কথাও বলবি না। শুধু দেখে যা। আমরা একটা অন্ধকার পাড়ায়। এলুম। খুব খারাপ জায়গা। মেয়েরা ঘুরছে। অপরেশ হনহন করে হেঁটে একটা সাবেক কালের বাড়িতে ঢুকল। গোটা বাড়িটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। পেছন দিকের একটা ঘরে আলো জ্বলছে।
ঘরে একটা ডিভান। ডিভানে বলিষ্ঠ চেহারার এক যুবক আড় হয়ে শুয়ে আছে। আর চারজন মেঝেতে বসে আছে বেশ আয়েস করে। পেছন দিকের দরজাটা খোলা। সেখানে একটা মাঠ। দরজার ধারেই পাঁচটা মোটর সাইকেল অন্ধকারে চকচক করছে। মাঠের ওপারে বড় রাস্তা। আলো জ্বলছে। রাস্তার ওপারে জমজমাট বাজার দোকানপাট, নতুন নতুন বাড়ি। সেটা পেরোলেই রেললাইন। আবার অন্ধকারের এলাকা। মেঝেতে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে একজন খুব সুন্দর গলায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে তোমার অসীমে।
অপরেশ ঘরে ঢুকেই বললে—নিবারণদা, উঠে পড়ো, অ্যাকশান। আবার কী হল? আজ যে আমার অফ ডে। ঠাকুরের জন্মদিন বুধবারে আমিও কোনও কাজ করি না।
ঠাকুরেরই কাজ। তপার দল আমাদের এক হেডমাস্টারের বাড়িতে ঢুকে অত্যাচার করছে। স্যার হাসপাতালে আই সি ইউতে পড়ে আছেন।
কেসটা কী?
মডার্ন ইলেকট্রনিকসের জগদা মণ্ডল বাড়িওয়ালা। ভাড়াটে উচ্ছেদ করে বাড়িটা প্রোমোটারকে দেবে। উৎপাত চলছে অনেক দিন ধরে। স্যার হাসপাতালে। এই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে।
তোর প্ল্যানটা বল? তোর মাথা আমার চেয়ে অনেক ভালো।
আমরা পাঁচটা বাইকে চড়ে সোজা জগদার ঠেকে যাব। কোথায় এই সময়ে থাকে তুমি জানো। আমিও জানি। এখন সে খুব দুর্বল। সঙ্গে মেশিন রাখে চালাতে জানে না। যদি ট্যান্ডাই ম্যান্ডাই করে সোজা তুলে নিয়ে যাব ওর গুরুর বাড়িতে। সেখান থেকে মোবাইলে তপাকে বলবে। যদি না বলতে চায় বারুইপুরে তোমার ডেরায় ডামপ।
মন্দ বলিসনি, তপা তো ওইটার কুত্তা। চল তাহলে।
যে গান গাইছিল, সে এবার গাইতে লাগল—কোন খেলা যে খেলবে কখন।
.
৫.
পাঁচখানা মোটর সাইকেল একসঙ্গে পাড়ায় ঢুকল। বিকট শব্দে। আমরা অবাক। জগদার ফুর্তির ডেরার সামনে আমাদের বিদ্যায়তনের অন্তত দুশো ছেলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ভেতরে ঢুকে আরও অবাক। জগদা কাঁদছে, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের হেডস্যার, বাংলার স্যার, আর ব্যায়াম স্যার। বেশ একটা নাটক। ব্যায়াম স্যার ঘন ঘন ভেঁকুর তুলছেন।
আমরা যখন ঢুকলুম তখন হেডস্যার বললেন—জগদা! তুমি আমাদের এক্স স্টুডেন্ট। তোমার বাবা ছিলেন অতি সম্মানিত, সাধক মানুষ। ভগবান তোমাকে কিছু কম দেননি, তোমার এই অধঃপতন! গুণ্ডারাজ একদিন শেষ হবে। তখন তুমি কী করবে? বাইরে তাকিয়ে দেখো আমার দুশো ছাত্র হাত মুঠো করে দাঁড়িয়ে আছে আদেশের অপেক্ষায়। আর এই তো আমাদের নিবারণ এসে গেছে। নিবারণকে তুমি চেনো নিশ্চয়।
জগদা হাঁ-করে চেয়ে আছে। ফোলা ফোলা মুখ। কাতলা মাছের মতো চোখ। বাবু আবার মদ খাচ্ছিলেন। সামনের বার ইলেকশানে দাঁড়াবে। এইসব লোক সমাজের মাথা হবে!
হেডস্যার বললেন যে বাপের পরিচয় দিতে গিয়ে ছেলে-মেয়ের মাথা হেঁটে হয়, তারা তো অরফ্যান। তুমি যখন তোমার পিতার পরিচয় দেবে লোকে বলবে আম গাছে আমড়া হয়েছে। শোনো জগদা, আমার শরীরে বিপ্লবীর রক্ত বইছে। এখুনি তোমার সাজানো-গোজানো দোকানটা আমার ছেলেরা চুরমার করে দিতে পারে।
জগদা উঠে দাঁড়াল। টলছে। বললে—আর আমাকে কিছু বলবেন না স্যার। আমি নিজে যাচ্ছি ক্ষমা চাইতে।
একটা মিছিল। পাঁচখানা মোটর সাইকেল আগে। তারপর আমাদের তিনজন স্যার। তারপর আমরা। বিষ্ণুদের বাড়ির সামনের রাস্তায় মালপত্তর ডাঁই। বিষ্ণুর মা আর দিদি সামনের বাড়ির রকে চুপ করে বসে আছেন। আর বাঙালি ভদ্দরলোকের যা রীতি, সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল। আমাদের মিছিল দেখে সব পালাচ্ছে।
নিবারণ একটার হাত চেপে ধরে বললে—পালাচ্ছিস কোথায়! বাকি মজাটা দেখে যা। এই এর ফুলপ্যান্টটা হাফপ্যান্ট করে দে। প্রতিবাদ না করে এই পাড়ার যারা মজা দেখেছে তাদের সঙ্গে ক’টার বাড়ি আজ ভাঙচুর হবে। একসঙ্গে দুশো ছেলে চিৎকার করে উঠল—হবে।
পটাপট দরজা-জানালা বন্ধ হচ্ছে। রক-বারান্দা সব খালি।
তপা বেরিয়ে এসেছে। হেডস্যার বললেন—তুমি আমাদের স্কুলের ছাত্র ছিলে। পরিচয় দিতে লজ্জা করে। তোমার বাবা ছিলেন সেক্রেটারি। লেখাপড়ায় তুমি ভালোই ছিলে। অধ্যাপক না হয়ে গুণ্ডা হয়েছ। খুব গর্বের কথা!
তপা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছে।
হেডস্যার বললেন তোমার কাছে তো রিভলভার আছে, যে রিভলভার দিয়ে স্বদেশিরা অত্যাচারী ইংরেজদের মারত, তুমি আমাকে মেরে ফেলল। এ লজ্জা আর সহ্য হচ্ছে না।
একে একে সব মাল ভেতরে উঠে গেল। জগদা বললে—কালই আমি বাড়িটা আপনাদের নামে রেজিষ্ট্রি করে দোব।
বিষ্ণুর মা ধীর শান্ত গলায় বললেন—দান আমরা নিই না। উনি অসুস্থ, বিপদে পড়েছি, সময় হলেই উঠে যাব।
জগদা বললে বাড়িটা তা হলে আমি সুন্দর করে সারিয়ে দোব। যতদিন ইচ্ছে আপনারা থাকবেন। আমার অপরাধ মার্জনা করবেন।
বাংলার স্যার—ইস করলেন।
ব্যায়ামস্যার বললেন—কী হল গোবর মাড়ালেন?
না, না, পরপর দুটো ক্রিয়া, আপনারা থাকবেন, মার্জনা করবেন।
দুটো নম্বর কেটে নিন।
সঞ্জয় আমার কানে কানে বললে—ইস আলুকাবলিটা।
হেডস্যার উঁচু রকে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা সব রাস্তায়। রাস্তার আলো তাঁর মুখে এসে পড়েছে। সুন্দর, সুপুরুষ চেহারা। হাসছেন আর বলছেন—আমি আমার পেসমেকারটা খুলে ফেলে দিতে পারি। তোমাদের সকলের হৃদয়ের শক্তিতে আমি আজ শক্তিমান। তোমরা আমার গর্ব।
আমরা সবাই চিৎকার করে বললুম—আপনাকে আমরা কোনওদিন ভুলব না স্যার। কোনওদিন। ভুলব না।
উপলব্ধি
ওহে তোমার ফোন, সেকশানের বড়বাবু লম্বা হলঘরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে হেঁকে উঠলেন। বাঁ-হাতে রিসিভারটা মাথার ওপর তুলে বারকতক নাড়ালেন। এইটাই তাঁর অভ্যাস।
যে-কোনও ফোন এলেই প্রভাতবাবু এই রকম করে থাকেন। এতবড় অফিসে অনবরতই ফোন আসে। সারাদিনে প্রভাতবাবু দাঁড়ে বসা চন্দনার মতো কপচে চলেছেন, ওহে তোমার ফোন। গলার জোরেই বড়বাবু, গলার জোরেই কাজ। তোমার ফোন বলেই প্রভাতবাবু রিসিভারটা ঠকাস করে টেবিলে নামিয়ে রেখে পাশের চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁর সঙ্গে গল্পে মেতে যান। পাশের চেয়ারটা কদাচিৎ খালি থাকে। তদবিরের জন্যে অনবরতই লোক আসছেন। কাপ কাপ চা আসছে, খিলি খিলি পান উড়ছে। অবশ্য এ না হলে কোনও অফিসের বড়বাবুরই শোভা খোলে না। তোমার ফোন-এ নামটা উহ্য থাকে বলে অফিসসুদ্ধ সকলেই তারস্বরে চিৎকার করে। ওঠেন, কার ফোন বড়বাবু, কার ফোন? বড়বাবু ইতিমধ্যেই কার ফোন ভুলে যান। গল্প করতে করতেই রিসিভার আবার কানে তুলে নিয়ে নামটা জেনে নেন। সেই প্রতিক্রিয়াতেই বিমান জানতে পারল এবারের ফোনটা তার।
বড়বাবুর পেছন দিকে একটা বড় জানলা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে অনেকটা নীচে রাস্তায় ছোট পিঁপড়ের মতো লোক দেখা যায়। খেলাঘরের গাড়ি। পোর্ট কমিশনারের গোডাউন। গঙ্গা। পরপারের দূর আকাশ। বিমান ফোনটাকে টেবিলের কোনায় টেনে এনে জানলার নির্জনতার দিকে সরে গেল। মৃদু গলায় জানতে চাইল, হ্যালো। যা ভেবেছিল তাই, ইলার গলা ভেসে এল। রাগ, ভালোবাসা, অভিমান, বিক্ষোভ সব মিলেমিশে ইলার গলাটা খসখসে রেকর্ডের মতো শোনাচ্ছে। মৃদু, সংযত। আড়ালে লুকিয়ে আছে উত্তেজনা। বিমান জানলার দিকে সরে এসে ভালোই করেছে। ফোনে নারীকণ্ঠ শুনলেই প্রভাতবাবু মনে করেন হয় প্রেমিকা না হয় রক্ষিতা। অবশ্য তাঁরও দোষ নেই। একই অফিসে, একই ফাইলে মুখ গুঁজে জীবন প্রায় কেটে গেল। চুলে অল্প পাক ধরেছে। স্ত্রী-র যৌবন চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। জীবনীশক্তি আস্তে আস্তে কমে আসছে। লোভ বাড়ছে। প্রদীপ নেভার আগে ষড়রিপুর ছটি সলতে ছটি শিখার মতো। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মানুষের চিন্তা, মানুষের রুচি এই বয়সে একটু অন্যরকম হয়ে যায়। পথের পাশে পড়ে থাকা আমের আঁটির গায়ে ঘিনঘিনে মাছির মতো।
বিমানকে কিছু বলার অবসর না দিয়েই ইলা শুরু করেছে এক গাদা অভিযোগ। দু-মাসের জমে থাকা অভিযোগ বাঁধ কেটে বেরিয়ে আসা জলের মতো কুলকুল করে বয়ে আসছে। তুমি আজকাল আমাকে এড়িয়ে যেতে চাও। কী তোমার এমন কাজ? রাখো রাখো, কাজ সবাই করে। এইরকম হয়, পুরোনো হয়ে গেলে তার আর দাম থাকে না! শনিবার তোমাকে গোলপার্কের কাছে দেখেছি। বুধবার তুমি সিনেমায় গিয়েছিলে। এর আগে তোমাকে আমি দুদিন ফোন করেছি। তোমাকে কেউ বলেনি! কই, তুমি তো রিংব্যাক করলে না! তুমি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার। করবে না কিন্তু। পরে এজন্যে তোমাকে কাঁদতে হবে দেখো, বলে দিচ্ছি। ইলার গলা ক্রমশই ধরে আসছে। বিমান কোনও জবাব দিতে পারছে না। বিমান কোনও প্রতিবাদ করতে পারছে না। অফিসের ফোনে কাজের কথা বলা যায়, কোনও পাটিকে খেলানো যায়, অধস্তন কর্মচারীকে। ধাতানো যায়, কিন্তু অভিমানী কোনও মেয়ের মান ভাঙানো যায় না। ইলা যেভাবে শুরু করেছে তাতে চালাতে দিলে ঘণ্টাখানেকের আগে ফোন ছাড়বে না। ইতিমধ্যে বাইরের লাইন আসবেই। নিমতলার শ্মশানের মতো অফিসের জেনারেল ফোন কখনও খালি যায় না। বোর্ডে কল মুখিয়েই আছে। ঢোকবার জন্যে ঠেলাঠেলি করছে। অপারেটররা ঝুলিয়ে রেখেছেন। যাঁর ধৈর্য অসীম তিনিই প্রবেশপথ পাবেন। ইলা বলছে, ঘণ্টাদুয়েক চেষ্টা করে তবে তোমাকে পেলুম। তুমি দেখছি দুর্ভেদ্য দুর্গে বসে আছ। ফোনও করো না, দেখাও করো না। বেশ মজা! তোমাকে যে ফোন করব তাও সহজে লাইন পাবার উপায় নেই। দু-ঘণ্টা চেষ্টা করে আজ অবধি যদিও পেলুম, কী উকিলের জেরা রে বাবা! কে বলছেন, কেন বলছেন, কী দরকার? আমি কী বলেছি জানো? তোমার বোন বলছি। কী করব বলো? লোকটা কে গো?
লোকটা প্রভাত সরখেল। আরও পাঁচবছর চাকরি করবে নর্মাল কোর্সে, তারপর তদবিরের জোরে আরও তিন বছর একসটেনশন। বিমান প্রভাতবাবুর গর্দানের দিকে তাকিয়েছিল। বেশ ঘাড়ে গর্দানে চেহারা। মালটাল খায় নিশ্চয়ই। মেয়েছেলেও আছে। চুলে এখনও পুরো পাক ধরেনি। বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে তিন বছর আগেই। এই বয়েসে বিমানরা বুড়িয়ে যাবে নিশ্চয়ই, বিমান ফিশফিশ করে বলল, আমাদের অফিসের বড়বাবু।
কী অসভ্য বাবা! তুমি কতটা দূরে বসো?
বিমান তার বসার জায়গার দিকে তাকিয়ে আন্দাজে একটা হিসেব করার চেষ্টা করল। গজ, ফুট, মিটার সম্পর্কে তার ভালো ধারণা নেই। বলে দিল, তা প্রায় বিশ গজ হবে।
বিশ গজ আসতে তোমার এত সময় লাগল? তার মানে তুমি আমাকে এড়াতে চাইছিলে! আমি এত কথা বলছি তুমি কেবল হ্যাঁ না দিয়েই সেরে দিতে চাইছ!
বিমান একটা কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় বাইরের একটা লাইন ঢুকে পড়ল। অপারেটারের কীর্তি।
কে প্রভাত নাকি? আরে এবারে তো ব্যাগপাইপ বাজিমাত করবে বলে মনে হচ্ছে। সেমিখান এন্ড প্রিন্স টিউডর বুঝলে, লকে আটশো মিটার টাইমিং শুনবে—১৩ সেকেন্ড, ২৯ সেকেন্ড।
বিমান প্রভাতবাবুরই রেসুড়ে বন্ধুকে থামিয়ে দিলে, আজ্ঞে আমি প্রভাত নই।
প্রভাত নও, তাহলে বিশ গজ, তিরিশ গজ কী বলছিলে? আমি ভাবলুম ফেয়ার প্রিন্সের কথা বলছ। প্রভাতকে দাও, প্রভাতকে দাও। ব্যাগপাইপের কথাটা বলি। শালা কেবল হেরে মরে। আমার টিপস তো নেবে না।
আপনি একটু ধরে থাকুন প্লিজ। আমি একটা অন্য লাইনে কথা বলছি। এক্ষুনি হয়ে যাবে।
এক্ষুনি হবে না রে ভাই। মা আমার রেগে আছে। মেয়েছেলে আর ঘোড়া দুটোই এক জাতের রে
ভাই, মেজাজ বোঝা দায়।
ইলাকে ঠান্ডা করার জন্যে বিমান বললে, শোনো ইলা, এ লাইনে আর বেশিক্ষণ চালানো যাবে না। আজ আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবই। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলছি। পৃথিবী রসাতলে গেলেও। তুমি প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে চলে এসো। ঠিক তিনটের সময়। তিনটে থেকে তিনটে তিরিশ। কেমন। তখন অনেক কথা হবে! অনেক অনেক। আরে দুর, এটা তো অফিস, না কি? এক ঘর লোক। লক্ষ্মী প্লিজ রাগ কোরো না।
বিমান হাত থেকে গরম জিনিস ফেলার মতো করে রিসিভারটা যথাস্থানে ফেলে দিল। মুক্তি! বাবা! একবার কথা শুরু করলে সহজে কি থামতে চায়? মেয়েদের কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল। প্রভাতবাবু বললেন, দ্যাখো না হে কার এল। আচ্ছা স্বার্থপর তো। নিজেরটা যেই হয়ে গেল অমনি পালাচ্ছ।
বিমান বললে, আপনারই। রিসিভারটা তুলে প্রভাতবাবুর হাতে ধরিয়ে দিল।
বিমান নিজের চেয়ারে এসে বসতেই পাশের চেয়ার থেকে বিকাশ বলে উঠল, তাহলে আজও আড়াইটেয় কাটছ!
বিমান অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তার মানে?
তার মানে তুমি আজও কাটছ, এখান থেকেই আমি শুনতে পাচ্ছি, প্লিজ আর লক্ষ্মীটির ছড়াছড়ি। আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবে। অনেক দিন তো হল। এবার ঘরের জিনিস ঘরে তুলে ফেল। রোজ রোজ এই অফিস থেকে আগে আগে বেরিয়ে পড়া, ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু হে! আফটার অল আমরা হলুম গিয়ে পাবলিক সারভেন্ট!
বিমান সবে চাকরিতে ঢুকেছে। ঢুকেই পাবলিক সারভেন্টদের যা নমুনা দেখছে তাতে পাবলিকদের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। অফিসের বাইরে সে-ও তো পাবলিকের একজন। বিকাশও তাই, প্রভাতবাবুও তাই। বিমান বিকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বিমানের সারা মুখে অত্যাচারের চিহ্ন। মুখ দেখলেই একজন মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতির, তার চিন্তাজগতের কিছু আভাস পাওয়া যায়। বিকাশ চেয়ারে গা এলিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। সকাল। থেকে একটাও ফাইল ধরেনি। সিনেমা-পত্রিকা ওলটাছে। বিমান বললে, আমার জন্যে তোমার চিন্তার প্রয়োজন নেই। ছুটি পাওনা আছে। প্রয়োজন হলে হাফ সিএল নিয়ে নেব। তুমিও তো পুরো খেলার সিজনটা তিনটের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যাও। আজও তো বড় খেলা আছে।
বিকাশ গুম হয়ে গেল। বিমান বললে, নিজেকেই বললে, পেড ব্যাক ইন হিজ ওন কয়েনস। অফিসের যে কটা লোক চাকরি করছে তাদের নব্বই ভাগের স্বভাব যেমন, চরিত্রও তেমন। আসলে এই ধরনের লোককেই বেছে বেছে চাকরি দেওয়া হয়, না চাকরি করতে করতে এইরকম হয়ে যায়! কথায় বলে, দশ বছর স্কুল মাস্টারি করলে গাধা হয়ে যায়, তেমনি হয়তো বছরকয়েক সেরেস্তায় চাকরি করলে মানুষের কালচার-টালচার নষ্ট হয়ে গিয়ে মোটামুটি একটা পশুতে পরিণত হয়। না পশুরও তো গুণ আছে, ক্রিমিনাল হয়ে যায়। একদিন আমিও হয়তো এদের মতো হয়ে যাব। বিমান যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। জীবিকার জন্যে এ কী দাসত্ব, এ কোন পরিবেশে তিল তিল করে শুকিয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে তার প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করে। বিকাশের গালে ঠাস করে একটা চড়। বাপের বয়সি প্রভাতবাবুর ঘাড়ে একটা রদ্দা। চড় অথবা রদ্দা সম্ভব না হলেও, কড়াকড়ি কিছু কথা। নেহাত চাকরিটা বেশি দিন হয়নি। এইসব দপ্তরে। কোথায় যে কী ফাঁদ পেতে রেখেছে জানা নেই। তারপর শালা ক্লিকবাজি করে এমন গাড়ায় ফেলে দেবে—ফিউচার ডুমড। যে করে চাকরি পেয়েছে ভাবলে গায়ে জ্বর আসে। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে নাম। লাখ লাখ বেকার থেকে একটি নাম, ঝাঁক থেকে একটি পাখি তুলে আনার মতোই কঠিন কাজ। তারপর কম সে কম ছবার ইন্টারভিউ। চাকরি যেন দৈত্যের প্রাণ। এক ডুবে সরোবরের তলায় গিয়ে স্ফটিকস্তম্ভ চুরমার করে কৌটোর মধ্যে থেকে ভোমরা বের করে ছাইগাদায় ফেলে টিপে মারতে পারলে তবেই সিদ্ধিলাভ। নচেৎ সেই অফুরন্ত কর্মহীন অবসর।
বিমান মনে মনে হাসল। কর্মহীনতা। যতদিন চাকরি পাইনি ততদিন ভেবেছি বসে বসে আর কতদিন পারা যায়? এখন চাকরি পেয়ে দেখেছি, বেকাররাই অফিসে আর এক বেকার মজলিশ বসিয়েছে। বাইরের বেকাররা মাইনে পায় না, এরা পায়। এই একটা বড় তফাত। যেহেতু বিমানের নতুন চাকরি, যত কাজ বিমানের ঘাড়ে। পুরোনো পাপীরা সারাদিন বসে বসে চা খাবেন, পান চিবোবেন, টেবিলে টেবিলে জটলা করবেন, আজ ইলেকট্রিক বিল জমা, কাল বিয়ের প্রেজেনটেশান কেনা, পরশু হাওড়া স্টেশনে ট্রেন অ্যাটেন্ড করার বাহানা করে হাওয়া হয়ে যাবেন। অফিস চালাবে নতুন রিক্রটরা। বলিহারি নিয়ম! রাসকেলদের জগতের রাসকেলিয়ান নিয়ম। ডায়েরি করার জন্যে একগাদা চিঠি খুলে বিমান আড়চোখে একবার বিকাশকে দেখে। নিল। প্রভাতবাবুর কীর্তনপার্টির লোক। কেমন সুখে আছে! এ জগতে যে আত্মবিক্রয় করতে পেরেছে সেই ব্যাটাই সুখী। এ এক সাধনা, এ-ও একপ্রকার সিদ্ধি! দল পাকাও, ঘোঁট পাকাও আর ক্ষমতার আসনে ফুল ফেলো, দুধের সরের মতো জগতে সুযোগের সরটুকু তুলে তুলে খাও।
কতরকমের চিঠি, কত রকমের আবেদন-নিবেদন, চাহিদা। কাদের কাছে আবেদন? সেই সংস্থার কাছে যেখানে বসে আছে বিকাশ, প্রভাত, মাধবীর মতো জনসেবকরা। এইসব চিঠি যাবে। প্রভাতবাবুর টেবিলে। সেই প্রভাতবাবু যিনি সারা সপ্তাহ ব্যাগপাইপ আর ফেয়ার প্রিন্সের চোদ্দোপুরুষ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সারাটা দিন অফিসে যাঁর কাজ হল উলটো দিকের চেয়ারে ছড়িয়ে বসে থাকা মাধবীর শরীরের অনাবৃত অংশের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই এক মেয়েছেলে মাইরি! সারা অফিসটাকে জ্বালিয়ে দিলে। যেমন সাজপোশাক, তেমনি চালচলন। কোনও ভদ্রঘরের মেয়েছেলে পারবে ওইভাবে টেবিলের তলায় বিশ্রীভাবে পা ছড়িয়ে বসতে পারবে বুকের। কাপড়টা ওইভাবে অনায়াসে ফেলে দিতে? পারবে সারা অফিসে ওইভাবে ফ্লার্ট করে বেড়াতে? পারবে বড়বাবুকে পিঠে করে খাওয়াতে? পারবে বিকাশের চেয়ারের হাতলে এসে বসতে? পারবে টাইপিস্ট নীলকণ্ঠর পিঠে হাত রেখে গায়ের ওপর ঢলে পড়ে দাঁড়াতে পারবে না। বিমান এতদিনে বুঝেছে কেন তার বোনের চাকরি হয় না। চাকরিও হবে না, বিয়েও হবে না। চাকরির বাজার মাধবীদের দখলে, বিয়ের বাজার ইলাদের। কীভাবে বিমানকে কামড়ে ধরেছে ইলা!
কামড় শব্দটা বিমানের খুব ভালো লাগল না। মনে হল ইলাকে ছোট করা হল। আসলে অনেকদিন ইলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই বলে ইলার আকর্ষণটা বোধহয় ক্রমশ কমে আসছে। অভাবের জগতে প্রেমের ভাব কতদিন বজায় রাখা যায়? তা ছাড়া দিনের পর দিন রোজ ঘন্টাসাতেক মাধবীকে খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে ইলা আর মাধবী যেন এক হয়ে গেছে। অফিসটা যেন মাধবীর কুঞ্জবন। প্রেম মানেই মাধবীর প্রেম। বড়বাবু যখন মাধু বলে ডাকেন, বিমানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যায়। সব মেয়েই যদি মাধুহত, সব ছেলেই যদি বিকাশ হত, সংসারের কী অবস্থা হত! ভাবা যায় না শালা। সব সংসারই হয়ে যেত মাধবীর সংসার, হাফগেরস্তর সংসার। স্বামীও থাকত, আবার অফিসের প্রভাতবাবু, বিকাশ-মিকাশও থাকত।
মাধবীর স্বামী! মনে হতেই বিমান খুব নার্ভাস হয়ে গেল। ইলাকে যদি বিয়ে করে তাহলে সেও মাধবীর স্বামী হয়ে যাবে না তো! মেটামরফসিস। তার এই আবরণটা ক্রিশ আলিস-এর মতো খুলে পড়ে যাবে। বেরিয়ে আসবে মাধবীর স্বামী। খেকুরে, দাঁত উঁচু একটা লোক। গায়ে গেরুয়া পাঞ্জাবি। থাকে আলাদা। মাঝে মাঝে চোরের মতো অফিসে এসে ইশারায় মাধবীকে বাইরে ডেকে নিয়ে যায়। দুজনকে একসঙ্গে দেখলে মনে হয় স্বামী নয়, ট্যাক্স কালেকটার কিংবা জলের মিস্তিরি। মাধবীর বাথরুমের কল ঠিক করতে এসেছে কিংবা মেয়েছেলের দালাল, মাধবীকে বুক করতে এসেছে। অফিসের বাইরে দুজনের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর হয়। ব্লাউজের বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে মাধবী ব্যাগ বার করে। লোকটা মাধবীর এই অবস্থা করেছে, না মাধবী লোকটার। ওই অবস্থা করেছে বিমানের জানতে ইচ্ছে করে। কী করলে কী হয়, কী থেকে কী হয়, জীবন শুরুর আগেই জানতে পারলে সচেতন মানুষ সাবধান হতে পারে।
বিকাশের মতো সচেতন-অচেতন জড়পদার্থ কিংবা প্রভাতবাবুর মতো জীবনহীন জীবদের কথা অবশ্য আলাদা। সংসারে এরা চেনামুখ। কিন্তু ঘরের বউ মাধবী কী করে প্রভাতবাবুর মাধু হল, বিকাশের মাধবীদি, জানার জিনিস। জানতে হলে বিমানকে মধুচক্রের সভ্য হতে হয়। শনিবার শনিবার প্রভাতবাবু আর বিকাশের সঙ্গে রেসের মাঠ থেকে বেরিয়ে দিশির বোতল ব্যাগে ভরে। খানদানি পাড়ায় মাধবীর বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতে হয়। তার আগে মাধবীদি নামের মহিলার সঙ্গে অফিসেই ঘনিষ্ঠ হতে হয়। বিমানচন্দ্র তা কি তুমি পারবে? বিমান নিজেকেই নিজে প্রশ্ন। করল। জবাবে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বড় ধরনের একটা না। অসম্ভব। মাধবীকে সে ঘৃণা করে। মাধবী তার কাছে নারীত্বশূন্য সেক্স। মাধবী তার কাছাকাছি বিকাশের টেবিলে এলে তার মনে হয় ঘিনঘিনে কোনও সরীসৃপ এসে দাঁড়িয়েছে।
সে যদি বিকাশ হত, তাহলে জানতে পারত, মাধবীরা কেন মাধবী, বিকাশরা কেন বিকাশ। জানতে পারত জীবন এক, অথচ জীবনদর্শন এত ভিন্ন কেন। কী করে বিকাশতাকে একদিন বলেছিল, এ যুগে বিয়ে করে কারা? যারা বোকা। এ যুগ হল জিও-পিওর যুগ। মেয়েছেলে সো চিপ। গোটাকতক সিনেমা দেখালেই দে আর বেডেবল। বিমান চমকে উঠেছিল। এই যদি
জীবনদর্শন হয় কামিং জেনারেশনটা কী দাঁড়াবে। আগামী পুথিবী কি শাসন করবে বাস্টার্ডরা? সেদিনই তোমার দাঁত ভেঙে দিতুম হারামজাদা যেদিন তুমি বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলে, মেয়েটা কে হে বিমান? প্রায়ই তোমাকে ফোন করে। একদিন ব্যবস্থা করো না। ডায়মন্ডহারবার থেকে ঘুরে আসি। টানা ট্যাক্সিতে যাব-আসব। মালফাল খাওয়াদাওয়া সব খরচ আমার, তোমার নো এক্সপেন্স।
বিমান জিগ্যেস করেছিল, কেন?
বিকাশ বলেছিল, দেখব মালটা কেমন! তোমার সঙ্গে ফিট করবে কি না! আমরা হলুম গিয়ে এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট। বিমান সঙ্গে সঙ্গে কলার চেপে ধরেছিল। তুমি শালা ইউনিয়নের নেতা। অফিসে মর্যাল গার্জেন। দাবিদাওয়া নিয়ে তুমি যাও কর্তৃপক্ষের কাছে। আর এই তোমার ভেতর! বিকাশ ভাবতেও পারেনি তার মতো একজন নেতার ওপর বিমান হঠাৎ এমন। খেপে উঠবে। নিজের আখেরের কথা ভেবেও বিমানের অন্তত হয় রাজি, না হয় হজম করা উচিত ছিল। বিকাশ বলেছিল, ইয়ার্কি বোঝো না! কথায় কথায় অত তেরিয়া হয়ে ওঠো কেন? আজকাল বিয়ে করা বউ ঘরে থাকছে না, এ তো প্রেম করা মেয়ে! তুমি কি ভাবো এ অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে ঘোরে না, সিনেমা দেখে না? ধারণা পালটাও বিমান। যুগ পালটাচ্ছে। বি প্র্যাকটিক্যাল। কলারটা চেপে ধরা অবস্থাতেই বিমান বলেছিল, সবাইকে তুমি নিজের মতো ভাবো, তাই না? শালা, তোমার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। সব মেয়েই বেশ্যা তাই না?
অফিসে পাশাপাশি চেয়ারের ঘটনা এর চেয়ে বেশি দূর এগোয়নি। পেছন থেকে মোহন মিটমাট করিয়ে দিয়েছিল। মোহন আবার বিকাশের চামচা। এক কলকের স্যাঙাত। ইউনিয়নের নাম। করে চাঁদা তোলে, যার কোনও হিসেব নেই। কোথাকার চাঁদা কোথায় যায় জিগ্যেস কোরো না। মাসে মাসে শুধু চাঁদাটা দিয়ে যাও। বছরে একটা করে থিয়েটার, একবার পিকনিক, এ তো বাঁধা ব্যাপার। রিহার্সালে ভাড়া করা মেয়েরা আসবে। মোহন চা আর খাবার সাপ্লাই করবে। বিকাশ আর প্রভাতবাবুর পকেটে এক আউন্স শিশিতে ভাইনাম গ্যালেসিয়া থাকবে। হাফ চা, হাফ এ জিনিস। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যাবে। প্রভাত সরখেল একটা চেয়ারে বসে রিহার্সাল শুনতে শুনতে রসের কথা বলবেন। মাঝে মাঝে মেয়েদের পিঠে কিংবা হাতে আঙুলের খোঁচা মেরে খিক খিক করে হেসে উঠবেন। মেকআপ করা গালে বুড়ো বয়সের পাকা আঙুলের টুসকি মারবেন। বিকাশ বলবে, প্রেমের দৃশ্যে অত আড়ষ্ট হলে চলে? আহা স্টেজে না হয় চুমু চলবে না। রিহার্সালে দোষটা কি? চাঁদার টাকায় বিকাশ চুমু খাবে। প্রভাত সরখেল যৌবনে খোঁচা মারবেন, মোহন মালের হিসেব রাখবে। বিমান বলেছিল তোমরা হিসেবটা দাও না কেন? বিকাশ বলেছিল, কালকা যোগী, ব্যাটাকে থেফট কেসে ফেলে সাসপেন্ড করিয়ে দেব। কত হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে দেখি কত জল!
দুজনে পাশাপাশি বসলেও সেই থেকে বিকাশ বিমানের শত্রু। বিমানের সব কিছুর ওপর বিকাশের নজর। স্পাইং করে চলেছে। সাপের ফণা তোলাই আছে, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। মাঝে মাঝে বিমানের খুব ইচ্ছা করে বিকাশের চোয়ালে একটা আন্ডারকাট ঝেড়ে প্রভাত সরখেলের মুখের ওপর একটা রেজিগনেশান ছুড়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে জনতার দলে মিশে গিয়ে বহুতল এই বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে বলে—ওই দেখুন, ওই বাড়িটার তলায় তলায় আপনার আমার পয়সায় একদল করাপ্ট পাবলিক সারভেন্ট দিনের পর দিন আমাদের স্বার্থ নিয়ে তামাশা করে চলেছে। আমি দেখেছি আপনারা আশা নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে প্রতিকার চেয়ে, বিচার চেয়ে সব চিঠি লেখেন। ওরা দিনের পর দিন সেইসব চিঠির ওপর চেপে বসে থেকে সময় পার করে দেয়। নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়েই ওরা ব্যস্ত। ডিএ চাই, টিএ চাই, ক্ষমতা চাই। লাঠি ঘোরানোই ওদের কাজ। ওই পুরো কাঠামোটাই ঘুণ ধরা। সাহস করে নাড়া। দিতে পারলেই ভেঙে পড়বে। বিমান ভাবে, কিন্তু পারে না। পারে না, কারণ সে জন্ম থেকেই ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের পুত্র ক্রীতদাস। কে বলেছে, এ দেশ থেকে দাসব্যবসা উঠে গেছে? জন্ম থেকেই শুনে আসছে—ভালো করে পড়ো, চাকরি করতে হবে। কই তার বাবা তো বলেননি, চাষ করতে হবে, কী পান-বিড়ির দোকান করতে হবে। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক হতে হবে। মাধবীর মতো হাফগেরস্ত হতে হবে। বিমানবাবু হতে হবে। হরিদাসবাবুর ছেলে, যিনি জর্জ শেফিল্ডের ক্যাশিয়ার ছিলেন। বর্তমানে রিটায়ার্ড। বয়স তিয়াত্তর। এক ছেলে তিন মেয়ের জনক। যাঁর। শরীর বর্তমানে জরাজীর্ণ, যাঁর অ্যাসেটের চেয়ে লয়াবিলিটিই বেশি। যিনি যাওয়ার আগে আর এক হরিদাসকে রেখে যাবেন। সেই এক ইতিহাস, এক গতি! এ যেন ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসন —প্রথম জর্জ, দ্বিতীয় জর্জ…পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ জর্জ।
বিমান ভাবতে ভাবতেই কাজ করছিল। একের পর এক ডায়েরি। প্রেরকের নাম, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, যে ফাইলে সমাধি হবে সেই ফাইলের নম্বর। পাকা কাজ। চিঠি যেন না হারায়, মিসপ্লেসড না নয়, অ্যাকশন চুলোয় যাক। সারা বছর চিঠির সংখ্যা দেখিয়ে এতগুলো লোকের চাকরির প্রয়োজনের জবাবদিহি করতে হবে। সারা বছর আমরা ভেরেন্ডা ভাজিই না। কাজে কাজে আমাদের নাভিশ্বাস। সুধীর চা দিয়ে গেছে। বিমান চা খেতে খেতে একটু উদাস হয়েছে। রাগটা ক্রমশ থিতোচ্ছে। অফিসটাকে সে এখন চোখের অফ লেন্সে ঝাপসা দেখছে। চাকরিটা সে ছাড়তে পারবে না দুটো কারণে—তাকে এখানেই থাকতে হবে। থেকে থেকে ওই প্রভাত সরখেলের চেয়ার পর্যন্ত যেতে হবে। প্রথম কারণ, তার সংসারে মা, বাবা, বোন। দ্বিতীয় কারণ, ইলা। যে। মেয়ে তিন বছর ধৈর্য ধরে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে পারে সে মেয়ে, বিকাশ যতই বলুক, সস্তা মেয়ে নয়। বাজারের মেয়ে নয়। বিমান এমন কিছু রাজপুত্র নয়। হিরো নয়। বড়লোকের পয়সা ওড়ানো ছেলে নয়। কী দেখেছে ইলা তার মধ্যে এই তিন বছরে বিমান তাকে কোনও উপহার দিতে পারেনি, দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে পারেনি, এখানে-সেখানে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেনি। হ্যাঁ, সিনেমায় গেছে মাঝে মাঝে, তাও সব সময় বিমানের একার পয়সায় নয়। আর মাঝে মাঝে ময়দানের ঘাসের ওপর বসে একশো গ্রাম চিনেবাদাম ভেঙে ভেঙে খেয়েছে, গল্প করেছে। এই একশো গ্রামই বরাদ্দ। তাও ইদানীং দাম বাড়ায় কমে পঞ্চাশ হয়েছে। ইলা সময় সময় বিমানের কাছে কর্কশ ব্যবহারও পেয়েছে! সংসারের চাপে, সমাজের উৎপীড়নে সবসময় মানুষ মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারে না। সবসময় প্রেম থাকে না! কাম থাকতে পারে। ক্রোধের মতো কামও একটা জৈব তাড়না। প্রেম অনেকটা চোলাই করা সিজনড মদের আবেশের মতো। সুইচ টিপে আলো জ্বালাবার মতো চট করে প্রেমের আবেগে মন ভরে তোলা যায় না। দুটো মন সব সময় একই তরঙ্গে কাঁপে না। সেই সব ক্ষত-বিক্ষত মুহূর্তে ইলা হয়তো এসে পড়েছে। তার নারীসুলভ ভবিষ্যৎ কল্পনার ছবি তুলে ধরেছে। ভবিষ্যৎকে দ্রুত বর্তমান করে তুলতে চেয়েছে। বিমানের জীবনে ভবিষ্যৎ কোথায়! বর্তমানের ভেলায় ভেসে চলেছে। কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে কিছুই জানে না। সে পরিস্থিতির দাস। মুহূর্ত ঝরছে বৃষ্টির মতো। বিমান ভিজতে ভিজতে চলেছে। ইলারও ভবিষ্যৎ তৈরি করার ক্ষমতা নেই। তবে স্বপ্ন তৈরি করার ক্ষমতা আছে। সময় তার তাসের ঘর তৈরিতে ব্যস্ত বিমান তাস সাজিয়ে দেয়নি তা নয়, তবে বেশির ভাগ সময়ই ইলা যতটুকু সাজিয়েছে বিমান ভেঙে দিয়েছে। ইলা হয়তো অভিমান করেছে, কিন্তু ত্যাগ করেনি। অধৈর্য হয়েছে, ধৈর্য হারায়নি। দুমড়ে গেছে, ভেঙে যায়নি। এই ইলাকে নিয়ে বিকাশ যাবে ডায়মন্ডহারবারে মালের সঙ্গে টেস্ট করতে। শালা মাংসলোলুপ হারামজাদা!
বিমানের চিঠি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চা অনেক আগেই শেষ। ইলার টেলিফোন পেয়ে সে যেন এই প্রথম ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে শুরু করেছে। ভবিষ্যৎটাকে কেন সে কিছুতেই বর্তমানের মতো একটা সুনিশ্চিত চেহারা দিতে পারছে না। তার বাবা কিন্তু পেরেছিলেন। হরিদাসবাবুর। ভবিষ্যৎ তাঁর কল্পনার মতোই হয়েছে। তিনি তাঁর বর্তমানটাকে অভিজ্ঞ মাঝির মতোই ঝড়ঝাপটা ঠেলে ভবিষ্যতের কূলে গিয়ে ঠেকাতে পেরেছেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। যা হোক একটা চাকরি অবশেষে সম্ভব হয়েছে। বড় কিছু। অ্যামবিশান তাঁর ছিল না। থাকলেও বড় চুল ছোট করার মতো হেঁটে নিয়েছিলেন। এখন তিনি বিদায়ি। যাওয়ার দিন গুনছেন। সকলকেই যেতে হবে। তবে যাওয়ার জন্যে এমন তৈরি হয়ে। বেঁধেবঁধে বসে থাকা কটা মানুষের হয়? প্রায়ই দেখা যায় হঠাৎ উপড়ে গেল। যাঃ শালা, কেটে গেছি গোছের ব্যাপার। ইলার কথা বিমান বাড়িতে বলেনি! বলার সাহস নেই বলেই বলেনি। মোটামুটি তার জন্যে একটি মেয়ে ঠিক করাই আছে। সেই ঠিককে বেঠিক করতে হবে। শক্ত কাজ। চাকরির দোহাই দিয়ে এতদিন ইলাকে আটকে রাখা গিয়েছিল। এখন তো সে অজুহাত খাটবে না। এইবার কী চাল চালবে বিমানচন্দ্র? ডায়েরি বন্ধ করতে করতে বিমান নিজেকেই। নিজে প্রশ্ন করল। জীবন নিয়ে তো খেলা চলে না। এ পাখি খাঁচার পাখি। দাঁড়ে দাঁড়ে বসে মাপা ছোলা আর জল। শিস দিতে পারো ভালো। না পারো কর্কশ গলার ডাক শুনিয়ে যাও গৃহস্থকে। মুক্ত হওয়ার জন্যে তো তোমার জন্ম নয়। বন্দি হওয়ার জন্যেই জন্মেছ। আঠাকাঠি দিয়ে হরিদাসবাবু তোমাকে ডাল থেকে পেড়ে এনেছেন। কর্তব্যের সোনার খাঁচায় পুরেছেন। সংসারের শিকল পরিয়ে দিয়েছেন। অনন্ত আকাশ তোমার নয়। খাঁচার আকাশে একটু একটু উড়তে পারো। ডানা ঝাপটাতে পারো। শিকলের মানে তোমার স্বাধীনতার পরিধি। বিমান, এ যে বড় শক্ত ঠাঁই। ইলাকে তুমি এখন কী করে ঠেকাবে? কী করে মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে জানাবে। আপনার নির্বাচিত পাত্রী নয়, আমার পছন্দকে আমি ঘরে নিয়ে আসতে চাই বাবা।
বিমানের মনে হল, এই মুহূর্তে সে বিকাশের জীবনদর্শন ধার করবে কি না? আরে ম্যান, প্রেম করলেই বিয়ে করতে হবে নাকি? ফুল তুমি শুকবে তারপর ফেলে দেবে। জলের মাছকে খেলিয়ে জলেই আবার ছেড়ে দেবে। উসমে কেয়া হ্যায় গুরু। তুমিও অ্যাডাল্ট, সেও অ্যাডাল্ট। এ কি মুচলেকা লিখে দিয়ে প্রেম? এ তো সেই চিরাচরিত স্টোরি-বয় মিটস গার্ল। কত আসবে কত যাবে! বি এ ডগ। সিজনে সিজনে একটা করে বিচ ধরবে অ্যান্ড ডোন্ট ফরগেট দিস ইজ দি এজ অফ পিলস এন্ড কন্ট্রাসেপটিভস। কথাটা ভেবেই বিমানের গা-টা কেমন করে উঠল। কিছুতেই সে হিউম্যান ডগ হতে পারবে না। বিকাশ হতে পারবে না। এমনকী প্রভাত সরখেলও নয়, মাধবীর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা খেকুরে স্বামী তো নয়ই। এই রোজগারে সংসার চলবে না, তখন কাঁঠাল ভেঙে চালাতে হবে। একটা বিকাশ জোটাতে হবে। সামনে একটা মাধবীকে বসাতে। হবে। শনিবার শনিবার ব্যাগপাইপে ভাগ্য লাগাতে হবে। তারপর চাঁট খেয়ে বাঙলা মেরে মাধবীর গোদা পায়ে মাথা খুঁড়ে বলতে হবে—দোষ কারও নয় গো মা আমি স্বখাত সলিলে।
এই যে বিমান, সরু মেয়েলি গলার বড়বাবু প্রভাত সরখেল বিমানকে ডাকলেন। বিমান তার। সমস্ত চিন্তা ধামাচাপা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কী নির্দেশ কে জানে! কার বাড়া ভাতে ছাই দিতে হবে দেখা যাক। হয়তো নিজেরই! সরখেলের খুঁটি সোজা রাস্তায় চলে না। মাধবীর দেওয়া জর্দাপানে। সরখেলের পাতলা ঠোঁটদুটো কালচে লাল। দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। মনে হয় যেন রক্ত পান করেছিলেন, শুকিয়ে আছে। চেহারাই যেন চরিত্রহীনের। বড়বাবু তীক্ষ্ণ সরু গলা একটু খাদে নামিয়ে বললেন, আজ যেন তাড়াতাড়ি কেটে পোড়োনা। সেন্ট্রাল বাজেটের দিন। সাতটা অবধি থাকতে হবে সকলকে। পার্লামেন্টে কোশ্চেন উঠলে জবাব দিতে হবে। নতুন ডিউটি যে যে। জিনিসে চাপল, লিস্ট করে সাইক্লোস্টাইল করতে হবে। বুঝলে কিছু?
বুঝলেও কিছু করার নেই। সাড়ে তিনটের সময় আমার এনগেজমেন্ট আছে। বিমান সোজাসুজি মুখের ওপর বলে দিল। প্রভাতবাবু বাঁকা চোখে বিমানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ব্যঙ্গের গলায় বললেন, কোথায়? ক্যালকাটা ক্লাবে? তারপর অত্যন্ত অভদ্রভাবে যোগ করলেন, অফিসটা কি তোমার মামারবাড়ি ভাবো নাকি হে! যাও, অর্ডার ইজ অর্ডার। বিমানের ইচ্ছে করছিল প্রবীণ মানুষটির গালে ঠাস করে একটা চড় মারে কিংবা বাঘের মতো টুটি চেপে ধরে ভবসাগর তারণ পারণ করে দেয়। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে নিল। এখনও বোনের বিয়ে বাকি। ইলার সঙ্গে সংসার পাততে হবে। শিল-নোড়া, হাতা-খুন্তি, বেবিফুড, মশারি, গ্রাইপওয়াটার, কাফ মিক্সচার। বিমান চেয়ারে বসতে বসতে মনে মনে বলল, ইলা স্রেফ তোমার জন্যে বুড়োটা বেঁচে গেল।
তিনটের সময় বিমানকে অফিস ছাড়তেই হবে। ইলাকে সে কথা দিয়েছে—পৃথিবী রসাতলে গেলেও দেখা আজ হবেই। আবার ফোন করে বারণ করারও উপায় নেই। সে কোথা থেকে ফোন করছিল তাও জানে না। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে হতাশ হয়ে ইলা ফিরে যাচ্ছে এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে! বিমান যাবেই। দেখা যাক কী হয়! বড়জোর চাকরিটা চলে যাবে। যায় যাক। ফুটপাথে গামছা ফিরি করবে। হাওড়া স্টেশনে কুলিগিরি করবে। পারবে না? পারতেই হবে। জীবনের বাজি ধরে পাশার চালে হারলেই হল! এবার সে খেলবে। লোহার বাঁধনে সংসার বেঁধেছে সত্যি তবু দাসখত লিখিয়ে নিতে পারবে না। অন্তত একবার সে বিজয়ী হবে।
বিমান সোজা বড়কর্তার ঘরে চলে গেল। চাকরির ভয়টাকে সে হত্যা করতে পেরেছে। এখন সে সবকিছু করতে পারে। বিমানের মনে হল, প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ ভয় থেকে মুক্তি। অফিসের সর্বময় কর্তা বিমানকে কখনও দেখেননি। বিমানও তাঁকে দেখেনি। তিনি থাকেন বিশাল পর্দা ফেলা ঘরে। বসেন ঘূর্ণায়মান চেয়ারে। তাঁর টেবিল অর্ধচন্দ্রাকৃতি। মেঝেতে কার্পেট। সমস্ত। আয়োজনটাই ভয় ধরানোর মতো। তাঁর অঙ্গসজ্জার মধ্যেও একটা ক্ষমতার ভাব। সে ক্ষমতা মঙ্গলের কি অমঙ্গলের বলা শক্ত। যে-কোনও ছবির দিকে তাকালে চোখ যেমন প্রথমেই বিশেষ একটি কেন্দ্রীয় বস্তুতে ধাক্কা খায়, যাকে আর্টের ভাষায় বলে সেন্ট্রাল অবজেক্ট কিংবা আইলাইন, বিমানের চোখও তেমনি প্রথমেই গিয়ে পড়ল পাইপের ওপর। পাইপ থেকে ঠোঁট, ঠোঁট থেকে। গোঁফ, গোঁফ থেকে নাক, নাক থেকে চোখ, অবশেষে পুরো মুখ, গলা, হাফবোস্ট। মুখটা অল্প নীচু করে তিনি কী একটা কাগজ দেখছেন। মাথার পেছন দিকে ধোঁয়ার একটা আবরণ তৈরি হয়েছে। বিমানের মনে হল নীহারিকা থেকে সদ্য একটি তারকার জন্ম হচ্ছে। এত সহজে সে এই ভাবতে পারছে কারণ ভয়ের নার্ভটাকে সে অবশ করে দিতে পেরেছে। কত সহজে সোজা সোজা পা ফেলে সে টেবিলের সামনে দাঁড়াতে পেরেছে। বিমান ভেবেছিল টেবিলের উলটোদিক থেকে। একটা ভয় দেখানো গলায় প্রশ্ন আসবে, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? তা কিন্তু এল না। মুখটা কাগজের দিকে টেবিল ল্যাম্পের মতো নেমেই রইল। বিশেষ কোনও চিঠি বা রিপোর্ট হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। এটা এক ধরনের চালও হতে পারে। বাড়ির বেড়াল কি কুকুর হঠাৎ ঘরে ঢুকলে যেমন আমরা গ্রাহ্যই করি না কিন্তু একটা বাঘ ঢুকলে লাফিয়ে উঠি, এক্ষেত্রেও তাই। তোমাকে দেখেই বুঝেছি অধস্তন কোনও কর্মচারী। নিশ্চয় কোনও তদবিরে এসেছ, কিছু চাইতে এসেছ। অতএব তোমাকে অত খাতিরের কী প্রয়োজন! তুমি অধমর্ণ।
বিমান কাজের কথাটা পেড়েই ফেলল, স্যার, আপনি কি আমাকে আজ সাতটা অবধি থাকতে বলেছেন বাজেটের জন্য?
বাই নো মিনস। হোয়াই শুড আই আস্ক ইউ টু স্টে? মুখ না তুলেই দাঁতে পাইপ চেপে উত্তর দিলেন। বিমানের হাসি পেল। কেমন একটা উপেক্ষার ভাব। দুজনের শারীরিক ব্যবধান ফুট ছয়েক, স্ট্যাটাসের ব্যবধান যোজনখানেক। এই ভদ্রলোককেই নির্জন রাস্তায় অন্ধকারে চেপে ধরে তলপেটে ভোজালি ধরলে নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা করবেন। এই লোকেরই হঠাৎ চাকরি চলে গেলে বিমানের কাঁধে হাত রেখে বলবেন—হ্যাললো ফ্রেন্ড! ক্ষমতা এক ধরনের ইনটকসিকেশান।
বিমান বললে, স্যার, আমি আজ তিনটের সময় অফিস লিভ করতে পারি?
আস্ক ইওর বড়বাবু।
তিনি তো আপনার নাম করে সাতটা অবধি থাকার ফতোয়া জারি করেছেন অথচ আমার গার্লফেন্ডকে কথা দিয়ে ফেলেছি।
ইজ ইট? এতক্ষণে চোখ তুলে তাকালেন। ইজ ইট অফিস অর ক্লাব?
আজ্ঞে অফিস। তবে আমরা সবাই মানুষ তো! সামটাইমস এমন কিছু জেনুইন প্রবলেম আসে যখন আপনার কর্মচারীরা অফিসের নিয়মে না চলে জগতের নিয়মে চলতে চায়। বড়বাবু, ম্যানেজিং ডিরেক্টার প্রভৃতিকে মানুষ বলে ভাবতে চায়। বোথ অফ আস ইন এ জেনুইন প্রবলেম। সেই সমস্যাগুলোর জন্য আমি অনুমতি চাইতে এসেছি।
বড়কর্তা ঠোঁট থেকে পাইপ খুলে নিয়ে বিমানের দিকে বিস্ময় মাখানো মুখে চেয়ে রইলেন। মুখের শক্ত রেখাগুলো যেন নরম হয়ে আসছে। কর্মজীবনে কর্মচারীদের মুখ থেকে স্পষ্ট সত্য কথা বোধহয় কমই শুনেছেন। কী সংসার, কী অফিসসর্বত্রই ছলচাতুরী। ঠোঁটের কোণে একটু হাসিও দেখা গেল। তিনি বললেন, সরখেল, আই মিন ইওর বড়বাবু আপনাকে খুব লাইক করছেন বলে মনে হচ্ছে না। হি কুড হ্যাভ ইজিলি গিভ ইউ পারমিশান টু লিভ।
তার কারণ আছে স্যার, আমাদের জেনারেশনকে আগের জেনারেশনের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। প্রবাবলি আমরা স্পষ্ট কথা বলি, প্রতিবাদ করি বলে।
দ্যাটস রাইট, দ্যাট মে বি দি রিজন। হাওয়েভার আপনি কি ওই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন? উইল ইউ ম্যারি হার?
সেইরকমই ইচ্ছে আছে।
কী করছেন তিনি? আই মিন হোয়াট শি ইজ!
টিচার।
ভেরি গুড। কোথায় আপনাদের মিটিং প্লেস, আই মিন প্লেস অফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
প্ল্যানেটোরিয়াম স্যার।
ঠিক আছে, আমি ওই দিকেই যাব, গিভ ইউ এ লিফট। বড়কর্তার পাইপ ফিরে গেল ঠোঁটে। মুখ নেমে গেল কাগজে। বিমান বললে, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
বিমান চেয়ারে এসে বসল। হায় সরখেল! তুমি জানতেও পারলে নাকী ঘটে গেল। রেসের বই কোলে ফেলে বিকাশ আর সরখেল দুজনেই তন্ময়। কাল শনিবার। ব্যাগপাইপ দৌড়োচ্ছে মাঠে। পৃথিবীতে এখন আর অন্য কিছু নেই। অশ্বময় পৃথিবী। ওদিকে টাইপিস্ট সুখময় মাধবীর টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে হেসে হেসে খোশগল্পে মশগুল। মাধবীর লো কাট হাতকাটা ব্লাউজ, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মধ্যবয়সের মেদ। নাভির তলায় শাড়ি। বিমান মনে মনে প্রশ্ন করল, ইজ ইট এ ক্লাব? বড়কর্তার মতো গলা করে উত্তর দিল, নো স্যার অবসলিউটলি এ ব্রথেল।
বিমানের আবার একটা ফোন এল। এবার ধরেছে মাধবী। আপনার ফোন। মাধবীর চোখ চিকচিক করে উঠল, একটি মেয়ে। মেয়ে মানেই মজার জিনিস, লোফালুফি খেলার বল। বিমান উঠে গিয়ে ফোন ধরল। প্রভাত সরখেল সিট ছেড়ে কোনও ধান্দায় গেলেন। ইলার ফোন নাকি! বিমান খুব ধীর গলায় বললে, হ্যালো। বিমানের ছোট বোন চিত্রার গলা ভেসে এল, দাদা! হ্যাঁ দাদা, কী ব্যাপার রে? তুই আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবি। বাবার শরীরটা ভালো নেই। তুই যাওয়ার পর থেকেই স্প্যাজমটা বেড়েছে রে। ঠিক আছে শোন; আমি যতটা সম্ভব। তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করব, তুই ততক্ষণে ডাক্তার সেনকে একবার কল দিয়ে দেখিয়ে নে। বুঝলি। ক্লিক করে লাইন কেটে গেল। অপারেটারদের কারসাজি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা। মানেই ফস্টিনস্টি। সুতরাং লাইন অফ করে দাও।
বিকাশ কিছু মন্তব্য করবেনই, কী আবার ফোন? সব প্ল্যানমাফিক চলছে, কী বলো?
মানে?
মানে বেশ সাজিয়েছ হে। প্রথমে কী আসবে? পরে কী আসবে? অতঃপর তুমি কাটবে। অতঃপর আমরা সবাই বাসর জাগিয়ে রাখব।
বিমান বললে, বিকাশ, এর জবাব আমি আজ দোবোনা, এখানেও দেব না, দেব অফিসের বাইরে, মুখ নয়, হাতে।
বিকাশ বললে, তাহলে তো একটা ইঁদুরের গর্ত খুঁজতে হচ্ছে হে! বড় ভয় পেয়ে গেলুম যে।
এখনও ভয় পাওনি তবে বিটিং স্কোয়াডের হাতে পড়লে ভয় অবশ্যই পাবে এবং আমাদের। মেথডটা ভেরি স্নিক অ্যান্ড ফানি। তুমি কিছু বোঝবার আগেই তোমার উইন্ড পাইপটা ওপেন করে দেওয়া হবে। ভেতরের দূষিত হওয়ার সঙ্গে প্রাণপাখিটা ফুড়ুক করে উড়ে যাবে। কেউ। জানবে না, উড়বে সাধের ময়না।
বিকাশ হাতটা দুবার মুঠো করল। শরীরটা কাঁপছে। বেশ বুঝল, নেশা-ভাঙ করে শরীরের ওপর অসাধারণ অত্যাচার করে স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছে। হাত-পা কেমন হলুদ হলুদ। চোখ ঘোলাটে। অথচ বিমান! সবুজ গাছের মতো। মাথা তুলে দাঁড়ালে শালের খুঁটি। শহরে হঠাৎ মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। সমাজ আর আগের মতো নেই। বাঙালির ছেলের স্বাদ পেয়ে গেছে। বিকাশ যেন একটু স্তম্ভিত হয়ে গেল।
তিনটে বাজতে দশ মিনিটে বেয়ারা এসে খবর দিলে, সাহেব সেলাম দিয়েছেন। বড়বাবু একবার চোখ বড় বড় করে দেখলেন। ভাবলেন, এইবার মরেছে ছোকরা। চাকরি থাকে কি যায়। বিকাশের বিমর্ষ মুখেও প্রত্যাশার ঝিলিক, শালা একটু আগে তুমি বিটিং স্কোয়াড দেখাচ্ছিলে, তাই না! এদের কাছে বড়সাহেবের তলব যেন মৃত্যুর পরোয়ানা। সবকটাই তো গিল্টি কনসেন্স বয়ে বেড়াচ্ছে। সব সময়েই তাই দেখছে খাঁড়া বুঝি নেমে এল।
বিমান একটু পরেই ফিরে এসে যেই বললে, সাহেবের সঙ্গে বেরোচ্ছি, আজ আর ফিরব না, সরখেল আর বিকাশের চোখ কপালে উঠল। বিস্ময়ে হতবাক। কী ব্যাপার। সাহেবের আপনার লোক নাকি। কী ভুল করেছি এতদিন। একে তো তাহলে সমীহ করা উচিত ছিল। সরখেলের গলার সুরই পালটে গেছে, এ আর বলার কী আছে? সাহেব যখন বলছেন।
আপনি বাজেট দেখাচ্ছিলেন তো, সেই কথাই বললুম। বিকাশের কথাও বললুম। দুজনের মুখই চুপসে গেছে।
কী বললেন? কেন বলতে গেলেন?
একটা কথাই বললেন, আই উইল সি। বিমান ভয়ের একটা আবরণ তৈরি করে দিয়ে চলে গেল।
তিনটে পনেরো। ইলা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কচি কলাপাতা রঙের শাড়িতে পশ্চিমের রোদ।
ইলা যেন রাস্তা আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। থিয়েটার রোড পেরিয়ে গাড়ি বাঁ-দিকে দাঁড়াল।
এসেছেন? যাকে চাইছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই তো দাঁড়িয়ে।
ভেরি গুড। কোয়াইট চার্মিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং, পরে একদিন আলাপ করব। উইশ ইউ লাক।
বিমানকে রেখে গাড়ি ডানদিকে সরে গিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল।
ইলা অবাক। কী ব্যাপার, ময়ূরপঙ্খী থেকে নামলে! বিমান বললে, একদিন তো তোমার বাড়ির সামনে নামতে হবে। আজ তোমার সামনে নেমে মহড়া দিলুম। ইলা বেশ খুশি হল। বিমান। বললে, বড়কর্তার গাড়ি। তোমার সঙ্গে এনগেজমেন্ট শুনে লিফট দিয়ে গেলেন। তোমাকে পাকা দেখাও হল। পছন্দ। বললেন, চার্মিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং।
ইলা বলল, উনি পাকা দেখার কে? বরপক্ষ নাকি?
অফকোর্স। আমার চাকরিদাতা। বেকার থেকে সাকার করেছেন। ইচ্ছে করলে আমাকে কত কী করে দিতে পারেন। হি ইজ মাই ব্রেড অ্যান্ড বাটার ডিয়ার।
বুঝেছি। চলো এখন কোথাও বসা যাক।
কোথায় যাবে বলো?
মাঠে-ময়দানে যেখানে খুশি। তোমার সঙ্গে জাহান্নামেও যেতে পারি।
ইলা আজ যত্ন করে সেজেছে। সন্ধে আর রাত্রির কিছু অংশ সে বিমানের সঙ্গে কাটাবার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছে। বিমানের মন বাড়ির দিকে পড়ে আছে। চিত্রা ফোন করেছিল বাবা অসুস্থ। অসুস্থ অনেকদিনই, আজ একটু বেড়েছে। এদিকে খোলা ময়দান, ভিক্টোরিয়া, ইলা আর যৌবন। আকর্ষণ এদিকেও কিছু কম নয়। একদিকে, কর্তব্য, রক্তের টান। আর একদিকে হৃদয়ের টান, আবেগের টান, আগুনের টান। দুটো আকর্ষণের টানে বিমান যেন উদাস। মনে হচ্ছে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে তার মনের বাইরে। বিমান যেন সুদূরে বসে লক্ষ করছে বিমানের চালচলন। বিমান দু-খণ্ড হয়ে গেছে।
ভিক্টোরিয়ার রেস্তোরাঁয় দুজনে দু-কাপ কফি খেয়ে নিল। কফি খেতে খেতে বিমানের মনে হল একবার বলে, ইলা আজ এই পর্যন্ত থাক। মনটা পড়ে আছে বাড়ির দিকে। মন ছাড়া দেহ নিয়ে পুতুলের মতো তোমার সঙ্গে ঘুরে মুহূর্তগুলো কেন অপচয় করি। বিমান কিছু বলার আগেই ইলা বললে, আমি যেদিনই আসি তুমি কেমন গম্ভীর আর উদাসীন হয়ে যাও। আমাকে ভালো না লাগলে স্পষ্ট করে বলে দিলেই পারো।
বিমান প্রাণ খুলে হাসার চেষ্টা করল, জানো, সাইলেন্স ইজ সামটাইম গোল্ডেন। অনুভূতির একটা জায়গায় ভাষা আর পোঁছোতে পারে না। আমরা এখন সেই জায়গায় আছি। ভাষাহীন নীরবতায় দুটো প্রাণের যোগাযোগ।
ইলা বোঝে। তার মন বোঝে কিন্তু দেহ যে বোঝে না। সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে চায়। উত্তাপে সে মোমের মতো, আইসক্রিমের মতো গলে যেতে চায়, জ্বলে যেতে চায় শুকনো পাতার মতো। বিমানকে সে দিতে চায়। সে শিকার হতে চায়। এমন কোনও নিভৃত জায়গা তারা আবিষ্কার করতে পারেনি যেখানে দেহের পাওনা বুঝে নেওয়া যায়। বিমান এসব ব্যাপারে বড় পিউরিটান। ছিচকে চুরি তার পোয় না। পার্কে, ট্যাক্সিতে, পরদাঢাকা রিকশায়, রেস্তোরাঁর কেবিনে পাশাপাশি ঘেষাঘেষি বসে জানুতে নিতম্বে কিংবা অন্য কোথাও তার আবেগকে খেলো করতে চায় না। তার অপেক্ষা আছে, বাঁধন আছে, তার একটা স্বতন্ত্র আভিজাত্য আছে। ইলারও আছে। তবে ইলা একটু বেশি সাহসী। মাঝে মাঝে বিদ্রোহী।
ভিক্টোরিয়ার বাইরে এসে ইলা বললে, চলোনা, আজ প্ল্যানেটোরিয়ামে যাই।
স্পষ্টতই ইলা আজ ছটফট করছে। অন্ধকার তারামণ্ডলে সে নিশ্চয়ই তারা দেখতে চায় না। অন্ধকারে সে বিমানকে কাছে পেতে চায়। কী বলবে বিমান? হ্যাঁ বলবে না না বলবে? শেষে ইলাই আবার বিকল্প প্রস্তাব দিল, তার চেয়ে চলো ট্যাক্সি করে একটু ঘুরে আসি, আজ আমার খরচ। বিমান আর ইলা হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে। বিমানের কেবলই বাড়ির কথা মনে। পড়ছে। অদৃশ্য একটা হাত যেন তাকে বাড়ির দিকে টানছে।
এখন ট্যাক্সি পাওয়া দুরূহ হলেও এই অঞ্চলে এক জোড়া তরুণ-তরুণীর জন্যে ট্যাক্সিদের মমতা আছেমিটার ছাড়া রোজগারের লোভে। ড্রাইভার জানে তাকে কিছুক্ষণ দেখেও দেখছি না, শুনেও শুনছি না এই ভাব করে বসে থাকতে হবে। আর তার পিঠের দিকে দুটি প্রাণী কিঞ্চিৎ জড়াজড়ি করবে, হাসবে, খেলবে, মাঝে মাঝে পরিবেশ ভুলে যাবে। তাদের চোখের সামনে চালক ঝাপসা হয়ে যাবে। তার নিজেরও বাড়তি আনন্দ। সময় সময় তার নিজের কানও গরম হয়ে উঠবে।
ইলা আজ খুশিতে চঞ্চল। দু-মাস পরে তার পাশেবিমান। ফর্সা টকটকে চেহারা। উঁচু নাক। টানা টানা চোখে প্রথম উষার নির্মলতা। ঝাঁকড়া চুল হাওয়ায় উড়ছে। ইলার সংযম শাসন মানছে না। ভুলে যেতে চাইছে সে একজন শিক্ষিকা। কবে তুমি ঘরে তুলে নেবে। রজনীগন্ধার মালা ঝোলাবে। তিনটে বছর গেছে, আরও কত বছর যাবে। দাঁতের গর্ত আরও বড় হবে। জীবন যে বড় চঞ্চল বিমান। আর একটু কাছে সরে এসো। সূর্য অনেক আগে অস্ত গেছে। আলোর বিন্দু উলটো দিকে ছুটে চলেছে। ছুটছে মানুষ। কেউ দেখছে না আমাদের। মানুষ আর এসব দেখে না। জীবনের এ একটা অপরিহার্য অবস্থা। প্লিজ আর একটু কাছে এসো। মুহূর্ত বড় তাড়াতাড়ি অতীত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ বড় দ্রুত হেঁটে আসছে। প্লিজ তোমার হাতটা এইখানে এইভাবে রাখো। অনেকদিনের অব্যবহৃত পালঙ্কের মতো আমার সারা শরীর তোমার ভারে শব্দ করে উঠুক।
বিমান বলছে, আমি যে বিকাশ হতে পারব না ইলা। সে তোমাকে ডায়মন্ডহারবারে নিয়ে গিয়ে চোখে দেখতে চেয়েছিল। আমার এটা যে টেস্ট-কেস নয়। আমি ধরতে জানি, ছাড়তে জানি না। তুমি আর একটু ধৈর্য ধরো। মানুষ কত অসীম ধৈর্য নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে, কত ক্লেশ স্বীকার করে একটা জীবনের জন্ম হয়। তুমি আর একটু ধৈর্য ধরতে পারবে না নতুন জীবনের জন্যে? ধৈর্য একটা অভ্যাস। সে অভ্যাসটা হারিয়ে ফেললে তুমি মাতাল হয়ে যাবে।
বিমান কথা বলছে, অল্প অল্প অংশও নিচ্ছে হয়তো কিন্তু তার মনের বিশাল একটা অংশ অকেজো হয়ে আছে। মনের সামান্য একটা অংশে সে ইলাকে রেখেছে। সারা মনে ছড়িয়ে যেতে দেয়নি। বাইরের ঘরে অতিথির মতো বসিয়ে রেখেছে। পুরো মনটাকে চালু করে দিলে বিমান। আর এক মুহূর্তও ইলাকে সঙ্গ দিতে পারবে না, ছুটবে বাড়ির দিকে। চিত্রা ফোন করেছিল, বাবার খুব বাড়াবাড়ি।
ট্যাক্সি ম্যারিন হাউসকে বাঁয়ে রেখে আলিপুরের দিকে বাঁক নিয়েছে। ইলার নির্দেশে গাড়ি চলেছে। যেমন চলেছে বিমান। আজ সুন্দর সেজেছে। বড় খোঁপা, কাজল টানা চোখ। শরীরের ত্বক তেলতেলে মসৃণ। ওপর বাহুতে হাত রেখেছিল—ধোয়া মার্বেলের মতো শীতল। প্রসাধনের হালকা গন্ধ। এই তো এই মুহূর্তে জীবন কত সুন্দর। এখন তাদের বাঁচবার বয়েস অথচ হরিদাসবাবুর কী নিদারুণ শ্বাসকষ্ট। ইলার ফর্সা চওড়া বুকের ওপর পেন্ডেন্টের একটা লাল। পাথরে আলো পড়ে চকচক করে উঠছে। বিমানের মনে হচ্ছে জেড-এর পানপাত্র থেকে অমনই উজ্জ্বল লাল পানীয় পান করে সে খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, আমি বিমান, আমি স্বয়ম্ভু, আমি দাস নই। আমি প্রভু, আমি ঘটনার প্রভু, আমি সময়ের প্রভু, পরিস্থিতি, পরিবেশের প্রভু। সব কিছু আমার হাতের মুঠোয়। আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, তারপর তলিয়ে যায় পাশে বসা নারী শরীরের কোমল জ্বণের ডিম্বাধারের জেলিতে।
বিমান হঠাৎ উপলব্ধি করল, সে মোটেই প্রভু নয়, দাস। মানুষ কখনও প্রকৃত প্রভু হতে পারবে না। পারলে বিমান এই রকম স্থাণুর মতো ইলার পাশে বসে থাকত না। ইলার হাত থেকে নিজের ডান হাতটা মুক্ত করে, এই রোককে বলে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে সে বাড়ির দিকে ছুটত। ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা যদি তার থাকত তাহলে ইলা ফোন করবার পরই চিত্রার ফোন। আসত না। এ হরিদাসবাবুর ষড়যন্ত্র নয়, অদৃশ্য কোনও শক্তির খেলা। যুগ যুগ ধরে মানুষ যাকে বলে আসছে নিয়তি। সেই নিয়তি বিমানকে আজকের এই সন্ধ্যাটা পুরোপুরি ভোগ করতে দিলে না। পাথরের মূর্তির মতো বিমানকে বসিয়ে রেখেছে ইলার উষ্ণ সান্নিধ্যে। ইলা আজ মুডে আছে, তা না হলে লক্ষ করত তার একতরফা আদরে বিমানের অংশ কত কম! তবুও সে সুখী। বিমানের বুকের কাছে তার মাথা। গাড়ি ছুটছে হু-হু করে। হাওয়ায় একটা-দুটো আলগা চুল উড়ে বিমানের মুখে চোখে লাগছে। শরীরের ঘ্রাণ।
অবশেষে সময় একটা মাইল পোস্টে এসে বিমানকে মুক্তি দিল। আর পারছিনা বিমান, এইবার যা হয় একটা কিছু করো বলে ইলা বিদায় নিয়েছে। ভরা রাতের আকাশ মাথার ওপর থমকে আছে। বিমান ছুটছে বাড়িমুখো। চিত্রা শক্ত মেয়ে। বিশেষ ভয়ের কিছু না থাকলে সে ফোন করত না। বিমান মুসাম্বি কিনেছে, নরম পাকের সন্দেশ কিনেছে এক বাক্স। অসুস্থ পিতার প্রতি তার কর্তব্য—মুসাম্বি আর সন্দেশের বাক্স! বিচারক বিমানের এজলাসে বিমানের বিচার চলেছে। তিনটের সময় তুমি তো বাড়িমুখো হতে পারতে। তা না করে তুমি কী করে এলে। জানো না তুমি হরিদাসবাবুর অন্নদাস ছিলে বহুদিন। তোমার শরীর কার দান?
বাড়ির সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়। বিমানের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। যা ভেবেছি ঠিক তাই। বিমানকে ঢুকতে দেখে প্রতিবেশীদের মধ্যে কে যেন ব্যঙ্গের গলায় বললেন,—বাবু এসেছেন! আত্মীয়দের মধ্যে থেকে একজন বললেন,—এত দেরি করলে বিমান! ঘরের বাইরে চিত্রা চোখ মুছতে মুছতে বললে, তোকে কখন ফোন করেছি দাদা আর তুই এখন এলি! শুনলাম তুই তিনটের সময় অফিস থেকে বেরিয়েছিস। বিমান অপরাধীর মতো মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফল আর সন্দেশের বাক্স। চিত্রা বলছে, তোর কথা বারবার বলছিলেন। শেষ কথাটা। একবার বললি না। চিত্রা হু-হু করে কাঁদছে। বিমানের মনে হচ্ছে তার ঘুমভাঙা চোখের সামনে যেন ভীষণ চড়া পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে, সব যেন ভীষণ ঝলসানো সাদা। কারুর মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না। কেবল কিছু শব্দ শুনছে। তাও যেন বহু দূর থেকে।
বয়স্ক কে একজন বলছেন, তুমি তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে নাও। কী মুশকিলে যে ফেলেছিলেন। সেই তিনটেয় বেরিয়েছ। ছি-ছি! সে আর এক ভাবনা। এতক্ষণ লাগে আসতে!
নিজের ঘরে এসে জামা খুলতে গিয়ে বিমান আবিষ্কার করল কাঁধের কাছে একটা লম্বা সোনালি চুল আটকে আছে! কী আশ্চর্য মন! হঠাৎ তার মনে হল ইলাকে আরও কাছাকাছি পাবার সবচেয়ে বড় বাধা সরে গেল। কোনও আপত্তি আর কোনওদিক থেকে আসবে না, কেউ। গুরুগম্ভীর গলায় বলবেন না–না ওসব হবে না, বলে দাও ওকে। জাতে মিলছে না। যদি কিছু করতে চাও এ বাড়ির বাইরে। এখানে তার স্থান হবে না।
চিন্তাটা নিমেষে সরে গেল। চড়া আলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে বিমানের চোখে, সব কিছু তখন
স্পষ্ট। ফুল, খাট, মৃতদেহ, মানুষ। বিমানের চোখের কোল বেয়ে এইবার জল নামছে। এর জন্যেই যেন সে অপেক্ষা করে ছিল!
একটি দুর্ধর্ষ অভিযান
আমি তখন দেওঘরে এক বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতা করি। শীত প্রায় আসব আসব করছে। সকাল সন্ধে হাওয়ায় একটু ঠান্ডার কামড়। শিক্ষক ছাত্র এখানকার নিয়ম অনুসারে সকলেই সকলকে দাদা সম্বোধন করে থাকেন। রবিবার দুপুরে বেশ ভুরিভোজ হয়েছে। এইবার একটু গড়াগড়ি দিতে পারলেই হয়। এমন সময় একটা টাঙা রোদ ঝলমলে মাঠ পেরিয়ে আমাদের শিক্ষকাবাসের সামনে এসে দাঁড়াল। সংগীতশিক্ষক তুলসীদা লম্বা ছিপছিপে গৌরবর্ণ মানুষ, একেবারে ধোপদুরস্ত হয়ে এসে আমাদের ঘাড় ধরেই প্রায় বিছানা থেকে তুলে দিলেন। আজ ত্রিকূট দর্শন করতেই হবে।
তুলসীদার কৃপায় আজ আমরা ত্রিকূটযাত্রী। সঙ্গে গেম টিচার বিদ্যুৎদা আর ইংরেজি শিক্ষক সুধাংশুদা। তুলসীদা আর সুধাংশুদা সমবয়সি। আমাদের দুজনের চেয়ে বয়সে বড়। তুলসীদার গলায় মাফলার। গাইয়েদের গলার অদৃশ্য শত্রু অনেক। বারোমাসই মাফলার দিয়ে প্যাক করে রাখতে হয়। নাদব্রহ্মে। তিনি নাভির কাছ থেকে বায়ু পিত্ত কফ ভেদ করে উঠে আসেন কণ্ঠে। তুলসীদার ডোল ডায়েটে স্টার্চ কম, প্রোটিন বেশি, এক কেজি বিদ্যাপীঠের বাগানের পেঁপে, দুটো মাঝারি সাইজের পেয়ারা আর সকালে আধহাত নিম দাঁতন কমপালসারি। চেহারাটি। একেবারে কঞ্চিকা মাফিক। বিদ্যুৎদা বারবেল সাধেন, বাইসেপ, ট্রাইসেপ, ডেলটয়েড সবই বেশ খেলে। খেলে না শুধু কোলন। ইসবগুল, দু-কেজি পালঙের সুরুয়া সবই ফেল করেছে। মাংসের জুসটি খান, মাংস ফেলে দিন—এই তাঁর উপদেশ। দুশ্চিন্তা একটাই, চুলে সাদা ছিট। ধরেছে আর উঠে যাচ্ছে। অন্যথায় স্বাস্থ্যবান। সুপুরুষ সুধাংশুদার সমস্যা একটাই। ভুঁড়িটা আর কত বাড়তে পারে তিনি দেখতে চান। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে প্রকৃতই উদার। বিদ্যুৎদার মতে এই উদারতা সব উদরে গিয়ে জমছে। সুধাংশুদার মস্ত বড় গুণ ধীর, স্থির, মেজাজটি অদ্ভুত ঠান্ডা এবং বেশিক্ষণ তিনি জেগে থাকতে পারেন না। এই তো কোলের উপর উঁড়িটি নিয়ে আয়েস করে বসে আছেন। মুদিত নয়ন। নাসিকায় গর্জন। আমাদের রসিকতা তাঁর শরীরের চর্বির স্তর ভেদ করতেই পারে না। তুলসীদা নাকি ৬৫ সালে একটা গন্ডারকে সুড়সুড়ি দিয়েছিলেন, রিপোর্ট, সেটা ৬৭ সালে হেসে উঠেছিল।
তিনটে নাগাদ আমরা ত্রিকূটের পাদদেশে। তুলসীদার ফ্লাস্কে চা। এক চুমুক করে হল। সুধাংশুদা ঘাড় বেঁকিয়ে পাহাড়ের মাথাটা একবার দেখবার চেষ্টা করে বললেন, ইমপসিবল, ওনলি এ গোট ক্যান ক্লাইম্ব দিস হিল। তুলসীদা বললেন, রাখুন মশাই আপনার ইংরেজি। ভাষাটা জানি না বলে যা খুশি তাই গালাগালি দেবেন! বিদ্যুৎদা বললেন, বিদ্যাপীঠের ডাক্তারবাবু কী বলেছেন মনে। নেই? পূর্ণকুম্ভের মতো আপনি এখন পূর্ণগর্ভ। আরোহণ এবং অবরোহণ আপনার একমাত্র ওষুধ। ওসব চালাকি চলবে না। চলুন।
সুধাংশুদার প্রতিবাদ, কাকুতি-মিনতি, কে শুনবে। পর্বতশীর্ষে সুধাংশুদাকে আমরা ভোলানাথের মতো প্রতিষ্ঠিত করবই। প্রতিজ্ঞা ইজ প্রতিজ্ঞা।
ত্রিকূট খুব সহজ পাহাড় নয়। উঠতে গিয়েই মালুম হল। কাঁকরে পা স্লিপ করে। আঁকড়ে ধরার মতো কিছুই নেই, একমাত্র নিজের প্রাণটি ছাড়া। পাশেই খাদ। পড়লে চিরশান্তি! পাহাড়েই প্রেতাত্মা হয়ে আটকে থাকতে হবে। ভ্যানগার্ড তুলসীদা, রিয়ারগার্ড বিদ্যুৎদা। মাঝে আমি আর সুধাংশুদা। সুধাংশুদা বললেন, এই প্রথম বুঝলুম ভুঁড়ির ওজন কত। বেশ ভারী মশাই। আগে। ভাবতুম মাস উইদাউট ওয়েট, এখন দেখছি উইথ ওয়েট।
একটা চাতাল মতো জায়গা পাওয়া গেল। একটু বসে, বাকি চা-টা শেষ করতে হয়। একটু প্রকৃতি দর্শন না করলে পর্বতপ্রেম আসে কী করে! সুধাংশুদা বললেন, ভাই, আমার উপর আর টর্চার। কোরো না, তোমরা আমার ছেলের মতো। আমি এখানে বসি, তোমরা নামার সময় আমাকে নিয়ে যেয়ো। একটা রফা হল। আর একটু উঠলেই রাবণ গুহা। গুহা দর্শন করে আমরা নেমে যাব। আরে মশাই শরীর আগে না মাইথোলজি আগে? রাবণের রেলিক্স না দেখে চলে যাবেন? তুলসীদার অনুপ্রেরণায় হাতের ওপর ভর দিয়ে সুধাংশুদা শরীরটাকে ওঠালেন। গুহা দেখলেই ভয় ভয় করে। গুহার অন্তর্নিহিত সত্য সহজে জানা যায় না। কী যে মালমশলা ঘাপটি মেরে ভেতরে বসে আছে একমাত্র ঋষিরাই বলতে পারেন। মুখটা বিশাল। দুদিকে পাথরের দেয়াল। একটু যেন টেপারি হয়ে গেছে। আমাদের কনভয়ের সেই আগের অর্ডার। প্রথমে তুলসীদা, পাথ ফাইন্ডার, হাতে টর্চ। নেকস্ট সুধাংশুদা, তারপর আমি, তারপর বিদ্যুৎদা। তুলসীদা বললেন, ব্যা যদি থাকে আগে আমাকে খাবে। সুধাংশুদা বললেন, অ্যাম নট শিওর! খাদ্যের ব্যাপারে ওরা ভীষণ সিলেকটিভ, বোনস ওরা চিবোয় ঠিকই তবে ফ্লেশটাই আগে চায়।কথা বলতে। বলতে বেশ কিছুটা ঢুকে গেছি। এইবার সেই জায়গাটা দুই পাথরের দেয়াল চেপে এসেছে। তুলসীদা কাত হয়ে এগিয়ে গেলেন। সুধাংশুদাও তাই করলেন! কেবল একটু মিস ক্যালকুলেশান। এ কী হল! সুধাংশুদার গলা! আর তো যাচ্ছে না, মরেছে! কী যাচ্ছে না? আমরা এপাশের দুজন সমস্যাটা বুঝতেই পারিনি। সুধাংশুদা বললেন, আমি যাচ্ছি না। দাঁড়িয়ে থাকলে যাবেন কী করে? চলার চেষ্টা করুন। সুধাংশুদা বললেন, প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে খুঁড়িটা আটকে গেছে ডাইসের মতো। আমরা চিৎকার করলুম, তুলসীদা। দূর থেকে উত্তর এল। সুধাংশুদার ভুঁড়ি আটকে গেছে!
শেওলা ধরা দেয়াল, ভুড়ি তার গেঞ্জি আর আদ্দির পাঞ্জাবির কভার নিয়ে দুটো পাথরের মাঝখানে জম্পেশ! প্রথমে কিছুক্ষণ কমনসেন্সের খেলা চলল—নিশ্বাস খালি করে পেট কমান। দেখা গেল, এ পেট সে পেট নয়। নিশ্বাসের সঙ্গে বাড়া-কমার কোনও সম্পর্ক নেই। সন্ধের মুখে আবার উদরে বায়ুর সঞ্চার হয়। আপনার নিজের পেট নিজের কন্ট্রোলে নেই? একটু নামাতে পারছেন না? তুলসীদা সুধাংশুদার অক্ষমতায় খুব অসন্তুষ্ট। কী করি বলুন, কমছেনা যে! সুধাংশুদা হেল্পলেস। বিদ্যুৎ, তোমরা ওদিক থেকে টেনে দেখো, আমিও এদিক থেকে ঠেলে দেখি। আউর থোড়া, হেঁইও, বয়লট ফাটে, হেঁইও। এক ইঞ্চিও নড়ানো গেল না। মোক্ষম আটকেছেন মশাই! কী করে আটকালেন একেবারে নিরেট থাম! আপনি কি রাবণের চেয়ে দশাসই। অতবড় একটা রাক্ষস স্যাঁট স্যাঁট করে গলে যেত। আর আপনি সামান্য একজন মানুষ আটকে গেলেন!
রাবণের ফিজিওলজি নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা হল। সুধাংশুবাবু বললেন, তার মশাই নানারকম মায়া জানা ছিল। এইখানটায় এলে হয়তো মাছি হয়ে যেত। বিদ্যুৎদা বললেন, ধুর মশাই! তবু। নিজের দোষ স্বীকার করবেন না! ব্যায়াম, ব্যায়াম। রাবণ মুগুর ভাঁজতেন। পাঁচ হাজার ডন, দশ হাজার বৈঠক ডেলি। আর রাক্ষস হলেও রাক্ষুসে খাওয়া ছিল না আপনার মতো। কোনও ছবিতে রাবণের হুঁড়ি দেখেছেন? অন্য সময় হলে তর্কাতর্কি হত। বিপন্ন সুধাংশুদা রাবণের ওপর লেটেস্ট রিসার্চ অম্লানবদনে মেনে নিলেন।
আচ্ছা এখন তাহলে কাতুকুতু দিয়ে দেখা যাক। নিন হাত তুলুন। প্রথমে বিদ্যুৎদা! কোথায় কী? খ্যাত খ্যাত করে হেসে উঠলে উঁড়িটা হয়তো ধড়ফড় করে উঠত, সেই সময় মোক্ষম ঠ্যালা। আমি বললুম, দাঁড়ান, ওভাবে ডিরেক্ট কাতুকুতুতে হবে না। টেকনিক আছে। দেখি হাতের। তালুটা। এই নিন, ভাত দি, ডাল দি, তরকারি দি, মাছ দি, নিন মুঠো করুন, মুঠো খুলুন, যাঃ কে খেয়ে গেল অ্যাাঁ, ধর মিনিকে, কাতুকুতু। কোথায় হাসি? না মশাই হবে না। আপনি এখানেই থাকুন ফসিল হয়ে। অপঘাতে মৃত্যু লেখা আছে কে খণ্ডাবে! তুলসীদা বললেন, আহা! আমি কী শুনব সতী সাধ্বী স্ত্রী, যে সহমরণে যাবে? এই মালকে ক্লিয়ার না করলে, এ দিকে তো ট্রাফিক জ্যাম হয়ে গেছে। আপনি হামাগুড়ি দিয়ে চলে আসুন। কাপড়ে শ্যাওলা লেগে যাবে যে! বিদ্যুৎদা বললেন, জীবন আগে না কাপড় আগে? তুলসীদা অবশেষে হামাগুড়ি দিয়ে চলে এলেন আমাদের দিকে।
বসার চেষ্টা করে দেখুন তো। সুধাংশুদাকে যা বলা হচ্ছে, প্রাণের দায়ে তাই তিনি বাধ্য ছেলের মতো করছেন। বসার চেষ্টা করলেন, হল না! আমরা বললুম, একটু জল ত্যাগ করুন তো, যদি পেটটা কমে। না, মরে গেলেও তিনি এই কাজটি করতে রাজি হলেন না। এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে। তুলসীদা বললেন, টাঙ্গাওলা চলে গেলে ফেরার দফারফা। টর্চ জ্বেলে তুলসীদা একবার ভুড়িটার ইনসপেকশান করে বললেন, বিদ্যুৎ এদিকে এসো। ছুরি আছে? আমার পকেটে ছুরি ছিল। ছুরি কী হবে তুলসীদা? সুধাংশুদা একটু সিঁটিয়ে গেলেন। কাজ হয়েছে। তুলসীদা ফ্লাস্ক-এর ওপর থেকে খানিকটা চা ঢাললেন জয় বাবা বন্দি বিশালা। একটু লুব্রিকেট করে দিলুম। এবার মারো টান। আমরা চারজনেই জড়াজড়ি করে পড়লুম। সুধাংশুদার ভূঁড়ির ওপরে নুনছাল একটু উঠে গেছে। পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। ভুঁড়িটা সম্পর্ণ অনাবৃত। চা আর শ্যাওলার পেস্ট মাখানো। বৃদ্ধ বয়সে গায়ে হলুদ।
টাঙ্গা যখন বিদ্যাপীঠে প্রবেশ করল, রাত হয়ে গেছে। নামার আগে পুনর্জীবনপ্রাপ্ত সুধাংশুদার একটিই খালি কাতর মিনতি—ভাই, দয়া করে ছাত্রদের বোলো না। বৃদ্ধ বয়সে চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে। তবু এমন ঘটনা চেষ্টা করলেও চেপে রাখা যায় না। রাষ্ট্র হয়ে পড়বেই।
একটি মেয়ের আত্মকাহিনি
চাঁদের আলোয় তেপান্তরের মতো একটা মাঠ। মাঠের মাঝখানে তেলমাখা একটা তাগড়া ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। চেস্টনাট ব্রাউন তার রং। চামরের মতো লেজ দোলাচ্ছে। ওই ঘোড়াটাকে ধরতে হবে। পিচ্ছিল পিঠে চেপে বসতে হবে। ঘোড়াটা দিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটবে। চেষ্টা করবে ফেলে দিতে। তোমার কসরতটা হবে, চেপে থাকা। পড়ে গেলে তুমি তোমার সার্কিটের বাইরে চলে গেলে। পৃথিবীটা এখন রেসের মাঠ। সকলেই জকি।
দীপার বাবা পয়সাঅলা লোক। জাহাজের মাল খালাসের কারবার, স্টিভেডার। বেহালার দিকে বৃহৎ বাগানবাড়ি। তিনপুরুষের ব্যবসা। বেশ থকথকে পয়সায় ডুবে আছেন। পয়সাও এক। ধরনের পাঁক। একমাত্র মেয়ে দীপাকে রেখে মা মারা গেছেন। দীপা বড় হয়েছে একটা ভয়ের পরিবেশে। তার বাবা, কাকা, জ্যাঠামশাই সব দৈত্যের মতো দেখতে। কংস, দুর্যোধন, দুঃশাসন। দীপার সেইরকমই মনে হত। হাঁউ হাঁউ করে কথা। গগন ফাটানো হাসি। গপ গপ করে খাওয়া। এক-একজন এক এক কেজি মাংস খেয়ে ফেলতেন। দাঁতে হাড় ভাঙতেন মটমট করে। মজ্জাটা চুষে নিতেন স্যুৎ স্যুৎ শব্দে। মনে হত, তিনটে রাক্ষস পাশাপাশি খেতে বসেছে। চিৎকার করে বলতেন, ভাত দিয়ে যাও। লে আও ঝোল। থলথলে হুঁড়ি। বাড়িতে সকলেই চেক চেক লুঙ্গি পরতেন। কাঁধ কাটা গেঞ্জি। মোটা মোটা হাতে বড় বড় লোম। ঢেলা ঢেলা চোখ। চোখের কোলে পাউচ। রাতের দিকে সব মদ্যপান করতেন। নেশা হলে দীপার কাকাবাবু। নিজেকে খুব অপরাধী ভাবতেন। যে সামনে আসত তাকেই বলতেন, পা থেকে জুতো খুলে। আমাকে প্যাঁদাও। আমি কী করেছি জানিস! প্রশ্নটা করার পরেই একটা অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স হত। সবাই যখন ভাবছে, না জানি কত কী পাপের ফিরিস্তি বেরিয়ে আসবে, কাকা কান্না জড়ানো গলায়। বলে উঠতেন, আমি কি করিনি। কারুর জন্যে কিস্যু করিনি। করবও না কোনওদিন। প্যাঁদাও, শালাকে উত্তম-মধ্যম প্যাঁদাও, জুতিয়ে খাল খিঁচে নাও।
ঠিক সেই মুহূর্তে জ্যাঠামশাই নেশার ঘোরে বলতেন, ইশ, নাদুটা সব সিক্রেট আউট করে দিলে। মুকুজ্যে পরিবারের মানসম্মান আর কিছুই রইল না। আমার ঘোড়াটা নিয়ে আয়। বিশ্বাসঘাতকটার বুকে বুলেট চালাই। মীরজাফর, মীরজাফর।
দীপার বাবা নেশার ঘোরে হয়ে যেতেন চিফ জাস্টিস, ক্যালকাটা হাইকোর্ট। তিনি খুব গম্ভীর গলায় বার বার বলতেন, সাইলেন্স, সাইলেন্স। দিস ইজ কনটেম্পট অফ দি কোর্ট। টার্ন দেম আউট, টার্ন দেম আউট। নাদু উইল বি হ্যাঙ্গড টিল ডেথ।
দীপার ঠাকুরদা বেঁচে ছিলেন। যথেষ্ট বয়েস। প্রায় অথর্ব। একটা ঘরে শুয়ে শুয়েই দিন কাটাতেন। সেবার জন্যে একজন নার্স ছিলেন। বেশ স্বাস্থ্যবতী। মুখটা ছিল মঙ্গোলিয়ান ধাঁচের। মহিলা দীপাকেও খুব ভালোবাসতেন। ঠাকুরদা মাতালদের এই হট্টগোলের সময় কেবলই বলতেন, সন্ধের আর কত দেরি?
রাত আটটা সাড়ে আটটার পর দীপা ভয়ে কুঁকড়ে যেত। চেনা মানুষগুলো সব অচেনা হয়ে যেত। রান্নাঘরে দুজন রাঁধুনি ভালোমন্দ রাঁধছে। রান্নার গন্ধে বাড়ি ভাসছে। কাজের লোকেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঘুরছে। নানারকম ভাজাভুজি নিয়ে মদের আসরের দিকে ছুটছে। সেখানে দু-চারজন। বাইরের লোকও থাকত। বাবুদের পেয়ারের বন্ধু, মোসায়েবের দল। পরের পয়সায় মদ খাওয়ার জন্য আসত। তাদের মধ্যে একজন নেশার ঘোরে মেয়েদের মতো ঘুরে ঘুরে নাচত। আর। একজন গম্ভীর গলায় বলত সাধু, সাধু।
বউরা সব ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। এদের পয়সা ছিল। জাহাজের বিদেশি মাল বাড়ি বোঝাই। মানুষকে এরা মানুষ বলেই মনে করত না। দম্ভ ফেটে পড়ত। অভাবী লোকের সঙ্গে। চাকরবাকরের মতো ব্যবহার করত। কথায় কথায় বলত জুতিয়ে লাশ করে দোবো। তিন। ভাইয়ের তিনটে মোটর। বাইরে বেরোবার সাজগোজের কী ঘটা। লোকগুলোকে তখন ভীষণ বোকা বোকা দেখাত। দীপা ছিল নীরব দর্শক। মায়ের কথা তার মনেই পড়ে না। জ্ঞান হওয়ার আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। দীপার মায়ের জন্যে দীপার বাবার কোনও আক্ষেপ ছিল বলে। মনেই হয় না। ভদ্রলোক একমাত্র নিজেকেই ভালোবাসতেন। দীপার জ্যাঠামশাই ওরই মধ্যে কিছুটা সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। দীপার জ্যাঠাইমা ছিলেন বোকাসোকা। তিনিই দীপাকে মানুষ করেছিলেন। মুকুজ্যে পরিবারের বউরা সব অলস ছিলেন। অতিরিক্ত আলস্য ও প্রচুর প্রোটিনজাত খাদ্যে তাঁরা মেদভারে বিপর্যস্ত ছিলেন। পুরুষরা সেইটাই পছন্দ করতেন। এও এক ধরনের বিকৃত রুচি। দীপা বড়ো হয়ে বুঝেছিল, এটাও এক ধরনের ভালগার টেস্ট। বউগুলোকে করে ফেলেছিল জ্যান্ত পাশবালিশ। দীপার মনে হয়েছিল মেয়েরা বন্দি হতে পছন্দ করে। দাসত্বের প্রতি তাদের ভয়ংকর আসক্তি। খাঁচা থাকবে। পুরুষের ভোগের সামগ্রী হবে। এই ভাবটা তাদের সংস্কারে চলে গেছে। মেয়েরা নিজেরাই মনে করে, তারা দেহ ছাড়া কিছুই নয়, ভিতরে একটা মন নড়াচড়া করে ঠিকই, কিন্তু সেই মনটা বিকলাঙ্গ। অন্ধকারে একটা পাখি। ভিতরটা খুব নোংরা। যা-তা বই পড়ে। অশ্লীল আলোচনা করে। কাজের মেয়েদের সঙ্গে পরের বাড়ির আলোচনা করে। যখনই সুযোগ পায় আজেবাজে সিনেমা দেখতে ছোটে। আর কুৎসিত সাজগোজ করে স্বামীদের সঙ্গে বিয়েবাড়িতে হল্লা করতে ছোটে। সঙ্কীর্ণ মনের মানুষ সব। নিজেদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া করে। তখন মুখের আর কোনও আগল থাকে না। বস্তির ভাষা ব্যবহার করে। স্বামীকে বলে ভাতার। বউগুলো সব মাগি। তখন মুখ-চোখের চেহারা পালটে যায়। আঁচল খসে পড়ে। বিশাল বুক থলথল করে নাচতে থাকে। বৃহৎ নিতম্ব দুলতে থাকে। খোঁপা আলগা হয়ে যায়। গা থেকে একটা পাশবিক গন্ধ বেরোতে থাকে। সমস্ত হিংস্র পশুর সমাহার। মাসের মধ্যে তিন-চার বার দীপা এই দৃশ্য দেখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কাকার উপর রাগ করে একদিন তার কাকিমা তিন বছরের মেয়ের গলা টিপে ধরেছিল। সেই মুহূর্তে তার। কাকিমাকে মনে হয়েছিল মানুষ নয়, পিশাচিনী। ঘটনাটা ঘটেছিল দুপুরে। সেই রাতেই দেখা গেল কাকিমা সেজেগুঁজে, দশ ভরি গয়না চাপিয়ে কাকার সঙ্গে গাড়ি চেপে পার্টিতে যাচ্ছে!
এইসব দেখে দীপার ভয় হত, তার ভবিষ্যৎটা কী হবে! ওই জ্যাঠাইমা, কাকিমার মতো মহিলা। কোনও একটা লোকের বউ। ব্যবসাদার, দালাল অথবা ফোড়ে। অনেক টাকা তার। গদগদ চেহারা। ধামার মতো উঁড়ি। গলগল করে ঘামে। মাংস খেয়ে দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচায়। ফুক ফুক করে ঘরের দেয়ালে কুঁচি ফেলে। বগলের চুলে ঘামে জড়িয়ে থাকা পাউডার। রাতের বেলা বিছানায় জড়িয়ে ধরে। লোমঅলা বুকে মুখ চেপে ধরে। এখানে-ওখানে খামচায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেহভোগ করে। অবাঞ্ছিত সন্তানের মা হতে হয়। দীপা স্বপ্নে দেখত, হাজার হাজার হাত অক্টোপাসের মতো এগিয়ে আসছে। বিশাল, বিকট একটা মুখ, কমলাভোগের মতো দুটো চোখ, শিমপ্যাঞ্জির মতো মোটা দুটো ঠোঁট, নর্দমার মতো নিঃশ্বাস। ছ্যাঁত করে ঘুম ভেঙে যেত। রাতের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে হত আত্মহত্যা করি। বাগানের ঝাঁকড়া গাছে কালপ্যাঁচা ডাকছে। উত্তরের পাঁচিলে হুলো বেড়ালের জৈব চিৎকার।
দীপা ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে আসত। অসুস্থ ঠাকুরদার ঘরে আলো জ্বলছে কম পাওয়ারের। নার্স দিদি ইউরিন্যাল দিচ্ছে। ছ’ফুট লম্বা একটা মানুষের খাঁচা বিছানায় পড়ে আছে। কোনও আব্রু নেই। লজ্জা নেই। ঠাকুরদার যৌবনের ছবিতে কী অহংকার, কী দাপট! ইউরোপিয়ান। পোশাক। নিষ্ঠুর দুটো চোখ, বাজপাখির মতো। শিকারের শখ ছিল। রাইফেল ছিল। বহুবার। বিলেত গিয়েছিলেন। তিন ছেলে ও তিন মেয়ের জন্মদাতা। সেই মানুষটার কী অবস্থা! ছেলেরা ফিরেও তাকায় না, বউরা মাঝেমধ্যে আসে। সমস্ত দায়িত্ব ওই নার্সের।
দীপা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে যায় ঘরে। বয়সের তুলনায় তার চিন্তাটা ছিল অনেক পাকা। শরীরে সব লক্ষণই সুস্পষ্ট। রাতে কোনও কোনও দিন নার্সদিদি তার পাশে এসে শুত। আদর। করে জড়িয়ে ধরত। তখন দীপার মনে হত শরীরের কোনও একটা স্তরে কিছু একটা ঘটছে, যার অনুভূতিটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। এই অনুভূতির মধ্যেই আছে নেশা, আছে শৃঙ্খল। একসময় দীপা নিজেকে সমর্পণ করে দিত তার হাতে। তখন অতটা বুঝত না, ব্যাপারটা কী হচ্ছে। এখন বোঝে। বুঝে আরও ভয় পেয়ে যায়। মানুষের স্বভাবে কী আছে কেউ বলতে পারে না। একটা। গুহা আছে ভিতরে। বসে আছে প্রবণতা। আকর্ষণ এত প্রবল, অপেক্ষা করার উপায় নেই। দীপা উন্মুখ হয়ে থাকত। কখন সে আসবে। তার একটা পাপবোধ। একটা অসুস্থতা। না জানার ভান; কিন্তু ভীষণ উপভোগ্য। যে রাতে ঠাকুরদা একটুও ঘুমোতেন না, সারাক্ষণ নার্সদিদিকে ওইখানেই ব্যস্ত থাকতে হত, দীপা রেগে যেত। অসুস্থ মানুষের কষ্টটা তার কাছে কিছুই নয়। নিজের সুখটাই বড়। এইটাই পৃথিবীর চরম সত্য। আমি আমি, তুমি তুমি। বাকিটা অভিনয়। লোকলজ্জা। বুদ্ধিমান মানুষ সেই কারণেই কিছু অনুশাসন তৈরি করে রেখেছে। কিছু কর্তব্য। ভাব, ভাবনাহীন কিছু করণীয় কাজ।
ওই বাড়িতে আরও কিছুকাল থাকলে দীপার কী হত এখন আর বলা যায় না। ঘটনাই ভাগ্য। দীপার বাবা ওই সময় এক চিত্রাভিনেত্রীর খপ্পরে পড়লেন। মহিলা তিন-চারটে বাংলা ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। প্রথমটা হিট করেছিল। মহিলার দেহ ছিল। কোনও এক পার্টিতে দীপার বাবার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সেই মহিলার। দীপার মায়ের মৃত্যুর পর দীপার বাবা একটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলেন। সকালে উঠে টুথব্রাশ হারিয়ে গেলে যে অসুবিধে হয় অনেকটা সেইরকম। সুধন্যবাবু আর একটা অ্যাঙ্গুলার টুথব্রাশ পেয়ে গেলেন, তবে দামটা একটু বেশি। ছাপ মারা নায়িকা। শহরের দেয়ালে যার ছবি সাঁটা থাকে।
দু-ধরনের পুরুষ আছে—এক হিসেবি লম্পট, আর এক বেহিসেবি লম্পট। সব পুরুষই লম্পট যেমন সব কিশোরীই লেসবিয়ান। উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, আধুনিক মনস্তাত্বিকদের এইটাই বক্তব্য। মানুষের কাণ্ডকারখানা দেখে তাঁরা অন্য কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না বলে। মানবজাতির কাছে ক্ষমা চাইছেন। সুধন্য মুখার্জি ছাগলের মাংস ভয়ংকর ভালোবাসতেন, সেই কারণে বুদ্ধিটাও হয়ে গিয়েছিল ছাগলের মতো। মানুষ তো এমনিই নাচের পুতুল, অদৃশ্য দড়ির টানে সারাজীবন হাত-পা ছোঁড়ে, এর সঙ্গে যোগ হল এক খেলোয়াড় মহিলা। ডবল ডিমের। ওমলেটের মতো ডবল নিয়তি। বোকা-লম্পটদের মেয়েরা সহজেই চিনতে পারে। এই একটু গায়ে গা লাগিয়ে বসা, চোখের ভঙ্গি করা, শরীরের ঝলক দেখানো, মাঝেমধ্যে হাসতে হাসতে গায়ে ঢলে পড়া—এইজাতীয় কিছু প্রাচীন টোটকাই যথেষ্ট। লোকটা একেবারে পোষা কুকুর। পটাপট ল্যাজ নাড়বে। সুধন্যর ব্রেনের একটা অংশ অকেজো হয়ে গেল। অদ্ভুত একটা ইউফোবিয়া তৈরি হল। পৃথিবীটা হল নারীদেহ। মানুষ তার শৈশবটা কোনওরকমে পেরোতে পারলেই হয়ে গেল। তারপর স্রেফ নারী সম্ভোগ। প্রেম কাকে বলে, কবিতায় আছে, না সাহিত্যে আছে, ফুলে আছে না ফলে আছে ইত্যাদি গবেষণার প্রয়োজন নেই। লেগে থাকো, জড়িয়ে থাকো, নিমজ্জিত হয়ে যাও। অজগরের মতো গিলে ফেলুক তোমাকে। পৃথিবীকে ঘোরাচ্ছে কোনও শক্তি, কামিনী আর কাঞ্চন। সেই অভিনেত্রীর নাম ছিল রমলা। তাঁর জীবনকাহিনি একটু ঘোলাটে মতো ছিল। মা ছিলেন থিয়েটারের অভিনেত্রী। খুব দাপট ছিল। ইংরেজিটা ভালো জানতেন। সেকালের এক বিখ্যাত নটের বিপরীতে অভিনয় করতেন কলকাতার এক নামকরা মঞ্চে। শেক্সপিয়ারের নাটকেও তিনি অভিনয় করতেন। রমলার পিতা কে ছিলেন? রমলার মায়ের স্বামী ছিলেন কলকাতার নামজাদা এক কলেজের অধ্যাপক। অ্যানিমিক চেহারা। অ্যাকাডেমিক টাইপ। উত্তর কলকাতার এক এঁদো গলিতে সাবেক কালের এক স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িতে সেই অধ্যাপক থাকতেন। বিষণ্ণ পরিবেশে। একনাগাড়ে তিন-চার মাস সেই বাড়িতে থাকলে আত্মহত্যার ইচ্ছে হওয়া স্বাভাবিক। অধ্যাপকের মাথায় পরিমিত টাক, চোখে পুরু চশমা। অ্যামিবায়োসিসের রুগি। সপ্তাহের তিনটে দিন মাথাধরায় কাবু। মাইগ্রেন। অধ্যাপক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল। মানুষও ভালো। কেবল একটা জিনিসেরই অভাব ছিল, সেটা হল। জীবনীশক্তি। প্যাঁ করে সানাই বাজল। মালা গেল এগলা থেকে ওগলায়। কিছু লোক রাত বারোটা পর্যন্ত মহা হল্লা করে পোলাও, মালাইকারির ভুষ্টিনাশ করে গেল। রজনীগন্ধা দোলানো ভেলভেটের চাদর-মোড়া বিছানায় এক যুবতীর পাশে তুমি শুলে। সেইটাই সব নয়, আসল খেল তারপরে। তাকত। কবিতাই শোনাও আর নীল আকাশে চাঁদ দেখাও; কিছুই কিছু নয়। তোমাকে হতে হবে একটা স্যাভেজ, ব্রুট। পশু না হলে তুমি নাম কা ওয়াস্তে স্বামী। তোমার স্ট্যাটাস হল সিঁদুরের একটি রেখা।
রমলা সেই বিবর্ণ মানুষটিকে বাবা বলে জানলেও, অধ্যাপক জানতেন রমলা তার সন্তান নয়। রমলার পিতা সেই মঞ্চ দাপানো অভিনেতা। যিনি মাইকেল হয়ে মেঘনাধ বধ আওড়ান, চাণক্য হয়ে দর্শকদের অনুভূতিতে রোমাঞ্চ আনেন। যৌবন সমাগমে রমলাও অনুমান করতে পেরেছিল, এমন একটা দীঘল শরীরের নির্মাতা ওই অধ্যাপক হতে পারে না। রাতের পর রাত বালিশে পিঠ দিয়ে বসে বসে হাঁপান। শ্বাসের শব্দ শুনলে অবাক হতে হয়, পৃথিবীতে বাতাসের এত অভাব! মানুষটা গ্যালপিং রেটে বৃদ্ধ হয়ে শুরু করেছিলেন। করুণ চোখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতেন। চওড়া পিঠে চকচকে চামড়া। ফেটে পড়া যৌবন। বহির্মুখী মন। সংসারে অলীক মন বসে না। পুরুষের সঙ্গ পছন্দ করে। যেসব পুরুষ অসুস্থ নয়, যাদের লিভার ভালো, শ্বাসকষ্ট নেই, ন্যায়-অন্যায়ের অলীক বোধে পেন্ডুলামের মতো দোল খায় না, তাদের কাছে পরস্ত্রীর মতো সুস্বাদু স্যালাড আর কী থাকতে পারে। প্রবাদে আছে, আমি মাখব ফলার, তুমি এসে খেয়ে যাবে। নেপোয় মারে দই।
অবশ্য রমলার মা বোকা ছিলেন না। অতিশয় খেলোয়াড় এক মহিলা। প্রতিভা তো ছিলই। নিষ্ঠুরতা স্বার্থপরতায় অদ্বিতীয়। কারুকার্য করা ভোজালির মতো। মণি বসানো সাপের ফণার মতো। বিষাক্ত সুন্দর। পৃথিবীতে অমতের চেয়ে হলাহলের আকর্ষণ বেশি। এক ছোবলে মরব না; কিন্তু তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে এগোব। সর্বনাশের আকর্ষণ। চরণামৃত খেলে মোক্ষ লাভ হয়। সেটা কি কেউ জানে না; কিন্তু কোকেন অথবা মরফিন সব গোলাপি;নভোচরের মতো আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছি। পেঁয়াজের খোসার মতো পাতলা শাড়ি পরে চন্দনবর্ণা মহিলা ঘুরে ঘুরে নাচছে। সে সুখ পৃথিবীতে নেই সেই সুখে ভাসছি। নর্দমাকে মনে হচ্ছে যমুনা। সেন্ট্রাল নার্ভাস সিসটেমে সেতার বাজছে।
রমলার মা সেই দশকের কলকাতার হিরোইন। দুই অর্থে এক। নায়িকা প্লাস ড্রাগস। প্রবীণ মাজা ভাঙা সাহিত্যিকরা তাঁর পা চাটতেন। আর উপন্যাসে বড়ো বড়ো আদর্শের বুলি কপচাতেন। উপনিষদ পাঞ্চ করে মনে করতেন ক্ল্যাসিক লিখে ফেলেছি। সভায় শাল জড়িয়ে বসতেন, সবাই। মনে করত ব্রামার জেরক্স কপি। দাঁতে পায়োরিয়া, মুখে দুর্গন্ধ, ঘামে টকসিন স্মেল, গেলাস তুলতে গেলে হাত কাঁপে, উদরে কোষ্ঠকাঠিন্যের বাতাস। সমালোচকরা চারপাশে নেংটি ইঁদুরের মতো ঘোরে। স্তাবকরা এই ভাজার মতো প্রেক্ষাগৃহে বসে চটরপটর তালি বাজায়। কলের। গোড়ায় লাগাম চড়িয়ে বসে আছেন মঞ্চাভিনেত্রী। যখন পিছন ফিরে হেঁটে যান পুরুষদের গলা শুকিয়ে যায়। সামনে দাঁড়িয়ে যখন হাত তোলেন, মনে হয় নিয়তি। একজনের কাছেই নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন, তিনি সেই নট, রঘুবীর।
রমলা সবই পেয়েছিল, মায়ের প্রতিভাটা পায়নি। মণিহীন ফণী। সুধন্য সেই চন্দ্রমুখীর নেশায় চুর হয়ে গেলেন। একটা বাড়ি ভাড়া করে সেই প্রতিষ্ঠা করলেন। স্থির করলেন বিগবাজেটের একটা ফিলম করবেন। রমলাকে করে তুলবেন বাংলা চলচ্চিত্রের গ্রেটা গার্বো। ভাগাড়ে যখন নতুন। মৃতদেহ পড়ে তখন শকুনরা সব খ্যাখ্যা করে ছুটে আসে। বাঘ যখন শিকার মারে ফেউরা সব দুরে বসে কেয়াবাত কেয়াবাত করে। সেইকালের এক মরফিনসেবী পরিচালক গন্ধে গন্ধে ছুটে এলেন। তিনি আবার কলকাতার এক মিশনারি কলেজে ইংরেজি অধ্যাপক ছিলেন। পাকতেড়ে চেহারার কোকেনসেবী এক লেখক তাঁর কোটর থেকে বেরিয়ে এলেন। এক ম্যাটিনি আইডল। নায়ক রমলার বিপরীতে অভিনয় করতে নিমরাজি হলেন।
মদের ফোয়ারা ছুটল। মুরগি উড়ে গেল প্লেট প্লেট। রাতের পর রাত আলোচনা। কাউচে এলিয়ে আছেন রমলা। দু আঙুলের ফাঁকে লম্বা পাইপে লাগানো সিগারেট। এনামেল করা ঠোঁটে মাঝে। মাঝে টানছেন। ছাই ঝাড়ার দরকার হলে মিউজিক ডিরেক্টর অ্যাশট্রে এগিয়ে দিয়ে ধন্য হচ্ছেন। ফরাসি পারফুম জড়িয়ে আছে শরীরে। দিনে একরকম সুগন্ধ, রাতে আর একরকম। গবেষণার বিষয় গল্পটা কী হবে। প্রমথেশ বড়ুয়া, দেবকী বোস, জ্যোতির্ময় রায় পাঞ্চ। জবরদস্ত একটা ককটেল। ছবির সব ফ্রেমেই রমলা থাকবে।
সুধন্য মুখার্জি ব্যাঙ্ক যাচ্ছেন, বান্ডিল বান্ডিল টাকা তুলছেন, এম্পায়ার স্টোর্স বিলিতি সাপ্লাই করছে, বাথগেট থেকে আসছে পেটি পেটি সোডা ওয়াটার। দীপার জ্যাঠামশাই একদিন সুধন্যকে বললেন, ‘চৌবাচ্চায় ফুটোটা তা হলে তুমিই করলে।’ প্রথমে মৃদু গলায় হচ্ছিল। দাদা তার ভাইকে সতর্ক করছেন। কর্তা এখনও জীবিত, তাঁর জীবৎকালেই লালবাতি জ্বেলে দেবে। জলের মতো টাকা উড়ছে। রমলার রসের ভিয়েন হচ্ছে। একটাই মেয়ে বড় হচ্ছে। বাপ যদি চরিত্রহীন হন মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে।
আমি সিনেমা করব। প্রডিউসার। টাকাটা আমার চাই।
সিনেমা!
জ্যাঠামশাই আঁতকে উঠলেন। দীপা আড়াল থেকে দেখছে। বাবাকে চিরকালই তার মনে হত অচেনা একটা মানুষ। দুমদাম কথা বলে। যে-কোনও কথা যে-কোনও লোককে অক্লেশে বলতে পারে। বয়সের মর্যাদা দিতে জানে না। মানুষকে অপমান করে আনন্দ পায়।
জ্যাঠামশাই একটু সামলে বলেছিলেন, মাথাটা তাহলে সত্যিই খারাপ হল। সিনেমার তুমি কী বোঝো? কত টাকার ব্যাপার!
দশলাখ নিয়ে নামব। এতকাল জাহাজের পেটে জীবনটাকে নষ্ট করেছি।
জ্যাঠামশাই বললেন, এইবার মেয়েছেলের তলপেটে জীবনটাকে শেষ করবে।
দীপার বাবা সপাটে দাদাকে একটা চড় হাঁকালেন। নেশাটা চড়ছিল। বড় ভাই হকচকিয়ে। গেলেন। সেই রাতটা ভোলার নয়। দীপা ছুটে এসে জ্যাঠামশাইকে জড়িয়ে ধরেছিল। জ্যাঠাইমা দৌড়ে এসে বলেছিলেন, দাদাকে মারলে! দীপার বাবা যে চেয়ারটায় বসেছিল, সেই চেয়ারটা। উলটে ফেলে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এই চলে যাওয়াটা দীপার মনে একটা স্থায়ী ছাপ। রেখে গেছে। কেউ বাধা দিতে এগিয়ে আসেনি। দীপার মা বেঁচে থাকলে নিশ্চয় স্বামীর হাত। ধরতেন। একটা নিঃসঙ্গ মানুষ চলে গেল। সারা বাড়ি থমথমে। দীপার সঙ্গে কেউ কথা বলছে না, যেন চড়টা সেই মেরেছে। বেশ বুঝতে পেরেছিল সবাই তাকে ঘৃণা করছে। দীপা বুঝে গিয়েছিল। সংসারে সে একা। সেই রাতের আর একটা ঘটনা, রাত দুটোর সময় ঠাকুরদা মারা গেলেন। সন্ধে থেকেই ছটফট করছিলেন, কাকে যেন খুঁজছিলেন। কারও হাত ধরার চেষ্টা। একটা অজানা পথে একেবারে একা যাওয়া। নাস্তিক ভোগী মানুষরা মৃত্যুর সময় খুব ভয় পান। এপার থেকে ওপারে যাওয়ার সময় সঙ্গে কিছু নিয়ে যাওয়া যায় না। কেউ সঙ্গে যেতেই পারে না। তা ছাড়া। একটা কষ্টও আছে, তখন আর শ্বাস নেওয়া যায় না। ভিতরের বন্দি বাতাস বেরিয়ে আসতে চায়। মৃত্যুর এক ভয়ংকর যন্ত্রণা।
যখন মারা গেলেন, তখন যে যার ঘরে খিল এঁটে শুয়ে আছে। এতদিন যা শুনতে হয়নি, সেই চোখা কথা দীপাকে শুনতে হয়েছে। সব কথার সারাংশ হল, এই বাপের মেয়ে আর কত ভালো হবে। দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষা। জ্যাঠাইমা মুখ ঘুরিয়ে নিলেন, কাকিমা ফড়ফড়িয়ে চলে গেলেন। ভাবটা এই, নান অফ মাই বিজনেস। বড়র সঙ্গে হয়েছে বড়র বউ বুঝবে। বড় হয়ে বড়র সম্মান যদি আদায় করে নিতে না পারে, সে তোমার দোষ! বসে বসে মদ খাওয়ার সময় মনে থাকে না? ঠাকুরদার মৃত্যুর সময় আপনজনদের মধ্যে দীপাবলীই পাশে ছিল। মানুষ। কীভাবে দুঃসহ যন্ত্রণায় মারা যায় একবারে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দেখা হয়ে গেল। প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাওয়ার পর নার্স দিদিমণি পাশের টুলে যেমনভাবে বসে পড়লেন, যেন চা খেয়ে চায়ের কাপ নামিয়ে রাখল। কিছুই না পেয়ালা খালি হয়ে গেল। এইটা হয়তো তার অভিজ্ঞতায় একশো একতম মৃত্যু। দীপার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আমার ছুটি হয়ে গেল। যাও ওনাদের ডাকো।’
ওদের সঙ্গে কথা বলতে দীপার একেবারেই ভালো লাগছিল না। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাকা, কাকিমা, জ্যাঠামশাই, জ্যাঠাইমা বলে ডাকতে তার ঘেন্না করছিল। কিছুক্ষণ বসে থেকে নার্স ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, ‘নাঃ ডেডবডিতে ঠান্ডা লেগে যাচ্ছে। যাই বাবুদের টেনে তুলি।’
ঘরে কম পাওয়ারের নীল একটা আলো জ্বলছিল। ঠাকুরদা চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন অনন্ত নিদ্রায়। সাদা চুল, সাদা দাড়ি। ঘরের বাতাসে তখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস। নীল সমুদ্রে মৃত্যু নীল অনন্তে লীন এক মানুষ। দীপার সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, এমন একজন মানুষের ছেলেরা এমন কেন হল! ঠাকুরদা তো ধার্মিক ছিলেন। ভাগবত পাঠ করতেন, গীতা পাঠ করতেন, মালা জপতেন, সন্ন্যাসী সঙ্গ করতেন, দানধ্যান ছিল। দীপা ঠাকুরদার হাতটা ধরতে চেয়েছিল, ভয়ে। পারেনি। মৃত্যুকে ভয় করে। এমনি দেখা যায় না। কিন্তু মৃতদেহে তার অবস্থান। ভেতরে তুমি। কে? নিথর, নিষ্পন্দ, দেহ খাঁচায় আমি মৃত্যু। আমি জীবনের সঙ্গেই থাকি। সময় হলেই জীবনকে ঠেলে বের করে দিয়ে দেহের দখলদারি নিই। নীল, হিমশীতল মৃত্যু আমি। আমাকে স্পর্শ কোরো না। জীবনের মতো আমিও এক মহাসত্য।
ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠল। ভোগের বিছানা ছেড়ে সব নেমে এলেন। মেয়েদের পোশাকে তখনও ঘুম কুঁচকে আছে। সহবাসের সুখ। এ কী মহাবিদ্যু! মাঝরাতে কেউ মারা যায়! সেটা কী উচিত কাজ? টেলিফোনের ডায়াল ঘুরতে লাগল কড়কড় শব্দে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তের। আত্মীয়স্বজনদের ঘুম নষ্ট হল। বড়কর্তা পরলোক গেছেন। দুটো বেজে দশ মিনিটে ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়েছে। তোমরা সব এসো।
নাকের গর্তে তুলো গোঁজা হল। নাকের কাজ শেষ। চোখের পাতায় বসানো হল চন্দন-তুলসী। একখণ্ড গীতা রাখা হল বুকে। রথে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি বলে গেছেন, মানুষ জন্মায় না, মানুষ মরেও না। অবিনাশী আত্মা। সবই অঙ্গুষ্ঠ পরিমাপের এক জ্যোতির্লিঙ্গের খেলা। তাকে না যায় ছেদা করা, না যায় তাকে কচুকাটা করা, না যায় তাকে আগুনে পোড়ানো। অজেয় অমর, শাশ্বত। নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত। চড়চড়ে রোদ উঠল, তবু চড়া পাওয়ারের আলোগুলো নেভানোর। কথা সবাই ভুলে গেল। দীপার মনে আছে, সে ঘুরে ঘুরে আলো নেভাচ্ছে, আর আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবরা সব হাসছে সেজেগুঁজে, মালা, ফুলের রিং, বোকে নিয়ে। একেবারে উৎসবের মেজাজ। গাড়ির পর গাড়ি। দরজা বন্ধের ঢিসটাস শব্দ। কেউ কেউ ঢোকার আগে রুমাল ঘষে চোখ লাল করে নিচ্ছেন। মেয়েদের মধ্য কেউকেউ ফোঁস ফোঁস শব্দ করছেন। চোখে একটু জলও হয়তো আসছে। এরই মাঝে দীপার বড় পিসি এলেন। তিনি একটু আন্তরিকভাবেই কাঁদছিলেন। হাপরের মতোই শব্দ হচ্ছিল। বাবা বলছিলেন বারে বারে। শোনাচ্ছিল, ফাবা, ফাবা। বয়স্কা মহিলা। নানাবিধ ব্যাধিতে শরীর বিপর্যস্ত। তাঁকে ধরেছিলেন তাঁর স্বামী। রিটায়ার্ড ফরেস্ট অফিসার। মুখে অজস্র পাহাড়ি ভাঁজ। পাকানো গোঁফ। পেটানো চেহারা। বাঘ আর বউ দুটোকেই সমান ভালোবাসেন। গঙ্গার জল আর বোতলের জল দুটোরই সমান সেবা করেন। তিনি বউকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন এই বলে, মান্তু অনেকদিন বেঁচেছেন, ফুল টার্ম ফুল টার্ম, আবার কী, আবার কী, রাইপ ওল্ড এজ। কেঁদে আর শরীর খারাপ কোরো না, তোমার আবার মাইগ্রেন আছে। এখুনি বমি শুরু হবে।
শান্ত করার আর প্রয়োজন হল না। তিনি এক ধাক্কায় ছিটকে পাশে সরে গেলেন। মেয়র এসেছেন। মেয়র। সারা বাড়িতে একটা ঢেউ খেলে গেল। লম্বা, কৃশ এক ভদ্রলোক, সাদা ট্রাউজার, কোট, পায়ে অক্সফোর্ড শু। চারপাশে চারজন স্তাবক। মশমশ করে ঢুকলেন। একজনের হাতে একটা পদ্মফুলের রিং। দীপার জ্যাঠামশাই আর কাকা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। ধিতিং ধিতিং করে নাচছেন। সাধারণ আত্মীয়স্বজনরা ছিটকে সরে যাচ্ছেন। কাকা ইংরেজিতে বলছেন, ক্লিয়ার আউট, ক্লিয়ার আউট। জ্যাঠামশাই বলছেন, ভিড় হাটাও, ভিড় হাটাও।
মেয়র মৃতদেহ স্পর্শ করবেন না। ইনফেকশনের ভয় আছে। সঙ্গের একজনকে ইশারা করলেন। তিনি ফুলের রিংটা মৃতদেহের বুকের উপর রাখলেন। মেয়র একটা নমস্কার করে বললেন, ‘যথেষ্ট বয়েস হয়েছিল।’
সবাই বললেন, ‘তা ঠিক, তা ঠিক।’
‘এর পর আর বাঁচা উচিত নয়।’
‘অবশ্যই নয়, অবশ্যই নয়।’
‘আই লাইক টু ডাই ইয়াং।’
ভদ্রলোক হয়তো ষাটে পৌঁছেছেন। ভাবছেন ইয়াং। আহারাদি ভালোই হয়। রাতের দিকে দু পাত্তর স্কচ চড়ান। পার্টি পেছনে আছে। এত বড় একটা শহরের মালিক। যুবক তো বটেই। তাঁর এই ডাই ইয়াং শুনে সবাই হায় হায় করে উঠলেন, ‘মরবেন কী স্যার। আপনার মতো মানুষের। অমর হওয়া উচিত। জনগণ আপনাকে চায়।’
মেয়র বললেন, ‘সেটা কোনও কথা নয়। চায় বলেই যে বাঁচতে হবে এমন কোনও কথা নয়। আমার কথা, নড়বড়ে শরীরে বাঁচার কোনও মানে হয় না।’
সবাই বললেন, ‘তা ঠিক, তা ঠিক।’
মেয়র কথা বলতে বলতে মার্বেলপাথর বাঁধানো সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। চামড়ার জুতো। স্লিপ না। করে। চারজন বডিগার্ড সতর্ক। এদিকে সার্ভিস দিলে ওদিকে আসবে। মানুষটার কাছ থেকে কত কী বাগিয়ে নেওয়ার আছে। এ তো মানুষ নয়, ভক্তবাঞ্ছা কল্পতরু।
দীপা একপাশেদাঁড়িয়ে সব দেখছে। বড়লোকের কী খাতির। বড় পিসিমা রেগে চলে যাচ্ছেন। হাইপ্রেসার। ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে কী হত! সেরিব্রাল অ্যাটাক। কে তখন দেখত আমাকে। মেয়র এসেছে তো কী হয়েছে। পিসেমশাই ঠান্ডা করার চেষ্টা করছেন, কাজের বাড়িতে এমন হয়। তোমার এই রাগটা একটু কমাও মান্তু।
এক ঝটকায় স্বামীর হাত সরিয়ে দিয়ে মান্তু বললেন, ওই জন্যই তো এই মড়াদের বাড়িতে আমি আসতে চাই না। নিজের বাপ, তায় আবার মারা গেছে, বলতে নেই তবু বলছি, কতগুলো জানোয়ারের জন্ম দিয়েছিল।
ছোটোর বউ পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে শুনে ফেলল। সাপ যেমন থমকে দাঁড়িয়ে ফণা তোলে। সেইরকম ফোঁস করে উঠল, তার মধ্যে তুমিও পড়ো ঠাকুরঝি। তুমি যে কী সে তোমার স্বামী জানে।
আর তুই কী সে আমরা জানি ঢলানী মাগি। তোর গুণের তো ঘাট নেই। শ্বশুরের কোলে উঠে বসে থাকতিস।
আর তুই কী করতিস! ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতিস।
বুড়ো কত্তা ওদিকে খাটে কাঠ হচ্ছে, এদিকে দুই বাঘিনীর খামচাখামচি। মেয়েরা ঝগড়ার। সূত্রপাতেই তুই আর মাগিতে যাবেই যাবে। আর সব অপরাধের সেরা হল যৌন অপরাধ। আর। যত লুকিয়ে চুরিয়েই করো প্রকাশিত হবেই। অনেকটা চিকেন পক্সের মতো। ব্যাপারটার মধ্যে অন্য কিছু থাকলেও সেটাকে টেনে ওই একই লাইনে আনা হবে। আর দুজনের এই কাদা। ছোড়াছুড়ি দীপা শুনছিল। ভয় পাচ্ছিল। পৃথিবীটা বিশেষ সুবিধের জায়গা নয়। প্রশ্ন আসছিল মনে, এই কারণেই কী ঠাকুরদা কাকাকে একটু বেশি ভালোবাসতেন। জ্যাঠামশাই কী সেই কারণেই কাকিমার সঙ্গে কথা বলেন না। জ্যাঠাইমা কী সেই কারণেই কাকিমাকে সহ্য করতে পারেন না। দীপার মনে পড়ল, সে যখন আরও ছোটো ছিল, দেখত পিসিমার সঙ্গে একটা ছেলে আসত। ভালো চেহারা, কোঁকড়া চুল। পিসিমা কথায় কথায় তাকে আদরের চড় মেরে বলত, তুই থাম, আর জ্বালাসনি আমাকে। মেয়েমহলে গবেষণা হত পিসিমার কেন ছেলেপুলে হয় না। একটা কথা প্রায়ই শুনত, ঠাকুরজামাই ঢোঁড়া সাপ। ছোবল আছে বিষ নেই। দীপার মনে আছে পিসিমা খুব সাজতেন। গোড়ালিতে ঝামা ঘষতেন। দুধের সরের সঙ্গে কমলালেবুর খোলা বেটে সারা শরীরে লাগাতেন প্রায় বিবস্ত্র হয়ে। রেশমের তৈরি বক্ষবন্ধনী পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতেন। সামনে খোলা জানালা। বাগানের কোণে সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে মালির ছেলের গোঁফ গজিয়েছে। সে হাঁ করে দেখছে।
সব কথা, উড়ো কথা, হেঁদো কথা। কোথাও না কোথাও একটু সত্য থাকেই। দীপা দেখেছে কাকিমাকে পাশবালিশ করে ঠাকুরদা শুয়ে আছে। খাটের পাশের টেবিলে খল, নুড়ি। চেটে চেটে মকরধ্বজ খেয়েছেন। ডিশে পড়ে আছে একটা খাস্তা কচুরি। বৃদ্ধ আলুর দম দিয়ে খাস্তা কচুরি। খেতে ভালোবাসতেন। কোনও কোনও মানুষ বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে ফুলতে থাকেন। মনের দিক থেকে হয়ে ওঠেন পৈশাচিক। পয়সাঅলা লোকদের মধ্যে এটা খুব হয়। কারণ তাঁরা অধার্মিক। দেব-দেবীর পূজাঅর্চনার ঘটা করেন ঠিকই, সে সবই বিত্তবাসনায়। আকাঙ্ক্ষা একটাই —ধনদৌলত। নিজের অন্তরে স্নিগ্ধ, পবিত্র দেবভাব জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যে নয়। দীপার ঠাকুরদা ষাটের পর এইরকমই হয়ে গিয়েছিলেন। সিল্কের লুঙ্গি, কাঁধকাটা গেঞ্জি পরে বেতের একটা চেয়ারে বসে থাকতেন। বসে বসে কেবল ভোগের কথা বলতেন। মেয়েদের শরীর নিয়ে কথা বলতেন। বহুকাল আগে এ-পাড়ার কোথাও একঘর বেশ্যা ছিল, তাদের কথা বলতেন। আর মাঝে মাঝে দীপাকে আদর করার চেষ্টা করতেন। দীপা তখন পালাবার পথ পেত না। মেয়েরা শৈশব থেকেই বুঝতে শেখে কোন আদরটা কেমন।
বেলা দশটা বেজে গেল, তখনও দীপার বাবা কিন্তু এলেন না। কলকাতার এক হোটেলে বসে আসেন অন্য জগতে। দীপা এখন বোঝে, ফেটাল ওম্যান কাকে বলে। বিষকন্যা, নাগিনী। কলেজে সে লুইসের ‘দি মঙ্ক’ বইটি পড়েছিল। পাঠ্য হিসাবে নয়, পড়তে বাধ্য হয়েছিল তার ইংরেজির অধ্যাপকের অনুরোধে। ছোট্টখাট্টো হাসিখুশি মানুষটি। অনেকটা পাকা নারকোল কুলের মতো দেখতে। চকচকে উজ্জ্বল। একমাথা কালো কোঁকড়া চুল। ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতেন। কোনও কৃত্রিম গাম্ভীর্য ছিল না। দীপার সঙ্গে অদ্ভুত একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীপা এখন বোঝে, সেই খোলামেলা, বালকস্বভাবের মানুষটিকে সে ভালোবেসেছিল। সবুজ মাঠের মতো, স্বচ্ছ জলে লুটিয়ে থাকা আকাশের মতো, ঝাঁকড়া একটা মহুয়া গাছের মতো। সেই কথাটা মুখ ফুটে বলতে পারেনি দীপা। লজ্জা করছিল। একজন অধ্যাপককে কী সেইভাবে ভালোবাসা যায়! সম্পর্ক যে গুরু-শিষ্যের। সেই অধ্যাপক ছিলেন অবিবাহিত। কলেজ স্ট্রিটের এক বনেদি বাড়ির তিনতলায় একা থাকতেন। দীপা প্রায়ই সেখানে যেত। লাশের খাটে গেরুয়া চাদরপাতা বিছানা। লাগোয়া ছাদে ছিল অ্যাসবেস্টারের ছাউনিতে একটা রান্নাঘর ও বাথরুম পাশাপাশি। রান্নাঘরে অন্য কোনও রান্নার ব্যবস্থাই ছিল না। ছোট্ট একটা টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। হিটার, কেটলি, কাপ-ডিশ, ছাঁকনি এইসব। কৌটোয় বিস্কুট, চানাচুরি, নিমকি। অনেকটা সন্ন্যাসীর আস্তানার মতো। ঘরে সবসময় বাতাবিলেবুর গন্ধ। খোলা ছাদে ব্যায়ামের সাজসরঞ্জাম—ডাম্বেল, বারবেল, মুগুর। অনেক সময় রামকৃষ্ণ মিশনের। সন্ন্যাসীরা আসতেন। তখন বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ, গীতার চর্চা হত। স্বামীজি, ঠাকুরের নানা প্রসঙ্গ। দীপা মেঝেতে বিছানো দড়ির কার্পেটে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনত। ওইসব আলোচনা তার ভীষণ ভালো লাগত। মনে মনে অন্য জগৎ থেকে ভিন্ন একটা বাতাস ভেসে আসছে। নীচে। কলেজ স্ট্রিটের ডাবপট্টির হইচই। কিছু উপরেই মশগুল আধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ। একই বেঁচে থাকার কত প্রবাহ।
বন্ধুর মতো সেই অধ্যাপক রোমান্টিক অ্যাগনি বোঝাতে গিয়ে দীপাকে বইটি দিয়েছিলেন বাড়তি পাঠ্য হিসাবে। এক সাধুর পতনের কাহিনি। জীবকোষ কুরে কুরে খায় কামনার কীট। সুতো যদি কারও লাটাইয়ে থাকে, সে-লাটাই ধরা আছে রিরংসার হাতে। ও তার নড়াচড়া, ওঠাবসা সবই। সেই কামকুঞ্জে। সর্বনাশা আকর্ষণ তার। গভীর রাতে সেই কাহিনি দীপা পড়েছিল বিছানায় আধশোয়া হয়ে। নায়িকার নাম মাটিলভা। নায়কের নাম সন্ন্যাসী অ্যামব্রোসিয়া। ঘটনাস্থল একটি আশ্রম। অ্যামব্রোসিয়ার আশ্রমে মাটিলভা এসেছিল বৈরাগী, সমাজসেবিকা রূপে। ধরা যায়নি। তার আসল রূপ। কত প্রশংসা তার। নিঃস্বার্থ সেবিকাসুন্দরী। দিন যায়, সে তার প্রলোভনের জালে জড়াতে চায় আদর্শবাদী সন্ন্যাসীকে। তুমি ত্যাগী, চরিত্রবান, সংযমী। তোমাকেই আজি জয় করব। মাকড়সার জালে পতঙ্গের মতো। তোমার প্রতিরোধের দুর্গ ভেঙে যাবে। সেদিন ছিল চাঁদের আলোর রাত। আশ্রমের একটি গ্রামীণঘর। কালো পাথরে দুধের মতো লুটিয়ে আছে। চাঁদের আলো। মাটিলভা বলছে, এসো আমার বাহুবন্ধনে। ইন্দ্রিয়ের সেবাই পাশব ধর্ম। নিগ্রহ এক মানসিক ব্যাধি। নদী জানি যাবেই চলে সাগরের পানে। ঝিমঝিম নিশুতি রাত। পুরোনো। ফার্নিচারে ঘুণপোকার শব্দ। দূরপ্রান্তরে শেয়ালের ডাক। গির্জার নিঃসঙ্গ চূড়ায় রাতের আকাশ বাতাসে শীত। পাহাড়ের মাথায় বরফের কিরীট। যুবক সন্ন্যাসীর প্রতিরোধ, তুমি চলে যাও, এ আমার পথ নয়। আমি নিষ্পাপ, নিষ্কলঙ্ক সন্ন্যাসী।
সুন্দরী নায়িকা বলছে, সন্ন্যাসী। আমার হাতে কী দেখেছ?
চাঁদের আলোয় ঝিলিক মারছে চকচকে ছুরি। তুমি যদি প্রত্যাখ্যান করো, এই ছুরি আমি আমার বুকে বসাব। ফড়ফড় করে সে তার নানের পোশাকের বুকের দিকটা ছিঁড়ে ফেলল। বর্তুলাকার বুকের আধখানা ছিটকে বেরিয়ে এল।
লেখক বর্ণনা দিচ্ছেন। চকচকে ছুরির ফলা বাতাবিলেবুর মতো বাঁ-দিকের বুকে ঠেকানো। উঃ সে কী বুক! এই হল নারীর স্তন। চাঁদের আলো সোজা সেই বুকে এসে পড়েছে। সেই ঝকঝকে সাদা বুকের দিকে তাকিয়ে সন্ন্যাসী স্তম্ভিত। ঈশ্বর কী তার চেয়ে অন্য কোনও সৌন্দর্যের সন্ধান দিতে পারেন। শরীর মুচড়ে দিতে পারে অন্য কোনও এমন বস্তু। চোখ ফেরাতে পারছে না। তৃষ্ণা, আগ্রহ, আবেগ। একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে, ছিঃ ছিঃ, তুমি সন্ন্যাসী। প্রলোভন, দেহবাসনা, পাপ। তাকিও না। কিন্তু আনন্দ। এ কী আনন্দ! সারা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আগুন। ধমনীর রক্ত টগবগ করে ফুটছে। চোখে আগুন। বহুতর পাশবিক কামনায় শরীর কাঁপছে। মাত্র আড়াই হাত দূরে। সেই লোভনীয় প্রলোভন চাঁদের আলোয় ধকধক করছে। সন্ন্যাসী হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘দাঁড়াও। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছিনা। মোহিনী। তুমি দাঁড়াও, আমার সর্বনাশের জন্য তুমি দাঁড়াও।’
সন্ন্যাসী সেই সুন্দরীর ক্রীতদাসে পরিণত হলেন। আমি বলছি, তুমি করো। পাপ করো, ধ্বংস হয়ে যাও, সংসার, ঈশ্বর, সম্পর্ক সব ধুস। ইন্দ্রিয়ই একমাত্র সত্য। অপরাধেই বাঁচার উত্তেজনা। যে-অভিনেত্রীর ফাঁদে দীপার বাবা ধরা পড়েছিলেন সেই মহিলা ওই ম্যাটিলভার মতোই। রূপালি পর্দায় দীপা তাকে দেখেছিল। ভয়ঙ্কর একটা শরীর, অভিনয় যেমনই হোক। দীপা জানে, সত্য একটাই, দেহ, ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব। ছেলে, মেয়ে, দাদা, বউদি কিছুই কিছু নয়। আমি খাব, আমি পরব, আমি রমণ করব, আমি অসুস্থ হব, আমি মরে যাব। এর বাইরে যা কিছু সব ভণ্ডামি। ওই যে অধ্যাপক, তিনিই বা কেন বইটা পড়তে দিয়েছিলেন দীপাকে। কোনও প্রয়োজন ছিল কী? তিনি পড়েছেন। পড়ার পর সেই চোখে দীপার দিকে তাকাচ্ছেন। সে এক ভয়ংকর অস্বস্তি! অমন করে কী দেখছেন? প্রশ্নটা মুখের উপর করা যায় না। কিন্তু প্রশ্নটা আসে।
দীপার বাবা এলেন সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে। না, একান্নবর্তী পরিবার আর নয়। যে যার স্বাধীন। এমনকী, ব্যবসাও ভাগ করতে হবে। আমার আমার, তোমার তোমার।
জ্যাঠামশাই বোঝাতে চেয়েছিলেন, তুমি ধ্বংস হবে। তুমিও বাঁচবে না।
নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে কারও মঙ্গল হবে? তুমি বরং তোমার শেয়ারটা আমাকে বিক্রি করে দাও। এই মাল খালাসের ব্যবসা তোমার ধাতে সইবে না।
দীপার বাবা টোপটা গিললেন। মাথায় তখন সিনেমা নাচছে। পরামর্শদাতা অনেক। দীপার বড় মামা এসে বললেন, মনে কর, তোর বাবা-মা দুজনেই মারা গেছে। তুই আমার সঙ্গে চ। দেখি তোকে মানুষ করা যায় কি না। এই তাসের বাড়ি এইবার ভাঙবে।
কলকাতার বন্দরে বড় জাহাজ আর তেমন ভিড়ছে না। আমদানি, রপ্তানি কমছে। ইংরেজ আমলের সেই বিপুল বোলবোলা আর নেই। ফিরবেও না কোনওদিন। দক্ষিণে নতুন নতুন বন্দর তৈরি হয়েছে। বড় জাহাজ সব ওই দিকেই ভিড়বে। এদিকে শুধু ইনকিলাব হবে।
দীপার জ্যাঠামশাই আর কাকা একটু আদিখ্যেতা করলেন লোক দেখানো। আসলে সবাই খুশি। বাপ আর মেয়ে দুজনেই ছাঁটাই। একটা চরিত্রহীন, আর একটা মা-মরা আদুরি। পরের দায়িত্ব কে ঘাড়ে নেবে। কলাগাছের মতো চড় চড় করে বাড়ছে। বখাটেরা তাকাতে শুরু করেছে। মায়ের মতো শরীর পেয়েছে, এখন বাপের মতো স্বভাবটা পেলেই হয়েছে আর কী! কে সামলাবে।
এইসব কথা প্রকাশ্যেই হল। যাও বাছা, বাপের সিনেমায় এইবার বুক খুলে নাচো। নায়িকা হও। বড়মামার হাত ধরে দীপা চলে এল মামার বাড়ি। দুই মামা। দাদু, দিদিমা। মামারা খুব মজার মানুষ। কারবারি, কিন্তু শিক্ষিত। গিরিডি আর কোডার্মায় মাইকার কারবার। পয়সার অভাব নেই। দুই ভাইয়ে খুব মনের মিল। বারগণ্ডায় বিশাল বাড়ি। ছবির মতো বাগান, লন। দীপা যেন। প্রকৃতিতে মুক্তি পেল। মুক্তি পেল সুস্থ জীবনে। বোতল নেই, গেলাস নেই, সিল্কের লুঙ্গি নেই, স্যান্ডো গেঞ্জি নেই। মাংসল দেহ নেই। খিস্তি, খেউড় নেই। সদা হাসিখুশি শান্ত একটা পরিবার। বড়মামার মেয়ে তুলি ছিল দীপারই সমবয়সি। সবসময় হেসেই আছে, ফুলের মতো ফুটেই। আছে, শুকোতে জানে না। শিশিরের মতো দুটো চোখ। বড়মাইমা সবসময় সেজেগুঁজে থাকেন, একেবারে টিপটপ। বাড়িটার কোথাও এতটুকু ময়লা নেই, দুর্গন্ধ নেই। মাছের কাঁটা পিপড়ে। টেনে নিয়ে যাচ্ছে, ইঁদুরে মাংসের হাড় নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে, এ দৃশ্য চোখে পড়ছে না। প্রকাশ্য তারে ফাঁদালোশায়া বাতাসে ফুলে ফুলে উঠছে না। যেমন-তেমন ভাবে ব্যবহৃত বাথরুমে। মেয়েদের ভেঁড়া বুকের মতো বক্ষবন্ধনীর ঝুলে থাকা অসভ্যতা নেই। মামার বাড়িতে এসে দীপা ধরতে পারল তার মনের সংস্কারটা কী। সে বৈষ্ণব। শান্ত, দাস্য, সখ্য, মধুর এই চারটি ভাব তার মনে বাসা বেঁধে আছে। সে চায় মধুরকে। রাক্ষস স্বভাবের মানুষকে সে ঘৃণা করে। পৈশাচিক পরিবেশে তার প্রবল ভয়।
দীপার মেজোমামা ছিলেন আর এক সুন্দর মানুষ। গিরিডির নামকরা ডাক্তার। সাংঘাতিক প্র্যাকটিস। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। তিসরি আর তার আশপাশের কয়লা ও মাইকা। মাইনসের শ্রমিকরা ভিড় করে থাকে। গলায় স্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে ডাক্তার ছুটে বেড়াচ্ছেন। টাকাপয়সা কে কী দিচ্ছে খেয়ালই নেই! মাঝে মাঝে মনের আনন্দে শিস দিতেন। ফাঁকা মাঠ পেলেই এক রাউন্ড ছুটে নিতেন। বলতেন, বাছুরের আনন্দ, ছাগল ছানার নাচ, বাচ্চা কুকুরের দুষ্টুমি—এই তিনটেকে এক করে নিজের ভিতরে ঠিক ঠিক আনাটাই হল সাধনা। পয়সায় কী হয়। গুচ্ছের খাওয়া হয়। তারপর বাথরুমে নামিয়ে দিয়ে আসা হয়। আনন্দই হল জীবের শ্রেষ্ঠ খাদ্য। থেকে থেকে চিৎকার করে গেয়ে উঠতেন,
আকাশভরা সূর্য-তারা বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বড়োমাইমা আর মেজোমাইমাকে মনে হত দুই বোন। ‘দিদি, দিদি’ বলে সর্বক্ষণ পেছন পেছন ঘুরত মেজো। বড়র অনুমতি ছাড়া কিছু করত না। দুজনের মিল দেখে দীপা ভীষণ আনন্দ পেত। পৃথিবীর ভালো দিকটা দেখতে কী ভালো লাগে।
একটা আস্তাবল ছিল বিরাট। তিনটে তাগড়া ঘোড়া। চেস্টনাট ব্রাউন কালার। বড়মামা সেই ঘোড়ায় চড়ে দূর পাহাড়ের খনি অঞ্চলে চলে যেতেন রোজ সকালে। দুটো গাড়িও ছিল—একটা জিপ, একটা মোটর। দীপা নরক থেকে স্বর্গে এল। তার দাদামশাই কেন ওই বাড়িতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন? পয়সা দেখে, পয়সা ছাড়া ওদের আর কী আছে! যে বাড়িতে একটাও বই নেই সে বাড়ি কেমন বাড়ি। মা তার মরে বেঁচেছে।
বড়মামা মেজোমামাকে বললেন, দীপাকে কীভাবে মানুষ করা যায়। ওর তো মনে ভীষণ দুঃখ।
কীসের দুঃখ?
মা নেই, বাবা থেকেও নেই। এটা একটা কম কথা!
আমরা সবাই কী করতে আছি। ওকে আমরা ডাক্তার করব।
ওর মতো কোমল, ভাবুক মেয়ে ডাক্তার হতে পারবে না, ওকে আমরা অধ্যাপিকা করব।
আমার লাইনটা তাহলে লোপাট হয়ে যাবে।
তোর ছেলে হলে, ছেলেকে ডাক্তার করবি।
কবে হবে তার ঠিক নেই।
দীপার মনে আছে, টুকটুকে ফরসা মেজোমামা কাঁচা শাকসবজি, খোসাসুদ্ধ ফলপাকড় কশমশ করে চিবিয়ে খেতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি কশমশ করে শশা খেতে খেতে আস্তাবলের দিকে চলে গেলেন। দুঃখ-দুঃখ মুখ। পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে কোনও ছেলেপুলে হয়নি। সেই কারণেই দীপাকে আঁকড়ে ধরতে চান। মাইকা মাইনে তখনও অনেক সায়েসুবো। ব্যবসা সূত্রে এই পরিবারের সঙ্গে তাদের খাতিরও যথেষ্ট। দীপাকে বিলেত পাঠিয়ে স্পেশ্যালিস্ট ডাক্তার করিয়ে আনতে পারলে আর কোনও ভাবনা থাকবে না। এখনও সময় আছে যা করার করে নাও। অ্যায়সা দিন নেহি রয়েগা। হঠাৎ মনে হল, কোন ভবিষ্যতের কথা ভাবছি। দীপা বড় হবে, তবে তো। ততদিনে বাঙালি শেষ হয়ে যাবে। সময় খুব নিষ্ঠুর।
দীপার আলাদা ঘর। পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে সীমানার ওপারে খোলা জমি দুহাত তুলে ছুটে চলে গেছে পরেশনাথ পাহাড়ের দিকে। শাল আর মহুয়ার জঙ্গল। লাল কাঁকর। হঠাৎ কোথাও বিশাল একটা পাথর। পাহাড়তল্লাট ছেড়ে সমতলে বেড়াতে এসে আর ফিরে যেতে পারেনি। দূর থেকে কে যেন ডাকে, দীপা।
মুক্তির ডাক।
দাদুর কাছে বসে রাতের বেলা দীপা বাঙালির গল্প শোনে। একশো বছরের পেছনের ইতিহাস। দাদুর ধবধবে সাদা চুলদাড়ি। বড় বড় উজ্জ্বল চোখ। সাদা পাঞ্জাবি। রূপকথার মানুষ যেন। মধুপুর থেকে গিরিডি আসার ব্রাঞ্চ লাইন পাতা হল ১৮৭১ সালে। সেই কাজের ঠিকাদারি পেয়েছিলেন হুগলি জেলার গোষ্ঠ কুণ্ডু। প্রকৃতির প্রেমে পড়লেন কুণ্ডুমশাই। তেমনই জলের গুণ। নির্মল বাতাস। গোষ্ঠবাবু গিরিডিতে জমিদারি কিনে ফেললেন। মধুপুরেও কিনলেন। এই ছোটনাগপুর অঞ্চলটার একটা মায়া আছে। মানুষকে বড় টানে। সন্ন্যাসিনীর মতো সুন্দরী। অবাঙালিরা এই গোষ্ঠবাবুকে বলত, ‘বাবু তো বাবু গোষ্ঠবাবু।’ ১৮৮২ সালে একদল জার্মান। এলেন। তখন তো জানাজানি হয়ে গেছে, গিরিডির মাটির তলায় সম্পদ আছে—তামা মাইকা উঁচু জাতের কয়লা। জার্মান সায়েবরা খোঁজ খোঁজ করে বারগান্ডায় খুঁজে পেলেন তামা। খোলা হল ‘বারগান্ডা কপার করপোরেশন’।
দাদুর কাছে সেকালের গল্প শুনতে শুনতে তার কল্পনা আরও ঘন হত। কল্পনার চোখে তৈরি হত অতীত চিত্র। দীপা সেই বিদেশিদের দেখতে পেত। শুনতে পেত পাথরে গাঁইতির শব্দ। বিদেশি বাংলোর লণ্ঠনের আলো। আদিবাসী রমণী। মহুয়ার গন্ধ। মাতাল ভালুক। আটবছর ধরে লোকসান দিয়ে নব্বই সালে জার্মান সায়েবরা কারবার গুটিয়ে ফেললেন। লোকসানের কারণ, যোগাযোগের তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। পথঘাটের অভাব। তামা পরিশোধনের জন্যে যে প্ল্যান্ট দরকার তাও বসানো গেল না। এই নব্বই সালেই বাঙালিরা এলেন। কিনে ফেললেন সায়েবদের যত বাংলো। এই বাঙালি সেটলমেন্টের নেতা ছিলেন, গিরিডির আদি বাসিন্দা তিনকড়ি বসু। তাঁরই আকর্ষণে বাঙালিরা ছুটে এলেন। তামার ব্যবসা যিনি কিনলেন তাঁর নাম জে এন দে। জে এন দে-র মেয়ে রেবা একজন নামকরা অভিনেত্রী।
এইসব শুনতে শুনতে দীপার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসত। বাংলোটা তার দাদু কিনেছেন, সেটাও এক জার্মান সাহেবের ছিল। অনেকটাই অদলবদল করা হলেও, আদলটা বিলিতি। বড় বড় ঘর, টানা বারান্দা। ঘোরাফেরা করলেই মনে হয় বেশ উদার। কোনও সঙ্কীর্ণতা নেই।
দাদু খুব মিষ্টি করে বলতেন—দিদিভাই, তোমার খুব ঘুম পেয়েছে, চোখের পাতা ভিজে আসছে।
দীপা তার দক্ষিণের কোণের ঘরে এসে শুয়ে পড়ত। পরিষ্কার বিছানা, ধবধবে মশারি। দক্ষিণের জানালা দুটো ভোলা। শুয়ে শুয়ে ভাবত, দাদুর মতো সুন্দর মানুষ যেন হয় না। চোখের পাতা ঘুমে ভিজে এসেছে। সে কেমন? ঘুম কি কোনও তরল পদার্থ! এই দাদুর কাছ থেকেই দীপা পেয়েছিল কবির মন, ভাষা, উপমা। নারকোল গাছের ঝিরিঝিরি পাতার মতো চোখের পাতা। নারকোল গাছের পাতায় যখন চাঁদের আলো পড়ে জ্যোৎস্নার রাতে। তখন মনে হয় যেন ভিজে গেছে। চাঁদের আলো যেন তরল দুধ।
জানালার দিকে পাশ ফিরে আকাশ। আকাশের গায়ে আঁকা মহুয়ার টোপা টোপা পাতা। ফুলের গন্ধ নাকে নিতে নিতে, অদ্ভুত অদ্ভুত সব কল্পনায় ভাসতে ভাসতে দীপা চলে যেত ঘুমের দেশে। ঘুমের কোনও দেশ আছে? অবশ্যই আছে। মানচিত্রে মিলবে না। কিন্তু জল আছে, হল আছে, আছে কানন-পাহাড়। বিছানায় শুয়ে ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে দীপার মনে হত, এই সময় কোনও নরম শরীর যদি তাকে জড়িয়ে ধরত। নরম শরীরের উষ্ণতা। পিঠের কাছে নরম একজোড়া বুকের ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠাপাড়া। নরম একটা জানুর তার কোমরের কাছে চেপে বসা। তার বুকের কাছে লেগে থাকা নরম একটা হাত। মুক্তো যেমন ঝিনুকের শ্লেষ্মর আবরণে মাখামাখি। হয়ে থাকে, রাতের নির্জন অন্ধকারের কোলে সেইভাবে থাকা ঘাড়ের কাছে খোপার নীচে ঠেকে থাকা একটা নাকের নরম নিঃশ্বাস। এই নেশাটা ধরিয়ে দিয়ে গেছে সেই মহিলা, যে তার ঠাকুরদার সেবা করত কলকাতার বাড়িতে। সাদা ব্লাউজ, সাদা শাড়ি। শরীরে ওষুধের গন্ধ। ঘামের গন্ধ, চুলের গন্ধ। কী একটা মশলা চিবোতো। মুখে সেই মশলার গন্ধ। পুরু দুটো ঠোঁট। জোড়া ভুরু। অন্ধকার কালো চোখ। সেই দেহের আলিঙ্গন, উত্তাপে দীপার শরীর ঘেমে উঠত। সে পাশ ফেরার সময় দীপাকে জড়িয়ে ধরেই পাশ ফিরত। দীপা তার শরীরে উপর দিয়েই। এপাশ থেকে ওপাশ চলে যেত। সে তার পিচ্ছিল ত্বকে হাত বোলাতে বোলাতে বলত, তোর স্কিন সিল্কের মতো। তোকে ছেড়ে আমি থাকব কেমন করে। এই কথা বলে সে পাগলের মতো আদর করত। তখন তাকে মনে হত নারী-পুরুষ। বিছানার চাদর কুঁচকে যেত। বালিশ ছিটকে চলে যেত খাটের বাইরে। সেই আদরের হাতে দেহ-সমর্পণ করতে দীপার খুব ভালো লাগত। মনে হত। সবটাই অন্যরকম। স্বাভাবিক নয়। একটু ভয়ের; কিন্তু খুব মজার, ভীষণ আরামের।
এই একলা ঘরে, সাদা বিছানায় শুয়ে দীপার সেই অভাববোধটা ফিরে আসত। একটা আকাঙ্ক্ষা। এপাশ-ওপাশ করতে করতে একসময় ঘুম। পাশের ঘরেই মেজোমামা। আলো জ্বলছে। কিছুটা ছিটকে গিয়ে লেগেছে গাছের পাতায়। অনেক রাত পর্যন্ত মেজোমামা লেখাপড়া করতেন। দেশ বিদেশের ডাক্তারি ম্যাগাজিন বই। এই অঞ্চলের মানুষের সাধারণ চিকিৎসায় এতটা জ্ঞানের প্রয়োজন হয়তো ছিল না। কিন্তু জ্ঞানের স্পৃহা ছিল অসীম। মানুষের শরীরই তো জটিল এক দর্শন। অদ্ভুত সব ভাবনা আসত। অনেক সময় উদ্ভট।
এমন যদি হত, হঠাৎ কোনও ভাইরাসের আক্রমণে মানুষের বাইরের আবরণটা হয়ে গেল কাচের মতো স্বচ্ছ গ্লাসকেস। ভাইরাসটার নাম যদি হয় ফ্লোরেসেন্ট ভাইরাস। ডাক্তার ধীরে ধীরে কল্পজগতে প্রয়াণ করতেন। দু-হাত দূরে বিছানায় অকাতর ঘুমে তার সুন্দরী, শিক্ষিতা স্ত্রী। ট্রান্সপারেন্ট। ডাক্তার তার অ্যানাটমির জ্ঞান নিয়ে দেখতে পাচ্ছে। কালচে লাল, থলথলে একটা হৃদয় থির থির করছে। একাধিক আবরণে আবৃত। আবরণের পাটে পাটে এক ধরনের তরল পদার্থ। বুকের খাঁচার ভিতর একটু তেরছা করে আটকানো। তলায় পরদা উপরে আবরণ। দিন নেই রাত নেই ধক ধক করে চলেছে। ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা তরল পদার্থ যেন তেলের কাজ করে। পিচ্ছিল, হড়হড়ে করে রেখেছে। ওঠাপড়ার সময় আটকে না যায়। মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতো পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, সাড়ে তিন ইঞ্চি চওড়া। মেয়েদের হার্টের ওজন আট আউন্স, ছেলেদের দশ আউন্স। চারটে নল আটকানো।
সেই নলের চেহারা মোটেই সুদৃশ্য নয়। কিড়িকিড়ি। রিং রিং। সারা শরীর ভ্রমণ করে রক্ত হার্টে ঢুকছে। স্বচ্ছ মানুষের স্বচ্ছ আবরণের অন্তরালে শরীরের যাবতীয় যন্ত্রপাতি দৃশ্যমান। একটা। ভয়। এসব কী! মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দিবারাত্র কাজ করে চলেছে। হার্টের দু-পাশে ঝিল্লির আচ্ছাদনে দুটো ফুসফুস। বিচিত্ৰদৰ্শন দুটো বেলুনের মতো। গাছের শিকড়ের মতো শিরা উপশিরা জড়িয়ে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসের নিয়মিত ছন্দে ফুলছে আর চুপসে যাচ্ছে। রক্তকণিকায় মিশছে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন। অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত লক্ষ লক্ষ শিরা-উপশিরার পথ ধরে শরীরের বিভিন্ন খণ্ডে ছুটে চলেছে। ডাক্তার তাঁর ঘোরলাগা চোখে দেখতে পাচ্ছেন। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী, কাবেরী, নর্মদা, গোদাবরী। কলস্বিনী রক্তনালিকা। মূল স্রোতধারা থেকে বেরিয়ে আসছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ধারা। বাহিকা। নীল ধমনী। মিনিটে ষাট থেকে আশি, এই হল হৃদয়ের স্পন্দন ছন্দ। সেকেন্ডে একবার অথবা একের একটু বেশি। একবার ধক করা মানেই একশো তিরিশ। কিউবিক সেন্টিমিটার রক্ত হৃদয় থেকে বেরিয়ে গেল। তার মানে মিনিটে পাঁচ লিটার রক্ত পাম্প করছে হার্ট। একজন মানুষ যদি একশো বছর বাঁচে, তা হলে এই বিশ্বস্ত ক্ষুদ্র পাম্পটি ছ-লক্ষ টন রক্ত টানবে আর ছাড়বে। চল্লিশ কোটি হবে স্পন্দন সংখ্যা। ডাক্তার নিজেই ঘাবড়ে গেলেন। বুকের বাঁপাশে বসে আছে এই অবিশ্বাস্য শক্তিশালী যন্ত্রটি। সারাদিন ঘুরছি ফিরছি, অথচ একবারও খেয়াল হচ্ছে না। কে চালায়, আমি চলি বা কেন। হৃদয় কী ভয়ংকর শক্তি তোমার। পঁয়ত্রিশ সের ওজন মাটি থেকে একফুট তুলতে আমার মাংসপেশিকে যে-শক্তি খরচ করতে হয় সেই শক্তি তুমি প্রতি মিনিটে প্রয়োগ করছ। আমার হাত আর পায়ের পেশির শক্তির চেয়ে। তোমার শক্তি দ্বিগুণ বেশি। আমি ক্লান্ত হব কিন্তু তুমি অক্লান্ত কর্মবীর। তোমার শক্তির উৎস আজও খুঁজে পায়নি শরীরতত্ববিদ।
মেজোমামা গভীর রাত পর্যন্ত নিজের ঘরে বসে বসে কী করেন দীপা জানে না। মেজোমাইমাও জানেন না। ঘুমোতে ঘুমোতে মাঝে মাঝে চোখ খুলে বলেন, ‘এ কী এখনও আলো জ্বলছে, তুমি শোওনি। কী করছ কী এখনও?’
—তুমি ঘুমোও, আমাকে বুঝতে দাও, হোয়াই আই ব্রিদ। কে আমাকে প্রথম প্রভাতে বলেছিল, বাছা শ্বাস নাও। এই আমি চালিয়ে দিয়ে গেলাম। ইচ্ছে থাক আর না থাক, এ চলবে। শ্বাসই জীবন। আমিই আবার একদিন বন্ধ করে দিয়ে যাব। তখন তোমার ধমনীতে আর এক ফোঁটাও রক্ত থাকবে না। তাজ্জব কী বাত! কোথায় গেল সব রক্ত।
—তুমি বসে বসে ওই সব ছাইপাঁশভাবো, আমি ঘুমোই।
—সেই ভালো। জানলেই তুমি পাগল হয়ে যাবে।
প্রাচীনকালের শরীরতত্ববিদদের কথা মনে পড়ে গেল ডাক্তারের। কবর থেকে মৃতদেহ তুলে এনে ফালাফালা করে দেখছেন কোথায় কী আছে। সাধারণ মানুষের চোখে তাঁরা পিশাচ। মৃতদেহ কেটে তাঁরা শরীরের ছবি তৈরি করছেন, অ্যানাটমি। হাড়ের খাঁচার রহস্য সন্ধান করছে। মাইকেল অ্যাঞ্জেলো স্কেচবুকে নকশা আঁকছেন। অধ্যাপকের গোপন ঘরে কঙ্কাল ঝুলছে। কতিপয় ছাত্র। তারা কঙ্কালতত্ব বোঝার চেষ্টা করছে। মৃত মানুষের ধমনিতে রক্ত নেই দেখে তাঁরা সিদ্ধান্ত করলেন, জীবন্ত মানুষের এই নালিকায় বাতাস থাকে। এর নাম রাখো আর্টারি। পরে যখন জ্ঞান আরও হল, জানা গেল, না, ধমনি হল এক একটি রক্ত নদী, তখন কিন্তু নামটা আর বদলানো হল না। এয়ার ট্র্যাক্ট, আর্টারিই রয়ে গেল। ডাক্তার আর ভাবতে চাইলেন না। শুয়েই পড়ি বলে স্ত্রীর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন। পাশ ফিরে শুয়ে আছে রমণীয় একটি নারী দেহ। গৌরবর্ণ তৃক। তার তলায় একপুরু মেদ, মাংসপেশি। শিরা, ধমনী, কঙ্কাল। এর কোথায় আছে প্রেম, প্রীতি, সৌন্দর্যবোধ। এ তো একটা যন্ত্র। তবু কেন তোমাকে এত ভালোবাসি। মানুষ কি তা হলে মানুষের ভিতরে নেই। মানুষের অনুভূতি কি বাইরে আছে!
নিশীথ রাতের আকাশে। নদীর বুকের উপর দিয়ে বহে যাওয়া বাতাসে। স্ত্রীর চওড়া পিঠে হাত রেখে ডাক্তার শুয়েছিলেন। আবার উঠে বসলেন ধড়মড় করে। তাকিয়ে আছেন দেয়াল ঘড়িটার দিকে। ঘড়িতে কি সমস্যার সমাধান আছে। প্রশ্ন আছে। মহা প্রশ্ন। সময় কোথায় আছে। ঘড়ির ভিতরে, না বাইরে? ঘড়ির কাঁটাদুটো আর ডায়ালের অক্ষরগুলো খুলে নিলে কী হয়। নির্বোধ টিক টিক। স্প্রিং, পিনিয়ন, হুইল, ব্যালেন্স। একটা যন্ত্রমাত্র। সময় তো আছে মহাকালের স্রোতে। সময় আছে মানুষের বেঁচে থাকার বোধে। যন্ত্র, কাঁটা, অক্ষর তিনের মিলনে সময়। ভাষাতে কি মনের ভাব প্রকাশ পাবে যদি না বোধ দিয়ে সাজানো যায়। যদি বলি, গেলাস, পাথর কাঠ। পাথরের গেলাসে মেঘের জল, তা হলে কত কী প্রকাশিত হল একই সঙ্গে। শব্দের পিছনে কণ্ঠযন্ত্র যন্ত্রমাত্র, বোধটাই সব। এই বোধ তো যন্ত্রে নেই। দেহযন্ত্রে জীবন আছে, অ্যাকশন, মোশন আছে। চেতনা কোথায় আছে, বোধ আর বোধি কোথায় আছে। জন্ম আর মৃত্যু তো মানবসভ্যতা নয়, যুদ্ধ বিগ্রহ, সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, সাহিত্য-সংস্কৃতি, নৃত্য-গীত সবই তো বোধের প্রকাশ। তা যদি না হত, তা হলে কীটেরও তো সভ্যতা তৈরি হত। নর্তকীর নৃত্য তার শরীরে আছে, না। সবোধে মুদ্রায়। তাই যদি না হবে, তা হলে পিস্টনের ওঠাপড়াকেও তো নাচ বলতে হয়।
একটা হাত ডাক্তারকে সস্নেহে বিছানায় টেনে নিল—’আর নয়, এইবার ঘুমোও। ভোর হয়ে এল। সারাটা দিন তোমার কোনও বিশ্রাম নেই।’
ডাক্তার স্ত্রীর কোলে ঢুকে যেতে যেতে ভাবছেন, এই কথাটা কে বলছে! একটা শরীর, যে শরীরের বর্ণনা আছে অ্যানাটমির পাতায়! না কখনওই না? এর উৎস অন্য কোথাও। গঙ্গা একটা নদী, হিমালয় থেকে সাগরে দিকে ছুটে চলা জলধারা। আর দেবী! সুরেশ্বরী ভগবতীগঙ্গে, সেই গঙ্গা
তো মানুষের বোধে। দীপার এই মেজোমামা দিন দিন এক অসাধারণ মানুষ হয়ে উঠতে। লাগলেন। কী যেন একটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন! অর্থ, সম্মান, ভোগ, প্রতিপত্তি নয়। একটা উত্তর খুঁজছেন। রুগি দেখতে দেখতে ভাবেন, আমার কী করার আছে। যন্ত্র যিনি চালু করেছেন তিনিই বেঁধে দিয়েছেন আয়ু। যেদিন বন্ধ হবে সেদিন বন্ধ হবে। ভিতরে কলকবজা কার নির্দেশে চলছে! তোমরা জানো না, তোমাদের ভিতরে কী আছে! পেট একটা ল্যাবরেটারি, দুটো ফুসফুস তোমার হাপর, হার্ট শক্তিশালী এক পাম্প, কিডনি বিশাল এক ছাঁকনি, আর মস্তিষ্ক তোমার ব্রহ্মাণ্ড, ঘাড়ের পেছনে চেতনার ‘কেবল লাইন’। এসব আমরা ডিসেকট করে জেনেছি; কিন্তু জানতে পারিনি প্রথম শ্বাস তুমি কার ইচ্ছায় নিলে। ডাক্তার রুগি দেখেন, ভিজিট নিতে পারেন না। কার ডাক্তারি কে করে!
ডাক্তারের কেবলই মনে পড়ে জেনেসিসের কাহিনি। হয়তো সেইখানেই আছে তাঁর প্রশ্নের উত্তর।
এই জগকারণের পিছনে আছে এক ইচ্ছাশক্তি। লেট দেয়ার বিলাইট, অ্যান্ড দেয়ার ওয়াজ লাইট, অ্যান্ড ইট ওয়াজ গুড। মহা মহা অন্ধকার শূন্যে কে যেন ফিশফিশ করে বললেন, তমসো মা জ্যোতির্গময়। আলো আমার আলো। আলোয় ভুবন ভরে গেল। শতকোটি সূর্যের দীপ্তি। দিনের সূর্য, রাতের নক্ষত্র। জল, স্থল। সমুদ্র, নদী। প্রাণ, প্রাণী, লতাগুল্ম, স্থলচর, নভোচর। সৃষ্টির ষষ্ঠ দিবসে তৈরি করলেন শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। পৃথিবীর ধুলো থেকে পরম যত্নে। নিজের সামনে তাকে শোয়ালেন। তখনও নিষ্প্রাণ। দেন হি হিমসেলফ ব্রিদভ দিব্রদ অফ লাইফ ইনটু ইট। নাকের ছিদ্রপথ দিয়ে ঢুকিয়ে দিলেন প্রাণবায়ু। চোখ মেলে তাকাল প্রথম মানব। সেই এক আজ কোটি কোটি অনন্ত যাত্রাপথ।
দীপাকে বললেন, ‘এই নে পড়। জোরে জোরে। আমাকে শোনা।’
রবীন্দ্রনাথ। ‘মহাস্বপ্ন’। দীপা পড়ছে, তিনি শুনছেন চোখ বুজিয়ে।
পূর্ণ করি মহাকাল পূর্ণ করি অনন্ত গগন,
নিদ্ৰাময় মহাদেব দেখিছেন মহান স্বপন।
বিশাল জগৎ এই প্রকাণ্ড স্বপন সেই,
হৃদয়সমুদ্রে তাঁর উঠিতেছে বিশ্বের মতন।
উঠিতেছে চন্দ্রসূর্য, উঠিতেছে আলোক আঁধার,
উঠিতেছে লক্ষ-লক্ষ নক্ষত্রের জ্যোতি-পরিবার।
উঠিতেছে, ছুটিতেছে গ্রহ উপগ্রহ দলে দলে,
উঠিতেছে, ডুবিতেছে, রাত্রিদিন আকাশের তলে।
একা বসি মহাসিন্ধু চিরদিন গাইতেছে গান,
ছুটিয়া সহস্র নদী পদতলে মিলাইছে প্রাণ।
দীপা দেখত মেজোমামার চোখ বেয়ে জল নামছে। দেহ স্থির। সবটা শোনার পর চোখ চেয়ে বলতেন, ‘বুঝলি, রবীন্দ্রনাথের সত্যদর্শন হয়েছিল। যত পড়বি, তত আনন্দ পাবি।’
মেজোমামা দীপাকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কোনও সময় কাছছাড়া করতেন না। বলতেন, ‘তোর মধ্যে আমি একটা অন্য জগৎ তৈরি করে দিয়ে যাব। শুয়ে শুয়ে ভাববি, তোর গায়ে সবুজ ঘাস গজিয়েছে, বিশাল এক গাছের শিকড় তোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। নদী বয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তুই হয়ে গেছিস আকাশ। সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ফুটে আছে সেই আকাশে।’
দীপাকে তিনি ভর্তি করে দিলেন রবীন্দ্রসংগীত শিক্ষার ক্লাসে। গিরিডিতে তখন বড় বড় মানুষের বাস। রবীন্দ্র বাতাস। ব্রাহ্মসমাজ। ব্রাহ্মমন্দির। উপাসনা। ঈশ্বরকে মানুষ তিনভাবে ধরতে চায় —গুণ সাকার, সগুণ নিরাকার, নিগুণ নিরাকার। ব্রাহ্মবাদে তিনি সগুণ নিরাকার। অখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা তুমি। মেজোমামা দীপাকে নিয়ে ব্রাহ্মসমাজে যেতেন। তিনকড়ি বসু ছিলেন। আদি বাসিন্দা। তিনিই গড়ে তুলেছিলেন এই বাঙালি উপনিবেশ। কলকাতা থেকে যেসব বিশিষ্ট বাঙালি এখানে এসেছিলেন, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। নববিধান আর সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ দুটি ভিন্ন উপাসনা মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মেজোমামা দীপাকে নিয়ে নববিধানে যেতেন। পরিবেশটা দীপাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। মহুয়ার বাতাস। শাল, সেগুনের প্রহরা। বোগেনভেলিয়ার বর্ণ বিস্ফোরণ, গোলাপের আভিজাত্য। এর মাঝে সুসংযত, শিক্ষিত নারী-পুরুষের মিলন। সবাই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সারস্বতচর্চাই তাঁদের ধ্যানজ্ঞান। স্বয়ং। রবীন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে অবসর কাটাতে চলে আসতেন বারাগাণ্ডায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের সেই বোলবোলা দীপার সময়ে স্তিমিত হয়ে এলেও কিছুটা ছিল। মন্দির জীর্ণ। বাইরের দেয়ালে সময়ের শ্যাওলা। উপাসনা কক্ষে ধুলো আর ঝুল। কাঠে আর পালিশের জেল্লা নেই। তবু মিলন। অতীতকে ধরে রাখার চেষ্টা। এইখানেই মাঘ মাসের সন্ধ্যায় একজনের সুরেলা কণ্ঠে দীপা শুনেছিল ব্রহ্মসংগীত। মোহিত হয়ে গিয়েছিল। মেজোমামা কানে কানে বলেছিলেন, গানটির লেখক বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই সংগীতের পথে দীপা এক অন্যজগতে চলে গিয়েছিল। যে জগৎ ছিল তার মেজোমামার, পরে দীপা ওই গানটি শিখেছিল সুরমাদির কাছ থেকে। ওই গানটিকেই সে করতে চেয়েছিল তার জীবনের টাইটেল মিউজিক।
অসীম রহস্য মাঝে কে তুমি মহিমাময়!
জগৎ শিশুর মতো চরণে ঘুমায়ে রয়।
এই গানের আসরে সময় পেলেই বড়মামাও এসে যোগ দিতেন। সেজন্যই হয়তো চলে এসেছেন তাঁর অভ্রের কারখানা থেকে। সেখানে একটা বিশাল পালভারাইজার আছে। একপাশে একা দাঁড়িয়ে আছে খাণ্ডোলি পাহাড়। একটু দূরেই একটা লেক। নীলজলে ভাসছে আকাশের ছবি। সেখানে সারাদিন যন্ত্রে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে অভ্রের পাত। কারখানার বাতাসে ভাসছে অভ্রের রেণু। বড়মামার চুলে, জামা চিকচিক করছে অভ্রের কুচি, যেন জড়োয়ার মানুষ। বড় বড় চুল। বড় বড় টানা টানা চোখ। জীবনের নেশাদুটো—অভ্র আর সাহিত্য। ইংরেজিটা ভীষণ ভালো জানেন। প্রবন্ধ লেখেন, রম্যরচনা লেখেন। গান ভালোবাসেন, ভালোবাসেন কবিতা।
বড়মামা এলেই আসর যেন আরও জমে উঠত। গানের সঙ্গে গলা মেলাবার চেষ্টা করতেন। গানের এক-একটা লাইন শুনে, ‘আহা আহা’ করে উঠতেন। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলতেন, ‘কী রিয়েলাইজেশান দেখেছিস! বসে আছি পৃথিবীতে, তুলে নিয়ে যাচ্ছেন মহাবিশ্বে। রবীন্দ্রনাথ ইজ রবীন্দ্রনাথ।’ মাথা হেঁটে করে বসে থাকতেন। ভাবের ঘোরে দুলতেন। সারা শরীরে লেগে থাকা অভ্রের রেণু চিকচিক করত। মনে হত জীবন্ত দেবতা, এইমাত্র ভক্তির অঞ্জলি নিয়ে এসে। বসেছেন। দুই মামা পাশাপাশি বসে আছেন। এ ওর গায়ে হেলান দিয়ে। এদিকে একের পর এক গান চলেছে। দীপার মাঝে মাঝে মনে হত পৃথিবীটা কি সত্যিই এত সুন্দর! এত মিল, এত ভালোবাসা! দুই মাইমার একসঙ্গে ওঠা-বসা। ঋষির মতো দাদু। ছবির মতো সাজানো বাড়ি! সব কিছু ঝকঝক করছে, যেন এই মাত্র কেনা হল। নিখুঁত বাগান। লন। রোদ ছাতা। তার বাড়িতে সব কিছু আছে, বেশি বেশি আছে, যত্ন নেই। কাজের লোকগুলি শয়তান। একটা এলোমেলো, বীভৎস, দুর্গন্ধী সংসার। লেখাপড়ার বালাই নেই। গান-বাজনার ধার ধারে না কেউ। টাকা, খাওয়া, ঘুম আর ঝগড়া। দীপা একদিন দাদুকে জিগ্যেস করেছিল, অমন একটি বাড়িতে মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন কেন? দাদু স্বীকার করেছিলেন, ‘জীবনের হিসাব ওই একটা ব্যাপারেই ভুল হয়ে গিয়েছিল। পয়সাটাই দেখেছিলুম, কালচারটা দেখিনি।’
মেজোমামা একদিন দীপাকে বললেন, ‘চল দীপা আজ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব। সেজেগুঁজে রেডি হয়ে নে। আমি গাড়িটা বের করে আনি।’
প্রথম শীতের মিষ্টি দুপুর। দীপা এসেছিল ছন্নছাড়া চেহারা নিয়ে। সেই চেহারায় লালিত্য এসেছে। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। সে এখন হাসতে পারে, অভিমান করতে পারে। তার চারপাশে এখন ভালোবাসার অনেক লোক। মুখভার করে থাকলে তুলি এসে কাতুকুতু দেয়। মাইমারা ছুটে এসে জানতে চায় শরীর খারাপ কি না। দিদা এসে চুলের পরিচয্যা করেন। দাদু বলেন মজার মজার কথা। দীপা তার জীবনের মূল্য ফিরে পেয়েছে। দীপা দীঘল হয়েছে।
গাড়ি এসে গেল। দীপা সামনের আসনে মেজোমামার পাশে গিয়ে বসল। প্রশ্ন করল, কোথায় যাবে। রাস্তার দুপাশে বড় বড় নামকরা মানুষদের বাড়ি। হেরম্বচন্দ্র মৈত্রের ‘কমল-আবাস’। উলটোদিকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের ‘মহুয়া’, সেকালের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেশচন্দ্র। সরকারের ‘উপলপথ’। ডাক্তার নীলরতন সরকারের ‘মাঝলা কুঠি’। যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘গোল কুঠি’। এই ‘গোল কুঠি’-র কাছে এলেই দীপার মনটা কেমন হয়ে যায়। সেই বিখ্যাত লেখক হারাধনের দশটি ছেলে। কোন ছেলেবেলায় দীপা পড়েছিল। গাড়ি জনপদ পেরিয়ে ফাঁকা মাঠে এসে পড়ল। বড়মামা বেশ বলেন, মাঠ যেন দু-হাত তুলে ছুটতে ছুটতে আকাশের কোলে গিয়ে পাথর হয়ে গিয়েছে। সত্যিই তাই, বহুদূরে কোথাও টিলা দেখলে মনে হয়, একটা শিশু আকাশের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
জঙ্গল শুরু হল। মাঝখান দিয়ে রাস্তা। দুপুরবেলাতেও ঝিঝির ডাক। দুটো কান ঝমঝম করছে। শাল, সেগুন, মহুয়া, বট, অশ্বখ। ফাঁকে ফাঁকে রোদ নেমেছে। গাড়ি কখনও উপরে উঠছে কখনও নামছে নীচে। ঢালুতে নামার সময় মেজোমামা স্টার্ট বন্ধ করে দিচ্ছেন। বৃষ্টির জলে রাস্তার দু পাশে ক্ষয়ে ক্ষয়ে গিয়েছে। নালা তৈরি হয়েছে। একটু অসাবধান হলেই গাড়ি পাশ ফিরে শুয়ে পড়বে।
মেজোমামা জিগ্যেস করছেন, ‘কি রে দীপা, তোর ভয় করছে?
‘একটুও না। ভীষণ ভালো লাগছে।’
‘দেখছিস তো, ভয়ের মধ্যেও একটা ভালো লাগা থাকে। যেমন ধর কালো। কালোর মধ্যে কিন্তু সব রং আছে।’
রাস্তা শেষ। মেজোমামা গাড়ি রাখলেন। সামনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সঁড়িপথ চলে গিয়েছে। বেশ ঠান্ডা। শীতের কনকনে বাতাস। শুরু হল পায়ে হাঁটা। দুপাশে বড় বড় পাথর। পথও পাথরে। উঁচু-নীচু। জায়গায় জায়গায় মারাত্মক রকমের ঢালু। একটু অসাবধান হলেই গড়িয়ে পড়ে যেতে হবে। এত গাছ! দীপার চোখ যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। পৃথিবী কী ভয়ংকর রকমের উর্বর। জমির এত প্রাণ। মেজোমামা হঠাৎ গান ধরলেন,
প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।
তব ভুবনে তব ভবনে
মোরে আরো আরো আরো দাও স্থান।
দীপা অবাক হয়ে গেল, মেজোমামার এত সুন্দর গলা! ‘তুমি গান গাও না কেন?’
‘গান!’ মেজোমামা একটা বড় পাথরের ওপর বসে পড়লেন, ‘গান!’ দু-চোখে জল টলটল।
‘তুমি কাঁদছ কেন?’
‘তোর মা এই গানটাই এখানে গেয়েছিল এইরকম এক শীতের বেলায়। তার মাকে ওরা মেরে ফেলল। তোর মায়ের গান শুনলে তুই পাগল হয়ে যেতিস। মাকে মনে পড়ে?
‘খুব আবছা।’
‘আয়নার সামনে দাঁড়ালে তুই তোর মাকে দেখতে পাবি। অবিকল তোর মতো।’
মেজোমামা একটুক্ষণ থমকে থেকে বললেন, ‘তোর মা তোরই মতো ফিকে হলুদ রং পছন্দ। করত। তোরই মতো ধীর, শান্ত। তোরই মতোনীচু গলায় কথা বলত। লাজুক লাজুক মুখে তাকিয়ে থাকত। কখনও কিছু চাইত না। একেবারে ঠিক আমার মায়ের মতো স্বভাব। বাড়িতে আছে কী নেই বোঝা যায় না।’
চারপাশে গভীর অরণ্য। ঝিল্লির রব। পাতা ঝরে পড়ার খসখস শব্দ। দীপার মেজোমামা টিলার উপর বসে আছেন। পায়ের পাশ দিয়ে লেজ খাড়া করে চলে যাচ্ছে শুকনো গিরগিটি। আশ্চর্য। একটাই, কোথাও কোনও পাখি ডাকছে না। মেজোমামা মুখ তুলে বললেন, ‘দীপা পেছনে থাক। সময়ে পিছিয়ে যা। দশ বছর, বারো বছর, পনেরো বছর। তোর মা বসে আছে এই টিলার উপর। আমি তোর মায়ের পায়ের কাছে। ওইখানটায় বসে আছে দাদা। বাবা আর মা পাশাপাশি। আমার পাশে বউদি। তোর মেজোমাইমা তখনও আসেনি জীবনে। কলেজে পড়ছে। দৃশ্যটা দেখার চেষ্টা কর। এই পাথরে তার স্পর্শ লেগে আছে। সেই সময়ে যে-গাছগুলি ছিল চারা আজ তারা বিশাল সাবালক। একজন ছিল, এখন নেই, কিন্তু তার না থাকাটাকে অনেকে ধরে রেখেছে। সে না থেকেও আছে। বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা! নেইটাকেও কাঁধে নিয়ে পৃথিবী এগোচ্ছে।’
দীপা অবাক হয়ে মেজোমামার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এত সব বোঝার বয়স তার হয়নি, তবু মনে হল এইসব কথার মধ্যেই আসল কথা আছে। মেজোমামা তাকে বাইরের ঘর থেকে ভিতরের ঘরে নিয়ে যেতে চাইছে। সেদিন রাতে স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা থেকে মদালসার কাহিনি শোনাচ্ছিলেন। মদালসা রানি হয়েছেন। রাজাকে বলেছেন আমার সংসার। করতে আপত্তি নেই কিন্তু একটি শর্ত যে সন্তান মানুষ করবার ব্যাপারে তুমি কোনও বাধা দিতে পারবে না। রাজা বললেন, বেশ তাই হোক। তোমার শর্ত মেনে নিলুম। জন্মের পর থেকে। মদালসা শিশুকে দোলনায় দোল দেন আর বলেন, ‘ত্বমসি নিরঞ্জন!’ —তুমি শুদ্ধ, নিরঞ্জন আত্মা।
এতে কী লাভ?
মহা লাভ, আবাল্য শিশুর সংস্কার গড়ে উঠল যে সে নিরঞ্জন।
নিরঞ্জন মানে?
কলঙ্কহীন, নির্মল, শিব। সংসার তোমাকে কাবু করতে পারবে না। রোগ, শোক, দুঃখ, জরা বাইরে দিয়ে চলে যাবে, যেন ফেরিঅলা হেঁকে যাচ্ছে। এই গল্পটা তোকে কেন শোনাচ্ছি, যাতে তোর মনেও এইরকমই একটা সংস্কার তৈরি হয়।
আজ এই নির্জন বনে একটা শিলার উপর বসে মেজোমামা এমন কিছু বলছেন যা অনেক দূরের কথা। মানুষের ভিতরটাকে অন্যরকম করে দেয়। ভিতরে একটা চাপা দুঃখ তো আছেই, একটা অভাববোধ। নিজের বাড়ি আর মামার বাড়িতে একটা তফাত তো থাকবেই। যদিও তুলির সঙ্গে তার কোনও পার্থক্যই মামারা রাখেনি, তবু নিজের মন থেকে সে যে পরের বাড়ির মেয়ে, ওই বোধটা একেবারে যায়নি। নিজের বাবার কথা ভেবে কুঁকড়ে যায়। না দেখতে আসুক, না আসুক, এক পক্ষে ভালো, কিন্তু একটু ভেবে দেখলে মনে হয় দীপাকে ফুটপাথে ফেলে দিয়ে তিনি অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে মজা করতে চলে গিয়েছেন। এমন বাবার পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে?
‘নাঃ, তোর মনটা খারাপ করে দিলাম, নে চ, আরও কিছু দূর যেতে হবে।’
মেজোমামা উঠে পড়ে হাঁটতে লাগলেন। এবার ধরেছেন অন্য গান। সেই অপূর্ব সুরেলা গলা। গাছের পাতায় উতলা বাতাসের মাখামাখি। মেজোমামা গাইছেন :
আর কত দূরে আছে সে আনন্দধাম।
আমি শ্রান্ত, আমি অন্ধ, আমি পথ নাহি জানি।।
রবি যায় অস্তাচলে আঁধারে ঢাকে ধরণী
করো কৃপা অনাথে হে বিশ্বজনজননী।।
এই গান দীপাব্রাহ্মসমাজে শুনেছে। মেজোমামা তার চেয়ে ভালো গাইছেন। কানে আর একটা নতুন শব্দ আসছে, জল পড়ার শব্দ। অজস্রধারায় কোথাও জল পড়ে চলেছে। ঢালু পথ বেয়ে তারা নামছে। বনের মধ্যেই বড় টেবিলের মতো খোলা একটা জায়গা। অল্প অল্প ঘাস, বড় ছোট পাথর, রোদ, আর সামনেই ত্রিধারায় নামছে জলপ্রপাত। বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে। নেমে নেচে আসছে জলধারা। হেসে কলকল, গেয়ে খলখল, তালেতালে দিয়ে তালি। বাঁ দিক। থেকে পাথরের আড়ালে আড়ালে দামাল এক বালিকার মতো ছুটে আসছে একটি ধারা। প্রখর তেজ। জল ছিটকে ছিটকে উঠছে। মূল ধারাটি নামছে সামনে। উপরের একটা চাতাল ধরে। হরিনাম সঙ্কীর্তনের দলের মতো খোল-করতাল বাজিয়ে ছুটে সে কিনারা বেয়ে ঝরে পড়ছে। অবিরল ধারায়। আর একটি ধারা নামছে একেবারে অন্যপথে। অনেকটা নীচে তৈরি হয়েছে। গভীর একটি হ্রদ। সেই হ্রদ উপচে ডান দিকের শিলাপথ ধরে বয়ে গিয়েছে নদী, তার নাম উশ্রী। এই উশ্রীকে নিয়েই কবি সুনির্মল বসু লিখেছেন,
মনে পড়ে অতীতের স্মৃতি অনাবিল
উশ্রী নদীর জল করে ঝিলমিল
আমলকী বনে বনে ছায়া কাঁপে ক্ষণেক্ষণে
শিরশির করে উঠে ‘শিরশিয়া ঝিল’!
কবি সুনির্মলের বাড়ি দীপা দেখেছে। সামনে মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার বাড়ি। লম্বা লম্বা সিঁড়ি। পিছনেই পশুপতি বসুর ছোট্ট একতলা। বড় বড় কাঁঠাল গাছের ছায়ায় আশ্রমের শান্তি। কবির বাস এইখানেই।
মেজোমামা একটা চ্যাটালো পাথরে ধ্যানাসনে বসে দীপাকে ডেকে বললেন, ‘বোস এখানে, প্রকৃতি দেখ। প্রকৃতির সর্বত্র পরমেশ্বরের আনন্দের প্রকাশ। ঝরনার মতো উপছে পড়েছে। জায়গাটা তোর ভালো লাগছে না?
‘ভীষণ ভালো লাগছে মেজোমামা। মনে হচ্ছে এইখানেই থাকি আর কোথাও যাব না।’
‘তাহলে একটা গান শোন।’
মেজোমামা গাইতে লাগলেন,
‘আমি কান পেতে রই ও আমার আপন হৃদয় গহন-দ্বারে বারে বারে
কোন গোপনবাসীর কান্নাহাসির গোপন কথা শুনিবারে বারেবারে।।
ভ্রমর সেথা হয় বিবাগী নিভৃত নীল পদ্ম লাগি রে,
কোন রাতের পাখি গায় একাকী সঙ্গীবিহীন অন্ধকারে বারেবারে।।
দীপা আর থাকতে পারল না। সেও গলা মেলাল। সামনে কলকল ঝরনা। একসময় মনে হল। দীপা প্রকৃতির সঙ্গে এক হয়ে গিয়েছে। আমি আকাশ হয়ে গিয়েছি। নীল নীল বাতাসের অনিবার ছোটাছুটি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত পবিত্রতার তরঙ্গ খেলছে। দেহের সমস্ত দুয়ার খুলে গিয়েছে। পাখি উড়ে যাচ্ছে ডানা মেলে। দীপার চোখে জল এসে গিয়েছে। এত সুখ শেষপর্যন্ত থাকবে তো! তার কানের কাছে সবাই ঘণ্টার মতো বাজিয়ে গিয়েছে ঘোষণা, মেয়েটা অপয়া। দুর্ভাগা। অনেকে শরীরের লক্ষণ মিলিয়ে তার জাত ঠিক করেছে, পদ্মিনী। শঙ্খিনী নয়, হস্তিনী নয়, পদ্মিনী। এ মেয়ের সংসার হবে না। তখন দীপার হয়ে বলার কেউ ছিল না।
অঝোর ঝরনার মতো মেজোমামা অঝোরে গেয়ে চলেছেন। একসময় গান থামিয়ে বললেন, ‘চল, এইবার সাধুর ডেরায় যাই।’
বাঁদিকে একটা ভয়ংকর বিপজ্জনক সঁড়িপথ সোজা উপর দিকে উঠে গিয়েছে। বড় বড় পাথর। কোনওটা আলগা হয়ে ঝুলছে। দু-পাশে ঝোপঝাপ। খুব সাবধানে দুজনে উঠছে। অনেকটা ওঠার পর চাতালের মতো একটা জায়গা। সেখানে পাথরের উপর পাথর সাজিয়ে একটা কুঠিয়া। খুব নীচু হয়ে ঢুকতে হয় এইরকম একটা দরজা। চারপাশে পাথর ছড়িয়ে একটা বেদি। উশ্রীতে পাথরের অভাব নেই। একেবারে পাশ দিয়ে লাফাতে লাফাতে ফুটতে ফুটতে নীচের দিকে গড়িয়ে নামছে ঝরনার একটি শাখা। বাঁপাশে বিশাল একটা তেঁতুল গাছ। তার তলাতে বেদি।
মেজমামানীচু হয়ে কুঠিয়ায় ঢুকলেন। পিছনে দীপা। ভিতরটা অন্ধকার অন্ধকার। কম্বল বিছানো। তার উপর বসে আছেন শীর্ণকায় এক সাধু। পরিধানে গেরুয়া। সামনে একটা স্লেট পেনসিল। মেজোমামাকে দেখে সাধু স্লেটে লিখলেন, ওয়েলকাম।
মেজোমামা পাথরের উপর বসলেন, পাশেদীপা। মেজোমামা বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ দীপাকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমার ভাগনী।’
সাধু হাসলেন। দীপার মনে হল, হাসিটার জাত আলাদা। ছেলেমানুষের অকারণ আনন্দের হাসির মতো। শরীর শীর্ণ হলেও প্রদীপ্ত মুখ, উজ্জ্বল চোখ। তাকিয়ে আছেন অথচ দেখছেন না কিছুই। এইরকম একটা ভাব। সুদূর দৃষ্টি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি হয়।
মেজোমামা বললেন, ‘একটা-দুটো কথা জিগ্যেস করতে পারি?
সাধু ঘাড় দুলিয়ে বোঝাতে চাইলেন, ‘পারো’। মেজোমামা প্রশ্ন করছেন মুখে সাধু উত্তর দিচ্ছেন স্লেটে লিখে ইংরেজিতে। দীপা পাশে বসে শুনছে আর দেখছে।
মেজোমামা প্রথমে জানতে চাইলেন, ‘মানুষ কী চায়?’
উত্তর এল, ‘মানুষ প্রথমে চায় বাঁচতে। তারপর সে ভালো যা কিছু পায়, অর্থাৎ সে নিজে যা কিছু তার পক্ষে ভালো মনে করে, সেইটাই আরও বেশি করে চাইতে শেখে। যেমন টাকা পেলে আরও আরও টাকা পেতে চায়। বিষয়-সম্পত্তি পেলে আরও পেতে চায়। যশ-খ্যাতি পেলে আরও পেতে চায়। আগে সে পায়, তারপর সেই পাওয়ার ফল দেখে সে চাইতে শেখে। সবার আগে সে চায় বাঁচতে। আগে জীবন দিয়ে সে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খোলে। সেইটাই তার মিনিমাম ব্যালেন্স। সেইটাকে বজায় রেখে তারপর যত কিছু সঞ্চয়ের ভাবনা।’
‘মানুষ দুঃখও কি চায়?’
‘ওটা চাইতে হয় না, আপনিই আসে। টাকার কি একটা পিঠ? দুটো পিঠ নিয়েই টাকা। টাকা চাইলে এপিঠ-ওপিঠ দুপিঠই তোমার কাছে আসবে। সুখের উলটো পিঠেই আছে দুঃখ। এটাকে চাইলেই ওটা এসে যাবে। যেমন ফুল চাইলে ফুলের গন্ধ আসবে। ভ্রমর চাইলে তার গুঞ্জন। আসবে। শিশু চাইলে তার ক্রন্দন আসবে। পাখি চাইলে গান আসবে। সাপ চাইলে তার ছোবল আসবে। টাকার সঙ্গে ট্যাক্স আসবে। ছাতার সঙ্গে ছায়া আসবে। রোদের সঙ্গে গরম আসবে। বন্ধুর সঙ্গে শত্রু আসবে। বরফের সঙ্গে শীতলতা আসবে। বাতাসের সঙ্গে ধুলো আসবে। আগুনের সঙ্গে দাহিকা শক্তি। জলের সঙ্গে আর্দ্রতা। কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা। পুরুষের সঙ্গে প্রকৃতি। যুগলে আছেন। দুঃখ, যন্ত্রণা মানুষ চায় না। কিন্তু সহ্য করতে শেখে। এই সহ্যের শক্তিটা মানুষের মধ্যেই আছে। ভোগে মানুষ খরচ করে, সহ্যে মানুষ অর্জন করে। দুটো দরজা। ভোগের দরজা। দিয়ে শক্তি বেরিয়ে যায় আর সহ্যের দরজা দিয়ে শক্তি ঢোকে।’
‘আমার কাছে এটা খুব পরিষ্কার হল, এখন আমাকে বলুন, এরই মাঝে পরমানন্দে কীভাবে বাঁচা যায়?’
‘গ্রহণ করতে শিখুন। দুঃখ এবং সুখ, শান্তি এবং অশান্তি, অসুখ এবং আরোগ্য দুটোকেই। সমানভাবে নিতে শিখুন। জয় এবং পরাজয় দুটোতেই অবিচলিত থাকুন। জীবন যখন যা কুড়িয়ে পাচ্ছে তখন সেইটাকেই পরম প্রাপ্তি বলে মেনে নিতে শিখুন। তাহলেই আনন্দ। গেল গেল, হল না, হল না, ওর হল আমার হল না এই ভাবটাই নিরানন্দের কারণ। বৃষ্টিতে ভিজতে হবে, রোদে পুড়তে হবে, শীতে কুঁকড়ে থাকতে হবে—এইটাই সত্য। এইটা দর্শন করার নামই সত্য দর্শন। এইটাকে অতিক্রম করার সাধনাই হল যোগ। আর এই যোগ অভ্যাস করাই হল সাধনা। কোনও কিছু আশা না করাটাই হল শ্রেষ্ঠ করা। যা পাওয়া যায় সেইটা পাওয়াই হল শ্রেষ্ঠ পাওয়া।’
মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘আমরা এত ভয় পাই কেন?’।
সাধু লিখলেন, ‘ভয় পেতে শেখানো হয়েছে বলেই ভয় পাই। সমস্ত ভয়ের পিছনেই আছে মৃত্যু চিন্তা। মৃত্যুকে বন্ধু করতে পারলেই ভয়কে জয় করা যায়। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানোটাই আতঙ্কের।’
‘আমি কোন পথে চলব?’
‘পথ বলে কিছু নেই। সবটাই প্রান্তর। চলার চেয়ে স্থির থাকার চেষ্টাই ভালো। পাথর যত গড়ায় ততই তার ক্ষয় হয়। শ্যাওলা ধরে না। জ্ঞানের শ্যাওলা ধরাতে হলে স্থির থাকতে হবে। পথ পড়ে থাকে। মানুষই চলে চলে ক্লান্ত হয়। বিচারের পথই শ্রেষ্ঠ পথ। নিজেকে জানাই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। যে সাধু হবে সে সাধুই হবে। যে ভোগী হবে সে ভোগীই হবে। যে চোর হবে সে চোরই হবে। যার যা পথ সে সেই পথেই যাবে। এ নিয়ে অকারণ ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই।’
‘তাহলে মানুষের চেষ্টা বলে কিছুই থাকবে না?’
‘অবশ্যই থাকবে। আমি যা নই সেইটা ভাবার চেষ্টা করাই চেষ্টা। নিজের স্বরূপটাকে ধরার চেষ্টাই চেষ্টা। ধরতে পারলেই শান্তি।’
‘তাহলে মানুষ ভালো হবে কী করে?’
‘যে ভালো হবে সে ভালো হবে, যে খারাপ সে খারাপই হবে। গেরুয়ার তলায় ভোেগী লম্পট থাকতে পারে। স্বভাব পোশাকে নেই মনে আছে। ভদ্রলোকের পোশাকে ইতরও ঘুরতে পারে।’
‘আপনি আমাকে বদলে দিন।’
‘বদলানো যায় না। যে বদলাবার সে নিজেই বদলে যায়। কুঁড়ি নিজে থেকেই ফুল হয়। শুঁয়োপোকা নিজে থেকেই প্রজাপতি হয়। মানুষ যদি রূপান্তর চায় তাকে প্রার্থনা করতে হবে। গুরুর কিছু করার ক্ষমতা নেই। কৃপা ছাড়া কিছু হয় না।’
মেজোমামা সব শেষে বললেন, ‘এই মেয়েটিকে একটু আশীর্বাদ করবেন।’
সাধু ইশারায় দীপাকে কাছে ডাকলেন। দীপা ভয়ে ভয়ে কাছে এগিয়ে গেল। এমন সাধু সে কখনও দেখেনি। কোনও মন রাখা কথা নেই। সব প্রশ্নেরই কাটা কাটা উত্তর। সাধুর শরীর থেকে সুন্দর সাত্বিক একটা সুবাস বেরোচ্ছে। দীপার মাথায় হাত রাখতেই একটা শক্তির তরঙ্গ খেলে। গেল শরীরে। দীপা কেমন যেন হয়ে গেল। মনটা সেই মুহূর্তে হয়ে গেল ভোরের আকাশের মতো। সাদা একটা পাখি চক্কর মারছে ডানা মেলে। কেমন যেন শীত শীত করছে। দুঃখও নয় সুখও নয় ভারমুক্ত একটা অনুভূতি।
সব শেষে সাধু লিখলেন, ‘এই মুহূর্তে তোমার যদি কোনও অনুভূতি হয়ে থাকে আর তা যদি তোমার ভালো লেগে থাকে, সেই অনুভূতিকে তুমি দীর্ঘস্থায়ী করার চেষ্টা করতে পারো। এর জন্য প্রয়োজন পবিত্র জীবন।’
দীপাকে খুব সহজ উপমায় সাধুবুঝিয়ে দিলেন, দেহের আকাশ হল মন। চিন্তা হল মেঘ।
একেবারে মেঘশূন্য নির্মল মনাকাশ সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। দেখতে হবে মেঘের রং যেন সাদা থাকে। ধারণাই হল সূর্য। সেই ধারণার দীপ্তিতেই মেঘ সাদা হয়, সোনালি হয়। শুভ্র। চিন্তাকে ধারণা করো। ইন্দ্রিয়ের জানালা দিয়ে জগতকে দেখোনা। উপরের জানালা, স্কাইলাইট দিয়ে দেখো। উঁচুতে উঠতে পারলে মানুষ অনেকটা দূর দেখতে পায়। দি সেম আই সে টু মাই ডক্টর।
মেজোমামা কুঠিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগে সাধুর সামনে মাথাটা নীচু করে দিয়ে বললেন, ‘টাচ মি।’
সাধু স্লেটে লিখলেন, ‘আজ উলটোটা হোক। আপনি আমাকে স্পর্শ করুন। দেখি কি ভাইব্রেশন আসে।’
মেজোমামা স্পর্শ করলেন। হাত রাখলেন সাধুর ব্রহ্মতালুতে। হাত যেন ম্যাগনেট আটকে রইল বহুক্ষণ। সাধু বসে আছেন চোখ মুদে, স্থির। বেশ কিছুক্ষণ থাকার পর মেজোমামার হাত খুলে গেল। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সাধু হাসলেন। মেজোমামা হাসলেন।
সূর্য অস্ত নেমেছে। অক্লান্ত, অফুরন্ত উশ্রী লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। ডুরে শাড়ি পরা চপলা বালিকার মতো। আকাশের রঙে দিবাবসানের রহস্য জমছে। দূরের গাছ শাখা-প্রশাখার খুঁটিনাটি হারিয়ে শুধুমাত্র একটি আকারে পরিণত হচ্ছে। বিশাল বিশাল শিলাখণ্ড যেন আরও ভারী হয়ে উঠছে। নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলার ভয়ে পাখিরা আর শব্দ করছেনা। ইঞ্জিন বন্ধ গাড়ি নিঃশব্দে। গড়িয়ে চলেছে ঢালুপথ বেয়ে। মেজোমামা স্টিয়ারিং-এ স্থির। পাশে বসে আছে দীপা।
গাড়ি খাড়াইতে উঠবে। ইঞ্জিনে ইগনিসনের শব্দ। যন্ত্রের শক্তি গর্জন করে উঠল।
দীপা বলল, ‘মেজোমামা, এসো না, আজ রাতটা আমরা এইখানেই থেকে যাই।’
‘আমারও তো ওইরকম ইচ্ছে করে, ওই তেঁতুলতলায় সাধুর কুঠিয়ার কাছে সারারাত বসে থাকব ধুনি জ্বালিয়ে। মাথার উপর পিচ কালো আকাশ। তারায় ভরা। অন্ধকারে ঝরনার কলকল শব্দ। কোনও বন্যপ্রাণী এসে জল খাচ্ছে। চকচক আওয়াজ। বনের ভিতর আগুনের গোলার মতো দুটো চোখ। অন্ধকারের পাঁচিল ঘেরা নিভৃত একখণ্ড বন। কত কী হয়তো দেখা যায় ওই সময়টায়। কত অলৌকিক কাণ্ডকারখানা। ভাবি, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। চড়া আলো, পাকা বাড়ি আর সংসারের আদরে থাকতে থাকতে ভীতু হয়ে গেছি রে দীপা। থাকতে বাধ্য না হলে থাকতে পারব না।’
‘সাধু কী করে আছেন। আমরা তো চলে এলুম উনি তো একা।’
‘সেই কারণেই উনি সাধু।’
গাড়ি ছুটছে শহরে দিকে জোর গতিতে। গাছগুলো সব ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে পিছনে চলে যাচ্ছে। গভীর রাতে দীপা একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল সাধু এ কী বললেন। যে যা হবে সে তা হয়েই এসেছি। লেখাপড়া শিখে সবাই পণ্ডিত হতে পারে, কিন্তু সে চোর হবে না সাধু হবে, দয়ালু। হবে না নিষ্ঠুর হবে, সেটা ঠিক হয়ে আছে। সে কী হবে, কেমন হবে সেটা তার কপালে আগেই। কেউ লিখে দিয়েছে। চেষ্টা করলে পণ্ডিত হওয়া যায় সাধু হওয়া যায় না। সেটা অন্য ব্যাপার। দীপার কেমন যেন ভয় করতে লাগল। নিজের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। সবার আগে মনে পড়ে গেল বাবাকে। একদিন টেলিফোনে কথা বলছেন সেই মহিলার সঙ্গে। খেয়াল নেই যে ঘরের আর এক ধারে দীপা টেবিলে বসে লেখাপড়া করছে। সে কী নরম নরম, মিষ্টি মিষ্টি কথা। মানুষটার মুখের চেহারা অন্যরকম হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো আধবোজা। ঢোলা হাতা পাঞ্জাবি, ফাঁদালো পাজামা পরনে। কবজিতে সোনার ব্যান্ড লাগানো নীল ডায়ালের দামি ঘড়ি। আঙুলে হীরের আংটি ঝিলিক মারছে। এমন এমন সব কথা বলছেন যা কোনও মেয়ের শোনা উচিত নয়। নরম কোলে শুয়ে বেড়াল যেমন ঘড়ঘড় করে গলাটা অনেকটা সেইরকম। টেলিফোনেই আদর করছেন। দুপুরেই একবার দেখা করার অনুমতি চাইছেন। পায়ে ধরছেন। বলছেন, তোমার লাথির দাম লাখ টাকা। বলছেন, তোমার গাড়ি বুক করে দেওয়া হয়েছে। কালই হয়তো ডেলিভারি দেবে। তা হলে আজকের দিনটা তুমি আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি আর আমি।
দীপা আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল টেবিলে। নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছিল। এইসব ভয়ংকর কথা তার শোনা উচিত হয়নি। একটা মানুষ যে কিনা তার বাবা, একটা বাজারি মহিলার শরীরের জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছে। দশ হাত দূরে মেয়ে বসে আছে, কোনও দৃকপাত নেই। দুপুরে দেখা হলে কী কী করবে তার খোলাখুলি বর্ণনা। সেই সব শুনে দীপার শরীর হিম হয়ে গিয়েছিল। একটা। মেয়েকে একজন পুরুষ এইভাবে ব্যবহার করবে। সে সহ্য করবে। তার বদলে সে একটা গাড়ি পাবে, হিরে পাবে, অনেক টাকা পাবে।
দীপা চিত হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। খাটটা এত বড় যে তিনজন পাশাপাশি শুলেও আরও একজনের জায়গা থাকবে। একেবারে একা সে। ঘরের তিন পাশের জানালা খোলা। তিন দিকেই গাছপালা। মহুয়া, দেবদারু, আমলকী, কাঞ্চন। পাতায় পাতায় বাতাসের কানাকানি। নিশ্চিদ্র। অন্ধকার। দীপা নিজের শরীরে হাত রাখল। এই শরীর! বুক, পেট, বাহুঁ, কণ্ঠদেশ, ঠোঁট। এই শরীর পুরুষরা ছিঁড়ে খেতে চাইবে। বন্ধুত্ব করবে। বলবে প্রেম। চিঠি লিখবে। বেড়াতে নিয়ে। যাবে, রেস্তোরাঁয় খাওয়াবে, উপহার দেবে। লক্ষ্য কিন্তু একটাই। বর্বরতা। হাত দিয়ে নিজের শরীরের বিভিন্ন স্থান স্পর্শ করতে করতে দীপার মনে হল কোথাও একটা ভালো লাগার ব্যাপার আছে। একটা অনুভূতি সারা শরীরে চারিয়ে যাচ্ছে। একটা কাঁপুনি আসছে। একটু কিছু জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ একটা আবেগ, দুঃখ, নিঃসঙ্গতা, যন্ত্রণা, আনন্দ। দীপা বিছানায় উঠে বসল। একটু আগে শীত শীত করছিল, এখন গরম। আবার মনে পড়ল। সাধুর কথা। মানুষ যা হতে এসেছে, তাই হবে; যেমন সাপ সাপ হবে, বাঘ বাঘ। তা হলে! তাই কি বারে বারে সেই নার্সকে মনে পড়ে। মনে হয় সে কাছে থাকলে খুব ভালো হত। সে ছিল নেশার মতো। দীপার ভিতরটা হু হু করে উঠল। শরীর আগুনের মতো গরম। মনে হচ্ছে, সব পোশাক খুলে ফেলে। আবার সেই কাঁপুনি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত। দাঁতে দাঁতে শব্দ হচ্ছে। অসহায়ের মতো বাইরে তাকাল। মেজোমামার জানালা দিয়ে আলোর একটা আভা বাইরের বাগানে গাছের পাতায় মিহি সিল্কের মতো জড়িয়ে আছে। জেগে আছে এখনও।
দীপা খাট থেকে নামল। অন্ধকারেই আন্দাজ করে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ছিটকিনি খুলে। বাইরে এল। বিশাল লবি। অন্ধকারে সোফা-টোফা জমাট বেঁধে আছে। ঘড়ির টিকটিক। মার্বেল পাথরের ভেনাস। সাইড টেবল, কর্নার টেবল, সেন্টার টেবল। জায়গাটা হা হা করছে। অশরীরী কেউ ছিল যেন! এখনও হয়তো আছে। দীপাকে লক্ষ করছে।
দীপার সঙ্কোচ হচ্ছিল, তবু সে মেজোমামার দরজায় টোকা মারল। মেজোমামা কে, বলে দরজা খুলে দীপাকে দেখে অবাক হলেন, ‘কী রে! তুই! ঘুমোসনি এখনও! ভয় পেয়েছিস?’
দীপা ফিশফিশ করে বলল, ‘একবার আসবে আমার ঘরে?’
‘কী হয়েছে বল তো, সাপখোপ কিছু বেরিয়েছে?’
‘ওসব কিছু নয়, তুমি এসো।’
দীপার পিছনে মেজোমামা। দীপা আলো জ্বেলে দরজা ভেজিয়ে দিল। মেজোমামার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘দ্যাখো তো গাটা জ্বর এসেছে কি না।’
মেজোমামা কপালে হাত রাখলেন। গলার কাছে রাখলেন। নাড়ি টিপলেন, ‘মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। দাঁড়া থার্মোমিটার আনি। তোর মেজোমাইমাকে একবার ডাকি।’
‘না, থার্মোমিটার, মেজমাইমা, কোনও কিছুর দরকার নেই।’ ‘তা হলে একটা ওষুধ দিচ্ছি, খা।’
‘সে পরে হবে। তুমি আমার বন্ধুর মতো, তোমাকে আমি একটা কথা বলতে চাই। তুমি আগে বসো।’
মেজোমামা মশারি সরিয়ে খাটের ধারে বসলেন। দীপাও বসল। মেজোমামা ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলেন,
‘কী হয়েছে বল তো?’
‘আমার ভয় করছে।’
‘তুই আমাদের বিছানায় শুবি চল। তিনজন খুব আরামে শোয়া যাবে।’
‘সে ভয় নয়, অন্য ভয়।’দীপা ইতস্তত করছে বলতে বলতে তাকে হবেই। একজন কারোকে বলা দরকার। মেজোমামাই তার একমাত্র বন্ধু যাকে সব কথা বলা যায়। সাধুর কথায় দীপা ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে। রাত যখন গভীর হয়, দরজা বন্ধ করে সে যখন বিছানায় মশারির তলায়, তখন সে কেন সকালের দীপা থাকে না। বয়সটা অনেক বেড়ে যায়। শরীরে টান ধরে। বুক, পেট, পিঠ সব ভারী হতে থাকে। কণ্ঠস্বর কেমন পালটে যায়। চরিত্রটা বদলে যেতে চায়। সে কি তার বাবার মতো, ঠাকুরদার মতো হয়ে যাবে। জ্যাঠামশাই, কাকা আর কাকিমাদের মতো!
মেজোমামা বললেন, ‘বল, কী বলবি বল! শীতের রাত হি হি করছে?’
‘তোমাকে এমন একটা কথা বলব, যা একমাত্র তোমাকেই আমি বলতে পারি। তুমি আমার বন্ধু। সেইকথা তুমি আর কারোকে বলবে না।’
মেজোমামা ভয় পেলেন, ‘কেউ কিছু বলেছে তোকে। হতচ্ছেদ্দা করেছে। অভিমান হয়েছে?
‘না, সে সব কিছু নয়। এমন কথা যা বলা যায় না, তবু বলছি। তুমি আমাকে ভালো করে দাও।’
‘সামান্য একটু জ্বর হয়েছে ঠান্ডা লেগে, তার জন্য এতটা উতলা হচ্ছিস কেন?’
‘তুমি তোমার ঘরের আলো নিবিয়ে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসো। মেজোমাইমা ঘুমোচ্ছে তো?’
‘হ্যাঁ, তোর মামি ঘুমকাতুরে। শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ে।’
‘তা হলে যাও, যা বলছি তাই করে এসো।’
মেজোমামার হঠাৎ একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি এল মনে। কত রকমের চোখ আছে পৃথিবীতে। মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছে করে। ঈশ্বরের চোখ, নিজের চোখ, সমাজের চোখ। নিজের চোখে। আমি নিষ্পাপ। সমাজের চোখে আমি যে-কোনও মুহূর্তে পাপী হয়ে যেতে পারি। কেউ কখনও এইভাবে অমন করেছিল অতএব তুমিও তাই করবে। সেইটাই আমাদের সিদ্ধান্ত। তুমি নিজেকে সাধু বললে কী হবে! পাপেরও একটা শাস্ত্র আছে। যেমন ঘণ্টা বাজলেই মনে করতে হবে পুজো হচ্ছে, সেইরকম সম্পর্ক যাই হোক, বয়সের ব্যবধান যতই থাক, একটা ঘরে অনেক রাতে একজন পুরুষ ও রমণী, হোক না কিশোরী, পাপ শাস্ত্র বলবে, ভয়ংকর একটা কিছু ন্যাক্কারজনক। ঘটনা ঘটছে। নিজের মন দিয়ে মানুষ বাইরের পৃথিবীটাকে দেখে। সাধুর লেখা সেই গল্প মনে পড়ে গেল—
ফাঁকা একটা মাঠ। অমাবস্যার অন্ধকার রাত। মাঝখানে একটা টিবি। অন্ধকারে দেখলে মনে হবে, একটা লোক গুড়ি মেরে বসে আছে। গুঁড়িখানা বন্ধ হয়েছে। মাঝরাতে মাতাল ওই মাঠের পথ ধরে টলতে টলতে ফিরছে। ঢিবিটা দূর থেকে নজরে পড়েছে। নিজের মনেই বলছে, বাঃ, আমার নেশা হওয়ার আগেই, তুমি ভাই লাগিয়ে বসে আছে। তোমার মালের তো বহুত জোর। সে তো আপশোশ করতে করতে চলে গেল। একটু পরেই এলেন এক সাধু। দূর থেকে টিবিটাকে দেখছেন। ভাবছেন, কী ভাগ্যবান, আমি এখনও বসতেই পারলুম না, আর আপনার ধ্যান লেগে গিয়েছে! সব শেষে এক পুলিশ, দেখে ভাবছেন, ব্যাটা চোর, মাল সাফ করে এখানে ঘাপটি মেরে বসে থাকা হয়েছে! একটা টিবি, তিনজন মানুষের তিন ধরনের দেখা।
মেজোমামা বললেন, ‘দরজাটা খোলা থাক, আলোটাও জ্বলুক। আমাকে দেখতে না পেলে তোর মাইমা অন্যরকম ভাববে।’
দীপাবললে, ‘অন্যরকম মানে কী রকম! আমি তো তোমাকে একেবারে অন্যরকম কথাই বলতে চাইছি।’
দীপা বুঝতে পারছে, মেজোমামা ভীষণ ভয় পেয়েছে। ঠিকমতো বসতে পারছে না। পালাবার জন্যে উশখুশ করছে। ঘন ঘন ঢোঁক গিলছে।
শেষে বললেন, কী এমন কথা! আজ অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালেও তো বলা যায়।’
‘এসব কথা রাত ছাড়া বলা যায় না। তুমি অমন ছটফট করলে বলতে পারব না। সময় লাগবে। সারাটা রাতই লেগে যেতে পারে। তুমি অমন ভয় পাচ্ছ কেন? ভূত দেখেছ নাকি!’
‘না, তা নয়, তবে তোকে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। চুল এলোমেলো, চোখ ছলছল। জ্বরের ঘোরে ভুল বকছিস না তো!’
‘এখনও বকিনি, তবে এইবার যা বলব তাতে তোমার মনে হবে আমি সত্যিই হয়তো ভুল বকছি।’
দীপা মেজোমামার পাশে বসে পড়ল। দু-হাত দিয়ে মেজমামার সহজ সরল মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললে, ‘আমার মুখটা ভালো করে দেখে বলো তো, কার মতো, বাবার মতো, না মায়ের মতো?’
কিছুক্ষণ দেখে বললেন, ‘দুজনের কারও মতোই নয়, একেবারে অন্যরকম।’
‘মেয়েদের চরিত্র কার মতো হয়, বাবার মতো, না মায়ের মতো। তুমি আমার বাবাকে চেন, আমি
কী সেইরকম হব।চরিত্রহীন?’
‘এই বয়সে এই প্রশ্ন কেন?’
‘সাধু আমার মনে ভীষণ ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন। যে যা হবার তাই হবে। অন্য কিছু হওয়ার চেষ্টা করলেও হতে পারবে না। আমি কী হব। আমার মায়ের মত, আমার বাবার মতোনা একেবারে অন্যরকম।’
‘তুই একেবারে পাগলের মতো কথা বলছিস। এই বয়সে এইসব কেউ ভাবে না। তোকে আমরা সবচেয়ে ভালো কলেজে লেখাপড়া শেখাব। পারলে বিলেত পাঠাব। গবেষণা করবি, ডিগ্রি নিবি। তারপর নিজের জীবনের ধারা নিজে ঠিক করে নিবি।’
‘সে তো শিক্ষার কথা, চরিত্রের কথাটা বলো।’
‘শিক্ষাই তো চরিত্র। আলাদা করে চরিত্রের কথা ভাবছিস কেন?’
‘আজকের কাগজে একটা খবর পড়েছ, এক শিক্ষিত অধ্যাপক আর একটা মেয়েকে বিয়ে করবে বলে বউকে খুন করেছিল ধরা পড়েছে। যে মেয়েটাকে বিয়ে করবে সে ওই অধ্যাপকের ছাত্রী। লোকটা তো শিক্ষিত, নামকরা অধ্যাপক।’
‘ওরা অপরাধী। তাই খুঁজে খুঁজে ওইসব খবর পড়ে মাথা খারাপ করবি কেন? এমন ঘটনা অনেক ঘটে। মানুষ নিজের দুর্বলতায় হঠাৎ অনেক কাজ করে ফেলে, পরে আপশোশ করে। রাগের মাথায় মারতে গিয়ে মেরে ফেলে জেলে যায়। একে বলে, টেম্পরারি ইনস্যানিটি। সব দেশেই এমন ঘটনা ঘটে। তাতে তোরই বা কী, আমারই বা কী! সাপ গর্তে থাক, বাঘ জঙ্গলে, কুমির। জলে, পাখি গাছে, আমরা আমাদের মতো, ওরা ওদের মতো। কেউ কারও এলাকায় ঢুকবে না। তাহলেই হল।’
‘তুমি কি জানো, আমি একটা খারাপ মেয়ে। আমাকে খারাপ করে দিয়েছে।’
দীপার মেজোমামা একটু থমকে গেলেন। কুমারী মেয়েদের এই একটা বয়স। কৈশোর আর। যৌবনের সন্ধিক্ষণ। যে বাড়িতে মানুষ হচ্ছিল, সেই বাড়ির মানুষগুলোর পয়সা ছিল, আদর্শ ছিল না। সব কটার ঠোঁটের উপর অহঙ্কারের গোঁফ। পুলিশ, সরকারি পদস্থ কর্মচারীদের তোয়াজ করে যতরকম অন্যায় পথ আছে, সেই পথে অর্থ উপার্জন। প্রতিটি মানুষ ইন্দ্রিয়পরায়ণ। মাত্রাতিরিক্তি যৌনতা। দীপাকে কে কীভাবে ব্যবহার করেছে কে জানে! সে সব কথা এই মাঝরাতে শুনে লাভ কী! মানুষ তো প্রতি মুহূর্তে নতুন জীবন শুরু করতে পারে। যদি ইচ্ছে থাকে, যদি মনের জোর থাকে।
মেজোমামা বললেন, ‘দীপা, তুই কী বলতে চাইছিস আমি জানি না, আমি শুনতেও চাই না। আমি যেমন তোর মামা, আবার আমি তোর অন্তরঙ্গ বন্ধু। আমি বিশ্বাস করি, তুই ভীষণ ভালো মেয়ে। তোর পক্ষে খারাপ হওয়া সম্ভব নয়, কারণ, তোর রক্তে আমাদের বংশের রক্ত আছে।’
দীপা একটুক্ষণ ভাবল। তার মনে হল, যে কথাটা সে বলতে চাইছে, সেটা বলা যায় না। যেমন সকলের সামনে উলঙ্গ হওয়া যায় না। দীপা ভয় পেয়েছিল। সেই ভয়টা ক্রমশ কেটে আসছে। একা ঘরে একা-একটা মানুষ, একটা শরীরে একটা মন, ভয় পেতেই পারে। দীপা ভাবলে, আর কিছুদিন দেখাই যাক না। কী হয়! যদি কিছু না-ই হয়, তাহলে যা হবার তাই হবে। অনেকেরই তো অনেক খুঁত থাকে, কারও ছ’টা আঙুল, কারও থ্যাবড়া নাক, গজদন্ত।
দীপা বলল, ‘চলো, আমরা শুয়ে পড়ি। যে কথাটা তোমাকে বলতে চাই, তা বলা যায় না। ওটা আমার ভিতরেই থাক।’
‘দীপা তোর যা বয়েস সেই বয়সে তুই কেমন করে এইসব কথা বলিস! একেবারে পাকা বুড়ির মতো!’
‘মেজোমামা, মেয়েরা তাড়াতাড়ি পেকে যায়।‘
‘একলা শুতে ভয় করলে, তুই তোর মাইমার পাশে গিয়ে শো, আমি তোর ঘরে শুচ্ছি।’
‘আমার ভূতের ভয় নেই। আমার মা মারা গিয়ে আমাকে অনেকটা সাহসী করে দিয়ে গিয়েছে।’
‘আমি তোকে আরও সাহসী করে দিয়ে যাব। তোকে আমি আত্মরক্ষার কায়দা শেখাব। অ্যানাটমি চেনাব। মানুষের শরীরে কয়েকটা স্পট আছে, সেখানে মারতে পারলে যত বড়ো পালোয়ানই হোক কাবু হয়ে যাবে।’
‘তুমি আমাকে মারধোর শেখাবে কেন?
‘একটাই কারণ, এদেশের পুরুষরা মেয়েদের ভোগের সামগ্রী ছাড়া আর কিছু ভাবতে শেখেনি। বাইরে ভদ্রলোক ভিতরে জানোয়ার। অথচ আমাদের দেশে দেবতার চেয়ে দেবীর সংখ্যাই বেশি।’
‘তুমি আমাকে যুযুৎসু শেখাবে?’
‘আমি শেখাব না, আমার এক জাপানি বন্ধু শেখাবে।’
মেজোমামা তাঁর ঘরে চলে গেলেন। দীপা শুয়ে পড়ল।
মেজোমামার ঘুম কম। দীপার চিন্তায় সারারাত প্রায় জেগেই রইলেন। মনে একটা খোঁচা। কী এমন হতে পারে মেয়েটার। অনেক কিছুই হতে পারে। ওর মনটাকে কেউ নষ্ট করে দিয়েছে।
মানুষকে মনেও বিকলাঙ্গ করা যায়!
পৃথিবীতে মানুষই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। বাঘ, ভাল্লুক, সাপ নয়। বড়দার লেখা একটা কবিতা মনে পড়ছে,
মনে হয়েছিল মানুষ
দুটো হাত, দুটো পা
কথা বলে মানুষের মতো,
ভুল ভেঙে যেতে দেরি হল না
দেখতে মানুষ হলেও
নির্ভেজাল জানোয়ার।।
কথার কথা
প্রভু ভৃত্যকে বললেন, বাজার থেকে খুব ভালো মাংস কিনে আন। ভৃত্য নিয়ে এল ভেড়ার জিভ। পরের দিন প্রভু বললেন, বাজার থেকে সবচেয়ে খারাপ মাংস কিনে আন। আবার সেই জিভ।
প্রভু ভৃত্যকে জিগ্যেস করলেন, হ্যাঁ রে ব্যাপারটা কী? ভালো মাংস বললুম, এল একটা জিভ। খারাপ মাংস, তখনও সেই জিভ!
ভৃত্যকে বললে, মালিক, মানুষ তার এই জিভের কারণেই কখনও ভীষণ খুশি, কখনও ভীষণ অখুশি। মানুষকে কটু কথা বলে, গালমন্দ করে, ধোলাই খায়, মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়ে, খুন-খারাপিও হয়ে যেতে পারে। আবার যখন ভালো কথা বলে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা বলে, প্রেমের কথা বলে, পৃথিবীর মানুষ ছুটে আসে শ্রদ্ধা জানাতে, সুখী করতে। ভালো আর মন্দ সবই এই জিভে।
প্রভু ভীষণ সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, কেয়া বাত। তাহলে আয়, আমরা এই খতরনক জিভকে সংযত করার জন্যে দুজনেই চেষ্টা করি।
Bridle your tongue. ইংরেজি উপদেশ। লাগাম চড়াও। মা কালী দাঁত দিয়ে জিভ চেপে ধরে ইঙ্গিতে বলতে চাইছেন, সংযত বাক, সংযত রচনা।
অনেক কথার অনেক দোষ।
ভেবে চিন্তে কথা কোস।
A sharp tongue is the only edged tool that grows keener with constant use.আরভিং ওয়াশিংটনের কথা। এরকম ধারালো অস্ত্র অনবরত ব্যবহারে ধার বাড়তেই। থাকে, বাড়তেই থাকে। সেই অস্ত্রের নাম—জিভ। জিভেই অক্ষরের অবস্থান। শব্দ নির্মাণ করে বাইরে প্রক্ষেপ। Ilove you বলা যায়। আবার I hate you-ও বলা যায়। জিভ না থাকলে। মানুষ হত অব্যক্ত প্রাণী। এক ধরনের অর্থহীন শব্দ ছাড়া আর কিছু প্রকাশ পেত না।
কোলাহলমুখর এই ভূমণ্ডল কেবল উল্লাস আর আর্তনাদের ধ্বনিতে ভরপুর হয়ে থাকত। কোথায় সংগীত, কোথায় স্তোত্র। শব্দকারী কিছু জন্তুতে পুথিবী ভরে যেত। নানারকম শব্দ। ঝরনার। প্লবমান শব্দ। সমুদ্রের শাসন। বাতাসের হা-হুতাশ। বিদ্যুতের চিড়িক। পত্র পল্লবের মর্মর আর পারি না, আর পারি না কথার চেয়ে শব্দ বড়। শব্দ হল মাতা। বিশাল বিস্ফোরণ পরমুহূর্তেই শত কণ্ঠের আর্তনাদ। গাড়ির তীব্র ব্রেকের শব্দ। ওই একটি শব্দ থেকে সংবাদপত্রে জন্ম নেবে শত অক্ষরের কাহিনি। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ঢুকে যাবে হয়তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা শব্দ। শব্দে ঘটনা। আছে বর্ণনা নেই। শব্দে ভাব আছে, ভাষা নেই। বীভৎস শব্দ। মধুর শব্দ। প্রাণবন্ত শব্দ, প্রাণহীন শব্দ। জীবন্ত মানুষের বুকে কান পাতলে একটানা প্রাণের শব্দ। ডাক্তার শুনবেন একরকম শব্দ, যোগী শুনবেন আর একরকম। অজপা চলছে বিরামহীন হংসঃ। সোহ—আমিই সে। আমিই ঈশ্বর। আমি ব্রহ্ম। ব্রহ্মাচ্ছি।
শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিকি বলছে শ্রীমতী জানেন,
বংশী বাজিল ওই বিপিনে
(আমার তো না গেলে নয়) (শ্যাম পথে দাঁড়ায়ে আছে)
তোরা যাবি কিনা যাবি বল গো।
তোদের শ্যাম কথার কথা।
আমার শ্যাম অন্তরের ব্যথা
তোদের বাজে বাঁশি কানের কাছে।
বাঁশি আমার বাজে হৃদয় মাঝে।।
ভাষা, ভাব, অনুভূতি, অর্থ আকর্ষণের বায়বীয় অবস্থা হল সুর। নেশা শব্দের তরল অবস্থা হল সুরা। দুঃখ শব্দের আকৃতিও তরল, চোখের জল। রাগ শব্দের চেহারা আগুন। একটি চুম্বনের। শব্দে কত বছরের প্রেম! রাতে রেলগাড়ির শব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে আসার আহ্বান—কত নদী, প্রান্তর! কেউ চলেছেন প্রবাসে—বিচ্ছেদ-বেদনা নিয়ে। কেউ ফিরছেন স্ববাসে আনন্দের বোঝা নিয়ে।
দুপুরে আলমবাজার জুটমিলের বাঁশির শব্দ শুনে দক্ষিণেশ্বরের নহবতের দ্বিতলে শ্রীরামকৃষ্ণের জননী আহারে বসতেন। তিনি ওই বাঁশির শব্দে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনতেন। ছুটির দিনে, যেদিন মিলের বাঁশি বাজত না সেদিন অনেক সাধ্য-সাধনা করে তাঁকে আহারে বসানো হত।
মা উচ্চকণ্ঠে মেয়েকে উনুন ধরানোর নির্দেশ দিচ্ছেন, ওরে সন্ধে হল, বাসনায় আগুন দে। বিখ্যাত ধনী, প্রখ্যাত লালাবাবু সব ছেড়ে বৃন্দাবনে চলে গেলেন। বাসনা শব্দটি তাঁর কাছে যে অর্থে ভেসে এল, তা হল কামনাবাসনা। প্রেমিকই বলতে পারেন, For gods sake hold your tongue and let me love (John Donne).
কাচ
ছেলেবেলায় আমি তো একটু দুষ্টু ছিলুম। সবাই বলত, ভীষণ দুষ্টু। একদণ্ড স্থির হয়ে বসতে জানে না। আমার মা বলতেন, ‘ওইটাকে নিয়েই হয়েছে আমার ভীষণ জ্বালা। সারাদিন আমার এতটুকু শান্তি নেই।’
আমি লক্ষ্মী হওয়ার চেষ্টা যে করতুম না তা নয়। বইপত্র নিয়ে বসতুম। দু-এক পাতা হাতের লেখা করতে না করতেই মাথাটা কেমন হয়ে যেত। নীল আকাশে নিলুর ঘুড়ি লাট খাচ্ছে, পাশের মাঠে প্রতাপ আর গোপাল ডাংগুলি খেলছে। মাথার আর কী দোষ!
আমরা তখন খুব একটা পুরোনো বাড়িতে থাকতুম। বাড়িটার দুটো মহল ছিল বারমহল আর অন্দরমহল। অনেক ঘর। চওড়া, টানা-টানা বারান্দা। তিনতলার ছাতটা ছিল বিশাল বড়। ইচ্ছে করলে ফুটবল খেলা যেত। সেখানে পাশাপাশিদুটো ঘর ছিল। কেউ একটু নির্জনে থাকতে চাইলে থাকতে পারত। একটা ঘরে থাকত আমার দিদির যত খেলনা—বড় পুতুল, ছোট পুতুল। দিদির বন্ধুরা বিকেলে এসে খেলা করত। আমি মাঝে মাঝে এসে দুষ্টুমি করতুম। দিদি তখন তার বন্ধুদের বলত, ‘দ্যাখ, ভাই কী বানর ছেলে!’ দিদি আমাকে বানর বললে আমার খুব ভালো লাগত। আমি দুষ্টুমি করলে দিদিরও খুব ভালো লাগত মনে হয়। মাঝে মাঝে প্রবল লড়াই হত। তখন দিদি বলত, ‘দেখবি, যখন কোথাও চলে যাব তখন বুঝবি ঠেলা। কে তোকে গরমের ছুটিতে আচার তৈরি করে খাওয়ায় দেখব।’
রোজ রাত্তিরে বাড়িতে একটা কুরুক্ষেত্র কাণ্ড হবেই হবে। বাবা অফিস থেকে এসে আমাকে পড়াতে বসবেন। সারাদিনের লাফালাফিতে ঘুমে আমার চোখ দুলে আসবে। জানা জিনিসও ভুল করব। বাবা পরপর যোগ করতে দেবেন। একটাও ঠিক হবে না। ‘উইক’ বানানটা ভুল হবেই হবে। দুর্বলটা সপ্তাহ হবে, সপ্তাহটা দুর্বল। বাবা মাকে ডেকে বলবেন, ‘সারাটা দুপুর তুমি করো কী? ছেলেটাকে একটু দেখতে পারো না!’
মা তখন ফিরিস্তি দেবেন ছেলে এই করেছে, ওই করেছে। বাবা গম্ভীর মুখে উঠে গিয়ে লম্বা বারান্দায় পায়চারি করবেন আর আক্ষেপ করবেন, ‘নাঃ, হল না, কিছুই হল না। ফেলিওর, ফেলিওর।’ রাতে খেতে বসে বলবেন, ‘কালিয়া, পোলাও খেয়ে কী হবে, ছেলেটাই যার মানুষ হল না!’
এত কাণ্ডতেও আমার কিছু হবে না। ঘুমিয়ে পড়ব। একসময় দিদি এসে আস্তে আস্তে ডাকবে, ‘চল, খাবি চল। কাল থেকে একটু ভালো করে পড়বি। তোকে বকলে আমার খারাপ লাগে।’ কোনও-কোনওদিন দিদি আমাকে খাইয়ে দেয়।
এইভাবেই চলতে চলতে গরমের ছুটি পড়ে গেল। একদিন দুপুরবেলা সবাই ঘুমোচ্ছে। আমিও মায়ের পাশে শুয়েছিলুম। দিদি কয়েকদিনের জন্য মামার বাড়ি গেছে। শুয়ে থাকতে থাকতে উঠে পড়লুম। ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করা উচিত নয়। মা যে-ঘরে, তার পাশের ঘরে একটা টেনিস বল নিয়ে কেরামতি করছি। এখন থেকে প্র্যাকটিস না করলে, বড় হয়ে পেলের মতো খেলোয়াড় হব কী করে! বাবাই তো বলেছেন, ‘সাধনাতেই সিদ্ধি।’
প্রথমে সাবধানেই সবকিছু করছিলুম, হঠাৎ ভীষণ উত্তেজিত হয়ে মারলুম এক শট। বাবার বইয়ের আলমারির সব কাচ ভেঙে চুরমার! পাশের ঘর থেকে মা দৌড়ে এলেন। ধড়াধ্বাম। মারাটাই আমাকে উচিত ছিল; কিন্তু বাবা বলেছেন, ‘একদম গায়ে হাত তুলবে না। ভয় ভেঙে যাবে। অন্য শাস্তি দেবে।’
মা আমাকে টানতে টানতে ছাদের ঘরে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে দিলেন, ‘থাকো এইখানে, বাবা এলে তোমার বিচার হবে। বড্ড বেড়েছ তুমি। নির্জলা উপবাস।’
চারপাশে খাঁ-খাঁ করছে রোদ। দুপুরের নীল আকাশে গোটাকতক চিল উড়ছে। জানলার ধারে বসে আছি মনখারাপ করে। বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আলমারির সব কাচ চুর হয়ে গেল। খুব অন্যায় হল। কবে যে আমি মানুষ হব! এইসব ভাবছি। ভীষণ গরম। একটুও হাওয়া নেই। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। শেষকালে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। গায়ে কেউ হাত রাখল। ধড়মড় করে উঠে বসলুম। সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন বাবা। আকাশে তখনও শেষবেলার রোদ। ভয়ে কুঁকড়ে গেলুম। বাবার মুখের দিকে তাকালুম, হাসছেন। স্বপ্ন দেখছি না তো! দরজার দিকে তাকালুম। হাটখোলা। তখন আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘বাবা! আজ আপনি এত তাড়াতাড়ি এলেন?’
কোনও উত্তর নেই। বাবা হাসছেন। কেবল হাসছেন।
আমি বললুম, ‘বাবা, আমি সব কাচ ভেঙে ফেলেছি। আমি খুব অন্যায় করেছি বাবা।’
বাবা তবু হাসছেন। মুখে এতটুকু রাগ নেই। আমি তখন প্রণাম করার জন্য বাবার পা স্পর্শ করতে গেলুম, দেখি কেউ কোথাও নেই। ঘর ফাঁকা। দরজাটা হাটখোলা। খুব জোর হাওয়া ছেড়েছে গ্রীষ্মের বিকেলের।
আমি ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেলুম! স্বপ্ন দেখেছি। নিশ্চয় স্বপ্ন। সাহস একটু ফিরে পেতেই এক ছুটে নীচে। দেখি মা রান্নাঘরে ঘুগনি তৈরি করছেন। আমাকে দেখে অবাক, কী করে এলি, কে তোকে দরজা খুলে দিল?’
বাবা ঘুগনি খেতে ভালোবাসেন, মা সেই জন্যই করছেন। কাচ ভাঙা নিয়ে ভীষণ কাণ্ডটা হয়ে যাওয়ার পরেই ঘুগনি এসে অবস্থাটাকে সামাল দেবে।
মাকে আমি সব কথা বললুম।
‘তোর বাবা এসেছে? কোথায়?
‘দরজা তো বাবাই খুলে দিলেন।’
সদরের দরজা আমি খুলে না দিলে আসবে কী করে?
গোটা বাড়িটা সার্চ করা হল। বাবার পড়ার ঘর, শোওয়ার ঘর, ঠাকুরঘর, বাথরুম। আলনাটা দেখা হল। সেখানে বাবার অফিসের জামাকাপড় ছাড়া নেই। বাড়িতে ফিরে যা পরবেন। সেইগুলোই গুছোনো রয়েছে।
আমরা তখন পাশের বাড়িতে গিয়ে বাবার অফিসে ফোন করলুম। অফিসের বড়কর্তার সঙ্গে মা কথা বললেন। জানা গেল। বাবা অনেক আগেই সাইটে গেছেন। সাইট মানে উলুবেড়িয়ায়। সেখানে কোম্পানির নতুন ফ্যাকট্রি তৈরি হচ্ছে।
মা খুব অনুরোধ করলেন, ‘আপনি নিজে একটু খবর নিন। মনে হচ্ছে, একটা কিছু হয়েছে।’ ফোন নম্বরটা তাঁকে দেওয়া হল। টেলিফোনটাকে ঘিরে আমরা বসে আছি। বসেই আছি। ওদিকে মায়ের ঘুগনি পুড়ে ছাই। এক ঘণ্টা পরে ফোন বাজল।
কনস্ট্রাকশন সাইটে একটা লোহার বিম ক্রেন ছিঁড়ে বাবার মাথায় পড়ে গেছে। তখন বেলা ঠিক সাড়ে চারটে। আমি এমন বোকা ছিলুম, সেই খরবটা পেয়েই আমি নাকি মাকে বলেছিলুম, ‘জানো, আমি কাচ ভেঙেছি বলে বাবা একটুও রাগ করেননি। শুধু হাসছিলেন।’
তখন আমার বয়েস ছিল আট। আজ আশি। আমি আর কোনওদিন কিছু ভাঙিনি। না কাচ, না সম্পর্ক, না পরিবার, না জীবন। বাবার সেই হাসি-হাসি মুখের হাসি যাতে কখনও না মিলিয়ে যায়, সেই চেষ্টা আমি করেছি।
কারুর আসার সময় এগিয়ে আসে, কারুর যাবার সময়
চলে যাওয়া মানেই শূন্যতা। এক সময় ছিল, এখন আর নেই। হয়তো সামান্য একটু স্মৃতি পড়ে থাকে। একটি দালানের ভগ্নাবশেষ। একটি গাছের কাণ্ড। কোনও মানুষের চলার স্মৃতি একজোড়া চপ্পল। একটি উত্তরীয়। পাখি উড়ে গেছে, গাছের তলায় একটি রঙিন পালক। দেয়ালে কালির দাগ। নিটোল একটি সংসার ছিল কোথাও। স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, ভাই-বোন, হয়তো লোমওয়ালা ফুটফুটে একটি কুকুর। কোথা থেকে কী হয়ে গেল! সব মিলিয়ে গেল বুদবুদের মতো। যে ঘরে পরিবারের রান্না হত, সে ঘরের উত্তরের দেয়ালে আঁকা রয়েছে ধোঁয়ার চিহ্ন। কোথাও পড়ে আছেনদীর ধারে একটি ভাঙা ঘাট, কত মানুষের স্নানের স্মৃতি নিয়ে!
কীসে আমরা ভাসছি? সময়ের স্রোতে। দানা দানা মুহূর্ত দিয়ে তৈরি সময়ের অনন্ত স্ফটিক। সময়ের কোনও শূন্যতা নেই। চূর্ণ চূর্ণ হয়ে ঝরে পড়লেও, সময় অনন্ত। বর্তমান কেবলই অতীত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ কেবলই চলে আসছে বর্তমানে। যে সময় চলে গেল তার জন্য আমাদের। কোনও শূন্যতার বোধ নেই। যে সময় কাছে চলে এল তার জন্যে আমাদের তেমন কোনও অনুভুতি নেই। সন্ধে সাতটায় আমরা হাত-পা ছড়িয়ে ভাবতে বসি না, সকাল সাতটা কোথায়। চলে গেল! সময় অনবরতই পেছন দিকে চলেছে বলেই আমরা সামনে চলেছি। আসলে আমাদের কোনও গতি নেই। আপেক্ষিক গতিতেই কাল থেকে কালে, মহাকালে লীন হয়ে যাই। অনেকটা সিনেমার দর্শক ঠকানো কায়দা। স্থির মোটরগাড়িতে নায়ক স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে, পাশের ঘর-বাড়ি, গাছপালা আঁকা প্রেক্ষাপটটি একজন উলটোদিকে টেনে নিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে গাড়ি ছুটছে সামনের দিকে।
পুরোনো বাড়ির পাশে একটি নতুন বাড়ি এসে প্রমাণ করতে চায় তুমি প্রাচীন হয়েছ। সংসারে একটি শিশু এসে বলতে চায়, আমি এলুম তোমাদের যাওয়ার সময় হল এবার। সৃষ্টির হাতে স্রষ্টা এইভাবেই মার খেয়ে চলেছে চিরকাল। Old order changeth yielding place to new. সময় জীব-জগৎকে যত তাড়াতাড়ি গ্রাস করে, বস্তু-জগৎকে তত তাড়াতাড়ি গ্রহণ করতে পারে। না। আমার শরীরের ত্বকে যত তাড়াতাড়ি কুঞ্চন ধরবে, আমার বাড়ির পলেস্তায় তত তাড়াতাড়ি ধরবে না। আমি চলে যাওয়ার পরেও বাড়িটা থাকবে। হয়তো পরের আরও তিন পুরুষ সেখানে বসবাস করে যাবে। যে ভূখণ্ডের ওপর বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে সেটি পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত থেকে যাবে। হয়তো হাত পালটাবে, তবু থাকবে। মাঠকোটা থেকে দালানকোটা, দোতলার ওপর। তিনতলা উঠবে। সিমেন্ট রং ঝলসাবে শরতের রোদে। যে রোদুরে আমি ফড়িং-এর নাচানাচি দেখেছি ঘাসের ডগায়, কেউ না কেউ সে নাচ দেখবে। সেই একই ভঙ্গি। আরামকেদারায় এলানো শরীর। কোলের ওপর সেই একই খবরের কাগজ। মাঝে মাঝে মেঘ ভাসানীল। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ চলে যাওয়া। অন্দরমহল থেকে ভেসে আসা সেই একই ধরনের শব্দ, রান্নার গন্ধ।
ল্যাম্পপোস্টে, টিভি অ্যান্টেনায় যে ঘুড়িটিকে আমি আটকে থাকতে দেখেছিলুম, ঠিক সেই রকম একটি ঘুড়ি আটকে থাকবে। পথের ওপাশে সেই একই কৃষ্ণচূড়ায় ডালপালার বিস্তার। দোয়েলের নাচানাচি। দেখা সেই এক, চোখ দুটোই যা ভিন্ন।
বর্ষা চলে গেলেও যেমন জলের স্মৃতি থাকে কোথাও কোথাও, তেমনি সময় চলে গেলেও লুটানো আঁচলের মতো সময় কোথাও কোথাও পড়ে থাকে। দেয়ালের গায়ে শ্যাওলার মতো বর্তমানের গায়ে লেগে থাকে অতীত। চোরকুঠুরিতে জমা আছে সংসারের অজস্র জিনিস। কোনও কোনওটা প্রায় শতাব্দীর মতো প্রাচীন। ভিক্টোরিয়ার আমলের ভাঙা চেয়ার। পেতলের বাতিদান। গিল্টি করা ছবির ফ্রেম। ছেড়া-খোঁড়া কিছু বই। একটি বৃহৎ আকৃতির বিধ্বস্ত বইয়ের নাম। মেটাফিজিক্স। সামনের আর পেছন দিকের পাতা নেই। কীট-দষ্ট মধ্যভাগটি কালের প্রহরণ থেকে কোনও রকমে আত্মরক্ষা করেছে। মার্জিনে কপিং পেনসিলে প্রপিতামহের নোট। খুদে খুদে অক্ষর এখনও স্পষ্ট। উনিশশো ছয় কি সাত সালে এক যুবক কলকাতার এক মিশনারি কলেজে বিএ ক্লাসের নোট নিয়েছিলেন। যুবক থেকে প্রৌঢ় শেষে বৃদ্ধ। অবশেষে তিরোধান। এক সময় ছিলেন, এখন আর নেই। তৃতীয় পুরুষের এক প্রবীণ নির্জন দ্বিপ্রহরে সেই বইটির পাতা। ওলটাচ্ছে। সময় পিছু হাঁটতে শুরু করেছে। সামনের পিচের রাস্তা কাঁচা হয়ে গেছে। লোকসংখ্যা কমে এসেছে। আশেপাশের অনেক বাড়ি নেই। ইলেকট্রিক পোস্টের বদলে গ্যাসপোস্ট এসে গেছে। রায়বাহাদুর সূর্য সেন আমবাগানে ট্যানা পরে বসে আছেন। থেকে থেকে হুসহাস করে কাক তাড়াচ্ছেন। স্টেট বাসের বদলে চিৎপুর দিয়ে কেরাঞ্চি গাড়ি চলেছে। পেছনের আসনে। বসে আছেন পাগড়ি মাথায় কোনও ব্যানিয়ান। পালকি চড়ে বউঠান চলেছেন শ্বশুরালয়ে। পারিমাঠে বসেছে স্বদেশীসভা। ইডেনের ব্যান্ডস্ট্যান্ডে বাজছে গোরা-বাদ্যি।
বইটির পাতা থেকে কলকাতার প্রাচীন এক রঙ্গালয়ের টিকিট বেরিয়ে এল। যুবক প্রপিতামহ। থিয়েটার দেখেছিলেন। সে রাতের অভিনেতা কে ছিলেন! তিনি এখন কোথায়? কিছু আগে আর পরে দর্শক আর অভিনেতা দুজনেই কালের শিকার হয়েছেন। চোরকুঠুরিতে সময়ের কিছু অভ্রচূর্ণ পড়ে আছে।
নিমেষে আবার বর্তমানে ফিরে আসা। অতীতের মরীচিকা অদৃশ্য। যা ছিল তা ফিরে আসে। যা ছিল না তা আর আসে কী করে! স্মৃতি পরগাছা। বর্তমানের গা বেয়ে অতীত লতিয়ে ওঠে। বর্তমান থেকে শুষতে থাকে প্রাণরস। অতীত আছে বলেই বর্তমান নিরালম্ব নয়। ভাসমান মেঘ। নয়। জপের মালার মতো। মুহূর্তের রুদ্রাক্ষ জীবন-জপ-মন্ত্রে ঘুরে ঘরে আসছে আবার ফিরে ফিরে যাচ্ছে। বছর বছর জুড়ে জীবনের সূত্র দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। এরই মাঝে যুদ্ধ, শান্তি, দেশবিভাগ, মানচিত্রের নব-বিন্যাস, নতুন দেশসীমার জন্ম, রিপাবলিক ডিকটেটারশিপ থেকে ডেমোক্রেসি।
তবু, বর্তমান যতই চেষ্টা করুক অতীতকে একেবারে ঠেলে বের করে দিতে পারে না। অতীত সময়ের ছোট ছোট ডোবা তৈরি হয়। কোনও কোনও অঞ্চলে শতাব্দী আটকে থাকে। এপাশে তিরাশি সাল বইছে ওপাশে ছয় সাল আটকে আছে গাছের ডালে ঘুড়ির মতো।
দেড়শো বছরের প্রাচীন মন্দির দাঁড়িয়ে আছে আকাশের গায়ে মাথা ঠেকিয়ে। অষ্ট ধাতুর ধর্ম পতাকাটি হেলে গেছে একপাশে। মন্দিরগাত্রের কারুকার্য কিছু কিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। বহুকাল বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়নি। সন্ধ্যায় ক্ষীণ তেজের একটি বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে। পুরোহিত একজন আছেন। বয়েসে নবীন হলেও, সাজপোশাক প্রাচীনের মতোই। আরতির ঘণ্টা বাজে টিং টিং করে কেঁদে কেঁদে। শীর্ণ একটি মানুষ কোণে বসে কাঁসর বাজায় থেমে থেমে। তার আবার একটি চোখে দৃষ্টি নেই। আরও একটি পাশে চুপটি করে বসে থাকে এক বৃদ্ধা। সময় তার শরীরের সমস্ত রস শুষে নিলেও প্রাণশক্তিটি এখনও কেড়ে নিতে পারেনি। মন্দির চত্বরের বাইরে কিছু দূরে অবন মালাকারের ভিটে। তালাবন্ধ পড়ে আছে দীর্ঘকাল। বিশাল বিশাল বৃক্ষে নিশীথের বাতাস কানাকানি করে। কর্কশ সুরে প্যাঁচার ডাকে প্রেতেরা নড়েচড়ে ওঠে। মিত্তির বাড়ির মেজোবাবু শতাব্দীর ধাপ বেয়ে বেয়ে নেমে আসেন, ফিনফিনে পাঞ্জাবি গায়ে, শুড় তোলা চটির শব্দ তুলে। দক্ষিণের চিলেকোঠায় ঝুলতে থাকে সুন্দরী মেজোবউ মনের দুঃখে। ভাঙা আস্তাবলে অদৃশ্য ঘোড়া পা ঠুকতে থাকে। উন্মাদ বড়বাবু মাঝরাতে চাতাল থেকে তালঠুকে লাফিয়ে পড়েন কুস্তির আখড়ায়। পরনে লাল ল্যাঙোট। পালোয়ান রামখেলোয়া বোঝাতে থাকে, বাবু এখনও ভোর হয়নি।
রাতে পৃথিবীর পরিসর বড় কমে আসে। দিন যেন মানুষের দান ফেলে দাবা খেলতে বসে। রাত এসে ছক গুটিয়ে নেয়, বোড়েরা উঠে যায় খোলে। গজ এলিয়ে পড়ে ঘোড়ার গায়ে। রাজা শুয়ে পড়ে রানির পাশে। মন্ত্রী চলে যায় বেড়েদের পায়ের তলায়। রাতে মানুষ চলে আসে মানুষের কাছে। অতীত সরে আসে বর্তমানে। নিদ্রার অচেতনতা এগিয়ে আনে অদৃশ্য ভবিষ্যৎ। গাছের ডালে প্রথম রাতে যা ছিল কুঁড়ি, ভোরের আলো ফোঁটার আগেই তা হয়ে দাঁড়ায় পরিপূর্ণ একটি স্থলপদ্ম। দিন চলে যায়। জঠরে জ্বণের আকার একদিনের মাপে বাড়ে। ফাঁসির আসামি মৃত্যুর। দিকে এগিয়ে যায় আরও একদিন। কারুর আসার দিন এগিয়ে আসে, কারুর যাওয়ার দিন। সময় পৃথিবীর সর্বত্র একতালে চলছে না। কোথাও ঘোড়ার চাল, কোথাও বলদের চাল, কোথাও স্থির। পৃথিবী কখনও জ্যোতির্ময়ী কখনও তামসী। মহামায়ার পদতলে শ্বেতশুভ্র শিব। দিন গেল, রাত এল—সময়ের এই হল সহজ হিসেব। জন্ম আর মৃত্যু এই হল নাটকের এক-একটি অঙ্ক। যা ছিল, তা একদিন নেই হবে, যা ছিল না, তা একদিন আছে হবে। শেষ হবে না কিছুই।
কালোয়াত কাল
কোথায় গেল আমাদের সেই সময়। Good old days চতুর্দিকে এত বিভিন্ন রকমের ভয়ংকর ভয়ংকর অপরাধী মার্কেটে ছাড়া পায়নি। জমিদাররা লেঠেল, পাইক, বরকন্দাজ পুষতেন। জমি দখল, চর দখল এই সব নিয়ে মারদাঙ্গা, মাথা ফাটাফাটি হত। লাশও পড়ে যেত। পুলিশ কেস। হত। উকিলে-উকিলে মুখ শোঁকাকি। মামলা উঠল, মামলা নামল। বিধবার সংখ্যা বাড়ল।
ডাকাত ডাকাতি করত সম্পন্ন মানুষের বাড়িতে। গরিবগুর্বো মধ্যবিত্তদের এলাকায় চোর, হিঁচকে চোর আর সিঁদেল চোর। ঘটি, বাটি, ল্যাম্পো, গামছা, গাড়ু, লাউ, কুমড়ো, বেগুন, বরবটি, দু কুনকে চাল, শালগ্রামের সিংহাসন, সাইকেল, দা, কুড়ুল, খোন্তা, গাঁইতি ইত্যাদি হাবিজাবি জিনিস চুরি করত।
গোলাগুলি, বন্দুক, চপার এসব ধারে কাছে যেত না। এদের একটাই কোয়ালিফিকেশন ছিল জলের পাইপ বেয়ে ওঠা, গাছের ডাল ধরে ঝুলে পড়া। কার্নিশ বেয়ে হাঁটা। চালের বাতা সরিয়ে ঘরের ভেতর ধুপ করে নয়, থুপ করে নেমে পড়া। এদের কাছে থাকত গুরুদত্ত ঘুমপাড়ানি মন্ত্র।
তখন সস্তাগণ্ডার বাজার। গোটাকতক শাড়ি, ধুতি, কাঠকুটো, তেল, মশলা, চুরি করলে দু একদিনের জন্যে সংসারের সুরাহা হত। ব্যাঙ্কডাকাতি, রেলডাকাতি এসব বড় বড় ব্যাপার। অবশ্যই রিস্কি। আমাদের কালে ছিচকে চোরদের ওপর মানুষের সিমপ্যাথিও ছিল। রাতে যে চোর, দিনের বেলা সে তো আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ। কলেজে পড়ি, আমাদের সকলের ভীষণ প্রিয় ভোলাদার চায়ের দোকানে চা খাই। সেই সময় মাঝেমধ্যেই লিকলিকে রোগা আমাদেরই বয়সি একটি ছেলে চা খেতে আসত। সবাই জানত সে চোর। তার কোনও লজ্জা, দ্বিধা, সংকোচ ছিল না। হাসছে, কথা বলছে, মজার মজার কথা। সেইসব কথা শুনে আমরা সবাই হো হো করে হাসতুম। সে যে চোর, একথা জানাতে তার কোনও লজ্জাই ছিল না।
অনেকের অনেক কিছু বাঁধা থাকে। বাঁধা শব্দটা এইভাবে ব্যবহার হয়, বাঁধা দরজি, বাঁধা মুদিখানা, বাঁধা চায়ের দোকান, সেলুন, স্বর্ণকার ইত্যাদি। চুরি করার জন্যে বাঁধা বাড়ি, আমরা তার মুখেই শুনেছিলুম। এলাকায় একসময় বড় বড় জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই তাঁদের বোলবোলা আশ্চর্যভাবে কমতে লাগল। সেই ছেলেটি এইরকমই একটি জমিদারবাড়িতে নিয়মিত চুরি করতে যেত। এক অথর্ববৃদ্ধ মানুষ ভেতর দিকের দোতলার একটি ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটাতেন। মোটাসোটা ধবধবে শিবের মতো চেহারা। জমিদার। মানদাশঙ্কর। ছেলে বিলেতে ব্যারিস্টার হচ্ছেন। বিলেতে গিয়ে এক বছরের মধ্যেই মেম বিয়ে করে ফেলেছেন। মেয়ে সন্ন্যাসিনী। পুনার আশ্রমে। দ্বিতীয় মীরাবাঈ। জমিদারবাবুর স্ত্রী মেয়ের কাছে চলে গেছেন। ছত্রাকার সংসার। পুরোনো আমলের অথর্ব একটি কাজের লোক। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায় দেখ।
সেই বৃদ্ধের সঙ্গে এই চোরটির অদ্ভুত এক ধরনের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। গভীর রাতে গল্পগুজবও হত। তারপর ওঠার সময় চোর বললে, তা হলে দেয়ালঘড়িটা নিয়ে যাই?
বৃদ্ধ বললেন, টেবিলের ওপর আমার চশমা আর জলের গেলাসটা আছে। সরিয়ে রেখে টেবিলে উঠে সাবধানে পেড়ে নে। পড়ে গেলে ভেঙে যাবে। দামি ঘড়ি। কিউরিও। বেচবি কোথায়?
চোর বললে, চোর বাজার।
দাম পাবি না। অনেক নতুন নতুন শিল্পপতি বড়লোক গজাচ্ছে, তাদের কাছে নিয়ে যা। কত দাম চাইবি? বলে দিচ্ছি, দশে শুরু করবি, সাতে নামবি। সাত হাজারের কমে ছাড়বি না। এ ঘড়ি ইন্ডিয়ায় বেশি নেই।
সেকালের ক্রিমিন্যালদের মধ্যে দারুণ একটা হিউমার ছিল। দরদও ছিল। বৃদ্ধ মানুষটির এইসব কথা শুনে সেই চোর ঘড়িটা নিল না। জিগ্যেস করল, আপনি ঘুমোন না কেন?
ঘুম আসে না। পুরোনো দিনের অজস্র কথা মনে পড়ে যায়। কত কথা! বাবার কথা, মায়ের কথা। আমার দাদার কথা। বাংলাদেশে আমাদের জমিদারির কথা। সেই তালপুকুরটার কথা। সেই সাদা ঘোড়াটার কথা। সেই ময়ূরপঙ্খী নাওটার কথা। আমার বিয়ের রাতের কথা।
চোর তখন বললে, শুনুন বাবু, ভদ্দরলোকদের এই এক মুশকিল, তারা শুধু ভেবে ভেবেই ঘাটে চলে যায়। অত ভাবেন কেন? মাথার ওপর ছাদ আছে, পেটে দুটো ভাত আছে, পিঠের তলায়। বিছানা আছে। যেটা নেই, সেটা হল নাক ডাকিয়ে ঘুম। টান টান হয়ে শুয়ে পড়ুন, আমি আপনার পা টিপি। গল্পের গরু নয়, সত্য ঘটনা। পরেশ চোর হয়ে গেল পরেশ সাধু। যে এদিকেও। যেতে পারে, সে ওদিকেও যেতে পারে। পরেশ ভালোর দিকে এমন পালটাল, যে বই লেখা যায়। সেই বৃদ্ধ মানুষটি তাকে সন্তানের চেয়েও ভালোবেসে ফেললেন। পরেশ তাঁকে চাঙ্গা করে তুলল। নতুন করে বাঁচতে শেখাল। একটা কারখানা খুলে বসল। পাওয়ারলুম। দিন-রাত কাজ হয়।
অঞ্চলের বহু দুস্থ মহিলার জীবিকার সন্ধান।
আমরা এখন চলেছি ভাঙনের মধ্য দিয়ে। সুনামি, আর্থকোয়েক, টেররিজম, এক্সটর্শান, কিডন্যাপিং সব ভালো ভালো শব্দ। মানুষ কী করতে চাইছে মানুষই জানে না। অজস্র বক্তৃতা, অজস্র প্রতিশ্রুতি। কিন্তু কোনও লক্ষ্য নেই, আদর্শ নেই। মন্দিরে মাধব নেই, ভোঁ ভোঁ শাঁখের শব্দ। বিগ্রহশূন্য মানব-মন্দিরে উন্মাদের পূজা।
এই ভালো, খুব ভালো। ধেই ধেই ভালো। পারমিসিভ সোসাইটি। যে-কোনও আদর্শই ব্যাকডেটেড। ছাত্রদের ভয়ে অধ্যাপক জড়সড়ো। ছেলের ভয়ে বাপ পলাতক। স্ত্রী-র ভয়ে স্বামী দার্শনিক। শিষ্যের দাপটে গুরু কেঁচো। কাজের মহিলার দাপটে গৃহ তটস্থ। শ্রমিকের দাপটে শিল্পপতি নিরুদ্দেশ। গাড়ির দাপটে পথচারী যমালয়ে। সর্বত্র মারমুখী জনতা। ভাষা হল খুন। খুন কা বদলা খুন।
সূর্য্যাস্তের পর জলখাওয়া নিষিদ্ধ। আরকের রাত। বউ পেটানো মধ্যরাতে। টেলি সিরিয়ালের জীবন। কসমেটিক সমস্যা। গান হল, ব্যান্ড।
তোমার মরণ, তোমার মরণ
আমার মরণ নয়।
মরব যখন ঘাটে যাব
কী করবি কর।
সবাই এখন কালোয়াত। কী ছেলে, কী মেয়ে! একটা হাত কানে। সেলফোন। চার্চে গেছি। একটি মেয়ে থামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জুতো জোড়া তার পায়ের কাছে। নিতে পারছি না। শুনছি উপগ্রহ ছুঁয়ে প্রেম আসছে—প্রেমের দেবতার মন্দিরে। ফোন করেছেন যিশু নয়, কাঁচরাপাড়ার বিশু।
কী হল!
ছাত থেকে নদীটা দেখা যায়। দূরে সূর্য ওদিকেই অস্ত যায়। নদীর ওপারে জঙ্গল আর পাহাড়। আমরা কয়েকদিনের জন্যে এখানে বেড়াতে এসেছি। বড়রা আশেপাশে বেড়াতে যান। এখনও স্টেশানে যান। বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাগানে ঘুরে বেড়ান। বৈঠকখানায় হাসি-গল্প করেন আর রকম রকম খাবার খান।
রুকু একদিন আমাকে বলল, ‘শোন পলাশ, তোর ভালো লাগে এই খুচখাচ ঘোরা আর সারাদিন বড়দের বড় বড় কথা শোনা?’
‘কী আর করা যাবে বল, বড়দের কথা ছোটদের শুনতেই হবে।’
‘আমরা অত ছোট নই, আর কয়েকবছর পরে আমরাও বড় হয়ে যাব।’
‘কী করতে চাস?’
‘কাল খুব ভোরে আমরা ওই নদীটার কাছে যাব। দুপুরে চান করব। চাল, ডাল, আলু সব নিয়ে যাব। খিচুড়ি বেঁধে খাব।’
শুনে খুব আনন্দ হল। ভয়ও হল। বললুম, ‘ওপারের জঙ্গলে বাঘ থাকে।’
থাকে থাক। বাঘ বাঘের জায়গায় থাকবে। আমাদের কী?’
‘এপারে যদি চলে আসে।’
‘আসুক। গরম গরম খিচুড়ি খাইয়ে দেব।’
‘মানুষ খায়?’
‘আমাকে খাইয়ে দেব। তুই বাড়ি চলে আসবি।’
পরের দিন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। পথ একসময় ফুরিয়ে গেল। তারপর মাঠ ময়দান। এর আগে একটা চালা দোকানে আমরা গরম জিলিপি আর কচুরি খেয়েছি। দোকানদারকে জিগ্যেস করায় বললেন, ‘নদী! সে তো বেশদূরে। অনেকটা পথ। কেউ থাকে না সেখানে। এক শিকারি সাহেবের ভাঙা একটা বাংলো আছে। সাপের আড্ডা। সেখানে গিয়ে কী করবে তোমরা!’
রুকু বললে, ‘নদী দেখব।’
‘নদীর আবার দেখার কী আছে? কলকল করে জল যাচ্ছে। সাদা সাদা পাথর।’ রুকু বললে, ‘সেইটাই তো দেখব।’
দোকানদার আর কথা বললেন না। বিরক্ত মুখে কড়ায় জিলিপি ঘোরাতে লাগলেন।
রুকু জিগ্যেস করলে, ‘কোন দিক দিয়ে যাব?’
‘পশ্চিমে ঘুরে যাও। শেষ এক মাইল স্রেফ জঙ্গল।‘
‘বাঘ আছে?’
‘না, বাঘ ওপারে। মাঝেসাঝে দেখা যায়।’
‘তাহলে আবার কী?’
‘আনন্দের কিছু নেই। প্রচুর কটাস আছে।’
‘কটাস আবার কী?’
‘বড় বড় কালো কালো বনবেড়াল। ধরলে শেষ।’
রুকুর খুব আনন্দ বিপদের নাম শুনলে। নাচতে থাকে।
শীতকাল। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে। ফনফনে উত্তরে বাতাস। আমাদের দুজনের হাতেই ভাঙা গাছের ডাল। বনবেড়াল এলে পেটাতে হবে। দেহাতি গ্রামের এলাকা শেষ হয়ে গেল। প্রথমে পাতলা জঙ্গল। ঘন জঙ্গল এইবার শুরু হবে। দূরে দেখতে পাচ্ছি।
গাছের আড়াল থেকে ভোজবাজির মতো একটা বাচ্চা ছেলে বেরিয়ে এল। ভারী সুন্দর দেখতে।
কোঁকড়া চুল। খাড়া নাক, বড় বড় চোখ। ছেলেটি জিগ্যেস করলে, ‘কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’
‘নদীর কাছে। তুমি কে?’
‘আমি এই বনে থাকি। আগে আমার জায়গায় চলো। বিশ্রাম করে নদীতে যাবে।’
ছেলেটি আগে আগে চলেছে। আমরা পেছনে। যেন টেনে নিয়ে চলেছে অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বেঁধে। গভীর জঙ্গলে হঠাৎ একটা জায়গা খুব পরিষ্কার। সেখানে একটা ভাঙা মন্দির। অপূর্ব কারুকাজ সব ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ছেলেটি চট করে সেই মন্দিরে ঢুকে গেল। ভেতরের থেকে ডাক এল ‘এসো’।
কেউ কোথাও নেই শ্বেতপাথরের বেদীর ওপর শ্বেতপাথরে তৈরি শ্রীরামচন্দ্রের অপূর্ব মূর্তি। যেন হাসছেন। কী সুগন্ধ!
ভাঙা মন্দিরের পাশে একটা কুঠিয়া। সেখানে শুয়ে আছে এক বৃদ্ধ সাধু। জ্বরে অচৈতন্য। রুকু। সঙ্গে সঙ্গে সেবা শুরু করল। জলপটি কপালে দিয়ে আমাকে বললে, ‘পা ঘষতে থাক। বরফ হয়ে গেছে।’
অনেকক্ষণ পরে সাধু চোখ মেলে বললেন, ‘রুকু! তুমি আর পলাশ এসেছ, আমি দেখেছি। আজ রঘুবীর তিন দিন উপবাসী।’
‘নাম জানলেন কী করে?’
‘ও জানা যায়, রঘুবীরের কৃপায়। আমার পাত্রে পঞ্চকেদারের জল আছে, আমার মুখে দাও। এক্ষুনি সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপর তোমরা ভোগ বসাও। পেছনেই নদী। আগে স্নান করে এসো।’
নদীতে স্নান করতে করতে রুকু বললে, ‘আমি আর ফিরব না। আমার বিশ্বাস সাধু আর কেউ নয়, বিশ্বামিত্র মুনি!’
স্নান করে ওঠার পর যা হল, তা আরও অদ্ভুত। সেই জায়গাটা আমরা আর খুঁজে পেলুম না! সেই মন্দির, বিগ্রহ নেই, সারা জায়গা জঙ্গল আর জঙ্গল! যেদিকে যাই জঙ্গল।
কুশলের সাইকেল
অমরবাবু মানে অমর বসু আমাদের ব্যাকরণ পড়াতেন। ব্যাকরণ যতটা নীরস, অমরস্যার তার চেয়েও নীরস ছিলেন। চেহারাটা ছিল কোষো পেয়ারার মতো। আমরা নাম রেখেছিলুম সব্যসাচী স্যার। ডান হাত, বাঁ হাত দুটোই সমান চলত। বেত আর ডাস্টার দুটোই চালাতেন অক্লেশে। আর একটা কী? বাদ দিতেন না কাউকে। ফার্স্ট থেকে লাস্ট বেঞ্চ, সবাই গোল আলু, ঠিকরে আলু। আঁচড়, শুধু কামড়টাই বাদ যেত। আমরা বলাবলি করতুম, আর একটু বয়স বাড়লে ক্লাসে আমাদের কামড়েও দিতে পারেন। তবে একটাই কথা—সব্যসাচীস্যারের বয়স বাড়লে আমাদেরও বয়স বাড়বে। বছরের পর বছর ফেল না করলে আমরা পাসটাস করে বেরিয়ে যাব। তখন যাকে কামড়াবেন, তাকে কামড়াবেন, আমাদের দেখার দরকার নেই।
অমরস্যারের ছেলের নাম কুশল। কুশল আমাদের সঙ্গেই পড়ে। ফাস্ট বেঞ্চে বসে। ভালো ছেলে। ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়। অঙ্কে আর ইংরেজিতে ভীষণ ভালো। কুশলের তেমন অহংকার নেই। আমাদের সঙ্গে মেশে। মুখ গোমড়া করে বসে থাকে না। কুশলের চোখ খুব খারাপ। পুরু লেন্সের চশমা চোখে। কাচের আড়ালে বড়-বড় চোখদুটো ঝকঝক করে। কুশল একটু তড়বড় তড়বড় করে কথা বলে। কথা বলার সময় হাত নাড়ে খুব। ছেলেটা খুব সরল। আমার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব। স্কুল ছুটির পর ক্লাসরুমে বসে দুজনে অনেকক্ষণ গল্প করি। তার কাছে আমি আবার অঙ্ক বুঝে নিই। যে-অঙ্ক আমি জীবনে কষতে পারব না, কুশল তা নিমেষে করে ফেলে।
যে-কুশল কখনওই স্কুল কামাই করে না, সে পরপর তিনদিন ক্লাসে আসছে না। ব্যাপারটা কী হল! অমরস্যারকে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘স্যার, কুশল কেন আসছেনা?’
‘কুশল কেমন আছে কুশল জানে, আমাকে জিগ্যেস কোরো না।’ ভয়ে পালিয়ে এলুম। আমার আর-এক বন্ধু অপূর্বকে বললুম, ‘কুশলের কী হল বল তো?’
‘চল না ছুটির পর দেখে আসি।’
‘স্যার যদি মারেন!’
‘কারও বাড়ি গেলে মারে! মারামারি সব ক্লাসে।’
স্কুল থেকে প্রায় এক মাইল হবে কুশলদের বাড়ি। খেলার মাঠ, বোসদের ঝিল, বরফকল, হরেনবাবুর কাঠকল পেরিয়ে, শ্মশানের পাশ দিয়ে, নদীর ধারে বাড়িটা। বড়লোকদের বড়-বড় বাগানবাড়ি, সারাদিন ঝিম মেরে থাকে। সেইরকম দুটো বাগানবাড়ির মাঝখানে অমরস্যারের বাড়ি। বেশ বড় একটা উঠোন। উঠোনের মাঝখানে একটি কামিনী গাছ। লাল দালান। পেছনেই নদী। বাড়িটা বেশ শান্ত। আমরা ডাকছি, ‘কুশল, কুশল!’ কোনও সাড়া নেই। সময়টা বিকেল বিকেল। কৃষ্ণকলির ঝোপে সাদা, হলুদ, নীল ফুল ফুটেছে। কামিনীর ডালে চড়াই পাখির ঝাঁক গল্প করছে। আবার ডাকলুম—’কুশল’! আমরা এই প্রথম কুশলদের বাড়িতে আসছি।
অমরস্যারের ভয়ে আগে কখনও আসিনি। বেশ ভয়-ভয় করছে। এইবার একটু জোরে ডাকলুম, ‘কুশল’। মায়ের মতো দেখতে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, ‘তোমরা কে বাবা?
‘আমরা কুশলের বন্ধু। কুশল কেন স্কুলে যাচ্ছে না মাসিমা?’
‘কুশল তো হাসপাতালে।’
‘হাসপাতালে! কেন কী হয়েছে?’
‘তোমরা জানো না!’
‘কোন হসপাতালে মাসিমা?’
‘জেলা হাসপাতালে।’
‘কী হয়েছে কুশলের?’
‘কুশলকে আর চেনা যাচ্ছে না। চুনের গামলায় পড়ে গেছে।’
আমি আর অপূর্ব দু’জনে বোকার মতো মুখের দিকে তাকালুম। কুশলের মা বললেন, ‘আমার আর দাঁড়াবার সময় নেই বাবা, আমি এখন কুশলকে দেখতে যাচ্ছি। তোমরা আসবে তো এসো।’
হাসপাতালের বিছানায় কুশল শুয়ে আছে। গোটা শরীর সাদা ব্যান্ডেজে জড়ানো। মুখেও ব্যান্ডেজ। শুধু নাকের একটুখানি আর চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। কুশল চিত হয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে একটা বোয়াল মাছ। চোখ দুটো গুলির মতো জ্বলজ্বল করছে। নাকটা মাছ ধরার। ফাতনার মতো জেগে আছে। ব্যান্ডেজের ভেতর থেকে কুশল একটা কিছু বলার চেষ্টা করল। কাচের জানালায় ডুমো মাছি আটকে গেলে যেমন বুজুর-বুজুর শব্দ হয়, সেইরকম একটা শব্দ ছাড়া কিছুই বোঝা গেল না।
আমি আর অপূর্ব দুজনে দুটো টুলে বসলুম। কুশলের বিছানা ঘেঁষে। কুশলের মা বসে আছেন মাথার কাছে। ছেলের চুলে হাত বুলোচ্ছেন। চুল ছাড়া শরীরে আর কোনও অংশই তো খোলা নেই। অপূর্ব বলল,—’তুই কী করে এমন হয়ে গেলি কুশল?’ কুশল কাচের গায়ে মাছির গলায় যা বলল, সেটা হল—কুশলের অনেকদিনের ইচ্ছে, সাইকেল চালানো শিখবে। অমরস্যার বারবার সাবধান করেছিলেন, ‘কুশল, টেস্ট পরীক্ষার আগে সাইকেল-মাইকেল নিয়ে মেতো না। পরীক্ষার পর তুমি নর্দমায় পড়ো; খানায় পড়ো আমার কিছু বলার নেই।’ কুশল বাবার কথা অমান্য করেছে।
‘তা লোকে তো সাইকেল নিয়ে খানায় পড়ে, তুই চুনের গামলায় পড়লি কী করে?’
বুজুর-বুজুর করে ব্যান্ডেজের তলা থেকে কুশল বলে গেল, ‘আমার ছোটমামার একটা সাইকেল আছে। যেমন বড়, তেমন ভারী।’
‘তাতে তোর কী?’
‘ছোটমামা অনেকদিন থেকে বলছিলেন, কুশল, সাইকেলটা শিখে রাখ, ব্যাটাছেলের সাইকেল শেখা খুব দরকার। অনেক উপকারে লাগবে।’ বললেন, ‘একমাস সাইকেলটা ধরে হাঁট। সাইকেলটা পাশে নিয়ে মাইলের পর মাইল হাঁট। সাইকেলটা তোর পাশে থাকতে-থাকতে বেশ পোষ মেনে যাবে। তারপর হঠাৎ একদিন তার ওপর চেপে বসাব।’
‘তা তুই হাঁটলি?’
‘সেই হাঁটতে গিয়েই তো এই কাণ্ডটা হল। ঘোষালদের দোকান চুনকাম হবে, পয়লা বৈশাখ এসে। গেল। গরুর জাবর খাওয়ার বড় গামলায় চুন ভেজানো ছিল। গামলাটা ছিল পথের পাশে। সাইকেলটা মাঝে-মাঝে আমাকে হ্যাঁচকা টান মারছিল। আমিও টান মারছিলুম। টানাটানি চলছিলই। গামলাটার কাছে এসে সাইকেলটা লগবগিয়ে শুয়ে পড়তে চাইল। আমিও মারলুম টান। সাইকেলটা আমার ঘাড়ের ওপর শুয়ে পড়ল, আমিও শুয়ে পড়লুম চুনের গামলায়। সবাই এসে যখন উদ্ধার করল তখন আমি চুনে ভিজে সপসপে হয়ে গেছি।’
সাতদিন পরে কুশল স্কুলে এল। রংটা বেশ ফরসা দেখাচ্ছে। চোখ দুটো কোনওক্রমে বেঁচে গেছে। চুন ঢুকে গেলে আর কিছু করা যেত না। নাকে ঢুকে গেলেও সাঙ্তিক ব্যাপার হত। কুশল বলল, ‘সাইকেলটার ওপর ভয়ংকর প্রতিশোধ নোব।’
‘কীভাবে নিবি?’
‘হাফ প্যাডল, ফুল প্যাডলের মধ্যে যাব না। একেবারে সিটে চেপে বসব। প্যাডলে পা। ব্যাপারটার মধ্যে হাতি-ঘোড়া কিছু নেই। শুধু ভোলার ব্যাপার।’
‘ভোলার ব্যাপার মানে?’
‘মানে ভুলতে হবে যে, আমি সাইকেল চেপে আছি। ভুলতে হবে যে আমি সাইকেল চালাতে জানি না। পৃথিবীর বড়-বড় মানুষ বড় হয়েছে কীভাবে জানিস? ভয়কে জয় করে। দুটো কথা মনে রাখবি—পারিব না, এ-কথাটি বলিও না ভাই, এটা হল প্রথম কথা। দ্বিতীয় কথা হল, আমি ভয় করব না ভয় করব না, দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।’
‘এতেই হয়ে যাবে?’
‘হয় কি না দেখবি চল।’
কুশলের সঙ্গে কুশলের মামার বাড়িতে গেলুম। কুশল আমাদের ম্যাজিক দেখাবে। সাইকেল। চালানোনা শিখেই পাকা চালিয়ের মতো সাইকেল চালাবে। স্রেফ দুটো কথার ওপর নির্ভর করে, ‘পারিব না এ কথাটি’ আর ‘আমি ভয় করব না’। কুশল সাইকেলটা বাড়ি থেকে রাস্তায় বের করে। আনল। বেশ তাগড়া, শক্তপোক্ত একটা সাইকেল। কুশলের মেজোমামা লম্বা মানুষ, তাই সিটটা বেশ উঁচু করা। রাস্তাটা সোজা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। পশ্চিমে গঙ্গা। রাস্তাটা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে শেষ হয়েছে। সেকালের জমিদারদের করা ঘাট। একটু ভেঙে এলেও বেশ সুন্দর। বিশাল চাতাল। ধাপে-ধাপে পইঠা নেমে গেছে জলে। রাস্তাটা নির্জন। তেমন লোক চলাচল নেই। দু পাশে বাগানবাড়ি, প্রাচীন মন্দির। বড়-বড় গাছ। বেশ স্নিগ্ধ, শান্ত পরিবেশ।
কুশল বলল, ‘আজ তোদের আমি দেখাতে চাই, কী দেখাতে চাই?’
‘সাইকেল চড়া।’
‘না সাইকেল চড়া নয়, আজ প্রমাণ করব, মানুষের মনই সব। মনই সব করে। যে জীবনে কখনও সাইকেল চড়েনি, সে সাইকেলে চড়ে চালাতে-চালাতে চলে যাবে।’
কুশল একটারকের কাছে সাইকেলটাকে নিয়ে এল। গম্ভীর মুখে বললে, ‘একটু বেআইনি হচ্ছে, মানে, রকে উঠে সিটে বসব। প্যাডেলে পা রেখে সাইকেলে চড়া, প্রথমেই পারব না। পড়ে মরব। অনেক পেকে গেলে তবেই ওভাবে চড়া যায়। আশা করি এতে তোমাদের আপত্তি হবে না।’
আমরা বললুম, ‘না, না, এতে আমাদের কোনও আপত্তি হবে না।’
কুশল রক থেকে বীরের মতো সাইকেলের সিটে উঠে বসল। বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এইবার আমি আমার মনকে বলব, মন! তুমি কাঁচা নও, পাকা সাইকেল চালক। তুমি সাইকেলে ভূ-পর্যটন করে এসেছ। তুমি সাইকেল চড়ে পৃথিবীতে এসেছ, সাইকেল চড়েই স্বর্গে যাবে।’
কুশল প্যাডেলে পা রেখে চাপ দিল। ডান দিকে হাতল ঘুরিয়ে লগবগ করে রাস্তায় নেমে পড়ল। আমরা ভয়ে চোখ বুজিয়ে ফেললুম। কুশল পড়বে, সাঙ্ঘাতিকভাবে পড়ে হাড়গোড় চুরমার করে ফেলবে। চোখ খুলে দেখি, কুশল অনেকটা দূরে চলে গেছে। সাঁই সাঁই করে গঙ্গার দিকে চলেছে। আমরা পেছন-পেছন দৌড়োচ্ছি। কুশল উল্কার মতো সামনে ছুটছে। রাস্তা শেষ। কুশল ঘাটের চাতালে। আমরা চিৎকার করছি, ‘নেমে পড় নেমে পড়।’ চাতাল শেষ করে কুশল। সাইকেলসুষ্ঠু লাফাতে-লাফাতে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে সোজা জলে নেমে গেল।
আমরা কোনওরকমে কুশলকে টেনেটুনে জল থেকে তুললুম। ডান পাটা ভেঙে গেছে। ডান হাত চুরমার। মনে আছে আমাদের, হাসপাতালে কুশলের জন্যে আলাদা একটা বেড রাখা হয়েছিল। কারণ, কুশল মনের জোরে সবকিছু করতে চাইত। তার ফলে দেহ কাবু হয়ে পড়ত। স্কুলে, কুশলের শেষ মনের জোর যা দেখেছিলুম, তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়া। কুশল দেখাতে চেয়েছিল, মনের জোরে মানুষ পাখির মতো উড়তেও পারে। সেবার তিন মাস শুয়ে ছিল। হাসপাতালে।
আজ, কুশল একজন বড় বিজ্ঞানী। আমেরিকায় থাকে। আমাকে আর অপূর্বকে হয়তো আর মনে নেই। এইটুকু জানি, কুশল মনের জোরেই বড় হয়েছে। অমরস্যার হঠাৎ মারা গেলেন। কুশল নিজেকেই নিজে বড় করেছিল।
কে?
১.
দু গেলাস চা, দুটো দিশি বিস্কুট। হাসপাতালের সামনে কোনওরকমের একটা চায়ের দোকান। যত বিপদগ্রস্ত মানুষ খদ্দের। কী খাচ্ছে না খাচ্ছে খেয়ালই নেই। মন পড়ে আছে বিপরীত দিকের হাসপাতালে, যেখানে প্রিয়জনেরা জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সায়েব আমলের এক নম্বর হাসপাতালের এখন দশদশা। ভেতরে ঢুকলে কান্না পায়।
সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। কোনওরকমে চা শেষ করে আমি আর সুবীর একটা পার্কে। গিয়ে বসলুম। শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। সুবীর বললে, ‘কী হয়ে গেল বল তো! আমি ভাবতেই পারছি না। কী করে হল? আত্মহত্যার চেষ্টা নয় তো!’
‘আত্মহত্যা করতে যাবে কী কারণে? অসাবধানতা। গ্যাস জ্বালিয়ে দেশলাই কাঠিটা নাইটির ওপর ফেলে রেখেছে। খেয়াল করতে পারিনি। যখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে, তখন ভয়ে কী করবে না করবে ঠিক করতে পারেনি। অনেকেই পারে না।’
‘বেশ ভালোরকম পুড়েছে। তোর কি মনে হয়, বাঁচবে তো?’
‘ভগবান জানেন। বার্ন কেসে কিছু বলা যায় না।’
সুবীর বাদাম কিনলে। সন্ধে এগিয়ে আসছে। একপাশে বাচ্চারা হইচই করছে। ছড়ি হাতে বৃদ্ধরা পাকের পর পাক মেরে চলেছেন। আরও আরও বাঁচতে হবে। কেউ মরতে চায় না। সাজপোশাক দেখে বোঝা যায় বিত্তবান। হয় বড় চাকরি করতেন, না হয় ব্যবসা। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ভরপুর সংসার।
এই সরকারি উদ্যানে আগেও বসেছি অনেকবার। ছাত্রজীবনের কত বিকেল এখানে পড়ে আছে! সৌরভ, শ্যামল, বিদ্যুৎ, বিকাশ। কে কোথায় চলে গেল! ডাকাবুকো শ্যামল এত জোরে বাইক চালাল, পৃথিবীর বাইরে চলে গেল। আমাদের ব্যাচে বিধানই খুব উন্নতি করেছে। এখন আমেরিকার ‘নাসা’য় আছে। সায়েন্টিস্ট। খুব অভাবের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছে। হয়েছে তার। মায়ের জন্যে। অমন মা বিরল। আমার দাদু বলতেন, জন্ম দিলেই মা হয় না। কোন্নগরে গঙ্গার ধারে এক চিলতে একটা বাড়ি। ছোট্ট একটা কিচেন গার্ডেন। বিধানের বয়েস তখন তিন, বাবা মারা গেলেন। মা মানুষ করলেন ছেলেকে। সে এক সংগ্রাম। বিধানের বাড়িতে প্রায় প্রতি রবিবারেই যেতুম। দুটো আকর্ষণে—গঙ্গা আর মাসিমার হাতের অসাধারণ রান্না। ভীষণ। ভালোবাসতেন আমাকে। এখন আর যাই না। সংকোচ। আমি তো কিছু হতে পারলুম না। একেবারে মিডিওকার। আমার বাবা দুঃখ করে বলতেন, হওয়ার ইচ্ছে না থাকলে কিছু হওয়া যায় না।
সুবীর বললে, ‘কিছু মনে করিস না, আমাকে যেতে হচ্ছে, শেয়ালদার এক পার্টিকে টাইম দেওয়া আছে।’
সুবীরের নিজস্ব একটা ফার্ম আছে—ইলেকট্রিক্যাল কনট্রাক্টর। বেশ ভালোই চালাচ্ছে। ব্যবসাদারের ফ্যামিলি। পরিবারের কেউ কখনও চাকরি করেননি। বড়বাজারে পারিবারিক একটা ব্যবসা আছে হার্ডওয়্যারের। কলকাতায় তিনখানা বাড়ি।
সুবীর একটু অন্যরকমের। লেখাপড়ায় বেশ ভালো ছিল। শিবপুরের ইলেট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। চাকরির অনেক সুযোগ এসেছিল। নেয়নি। হাতে বড় বড় প্রোজেক্ট। গ্রে স্ট্রিটে অফিস। কেন জানি না আমাকে ভালোবাসে। কখনও বন্ধু, কখনও আবার অভিভাবক। জীবনের পরামর্শ দেয়। মাঝেমধ্যে শাসনও করে।
আমি একটা জরাজীর্ণ বাড়ির দোতলার একটা ঘরে থাকি। বাড়িটা আমার দাদুর। বেশ বড়ো বাড়ি। আমার দাদু একজন নামী মানুষ ছিলেন। ইংরেজির অধ্যাপক। বহুবার বিলেত গেছেন। আমার মা একমাত্র মেয়ে। ছেলে ছিল না। দিদিমা বাড়িটা আমাকে লিখে দিয়ে গেলেন। আমার আদর্শবাদী বাবা দান নেবেন না। বাড়িও করলেন না। ভাড়া বাড়িতে দিন কাটালেন। বাড়িটা পড়ে রইল তালা বন্ধ। বাবা ছিলেন কেমিস্ট। জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনে ল্যাবরেটারিটা নষ্ট হল। নেতারা নৃত্য করলেন। বাবা ওপরে চলে গেলেন। পড়ে রইলুম আমি আর আমার মা। ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে উঠে এলুম দিদিমার বাড়িতে।
বাড়িটা হন্টেড।
বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করবেন না। আমি বিশ্বাস করি। বিজ্ঞান মঞ্চে তরুণ বামপন্থী বিজ্ঞানীদের বক্তৃতা অনেক শুনেছি। আমার বিশ্বাস কিন্তু বদলায়নি। গভীর রাতে সারা বাড়িতে যে বেহালার সুর ঘুরে বেড়ায় কে বাজায়? সে সুর বাইরে থেকে আসে না। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে, একতলার গুদাম ঘরে বিরাট একটা সিন্দুক আবিষ্কার করলুম। বিশাল তালা ঝুলছে। বিলেতের ‘চাবস কোম্পানি’-র তৈরি। চাবি কোথায়? চাবি হারিয়ে গেছে। মা জানে না। সিন্দুকে কী আছে, তাও জানে না। পড়ে আছে—আছে।
মা হঠাৎ মারা গেলেন। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর বারান্দায় বসে আমার সঙ্গে গল্প করছিলেন। ভবিষ্যতের গল্প। ‘ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে তোর চাকরিটা যদি হয়ে যায়, তা হলে তো তোকে ফরেস্টেই থাকতে হবে, তা হলে আমি কোথায় কার কাছে থাকব?’
‘তোমাকে আমি মাথায় করে রাখব। আমার কাছে থাকবে তুমি। আমাকে একটা ফার্স্ট ক্লাস ফরেস্ট বাংলো দেবে। চারপাশে বড়ো বড়ো শাল আর সেগুন গাছ। বাংলোর সামনে সবুজ লন। ফুলের বাগান। একটু হেঁটে গেলেই একটা নদী। দূরে পাহাড়ের পর পাহাড়। তোমার হাঁস। পোষবার শখ। তোমাকে আমি কুড়িটা হাঁস কিনে দেব। সাদা-কালো, পাঁশুটে রং। তুমি চই চই। করে ডাকবে। তোমাকে গোল করে ঘিরে হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করবে। মা সরস্বতীর একটা হাঁস আমার মায়ের কুড়িটা হাঁস।’
‘বাঘ আসবে?’
‘আসতেও পারে। তবে রোজই হাতি আসবে। বড় বড় হাতি।’
‘আমি একটা কিচেন গার্ডেন করব।’
‘কিচেন গার্ডেন কি গো, তোমার বিরাট বড় একটা বাগান হবে!’
‘যাক বাবা, অনেক দুঃখের পর এইবার একটু সুখ, কী বল খোকা?’ মা হেসে উঠলেন। হাসিটা আচমকা কেটে গেল। শব্দ নেই। মুখে হাসি লেগে আছে। মা নেই। পাখি যেভাবে খাঁচা থেকে উড়ে যায় মায়ের প্রাণ সেইভাবে উড়ে গেল।
অদ্ভুত আমার জীবন। কেউ আমার কথা একবারও ভাবলে না। সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি মায়ের ব্যবহারে। এক নিষ্ঠুর পৃথিবীতে কেউ আর আমার রইল না। আমি বেঁচে থাকলেই বা কী, মরে গেলেই বা কী? কারও কিছু যায়-আসে না।
মা চলে যাওয়ার পর শুরু হল আমার অন্বেষণ। বাড়িটার কোথায় কী আছে! ঘরের পর ঘর তালাবন্ধ। খোলার কোনও প্রয়োজন হত না। বড় বড় খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল। আলমারির ভেতর কত কত কাপড়, জামা। অতীতের চরিত্রটা পড়তেন। ড্রেসিং টেবিলে কত রকমের সাজার জিনিস। চিরুনি, হেয়ার ব্রাশ। হাড়ের চিরুনির হাতল ফেটে ফেটে গেছে। হেয়ার ব্রাশের হেয়ার সব ডেলা পাকিয়ে গেছে। পারফিউমের শিশির সব গন্ধ উড়ে গেছে। আয়নার বেলজিয়াম কাচে ছোপ ধরে গেছে। সোফায় সাতপুরুষের ধুলো। খাটে পরিপাটি বিছানা-বালিশ। ধুলোয় সাদা। মশারি ওপরে গোটানো। দামি নেটের মশারি। হাত দিলেই ঝরে পড়ে যাবে।
একটা ঘরের মেঝেতে পাউডারের মতো ধুলো। তার ওপর ছোট ছোট পায়ের ছাপ। ছোট তো কেউ ছিল না। কে এসেছিল এই ঘরে! এ এক রহস্য! মা থাকলে বলতে পারতেন। একবার মনে। হয়েছিল মেঝেটা ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলিসাহস হয়নি।
নীচের গুদাম ঘরে ঢুকে অবাক। অসম্ভব ব্যাপার! এক পা এগোবার উপায় নেই। ভাঙা ফার্নিচার। হরেক রকমের বাক্স। হাভানা চুরুটের খালি বাক্স কমসে কম শ’ দুই। মাতামহ চুরুট খেতেন। এক ডজন বিলিতি ছিপ। গোটা কুড়ি হুইল। মাছ-ধরা সুতো সমেত।
এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র বন্ধু সুবীর। মা মারা যাওয়ার পর রাতে সে আমাদের এই বাড়িতে আমার সঙ্গে শুতে আসত। কোনও কোনও দিন কাজকর্ম তাড়াতাড়ি শেষ করে সন্ধের পরেই। চলে আসত। সুবীরের হবি ছিল রান্না। নানারকম বাজার করে আনত। দুজনে রান্নাঘরে ঢুকে যেতুম। সর্বত্র মায়ের হাতের স্পর্শ। সুন্দরভাবে সব গোছানো। কৌটোর গায়ে গায়ে লেবেল মারা। ধনে, জিরে, পাঁচফোড়ন। ময়দা, সুজি, চিনি, চা। সব বৈজ্ঞানিক কায়দায় সাজানো। বড় মানুষের মেয়ে, একমাত্র মেয়ে।
আমার মাতামহী প্রয়াগের কুম্ভমেলায় হারিয়ে গিয়েছিলেন। রহস্যের জট খোলা যায়নি। সারা ভারতের পুলিশ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আমার দিদিমাকে উদ্ধার করে আনতে পারেননি। দাদু প্রাইভেট এজেন্সিকে ভার দিয়েছিলেন। সন্ধান মেলেনি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল—ডুবে গেছেন। অথবা, যেহেতু সুন্দরী ছিলেন দুর্বত্তরা ধরে নিয়ে গেছে।
দাদুর দুঃখ আমি বুঝি। চুরুট, বই, মাছ ধরা আর বিদেশ ভ্রমণ–নিঃসঙ্গ জীবনের এই হল সঙ্গী। সাত, আট খানা মোটা মোটা ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছেন জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
মায়ের রান্নাঘরে ঢুকলে প্রথম প্রথম আমার খুব কান্না পেত। সুবীর একদিন খুব বকাবকি করলে। পুরুষ মানুষ পুরুষ মানুষের মতো হবি। মেয়েদের চোখের জলের দাম আছে। পুরুষের চোখের জল দুর্বলতা। মৃত্যুর পৃথিবীতে মৃত্যু থাকবেই। কেউ আগে যাবে, কেউ পরে যাবে। কেউ কালে যাবে, কেউ অকালে। নাথিং ডুয়িং।
আমতা আমতা করে বলেছিলুম, ‘স্মৃতি’।
সুবীর বলেছিল, ‘একটা সুন্দরী মেয়ে এসে জাপটে ধরে চুমু খেলে চোখে জল থাকবে? মায়ের স্মৃতি ভেঁড়া কাগজের মতো উড়ে চলে যাবে। দুঃখ বাইরে প্রকাশ করবি না। ভেতরে ধরে রাখবি। দেখবি জীবনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। দুঃখের সুখে ভরে উঠেছিস। সংগীত হয়ে গেছিস, বাউল। হয়ে গেছিস, বসন্তের উদাস বাতাসের মতো। নে, বড় বড় দুটো পেঁয়াজ ডুমো ডুমো করে কাট।’
এটা হল সুবীর। এক রবিবার সুবীর বললে, ‘চল, সিন্দুকটা খোলার চেষ্টা করি।’ যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিল। ঘণ্টাখানেক মরণপণ, তালা খুলল। ভেতরে একটা ভেলভেট মোড়া বেহালার বাক্স। বাক্সটা কিন্তু খালি। বেহালাটা নেই। আছে পাট করা একটা সিল্কের রুমাল। এক কোণে মোনোগ্রাম।
সুবীর বললে, ‘ব্যাপারটা কী হল? বেহালাটা গেল কোথায়? এত যত্ন করে একটা খালি বাক্স! রহস্যজনক। চল তো দেখি।’
বাক্সটা নিয়ে আমরা বারান্দার রোদে এলুম। সুবীর মন নিয়ে পরীক্ষা করতে করতে কী একটা করল, তলাটা খুলে গেল। একটা গুপ্ত কন্দর। একগাদা সোনার গয়না, জড়োয়ার সেট।
আমাকে হা হা করে হাসতে দেখে, সুবীর বললে, ‘কী হল? ম্যাড হয়ে গেলি?’
‘গয়নাগুলোর কত দাম হবে?’
‘অনেক।’
‘আর আমরা কী অভাবেই না দিন কাটিয়েছি!’
পরের দিন আমরা দুজনে ব্যাঙ্কের লকারে গয়নাগুলো ঢুকিয়ে দিয়ে এলুম। শান্তি।
কিন্তু বেহালাটার কী হল? যে বেহালা রাতে বাজে। সুবীর বললে, ‘ছেড়ে দে। ও নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করিস না, তবে এই বাড়িটা একটা ট্রেজার হাউস। কী আছে তোরা জানিস না। জানার চেষ্টাও করিসনি।’
‘কী করা উচিত?
‘অনুসন্ধান।’
আমার একার দ্বারা সম্ভব নয়।’
‘বাইরের লোক ঢোকালে হবে না। জানাজানি হয়ে যাবে। সে খুব বিপদের। মাসিমা খুব ক্যালাস ছিলেন।’
‘না, মা ভয় পেতেন।’
‘কীসের ভয়?’
‘মা আমাকে প্রায় বলতেন, এই বাড়িটার ওপর আমার কোনও অধিকার নেই। তোর বাবা। বলতেন অনুপার্জিত ধন একটা উৎপাত, একটা অভিশাপ। দান নিয়ে বড়লোক হওয়ার চেয়ে ভিখিরি হওয়া ভালো। মা বলতেন, এর কোনও কিছুই আমার নয়। আছি, এই পর্যন্ত। নীচের তলায় তিনটে ঘরে আমাদের দুজনের সংসার।’
সুবীর কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে রইল, ‘ঠিক কথাই বলেছিলেন, তবু যখন হাতে এসেছে ফেলে তো আর দেওয়া যায় না। এত বড় একটা বাড়ি। একটু অদলবদল, মেরামত করে আমরা এখানে। একটা হাসপাতাল করব। অনেকের উপকার হবে।’
‘বড় কিছু ভাবতে ভালো লাগে, করাটাই কঠিন।’
‘ইচ্ছের জোর থাকলে সবই করা যায়। ইচ্ছে থাকলেই উপায় বেরোয়। গয়নাগুলো লকারে ফেলে
রেখে বিক্রি করে দিলেই অগাধ টাকা।’
‘কার গয়না কে বিক্রি করে!’
‘কার গয়না মানে?’ তোর মায়ের গয়না।’
‘আইনে আটকাবে না! যদি চোরাই মাল হয়?’
‘তোর দাদু নিশ্চয় চোর ছিলেন না!’
‘আমার দাদু বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। সেকালের ইতিহাসে হয়তো তাঁর নাম আছে।’
‘হয়তো কী? অবশ্যই নাম আছে। অত বড় একজন ভাষাতত্ববিদ! অ্যাকাডেমিক সার্কেলে, বিদগ্ধমহলে তিনি অমর।’
তিনি বেহলা বাজাতেন না।’
‘তোর দিদিমা?’
‘শুনিনি।’
‘এই বাড়ির ইতিহাস এই বাড়িতেই আছে। রবি, সোম, মঙ্গল—এই তিন দিন আমার তেমন কাজ নেই, এই তিন দিন আমরা দুজনে বাড়িটা ওলট-পালট করব।’
.
২.
সন্ধেবেলা খবর এল চিন্ময়ী মারা গেছে। সুবীরকে ফোন করলুম। সুবীরের মোবাইলে।
‘চিন্ময়ী চলে গেল! তুই কোথায়?’
‘স্টক এক্সচেঞ্জে। একঘণ্টার মধ্যে আসছি। পোস্টমর্টেম থেকে ছাড়বে কখন? কারা গেছে?’
‘ওদের বাড়ি থেকে কেউ এসে আমাকে কিছু বলেনি।’
‘তবে? কী করবি?’
‘কিচ্ছু করব না। তোর কাজ মিটে গেলে চলে আয়!’
একেবারে একা বসে আছি আমাদের বাড়িতে। দাদুর আমলের বৈঠকখানা ঘরে। একদিকের দেয়ালে অয়েলে আঁকা একটা পোট্রেট ঝুলছে, স্যার উইলিয়াম জোনস। ভারতে এসে ভারতচর্চার পথ খুলে দিলেন। স্থাপন করলেন এশিয়াটিক সোসাইটি। ভারততত্ববিদ। অসাধারণ পণ্ডিত। সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি। দাদু তাঁর ছবি আঁকিয়েছিলেন। শিল্পীর অস্পষ্ট স্বাক্ষর, ‘পিয়ারী’। মনে হয় কোনও সায়েব। দাদুর সঙ্গে বড় মানুষের আলাপ ছিল।
যে-ঘরে বসে আছি, সেখান থেকে বড় রাস্তা বেশ কিছুটা দূরে। রাত নেমেছে শহরে। দূরের বড় রাস্তায় যান চলাচল বেড়েছে। এই সময় যা হয়। চিনুর কথা খুব মনে পড়ছে। এই বাড়ির এই ঘরে সে কতবার এসেছে। কত আনন্দ করেছে। মা চলে যাওয়ার পর, সাবধান করেছিলুম, ‘আমি একা থাকি, তুমি একা আর এসো না, পাঁচজনে পাঁচ কথা বলতে পারে।’
‘বলে বলবে, আমি গ্রাহ্য করি না।’
‘আমি যদি কিছু করে ফেলি!’
‘আমিও তো কিছু করে ফেলতে পারি!’
দুজনে হা হা করে খানিক হাসলুম। ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেল। আমাদের আলাপের জায়গাটা আমাদের কলেজ। আমি বেরোবার মুখে, চিন্ময়ী তখন ওপর দিকে উঠছে।
আলাপের উপলক্ষ্যটা খুব মজার। হেদোর পাশ দিয়ে চিনু ট্রামরাস্তার দিকে এগোচ্ছে। আমি পেছনে। হঠাৎ গোটাচারেক কুকুর ঝটাপটি করতে করতে ঘাড়ে পড়ে আর কি! চিনু দু-হাতে আমাকে জাপটে ধরেছে। আমার বুকের সঙ্গে তার বুক লেগে আছে। ধুকপুক করছে। দুজনের কপাল ঠেকাঠেকি। রাস্তার বাঁ-ধারে প্রাচীনকালের বিখ্যাত, ঐতিহাসিক চায়ের দোকান। কড়া টোস্ট আর ডবল হাফ চায়ের জন্য সুখ্যাত। দোকানের রসিক মালিক আমাদের অবস্থা দেখে বললেন, ‘হয়ে গেল।’
কুকুরগুলো মারামারি করতে করতে পেছন দিকে চলে গেল।
চিনু বললে, ‘কী হল?’
‘যা হবার তাই হল, এখন এখান থেকে আগে সরে পড়ি চল।’
আমরা বিডন স্ট্রিট ধরে সোজা হাঁটছি। তখনও জানি না, কে কোন দিকে যাব। কলেজে মেয়েদের দঙ্গলে হয়তো দেখেছি, মনে রাখিনি। প্রয়োজন হয়নি। ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর ভালোবেসে ফেলেছি। পাগল হয়ে গেছি বললে ভুল হবে না। সামান্য ব্যাপার—একটি মেয়ে। দেহে দেহে ঠোকাঠুকি নয়, মনে মনে ছুঁয়ে যাওয়া। চোখে চোখে লেগে যাওয়া।
এসব ভাবছি কেন আমি, যখন সে নেই। সারা ঘরে ছড়িয়ে আছে তার উপস্থিতির স্মৃতি। একদিন সকালে এসে বললে,
‘তুমি কিছু পারো না, একেবারে লেদাডুস।’
আমি ছুরি দিয়ে আলুর খোসা ছাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলুম। একটা খাপছাড়া ব্যাপার হচ্ছিল।
‘দেখি, সরো। আলু কাটছ কেন?’
‘মাছের ঝোল হবে।’
‘কে রাঁধবে?’
‘কেন? আমি রাঁধব।’
‘সর্বনাশ! সে ঝোল মুখে দেওয়া যাবে? মাছটা কে কাটবে?’
‘বাজার থেকে কাটিয়ে এনেছি।’
‘কী মশলা দেবে?’
‘ধনে, জিরে, হলুদ, কাঁচালঙ্কা ফেঁড়ে দেব।’
সে নিজেই রান্নায় লেগে গেল, আমি জোগাড়ে। সুন্দর কপালে দু-এক গাছা চুল ঝুলে পড়েছে। গলার চারপাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটা সরু সোনার চেন গায়ের রঙের সঙ্গে মিশে গেছে। গোল গোল হাতে একটা করে চুড়ি। সে-হাতের কী কায়দা! কানে ছোট ছোট দুটো ইয়ার রিং। হালকা। হলুদ রঙের শাড়ি সাদা ব্লাউজ। ফরসা ফরসা পা দুটো আমার চারপাশে নেচে বেড়াচ্ছে। আমি মেঝেতে থেবড়ে বসে আছি। চারপাশে ঘটিবাটি, জলের বালতি। মাঝে মাঝে হুকুম হচ্ছে, এটা দাও ওটা দাও।
সেদিন আমরা দালানে একসঙ্গে খেতে বসেছিলুম।
‘কী, কেমন বেঁধেছি?’
‘দুর্দান্ত।’
‘ঝাল লাগছে? আমি একটু ঝাল বেশি খাই।’
‘আমিও। মা বলতেন, ঝাল খেলে বুদ্ধি খোলে।’
সেদিন আমার একটা কথাই মনে হচ্ছিল, চিনু আমার বোন নয় বউ। এত এত মানুষের মধ্যে থেকে হাত ধরাধরি করে দুজনে বেরিয়ে এল। সেই দুজনই তখন জগৎ। তাদের সম্পর্ক, সুখ দুঃখ, বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া। চিনু আমার বুকটা খালি করে দিয়ে চলে গেল। আমার আশ্রয় চুরমার। পড়ে আছি ফাঁকা মাঠে। পাশ দিয়ে সবাই সব দিকে চলে যাচ্ছে। কেউ যেন সিগারেট
ধরিয়ে কাঠিটা ফেলে দিয়ে গেছে!
ধ্যাৎ, ধ্যাৎ!
৩.
সুবীর এল। দেরিতে এল। ক্লান্ত দেখাচ্ছে। খুব খাটে। একা অত বড় একটা ব্যবসা চালায়। আমাকে বলেছিল, কি চাকরি করবি, আমার সঙ্গে আয়। আমি বলেছিলুম, না, ভাই আমাদের এই বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাই না।
সুবীর আসার সময় খাবার নিয়ে এসেছে। আমাদের দুজনেরই যা প্রিয়, হিং-এর কচুরি। রাতে আর কিছু খেতে হবে না। এইতেই হয়ে যাবে।
‘হ্যাঁ রে, ওদিকের কোনও খবর আছে?’
‘পোস্টমর্টেম হবে। কাল দুপুরের আগে বেরোবে না।’
‘আমরা কিছু করতে পারি?’
‘কী করবি, ওদের অনেক লোকজন!’
আমরা কথা বলছি, দরজার কাছে কে একজন এসে দাঁড়াল। বাইরের দালানে আলো জ্বলছে। লম্বা একটা ছায়া ঘরে এসে ঢুকেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। বেশ ভয় পেয়ে গেছি।
মেয়েটি সামনে এসে দাঁড়াল। চিনতে পেরেছি। চিন্ময়ীদের বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের মেয়েটি।
‘কী রে রুমকি?’
রুমকি খুব নীচু গলায় প্রায় ফিশফিশ করে বললে, ‘ভেতরের ঘরে চলো, অনেক কথা আছে।’
রুমকিকে নিয়ে শোবার ঘরে গেলুম। সে চেয়ারে বসল। আমি আর সুবীর খাটে। রুমকি খুব স্মার্ট। চেয়ারটা সরিয়ে আনল খাটের কাছে।
‘দিদিকে ওরা খুন করেছে।’
‘সে কী? কে খুন করেছে?
‘ওর মা আর ওর কাকা!’
‘সে আবার কী?’
‘ওই কাকা খুব বাজে লোক। চিনুদির মায়ের সঙ্গে একটা ব্যাপার আছে। এই নিয়ে দিদির সঙ্গে খুব অশান্তি হত। সম্পত্তি দিদির নামে। চিনুদির বাবার সঙ্গে চিনুদির মায়ের সম্পর্ক খুব খারাপ ছিল। মা আর মেয়েতে যখন ঝগড়া হত তখন সব শুনেছি। অনেক বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি ব্যাপার আমি
আড়াল থেকে দেখেছি।’
‘সে হোক, মেরে ফেলেছে বলছ কেন?’
‘এইটুকরো কাগজটা আমি পেয়েছি, পড়ে দেখ।’
কাগজটায় একটা লাইন, ‘অঙ্ক মেলাতে পারলেই পথ পরিষ্কার।’
‘এটা কার হাতের লেখা?’
‘কাকাবাবুর।’
‘এর মানে কী?
‘পথ পরিষ্কার মানে কী! একদিন রাত্তিরে, এই সাত-আট দিন আগে দিদি মাকে বলেছিল, তোমরা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাও।’
‘চিনু মারা যাওয়ার পর বাড়ি, সম্পত্তি কে পাবে?’
‘কাকাবাবু।’
‘মা পাবে না কেন?’
‘মায়ের অধিকার নেই। পৈতৃক সম্পত্তি সেই তরফেই ফিরে যাবে।’
‘কে বললে?’
‘প্রশান্তদা, হাইকোর্টের। আমি সকালেই জিগ্যেস করে জেনে এসেছি।’
সুবীর বললে, ‘এ তো অসাধারণ মেয়ে, এর ব্যারিস্টার হওয়া উচিত।’
রুমকি হাসল। কপালে টোকা মেরে বললে, ‘মানুষের এই জায়গাটাই সব। যা লেখা আছে তাই হবে।’
‘তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে?’
‘অঙ্ক। ব্যাপারটা অঙ্ক। দুই আর দুয়ে চার। মন দিয়ে শোনো অঙ্কটা কী! তোমার আর দিদির সম্পর্কটা বিয়ের দিকে যাচ্ছিল। বিয়ে তোমাদের হতই। অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা দুটোই
তুমি পেতে। তাহলে রাজকন্যাকে সরাতেই হবে। এইবার শোনো, দিদির বাবা বেঁচে থাকতেই ঠাকুরপো আর বউদির লটঘট চলছিল। শোনো, খুন একটা নয়, খুন দুটো। দিদির বাবাকেও খুব কায়দা করে সরানো হয়েছিল।’
‘কী রকম?’
‘আজ থেকে সাত বছর আগে লরি দিয়ে চাপা দেওয়া হয়েছিল।’
‘কাকাবাবু লরি কোথা থেকে পেল?’
‘সেই সময় ট্রান্সপোর্ট বিজনেস ছিল। দিদির বাবা ডানকুনির কোল কমপ্লেক্সে ছিলেন। সন্ধের সময় মোটর সাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। লরিটা মেরে দিয়ে চলে গেল। একটা জায়গায় অঙ্কটা গোলমাল হয়ে গেল, ওরা জানত না তিন মাস আগেই বাবা উইল করে মেয়েকে সব সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। সলিসিটারের ঘরে সেই উইল জমা ছিল। কেস কেঁচে গেল। এইবার কী হল, বউদিকে ভোগ করা হয়ে গেছে। বউদিকে বাঁচতে হবে মেয়ের দয়ায়, অতএব বউদিকে আর দরকার নেই। তখন বউদির সঙ্গে প্ল্যান হল, সম্পত্তিটা যদি পাইয়ে দিতে পার তাহলে তুমি হবে আমার পাটরানি।’
‘আগুনটা লাগল কী করে?’
সুবীর বললে, ‘গ্যাস খুলে রেখেছিল।’
রুমকি বললে, ‘অত বোকা নয়। গ্যাসের গন্ধ আছে।’
‘তাহলে!’
‘ওই যে বলেছে, অঙ্কটা যদি মেলাতে পারো! ভালো করে শোনো, চোখ বুজিয়ে দেখো। দেশলাই কাঠি জ্বলল, ডান হাত এগোচ্ছে। বাঁ-হাতে ওভেনের নবটা ঘোরানো হল, হঠাৎ আচমকা একগাদা বাসন পড়ল। চমকে উঠল। জ্বলন্ত কাঠিটা পড়ল নাইটির ওপরে। গ্যাস খোলা। হুহু করে বেরোচ্ছে। সেই গ্যাস আগুনকে দাউদাউ করে বাড়িয়ে দিল। প্রথম চান্সেই হিসেব মিলে গেল।’
আমি আর সুবীর হাঁ করে বসে রইলুম কিছুক্ষণ।
সুবীর বললে, ‘পারফেক্ট মার্ডার। কোনও ভাবেই প্রমাণ করা যাবে না।’
‘একটা কথাও তো বলতে পারল না। বললে কিছু করা যেত হয়তো।’
‘পোস্টমর্টেম?
‘কী পাওয়া যাবে? কিস্যু পাওয়া যাবে না। ভিসেরায় কিছু মিলবে না। যদি এফআইআর করতে হয় কে করবে? এ তো শ্বশুরবাড়িতে বউ পোড়ানো নয়। আমরা তো বাইরের লোক। ঘটনার জায়গায় ছিলুম না। প্রত্যক্ষদর্শী নই। সাক্ষীও হতে পারব না।’
রুমকি বললে, ‘কোনও খুনই কি কেউ দেখিয়ে করে!’
‘তা করে না, তবে কিছু না কিছু প্রমাণ ফেলে যায়। এখানে তো কিছুই নেই।’
রুমকি বললে, ‘কেন এই কাগজটা।’
‘এটা পেলে কোথায়?
‘দিদির মায়ের মাথার বালিশের তলায়। বিছানা করতে গিয়ে পেয়েছি।’
সুবীর বললে, ‘আমার প্রথম প্রশ্ন, এটা যদি নির্দেশ হয়, পড়ে ছিঁড়ে ফেললেই হত। যত্ন করে বালিশের তলায় রাখা কেন? প্রমাণ তো লোপাট করারই কথা।’
‘অসাবধানতা। ভুলে গেছে। আমার ধারণা, যেই আনুক এটা এসেছিল রাত্তিরবেলা। পড়ার সময় দিদি হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়েছিল। তাড়াতাড়ি বালিশের তলায় ঢোকাতে গিয়ে ঢুকিয়ে ফেলেছিল ওয়াড়ের ভেতর। পরে আর খুঁজে পায়নি।’
‘ঠিক আছে, এটা ধরে রাখা যাক, পরের প্রশ্ন, যাদের দু-বেলা দেখা হচ্ছে, এত ঘনিষ্ঠ, তাদের একজন আর একজনকে চিরকুট দেবে কেন, কায়দার কথা লিখে! কানে কানে ফিশফিশ করে বললেই তো হয়।’
রুমকি একটু চিন্তিত হল।
‘এই জায়গায় আমরা একটা কর্মাশিয়াল ব্রেক নি।’
সুবীর বললে। ‘কচুরিদের যথাস্থানে পাঠানো দরকার, বিলম্বে আরও শীতল হয়ে যাবে। তোর জায়গা-জমি বের কর।’
উঠে রান্নাঘরে গেলুম। রুমকি আমার পাশে এসে দাঁড়াল, ‘তুমি যাও। আমি ব্যবস্থা করছি।’
আমাদের সামনে কচুরি আর তরকারির প্লেট ধরে দিল।
‘তোমার?’
‘আনছি? হাত তো দুটো।’
সুবীর বললে, ‘তাও তো বটে।’
রুমকি এসে বসল।
‘সমান ভাগ করেছ তো!’
‘আমার একটা কম।’
‘কেন? বারোটা এনেছি তো!’
‘তুমি বারোটার দাম দিয়েছ, কচুরি দিয়েছে এগারোটা।’
‘আমাদের থেকে হাফ হাফ নাও।’
‘খাও তো। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। সকাল থেকে উপোস, ও বাড়িতে শোকের নকশা চলছে। এর পর চা খাবে তো?’
‘যদি করো।’
‘যন্ত্রপাতি দেখিয়ে দাও।’
আমার মা খুব গোছানো ছিলেন। সংসারটাকে করে রেখেছিলেন ছবির মতো। বড় ঘরের মেয়ে ছিলেন তো।
‘এই নাও কেটলি!’
‘কেটলি তো দেখতেই পাচ্ছি, কত বছর ধোওয়া হয়নি!’
‘রোজ চা করি, সপ্তাহে একদিন আচ্ছাসে ধোলাই করি।’
‘চা কোথায়, চিনি কোথায়, দুধ কোথায়?’
‘সব আছে।’
সুবীর চায়ে চুমুক দিয়ে বললে, ‘কাকাবাবু নয়, তৃতীয় আর একজন কেউ আছে। চিরকুটটার সঙ্গে এই মৃত্যুর যদি যোগ থাকে, তাহলে কাকাবাবু এর মধ্যে নেই।’
রুমকি বললে, ‘হতে পারে। কাকাবাবু আজ তিন মাস কলকাতার বাইরে।’
‘তাহলে, এই তৃতীয় লোকটা কে? তার সঙ্গে চিনুর মায়ের কী সম্পর্ক? তুমি কী আর কোনও লোককে বাড়িতে আসতে দেখেছ?’
‘না।’
‘তা হলে?
আমি বললুম, ‘সুবীর, এই সমস্যার সমাধান আমাদের দিয়ে হবে না। আমাদের সঙ্গে পড়ত প্রশান্ত, মনে আছে তোর?’
‘বারুইপুরে আমবাগান, আমরা পিকনিক করেছিলুম।’
‘প্রশান্ত পুলিশের বড়ো অফিসার। চল, কাল আমরা তার কাছে যাই।’
রুমকি বললে, ‘আমিও যাব। রান্নাঘর, যেখানে আগুন লেগেছিল, দিদি মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি দিয়েছিল, সেই মেঝেতে পোড়া আঙুল দিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করেছিল। চারটে অক্ষর। প্রথমটা মুছে গিয়েছিল। অক্ষর তিনটে যা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, বিনাশ।’
‘বিনাশ মানে, শেষ করে দেওয়া, হত্যা।’
‘আগে আর একটা অক্ষর ছিল। ছিলই ছিল।’
সুবীর বললে, ‘আজকের মতো এই পর্যন্ত থাক। কাল তো আমরা প্রোন্তর কাছে যাবই। একটা ফোন কর না।’
‘নম্বর জানি না।’
‘আমি তা হলে আজকের মতো ছুটি নিচ্ছি।’
রুমকি বললে, ‘আমি কোথায় যাব?’
‘কেন? ও বাড়িতে!’
‘আজ সকালে আমাকে ওরা ছুটি করে দিয়েছে।’
‘সে কী!’
‘গম্ভীর গলায় বললে, দরকার নেই।’
‘তোমার মালপত্র?’
‘ওই যে, দুটো স্যুটকেস।’
সুবীর বললে, ‘কী ব্যাপার বল তো? এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফাঁকা!’
‘মনে হয়, রুমকিকে সন্দেহ করছে।’
রুমকি বললে, ‘কিছু কাগজপত্র কাল ছাতের ঘরে পোড়াচ্ছিল। আমি জিগ্যেস করলুম, কী পোড়াচ্ছ? তা আমার দিকে কটমট করে তাকাল।’
‘কী পোড়াচ্ছিল মনে হল? ‘অনেক খাতা-মাতা, চিঠিপত্তর।’
সুবীর বললে, ‘এই রে, আগুনের নেশা ধরেছে। আগুনের একটা বিশ্রী নেশা আছে। তাহলে রুমকির কী হবে?’
রুমকি করুণ গলায় বললে, ‘সুবীরদা আজ তুমি থেকে যাও না। আমি কে, সেটা তোমার জানা হয়নি। তোমরা দুজনেই জানো না। কাল সকালে আমি কোথায় না কোথায় চলে যাব, আর তো দেখা নাও হতে পারে।
সুবীর বললে, ‘অল রাইট! তুমি যদি খিচুড়ি খাওয়াও তাহলে থেকে যেতে পারি।’
রুমকি বললে, ‘খিচুড়ি আর পাঁপড় ভাজা।’
সুবীর আমাকে জিগ্যেস করলে, ‘কিরে কাঁচামাল সব আছে তো? পাঁপড় আনতে হবে?
‘আমি যাচ্ছি। ভালো করে দেখ, চাল, ডাল, আলু সব আছে তো? ঘি আছে? খিচুড়ি কিন্তু ঘি চাইবে।’
ঘি আছে।’
রুমকি বললে, ‘খিচুড়ির সঙ্গে ডিমের ওমলেট?’
‘ওঃ! ভেরি ইন্টারেস্টিং। ফাটাফাটি।‘
সুবীর বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল।
‘কী হল রে?’
‘শোন শুভ্র, তোদের ওই আউটহাউসে কেউ থাকে?’
‘না তো, ওটা তো প্রায় ভেঙে পড়েছে। সাপ-খোপের আচ্ছা।’
‘বিশ্বাস কর, একটা দেশলাই কাঠি জ্বলেই নিবে গেল।’
‘সে কী রে?’
রুমকি আমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে।
সুবীর বললে, ‘সামওয়ান ইজ দেয়ার, আই অ্যাম সিওর। একবার দেখা দরকার।’
রুমকি বললে, ‘আমাকে মারবে।’
‘তোমাকে মারবে কেন?’
‘আমার মন বলছে। আমি একটা বিরাট চক্রর সন্ধান পেয়েছি।’
সুবীর বললে, ‘টর্চ আছে?’
ঝোপ-জঙ্গল মাড়িয়ে, বুনো গাছের ডালপালার খোঁচা সহ্য করে অতীতের সেই কুঠিটায় দুজনে পৌঁছোলুম। আমার মাতামহ যখন জীবিত ছিলেন তখন এই ঘরে একটি দাতব্য হোমিও চিকিৎসালয় করেছিলেন। আউটহাউসের পরেই বাউন্ডারি ওয়াল। তারপরেই বিরাট স্কুলবিল্ডিং। খাড়া দেয়াল ওপর দিকে উঠে গেছে। মাঝখানে ছোট্ট একটা গলি। পাক মেরে পৌঁছে গেছে শ্মশানে। গঙ্গা। প্রাচীন ঘাট। লঞ্চ সার্ভিস, জেটি।
সুবীর ঘরে আলো ফেলল। কেউ নেই। বাতাসে সিগারেটের গন্ধ। মেঝেতে দুটো সিগারেটেরে টুকরো। তিন-চারটে পোড়া দেশলাই কাঠি। টর্চের আলো ঘোরাতে ঘোরাতে দেয়ালের একটা জায়গায় একটা লেখা চোখে পড়ল। কাঠকয়লা দিয়ে কেউ লিখেছে,
নাক গলালেই বিপদ
লেখাটার পাশে একটা ত্রিশূল চিহ্ন। মেঝেতে আরও একটা কী পড়ে আছে। টর্চের আলো ফেলে দেখা গেল, চিবিয়ে চিবিয়ে প্রায় বিধ্বস্ত করে একটা মুরগির ঠ্যাং কেউ ফেলে গেছে।
ঘরের কোণে হঠাৎ আলোয় কী একটা ঝলমল করে উঠল। সুবীর ভালো করে দেখে একটা শব্দ করল ‘হুঁ’।
ওপাশে অনেক কালের ভাঙাচোরা টেবিল পড়েছিল। সুবীর তার তলায় একটা বাজে জিনিস আবিষ্কার করল।
‘তুই খুব বিপদে পড়ে যাবি শুভ্র। এই ঘরে ড্রাগ-অ্যাডিক্টরা আসে। মেয়েরাও আসে। তোর কোনও নজর নেই। এই ঘরে খুন করে কারওকে ফেলে গেলে তোকেই তো জেল খাটতে হবে।’
‘দেয়ালে লেখাটা?’
‘ওটা কোনও নাবালকের কাজ। পাশেই স্কুল। বাউন্ডারিটা তেমন উঁচু নয়। টপকে চলে এসেছিল, রোজই হয়তো আসে। ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ার ফল। হয়তো তাদেরই কেউ এসে ব্রাউন-সুগার নেয়। রাংতাটা তারই সাক্ষী। কাল সকালে আমার ফার্স্ট কাজ হবে, এই ঘরটাকে। ভেঙে মাঠ করে দেওয়া।’
পাঁচিলের পাশের সরু পথ দিয়ে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে শ্মশানে। পায়ের দুপদাপ শব্দ। মাঝে মাঝে ভারী গলায়, বলহরি হরি বোল। গা ছম ছম। সুবীর বললে, ‘চল, এর পর দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যাবে।’
রাত হয়েছে। বাজারে তেমন লোকজন নেই। কোনও কোনও দোকান বন্ধ হওয়ার মুখে। সবচেয়ে বড় কাপড়ের দোকান, বসাক স্টোর্স। দোকানের মালিক সারাদিন পা মুড়ে গদিতে বসে থাকেন। দোকান বন্ধ হওয়ার আগে কাপড় মাপার গজকাঠিটা মেঝেতে দাঁড় করিয়ে দুহাত দিয়ে ধরে ওঠবোস করছেন। পয়সা প্রচুর কিন্তু গৃহসুখ আর দেহসুখের অভাব। বড় মেয়েটি একের পর এক প্রেম করতে করতে শেষ প্রেমের প্রেমিকের সঙ্গে হাওয়া। কোন দেশে গেছে কেউ জানে না।
বাজারের পেছন দিকে ছোট্ট একটি গণিকাপল্লি। রাত্তিরে বেশ জমজমাট হয়। একটা লাল বিরাট মোটর সাইকেল একপাশে খাড়া। মালিক কোনও একটা ঘরে আয়েস করছি। মালিককে আমরা সবাই চিনি। রায়বাহাদুরের নাতি। তোলাবাজ। খুনটুনও করে।
ছোট ছোট খুপরি খুপরি ঘর। করুণ চেহারার একটি মেয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে। সুবীরকে বললে, ‘এসো না আমীর।’
সুবীর কেঁদে ফেলেছে। ‘শুভ্র! মেয়েদের এই পরিণতি সহ্য করতে পারি না।’
মেয়েটার হাতে একশো টাকার একটা নোট গুঁজে দিতে গেল।
মেয়েটা পরিষ্কার বলছে কানে এল, ‘কাজ না করে পয়সা নিতে পারব না। আমাদের নিয়ম নেই।’
সুবীর বললে, ‘তুমি আমার বোন।’
মেয়েটা কাটা কাটা উত্তর, ‘বোন, তা বাড়ি নিয়ে চলোনা।’
খদ্দের এসে গেল। একটা আধবুড়ো। কাঁধে একটা ব্যাগ। মদের গন্ধ। মেয়ের বয়সি মেয়েটার হাত খামচে ধরে ভেতরে চলে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
লোকটি আমার চেনা। বাজারে ইলেকট্রিক্যাল গুডসের চালু দোকান। বউ আছে, ছেলেমেয়ে আছে।
সুবীর ফেরার পথে, সারাটা পথ একটা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে এল—
ধরণী তোমার প্রমোদপ্রবাস,
বাঁধনিকো হেথা ঘর,
বিশ্বসুদ্ধ বুকে টেনে, বল
সবাই আমার পর।
পুণ্য তোমারে করে না লুব্ধ,
পাপে নাকি কাঁপে বুক!
নহ মা ঘৃণ্য কৃপার পাত্র,
আজ যে বুঝেছি খাঁটি—
মায়ের পুজোয় কেন লাগে তোর
চরণে দলিত মাটি!
বাড়িতে ঢোকার মুখে সুবীর আমার একটা হাত ধরে বললে, ‘আয় আজ রাতে আমরা শপথ করি—মেয়েদের আমরা খুব যত্ন করব।’
রুমকি ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
‘কীসের ভয়?’
‘এত বড় একটা বাড়িতে আমাকে একলা ফেলে চলে গেলে। গেলে তো গেলেই। কত রকমের শব্দ!’
‘ভয় পেলেই ভয় মানুষকে পেয়ে বসবে। এখন চলো রান্নাঘরে। শুরু হোক আমাদের সমবেত রন্ধনযজ্ঞ।’
রুমকি জিগ্যেস করলে, ‘কী ডাল?’
‘মুসৌরি।’
‘পেঁয়াজ চলবে?
‘লাগাও প্যাঁজ।’
সুবীর পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে আর গাইছে—
জীবনে মরণে সমপরিমাণে
মিলায়ে কেরাঁধে এ জগা-খিচুড়ি!
যারাচাপা ব্রহ্মাণ্ড-ভাণ্ডে
নুনে ঝালে অভাব রাখেনি কিছুরই!
নেপথ্যে হাঁকে কর্তা বাঙ্গাল—
জ্বাল ঠেলে দাও গণ্ডা গণ্ডা ঝাল;
বাকি কোনো দিকে রাখে না খেয়াল–
ঝি-চাকরে করে সকল খিচুড়ি।
সুবীর হঠাৎ নাচতে লাগল—
গুমে গুমে সিজে কাহার জন্য
ভূচর-জলচর-খেচরান,
তলা হতে সরা, সরা হতে তলা
মাথা ঠুকে মরে আছাড়ি বিছুরি!
‘এমন প্রলয় নাচ নাচলে রান্না করা যায়?
সুবীর শান্ত হতে হতে,
‘যে রাঁধুক আর যেই এরে খাক
এ খিচুড়ি নাহি হবে পরিপাক।
দেবতার পেট না হলেও ঢাক
অন্তত ফুলে হবেই কচুরি।’
রান্নাটা খুব জমেছে। সুগন্ধে বাড়ি ভরে গেছে। মা চলে যাওয়ার পর এই প্রথম। রান্না শেষ করে রুমকি বললে, ‘চান করব।’
‘কোনও অসুবিধে নেই। চলে যাও, ওই বাথরুম। সব আছে।’
খাওয়াদাওয়া শেষ হল প্রায় বারোটায়। সুবীরকে খুব খুশি লাগছে। ও সাধারণত খুব ধীর স্থির। ওর মন বোঝা যায় না।
.
৪.
আমাদের সেই সাবেককালের বিরাট খাট। অকারণে কারুকার্য। সেকালে কাঠ সস্তা, বড়লোকদের তহবিলে বাজে খরচ করার মতো অঢেল টাকা। সুবীর শুয়ে পড়েছে। প্রচণ্ড খেয়েছে। আমি আর রুমকি খাটের আর এক পাশে বসেছি।
মা বেঁচে থাকলে এইভাবে একই খাটে তিনজনে বসা যেত কি?
রুমকি সুবীরকে বললে, ‘তুমি শুয়ে শুয়ে শুনবে, তবেই হয়েছে। এক্ষুনি নাক ডাকবে।’
সুবীর বললে, ‘আমার ইনসমনিয়া আছে ভাই। বছরের পর বছর নিদ্রাহীন রাত আমার।’
‘ঘুমোতে পার না কেন? এর পর তো পাগল হয়ে যাবে।’
‘পাগল হতে আর বাকি কি? কত রকমের সমস্যা! জীবন-মরণ সমস্যা। এই প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় বেঁচে থাকাটা যেন কুস্তি! আমার কথা থাক, তোমার কথা বলো।’
‘তা হলে শোনো। চিনুদির এই কাকাবাবু আর আমার বাবা, দুজনে হলায়গলায় বন্ধু। পার্টনারশিপে ব্যবসা শুরু হল স্ক্র্যাপ আয়রনের। হাওড়ায় বিরাট গোডাউন। ক্যানিং স্ট্রিটে সাজানো, সুন্দর অফিস। দেখতে দেখতে ব্যবসা জমে উঠল। কত সুখ!
‘এইবার শুরু হল কাকাবাবুর খেলা। বাবাকে মদ আর মেয়েছেলে ধরাল। আমার এত সুন্দর মা জীবন থেকে ভেসে গেল। প্রথমে লুকিয়ে লুকিয়ে তারপর খোলাখুলি। জলের বদলে মদ। মাকে ধরে পেটানো। একজন নিভাঁজ নিপাট ভদ্রলোক—চোখের সামনে একটা কুৎসিত ছোটলোক হয়ে গেল। এইবার হল সিফিলিস। লোকটা কী ভয়ংকর শয়তান, ওই বিশ্রী রোগটা আমার নিরীহ মাকে ধরাবে বলে রোজ রাতে আমাদের চোখের সামনে আঁচড়া-আঁচড়ি, কামড়া-কামড়ি। মা চিৎকার করছে। একদিন দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকতে হল। সে দৃশ্য ভাবা যায় না! মদের ঘোরে বেহেড। মদের বোতলটাকে ভেঙে হাতে নিয়েছে। মায়ের পোশাক ছিন্নভিন্ন। লোকটার মুখ। বীভৎস রাক্ষসের মতো। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। জানোয়ারের মতো শব্দ করছে।
‘মারলুম তলপেটে এক লাথি। কোঁক করে উঠল। আচমকা ভাঙা বোতলটা ঢুকিয়ে দিল আমার দুই উরুর মাঝখানে। সে রাতে নির্ঘাৎ আমার মৃত্যু হত। অথবা আমার হাতেই জানোয়ারটার মৃত্যু হত। ঝুঁঝিয়ে রক্ত পড়ছে। এই দৃশ্য দেখে মা আর স্থির থাকতে পারল না। তখন মা আমার মা দুর্গা। জানোয়ারটাকে মারতে মারতে সিঁড়ি দিয়ে ফেলে দিল। গড়াতে গড়াতে দোতলা থেকে একতলায়।
‘সুবীরদা বিরক্ত হচ্ছে! বই বন্ধ করব?
সুবীর উঠে বসল, ‘চা খাব।’
রুমকি উঠে দাঁড়াল, ‘জানো তো, সোজা হয়ে দাঁড়াতে গেলে এখনও শিরায় টান ধরে।’
সুবীর বললে, ‘তোমরা বোসো, আমি চা করে আনছি’, রুমকি বললে, ‘আমি কি করতে আছি। একটাই সমস্যা, ওদিকে একা যেতে ভয় করছে।’
‘চলো, আমরা তিনজনে যাই। শুভ্র! গুমটি ঘরটা একবার দেখে এলে কেমন হয়!’
‘অসম্ভব! আমার যাওয়ার সাহস নেই। চুপ, চুপ একদম চুপ। সেই বেহালা। শুনতে পাচ্ছিস? কে বাজায়!’
রুমকি, ‘ওরে বাবারে’,বলে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।
ঠিক এইভাবেই অনেক দিন আগে কুকুরের তাড়া খেয়ে চিনু আমাকে পথের মাঝে জড়িয়ে ধরেছিল। এ মেয়ে আলাদা মেয়ে, আলাদা শরীর, কিন্তু মনটা সেই এক।
সুবীর বললে, ‘ভয় কীসের, একটি কবিতা শোনো,
আমি বোধ হয় কোন জীবনে,
দূর অতীতের কোন ভুবনে,
ছিলাম কোন গুণীর হাতে বেহালা
অকারণে কান্না-হাসি
মুখে যে মোর উঠছে ভাসি
এ বুঝি সেই পুবজনমের দেয়ালা।’
‘তোমার ভয় করে না সুবীরদা?
‘ভয় করবে কেন, কেউ তো আমাকে মেরে ফেলতে আসছে না। সাধু-সন্তরা বলে গেছেন, রাতের পৃথিবীতে অনেক রকম শব্দ ওঠে, আকাশে অনেক কিছু দেখা যায়। মানুষ ঘুমোয় তাই জানতে পারে না। পাশেই আবার গঙ্গা, মহাশ্মশান। চল না, ছাদটা একটু ঘুরে আসি। খুব ভালো। লাগবে।’
‘সে সাহস নেই ভাই।’
‘কী আশ্চর্য! তোর বাড়ির ছাদ, তুই ভয় পাচ্ছিস যেতে!’
বেহালার শব্দ ক্রমশ দূর থেকে দূরে চলে গেল। কে যেন বাজাতে বাজাতে মহাকাশে মিলিয়ে গেল।
এক রাউন্ড চা হল। বাইরের বাগানের ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটা ঝটাপটির আওয়াজ হল। একটা বেড়াল একবার মাত্র ‘ম্যাও’ করে থেমে গেল। একটা ছায়া বাইরের দালান অতিক্রম করে চলে গেল। আমরা তিনজনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রান্নাঘরে একটা স্টিলের গেলাস কোনও কারণ নেই ভীষণ শব্দ করে তাক থেকে মেঝেতে আছড়ে পড়ল। একটা পরিচিত সুগন্ধ নাকে এল।
সুবীর বললে, ‘কেউ ধূপ জ্বালিয়ে পুজোয় বসেছে।’
রুমকি কানে কানে বললে, ‘গন্ধটা চিনতে পারছ?’
‘পারছি।’
‘তোমার কাছে দিদি এসেছিল, আমরা আছি দেখে চলে গেল।’
বোধ হয় একটু আবেগ এসেছিল। বুকের কাছটা কেমন করে উঠল। রুমকি আমাকে তার নরম শরীরে জড়িয়ে ধরে বললে, ‘আমি আছি। আমি তোমাকে যেদিন দেখেছি সেইদিনই ভালোবেসে ফেলেছি।’
সুবীর টয়লেটে গিয়েছিল। দরজা খোলার শব্দ হতেই রুমকি দূরে সরে গেল।
শেষ রাতে যদি কোনও সুন্দরী বলে, ‘ভালোবাসি’, বুকের ভেতরে ভোরের পাখি ডেকে ওঠে।
সুবীর বললে, ‘একটা কথা বলি, রুমকির আত্মকথার দ্বিতীয় পর্বটা আমরা কাল শুনব। আজ আমরা কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একটু শুয়েনি। তা না হলে কাল সকালে খুব খারাপ লাগবে। বিরাট খাট, গড়ের মাঠের মতো। তিনজন তিন দিকে। এখন কথা হল, রুমকির যদি আপত্তি থাকে।’
রুমকি বললে, ‘আমি একলা শুতে পারব না। ভয়ে হার্টফেল করব।’
সুবীর ধপাস করে শুয়ে পড়ে বললে, ‘রুমকিকে তোর দিকে নিয়ে নে। গুড নাইট।’
‘একটু আগে বললি, ‘ইনসমনিয়া!’
‘ভোরের দিকে আসে, তিনটে থেকে আটটা।’
সুবীর নেতিয়ে পড়ল। নাক ডাকছে ফুরুর, ফুরুর।
রুমকি আমার পাশে শুয়ে বললে, ‘মনে কোনও পাপ রেখোনা। শরীর আলগা কর।’
মনে পাপ রেখো না। বললেই হল! এ যে আমার কাছে ফুলশয্যার রাত। রুমকি সুন্দরী। চিনুর চেয়ে সুন্দরী। যৌবনের ঢেউ খেলছে শরীরে। সে আমি বর্ণনা করতে পারব না। একাল অনেক এগিয়ে গেছে। সেকাল হলে এমন মেয়েকে মায়েরা চোখে চোখে আগলে রাখত।
দোতলার দালানের আলোটা জ্বেলে রাখা হয়েছে। আলোর আভা জলের ধারার মতো সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নামছে। ওপাশে সুবীর না থাকলে আমি হয়তো ভীষণ রকমের একটা অন্যায় করে জেলে যেতুম।
রুমকি বললে, ‘ঘুমোলে?
‘না, আসছে না।’
‘আমারও আসছে না। আমার দিকে সরে এসো না।’
আমার একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের বুকের ওপর রাখল। শ্বাসপ্রশ্বাসে তার বুক ওঠা-নামা করছে আমার হাতটাকে নিয়ে। এতটা ঘনিষ্ঠতা ভালো লাগছে না। পৃথিবীতে যে-ক-বছর এসেছি। তাতে সার বুঝেছি, আপনার বলতে দুজন, মা আর বাবা, আর সবচেয়ে আপনজন—ভগবান! এসব বাজে—সব ঝুট হ্যায়।
সুবীর ঘুমিয়েছে, না মটকা মেরে পড়ে আছে! আমাদের খানিক ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ঘি আর আগুন পাশাপাশি। রুমকি আমার খুব কাছে সরে এল। আমার কানের কাছে মুখ। গলায় নরম নিঃশ্বাস। বড়ো এলাচের গন্ধ।
রুমকি ফিশফিশ করে বললে, ‘দিদির মা পাগলের মতো একটা জিনিস খুঁজছে।’
‘কী জিনিস?’
‘কোথা থেকে শুনেছে, পারিবারিক যত গয়না শ্বশুরমশাই এই সবই কারও কাছে গচ্ছিত রেখে। গেছেন। বেহালার বাক্সে ভরে। তিনি খুব বড় ওস্তাদ ছিলেন। বেহালাটা ওই বাড়িতে পড়ে আছে। বাক্সটা নেই।’
সুবীর আচমকা ‘উঃ’ বলে লাফিয়ে উঠল ‘আলো জ্বাল, আলো জ্বাল।’
‘কী হল রে!’
‘কামড়েছে। মনে হয় কাঁকড়াবিছে!’
নিমেষে সব লণ্ডভণ্ড। বালিশ-চাদর মেঝেতে গড়াগড়ি। সুবীর বাইরে বেরিয়ে গেছে। আকাশে ভোরের আলো ফুটছে। সুবীর বাইরে থেকে ডাকছে, ‘শুভ্র! একবার আয় না।’
অনেকটা দূরে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘কিছু কামড়ায়নি। পাছে তুই গচ্ছিত গয়নার কথা বলে ফেলিস! আমি ঘুমোইনি। মটকা মেরে পড়েছিলুম। মেয়েটাকে স্টাডি করছিলুম। সব কিছু বাজিয়ে নিতে হয়। তোকে একটা কঠিন কাজ সুবীর থেমে গেল। রুমকি আসছে। ভীষণ উত্তেজিত। ‘এই দেখো কী বেরিয়েছে।’
এত বড় একটা ধুতরো ফল। ভোরের আলোয় স্পষ্ট।
অবাক কাণ্ড। ধুতরো এল কোথা থেকে!
রুমকি চা বসাতে রান্নাঘরে চলে গেল।
ধুতরো ফলটা আমার হাতে। মা সারা জীবন শিবপূজা করে গেছেন। বিছানায় ধুতরো রেখেছিলেন সুরক্ষার জন্যে। রুমকি চলে যেতেই সুবীর বললে, ‘তোকে লম্পট প্রেমিক হতে হবে।’
‘মানে?’
‘তোকে দেখতে হবে, রুমকির জঘনে ক্ষতচিহ্ন আছে কি না?’
‘সে কী করে সম্ভব!’
‘সম্ভব! রুমকি ভীষণভাবে তোর প্রেমে পড়েছে। ঘরে তুলতে হলে যাচাই করে নিতে হবে। কে সে! সে কোন দলের! হঠাৎ গয়নার কথা উঠল কেন?’
‘কোন দলের মানে?’
‘ওই ভদ্রমহিলার দলের কি না? হঠাৎ এল? কেন এল?’
‘তুই মানুষকে ভীষণ সন্দেহ করিস।’
‘আমাকে ব্যবসা করে খেতে হয় ভাই। আমি এখন যাচ্ছি। রাত্তিরে আসব।’ ফিশফিশের বললে, ‘চুটিয়ে প্রেম কর। জায়গাটা দেখে নে। গল্প না সত্যি।’
.
৫.
চা, বিস্কুট খেয়ে সুবীর বেরিয়ে গেল। একবার বললে, চানটা সেরে নি, তারপর বললে, থাক সময় নেই। খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।
রুমকি বললে, ‘ঘরে এসো।’
খাটের ধারে আমাকে ঠেলে বসিয়ে দিল। গায়ে খুব জোর আছে। ছাত্রজীবন থেকেই আমি ব্যায়াম করি। এখনও সপ্তাহে তিন দিন জিমনাসিয়ামে যাই। তবুও মনে হল রুমকির সঙ্গে লড়াই হলে আমি হেরে যাব।
রুমকি একে একে সব জানালা বন্ধ করে, দরজায় ছিটকিনি তুলে দিল।
ব্যাপারটা কী! বেশ ভয় পেয়ে গেলুম। আমাকে খুন করবে নাকি! মনে মনে আত্মরক্ষার জন্যে প্রস্তুত আমি। আমার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সব পোশাক খুলে ফেলে বললে, ‘নাও, দেখে নাও। যাচাই করে নাও। মাথা নীচু করে আছ কেন? যেদিকে তাকাবার তাকাও সে দিকে।’
জীবনের আমি কখনও নগ্ন নারী দেখিনি। ছবিতে না, সিনেমাতেও না। সামনে দাঁড়িয়ে সুঠাম এক দেবী। যবের মতো গায়ের রং। সিল্কের মতো ত্বক।
‘কী হল? চোখ বুজিয়ে আছ কেন? তোমার বন্ধু যা দেখতে বলেছে দেখ। তাকাও।’ আমার ভীষণ ভয় করছে। বুক ঢিপঢিপ করছে। মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত।
ভয়ে ভয়ে বললুম, ‘তুমি কী করে শুনলে?’
‘আমার কুকুরের কান।’
‘তুমি সব পরে ফেল। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।’
রুমকি হেসে উঠল, ‘তা কি হয়! নেপালীর ভোজালি জানো?’
‘না।’
‘খাপ থেকে বেরোলে একটু না একটু রক্ত না নিয়ে ঢোকে না। আমার এই বুক তোমার হাত দুটো চাইছে।’
কারও মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়লে যেমন হয়, আমার ঠিক সেই রকম হল। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো রুমকি আছড়ে পড়ল আমার ওপর। কিছুক্ষণ কী হল বলতে পারব না। তাল তাল মাখনের মধ্যে আমি ডুবে যাচ্ছি। আমি যেন একটা পুডিং। ছোট্ট একটা চেরি ফল আমার ঠোঁটের সামনে। এক ঝাঁক টিয়া বাইরের আকাশে বাতাস-কাঁপানো ডাক ডাকতে ডাকতে উড়ে গেল। পরক্ষণেই সেই প্রাচীন ঘুঘুটার ঘুক ঘুক ডাক। সুন্দর একটা দেহের তলায় চাপা পড়ে আছি। চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। বেলাভূমিতে আঁজলা আঁজলা ঝিনুক ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের ঢেউ। এখন চোখের সামনে সেই ক্ষতস্থান। কোনও এক নেশাকাতর পিতার খোদাই। আর পাশেই রহস্যময় গুহা। বীজ আকারে প্রতিটি মানবসন্তানকে দশমাসের জন্মসাধনা করতে হয়। সুরক্ষিত, শব্দহীন, আলোকহীন সেই নিভৃত। যেখানে খাদ্য আছে, স্নেহ আছে, অদৃশ্য কোনও ভাস্কর আছে। চৈতন্য দিয়ে, সংসার দিয়ে তৈরি করছে মানবদেহ। প্রবেশে পুলকিত আনন্দ, নিমণে কুঁকড়ে যাওয়া যন্ত্রণা। বিরাট জগতের ঝলসে যাওয়া আলোয় ক্রন্দনের ভূমিকায় ভূমিষ্ঠের জীবনকাব্যের শুরু। ঘড়ির টিকটিক। ষাট, সত্তর, আশি।
জানালা খুলে গেল। দরজা উন্মুক্ত। দালানের মেঝেতে খবরের কাগজ। ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে রবিদা। রুমকি ঝিনুকের মতো দাঁত বের করে হাসছে। সাদা সালোয়ার, সাদা কামিজ। নরম। সাদা ওড়না।
‘তোমার মুক্তি নেই। অজগরে ধরেছে। তুমি এত বোকা কেন?’
‘এ কথা বললে?’
‘কাকে বিশ্বাস করে বসে আছো? এই তো সেই তৃতীয় ব্যক্তি!’
‘কী বলছ তুমি?’
‘সাচ বাত। কম্বল চাপা দিয়ে আগুন নেভাবার চেষ্টা করছি। দূর থেকে সব হইহই করে আসছে। দিদি একটা কথাই বলতে পেরেছিল—বাঁচাস। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছিল, বাঁচাও বলতে গিয়ে বাঁচাস বলেছে; কিন্তু না; পড়ো এইটা, তোমাকে লিখছিল, শেষ করে ডাকে দেওয়ার সময় পায়নি।’
অসমাপ্ত সেই চিঠি—’শুভ্র, সাবধানে থেকো। যেভাবেই হোক ওরা জেনেছে বেহালার বাক্সটা তোমাদের বাড়িতে আছে। আইনজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে জেনেছে আমি মরলে বিষয়-সম্পত্তি ওই মা নামধারিণী মহিলাটি পাবেন। তোমাকে একটা অদ্ভুত কথা শোনাতে চাই, সুবীর একজন নয় দুজন আমি হয়তো—’ চিঠি আর এগোয়নি।
‘এর মানে?’
‘মানে এই হতে পারে, আইডেন্টিক্যাল টুইন। এক সুবীর যেমন ভালো, আর সুবীর সেইরকম খারাপ। উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু। এইবার ধরো কাল রাতের সুবীর বদলে যদি আর এক সুবীর আসে।’
‘কেন আসবে?’
‘বেহালা উদ্ধারে। সত্তর থেকে আশি লক্ষ টাকার গয়না। সতেরোখানা হিরে, পনেরোখানা রুবি। প্লাস সোনা।’
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘এই যে, এই কাগজখানা।’
লম্বা একটা পার্চমেন্ট। গয়নার লিস্ট।
‘তুমি কোথায় পেলে?’
‘চোরের ওপর বাটপারি। এই দ্বিতীয় সুবীর আর কাকাবাবু—এদের একটা ঘাঁটি আছে, নারকেলডাঙার বাগানে।’
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘এক সেকেন্ড। আমি আসছি।’
রুমকি বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মিনিট পনেরো পর একটি মেয়ে ঘরে এসে বললে ‘হাই।’
চোখে সানগ্লাস, চুল অন্যরকম। জিন্স, টিশার্ট। রুমকি বলে চেনার উপায় নেই।
বললে, ‘বসতে পারি?’
‘হ্যাঁ বসুন।‘
বসেই একটা রিভলভার বের করে আমার দিকে নিশানা করে বললে, ‘যা আছে বের করে দাও।’
ভয় পেয়ে গেছি। ইয়ারকি না সত্যি! দুই সুবীরের গল্প, সত্যি না গল্প!
রুমকি কি ওদের দলের!
‘ভিতু, ভিতু’, হেসে উঠল রুমকি, ‘এটা টয় রিভলভার।’
সানগ্লাসটা চোখ থেকে সরিয়ে বললে, ‘তোমাকে মানুষ করতে আমার অনেক সময় লাগবে। তোমাকে আমার বর করব, না ছেলে করব, বউ হব, না মা হব!’
ধর্মের জগতে একটা কথা—সমর্পণ। রুমকির এই একটি কথায় মনে মনে নিজেকে তার কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিলুম—কিন্তু, আমি যে তোমাকে চাই, এই একটু আগে যেভাবে পেয়েছিলুম।’
‘থামো, ওটাও আমাকে শেখাতে হবে। আনাড়ি কোথাকার।’
‘তুমি এই মেকআপে কী করো?’
‘ফলো করি। গোয়েন্দাগিরি করি।’
‘এই সাজ নিশ্চয় ওই বাড়িতে বসে করো না?’
‘অবশ্যই না। এজেন্সিতে বসে করি।’
‘অ্যাঁ, সে আবার কী?’
‘দিদি এক ডিটেকটিভ এজেন্সিকে দায়িত্ব দিয়েছিল তার মায়ের রহস্য বের করার জন্যে। চুপিচুপি আমাকে পাঠাত খবর নেওয়ার জন্যে। কর্নেল মুখার্জি একদিন আমাকে বললেন, ঘরের। শত্রু হবে। পারব আমি? নিশ্চয় পারবে। একটাই কায়দা, খুব সহজ হতে হবে। চোখে-মুখে যেন কোনও উদ্বেগ, উত্তেজনা না থাকে। এই ড্রেস তাঁরই দেওয়া। নারকেলডাঙার একটা পোড়ো বাগানে এদের ঘাঁটি। কারবার হল ব্ল্যাকমেল। দিদি মেঝেতে লিখেছিল বিনাশ, ওটা হবে অবিনাশ। ‘অ’টা ঠিকমতো ফোটেনি। এই অবিনাশই দ্বিতীয় সুবীর।’
‘কী কাণ্ড! এখন কোন সুবীর এল বুঝব কী করে?’
‘দেখো, এইরকম যদি হয় প্রথম সুবীর আর এলই না। বেমালুম উধাও করে দিল। তুমি কি জানো এই বাড়ির ওপর নজরদারি আছে? ওয়াচ করছে? তোমাদের আউটহাউসে তাকে ভয় দেখাবার জন্যে যা-তা কাণ্ড করছে। দূর থেকে বেহালার শব্দ ছুঁড়ছে।’
‘কেন? আমার ওপর এত রাগ কেন?’
‘বেহালাটা চাই, বাড়িটাও চাই। ওই বাড়িটাকে কেন্দ্র করে এই পাড়ায় পাপ ঢুকেছে।’
‘আমি এখন কী করব?’
রুমকি গম্ভীর মুখে বললে, ‘বিয়ে করবে।’
‘কাকে?’
‘কাকে আবার, আমাকে।’
‘তোমাকে করব কেন?’
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, তাই।’
‘কেন ভালোবাস? আমাকে কেউ ভালোবাসতে পারে আমি বিশ্বাস করি না।’
‘যে গুণ থাকলে মেয়েরা ভালোবাসতে পারে, তোমার মধ্যে সেইসব গুণ আছে। সব মেয়েই
তোমাকে ভালোবাসবে সেটাই আমার সমস্যা।’
‘তোমার মতো একটা স্মার্ট মেয়েকে আমার মতো একটা ক্যাবলা কতদিন কাছে রাখতে পারবে, সেটাই আমার ভয়।’
‘তুমি রাখবে কেন, আমিই তো তোমাকে আমার বুকে জড়িয়ে রাখব। আমার কত স্বপ্ন, তবে কী জানো, আমাকে মেরে ফেলতে পারে। অবিনাশযদি আমাকে বিনাশ করে!’
রুমকি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। দেহটাকে চেয়ারে এলিয়ে দিয়েছে। চোখ দুটো আধ বোজা। স্বপ্নের রিলে হচ্ছে, ‘বাগানঘেরা সুন্দর একটা বাংলো। ছোট্ট একটা মোটরগাড়ি, লাল রঙের। কাঠের মেঝে। নরম কার্পেট পাতা বসার ঘর। এক দিকের জানালায় ফরেস্ট, আর দিকের জানালায় পাহাড়। সুন্দর একটা রান্নাঘর। সুন্দর একটা চানঘর। একটা ধ্যানঘর। একটা গোল্ডেন রিট্রিভার কুকুর। ভালো একটা মিউজিক সিস্টেম। আর তোমার মতো একটা তুমি। বাঁচতে বাঁচতে আমরা দুজনে বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব। আমাদের কোনও সন্তান থাকবে না। শীতের রোদে গোলাপ বাগানে গার্ডেন চেয়ারে দুজনে বসে থাকব। আমার হাতে বোনা সাদা পশমের। সোয়েটার তোমার গায়ে। মাথায় বেরে ক্যাপ। কোনও দুশ্চিন্তা নেই, বেয়াড়া কোনও আকাঙ্ক্ষা নেই। বাইনোকুলার দিয়ে পাখি দেখব। পাহাড়ের দিক থেকে বয়ে আসবে শীতল বাতাস। শীতের পাতা বড় বড় গাছ থেকে খস খস করে ঝরে ঝরে পড়বে।’
সুবীর ফিরে এল।
বেশ আড়ষ্ট হয়ে গেলুম, এ কোন সুবীর!
রুমকি বললে, ‘যাচাই করে নাও।’
সুবীর একটু থতোমতো খেয়ে গেল।
রুমকি বললে, ‘যাচাই হয়ে গেছে, আসল সুবীর।’
জিগ্যেস করলুম, ‘কী ভাবে করলে?’
‘তোমাকে বলেছিল, আমাকে যাচাই করে নিতে। এই যাচাই শব্দটা শুনে সুবীরদা কেমন যেন হয়ে গেল। অবিনাশ হলে বুঝতই না।’
‘তোর যে একজন যমজ ভাই আছে কোনওদিন বলিসনি তো!’
‘আমাদের পরিবারের লজ্জা। আমি ভুলতে চাই। সে এক সমস্যা। হয় সে জেলে যাবে, না হয় আমি যাব। অথবা আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। তোদের দুজনকে আমার একটা আইডেন্টিফিকেশন মার্ক দেখিয়ে রাখি যেটা ওর নেই। এই দেখ আমার কপালের ডানপাশে হেয়ার লাইনের নীচে ছোট্ট একটা কাটমার্ক। ভাঙা কাচ ঢুকে গিয়েছিল। খুব সাবধান, দ্বিতীয় সুবীর যে কোনও সময় আসতে পারে, আর প্রথম সুবীর অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। আমাকে। একজন ফোন করেছিল—বেহালার বাক্সটা কোথায়! যে কোনও দিন এই বাড়িতে হামলা হতে পারে। আমাদের প্রথম কাজ, এই মুহূর্তে হোলার বাক্সটাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।’
‘কী ভাবে?’
‘আগুন। আগুনের মতো আর কী আছে! আর সেই কাজটা এখুনি করতে হবে।’
‘অত সুন্দর বাক্সটা!’
‘তোর সবচেয়ে বড় বিপদ কী বল তো—তুই চুরি না করেও চোর।’
‘গয়নাগুলো ফেরত দিয়ে দিলেই তো হয়।’
সুবীর দৃঢ় গলায় বললে, ‘না, ও গয়না চিনুর। তার মানে তোর।’
‘আমি তো চিনুকে বিয়ে করিনি।’
‘করবি! চিনু তো তোর সামনে বসেই আছে।’
চারদিক থেকে কীরকম একটা ভয় ঘিরে আসছে। নারকেলডাঙার যে বন্ধ কারখানায় পোডড়া বাড়ি থেকে সুবীরের যমজ অবিনাশ ‘অপারেট’ করছে, সেই বিখ্যাত স্বদেশী ফ্যাক্টরির ফাউন্ডার ছিলেন সুবীরের ঠাকুরদা। কোন জায়গার কী পরিণতি! পৃথিবীর সব দেশ চেষ্টা করছে এগোতে, আমরা চেষ্টা করছি পেছোতে।
সুবীর বললে, ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।‘
‘কী আইডিয়া?’
‘বেহালার কেসটা লুকিয়ে লুকিয়ে নারকেলডাঙার বাগানে ওদের ঘাঁটিতে রেখে আসব।’
‘কী লাভ?’
‘নিজেদের মধ্যে লাঠালাঠি শুরু হয়ে যাবে। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সন্দেহ করতে থাকবে।’
আমি বললুম, ‘এই উদবেগ, এই অশান্তি এক কথায় মিটে যায়, যদি গয়নাগুলো চিনুর মাকে দিয়ে আসি। কারণ চিনুর মৃত্যুর পর সমস্ত কিছুর মালিক চিনুর মা।’
রুমকি বললে, ‘অসম্ভব! এমনও তো হতে পারে গয়নাগুলো তোমার দাদুর কাছে বাঁধা রেখে টাকা ধার নিয়েছিল? এমনও তো হতে পারে ওর মধ্যে তোমাদের গয়নাও আছে। এটা কাঁচা প্রস্তাব?’
সুবীর চান করতে গেল।
রুমকি হঠাৎ বললে, ‘সুবীর একজন না দুজন?
‘মানে?’
‘আমার সন্দেহ হচ্ছে।’
রুমকি ফিশফিশ করে তার সন্দেহের কথা জানাচ্ছে। ‘দেখো, এমনও তো হতে পারে, একটা লোক ডবল রোল প্লে করছে।’
‘সন্দেহের কারণ?
‘সিনেমায় সীতা ঔর গীতা হয়, বাস্তবে দেখেছ?’
‘না। তবে ভ্রান্তিবিলাস পড়েছি।’
সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ, আঙুলের আংটি। একেবারে একই আংটি দুজনের আঙুলে থাকতে পারে কি? তৃতীয় কারণ, বেহালার বাক্সটা বাগাতে চাইছে, কারণ ওইটা হল রশিদ। সবচেয়ে বড়ো বিপদ, তোমরা দুজনে গিয়ে লকারে গয়নাগুলো রেখে এসেছ। সুবীর কী ব্যবসা করে? সে। ব্যবসা কেমন চলে? তুমি জানো কিছু?
‘না।’
‘একালে মানুষকে বিশ্বাস করা শুধু বোকামি নয় বিপদেরও কারণ। আমি কে? আমাকে এতটা বিশ্বাসের কারণ? যে-মেয়ে এক কথায় অজানা এক পুরুষের সামনে সব খুলে দাঁড়াতে পারে সে কি ভালো মেয়ে? তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে, তোমার বন্ধু আমাকে যাচাই করে নিতে বলল। কেন? তুমি সরল, সে সন্দিগ্ধ। সে ব্যবসাদার।’
সুবীর আসছে। রুমকি রান্নাঘরে চলে গেল। সুবীরের সঙ্গে কোনও কথা না বলে আমি বাথরুমে স্নানে ঢুকে গেলুম। বাথরুমের মতো নিভৃত চিন্তার জায়গা দ্বিতীয় নেই। চিনু মারা গেল আগুনে পুড়ে। পোস্টমর্টেমে সন্দেহজনক কিছু নেই। এখানেই তো সব মিটে যেতে পারত! একটি মেয়ে এল। সঙ্গে নিয়ে এল একগাদা সমস্যা ও সন্দেহ। বন্ধু বিচ্ছেদের উপক্রম। এখন মনে হচ্ছে, বাড়ির কোথায় কী আছে দেখার জন্যে সুবীরের এত উৎসাহ কেন?
আমরা যখন একসঙ্গে খেতে বসলুম, সুবীরকে কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক দেখাল। খেয়ে উঠে জামা-প্যান্ট পরে বেরোবার সময় বললে, ‘আমি ব্যবসার কাজে দিন পনেরোর জন্যে বাইরে। যাচ্ছি শুভ্র! তুই এদিকটা ম্যানেজ কর। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ চলে গেল!
আমি আর রুমকি বেশ অবাক হয়ে বসে রইলুম কিছুক্ষণ।
রুমকি বললে, ‘চলো, অলক্ষুণে বেহালার বাক্সটা পোড়াই। তুমি ওটাকে টুকরো টুকরো করে দাও, আমি কেরোসিন ঢেলে জ্বালিয়ে দি।’
সৎকার করার আগে সেই অপূর্ব সুন্দর বাক্সটা একবার খুললুম। ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ। ‘কী আশ্চর্য! এটা আবার কী?’
রুমকি বললে, ‘ছিল না?’
‘না।’
‘খোলো। খুলে দেখ।’
একটা চিঠি।
শুভ্র, এ আমার স্বীকারোক্তি। আমিই সুবীর, আমিই অবিনাশ। চিনুর মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী। চিনুকে আমি পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে তোকে ছাড়া আর কিছু চাইত না। আমার ঈর্ষা তাকে প্রাণদণ্ড দিল। অবিনাশ নামে ওই বাড়িতে আমার প্রবল প্রতিপত্তি ছিল। ওর মায়ের সঙ্গে আমার বিশ্রী একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দোষটা আমার নয় ওই মহিলার। কাকাবাবু অসুস্থ মানুষ। বাইপাস হয়ে গেছে। লোকটার আর কিছু নেই।
মা যে মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে, শুনেছি, এই প্রথম দেখলুম। যে-রাতে চিনু আমাকে
জুতো মারলে, সেই রাতেই আমার প্রতিশোধস্পৃহা প্রবল হল। একাধিক রাত আমি ওদের বাড়িতে থেকে দেখেছিলুম, সকালের চা চিনু নিজেই করে। অনেক মাথা খাঁটিয়ে একটু ফুলপুফ প্ল্যান বের করলুম। এমন বরাত, লেগে গেল। খুব ভোরে উঠে খানিকটা মোবিল রান্নাঘরের মেঝেতে কায়দা করে ফেলে রাখলুম। সন্দেহটা যাতে তৃতীয় কারও দিকে যায়, তার জন্যে একটা হেঁয়ালি চিরকুট লিখে ওর মায়ের বালিশের ভেতর রাখলুম। আমি ত্রিসীমানায় আর থাকলুম না। মোবিলে পা স্লিপ করে ওর মায়ের হাত থেকে বাসন পড়ল, চিনু পা হড়কে গ্যাসের ফ্লেমের ওপরে পড়ে সবসুদ্ধ নিয়ে মেঝেতে। বীভৎস! রাতের ঘুম চলে গেল। আমি এখন অন্য ঘুমের কোলে চলে যাচ্ছি। তুই যদি এই স্বীকারোক্তি নিয়ে থানায় যাস, আমাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তোর প্রেমিকা, তোর বাড়ি—দুটোর ওপরেই আমার লোভ ছিল। ভূতের উপদ্রব আমার প্ল্যান, আউটহাউসের যত কাণ্ড আমি করিয়েছি।
একটা শক্তিরূপিণী মেয়ে তোর জীবনে হঠাৎ এসে পড়ায় তুই জোর বাঁচা বেঁচে গেলি শুভ্র। আমার ভয়ঙ্কর, ভয়ঙ্কর সব প্ল্যান ছিল। আমি জানতুম তুই ফরেস্টে যাবি, আর তখনই ওই প্রাসাদের মতো বাড়িটা আমার দখলে এসে যাবে। চিনু কিন্তু খুব বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে ছিল না। রাগী, অহংকারী, বিলাসী, খুঁতখুঁতে। সে আমাকে ধরে ফেললেও উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে যাচ্ছি, রুমকি দেবী। দেবী দুর্গা। তোদের জীবনে সুখ আসুক।
আর একটা আশ্চর্য কথা বলে যাই, গয়নাগুলো সব রুমকির। রুমকির মা জমিদারের মেয়ে ছিলেন। স্বামীর অবস্থা দেখে গয়নাগুলো তোর দাদুর কাছে রেখেছিলেন। তারপর এল সেই দুর্যোগ। বোলপুরের কাছে রেললাইনে যে অজ্ঞাত পরিচয় মহিলা কাটা পড়েছিলেন, তিনি। রুমকির মা।
দেখ, কী মজার ব্যাপার, ভদ্রমহিলা কেমন না জেনেই ঠিক জায়গায় মেয়ের বিয়ের গয়না রেখে গিয়েছিলেন, পাত্রটিও তুলনাহীন ভালো। তিনি ওপর থেকে দেখে সুখী হবেন, আশীর্বাদ করবেন নিশ্চয়! ভগবান আছেন, কী বলিস শুভ্র! গয়নাগুলো কিন্তু আমার আবিষ্কার। বিদায়! তোদের ঘৃণাই আমার পাথেয়। একটা হিরের আংটি বাথরুমের সোপকেসে রইল। ঘৃণ্য অপরাধীর প্রীতি উপহার।
সুবীর।
রুমকির চোখে জল। আমার ভেতরটাও কেমন যেন থমথম করছে। না, ভাবব না। কিছুই ভাবব না। ভাবনা খুব খারাপ জিনিস। আমার মা বলতেন—সমর্পণ। ঠাকুরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দে।
হঠাৎ রুমকি তেড়েফুঁড়ে উঠল, ‘আজ পূর্ণিমা। আজই আমরা বিয়ে করব।’
‘সে কী, পুরোহিত পাব কোথায়?’
‘নিজেদের বিয়ে আমরা নিজেরাই করব। তুমি অনেক ফুল আর মালা কিনে আনো। মায়ের ছবির সামনে। চাঁদ সাক্ষী।‘ বিছানায় থইথই চাঁদের আলো। সাদা সাদা ফুল, মালা, সুরভি। রুমকির সুন্দর কপালে সোনার টিপ। তার ওপর চাঁদের আলো। রুদ্ধগলায় বললে, ‘যেদিন তোমার কাছে এলুম, সেদিন সুবীরদা ওই ওই পাশটায় শুয়েছিল।’ সেই বেহালা আজ আবার বাজছে। কে! কে বাজায়!
কেয়ারটেকার
পরেশ ক’দিন থেকে লক্ষ করছে হলঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে যেন নোনা ধরেছে। ছোপ ছোপ অসুস্থ ফুলের মতো একরাশি দাগ দেয়ালে ভেসে উঠেছে। হয়তো আরও অনেক দাগ বিশাল পেন্টিং-এর নীচে চাপা পড়ে আছে। মৃগাঙ্কভূষণ রায় ছড়ি হাতে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন। ছবি বলেই হাসিটা অক্ষয় হয়ে আছে। সাহেব আর্টিস্টকে পঞ্চাশ বছর আগে এই ভাবে হাসি হাসি মুখেই সিটিং দিয়েছিলেন। এই ঘরেই তখন তার হাসির সময়। সারা সংসার তখন তাঁর সঙ্গে হাসছে। তাঁর বিশাল চা বাগান সেই সময় দার্জিলিং হিলসের গা বেয়ে থাকে থাকে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে। অর্থ, সম্পদ, প্রতিপত্তির উপর একটা পা তুলে দিয়ে তিনি তখন হাসছেন।
পরেশ সারা হলঘরের ধুলো ঝাড়তে পারে। ফ্ল্যানেল দিয়ে পিতলের কারুকাজ করা ফুলদানি, ছবির ফ্রেম চকচকে করতে পারে। ফেদার ডাস্টার দিয়ে গ্র্যান্ড পিয়ানোর উপর থেকে। পাউডারের সূক্ষ্ম প্রলেপের মতো ধুলো উড়িয়ে দিতে পারে। মৃগাঙ্কভূষণের শুভ্র দাঁত থেকে ঝুল সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু পঙ্খের কাজ করা উত্তরের দেয়াল থেকে বিশ্রী ছোপ কী করে সরাবে! যা ভিতর থেকে আসছে, অনবরত আসছে তাকে সে আটকায় কী করে! অল্প অল্প চুন গুড়ো হয়ে পুরু কার্পেটের উপর ঝরে পড়ছে। দেয়ালের ওই নোনা ছোপ পরেশের মনে তার নিজের পিঠ বেয়ে ক্রমশ উপরের দিকে উঠে আসছে।
বয়স যখন তার পনেরো তখন থেকে সে এ বাড়িতে আছে। এখন পঁয়ষট্টি। যখন এসেছিলেন তখন তার নিজের জীবনে সকাল, এই সংসারের মধ্যাহ্ন। এরপর সে গোধূলি দেখেছে। রাত্রি এসেছে, পায়ে পায়ে। এখন বোধহয় মধ্যরাত। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘোরানো সিঁড়ির নীচে, কিংবা মালপত্র রাখার খুপরি ঘর থেকে প্রহরে শেয়াল ডাকছে। শহর কলকাতায় শেয়াল? না। শেয়াল তার মনে! এই বাড়িতে তার সুদীর্ঘ জীবনে সে অনেক শেয়ালের রজনী দেখেছে। সাদা। উর্দি পরে রঙিন গেলাসে রঙিন পানীয় পরিবেশন করতে করতে তার মনে হয়েছে সারসের ভোজ সভায় শেয়ালের বোকামি।
পুবের জানালা খুলে দিলে, সকালের রোদ কার্পেটে লুটিয়ে পড়ে উত্তরের দিকে কিছুটা গড়িয়ে আসে, তারপর চেয়ার আর পায়ায় জড়াজড়ি হয়ে একটা লোমশ বুড়ো কুকুরের মতো কার্পেটের উপর কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে উঠে চলে যায়। শেষ বেলার পশ্চিমের জানলা খুললে একটু রোদের জলাশয় তৈরি হয়। পুরোনো কার্পেট থেকে বয়সের গন্ধ ওঠে। কিছুটা রোদ খাওয়াতে পারলে যৌবন হয়তো ফিরে আসত। দেয়ালের ক্ষয় হয়তো আটকানো যেত।
ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে পরেশ মাঝে মাঝে বসে পড়ে। আগেকার মতো এক দমে কাজ করতে পারে না। অবশ্য কাজের আর আছে কী? এক সময় ছিল যখন এ বাড়িতে নিশ্বাস ফেলার সময় পাওয়া যেত না, আর এখন? এখন কাজ খুঁজে বের করতে হয়। পরেশ কাঁধের ঝাড়ন সোফার হাতলে নামিয়ে রাখল। মনে পড়ল আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই চেয়ারে বাংলার লাটসাহেব বসেছিলেন আর ওই উলটো দিকেরটায় বসেছিলেন মৃগাঙ্কভূষণ। সারা ঘরে লোক থইথই করছে। মাথার উপর সবক’টা ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে। কী সব জমকালো পোশাক, সুগন্ধ। দিদিমণির বয়স তখন কত হবে? পরেশ মনে মনে হিসেব করল আঠারো থেকে কুড়ির মধ্যে। একেবারে সাদা পোশাক পরে ওই পিয়ানো বাজিয়ে দিদিমণি গান গেয়েছিলেন সে রাতে।
ঘরের কোণে গ্র্যান্ডফাদার ঘড়িটা মিঠে সুরে একবার বাজল। পরেশ অতীত থেকে বর্তমানে। ফিরে এল। সামনের দিকে তাকাল, তার দৃষ্টি হলঘর থেকে গড়িয়ে কার্পেট বেয়ে দরজা পেরিয়ে উপরে ওঠার সিঁড়ি বেয়ে একটা বাঁক উঠলেই পরেশ দোতলায় উঠে যেত। টানা মার্বেল পাথর বাঁধানো চওড়া ঢাকা-বারান্দা পুব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। মেহগনি কাঠের বড় বড় দরজা লাগানো সারি সারি ঘর। একেবারে শেষের ঘরে এই বাড়ির শেষ উত্তরাধিকারিণী এখনও। বিছানায়। বিশাল খাটের তুলনায়, খাটো শরীর। কোঁচকানো চাদরের সমুদ্রে মোচার খোলা। মৃগাঙ্কভূষণের একমাত্র মেয়ে পদ্মিনী। পরেশ পদ্মিনীর কথা ভেবে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল। মা মরা মেয়েকে পরেশই মানুষ করেছে। কার্পেট মোড়া সিঁড়ি দিয়ে মৃগাঙ্কভূষণকে মধ্যরাতে শোবার ঘরে তুলে দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে জুতো খুলে দিয়ে, আলো নিভিয়ে দরজা ভেজিয়ে পরেশ দৌড়ে আসত পদ্মর ঘরে। কোনওদিন। দেখত ফুলের মতো ঘুমোচ্ছে, কোনওদিন দেখত জানালার কাছে চেয়ারে বসে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আছে।
সেই পদ্ম আজ প্রৌঢ়া। বাতে পঙ্গু! বিছানা আর ঘর এরই মধ্যে জগৎ সীমাবদ্ধ। সাড়ে আটটা ন’টার মধ্যে পরেশ এক গেলাস গরম জল, চা আর হট ব্যাগ নিয়ে উপরে উঠবে। সাবধানে দরজা খুলে ট্রেটা টিপয়ের উপর রেখে, একটা ওয়াশ স্ট্যান্ড বিছানার কাছে টেনে আনবে। কোনও কোনও দিন কার্পেটের উপর থেকে গড়িয়ে যাওয়া কাচের গেলাস তুলে রাখতে হয়। শেষ পেগ এক চুমুকে শেষ করে পদ্মিনী এইভাবেই গেলাস ছুড়ে ফেলে দেয়। পদ্মিনী উঠবে।
কোনওদিন এক ডাকে। কোনওদিন ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙে না। তখন পরেশ হাতির দাঁতের একটা পেপার কাটার নিয়ে পায়ের তলায় বারকতক সুড়সুড়ি দেয়। মোমের মতো পা আপেলের মতো রক্তাভ গোড়ালি।
বিছানায় বসে ওয়াশ স্ট্যান্ডে মুখ ধোবেন পদ্মিনী। তারপর এক কাপ চা খাবেন, লেবু আর অ্যাসপিরিন দিয়ে। টকটকে মুখে অসম্ভব খাড়া একটা নাক। টানা টানা প্রতিমার মতো চোখ, অসম্ভব একটা ব্যক্তিত্ব। পরেশ মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবে পদ্মিনী যখন ছোট, যখন একসঙ্গে দুজনে খেলা করত তখন দুজনের মধ্যে ব্যক্তিত্বের এই ব্যবধান ছিল না। তারপর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লাল রক্ত যখন নীল হয়ে আসতে লাগল, পরেশ আর তখন খেলার সাথী নয়। সম্পর্ক তখন প্রভু-ভৃত্যের।
পরেশ পেছন ফিরে তাকাল, মৃগাঙ্কভূষণ হাসছেন। পরেশ লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। হাসিটা যেন নীরব ভৎসনা, যে সোফায় লাট-বেলাট বসতেন, যে সোফায় স্বাধীন ভারতের যত ভাগ্যবিধাতারা বসে গেছেন, সেই সোফায় পরেশ তুই! সাম্যবাদের চূড়ান্ত হয়ে গেল যে! এতটা কি ভালো! পদ্মিনী যখন চলতে ফিরতে পারতেন তখনও পরেশ কোনওদিন সোফায় বসার সাহস পেত না। কার্পেটে বসে হুকুম শুনত। ইদানীং সে নির্ভয়। বয়স আর অত্যাচার আর নীল রক্তের অভিশাপ তার শেষ প্রভুকে শক্ত দুটো হাতে যেন পাকিয়ে দিয়েছে। শেষ কতবছর আগে দৃপ্তভঙ্গিতে ওই সিঁড়ি দিয়ে পদ্মিনী ঘুরে ঘুরে পায়ে পায়ে নেমে এসেছে তার মনে নেই। এই ঘর সোফা এই কার্পেট এই আয়োজনের মধ্যে গত পঞ্চাশ বছর ঘুরতে ঘুরতে পরেশ মাঝে মাঝে নিজেকে প্রভু ভেবে ফেলে; কিন্তু সে সাময়িক, কোথা থেকে সেই পঞ্চাশ বছরের ভৃত্য এসে কান ধরে তাকে প্রভুর আসন থেকে তুলে দেয়।
হলঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে পরেশ দরজার কাছে এসে একবার থমকে দাঁড়াল। দরজার পাশে সেই ছবিটা। আর এক মৃগাঙ্কভূষণ। ১৯৪৭ সালের মৃগাঙ্কভূষণ! জনপ্রতিনিধি! মন্ত্রী মৃগাঙ্কভূষণ। উলটোদিকের দেয়ালের অয়েল পেন্টিংয়ের হাসি মুখে নেই। গম্ভীর সৌম্য মুখ। ব্রত উদযাপনের সংকল্প মুখে। পরেশ যেন অজস্র কণ্ঠের জয়ধ্বনি শুনতে পেল, অজস্র হাতের তালি। মৃগাঙ্কভুষণ আজ থেকে ২৮ বছর আগে যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন যে বক্তৃতাকে উচ্ছ্বাস জানিয়ে একমাঠ মানুষ উল্লাসে উদ্দীপনায় ফেটে পড়েছিল, শব্দতরঙ্গে কান পাতলে পরেশ যেন এখনও স্পষ্ট শুনতে পায় জলোচ্ছ্বাসের কলরবের মতো। পরেশ কাঁধের ঝাড়ন নামিয়ে ছবির ফ্রেম আর কাচটা ঘষে ঘষে পরিষ্কার করে দিল। সংসারে মৃগাঙ্কভূষণ এতবড় একটা উপস্থিতি ছিলেন যে তাঁর অনুপস্থিতিটা যেন মেনে নেওয়া যায় না, ফুলের গন্ধের মতো হাওয়ায় ভাসে, ছায়ার মতো লুটিয়ে থাকে। পরেশ বাড়ির কয়েকটা জায়গায় গেলে এখনও যেন চমকে ওঠে। মনে হয় আরশির সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাচ্ছেন। টেবিলে বসে লিখছেন। কলমের ঠান্ডা শরীরে এখনও হাতের গরম। বাথরুম বন্ধ থাকলে মনে হয়, শাওয়ার খুলে স্নান করছেন। ওয়াশ-বেসিনের কাছে খাবার পর সামনে ঈষৎ ঝুঁকে উপরের পাটির বাঁধানো দাঁত পরিষ্কার করে চট করে মুখে পুরে দিচ্ছেন। খুট করে দাঁত সেট হয়ে যাবার শব্দ যেন এই মাত্র বেসিনের কাছ থেকে ভেসে এল। শোয়ার ঘরে গেলে মনে হয়, বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন বিশাল বুকের উপর আড়াআড়ি দুটো হাত, একটা পায়ের পাতার সঙ্গে আর একটা পায়ের পাতা জড়ানো। পরেশের জীবনে মৃগাঙ্কভূষণের পঞ্চাশ বছরের অস্তিত্ব যেন মুছে ফেলা যায় না। ফুলদানির ফুলের মতো মনের কোণে প্রতিষ্ঠিত।
কেটলিতে চায়ের পাতা ভেজালেই জলের ভাপের সঙ্গে দার্জিলিং চায়ের গন্ধ পরেশের নাকে এসে লাগে। এই গন্ধটা যেন পরেশের বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সাঁকো। জলে চা ভেজে। অতীতে পরেশের বর্তমান ভেজে। যে রাতে মৃগাঙ্কভূষণ শহরে ভুখা মিছিলের উপর গুলি চালাবার নির্দেশ দিলেন সে রাতের কথা পরেশ কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সারা শহরে সান্ধ্য আইন। রাত প্রায় বারোটার সময় মৃগাঙ্কভূষণের বিশাল কালো গাড়ি এসে ঢুকল। ক্লান্ত মৃগাঙ্ক সিঁড়ির হাতল ধরে ধরে উপরে উঠে গেলেন। কিছুই খেলেন না সেই রাতে। ইদানীং পান করতেন না। সেদিন আবার দীর্ঘ কয়েক বছর পরে, বোতল আর গেলাসের খবর পড়ল। পরেশ সারা রাত বসে রইল ঘরের বাইরে। সারা রাত মৃগাঙ্ক পান করলেন। শেষ রাতে পরেশ শুনতে পেল মৃগাঙ্ক নিজের সঙ্গে কথা বলছেন, নিজেকে তিরষ্কার করছেন, কাকে যেন বোঝাতে চাইছেন, মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলছেন ষড়যন্ত্র।
মৃগাঙ্কর রাজনৈতিক জীবনের চাকা সেই রাত থেকেই যেন ঘুরে গেল। মুখের হাসি মিলিয়ে গেল, আত্মবিশ্বাস খুলে পড়ে গেল। দীর্ঘ সময় উদাস দৃষ্টি মেলে ডেকচেয়ারে শুয়ে থাকতেন। দেখে মনে হত গতিশীল প্রচণ্ড একটা ইঞ্জিন যেন ক্রমশ স্তব্ধ হয়ে আসছে।
এর পরই সেই দিন, মৃগাঙ্ক নির্বাচনে হেরে গেলেন। যে কেন্দ্র থেকে তিনি এতকাল হাজার হাজার ভোটে জিতেছেন সেই কেন্দ্রে তাঁর হার হল খুবই অল্প ভোটে। তাঁর দল ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। সারা শহর উল্লাসে, বাজি পুড়িয়ে চিৎকার করে মিছিল বের করে পুরোনো দিন, পুরোনো। নেতৃত্বকে বিদায় জানাল। মৃগাঙ্কভূষণ সে রাতে, খুব অল্প আহার করলেন, দু-চারটে লিখলেন, ডায়েরি লিখলেন, ফোনে অল্প দু-একজনের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। তারপর মাথার কাছে আলো জ্বেলে শুয়ে ছবির বই উলটোলেন। পরেশের সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পও করলেন। সম্পূর্ণ অন্য মানুষ, একেবারে সাধারণ মানুষ। ঘাটের অন্ধকার কোণে বাঁধা ডিঙি নৌকোর মতো স্থির, কর্মহীন।
অতবড় বিশাল মানুষটি, পরেশের চোখের সামনে দেখতে দেখতে কেমন বিবর্ণ, চাকচিক্যহীন হয়ে গেলেন। শীতের ডালের শুকনো পাতার মতো। কালো রঙের বিশাল গাড়ির পরিবর্তে এল ছোটো অস্টিন। গাড়িটা প্রায়ই গ্যারেজে পড়ে থাকত। আগে বাড়ি সবসময় গুণগ্রাহী, স্তাবক, পার্টির দলবলে জমজমাট থাকত। দেখতে দেখতে তারা কপূরের মতো উবে গেল। গোটাচারেক টেলিফোন মিনিটে মিনিটে বেজে উঠত। তারাও নীরব হয়ে গেল।
আগে প্রায় প্রতিদিনই গোটাকতক সভা সমিতিতে হয় প্রধান অতিথি না হয় সভাপতি হতে হত। ব্যস্ত ডায়েরির পাতা উলটে সময় দিতে হত। বহু জায়গায় দুঃখ জানিয়ে প্রত্যাখান পত্র পাঠাতে হত কিংবা বাণী পাঠিয়ে কাজ সারতে হত। ক্ষমতাচ্যুত হবার পর ব্যস্ততা নিমেষে কমে গেল। শেষে বহুদিন পরে কারা যেন একবার এসেছিলেন, শিশুউদ্যানের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ধরে নিয়ে যাবার জন্য। মৃগাঙ্কভূষণ হেসেছিলেন। করুণ হাসি। পরেশকে বলেছিলেন, তলোয়ারে মরচে পড়ে গেলে শিশুদের খেলার জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।
দল ভাঙা কিছু প্রবীণ একবার এসেছিলেন, দল গড়ে নতুন স্বপ্ন দেখার প্রস্তাব নিয়ে। শীতের রোদে পিঠ রেখে লনে বসে সেই বৃদ্ধ শার্দুলের দল মৃগাঙ্কভূষণকে ঘণ্টাখানেক ধরে উত্যক্ত করে চলে গিয়েছিলেন। নতুন দলের উদীয়মান নেতারাও একবার এসেছিলেন তাঁদের নতুন দলে
আসবার প্রস্তাব নিয়ে। মৃগাঙ্কভূষণ রাজি হননি। বলেছিলেন, মোমবাতির পরমায়ু শেষ হয়ে। গেছে। নতুন রোশনাই আর সম্ভব হবে না। মৃগাঙ্কভূষণ নেতা ছিলেন না। দাপট ছিল, লোভ ছিল না।
পরেশ সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠেছে। হাতে ট্রে, গরমজল, লেবু, হট ব্যাগ। দশ বছর আগের সকাল আর আজকের সকালে অনেক তফাত। আগে জীবনের দিনগুলো লেবুর কোয়ার মতো টেনে টেনে ছাড়াতে হত।
বারান্দার একপাশে টবের পামগাছের পাতায় ধুলো জমেছে। সারি সারি ছবির কোনও কোনওটা কাত হয়ে আছে। আগে এরকম থাকত না। একটা হুক খালি। একটা ছবি ছিল এখন আর নেই। এই বাড়ির একমাত্র জামাই, পদ্মিনীর স্বামীর ছবি ছিল ওই হুকে।
দিদিমণির বিয়ে হয়েছিল। দু-বছরের বৈবাহিক জীবন ভুল বোঝাবুঝিতে শেষ হয়ে গেল। রাজনীতির হাওয়ায় প্রেম বোধহয় এমনি করেই শুকিয়ে যায়। জীবন থাকে ঠিকই তবে বিবর্ণ ঘাসের মতো। পদ্মিনী শুধু মৃগাঙ্কভূষণের মেয়ে ছিলেন না, প্রাইভেট সেক্রেটারিও ছিলেন। হয়তো এমন আশাও ছিল রাজনীতির মঞ্চে পাদপ্রদীপের আলোর সামনে এসে একদিন দাঁড়াবেন। স্বপ্ন অনেকটা ঘুণ ধরা বাঁশের মতো, গুঁড়ো গুঁড়ো পাউডারের মতো নিঃশব্দে ঝরে যেতে থাকলে কিছুতেই থামানো যায় না।
বারান্দা ধরে এগিয়ে চলেছে পরেশ ধীর পায়ে। বাঁ দিকে ঘাড় ফেরালেই পরেশ দেখতে পাচ্ছে সবুজ লন। লনটা এখনও সবুজ আছে। আগের মতো তেমন মনে করে ছাঁটা না হলেও একেবারে
খাপছাড়া হয়ে যায়নি! মৃগাঙ্কভূষণের জীবনের শেষ দিনগুলো এই লনেই কেটেছে। লনের দিকে তাকালে পরেশ যেন এখনও দেখতে পায়, মৃগাঙ্কভূষণ ছড়ি হাতে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। চওড়া কাঁধে ঝুলছে ঢলঢল পাঞ্জাবি। বিশাল শরীরের কাঠামোটা ঠিকই ছিল, তেমনি ঋজু, সরল, উদ্বৃত্ত মাংস আর মেদ ঝরে গিয়েছিল। যখন হাঁটতেন, পা একটু টেনে টেনে ফেলতেন। আর্থারাইটিস। পদ্মিনী তাঁর একমাত্র বংশধর। উত্তরাধিকারিণী।
কোথায় সে গেল? এখন কোথায় আছে? ভালো আছে তো!
কলেজ জীবনে আমাদের চারজনের একটা দল ছিল। সেই দলের আবার একটা নামও ছিল ঘুরঘুরে। ছুটিছাটা থাকলে আমরা বেরিয়ে পড়তুম। সেই সময়টা ভারতবর্ষের খুব একটা সুন্দর সময়। কয়েক বছর আগে দেশ স্বাধীন হয়েছে। ওদিকে নেহরু ছুটছেন, এদিকে বিধান রায়। আমরা সব স্বপ্নে ভাসছি। নতুন ভারত জাগছে। সারা দেশে একটা দলেরই শাসন। গুচ্ছের দলের গদি ধরে টানাটানির খেলা নেই। পকেটে পকেটে আগ্নেয়াস্ত্র ঘোরে না। আর ডি এক্স জড়ানো মানববোমা তৈরি হয়নি। একটি মাত্র উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক হত্যা—মহাত্মা গান্ধির মৃত্যু। নানারকম অসুখেই মানুষ মরত। যে মৃত্যুর নাম ছিল ন্যাচারাল ডেথ। চারপাশে অনেক হাসি খুশি ডাক্তার ছিলেন, যাঁদের সঙ্গে রোগীরা প্রাণ খুলে দু-চারটে রোগের কথা কইতে পারত সাহস করে। ফিজ মাত্র পাঁচ টাকা, কি দশ টাকা বাড়িতে এলে। চেম্বারে আড়াই টাকা। পেটেন্ট ড্রাগস তেমন ছিল না বললেই চলে। ডিসপেনসারি থেকেই ওষুধ দিতেন কম্পাউন্ডার। মিকশ্চার আর পুরিয়া। কম্পাউন্ডার জিগ্যেস করতেন, শিশি এনেছ—বিরাট দুটো কাচের জারে লাল, নীল তরল। শিশির গায়ে আঠা দিয়ে সেঁটে দিতেন কিরি-কিরি করে কাটা কাগজ। মাত্রার নির্দেশ। এইরকম বলতেন, সকালে এক দাগ, রাতে এক দাগ। আর এই চোদ্দোটা পুরিয়া। এবেলা একটা। ও-বেলা একটা। পয়সার যা কিছু লেনদেন এই কম্পাউন্ডারের সঙ্গে। দ্বিতীয়বার আর যাওয়ার প্রয়োজন হত না। সেকালের রোগবালাই একালের মতো খ্যাঁচড়া ছিল না। কাশতে কাশতে কাশি একদিন সরে পড়ল, কাঁপতে কাঁপতে জ্বর একদিন ছেড়ে গেল। একটাই ঘিনঘিনে ব্যাধি ছিল—টিবি। ধরেছে কী মরেছে! প্রত্যেককেই বসন্তের টিকে নিতে হত। পক্স হবে না, হবে চিকেন পক্স। তার আবার মিষ্টি দিশি নাম—মায়ের দয়া। এই দয়া দিন পনেরো মশারি-বাস। কাছে কেউ আসবে না, দূর থেকে বাক্যালাপ। দুরন্ত সাহস ছিল মানুষের। মানসিক প্রস্তুতি ছিল। মায়ের দয়ায় একজন কাত হলে বাড়িসুদ্ধ সকলেরই হওয়ার সম্ভাবনা। তবে ছাড় আছে। আগেই যে দয়া পেয়েছে সে এই মায়ের দয়া দ্বিতীয়বার আর না-ও পেতে পারে।
চারিদিকে সব বড় বড় সংসার। ভাই-বোনেদের ছড়াছড়ি। ঝগড়া আছে, ভাব-ভালোবাসা আছে। প্রাচুর্য আছে, দারিদ্র আছে তবু সময়টা তখন এইভাবে ভেঙে পড়েনি। প্রচারমাধ্যম এতটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি। আর সকলেরই পায়ের তলায় মাটি ছিল। ভবিষ্যতে কী হবে ভেবে বর্তমানটাকে কেউ ম্যাসাকার করে ফেলত না। দুজন মানুষ এক জায়গায় হলে ফাটাফাটি হাসি শোনা যেত। বড়লোকরা অবশ্য চিরকালই গ্রুমি। ছড়ি হাতে বেড়াতে বেরোলে বোঝা যেত না, ছড়ি বেড়াচ্ছে, না বাবু বেড়াচ্ছে। দুটোই সমান স্টিফ। ওই সময়টায় জমিদারদের খুব দুর্দিন চলছিল। বাড়িও ফাটছে, সম্পর্কেও চিড় ধরেছে। মামলা-মকদ্দমা, পার্টিশান। পুজোর দালানে। দুর্গাপুজোর ঢাক বাজছে কেঁদে কেঁদে। ফরসা, ফরসা মহিলারা পূজাস্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঠিকই, তবে পা-ফেলার ভাষায় অনিশ্চয়তা। অ্যালসেশিয়ান কুকুর ছাড়া-কুকুর হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে মনে যেন আঘাত লাগে। বড়লোকরা গরিব হয়ে গেলে সহ্য করা যায় না। খুব দুঃখ হয়। আমাদের ঘুরঘুরে দলে সুন্দর চেহারার এক জমিদারপুত্র ছিল। বিশাল বাড়ি ভেঙে পড়ছে। বাবা, কাকারা মামলা লড়ছে। ছাদের গম্বুজে গোলা পায়রার ঝাঁক। চারিদিকে আগাছা। সুসময়ে। এই বাড়ির বিয়েতে জোড়া সানাই ভৈরবীতে তান তুলত। সন্ধ্যার পর ইমনে কাঁদত। দিস্তে দিস্তে বড়লোক চারপাশে থইথই। আমাদের এই বন্ধুর সুন্দরী বোনকে এক ঝলক দেখে আমাদের দলের এক বন্ধুর মেন্টাল-হসপিট্যাল-এ যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। পরপর কদিন ত্রিফলার জল খাইয়ে মেরামত করা হল। মাঝখান থেকে তার আর বিয়ে করাই হল না। যে মেয়েই দেখানো। হয়, বলে, ওর মতো নয়। সেই মেয়েটি হঠাৎ একদিন অদৃশ্য হয়ে গেল। খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন মনে হয়েছিল, কী আর এমন ব্যাপার! এখন এই বৃদ্ধ বয়সে আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে ভাবি, কোথায় সে গেল! এখন সে কোথায় আছে! ভালো আছে তো!
ক্ষতবিক্ষত
ক্ষতবিক্ষত অবস্থা। ছেড়ে কথা বলিনি। ওরাও যেমন ঝেড়েছে, আমরাও সঙ্গে সঙ্গে রিটার্ন ঝাড় দিয়েছি। ঢাকাই শাড়ি, ব্লাউজ পিস দিয়ে কর্তা-গিন্নি একটা সন্দেশের একটুখানি ঠুকরে রাজহাঁসের মতো প্যাঁক প্যাঁক করতে করতে বেরিয়ে গেল। বছরে এই একবার পুজোর আগে দেখা হয়। ক্রমশই যত বড়লোক হচ্ছে, ততই দূরে সরে যাচ্ছে। আগে চেহারা ছিল কঞ্চির মতো, এবারে দেখছি একজোড়া গ্যাসবেলুন। আগে খড়খড় করে হাঁটত এখন হাঁটে থেবড়ে থেবড়ে। একালের রাজনীতি একেবারে মা লক্ষ্মী। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে পারলেই প্রোমোটার। বাথরুমেও মোবাইল গান গাইছে, জিন্দেগি এক সফর।
সেদিন শ্মশানে। একজনকে চুল্লিতে ঢোকাচ্ছে। চাদরের তলায় হঠাৎ মোবাইলের জল-তরঙ্গ। এ কী রে? তাঁর স্ত্রী সাশ্রু নয়নে বললেন, সঙ্গে দিয়ে দিয়েছি। কোথায় যাচ্ছে কে জানে? সেখানে এসি-অ্যাটাচাড-বাথ ঘর পাবে কি না কে জানে। কানে তুলো ঢোকাবার সময় বলে দিয়েছি, হ্যাঁ গো! যেখানেই থাকো, এই মোবিল দিয়ে দিলুম, কনট্যাক্ট কোরো।
ঢাকাই মেরে বেরিয়ে গেছে, মারো জামদানি।
অনেক দাম।
বেচে দাও।
কী বেচব?
ফ্যান-ফোন-ফ্রিজ। যো কুছ হ্যায়। ইজ্জত কি সওয়াল!
বোম্বাইয়ের বাবু ছেলে-মেয়েদের বিদেশি মাল লড়িয়েছে। এরিকশন।
চলো ক্যামাক স্ট্রিট। কিনে আমি ডিকিনশন। ওর তো দুটো!
চারটে।
চারটে কী করে হয়! একটা যমজ হল যে!
এইভাবে বাড়লে আমি কী করতে পারি! ওর পেট্রলের টাকা। আমার যে কোরোসিন, হাতে হারিকেন। ঠিক হ্যায়, করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। ভেঙে ফেলো।
কী ভাঙব?
একটা ফিক্সড ভেঙে ফেলো।
সেই ভীতিপ্রদ মানুষটির আবির্ভাব। সদা উৎফুল্ল। সবসময় মুখে ঠোসা জর্দা-পান। কোনও কথাই বোঝার উপায় নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে কানেকশান। পয়সার মা-বাপ নেই। চারশো টাকার ইলিশ একাই খেয়ে ফেলে। হজমের দায়িত্ব নিজের ওপর না রেখে বিলিতি এজেন্সিকে দিয়ে রেখেছে। ডেলি এক বোতল।
গত বছর এক ডজন বাংলাদেশি পাঞ্জাবি দিয়েছিল। এক-একটার এক-একরকম ডিজাইন। ছাত্রজীবনে আমাকে সবাই বলত, খ্যাংরাকাঠির মাথায় আলুরদম। অভিজ্ঞ বন্ধু অ্যাডভাইস। দিলে, বিয়ে করে ফেল। বিয়ের জল পড়লেই মোটা হয়ে যাবি। চাকরি পেয়েই সাততাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেললুম। রোগা-বউ দেখতে দেখতে গুজরাতি হাতি হয়ে গেল, আমি রইলুম যে কে সেই।
ভায়রার দেওয়া পাঞ্জাবি পরে একদিন রাস্তায় বেরোনো মাত্রই রকের ছেলেদের আওয়াজ পাঞ্জাবির মাথায় আলুরদম। তাড়াতাড়ি পালিয়ে এসে বড় আয়নার সামনে দাঁড়ালুম। বেঠিক। কিছু বলেনি। ক্ষুদ্র মানুষ। ভুড়ি নেই। পাঞ্জাবির স্কুল এত বড় যে পায়ের পাতা দুটো দেখা যাচ্ছে খালি। যেন নাইটি পরেছি। ঘাড় তো নয় বকের গলা। তার ওপর তে-এঁটে মাথা ফিট করা। নাম রাখা যেতে পারে আশ্রয়দাতা পাঞ্জাবি।
সেই ভায়রা এলেন। আতঙ্কে আছি, এইবার ঝুলি থেকে কী বেরোয়! সেই পাঞ্জাবি! একটা পাঞ্জাবি আবার খামে ভরা। পেপার ঘোসার মতো পেপার-থিন পাঞ্জাবি। একটা শাড়ি বেরোল। শাড়িটার নাম চোষা।
মেরে গেল বেধড়ক মার। পালটা মার কী মারা যায়। স্বামী, স্ত্রী দুজনে বসে ভাবছি। তোমার বোন বিয়ে না করলে, এরকম বিপদে পড়তে হত না। বীভৎস ভায়রা ভাই।
তুমি বিয়ে করলে কেন?
মোটা হব বলে। সিলিং ফ্যানটা খুলে দিয়ে আসব, কিংবা ওয়াশিং মেশিনটা!
ও-সব ওদের অনেক আছে। এক-একটা ঘরে চারটে করে পাখা। তিনটে ওয়াশিং-মেশিন। তার মধ্যে একটা পবিত্র।
বাকি দুটো অপবিত্র!
পবিত্রটায় পুজো করার কাপড় কাচা হয়। বাকি দুটোর একটা মেল একটা ফিমেল।
ওয়াশিং মেশিন-এর মেল, ফিমেল!
একটায় ছেলেদের আর একটায় মেয়েদের জামাকাপড় কাচা হয়!
ভদ্রলোকের এইরকম বিকট টাকাপয়সা হল কী করে?
ব্যবসা করে। তোমার মতো পড়ে পড়ে নাক ডাকলে তোমার মতোই অবস্থা হবে। সারাটা জীবন নাকে কান্না।
তোমাকে দিয়ে দিলে কেমন হয়। পুজোর সময় শাড়ির পর শাড়ি, আর আমার মাথার চুল খাড়া। চক্ষুলজ্জায় আমাকে দু-একজন দেয় বটে, একটা পাজামা, একটু ফতুয়া পাঞ্জাবি। হাটের মাল।
পাড়ার প্যান্ডেলে গিয়ে মাকে জানালুম, মা! এর একটা বিহিত করো। অসুরের বদলে আমাকেই যে মেরে শেষ করে দিলে মা।
স্বপ্নে মা এলেন, বাবা নান্টু!
বলো মা।
আমাকে তো আসতে হবেই বাবা। আমি যে এখন করপোরেট। তুই একটা কাজ কর, সামনের বার, তোর বউকে শাড়ি দিলে, তুই তাকে একটা গামছা দিস। ভালো করে প্যাক করবি, ভেতরে একটা চিরকুটে লিখে দিবি, তোমার সিক্ত গাত্রে গামছার দিব্য-স্পর্শ অনুভব করে পুলকিত হও। ঘটেও গামছা, তোমাকেও গামছা।
গামছাটাই আমাদের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি। গামছাই আমাদের ধর্ম। পুরোহিত গামছাতেই চাল-কলা বাঁধেন। গায়েহলুদে গামছা। শ্রাদ্ধেও গামছা।
গামছার পোশাক বিদেশেও যাচ্ছে।
খাটে বসে খেলা
আমি এত বড় একজন বিশেষজ্ঞ হলাম কী করে, এ প্রশ্ন যদি কেউ করেন তাহলে বলব, আমার সাধনভূমি হল খাট আর উপকরণ হল গোটা চারেক বালিশ আর হাত চারেক তফাতে একটা টিভি। মাঠ নয়, ময়দান নয়, দুরূহ কোনও প্র্যাক্টিস সিডিউল নয়, স্রেফ আড় হয়ে শুয়ে শুয়ে দু চোখ খোলা রেখে, আমি ফুটবলার, ক্রিকেটার, টেনিস চ্যাম্পিয়ন। হকি, ব্যাডমিন্টন কোনও খেলাই আর আমার অনায়ত্ত নয়। এমনকী বিশ্বের সেরা জিমন্যাস্ট। অবশ্য জিমন্যাস্ট হবার জন্যে প্রতিদিন আমাকে কড়া একটা প্র্যাক্টিস শিডিউল অনুসরণ করতে হয়। পি টি ঊষা কি মহম্মদ আলির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এ আমাকে প্রাণের দায়ে করতে হয়। আমার ভাত ভিক্ষা। না করলে হাঁড়ি চড়বে না। আসলে আমি একজন জিমন্যাস্ট। আর যে কোনও একটা দিকে প্রতিভার উন্মেষ হলেই তার সব আয়ত্তে এসে যায় একে একে। যেমন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সায়েব সেতার-সরোদ এসরাজ মায় সব তারের যন্ত্র বাজাতে পারতেন, আবার গানও গাইতে পারতেন। প্রতিভা হল কর্পোরেশনের পাইপফাটা জলের মতো। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ভাসিয়ে মহাজাতি সদনের পাশ দিয়ে কলাবাগান বস্তি ভেদ করে ঠনঠনিয়ায় মায়ের পায়ে আছড়ে পড়ে।
আমি জিমন্যাস্ট হতে চাইনি। যেমন চোরেরা থানা অফিসারকে বলে হজৌর আমি চোর হতে চাইনি। যেমন মাতাল, স্ত্রী-র ঝাঁটা পেটা খেতে খেতে বলে, মাইরি বলছি আমি ছুঁতে চাইনি, সাধনটা জোর করে খাইয়ে দিলে। আমি যে রাজ্যের ভোটার, রেশনকার্ড হোল্ডার, মানুষ আর। বলব না, কারণ আমি, যাদের মানুষ বলে, অন্যান্য দেশে যাদের মানুষ বলা হয়, আমি সে দলে পড়ি না।
আমার রাজ্যে গত স্বাধীনতার পর থেকে, গত বলছি এই কারণে স্বাধীনতা মারা গেছে। এখন আমরা আর শৃঙ্খলমুক্ত নই শৃঙ্খলামুক্ত অর্থাৎ বিশৃঙ্খলা, তা সেই স্বাধীনতার পর থেকে এ রাজ্যে সর্বব্যাপক-অ্যাথলিট-তৈরি-প্রকল্প চালু কর