- বইয়ের নামঃ সঞ্জীবের সেরা ১০১
- লেখকের নামঃ সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ পত্র ভারতী (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অঙ্কই ভগবান
দু মাইলের মতো জঙ্গল। তারপর একটা মিষ্টি নদী। সুইট রিভার। তার ওপর বন্ধুর মতো একটা সেতু। সেতু পেরোলেই ছবির মতো সেই গ্রাম। কুতুবপুর। ইতিহাস। কুতুবুদ্দিন আইবক এই গ্রামের বটতলায় বসে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন আর যুদ্ধ নয়, এবার শান্তি। যুদ্ধ করবে বলবান গিয়াসুদ্দিন বলবন। মরুক বাঁচুক দেখার দরকার নেই আমার। মাথার টুপি খুলে বাতাসে উড়িয়ে দিল। অলৌকিক ব্যাপার! টুপিটা পায়রা হয়ে উড়ে গেল নীল আকাশে। সেই থেকে পায়রার নাম হল ‘কবুতর।’ সেই পায়রা দেড় মাইল দূরে যে গ্রামে গিয়ে বসল সেই গ্রামের নাম হল কবুতর গঞ্জ। যত ভালো ভালো পায়রা, বনেদি পায়রা একমাত্র ওই গ্রামে পাওয়া যায়। দেশ-বিদেশের শান্তি উৎসবে চালান যায়। অর্ডার আসে সেন্ড আস এ পেটি অফ শান্তির শ্বেত পারাবত। কুতুবুদ্দিন বিরাট একটা মসজিদ তৈরি করলেন জরির কাজ করা। নাম হল ঝিলমিল মসজিদ। সেখানে বসে বাকি জীবন শুধু গান লিখে নিজের সুরে গাইতে লাগলেন। সেই ধারার গানের নাম হল ‘কাওয়ালি’।
এমন একটা ঐতিহাসিক জায়গা অবশ্যই যাব। যাবই যাব। কেউ আটকাতে পারবে না। আমি আর শংকর রেডি। শঙ্কর শুধু সাহসী নয় দুঃসাহসী। ভূত ছাড়া কারওকে ভয় পায় না। টেরিফিক, ডেঞ্জারাস এই সব বিশেষণ ওর জন্যেই তৈরি হয়েছে। কুতুবপুরেই শঙ্করের মামার বাড়ি। বড়মামা একসময় শিকারি ছিলেন। বেজায় বড়লোক।
মাইল দুয়েক ঘুটঘুটে জঙ্গল। বাঘ আছে। থাকা উচিত। বাঘ না থাকলে জঙ্গলের ইজ্জত থাকে না। শঙ্কর বললে, কোনও ভয় নেই, আজ শুক্রবার, বাঘদের ফাস্টিং ডে।
‘কে বললে?’
‘ব্যাঘ্রপুরাণে আছে।’
হাঁটছি, হাঁটছি। বিউটিফুল লাগছে। দু-পাশে ছোলাখেত। কয়েক আঁটি ছিঁড়েছি। কাঁচা সবুজ। ছোলা। ফ্যান্টাসটিক। জঙ্গল শুরু হল। প্রথমে পাতলা। তারপর দু-পাশ থেকে চেপে এল। পথ বলে কিছু নেই। পাতা মাড়িয়ে মাড়িয়ে কচমচ করে হাঁটছি। দুঃসাহসী সব গাছ চারপাশে। রোদ পড়ে আছে বাইরে।
হঠাৎ! যাঃ পথ নেই। পাহাড়ের গুহা যেমন হয়, এ দেখি তেমন বিশাল ঝোপের গুহা। জঙ্গলের টানেল। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঢুকব কি ঢুকব না! বলের মতো বড় বড় দুটো লাল আলো পাশাপাশি। ধকধক করছে। ‘ওরে বাঘ রে!’
বাঘটা কীরকম একটা শব্দ করে বিশ্রীভাবে বেরিয়ে এল অসভ্যের মতো। পেছন ফিরে দে ছুট করতে গিয়ে অবাক। পেছনে একটা বাঘ। ডান পাশে একটা, বাঁ পাশে একটা। চারটে কেঁদো, ঘিরে ধরেছে।
প্রথম বাঘটা একটা থাবা বাড়াল। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়টা বুক কাঁপানো শব্দে প্রথমটার থাবাটা ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল। নিমেষে আমাদের দুজনকে নিয়ে চারটে বাঘের মধ্যে ঝটাপটি বেঁধে গেল–রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
আমরা পালিয়ে এলুম।
শঙ্কর বললে, ‘কীভাবে বাঁচলুম বল তো?
‘ভগবান!’
‘ধূত! অঙ্ক! ম্যাথেমেটিক্সের জোরে বাঁচলুম। চারটে বাঘ, দুটো মানুষ। চারটে বাঘ চারটে মানুষ হলে এতক্ষণে বাঘের পেটে। একটা বাঘ একটা মানুষ। ভাগের গোলমালে বেঁচে গেলুম রে। চারটে বাঘ দুটো মানুষ। চল, এবার অন্য পথে যাব। নদী পথে।’
অঞ্জলি
স্নান করে ঠাকুরঘরে ঢুকেই প্রভাত অবাক হয়ে গেল। গত পাঁচ বছরে এরকম ব্যতিক্রম তার কখনও চোখে পড়েনি। পুজোর সব আয়োজন ঠিক রয়েছে কিন্তু ফুল কোথায়? ফুলের থালা গঙ্গাজলের ঘটির ওপরে বসানো, কিন্তু থালা শূন্য। এক থালা ভর্তি লাল আর সাদা ফুল—সেই পরিচিত পবিত্র দৃশ্য আজ অনুপস্থিত! এই সময়টা তার খুব তাড়া থাকে। ৮টা পঞ্চান্নর ট্রেন ধরে তাকে কলকাতায় ছুটতে হবে। দশটায় অফিস। এক মিনিট এদিক-ওদিক হওয়ার উপায় নেই। অথচ অফিস বেরোবার আগে কুলদেবতার পুজো করতেই হবে। ঠাকুরঘর থেকে গলা বাড়িয়ে প্রভাত চিৎকার করতে লাগল—কল্যাণী, আমার পুজোর ফুল কই? কী যে করো বুঝি না। একে দেরি হয়ে যাচ্ছে! কল্যাণী আঁচলে রান্নার হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এল। কী হয়েছে কী, চেঁচাচ্ছ কেন? ফুল নেই?
থাকলে চেঁচাই, নেই বলেই তো চেঁচাচ্ছি।
সে কী, পুতুল সেই সাতসকালেই ফুল তুলতে গেল! এখন বাজে ক’টা?
ক’টা আর সাড়ে সাতটা হবে, রেডিয়োয় খবর হচ্ছে।
সে কী গো, মেয়ে তো সেই ছয়টায় বাগানে গেল ফুল তুলতে। কোনওদিন তো এত দেরি করে না! দাঁড়াও দেখছি কী হল!
দেখতে দেখতেই বাজিমাত। বিনা ফুলেই পুজো করি। প্রভাত খুঁতখুঁত করতে করতে পুজোর আসনে বসল। কল্যাণী তাড়াতাড়ি মেয়েকে খুঁজতে গেল। উনুনে ভাত ফুটছে। একটু পরেই প্রভাত খেতে বসবে। তার আবার সাত্বিক ব্যাপার। নিরামিষ ভাতে ভাত খাওয়াই তার অভ্যাস। কোনওদিন একটু ঘি থাকে, কোনওদিন থাকে না। খাওয়ার ব্যাপারে প্রভাতের কোনও দৃকপাত নেই। কিন্তু পুজোর আয়োজনে সামান্য ত্রুটিও তার সহ্য হয় না।
আজ দশ বছর কি তারও বেশি হবে, পনেরো বছরও হতে পারে, কল্যাণীর ঠিক মনে পড়ছে না
তাদের বিয়ে হয়েছে। সুখের সংসারই বলা চলে। কোনও ঝামেলা নেই, নিঝঞ্চাট। একটি মাত্র মেয়ে বারো-তেরো বছর বয়স। ফুটফুটে সুন্দর। প্রভাতের বিয়ে করার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। জোর করে ধরে তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় দু-ভাই সন্ন্যাসী। পরিবারে অন্তত এই ভাইও যদি বিয়ে না করে বংশরক্ষা হয় কী করে?