মনে ধরেছিল বলেই মনে আছে। নিজের দোষটা কেউ দেখতে পায় না। কত কত প্রেমের কথা বলতে ইচ্ছে করে, শুরু করলেই বলবে, চুপ চুপ বিয়ে হয়ে গেছে, অশান্তি কোরো না। শান্তিতে ঘুমোও।
জেনারেটার চালানো দেখেছ, মিনি জেনারেটার? একটা ফিতে থাকে। জড়িয়ে নিয়ে মারো টান, জেনারেটার স্টার্ট। ফিতে অপ্রয়োজনীয়, প্রেমপত্র দিয়ে সংসার-জেনারেটার স্টার্ট হয়ে গেছে, এখন আর লেত্তিটা দিয়ে কী হবে।
বাপ রে! কী বিরাট বিরাট জ্ঞানের কথা। আচ্ছা, এই নাও আটটা সেফটিপিন। মুখ খোলা অবস্থায় বাথরুমের বিভিন্ন জায়গা থেকে উদ্ধার করা। তিনটে চুলের ক্লিপ। এই নাও ব্যাঙ্কের চেক বই, খাটের তলায়। এই নাও তোমার ময়েশ্চারাইজারের ক্যাপ, টেবিলের তলায়। এই নাও চারটে ডট পেন। এই নাও তিনটে নেলকাটার, সাতটা উল বোনার কাঁটা। আর গত তিন বছর ধরে আমার। জন্যে যে সোয়েটারটা বোনার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলে, আপাতত যেটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মতো ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে পরিত্যক্ত, এই সেই সোয়েটার। উলের গোলা, কাঁটা এবং একটি তাল। আমাদের ভাটা-পড়া প্রেমের ফলিত রূপ! গলিত রূপ! প্রথম বছরে চড় চড় করে আধহাত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে মাত্র চার ইঞ্চি।
আজ্ঞে না, তোমার ব্যাখ্যা তোমার মতো। আসলে ওই সোয়েটারে ধরা আছে আমাদের পারিবারিক বিপর্যয়। দ্বিতীয় বছরে মা অসুস্থ হলেন। সারাটা বছর যমে-মানুষে টানাটানি। তৃতীয় বছরে মা বিদায় নিলেন। এটা চতুর্থ বছর। মা ছিলেন আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। তোমাকে বিয়ে করে। আমি কী পেয়েছি জানি না, তবে মায়ের মতো মা পেয়েছিলুম। ওই শূন্যতা কোনওদিনই আর ভরাট হবে না।
এই তো আসল কথাটি বলে ফেলেছ। টোপ না দিলে মাছ ধরা যায়! দেশলাই কাঠি না থাকলে প্রদীপ জ্বালা যায়! আমি না থাকলে মাকে পেতে বৎস! আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে! আমি হলুম তোমার বিচরণভূমি, শ্রীচরণের তলায় বুক পেতে পড়ে আছি।
ওটা কী হচ্ছে?
কোনটা?
সোফার নতুন কভারে হাত মুছছ কেন?
হাতে কিছু নেই। পরিষ্কার ধবধবে খটখটে।
আমি দেখেছি। চায়ের কাপটা সরালে। আঙুল চটচট করছিল, মুছলে!
তুমি কী বলতে চাইছ, এর ওপর হাত রাখা চলবে না?
অবশ্যই চলবে। তবে কোনও দুরভিসন্ধি থাকলে চলবে না। বাথরুমের ওপাশের জানলার পর্দায় দাড়ি কামাবার সাবানের ফেনা কে মুছেছে! নিশ্চয়ই আমি না।
ওটার ভালো দিন, অর্থনৈতিক দিকটা দেখতে পেলে না। ওখানে আমি সাবান স্টোর করছি। পরদাটা যখন কাচবে তখন আর সাবান মাখাতে হবে না, জলে ডোবাবে, তুলবে, শুকোতে দেবে। আচ্ছা! তুমি রান্না করতে করতে হাত কোথায় মোছ? নিজের শাড়িতে?
আজ্ঞে না। আমার একটা ন্যাপকিন আছে।
পরদাটা আমার ন্যাপকিন।
আর একদিন সাবান মুছে দ্যাখো। ভালো কথায় হবে না।
কী করবে?
যখন করব, তখনই দেখতে পাবে।
বললে সাবধান হব।
তোমার ওই লেসের কাজ করা সাদা পাঞ্জাবিতে মাংসের মশলা মাখিয়ে দোব।
আমিও তোমার চাঁপদানি শাড়িতে আলকাতরা লাগিয়ে দোব।
ওটা চাঁপদানি নয়, জামদানি। এদিকে এসো, ঘুরে দাঁড়াও, কাঁধের মাপ নেব।
যথেষ্ট চওড়া। তিন-তিনবার বাঁক কাঁধে নিয়ে তারকেশ্বর গেছি।
সেই কৃপাতেই আমাকে পেয়েছ।
তা ঠিক। মা চলে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, তুমিই আমার মা, সেই শাসন, সেই স্নেহ।
প্রমীলা এতক্ষণ যে সোয়েটার বুনছিল, সেই সোয়েটারটা কাঁধে ধরে মাপ নিতে নিতে বললে, পারফেক্ট!
প্রশান্ত বললে, এটা আমার জন্য করছ? উলটার কী সুন্দর রং! কী তোমার চয়েস মাইরি!
শীত এসে গেছে বাবা প্রশান্ত। তবে এই রং তোমার জন্য নয়। এই প্যাস্টেল শেড। লাইট কালার। একদিনেই বারোটার জায়গায় আঠারোটা বাজিয়ে দেবে!
হঠাৎ বৃষ্টিতে
আকাশ মেঘলাই ছিল। হঠাৎ দূরে ঝাপসা হয়ে বৃষ্টি এল। বৃষ্টি আসছে, ক্রমশই এগিয়ে আসছে হু হু করে। আমরা দুজনে ছুটতে ছুটতে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় আশ্রয় নিলাম প্রথমে। জানি ভীষণ জোরে বৃষ্টি এলে মাথা বাঁচবে না; কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। ফোর্টের পাশে এই ফাঁকা মাঠে আর কোনও আশ্রয় আছে! সামনে গেরুয়া গঙ্গা। একটা দুটো মাঝারি জাহাজ বৃষ্টিতে ভিজছে। দূরে পাকিস্তান থেকে ধরে আনা প্যাটনের লোহার চাদরের উপর চটাপট বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকোচ্ছে। দুপুরে সাধারণত এদিকে তোক খুব কমই আসে। গ্রীষ্মের দুপুরে কে আর শখ করে বেড়াতে আসে ফাঁকা মাঠে। আমরা দুজনে এসেছিলাম মেঘলা দেখে। মেঘ থমকানো দুপুরে ভরা গঙ্গা, জেটি আর জাহাজকে এক পাশে রেখে হাতে হাত ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে মেরিন হাউসের দিকে যেতে চেয়েছিলাম। একটা দুটো বাস, কি মোটর হুসহুস করে চলে যাচ্ছিল পাশ দিয়ে। এখন বৃষ্টি আমাদের আটকে দিয়েছে। দুটো পাখির মতো জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছি গাছতলায়। গায়ে গুড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। বেশ বুঝতে পারছি মাথার উপর পাতার আবরণ আর বেশিক্ষণ আমাদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। কল্পনা ইতিমধ্যে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়েছে। নীল শাড়ি জড়ানো তার বাইশ বছরের শরীর এখন আমার খুব কাছে। আমি তাকে কোমরের কাছে জড়িয়ে ধরে প্রায় বুকের পাশে টেনে এনেছি। মনে হচ্ছে অনেক দূরের একটা ছবি বৃষ্টির দূরবিনে খুব কাছে এসে গেছে সেই সেদিনের ছবি, যেদিন কল্পনা আমার বউ হবে।