সুধেন্দু মেয়েদের মধ্যেই থাকেন; কিন্তু নারীর দেহের প্রতি তাঁর আর কোনও আকর্ষণ নেই। উন্মোচিত নারী দেহ, ছবিতে সামান্য অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষায় দেহদানের ঘটনা দেখে ধারণা। হয়েছে, কাম একটা জড়বস্তু। ওতে চেতনা নেই। চৈতন্যময় জগৎটাই জগৎ, বাকিটা ছোবড়া, যেমন নারকোলের জল আর শাঁসটাই আসল।
সুধেন্দু অক্ষত থাকার জন্যে বিয়ে করেছিলেন। মেয়েটি ছিল সহজ, সরল, ধার্মিক, সংসারী। প্রেম, রোম্যান্স এসব বুঝত না। মাথাও ঘামাত না। সুধেন্দুকে আর সংসারটাকে সামলানোই ছিল তার প্রধান কাজ। আধুনিক খেলে সেকালের পুর। আদর্শই বড় ছিল। প্রবল ধর্মবোধ ছিল। হঠাৎ পরিচয়, হঠাৎ বিবাহ। পিতা ছিলেন সংস্কৃতে নামকরা পণ্ডিত। সারাজীবন স্বপাকে আহার করতেন আর মাঝেমধ্যেই কাশীতে চলে যেতেন মা-আনন্দময়ীর আশ্রমে। গোপীনাথ কবিরাজের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় দিন কাটত। এই কাশীতেই সুধেন্দুর পরিচয় ঘটেছিল পরিবারটির। সঙ্গে। সুধেন্দুকে ভাগ্যই নিয়ে এসেছিল কাশীতে। ন্যায়তীর্থমশাই সুধেন্দুকে পছন্দ করেছিলেন। সুধেন্দুর ভালো লেগেছিল সহজ, সরল, সুন্দর বৈশালীকে। নবনীতের মতো একটি শরীর, পৌরাণিক মন, তন্ত্রের লক্ষ্মণযুক্ত একটি শ্রীমণ্ডিত দেহছন্দ। কোমর পর্যন্ত ছাপিয়ে পড়া ঘন কালো চুল। আয়ত দুটি চোখ, দীর্ঘ আঁখিপল্লব। যে-প্রেম যক্ষিণীর মতো কলেজ সহপাঠী প্রত্যাখান করেছিল, সেই প্রেমই সুধেন্দু উজাড় করে দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। বিয়ের পর সুধেন্দুর ভাগ্য খুলে গিয়েছিল। একের পর এক সাফল্য। আনন্দময়ী মা দুজনকেই অযাচিত দীক্ষা দিয়েছিলেন। ভাগ্য, অর্থ, গাড়ি, বাড়ি, সবই হল। তারপর বাজল ঘণ্টা। যেতে নাহি দিব। তবু যেতে দিতে হয়। এক বৈশাখী পূর্ণিমায় বৈশালী চলে গেল। সেই বছরই হিট করল সুধেন্দুর সপ্তম ছবি। একদা নামকরা নায়িকা, তখন পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী এক যায় যায়-যৌবন মহিলা খুব চেষ্টা। করলেন শূন্যস্থান পূর্ণ করতে। সুধেন্দু পাত্তা দিলেন না; কারণ সুধেন্দু রাতে আসনে বসলেই বৈশালীকে দেখতে পেতেন। প্ল্যানচেটের প্রয়োজন হত না। দেহ হল কপূর, উবে যায়; কিন্তু বায়ুমণ্ডলে থাকে অণু-পরমাণু হয়ে। সেই স্তরে নিজেকে তুলতে পারলে পরলোকগতকে পাওয়া যায়।
৩.
গরম কফি এসেছে। তনুকাই নিয়ে এল। পোশাক পালটেছে। সাদা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। আরও সুন্দর দেখাচ্ছে। সুধেন্দু প্রশংসা করলেন, ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, আমার কোনও ছবিতে নামিয়ে দিই।
তনুকা কফিতে ছোট্ট চুমুক মেরে বললেন, আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল নিজের ভুলে।
নষ্ট মনে করলেই নষ্ট। আমি তো আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে এসেছি। বরং আমার ফিরতি পথটাই ভালো হল। ধাক্কা না খেলে বড় জোর ছাপোষা একটা কেরানি হতুম। যত না আয় তার চেয়ে বেশি ব্যয়। এখন দিব্যি আছি। এখন আমি বলতে পারি, এই দুনিয়া মজার কুটির, খাই দাই আর মজা লুটি। আপনিও তাই করুন, কোনও কিছুই কিছুনয়। রামপ্রসাদ বলেছিলেন, ভবে। আসা খেলতে পাশা। কিছু হল না, কিছু হল না, সবসময় এই ভাবলে বারুদ ভিজে যাবে। আমার মতো করুন। আমি রোজ ভোরে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বলি, যা হয়েছে বেশ হয়েছে, এর বেশি আর কী হবে!
আপনি সাহিত্যিক, আপনি পুরুষ। আমি মেয়ে। জনঅরণ্যে একা। নেকড়ের পাল পেছনে ঘুরছে।
অবশ্যই সেটা একটা সমস্যা। মানুষ এখন আরও পশু। নারী এখন আরও ভোগের সামগ্রী। এর জন্যে আমরা ছবিওলারা কম দায়ী নই। পর্দায় মেয়েদের খোলা শরীর দেখিয়ে যৌনতা আরও বাড়িয়ে তুলেছি।
যখন যেখানেই যাই, যার কাছেই যাই, সে এমন চোখে তাকায়, কয়েকদিনের মধ্যেই এমন প্রস্তাব দেয় ছিটকে সরে আসি। আমি একটা সেক্স অবজেক্ট, ভাবলেই হতাশা আসে। মনে হয়, কোন পৃথিবীতে বাস করছি! বেড়াল, কুকুরের পৃথিবী না কি!
সুধেন্দু ঘড়ি দেখলেন। পৃথিবীকে পালটানো যাবে না। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির দৌলতে মানুষ যত। বিত্তবান হবে, পরিশ্রম বিমুখ হবে, ভোগের ইন্দ্রিয় তত প্রবল হবে। মুখে বলি হরি, কাজে অন্য করি। পুলিশ রেপ করবে, ধর্মগুরু ব্যভিচার করবে। শিক্ষক ছাত্রীর দেহ সম্ভোগ করবে। প্রবল একটা ভাঙচুর না হলে পৃথিবী সুন্দর হবে না।
সুধেন্দু বললেন, এত সহজ জিনিস, এমন জটিল হচ্ছে কেন? ডিভোর্স দিচ্ছেন না কেন?
অনেক প্যাঁচ আছে। আমাকে ছাড়তে তার আপত্তি নেই; কিন্তু আমার বিষয়সম্পত্তি ছাড়া কি সহজ! সেই লোভেই ধরে রেখেছে আমাকে। কিছুতেই মুক্তি দিচ্ছে না। মেন্টাল টর্চার করে মেরে ফেলতে চাইছে। একদিন ছঘণ্টা আমাকে বাথরুমে আটকে রেখেছিল। কেলেঙ্কারির ভয়ে। চিৎকার-চেঁচামেচি করতে পারিনি। আর একদিন ঘুমের ওষুধ খাইয়ে সেন্সলেস করার চেষ্টা করেছিল। উদ্দেশ্যটা ছিল সেক্স, ভালগার সেক্স। আপনি বলুন, লোকটা একটা বর্ন ক্রিমিন্যাল কি না!
এমন একটা ক্যারেটার জীবনে এল কী করে!
প্রথমে তো বোঝা যায় না। আপনার উপন্যাসের মতো। ক্রমশ প্রকাশ্য।
সুধেন্দু জানে, মানুষ এক দুর্বোধ্য প্রাণী। কখন কে কী করে বসবে বলা যায় না। সাধুর ভেতর শয়তানের বাসা থাকতে পারে। প্রেমিকের আড়ালে থাকতে পারে খুনি। খুব মিঠে গলায় একটা ঘড়ি জানান দিল, রাত একটা। সুধেন্দু দিনের পৃথিবীর চেয়ে রাতের পৃথিবী বেশি পছন্দ করে। সর্বত্র রহস্য। পুণ্যও যেমন গভীর হয়, পাপও সেইরকম থকথকে।