এর পরে যে দৃশ্য এল, সেটাও কম ভয়ের নয়। সুধেন্দু হঠাৎ একটা বিন্দুতে পরিণত হলেন, উজ্জ্বল একটি আলোক বিন্দু। সরু একটা নলের মধ্যে দিয়ে চলেছেন, সেই নলের গা বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, যেমন খনিতে জল চুইয়ে পড়ে। বিন্দুটা কমে একটা বেলুনের মধ্যে ঢুকে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে তাকে গ্রাস করে নিল শ্লেষ্মার মতো একটা পদার্থ। আবত হয়ে বিন্দুটির উজ্জ্বলতা। কমে শ্বেত শুভ্র একটি মুক্তোয় পরিণত হল। সুধেন্দু দেখতে পেলেন সেটি একটি মানুষের মুখ। তার হাত-পা সবই আছে। ক্ষুদ্র একটি মনুষ্যকীট। কোথা থেকে কলকল শব্দে জল এসে বেলুনের মতো সেই থলেটিকে ভরে ফেলল, সঙ্গে সঙ্গে মনুষ্যকীটটি হেঁটমুণ্ডু, ঊর্ধ্বপদ অবস্থায়, সেই জলে ভাসতে লাগল। তার নাভিতে সংলগ্ন সরু সূক্ষ্ম একটি নালিকা, অনেকটা পদ্মের ডাঁটার মতো। ধ্যানস্থ সুধেন্দুর মনে হল, ভারহীন অবস্থায় সে টলটল করছে। যে গুহায় বসে আছে, সেটা জলে ভরে গেছে। কিন্তু কোনও শ্বাসকষ্ট হচ্ছে না। বেশ একটা আরাম বোধ হচ্ছে। বেশ একটা। নিরাপত্তার ভাব। সুধেন্দু ডেকে উঠলেন—মা। সঙ্গে সঙ্গে একটি চিত্র হল চোখের সামনে কারণ সলিলে শ্রীবিষ্ণু যোগনিদ্রায় শায়িত। তাঁর নাভিকমলে চতুর্মুখ ব্রহ্মার অবস্থান।
এর পরেই সুধেন্দুর মনে হল, সেই মনে হওয়াটা আরও অদ্ভুত, মোমবাতির মতো তার দেহটা গলে যাচ্ছে। সমস্ত দেহটাই ক্রমে গলে গলে, শুধু শিখাটা জ্বলতে লাগল ভাসমান অবস্থায়। দেহ নেই, কিন্তু চেতনা-দীপটি আছে। এইভাবে ক-দিন গেল কে জানে! চোখ মেলে তাকালেন। গুহার গোলমুখের বাইরে সাদা দুধের মতো থকথকে আলো। তারই একটু আভা ভেতরে আসছে। গুহায় তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি ডাকলেন, সাধুজি, সাধুজি আপনি কোথায়! কোনও উত্তর নেই। তাঁর নিজের মাথার চুল বড় হয়ে গেছে। একমুখ দাড়ি। বাইরে এলেন। চারপাশে বরফ আর বরফ। চাঁদের আলোয় ধবধবে সাদা। দূরে পাহাড়ের চূড়া ঝলসাচ্ছে।
সুধেন্দু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। বিরাট কত বিরাট হতে পারে তাঁর ধারণা ছিল না কোনও। সেই রাতে হয়েছিল। লোকালয়ের বাইরে এই তো সেই স্রষ্টার সৃষ্টিশালা। ক্ষুদ্রকে গড়িয়ে দিয়েছেন নীচে সমতলে। গড়ে উঠেছে লোকালয়। কিলিবিলি মানুষ। প্রেম, ভালোবাসা, হিংসা, ষড়যন্ত্র, হত্যা, জন্ম, মৃত্যু, রোগ-শোক, জরা-ব্যাধি।
গুহায় ঢুকতে গিয়ে দেখলেন বরফের ওপর সাধুর ত্রিশূলটি পড়ে আছে। মনই বলে দিল, সন্ন্যাসী, মহাত্মা আরও কোনও উচ্চলোকে চলে গেছেন। ত্রিশূলটা স্পর্শ করতে গিয়েও করতে পারলেন না। সেইখানেই পড়ে রইল। সুধেন্দু ফিরে এলেন অন্য মানুষ হয়ে। ছিলেন শ্যামবর্ণ হয়ে গেছেন ফরসা। চোখের জ্যোতি বেড়ে গেছে। কণ্ঠস্বর বদলে গেছে। শরীর শীতল হয়ে গেছে। ঘাম চলে গেছে। ভেতরটা আনন্দে ভরে গেছে।
বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়েদের মধ্যে একটা খাবলা-খাবলি হচ্ছিল। বউদের তাণ্ডব নৃত্য। পিতার বিষয়-সম্পত্তি কিছু কম ছিল না। সেকালের নামকরা আইনজীবী ছিলেন। ফৌজদারি বিভাগে। চুটিয়ে প্র্যাকটিস করেছেন, দু-হাতে রোজগার করেছেন। প্রভূত ভোগ করেছেন। ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করেছেন। তারা শিক্ষিত হয়েছে, মানুষ হয়নি। বড়বোন সিনেমার হিরোইন হয়েছিল। খুবই জনপ্রিয়; কিন্তু চরিত্রের আঁট ছিল না। জীবনে মদ ও পুরুষ দুটোই ছিল। বছরে বছরে সঙ্গী পালটে যেত। সবাই বড়লোকের বেহেড ছেলে। দিদি সব কটাকেই ছিবড়ে করত। এই বিপজ্জনক খেলায় শেষদানে হারতেই হয়। দিদির শেষটা ছিল প্যাথেটিক। বাঁচেওনি বেশিদিন।
বিষয়-সম্পত্তির জটিলতা থেকে সুধেন্দু বেরিয়ে এসেছিলেন এক কথায়। ইটের একটা খাঁচা। রুমালের টুকরোর মতো একখণ্ড জমি। মানুষের হিসেবে বিশাল একটু কিছু বিরাটের দৃষ্টিতে কিছুই না। সেই মামলার ফয়সালা আজও হয়নি। পিতার মঞ্জিল এখন রিসিভারের হাতে।
সুধেন্দু একটা ফিলম কোম্পানিতে চাকরি পেলেন। এক বড় ডিরেকটারের সহকারী। পরপর সাতখানা ছবি হিট। স্টোরি অন্যের কিন্তু স্ক্রিপ্ট সুধেন্দুর। নাম, চাহিদা, খ্যাতি তিনটেই বেড়ে গেল। সুধেন্দুর হাতে সোনা ফলে। ব্যর্থ প্রেমিকের হাতে প্রেমের গল্পই খোলে ভালো। সুধেন্দু কলেজজীবন থেকেই বিশাখাকে ভালোবাসতেন। পাগলের মতো প্রেম। তাকে সুখী করার জন্যে জীবন দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ঝড়, গ্রীষ্ম, বর্ষা কিছুই মানতেন না। পুলিশের গুলি চলছে, কারফু; সুধেন্দুবিল্বমঙ্গলের মতো। বিশাখার কাছে হাজির। বিশাখা একদিন স্পষ্ট মুখের ওপর বলেই দিলে, আই ডোন্ট লাভ ইউ, রেদার আই হেট ইউ। তোমাকে দেখলে আমার ইরিটেশান হয়, নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়। ক্লিয়ার অফ, ক্লিয়ার অফ।
সুধেন্দুর এখন ধারণা হয়েছে, মেয়েদের জোর করে ভালোবাসা যায় না, তারা যাকে ভালোবাসবে তাকেই ভালোবাসবে। অধিকাংশ মেয়েই যাকে বিয়ে করে তাকে ভালোবাসে না। প্রেমহীন একটা চুক্তির সংসার গড়ে ওঠে। ছেলেরা দেহ ছাড়া কিছুই পায় না। পাশাপাশি শুয়ে থেকেও টের পায় না, মাঝখানে অদৃশ্য পাশ বালিশের মতো আর একজন শুয়ে আছে। সে তার প্রেমিক। সে কোনও হতদরিদ্র ছেলে হতে পারে, ভয়ংকর এক মস্তান হতে পারে, একজন বয়েসে বড় গুণী মানুষ হতে পারে। মনের দখল কে নিয়ে রেখেছে বোঝা শক্ত। মেয়েরা অভিনয় করতে জানে। ফিলমে এসে সুধেন্দু সেটা আরও ভালো বুঝেছে। নায়িকা যত সহজে তৈরি করা যায় তত সহজে নায়ক তৈরি হয় না। ছেলেরা চিরকালই একটু মাথামোটা, দামড়া টাইপ। সূক্ষ্মবোধ, সূক্ষ্ম সেন্টিমেন্ট—এসবের বড়ই অভাব। খেলতে জানে না, খেলাতেও জানে না। মেয়েরা না কেঁদেও কাঁদতে পারে, না হেসেও হাসতে পারে, ভালো না বেসেও ভালোবাসতে পারে। অক্লেশে মনটাকে বের করে নিয়ে দেহটা দিয়ে দিতে পারে। ছেলেদের বেশিরভাগই শিবঠাকুরের ষাঁড়।