আত্মহননের ইচ্ছা মিলিয়ে গেল। মনুষ্যজন্ম এক মহাভাগ্য। এমন একটা শরীর, পরতে পরতে যার রহস্য। সেই ভয়ংকর, ভয়াবহ নির্জনতায়, বাতাসের হাহাকারে বসে সুধেন্দু নিজের শরীরের রহস্যে মজে গেলেন। শক্তিশালী ক্যামেরার লেন্সকে হার মানায় এমন দুটো চোখ। সূক্ষ্ম বেতার যন্ত্রের মতো দুটো কান। কয়েক কোটি স্পর্শকাতর স্নায়ু। বিন্দুর মতো একটি কীটের চলাফেরা। টের পায় এমন প্রাণবন্ত দেহত্বক। আঙুলের কী অদ্ভুত ছন্দ, কাজ করার কী করণকৌশল। দেহসন্ধির কী অসাধারণ কারিগরি! পাদুটো মোড়ে পেছন দিকে, হাত দুটো সামনে। সর্বোপরি মাথা। অতীত সেখানে স্মৃতি। বর্তমান সেখানে বিচার, ভবিষ্যৎ এক আশঙ্কা।
হিমালয়ের সেই হতাশ দিনে সুধেন্দু দেখা পেলেন তাঁর গুরুর। সন্ধ্যা নামছে। আর একটি অসহ্য শীতসন্ধ্যা। ভাবছেন, রাতটা কাটবে কী করে! অনাহারে দুর্বল শরীর। এমন সময় তিনি সামনে। এসে দাঁড়ালেন, সাক্ষাৎ মহাদেব। হাতে ত্রিশূল। বড় বড় চোখ, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। পিতার স্নেহে বললেন, আও বেটা।
দুজনে একটা গুহায় গিয়ে ঢুকলেন। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। তেমনি ঠান্ডা। সাধু আদেশ করলেন, বয়ঠো বেটা। সুধেন্দু আন্দাজে বসলেন। একটা কিছুর ওপর বসেছেন। স্পর্শে বুঝলেন, কম্বল। সাধু বললেন, চোখের আলো জ্বালাবার চেষ্টা করো। আমি অন্ধকারেও দেখতে পাই।
সুধেন্দু মনে মনে ভেবেছিলেন, আপনি মহাযোগী, মহাসাধক, আপনি তো দেখতে পাবেনই। আমার সে শক্তি কোথায়! আমি তো রাতের পাখি। অন্ধ।
সাধু বলেছিলেন, তোমার চিন্তা আমি পড়তে পেরেছি বেটা। আমি পারি। আগে পারতুম না, এখন পারি। আমি ভবিষ্যৎ দেখতে পাই। অন্ধকারে আগে আমিও দেখতে পেতুম না, এখন পারি। আমার চোখ দুটো পোলারাইজড হয়ে গেছে। সুধেন্দু অবাক হয়েছিলেন, সাধু শিক্ষিত। ইনফ্রা রেড, শর্ট ওয়েভ লেংথ, রাডার সবই জানেন। ফিজিক্সের লোক। সংসারে থাকলে বিজ্ঞানী হতেন। অনেক টাকা রোজগার করতেন। কার টানে সব ছেড়ে এই ভীষণ জায়গায়!
সাধু বলেছিলেন, বিজ্ঞানে ভগবানকে টের পেয়ে, তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে এখানে এসে বসে আছি। যতদিন যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে, আলাদা করে ভগবান বলে কিছু নেই। স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন। তিনি জলে, তিনি স্থলে, তিনি অন্তরীক্ষে তিনি সর্বঘটে। আমার ক্ষুদ্র আমিটাকে মারতে পারলেই সেই বৃহৎ আমির অনুভূতি আসবে।পাওয়ার হাউস থেকে। বিদ্যুৎ আসে, ঘরে ঘরে আলো জ্বলে, আমি যেদিন সেই পাওয়ার হাউস হব, সেদিন আমি নিজেই আলো জ্বালাব, কল চালাব, আমাকে স্পর্শ করলে মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবে। সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় ঘটাবার ইচ্ছাশক্তি আমার নিয়ন্ত্রণে আসবে। আমি মারতে পারব, আবার বাঁচাতেও পারব।
সুধেন্দু ঠিক বুঝতে পারেননি সেই সব কথা; কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে টের পেয়েছিলেন, শীত আর। করছে না, জিভে অপূর্ব একটা স্বাদ লেগেছে, খিদে আর নেই, মনে ভীষণ একটা সুখের ভাব। মৃত্যু বলে পৃথিবীতে একটা কিছু যে আছে, সেই বোধটাই চলে গেছে। গীতার সেই শ্লোকটি মনে ঘুরছে, যেখানে ভগবান বলছেন,
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ
নায়ং ভূত্বাভবিতা বান ভূয়ঃ
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।
এই আত্মা কখনও জন্মগ্রহণ করেন না বা মৃত্যুমুখে পতিত হন না। আত্মা অন্যান্য জাতবস্তুর মতো জন্মগ্রহণ করে অস্তিত্ব লাভ করেন না, কারণ সদরূপে আত্মা চিরবিদ্যমান। আত্মা। জন্মরহিত, নিত্য শাশ্বত এবং পুরানো, শরীরের নাশে আত্মার নাশ হয় না।
সেই মহাত্মার কাছে প্রায় তিন মাস ছিলেন সুধেন্দু। অসাধারণ, অলৌকিক সব অভিজ্ঞতা হয়েছিল। শরীরটা যে কিছুই নয়, সেই ধারণাও ধারণ করতে পেয়েছিলেন। কারণ সেই মহাসাধক কোনও কিছুই আহার করতেন না। সুধেন্দুকে সপ্তাহের একদিন একটি করে পাকা হরিতকি খেতে দিতেন। সুধেন্দুর ক্ষুধা-তৃষ্ণা এক সপ্তাহের মতো নিবৃত্ত হয়ে যেত। একাসনে দিনের পর দিন বসে থাকার অভ্যাস হয়ে গেল। সন্ন্যাসী প্রণব মন্ত্র জপ করতে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, মনকে এমনভাবে নিবিষ্ট করবে যে, সময়ের কোনও জ্ঞান তোমার থাকবে না। দিন আসবে, রাত আসবে, তুমি কিছুই টের পাবে না। তোমার শরীর, জীবকোষ সব পালটে যাবে। নতুন একটা শরীর, জপের শরীর তৈরি হবে। আনন্দের সাগরে পদ্মফুলের মতো ভাসতে থাকবে। শ্বাসপ্রশ্বাস আর নাক দিয়ে পড়বে না, সুষুম্নায় বইতে থাকবে। তোমার সমস্ত শরীর শিরশির করবে। স্বেদ, পুলক, হর্ষ, কম্প হবে। আকাশ-বাতাস জুড়ে শুনবে নাদধ্বনি। সমুদ্রের গর্জন, মেঘের শব্দ, বাতাসের শীকার, কাঁসর-ঘণ্টা, পিনাক, ডমরু সব একসঙ্গে বাজতে থাকবে। নাকে পাবে ব্রহ্মকমলের গন্ধ। শিব-দর্শন হবে। রুপোলি আলোয় চরাচর ভেসে যাবে। দিব্যায় দেবায় দিগম্বরায়।
পাঁচ মিনিট, দশমিনিট, পনেরো মিনিট এইভাবে সময় বাড়তে লাগল। সুধেন্দু ক্রমশ ত্রিকাল থেকে মহাকালের দিকে এগোতে লাগলেন। সেখানে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নেই। গতি নেই, কম্পন নেই, আন্দোলন নেই, উদয় নেই, অস্ত নেই। প্রথমে ভীষণ একটা ভয়—নির্জন বনপথে যেতে বালকের যে ভয়, সেইরকম একটা ভয়। মনে মনে চিৎকার করেছিলেন কোথায় আমার মধুসূদন দাদা! সঙ্গে সঙ্গে মনের চোখে ভেসে উঠল একটি রথ। সারথি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ, আসনে। স্বয়ং অর্জুন। ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ কানে এল, চাকার ঘর্ষণ। বলগার আন্দোলন। ভয়টা কেটে গেল।