অবশ্যই। আমার নাম সুধেন্দুমুখার্জি।
কোন সুধেন্দু? লেখক সুধেন্দু?
আমি নিজেকে লেখক মনে করি না অবশ্য। চেষ্টা করি।
বিনয় ভালো; তবে আপনি আমার প্রিয়দের অন্যতম। আমার নাম তনুকা। এয়ার ইন্ডিয়ায় চাকরি করি।
তনুকা? সুধেন্দু অবাক হলেন।
কেন, তনুকা নাম হতে পারে না?
খুব পারে। তনুকা আমারই এক চরিত্রের নাম। একটি লেখায় আমার পুত্রবধূর নাম তনুকা। তার সঙ্গে আমার সংঘর্ষ।
এই তনুকার সঙ্গে সংঘর্ষ আপনার পুত্রের। আপনার পুত্রের কী নাম?
সীতেশ।
প্রায় মিলেছিল। এই শয়তানটার নাম সীতেন।
সীতেন? তা শয়তান কেন?
সে এক বড় গল্প। এই ফ্ল্যাটে আমার উকিল থাকেন। ডিভোর্সের মামলা চলছে। জোর ফাইট। উকিলের কাছে এসেই দেরিটা হল।
আজকাল ডিভোর্স খুব হচ্ছে। কোনওভাবে মিটমাট করা যায় না?
অসম্ভব। হি ইজ এ স্কাউন্ড্রেল। আমাকে তাহলে জিমনাসিয়ামে ভরতি হতে হবে। মারলেই মারব।
থাক দরকার নেই। আবার তাহলে বিবাহ করতে হবে।
আবার বিয়ে; কোনও পুরুষকে আমার বিশ্বাস নেই। টৌয়াইস চিটেড।
চক্রবেড়িয়ার মুখে গাড়ি এসে গেল। তনুকা বললেন, আমাকে এইখানেই নামিয়ে দিন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
এই মুখ থেকে আপনার বাড়ি কত দূর?
একটুখানি।
এখানে নামলে অসুবিধে হবে না তো? বলেন তো সামনেই নামিয়ে দিয়ে আসি।
এই প্রথম মহিলা প্রাণ খুলে হাসলেন। সুধেন্দু বহুকাল মেয়েদের জলতরঙ্গ হাসি শোনেননি। বয়েস তো তাঁর এমন কিছু হয়নি। সবে ষাট। বিলেতে এই বয়সের মানুষ বিয়ের কথাও ভাবে। তনুকা হাসি থামিয়ে বললেন, বেশ ভালো লাগল আপনাকে। এক রাতের পরিচয় এক রাতেই হারিয়ে যাবে?
তা কেন? সুধেন্দু বেশ উৎসাহী হলেন, আমার ভীষণ ভালো লাগল আপনাকে। বহুকাল পরে যেন হৃদয়ের শব্দ শুনতে পেলুম। বড় একা মানুষ তো আমি। কলম থেকে যে-সব চরিত্র নামে কিছুকাল তারাই আমাকে সঙ্গ দেয়। একসময় তারাও অদৃশ্য হয়ে যায় দুই মলাটের আড়ালে। তখন এই রাত আসে, দিন আসে, দুর্ভাবনা পায়চারি করে মনের বারান্দায়। অতীত এসে কাঁদে বিধবা রমণীর মতো।
বাঃ, কী সুন্দর বললেন। আপনার কেউ নেই?
দশ বছর আগে স্ত্রী মারা গেছেন ক্যানসারে। একটি মাত্র ছেলে। ওয়ান চাইল্ড সিন। ইঞ্জিনিয়ার। বিয়ে করে বউ নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে পালিয়েছে। আমি এখন একা।
Alone, alone, all all alone
Alone on a wide, wide sea!
And never a soul took pity on
My soul in agony?
সুধেন্দু একসময় ভালো আবৃত্তি করতেন। ইংরেজি নাটক করতেন। অর্সন ওয়েলস তাঁর মন্ত্রগুরু। গলাটা ভরাট। স্কটিশের সেই পাঁচের দশক যেন ফিরে এল।
তনুকা বললেন, আমিও একা। আপনি আমার বন্ধু হবেন?
বন্ধুত্ব শেষ পর্যন্ত টিকবে তো?
কোনও কিছুর শেষ ভাববেন না। ধরে রাখুন, এন্ড ইজ অলওয়েজ বিটার। শুরুটা হোক না।
কিন্তু!
হ্যাঁ অজস্র কিন্তু আছে এর ভেতর। অনেক কথা, অনেক বাদ-অপবাদ।
আই ডোন্ট কেয়ার। সুধেন্দু সাহসী হলেন, বেশ, তবে তাই হোক।
এবং আজই। আমার বাড়িতে চলুন, সামান্য কিছু খেয়ে, এককাপ কফি নিয়ে ফিরবেন। আপনার বাড়ি তো খুব কাছেই।
আপনার বাড়ির লোক?
আবার কিন্তু! নিন গাড়ি ঢোকান।
নির্জন রাস্তা। চাঁদের আলো যেন হরতালের কলকাতায় ক্রিকেট খেলছে। অল্প শীত। বেশি
শীতেও মেয়েদের শীত করে না। সরু একটা সিঁড়ি দিয়ে সুধেন্দু তনুকার পেছন পেছন দোতলায় উঠছেন। তনুকা দরজায় খটখট করতেই, দরজা খুলে সামনে দাঁড়ালেন এক প্রৌঢ়া। গায়ে গাঢ় রঙের আলোয়ান। বেশ একটা বড় হলঘরের মতো। মাঝখানে ছোট্ট একটা ঝাড়লণ্ঠন। উত্তরের কোনও একটা ফাঁক দিয়ে পৌষের বাতাস আসছে। ঝড়ে মৃদু একটা টিংলিং শব্দ। ঝকঝকে। খাবার টেবিল। অসম্ভব পরিচ্ছন্ন মায়াবি এক পরিবেশ। সোফায় একটা লোমওলা সাদা বেড়াল মহা আরামে ঘুমোচ্ছে।
তনুকা বললেন, আসুন। ভয় পাচ্ছেন কেন? আমার এই দুজন আর কেউ নেই।
সুধেন্দু ভেতরে ঢুকলেন। দরজাটা পেছনে ক্লক করে বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো আমলের একটা ঘড়ি কোথাও বাজাচ্ছে—এক, দুই, তিন…
২.
চিরটাকালই সুধেন্দু দেখে আসছেন তাঁর সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। আলো, অন্ধকার, মানুষের মুখ, গন্ধ, মেয়েদের মাথার চুল, শরীরের গঠন, ফার্নিচার সাজাবার ধরন, ঘরের বাতাস তাঁকে অনেক অপ্রকাশিত খবর দিতে পারে। যা নেই, যা ছিল, যা আসবে, তিনি যেন জানতে পারেন। পরে অবাক হয়ে দেখেছেন, মিলে গেছে। এই শক্তিটা তিনি অর্জন করেছেন। এক মহাপুরুষ অযাচিতভাবে দান করে গেছেন। জীবনের প্রথম পর্বে টগবগে যৌবনে প্রচণ্ড এক মানসিক বিপর্যয়ে আত্মহত্যার মুখোমুখি হয়ে সুধেন্দু ছিটকে চলে গিয়েছিলেন হিমালয়ে দুটি আকাঙ্ক্ষা নিয়ে—হয় ঈশ্বর না হয় আত্মহত্যা। পাহাড় আর বরফের নির্জনতায় মরে পড়ে থাকলে কেউ খুঁজে পাবে না কোনওদিন। কেউ বলতে পারবে না, কাপুরুষটা আত্মহত্যা করেছে। একটা রহস্যে আবৃত থেকে যাবে সুধেন্দুর অন্তর্ধান রহস্য। সাতটা দিন উদভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালেন তিনি। বিরাট পর্বত, হিমবাহ, ঝরনা, নদী, হাড়কাঁপানো শীত, প্রবল বাতাস, অভ্রনীল আকাশ, বারে বারে স্মরণ করিয়ে দিতে লাগল, সুধেন্দু! ঈশ্বরের কোনও রূপ নেই, তিনি অরূপ। বিরাটেই তাঁর অবস্থান। তিনি ক্ষুদ্রাদপি ক্ষুদ্র আবার বৃহতের চেয়ে বৃহৎ।