ডাকাতি হবে?
হোক। অ্যাকশান দিয়ে শুরু হোক।
মধু থাকবে, না কিডন্যাপড হবে?
ইয়েস, দ্যাটস দি পয়েন্ট। কিডন্যাপড হওয়া মানেই, রং্যানসাম আদায়ের জন্যে চিঠি। সেই জেমস হ্যাডলি চেজ মার্কা অ্যামেরিকান থ্রিলার। থ্রিলার আমরা পারি না সুধেন্দুদা। আমাদের। হাতে খোলে না। অকারণে হাতড়ে বেড়াবেন। কল্পনা ছুটবে বাঁধা পরিচিত রাস্তায়—পাড়ার গুন্ডা, সমাজবিরোধী, স্মাগলার, খুন, রেপ আপাতত নিরীহ মানুষের গোপন অপরাধ জীবন। এর বাইরে কিছুতেই আপনি বেরোতে পারবেন না। সুধেন্দুদা অন্যভাবে এগোন। মধুর চরিত্রটাই বাদ দিয়ে দিন।
বুঝেছি। আবার নতুন করে লেখার চেষ্টা করে দেখি। ধরতে পারি কি না! আচ্ছা আজ আমি তাহলে আসি।
সুধেন্দুমুখার্জি লিফটে করে নীচে নামবেন। করিডরে দাঁড়িয়ে আছেন। একেবারে ফাঁকা। রাত তো কম হল না। ফিলমের লোকেদের মাঝরাতেই দিন শুরু হয়। মনীশের এটা সন্ধে। সুধেন্দু করিডরের ঘোলাটে আলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। লিফটের ইন্ডিকেটার প্যানেলে লাল। আলোর অক্ষর ভীষণ জ্বলজ্বলে। জ্বলছে, নিবছে। লিফট উঠছে। সুধেন্দুর সামনে এসে হুস করে দরজাটা খুলে গেল। দুধের মতো আলোয় ভেতরটা ভাসছে। কেউ নেই। কেউই উঠে এল নানীচ থেকে ওপরে। ভেতরটা নীল। সুধেন্দু এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন। এক ধরনের অস্বস্তি। একটা। ভয়। এ যেন এক জগৎ থেকে আর এক জগতে প্রবেশ। সুধেন্দুক করে ঢুকে বোতাম টিপলেন। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ। লিফট নামছে। দশ, আট, সাত। পাঁচে একবার থামল। দরজা খোলা মাত্রই এক সুন্দরী আধুনিকা ঢুকলেন। সুগন্ধে লিফট ভরে গেল। সুধেন্দু একপাশে জড়সড়ো। লিফটের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। মহিলার চপ্পল নজরে আসছে। খুবই দামি পাদুকা। দামি সিল্ক। দামি জীবনের যাবতীয় আভরণ। মনে পড়ে গেল নিজের পুত্রবধূর কথা। অনেকটা এইরকমই। সুধেন্দু এইবার মহিলার মুখের দিকে। তাকালেন। সামান্য মিল যে নেই তা নয়। তবে সব আধুনিকা মোটামুটি একই রকম দেখতে। প্লাক করা ভুরু। খাটো করে ছাঁটা চুল। সংক্ষিপ্ত ব্লাউজ। পেঁচিয়ে পরা সিল্কের শাড়ি। ঠোঁটে রং। তফাত বিশেষ নেই।
লিফটের দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে গায়ে এসে লাগল মধ্য শীতের এক ঝলক শীতল বাতাস। একসময় সুধেন্দুর অনেক চুল ছিল। সেই স্টকেই চলছে। পাতলা হয়ে এলেও টাক পড়েনি। স্যাইড ব্যাগ থেকে একটা হিমাচলী টুপি বের করে মাথায় চাপালেন। বয়েস হয়েছে। ঠান্ডাটা ঝপ করে মাথাতেই লাগবে। সুধেন্দু শৌখিন মানুষ। জীবনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়েই বেঁচে আছেন; কিন্তু জীবনবোধ হারাননি।
সুধেন্দুর পুরোনো আমলের একটা ছোট্ট গাড়ি আছে। বেশ শক্ত-সমর্থ। সুধেন্দুর মতোই ঘাতসহ লাজুক। নিজেই ড্রাইভ করেন। মনোহরপুকুরে পৈতৃক আমলের বাড়িটি একটা মস্ত ভরসা। নীচেটা ভাড়া দিয়েছেন। দোতলাটা তাঁর। দরজা খুলে আসনে বসলেন। বাঁ পাশে কাত হয়ে জানলার কাচটা নামিয়ে দিলেন। ঘড়ি দেখলেন, প্রায় এগারোটা। স্টার্ট দিতে গিয়ে ক্ষণকালের জন্যে থামলেন। একটা প্রশ্নের উত্তর পেলেন—সুধেন্দুই তো ত্রিদিবেশ। পাঁচ বছর আগে জীবনে একটা ক্রাইসিস এসেছিল। আত্মহননের কথাও ভেবেছিলেন। শেষে নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছিলেন। হেরে যাব না। সাহায্য করেছিলেন বিজয়লক্ষ্মী। একটি দক্ষিণ ভারতীয় মেয়ে। মহিলা বলাই ভালো। একটা নাচের স্কুল চালান দক্ষিণ কলকাতায়। মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্যের মতোই দেহ-সৌষ্ঠব।
সুধেন্দুস্টার্ট দিল। হেডলাইট জ্বালালেন। সেই আলোয় দেখলেন লিফটের মহিলাটি কিছুদূরে তরতর করে হেঁটে চলেছেন। আশ্চর্য হলেন। এত রাত। গাড়ি নেই। একা কোথায় চলেছেন। পুত্রবধূ হেনার মতোই দেখতে পেছন থেকে। ছেলে প্রসূন আর হেনা এখন ব্যাঙ্গালোরে। বেশ ওয়েল টু-ডু। একটা ফর্মাল সম্পর্ক বজায় আছে এই মাত্র। কোনও ফর্মে ফাদারস নেম লিখতে হলে, প্রসূন সুধেন্দুই লিখবে; কারণ কোনও বিকল্প নেই।
গাড়িটা ধীরগতিতে এগোল। মহিলাকে পাশ কাটিয়ে এগোতে গিয়েও পারলেন না, সুধেন্দু থেমে পড়লেন। টিউন করা গাড়ি। ইঞ্জিন যেন নিশ্বাস ফেলছে। গাড়িটাকে পথ করে দিতে মহিলা এক পাশে থেমে পড়েছিলেন। সুধেন্দুবাঁদিকে প্রায় শুয়ে পড়ে বাঁ-পাশের জানলার কাছে মুখ এনে জিগ্যেস করলেন, আপনি যাবেন কোথায়?
মহিলা একটু ইতস্তত করে বললেন, চক্রবেড়িয়া।
কীভাবে যাবেন?
যা হয় একটা কিছু পেয়ে যাব।
আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে উঠে আসতে পারেন। আমি ওই দিকেই যাব।
আমি যে আপনাকে বিপদে ফেলব না কেমন করে বুঝলেন?
আপনারও বিপদ আমারও বিপদ। বিপদে বাঘে-মানুষে বন্ধুত্ব হয়। উঠে আসুন।
সুধেন্দুদরজা খুলে দিলেন। মহিলা সামনের আসনেই সুধেন্দুর পাশে বেশ সহজভাবেই বসলেন। একালের মেয়েরা বেশ স্মার্ট। সুধেন্দুফুরফুর করে গাড়ি চালাচ্ছেন। শুক্লপক্ষ। চাঁদের আলোয় চরাচর আচ্ছন্ন। পাতলা চাদরের মতো কুয়াশার আঁচল নামছে। বহুকাল পরে বেশ। রোমান্টিক লাগছে নিজেকে। কিছুই না, কলকাতা যেমন ছিল তেমনি আছে। শুধু মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে। একটু বিদেশি গন্ধ। সিল্কের আঁচল। ফুরফুরে চুল। উন্মুক্ত বাহু। এইসব আর কি। সুধেন্দু বেশ ভাবেই ছিলেন। মহিলা হঠাৎ বললেন, আমরা তো পরিচিত হতে পারি?