সেখানে তো ডাকাতি, মারধোর এইসব ছিল না। ওখানে একটা প্রেমও থাকতে পারে।
আমিও একটা টিন-এজ লাভস্টোরি ঢোকাতে চেয়েছিলুম। আজকাল কিশোর-কিশোরী প্রেম খুব হিট করছে। কিন্তু ভাই ডাকাতিটাই সব বারোটা বাজিয়ে দিলে।
বিমল করের বালিকা বধূ, খড়কুটোর পর ওই চেষ্টাটা না করলেই পারতেন।
আমি একটু অন্য ধান্দায় ছিলুম। প্রেমহীন-আত্মকেন্দ্রিক পরিবারের ছেলেমেয়েরা কত অসহায়, ইমোশন তাদের কীভাবে শিকার করে এইটা আমি দেখাতে চেয়েছিলুম। পারলুম না, ফেল। করলুম। মেয়েটাই বেরিয়ে চলে গেল হাত ফসকে। ডাকাতিটাই হয়ে উঠল কাহিনির নিয়তি।
ডাকাতিটা নিয়তি নয়, নিয়তি হল মধু অপহরণ। ডাকাতি হল, মাল-মশলা নিয়ে পালাল, মিটে গেল মামলা। আপনার অবচেতনে থ্রিলারের একটা থিম ছিল; কিন্তু আপনি জানেন না বাঙালির হাতে থ্রিলার জমে না। ডাকাতির কারণ খুঁজতে গিয়ে একেবারে লেজে-গোবরে হয়ে গেলেন। কল্পনা কাজ করল না।
তুমি পাকা লোক। ধরেছ ঠিক। একসঙ্গে অনেক সাম্প্রতিক ঘটনা আমাকে তালগোল পাকিয়ে
দিয়েছে। ব্যারাকপুর, বেহালা, মেহতা মার্ডার। মানুষ একালে হঠাৎ বড়লোক হয় কী করে! আমার তো ঠিক জানা নেই। শোনা আছে, কালো টাকা, স্মাগলিং, ড্রাগস এইসব। সব একসঙ্গে এসে গেল। ভয়ংকর একটা রহস্য-কাহিনি তৈরি করার বাসনা হল।
কোথা থেকে কোথায় চলে গেলেন। একবারও ভাবলেন না, এ দেশ থেকে সোনা বিদেশে যেতে পারে না। এ-দেশ সোনার দেশ নয়। গোল্ড বিস্কিট বিদেশ থেকে এ-দেশে আসে। গল্পের গরুকে গাছে ওঠালে হয়? সোনা যাচ্ছে মিউজিয়ামের আর্ট অবজেক্টের কেসে। সে-কেস আবার কাস্টমস চেকিং হয় না। এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি। এইবার সোনার বদলে ড্রাগস আসছে। কী। করে আসছে? কীভাবে আসছে? কার কাছে আসছে? ব্যাপারটাকে আপনি এত সহজ করে নিয়েছেন যে ছেলেমানুষির পর্যায়ে চলে গেছে। এই পয়েন্ট থেকেই আপনার স্টোরি ঝলঝলে, খলখলে। তার ওপর দুটো গ্যাং ঢুকিয়েছেন যার একটার নাম ব্ল্যাক-প্যান্থার। সুধেন্দুদা, কোথায় আছেন আপনি ভুলে গেছেন। এটা পশ্চিমবাংলা! তা ছাড়া সেই পুরোনো আমলের ডিটেকটিভ স্টোরি-রাইটারদের আদলে আপনি পুলিশকে ফানি করে তুলেছেন। পুলিশ এলেই আপনাদের রসিকতা করতে ইচ্ছে করে। তাঁরা খিকখিক করে হাসেন। অকারণে মানুষকে হ্যারাস করেন। জ্যান্ত পুলিশ দেখেছেন আপনি?
দূর থেকে।
পড়েছেন?
হ্যাঁ। হেমেন্দ্রকুমার, নীহাররঞ্জন, শশধরবাবু।
তাঁরা এখনও আপনার ঘাড়ে চেপে আছেন। সব কাহিনির একজন হিরো-হিরোইন থাকে। আপনার হিরো কে?
সমস্যায় ফেললে। কে যে হিরো!
আমি স্টোরিটাকে যখন সেলুলয়েডে নিয়ে যাব, আমার হিরো কে হবে? বিমান?
বিমানের হিরো হওয়ার একটা চান্স আছে। মনে হচ্ছে সে-ই কন্ট্রোল করবে স্টোরির পরের পার্ট।
তাকে তো আপনি একটা স্পাইয়ের মতো খাড়া করেছেন। তার জীবন ও জীবিকা অস্পষ্ট। বিমান কে? সে ছাত্র? সে বেকার? তার বয়েস কত? বাড়ি কোথায়? তার কে আছে! সবই
ঘোলাটে।
ইনফ্যাক্ট আমিও জানি না।
আপনার চরিত্র, আপনি জানেন না?
না জানালে কী করে জানব। একালের স্টোরির তো কোনও প্ল্যান থাকে না। এ তো প্রি-প্ল্যান্ড মাল্টি-স্টোরিড বিল্ডিং নয়। যতদূর মনে হয় বিমান ড্রপআউট। ফ্যামিলির অবস্থা খুব একটা। খারাপ নয়।
বিমানের সঙ্গে মধুর আলাপ হল কী করে?
হয়ে গেল। যেভাবে হয়।
বাঃ, কোনও অগ্রপশ্চাৎ নেই! ফ্রি স্টাইল রেস্টলিং-এর মতো। হিরোইন কে?
ধরো মধু।
মধুর বয়স কত?
ধরো চোদ্দো-পনেরো।
চোদ্দো-পনেরোর প্রেমে আমি কী দেখাব? নাচ-গান?
ও-কথা বোলো না। চতুর্দশীর প্রেমের আবেগ জানো? ওইটাই তো ভুল করার বয়স। ভেসে যাবার বয়েস। তুমি বোঝো না কেন, মধু তো একটা প্রবলেম চাইল্ড।
মধুর বয়েস আপনি জানেন না!
সে কী?
হ্যাঁ। স্বপ্ন দৃশ্যে মধুকে খাটের তলায় ঢুকিয়েছেন। সেখানে বহুক্ষণ সে থেকেছে। ছবি এঁকেছে।
ওটা স্বপ্ন নয়, হ্যালুসিনেশান।
আধুনিক খাটের হাইট সম্বন্ধে আপনার কোনও ধারণা আছে? তার তলায় চোদ্দো বছরের বাড়ন্ত একটা মেয়ে ঢুকতেই পারে না। ঢুকলেও সর্বক্ষণ তাকে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতে হবে।
কল্পনায় সবই হয়।
মনীশ হা হা করে হেসে উঠলেন। আর একটা সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, কোনও একটা জায়গায় কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিলন প্রয়োজন। ফাউন্ডেশান ছাড়া বাড়ি দাঁড়ায়? শুয়ে পড়ে।
তুমি খাটের তলায় ঢোকাটাকে এত ইমপর্টেন্স দিচ্ছ কেন?
নিশ্চয় দেব। স্টোরির প্রতিটি ইঞ্চ মূল্যবান। তাৎপর্যপূর্ণ। মধুকে যদি প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন বিমানের কোনও অস্তিত্ব থাকে না। বিমান না থাকলে, হিরো কে? দুটো তো ভিলেন তৈরি করে ফেলেছেন, সীতেশ আর ভাস্কর।
আচ্ছা ত্রিদিবেশকে হিরো করলে কেমন হয়?
খুব খারাপ হয়। ত্রিদিবেশকে আপনি বাংলা আর্ট ফিলমের টিপিক্যাল বুড়োর আদলে। ফেঁদেছেন। আত্মহত্যা করার জন্যে কামপোজ না কী যেন কিনতে ছুটছেন। ওই চরিত্রের সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু ছাড়া আর কোনও ভ্যালু নেই।
তাহলে এখন যাই কোথায়! আমার এতদিনের পরিশ্রম, ভাবনা সব জলে যাবে?
আমি সুধেন্দুদা আপনার কাছে টাইট, মিষ্টি একটা কাহিনি চেয়েছিলাম উপবাসী বাঙালি দর্শকদের চেয়ারের সঙ্গে একেবারে সেঁটে রাখার জন্যে। এ আপনি কী করলেন! থিমটা ভালোই ছিল। ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে পারলেন না। ফার্স্ট দুটো চ্যাপ্টার রেখে বাকিটা জলে ফেলে দিন।