আমার ডানপাশে ধপাস করে কে একজন এসে বসলেন। বসার ওজন বুঝে মনে হচ্ছে মিস্টার ইন্ডিয়ার কেউ হবেন টবেন। মোষের মতো নিশ্বাস পড়ছে। মহিষাসুরও হতে পারে। মা দুর্গার কাঁচা ফসকে পালিয়ে এসেছে। আমার একটা হাত ও-দিকের হাতলে আলগা ফেলা ছিল। তিনি প্রথমেই কী করলেন, আমার হাতটাকে এক ঠেলায় আমার কোলে ফেলে দিয়ে নিজের ঘেমো দুম্বো হাতটা হাতল জুড়ে রাখলেন। প্রথমে আমি কিছু মনে করিনি। যাক গে, বাঁ দিককার হাতলটা তো আমার দখলে আছে। সেই যথেষ্ট।
বই চলছে। সেই কুকুরওলা গাড়িটা বিশাল একটা বাগানবাড়িতে ঢুকছে। ঢুকুক। বাড়িটা একেবারে শহরের বাইরে। ভীষণ নির্জন। আমার নিজেরই বুকটা কেমন করছে। ভয় ভয় লাগছে। হঠাৎ মনে হল, ভদ্রলোক কোন অধিকারে আমার হাতটা ফেলে দিলেন ওইভাবে। আমিও পাঁচ পঁচানব্বইয়ের টিকিট কিনেছি, উনিও কিনেছেন। হাতলে দুজনের অধিকার সমান। সমান। মামার বাড়ি না কি! যেই মনে হওয়া, গোঁত্তা মেরে ওই লোমওলা ঘেমো হাতটাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে আমার অধিকার কায়েম করলুম। মনে মনে বললুম, অসভ্যতার একটা সীমা আছে।
মিনিট দুই আমার হাতটা থাকার সুযোগ পেল তারপই সেই লোমশ হাত আচমকা আমার হাতটাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে হাতল দখল করে নিল। এই শুরু হয়ে গেল লড়াই। তবে রে! আমি মিনিটখানেক অপেক্ষা করে আবার আচমকা ঠেলে ফেলে দিয়ে হাতল আমার দখলে নিয়ে এলুম। চোখ দুটো পর্দায়, মন কিন্তু পড়ে আছে ডান পাশের হাতলে। বাঁ পাশের দর্শকটিকে নিয়ে আমার তেমন সমস্যা নেই। তিনি তাঁর বাঁ পাশে একজন মহিলাকে নিয়ে বড়ই ব্যস্ত হয়ে। পড়েছেন। আমি জানি সারাক্ষণ তিনি বাঁ দিকেই কান্নিক মেরে থাকবেন।
এত বড় একটা হলের এত দর্শক কত ভাবেই না ব্যস্ত। কেউ মন দিয়ে ছবি দেখছেন। কেউ আছেন অন্ধকার দৃশ্যের অপেক্ষায়। অমনি ঘাড় আর দেহ হেলে পড়বে সঙ্গিনীর দিকে। পর্দার। প্রেম নেমে আসবে জীবনে। সবাই সব নিয়ে মশগুল। কারুর ধারণাই নেই এদিকে কি হচ্ছে! অন্ধকারে নিঃশব্দে চলেছে নিরক্ত বিপুল সংগ্রাম। হাতলের লড়াই। এ ঠেলছে, ও ঠেলছে। এই আমি হারি তো পরক্ষণেই আমি জয়ী। তবে জয়ী হয়ে বেশিক্ষণ রাজ্য আমার দখলে রাখতে পারছি না। কারণ লোকটি বেশ বলশালী। হাত নয় তো, কলাগাছের কাণ্ড! তা হোক, মানুষ জেতে মনের জোরে। আমার মনের জোর ক্রমশই বাড়ছে। হুহু করে বাড়ছে। প্রায় স্বদেশি যুগের দেশসেবকদের মতো করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। ইন কিলাব…।
পর্দায় চোখ আছে মন নেই। কী যে ঘোড়ার ডিম হচ্ছে ওখানে। আমরা দুই যোদ্ধা কেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছি না। শুধু অন্ধকারে আমি ঠেলছি, তিনি ঠেলছেন, তিনি ঠেলছেন, আমি ঠেলছি।
এইবার আমার হাতটাকে হাতলের ওপর কষকষে করে রেখে বাঁ হাত দিয়ে চেপে ধরলুম। নে। ব্যাটা এইবারে সরা দেখি, কেমন সরাতে পারিস। তিনি ঠেলছেন। পারবে না ম্যান। এইবার দু হাতে লড়ছি। ভদ্রলোকের জোরে নিশ্বাস পড়ছে। খুব তকলিফ হচ্ছে। প্রাণ ঢেলে ঠ্যালা মারছেন।
আমি তো এইটাই চাই। চাপ যখন তুঙ্গে উঠেছে, খুস করে হাতটা সরিয়ে নিলুম, আর ভদ্রলোকের হাত হড়াস করে চলে এল আমার পাশে, আচমকা ঘষড়ে গেল হাতলের ধারে, কনুইটা খটাস করে ঠুকে গেল আমার আসনের পেছনে। লেগেছে। অস্পষ্ট শোনা গেল—শালা, নুনছাল উঠে গেল। যাবেই তো। এটাই তো আমি চেয়েছিলাম বৎস। আমি ওই হাতের তলা দিয়ে আমার হাতটা কায়দা করে তুলে দিলুম হাতলে। শুধু গায়ের জোরে যুদ্ধ জেতা যায় না। চাই বুদ্ধি। যুদ্ধের ভাষায় যাকে বলে স্ট্র্যাটেজি।
পরদায় এখন ভীষণ কিছু ঘটতে চলেছে। মনে হয় একটা মার্ডার হবে। সেই রকম বাজনাই বাজছে। মরুক গে। ও তল্লাটে যা হচ্ছে হোক। আসল খেল তো আমার ডান পাশের হাতলে। ভদ্রলোক এইবার খেপে গেছেন। হেঁইসো মারি হেঁইও বলে আমার হাতটাকে আবার ফেলে দিলেন। জোরসে ঠেলো হেঁইও বলে আমি আবার ফেলে দিলুম। এত দুঃখেও আমার সেই গানের লাইনটা মনে পড়ছে—ওঠা-নামা প্রেমের তুফানে।
কী হল, কিছুই বুঝলাম না। সিনেমা শেষ হয়ে গেল।
ভদ্রলোক এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন, মৃদু হেসে বললেন—বইটা খুব সুন্দর তাই না!
আমি বললুম—তা না হলে ছটা অস্কার পায়!