খুব মন দিয়ে সিনেমা দেখছি। মারাত্মক সব ব্যাপার চলছে পর্দায়। কোনওদিকে আর তাকাবার অবসর পাচ্ছি না। সুন্দরী নায়িকা স্নান করতে নামছেন বাথটাবে। পাশের মহিলা শব্দ করে হাই তুললেন, তারপর তাঁর ওপাশের সুন্দরী মেয়েটিকে বললেন, আর কি সে বয়েস আছে রে শিবি, জোর করে এই সব বই দেখাতে নিয়ে এলি? এ যে ছোঁড়াছুঁড়ির প্রেম! আবার হাই তুললেন মৃদু শব্দ করে। সামনে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আরও আরাম করে বসলেন। ডান দিকে হেলতেই। আমার কাঁধে তাঁর কাঁধ ঠেকে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, কিছু মনে করিস নি। সিট করেছে দেখেছিস, একটু মোটা হলে আর বসার উপায় নেই।
এই গল্পটা আমার বলার উদ্দেশ্য নয়, কারণ এটা হল প্রেমের গল্প। সিনেমা হল থেকে বাসরঘরে গিয়ে এর পরিণতি। নানা, ওই বয়স্ক মহিলার সঙ্গে নয়। বিয়ে হল, তাঁর পাশে যে। সুন্দরী মেয়েটি বসেছিল তার সঙ্গে। যাকে তিনি শিবি বলে ডাকছিলেন। মেয়েটি তাঁর বোনঝি। এ খুব গোলমেলে মধুর রসের গল্প। তবে একটা কথা বলে রাখি, অন্ধকারে সিনেমা হলে ঢুকলেই যে সুন্দরী স্ত্রী লাভ হবে, এমন সিদ্ধান্ত না করাই ভালো। আমার হয়েছিল—আমার বরাত ভালো ছিল বলে।
আমার আজকের গল্প হল লড়াইয়ের গল্প।
আজ আমি আলো নেওয়ার অনেক আগেই আমার আসনে এসে বসেছি। আমার ডান দিক খালি। আমার বাঁদিক খালি। আমি মাঝের আসনে বসে আছি গদিয়ান হয়ে। সামনে ঝুলছে ঝলমলে শাটিনের পরদা। মাথার ওপর মোহিনী আলো, সিনেমা হল যখন ফাঁকা থাকে, বেশ লাগে চুপচাপ বসে থাকতে। ভাব এসে যায়। নিজেকে কখনও মনে হয় রাজা। কখনও মনে হয় প্রেমিক। বাইরে বাস্তব জগৎ কেলোর-বেলোর করছে। ভেতরে ছায়া ছায়া স্বপ্নজগৎ। পরদায়। ভেসে উঠবে নায়ক নায়িকা। সুন্দর চেহারা, ভরা যৌবন। নর্তকীরা আসবে কোমর দোলাতে। সুর, সুরা, স্বপ্ন, প্রেম, প্রাকৃতিক দৃশ্য। সে যে কী কাণ্ড! উপরি পাওনা, পাশেযদি আতর মাখা কোনও তরুণী এসে বসেন!
ভাবতে ভাবতে সময় চলে যাচ্ছে। আর যতই সময় যাচ্ছে ততই আসন পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ভরে এসেছে। কেমন সব লক্ষ্মীছেলের মতো বসে আছে। ফুলস্টপের মতো কালো কালো মুণ্ডু আলো-অন্ধকারে ভাসছে। দপ করে আলো নিভে গেল। আমার বাঁ পাশ ভরেছে। ডান পাশ। এখনও খালি। দু-হাতলে দু-হাত ফেলে রাজার মতো বসে আছি সামনে বুক চিতিয়ে। অন্ধকার। ঝিমঝিম ঠান্ডা। রিমঝিম সংগীত। পরদা ওপরে উঠছে পরতে পরতে। স্ক্রিনে ছবি পড়েছে। বিজ্ঞাপন-সুন্দরী স্লো মোশানে ভিজে সমুদ্র সৈকতে বাতাসে চুল উড়িয়ে ছুটে আসছে আমাদের দিকে। পেছনে ল্যাজ তুলে ছুটে আসছে একটা ঘোড়া। দুজনেই শ্যাম্পু করেছে। একজন চুলে, একজন ল্যাজে। কী সে শ্যাম্পু!
বিজ্ঞাপন দেখতে বেশ মজা লাগে। মনেই হয় না, এ দেশে দারিদ্র আছে, খুনোখুনি আছে, ভ্রাতৃবিরোধ আছে। শ্যাম্পুর পরে শুরু হয়েছে টুথপেস্ট। কে একটা মেয়ে, কী একটা টুথপেস্ট দিয়ে দাঁত মাজার ফল হাতে হাতে পাচ্ছে। কিন্নর চেহারার একটা ছেলে তাকে বুকে চেপে ধরেছে। টুথপেস্টের এত গুণ! এ দেশের আইবুড়ো মেয়েরা জানে না নাকি?
এইবার জাঙিয়া। উঃ, এমন জাঙিয়াও আছে, যা পরলে আর কিছু পরতে হয় না। একটা ঝকঝকে মোটর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ডনজুয়ান। গায়ে একটা ওভারকোটের মতো কী চাপানো। তার একটা দিক তুলে তিনি জাঙিয়া প্রদর্শন করছেন, আর দুদিক থেকে দুই সুন্দরী শরীরে একেবারে লেপটে আছে খোঁটার গায়ে উচ্ছেলতার মতো।
এর পরই শুরু হল শরীরে লোম ওঠাবার মলমের বিজ্ঞাপন। মোদ্দা কথা ব্লেড দিয়ে না চেঁচে মলম লাগাও, তাহলে সিল্কের কাপড় হড়কে নেমে যাবে। একটি সুন্দরী মেয়ের দুটি ঠ্যাং নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কসরত চলল।
শেষ হতে না হতেই লিরি লিরি করে একটা সুরেলা গান শুরু হল। আর নালা-নর্দমা-জলের কলে নয়, একেবারে পাহাড়ি ঝরনায় চান শুরু করে দিল এক কিশোরী। এই সাবান ভাসে তো, এই এক চাকা লেবু। সে কী নৃত্য! বেজে উঠল বিয়ের সানাই। হলুদ মাখানো হচ্ছে বিয়ের কনেকে। হলুদ নয়। হলুদওলা মলম। টুথপেস্টের মতো টিউব থেকে গিলগিল করে বেরিয়ে আসছে।
সানাইয়ের কালোয়াতি, মেয়েদের ফিনফিনে হাসি।
লেসারের তরোয়াল হাতে এক আধুনিক বীর এইবার যুদ্ধে নেমেছেন। এক নায়িকা ছুটে আসছেন মালা দিতে। কীসের যুদ্ধ! কার সঙ্গে যুদ্ধ! যাক গে, ও বড় গোলমেলে ব্যাপার। আসল কথা হল বিশেষ একটি মিলের কাপড় পরে যুদ্ধে যেতে বলছে, তাহলে রাজত্ব এবং রাজকন্যা দুই-ই একসঙ্গে লাভ হবে।
বাঁ পাশের ভদ্রলোক আপন মনে বললেন, বইটা মনে হচ্ছে খুবই ছোট। ওই জন্যে লোকে হিন্দি বই দেখে। আমার ডান পাশ তখনও খালি। তিনি মনে হয় জ্যামে ফেঁসে গেছেন। কলকাতায় যা হয় আর কি! একেবারে না এলেই ভালো হয়। বেশ ছড়িয়ে বসেছি।
ক্ষণ বিরতির পর শুরু হল ভারত সরকারের ডকুমেন্টারি। বাঁ পাশের ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, এই সব রাবিশগুলো কেন দেখায়? সময় নষ্ট। নাও, এখন বসে বসে গুজরাটি খরা দেখো। ভদ্রলোকের সবেতেই বিরক্তি। পৃথিবীতে কিছু কিছু এমন মানুষ আছেন; কিছুতেই যাঁরা সন্তুষ্ট নন। কী আর করা যাবে!
বই শুরু হল। আমেরিকার প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে চলেছে। পেছনের জানলা দিয়ে লোটা লোটা কানওলা একটা কুকুরের মুখ বেরিয়ে আছে। কেমন মজা করে চলেছে। ওদেশের। কুকুরও গাড়ি চাপে আর এদেশের মানুষ ছাগলের মতো গাদাই হয়ে বাসে ব্যা ব্যা করতে করতে অফিসে যায়। হায় দেশ!