কোথায় চলেছি আমি! আবার সেই লেকের কাছেই এসে পড়েছি। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে এক আকাশ তারা। সার সার গাছ বসে গেছে বিরাটের নিস্তব্ধ। ধ্যানে। অচেনা, অদ্ভুত পরিবেশে আমার একটুও ভয় করছে না। কেবলই মনে হচ্ছে একটা হাত আমাকে ইশারায় ডাকছে। এগিয়ে এসো, এগিয়ে এসো। যত এগোবে ততই শান্তি, তত আনন্দ। এই পৃথিবীতেই সেই জায়গা আছে। সেই একান্ত নিভৃত স্থান। মাতৃগর্ভে যেমন শিশু থাকে। তেমনই সেই স্থান আছে পৃথিবীর নিভৃত একান্তে। চলে এসো! চলে এসো! আমার হাতে হাত রাখো! আমি তোমাকে নিয়ে যাব!
আমি তো সেইরকম একটা জায়গাতেই যেতে চাই। ওই হাতেই হাত রাখতে চাই। যে হাত তৈরি হয়েছে আমার মায়ের হাত, আমার প্রেয়সীর হাত, আমার রক্ষাকর্তীর হাত একসঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে ছাঁচে ঢালাই করে।
পেছন দিক থেকে একটা গাড়ি আসছে হেডলাইট জ্বেলে। ট্যাক্সি। হাত তুলতেই থেমে পড়ল। দরজা খুলে উঠে বসলুম। মিটার ফ্ল্যাগ নেমে পড়ল মৃদু সুর তুলে। পেছনের সুখী অন্ধকারে ধীরে ধীরে ডুবে গেলুম। আলো পড়তে চালকের মুখ দেখতে পেলুম। হাসি পেয়ে গেল। আগের গাড়ি। সেই এক ড্রাইভার। আমাকে চিনতে পারেনি।
আপন মনেই বললুম, ‘ডব্লু বি টি থ্রি জিরো থ্রি ফাইভ।’
ভদ্রলোক ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘জানি, আপনি। আপনার জন্যেই ফিরে এলুম। হেডলাইট অন করে। ওদের হাতে আপনাকে ছেড়ে দিতে ইচ্ছে হল না।’
‘কাদের হাতে?’
‘নিশাচরদের হাতে। এইসব এলাকা আর আগের মতো নেই।’
‘কিছু হত না। আর-এক হাতে আমার হাত রেখেছি।’
‘জানি কোন হাতের কথা বলছেন। সে হাতে হাত রাখতে হলে নিজের হাত আগে পবিত্র করতে হয়।’
‘তার মানে?
‘বুঝে নিন।’
পিকাডেলি রেস্তোরাঁর সামনে নেমে পড়লুম গাড়ি থেকে। ভাড়া দিতে গেলুম। ভদ্রলোক নিলেন না।
সামনের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলুম, ‘সবই কি মনের ভুল?’
‘জানি না। আমি কিছু জানি না। জানার কথাও নয়।’
গাড়ি ছেড়ে দিল। যতক্ষণ দেখা যায়, ততক্ষণ তাকিয়ে রইলুম পেছনের ছোট্ট লাল আলোটার দিকে। যত দূরে যাচ্ছে তত ছোট হচ্ছে। সাপের ছুঁচোলো চোখ হয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
চওড়া পিচের রাস্তা নির্জন রাত পেয়ে দৌড়োচ্ছে যেন।
আমার হাত?
মাথার ওপর মার্কারি ভেপার ল্যাম্প জ্বলছে। সেই আলোয় প্রথমে নিজের ডান হাত মেলে ধরলুম। আঙুলগুলো ছড়িয়ে দিলুম মাছের পুচ্ছের মতো। কালচে, কর্কশ একটা হাত। আঙুলের মাথাগুলো ভোঁতা ভোঁতা। নখের আকৃতি সুন্দর বাদামের মতো নয়। আধখাওয়া চাঁদের মতো। কোণগুলো দাবা দাবা। অমসৃণ, চিড়খাওয়া চামড়া। এই আমার হাত। এ তো বনমানুষের হাত। এই হাত আশাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়েছে। এই হাত অসুস্থ বেকার ছোট ভাইকে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে যৌথ সম্পত্তির অংশ নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। এই হাত আর একটি হাতকে কথা দিয়েও নিজের হাতে তুলে নেয়নি। এই হাত আরও অনেক হাতকে নিজের ব্যবসার স্বার্থে কলুষিত করেছে। কী করেনি এ হাত? এ তো ভোগের হাত। পাপের হাত। বাঁ-হাতটাও মেলে ধরলুম আলোয়। একই চেহারা। দুটি যমজ ভাই। ভেপার ল্যাম্পের আলোয় ডানা-মেলা বাদুড়ের মতো থমকে আছে। আমারই বুকের সামনে। নিজের হাতদুটোকে নিজেই চিনতুম না এত দিন! আশ্চর্য!
হাতলের লড়াই
অন্ধকার হওয়ার আগেই আমি সাধারণত সিনেমা হলে ঢোকার চেষ্টা করি। একবার অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর ঢোকার চেষ্টা করে ধোলাই খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিলুম। চড়া আলো থেকে হঠাৎ অন্ধকার। হাতড়াতে হাতড়াতে ঢুকেছি। কিছুই চোখে পড়ছে না। সম্পূর্ণ অন্ধ। টিকিটচেকার টর্চলাইটের আলো ফেলে এক ঝলকে সিট দেখিয়ে সরে পড়লেন। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চোখে আরও ধাঁধা লেগে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না। আসনে গিয়ে বসতেই হবে। বরাতক্রমে সিটটাও পড়েছে, সারির একেবারে শেষে দেয়াল ঘেঁষে। পা ঘষে ঘষে, পা ঘষে ঘষে, টিকিটচেকার যে রো দেখিয়েছিলেন তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালুম। তলায় একটা লাল আলো জ্বলছে। ঠিকই তবে সেই আলোয় ওপরের অন্ধকারের বিশেষ কোনও অসুবিধে হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। ডান হাতটা পাশে বাড়িয়ে দিলুম। একটা কিছু ধরে, কায়দা করে জোড়া জোড়া হাঁটু ভেদ করে ঢুকতে হবে তো। হাতটা নরম মতো একটা কিছুতে গিয়ে ঠেকতেই সেটা সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বুঝলুম, চেয়ারের পেছন নয়, অন্য কিছু। নারীকণ্ঠ, ইশ করে উঠল। সর্বনাশ! হাত তুমি কী ছুঁয়েছিলে? না জানাই ভালো। সাবধান হলুম। কোনওক্রমে প্রথম হাঁটু জোড়া অতিক্রম করে, টাল সামলাবার জন্যে নীচের দিকে হাত বাড়ালুম কিছু একটা ধরার আশায়। মনে হল নরম পাশ বালিশে হাত পড়েছে। জিনিসটা থিরথিরিয়ে কেঁপে উঠল। নারীকণ্ঠের তিরস্কার অসভ্য। ভয়ে সিঁটিয়ে গেলুম। মরেছে, কোনও মহিলার ঊরুতে হাত পড়েছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে না, ওয়ে অফ নো রিটার্ন মানে এমন পথে চলে এসেছি যে আর ফেরার উপায় নেই। এগোতে আমাকে হবেই। ভেবেছিলুম পর্দায় আলোকিত কোনও দৃশ্য ফুটে উঠবে, আর সেই আলোয় পরিষ্কার পথ চিনে নেব। সে গুড়ে বালি। জঙ্গলের ডকুমেন্টারি শুরু হয়েছে। যাই হোক, এইবার খুব সাবধানে হাত বাড়ালুম। হাতে বুরুশের মতো কী একটা লাগল। অনেকটা টুথব্রাশের মতো। আর সঙ্গে সঙ্গে কে আমার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টান লাগাল। আমি হুমড়ি খেয়ে একটা কোলের ওপর পড়ে গেলুম। সিল্কের নরম কোল। সেন্টের গন্ধ। পড়ে গিয়েই আমি বুদ্ধি করে বললুম —মা আমাকে হ্যাঁচকা টান মেরে ফেলে দিয়েছে। বলেই মনে হল ইংরেজি তরজমার প্রয়োজন। বললুম, সরি ম্যাডাম। আনইন্টেনশানাল ফল্ট। একসকিউজ মি। এ সব বলেছি বটে কিন্তু পড়ে আছি কোলে। এইবার পাশ থেকে জাঁদরেল কেউ আমার চুলের মুঠি ধরে ফেলে দিলে পাশের খালি আসনে। আর সেটাই আমার সিট। এমনই মজা, সিটে এসে পড়লুম আর পর্দায় ভেসে উঠল উজ্জ্বল দৃশ্য। মানুষের চোখে একটা সুইচ থাকে। অফ থাকতে থাকতে হঠাৎ অন হয়ে যায়। আমারও তাই হল। সারা হল আমার চোখে এখন পরিষ্কার। গোলাপি আলোয় অসংখ্য মাথা গোল গোল লেডিকেনির মতো ভাসছে। আমার ডান পাশে দেয়াল। বাঁ-পাশে, পালোয়ানের মতো চেহারার বর্ষীয়ান এক মহিলা। এই মহিলাই আমার চুলের মুঠি ধরেছিলেন। তার পাশে সুন্দরী এক মহিলা। যার কোলে আমি পড়েছিলুম। তার পাশে এক পো লোক। যার গোঁপকে মনে হয়েছিল বুথব্রাশ। এইসব দেখতে দেখতেই আলো জ্বলে উঠল। মূল বই আরম্ভ হওয়ার আগে, সিগারেট খাবার জন্যে দু-চার মিনিটের বিরতি। আমি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলুম। বাইরে যেতে হবে তো। বর্ষীয়ান মহিলা থাবড়া মেরে বসিয়ে দিলেন, বোসো হারামজাদা। আবার অন্ধকারে ঢুকে পড়ে মরার ইচ্ছে। এই শাসন বড় ভালো লাগল। অবিকল আমার মায়ের মতো। বাইরে গিয়ে সিগারেট খাওয়া আর হল না। ফুস করে আলো নিবে গেল। শুরু হল গেল মেট্রো গোলউইন মেয়ারের যাত্রা। গোলের মধ্যে সিংহের হাঁউ হাঁউ গর্জন বার তিনেক।