ডান হাতটাকে কোলে তুলে নিলুম। নিজের হাত নিজের এলাকাতেই থাক। পাশের ফাঁকা। অঞ্চলটিকে আর বিশ্বাস নেই। বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। হয়তো কেউ বসে আছে। আমি দেখতে পাচ্ছি। না। গা ছমছম করে উঠল। ব্যাপারটাকে মনের ভুল বলে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলুম, ‘হ্যাঁ মশাই, আপনার গাড়িতে কি কিছু আছে?’
‘কী আবার থাকবে?’ সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘কখনও কিছু ঘটেছে এই গাড়িতে?’
‘কী আবার ঘটবে?’ সেই একই ধরনের উত্তর।
আর কিছু জিগ্যেস করার সাহস হল না। এখন তাড়াতাড়ি নেমে পড়তে পারলে বাঁচি, কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ভয় করলেও আমি সেই শরীরহীন অদৃশ্য হাতের প্রেমে পড়ে গেছি। স্পর্শে বুঝেছি, অবশ্যই কোনও সুন্দরীর সুন্দর হাত। লম্বা, সরু সরু মসৃণ আঙুল। বাদামের মতো। তেলা নখ। আংটিটা নিশ্চয় হিরের। রক্তমুখী নীলাও হতে পারে! সোনার ওপর জ্বলজ্বল করছে।
পাশে ফিরে তাকালুম। যদি দেখতে পাই সেই অদৃশ্য রমণীকে। এমন যার হাত সে কী শাড়ি পরবে? পিঙ্ক রঙের সিল্কের শাড়ি? ওই রং আমার ভীষণ প্রিয়। আর মুখ কেমন হবে? খুব। ধারালো। ছোট কপাল। একেবারে নিভাঁজ। আলো পড়লে চকচক করবে। সেই ছোট্ট কপাল ঘিরে থাকবে কুচকুচে কালো চুলের তটরেখা। রেশমের মতো কোমল। ঘাড়ের কাছে দুলবে তুলতুলে একটা খোঁপা। কানে চিকচিক করবে দুল। টিকোলো নাকে একটা হিরের নাকছাবি। আমি নিজে পরিয়ে দোব। পিঠটা হবে চওড়া। সরু হয়ে নেমে গেছে কোমরের দিকে। পিঙ্ক-রঙের ব্লাউজ ছুঁড়ে বেরুবে তপ্ত কাঞ্চন বর্ণ। দু-সার সুন্দর দাঁত, হাসলেই চকচক করে উঠবে। গোল। নিটোল হাতে দু-গাছা, মাত্র দু-গাছা রুলি কাটা সোনার চুড়ি। এ হাতে দু-গাছা, ও হাতে দু-গাছা। হাত নাড়লেই ঠিন ঠিন শব্দ। নীলার আংটি ছাড়াও আর একটা আংটি আমি পরাব বাঁ-হাতের মধ্যমায়। জোড়া সাপ। সাপের চারটে চোখে বসানো থাকবে ছোট ছোট চুনী, পোখরাজ আর পান্না। ঠিক এইরকম একটা আংটি ছিল আমার মায়ের আঙুলে। সে আংটি আর নেই। মা যখন মৃত্যুশয্যায় তখন আর কিছু বেচার নেই দেখে বাবা বেচে দিয়েছিলেন। আমার বড়বোন আশা বারণ করেছিল। মায়ের একটা স্মৃতি অন্তত থাক। বাবা উপায় থাকলে হয়তো রেখে দিতেন। তখন অবশ্য বলেছিলেন, ‘তোরা এখনই স্মৃতি নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? মানুষটা আগে বাঁচুক। বেঁচে উঠুক, তারপর নতুন স্মৃতি তৈরি করা যাবে।’ মানুষের কত আশা! ভাবলে হাসি পায়।
ড্রাইভার হঠাৎ জিগ্যেস করলে, ‘যাবেন কোথায়? লেক তো এসে গেছে।’
‘আসুক না। আপনি চালিয়ে যান। মিটার তো আছে।’
‘কোনদিকে যাব বলুন?’
‘টালিগঞ্জের দিকে চলুন।’
‘কোথায় যেতে চান আপনি?
‘চলুন না। এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?
‘আমি বেশি রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাই না। আমাকে আবার ফিরতে হবে। গাড়ি গ্যারেজ করতে হবে। দিনকাল ভালো নয়।’
‘আপনার এই গাড়িটার দাম কত?’
‘কেন? কিনবেন নাকি?’
‘না এমনি জিগ্যেস করছি।’
‘অ এমনি!’
ভদ্রলোক দাম বললেন না। যতই হোক গাড়ির মালিক, তার আলাদা অহংকার তো হবেই। অনেক পয়সা থাকলে গাড়িটা কিনে নিলুম। এ সাধারণ গাড়ি নয়। এর একটা অতীত আছে। একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস হয়তো কাঠখোট্টা মালিকও জানে না।
এবার চারপাশ অন্ধকার। বাড়ি তেমন নেই। গাছপালাই বেশি। শীত শীত কুয়াশা কুয়াশা ভাব। গাছের পাতায় পাতায় হিসহিস করে বাতাসের শব্দ হচ্ছে। আসনে হাতটা আবার আলতো করে ফেলে রেখেছি। এবার আমি লোভী হয়ে উঠেছি। মনে মনে আমি সেই হাতটিকে খুঁজছি। এবার সেই স্পর্শ পেলে আমি আঙুলে আঙুলেই কথা বলব। আমার হৃদয়টাকে আমার আঙুলের মাথায় এনে বসাব।
লোভ আর আকাঙ্ক্ষা এসে গেছে। পেতে চাইছি, তাই বোধহয় পাওয়া হল না। অজানা অদৃশ্য জগৎ থেকে রহস্যের আঁচল ফাঁক করে সে হাত আর এল না। ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল। এতক্ষণ বেঁচে থাকার যেন একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছিলুম। দেহ আর মস্তিষ্কের সমস্ত মৃত কোষ বেঁচে উঠেছিল। শতকরা একশো ভাগ জীবিত হয়ে উঠেছিল। চারপাশের অন্ধকার থেকে ঝাঁক ঝাঁক বাদুড়ের মতো বিষণ্ণতা উড়ে আসছে।
‘গাড়ি ঘোরান।’
‘কোথায় ঘোরাব?’
‘আমি তো গাড়িয়াহাট যাব। আগেই বলেছি।’
‘এই তো বললেন টালিগঞ্জ যাব।’
‘ভুল বলেছি। এখন আমি গড়িয়াহাট যাব।’
গাড়ি রাস্তার বাঁ-দিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।
সুইচ টিপে মিটারের আলো জ্বেলে ভদ্রলোক বাঁ-দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তারপর সোজা হয়ে মনে মনে কী হিসেব করে বললেন, ‘দিন না, বিয়াল্লিশ টাকা দিন। ফর্টি টুঁ রুপিজ।’
‘কী হল আপনি যাবেন না!’
‘না, আপনি এখানে নেমে যান! অন্য গাড়ি ধরে নিন।’ সংক্ষিপ্ত রূঢ় জবাব।
‘আপনার গাড়ির নম্বর কত? দয়া করে বলবেন।’
‘কেন পুলিশে যাবেন? বলে দিচ্ছি ডরু বি টি থ্রি জিরো থ্রি ফাইভ।’
একটা পঞ্চাশ টাকার নোট এগিয়ে দিতে দিতে বললুম, ‘আপনি অসন্তুষ্ট হলেন? আমি থানা পুলিশের জন্যে জিগ্যেস করিনি। আপনার গাড়িটা খুব পবিত্র। এর ভেতর একটা জিনিস আছে, আপনি নিজেও হয়তো জানেন না।’
‘অ, তাই নাকি?’
আটটা টাকা আমাকে ফেরত দিতে দিতে ভদ্রলোক রসকষহীন গলায় বললেন, ‘একেবারে অনুভূতিশূন্য মানুষ।’ কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে পথে নেমে পড়লুম। আজ আর কারুর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি নয়। এমনিই আমি ভীষণ রগচটা মানুষ। আজ কিন্তু আমার স্বভাব একেবারে পালটে গেছে। খুব হালকা লাগছে। ভেতরে যেন শান্তির অসীম উৎস খুলে গেছে! সব যেন সিনেমা। আমি এক চিরকালের নায়ক। বাতাসে ভেসে ভেসে উড়ে চলেছি। আমার চুল উড়ছে। সাদা পোশাক উড়ছে! চারপাশ থেকে ভেসে আসছে অর্গান আর পিয়ানোর সুর। সুন্দরী রমণীদের খিলখিল, কাচ-ভাঙা হাসির শব্দ। এত বছর বেঁচে আছি, পৃথিবীকে এত সুন্দর কোনও দিন মনে হয়নি।