কার মেয়ে ছিল কে জানে!
সুব্রত, ভেবে দেখেছিস কী সাংঘাতিক! ওরা কি ফিরে আসতে পারে? এই স্পট ওদের চিনতে অসুবিধে হবে না। শেফালির ডেডবডি হবে ওদের নিশানা।
তাহলে?
কী অসাধারণ ব্যাপার! তাহলে চল শেফালিকে আমরা লোপাট করে দিই।
কিন্তু ওই চাপ চাপ রক্ত। ষোলো বছরের মেয়ের ওই তাজা রক্ত!
অসাধারণ। আমার মাথাটা দেখেছিস? বিপদেও কী ক্লিয়ার! সুকুমার বালতি বালতি জল দিয়ে পরিষ্কার করবে।
ইউ সুকুমার, একটা সাদা কাপড় আছে? নেই। তবে তোমারটাই খোলো। কুইক। কটা বাজল? চারটে পঞ্চান্ন। সামনের চেক পোস্ট থেকে ওরা ফিরবে, আর মাত্র কয়েক মিনিট সময়।
খোল খোল খুলে নে ওর কাপড়। বিপদের সময় আবার লজ্জা।
কী আশ্চর্য! বিপদের সময় আর সেই সমস্ত চরম আনন্দের সময় আমরা কেবল নিঃসঙ্কোচে উলঙ্গ হতে পারি।
নে জড়িয়ে নে। গায়ে রক্ত লাগাসনি। তুলে নে। সুকুমার জল ঢালো। উঁহু দেখছ হাতে কী? নিষ্কৃতি নেই। ঢালো এক-দুই..ফাইন? দেখছিস পিচে রক্ত লাগে না।
মেয়েটা এখন হালকা হয়ে গেছে। কী ঠান্ডা। যদি বেঁচে থাকত কী অসাধারণ হত!
সামনে এগিয়ে চল। আর হাইওয়ে নয়। মাঠের রাস্তা ধর।
ওকে শুইয়ে দে এই সাঁকোর তলায়। অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে। বেচারা। মুক্তির সংগ্রামে মুক্তি পেয়ে গেল!
কী টাটকা শরীর ছিল এই একটু আগে। এখন মাটির কত কাছাকাছি। আমি ওকে একটা চুমু খেতে পারি!
হাইওয়ের ওপর দিয়ে আলোর সারি ছুটে চলেছে উত্তরে দক্ষিণে। যত রাত বাড়ছে তত আলো বাড়ছে, যত রাত বাড়ছে তত আলো বাড়ছে।
হাত
হু-হু করে রাস্তা ছুটে চলেছে জানালার দুপাশ দিয়ে। বেশ লাগছে। ছুটির কলকাতা। পথে তেমন। ভিড় নেই। ফাঁকা ফাঁকা। গাড়ি-ঘোড়াও কম। ট্যাক্সির বাঁ-ধারের জানলা ঘেঁষে বসেছি। বেশ জাঁকিয়ে। আরাম করে। পুরো গাড়িটাই আমার দখলে। আজ আর শাটলের হাঙ্গামা নেই। চলেছি উত্তর থেকে দক্ষিণে।
আমার বাঁ-হাতের কনুই জানলায় ফেলে রেখেছি আলতো করে। অলস ডান হাত পড়ে আছে মসণ আসনে। আমি দেখছি। হাঁ করে দেখছি—শহর কলকাতা। বড় বাড়ি। ছোট বাড়ি। দোকানপাট। বেমানান গাছ। আলো ঝলমলে দোকান। আসছে আর ছুটে চলে যাচ্ছে পেছনে। কে যেন টেনে নিচ্ছে ভালো করে দেখার আগেই।
ডান হাতের চেটো আসনের ওপর চলে বেড়াচ্ছে। মসৃণতা উপভোগ করছে। খুবই অন্যমনস্ক। আঙুলে কী যেন ঠেকল। আঙুলে আঙুল। আর একটা হাতের সরু সরু আঙুল। একটা, দুটো, মধ্যমা, অনামিকায় একটা পাথর বসানো আংটিও রয়েছে। বাইরে তাকিয়ে আছি। প্রথমে অতটা খেয়াল করিনি। যেই মনে হল গাড়িতে আমি একা, আর একটা হাত এল কোথা থেকে, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকালুম। কোথাও কিছু নেই! আমার হাতটাই পড়ে আছে, মসৃণ চকচকে আসনে। ডান পাশের দোকানপাটের আলো ভাঁড়ের চা ছুড়ে মারার মতো মাঝে মাঝে এসে পড়ছে, আবার। গড়িয়ে চলে যাচ্ছে। কোথাও কিছু নেই! বেশ ভালো করে বার কতক দেখে নিলুম। তারপর। ভাবলুম, আমি কী বোকা। শুধু একটা হাত আসবে কোথা থেকে। মানুষ ছাড়া হাত হয়! মানুষহীন হাত কেউ স্পর্শ করেছেকেউ দেখেছে কোনওদিন? কতরকম মনের ভুল হয়।
গাড়ি চলেছে। চালক খুব মন দিয়ে চালাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি, তার বাঁ-পাশের চোখের অংশ চিকচিক করছে বহুমূল্য মণির মতো। ধারালো মুখ। বেশ খাড়া নাক। প্রশ্ন করতে সাহস হল না। কী ভাববে! পাগল ভাবাও বিচিত্র নয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলে গেলুম। চারপাশে টগবগে শহর। চুম্বকের মতো মন টেনে নিল।
অন্যমনস্ক হাত সরাতেই আবার কী ঠেকল। সরু সরু আঙুল। পালিশ করানখ। একটা, দুটো, মধ্যমা, অনামিকা। অনামিকায় পাথর বসানো আংটি। আবার সেই একই ব্যাপার। আঙুল নিয়ে অন্যমনস্ক কিছুক্ষণ খেলা করার পর চমকে উঠেছি। হাত। আর একটা হাত। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে। তাকালুম। কিছুই নেই। আমার হাতটাই শুধু পড়ে আছে। একটু সরে গেছে দূরে। ওপাশে এগিয়ে গেছে বেশ কিছুটা। সাহসী শিশুর মতো বেড়াতে বেড়াতে অন্যের এলাকায় গিয়ে ঢুকেছে।
বেশ ভয় পেয়ে গেলুম এইবার। স্টিয়ারিং-এ শক্ত হয়ে বসে থাকা মানুষটিকে সন্দেহ হল সবার আগে। ওই রকম কাঠ হয়ে বসে আছে কেন! বাঁ-পাশে একটু বেশি ঘুরে। আধখানা চোখ জ্বলজ্বল করছে। কোনও কথা নেই মুখে। বলার মতো কত কী বিষয় রয়েছে। গত কয়েকদিনে শহর। জীবনের কড়াইতে বহু বিষয় ভাজা হয়েছে, গরম তেলে ভাজার মতো। নির্বাচনের ডাল ফুলুরি। প্রার্থিত প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়। নেতারা অনেক বেগুনি ভেজেছেন। ক্রিকেটের ভেজিটেবল কাটলেট। মুখরোচক এত কিছু থাকতে ভদ্রলোক মুখ খুললেন না কেন? খুবই সন্দেহজনক। বেঁচে আছেন তো? অনেক সময় গাড়ি চালাতে চালাতে হৃদরোগের আক্রমণ হয়। খবরে। পড়েছিলুম। একবার এক ইঞ্জিন ড্রাইভারের এই রকম হয়েছিল। বন জঙ্গল, নদী, প্রান্তর পেরিয়ে ট্রেন ছুটেছে। বাঙ্কে বাঙ্কে যাত্রীরা অঘোর ঘুমে দুলছে। কেউ জানতেই পারল না, সামনের ইঞ্জিনে ড্রাইভার মৃত।
লোকটি বেঁচে আছে কি না দেখার জন্যে বললুম, ‘আলোটা একবার জ্বালবেন?’
কেন, কী বৃত্তান্ত, কোনও প্রশ্ন না করেই পেছন দিকে হাত ঘুরিয়ে আলোটা জ্বেলে দিল। পাশটা ভালো করে একবার দেখে নিলাম। পরিষ্কার। সুন্দর। কিছু নেই। একটা কাগজের টুকরোও পড়ে নেই। আমি সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিলুম। নির্বিকার চালক স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে। কোনও প্রশ্ন নেই। এমন উদাসী মানুষ কদাচিৎ চোখে পড়ে। একবার মনে হল প্রশ্ন করি, গাড়িতে আর কেউ কি আছে? সাহস হল না। হয়তো হেসে উঠবে। বলবে, কী মশাই, খুব টেনেছেন। কিংবা ধমক দেবে, ন্যাকামি হচ্ছে?