কল্পনা আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি কল্পনাকে প্রশ্ন না করলেও দুজনের মুখেই এক কথা লেখা কী ব্যাপার, ব্যাপার কী?
মার্ডার নয় তো? চলো পালাই। শেষে হাঙ্গামায় জড়িয়ে যেতে হবে। পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
কী যে বলো না। একটা লোক এই অবস্থায় জল চাইছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। তাকে ফেলে রেখে যাবে। আমাদের একটা কর্তব্য নেই!
জল পাব কোথায় এখানে! গঙ্গায় অনেক জল কিন্তু আনবে কী করে? হঠাৎ কল্পনা হাঁটু মুড়ে লোকটার পাশে বসে পড়ল। তারপর শাড়ির আঁচল নিঙড়ে একটু করে বৃষ্টির জল তার ঠোঁটে ঢালতে লাগল। তালু বোধ হয় শুকিয়ে গিয়েছিল একেবারে। জিভ দিয়ে চেটে চেটে সেই জল খেল। খেয়েও যেন কিছু হল না, আরও চাই। এদিকে আঁচলে আর জল থাকে! কল্পনা কোমরের উপরের শাড়ির পুরো অংশটা খুলে নিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে নিঙড়ে জল বের করে লোকটার সেই ভীষণ তেষ্টা মেটাতে লাগল।
আমি কী দেখব? সেই লোকটাকে নাকি হাঁটু ভেঙে বসে থাকা কল্পনাকে। ঘাড়ের কাছে খোঁপা দুলছে। খাটো কাঁচুলি ঝুঁকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঠের দিকে আরও উঠে যাচ্ছে, ভরা বুক সেই। স্থান-কাল-পাত্রেও তার স্বাভাবিক কিংবা অস্বাভাবিক আকর্ষণ বিকিরণ করছে। এক সময়ে মনে হল এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখার জন্যই আমি হলে উঠে বসতুম। মৃত্যুর দিক থেকে জীবনের দিকে ফিরে আসতুম। কিন্তু লোকটা কিছুই করল না। জল খেতে খেতে এক সময় কাত হয়ে গেল
তার ঘাড়। চোখ দুটো একেবারেই উলটে গেল। একেই কি বলে মৃত্যু! দেখিনি। কল্পনা উঠে দাঁড়াল। শাড়ি আবার শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে। চোখের কোণে জল। কাঁদছে সে। কী আশ্চর্য! কোথাকার কে এক নাম না জানা লোক, তার শোকে কাঁদবার কী আছে!
যাঃ মরে গেল। কথাটা এমন ভাবে বলল যেন এইমাত্র তার হাত থেকে একটা পাখি উড়ে গেল।
তুমি আগে কখনও কাউকে মরতে দেখেছ কল্পনা?
দেখেছি বই কি, আমার বোনটা মারা গেল সেবার শীতকালে।
চলো এইবার এইখান থেকে সরে পড়ি, এইবার পুলিশ আসবে তখন মহা মুশকিল হবে। বৃষ্টি থেমেছে, বিকেল হয়ে গেছে। এখুনি অফিস ছুটি হবে, চারদিকে লোক গিসগিস করবে।
তাতে কী হয়েছে? এমনভাবে কথা বলছ যেন তুমি এইমাত্র লোকটিকে খুন করেছ!
তুমি জানো না কল্পনা, মরা মানুষ দেখতে আমার ভীষণ ভয় করে। তারপর পুলিশ? বাবা বলা যায় না কখন কাকে কীসে জড়িয়ে দেয়।
একটা কিছু না করেই চলে যাব? দাঁড়াও একটা ভিজিটিং কার্ড জামার পকেট থেকে গড়িয়ে পড়েছে।
কল্পনা নীচু হয়ে কার্ডটা তুলে নিল। আমি কার্ডটা নিয়ে দেখলাম। লেখা আছে, বিকাশ চৌধুরি, ম্যানেজিং ডিরেক্টর, রেনবো ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাঃ লিমিটেড। তলায় এন্টালির অফিসের ঠিকানা, নিউ আলিপুর। ছোট্ট করে ফোন নম্বর।
তার মানে এই ভদ্রলোকের নাম বিকাশ চৌধুরি, একটি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। বলো কী? এত বড়লোক!
হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এটা অন্য কারুর কার্ড হতে পারে, পকেটে ছিল হয়তো।
আমি তখন ভালো করে সেই ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। তন্ন তন্ন করে তার গায়ে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চিহ্ন খুঁজতে লাগলাম। পায়ের জুতো, বেশ দামি টাউজার, হ্যাঁ, কম দামি নয়, গেঞ্জি তাও বেশ দামি, চেহারা যথেষ্ট সুন্দর, হাতে একটি আঙটি রয়েছে, পাথরটা নীল। চেহারা, বেশভূষা বেশ সম্মানজনক। কল্পনা আমার মনে হচ্ছে হয়তো বিকাশ চৌধুরি হলেও হতে পারেন। না হলেই বা কী? একজন মানুষ মারা গেছেন, এখন আমাদের অবশ্য কিছু করতে হবে!
কল্পনা, একবার চেষ্টা করে দেখলে হয় না বাঁচানো যায় কি না?
কীভাবে?
কোনওরকম আর্টিফিসিয়াল ব্রিদিং-ট্রিদিংবা অন্য কিছু করে।
ছেলেমানুষ তুমি। ওভাবে কাউকে এই অবস্থায় কোনও কালে বাঁচানো গেছে?
একবার দেখব চেষ্টা করে। কলেজে আমার এনসিসি ট্রেনিং ছিল। ফার্স্টএড কিছুটা জানা আছে।
হঠাৎ তুমি এত উৎসাহী হয়ে উঠলে? এই তো বলছিলে সরে পড়বে।
ব্যাপারটা তুমি ঠিক বুঝবে না। ভদ্রলোককে কোনওভাবে বাঁচাতে পারলে উনি খুশি হয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমাকে ওই প্রতিষ্ঠানে একটা চাকরি দিতে পারতেন। কল্পনা হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে চলল। পশ্চিমে গঙ্গার দিক থেকে রেলের লাইন পেরিয়ে একটা কড়া চেহারার লোক আসছে এই দিকে। আমরা জোরে পা চালিয়ে দিলাম, ফোর্টের পাশে সবুজ ঢাকা জমির উপর দিয়ে। বৃষ্টি থেমে গেলেও চারিদিকে বেশ একটু বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব সন্ধেটাকে মধুর শীতল করছে। পশ্চিমে মেঘের ফাটলে সূর্য রঙের খেলা খেলছে।
হতে পারে
নেপাল থেকে এসেছেন মস্ত বড় এক যোগী। দু-হাতে ছটা ছটা বারোটা আঙুল। দু-পায়েও তাই। উচ্চতা সাড়ে চার ফুট। গোল পিপের মতো চেহারা। গায়ের রং ছাই ছাই। চোখে রঙিন চশমা। যোগী বলে পরিচয় না দিলে আমেরিকান ছবির গুন্ডা বলে মনে হতে পারে।
আশেপাশে কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন মহাপুরুষের আবির্ভাব হলে সাধারণ মানুষের মনে বড় আশা জাগে। ইদানীং জীবনধারণ করতে গিয়ে হাতের বাহুতে কবচের মতো একটি সত্য আমাদের গলায় ঝুলে গেছে। সত্যটি হল, আমাদের কিছু করার নেই, যা করার সবই গ্রহরা করছে। যেমন করাচ্ছে তেমনি করছি, যেমন করাবে তেমনি করব! গ্রহ আমাদের কন্ট্রোলে নেই। এ তো রেশনের চাল ডাল গম আটা নয় যে, মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে! আজ বাসমতী তো কাল দুর্বাসমতী। আজ পাঞ্জাব গম তো কাল বাংলা গম।