প্রভাত এসে ঘাটের বাঁধানো রকে একটু বসল। জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে লাগল —এর পর কী করবে? সত্যি থানায় যেতে হবে? না হঠাৎ পুতুল এসে ‘মা, মা’ করে ডাকবে। জলের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ প্রভাত একটা জিনিস লক্ষ করল, পশ্চিম পাড়ে যেখানে জবাগাছের একটা ডাল জলের ওপর ঝুঁকে এসেছে তার একটু দূরে একরাশ ফুল জলের ওপর ভাসছে। জবা গাছ থেকে একটা-দুটো ফুল জলে পড়া বিচিত্র নয়। কিন্তু টগর এল কোথা থেকে? টগর গাছ তো। জল থেকে অনেক দূরে। জলের ওপর সাদা আর লাল একরাশ ফুলের অঞ্জলি কে ছড়িয়ে দিল?
স্বামীর পাশে এসে কল্যাণীও বসল।
প্রভাত শুধু বললে, দেখেছ। একটা জায়গাতেই কত লাল আর সাদা ফুল একসঙ্গে ভাসছে! কে যেন অঞ্জলি দিয়ে গেছে।
কল্যাণী অন্যমনস্ক। জিগ্যেস করে বসল, কেন?
প্রভাত বললে, কেন? মনকে শক্ত করো কল্যাণী। এই কেন-র উত্তর বড় সাংঘাতিক। মাঝপুকুরে ওটা কী ভাসছে দেখেছ? একটা সাজি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুকুরে জাল নামানো হল। সামান্য অনুসন্ধানেই জালে জড়িয়ে উঠে এল পুতুলের দেহ। ফুল ছাপ ফ্রক পরা এক সুন্দরী কিশোরী। যেন এইমাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে, সে ঘুম আর ভাঙবে না কোনওদিন।
প্রভাত শুধু এই বলতে পারল, মা, এই ক’টা বছরের জন্যে মায়ার বাঁধনে কেন বাঁধতে এসেছিলিস! কার পুজো করছিলিস, বিরাটের? সে যে বড় নিষ্ঠুর!
তারপর কত বছর গড়িয়ে গেল রেলগাড়ির মতো জন্ম-মৃত্যুর জোড়া লাইন ধরে। প্রভাতের। ঠাকুরঘর এখন ওই দিঘির পাড়। রোজ সকালে সে নিজে ফুল তোলে, লাল আর সাদা। সাজি ভরে। প্রভাত আর কল্যাণীর বয়েস বেড়েছে। চুলে পাক ধরেছে, কপালে সময়ের রেখা পড়েছে। বয়েস বাড়েনি পুতুলের। সে এখনও সেই কিশোরী। প্রভাত যখন ফুল তোলে, গাছের আড়ালে। সে ঘোরে। প্রভাত তার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, ‘বাবা! এদিক এসো, এদিকে। দেখ, এই ডালে কত ফুল!’ সাজি ভরতি ফুল আর ঠাকুরঘরে যায় না। প্রভাত প্রণামের ভঙ্গিতে দিঘির পাড়ে বসে সেই সমস্ত ফুল অঞ্জলি দেয় জলে। ভাসতে থাকে লাল আর সাদা ফুল। এই তো তোমার পূজা! আছ অনল, অনিলে, চির নভোনীলে। ভূধর সলিল গহনে।
আকাশ
মনীশ সান্যাল নীরবে বেশ কিছুক্ষণ সিগারেট টানলেন। মাথার ওপর ধোঁয়ার একটা চন্দ্রাতপ তৈরি হয়ে গেল। দু-পাশে দুটো বড় বড় জানলা। ভীষণ ঝোড়ো বাতাস বইছে বলে শার্সি বন্ধ। ঘরটা দশতলায়। বাইরে কলকাতার রাতের আকাশ। নীচে বিত্তবান মানুষের পল্লি। আলোর বাহার। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল চোখে পড়ছে। আলোয় উদ্ভাসিত। মনীশ তাকিয়েছিলেন মেমোরিয়ালের দিকে। হঠাৎ যেন ঘরে ফিরে এলেন। সিগারেট অ্যাশট্রে-তে গুঁজে দিয়ে বললেন, হয়নি। আপনার এই পরিশ্রমের পুরোটাই বরবাদ হয়ে গেল। মৌলিক কোনও চিন্তা নেই।
টেবিলের উলটোদিকে বসেছিলেন সুধেন্দু মুখার্জি। মধ্যবয়সি সুন্দর চেহারার এক ভদ্রলোক। মুখে একটা জ্যোতি। সোনার ফ্রেমের চশমায় জ্বলজ্বল করছে। কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে সুধেন্দুমুখ তুলে তাকালেন মনীশের দিকে। এতটুকু আহত না হয়ে বললেন, আমারও তাই মনে হয়েছে। ধরতাইটা ভালোই হয়েছিল। তারপর আর প্রলোভন জয় করতে পারলুম না। ফাঁদে পা। দিয়ে ফেললুম। ইমাজিনেশানের দারিদ্র। তুমি ঠিকই ধরেছ। একটা সময়ে আমার মনে হল, ধরতে হবে। কেউ যেন পালাতে না পারে। সব দিক থেকে ঘিরে ফেলতে হবে। একেবারে অভিমন্যু করে ফেলতে হবে। একের পর এক আসে আর যায়। একটাও স্ট্র্যান্ড করে না। সব ডিগবাজি।
মনীশ বললেন, সে আমি বুঝেছি, আপনি একটা বোম্বাই-বাংলা পাঞ্চ করতে চেয়েছেন। বিদেশি বোতলে বাংলা মদ।
সুধেন্দু বললেন, আমি ঠিক তা চাইনি। আমার একটা সলিড থিম ছিল; কিন্তু পায়ে পায়ে চলে গেল সেই গতানুগতিক দিকে। কিছুতেই আর ফেরাতে পারলাম না। জানো তে সৃষ্ট চরিত্র নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে। কাগজের ওপর অক্ষরমালায় জন্ম। প্রাণ থাকা উচিত লেখকের হাতে। লেখক হঠাৎ আবিষ্কার করে তারা নিজেরাই প্রাণ পেয়ে, নিজেরাই চলতে শুরু করে। লেখকের কাজ তখন হয় অনুসরণ করা। যেমন চালাও তেমনি চলি।
সুধেন্দুদা, আপনার থিমটা কী ছিল?
থিমটা ছিল, ফ্ল্যাটে যেসব শিক্ষিত উচ্চবিত্ত মানুষ একালে বাস করে, তারা যে কী সাংঘাতিক আত্মকেন্দ্রিক, সেটা আমি দেখাব। তারা কেউ কারওর খবর রাখে না। সকলে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আর দেখাতে চেয়েছিলুম, জেনারেশন-গ্যাপ। সেকাল আর একালের মূল্যবোধ কতটা। পালটে গেছে। একালে একজন বৃদ্ধ, ডাইনসোর কী টেরোড্যাকটিলের মতোই অবাক প্রাণী। মিসফিট, সর্বত্র সমালোচিত।
থিমটা তো খুব সিরিয়াস। তাহলে ডাকাতি দিয়ে শুরু করলেন কেন?
আমি প্রথম থেকেই অ্যাকশান দিয়ে জমিয়ে দিতে চেয়েছিলুম। যাতে ঝুলে না যায়।
বেশ, তাই! ওই মধুকে কেন কিডন্যাপ করালেন? ওইখানেই তো বাঁশ দিলেন নিজেকে। ডাকাতি হতেই পারে। ভেঙে পড়া প্রাচীন শহরের আইন-শৃঙ্খলার শিথিল দিক সেটা। কেউ সাহায্যের জন্যে এল না, সেটা হল আত্মকেন্দ্রিক মানুষের ভীরুতা। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু কিশোরী মধুকে উধাও করলেন কেন?
সাম্প্রতিক একটা ঘটনার প্রভাব। ওই যে এক পুলিশ অফিসারের মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছে, আজও যার সন্ধান মেলেনি। ওই মেয়েটি এসে গেল কাহিনিতে।