অনধিকারীরা আছে বলেই, অধিকারীদের এত বিলাস। চায়ের দোকানের বয়, গৃহের গৃহভৃত্য। আমার সম্পদ ঠাসা সুদশ্য ব্যাগ তোমার মাথায়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া আমার পুত্রের হাত। তোমার হাতে। আমার মোজাইক করা মেঝেতে তোমার হাতের ন্যাতার দুবেলা ঘর্ষণ। আমার স্ত্রী-র ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রূপচর্চা তোমারই শ্রমের দান। আমার। সন্তুষ্টিই তোমার বেঁচে থাকার প্রাণরস। আমার অতীত ছিল বলেই বর্তমান আছে। বর্তমান আছে বলেই ভবিষ্যৎ তৈরি হচ্ছে। তোমার বর্তমান নেই, ভবিষ্যৎও নেই। আমার সামনে পথ তোমার সামনে দেয়াল।
যুগে যুগে অনেকেই এলেন, পৃথিবীর আদি বিলিব্যবস্থা কিন্তু বদলানো গেল না। এখানে নয়, কোথাও নয়। কত ইজম এল আর গেল। ছাপাখানা কোটি কোটি অক্ষর প্রসব করে গেল। লক্ষ লক্ষ কথামালা ইথার তরঙ্গে ভেসে গেল। হল না কিছুই।
আকাশছোঁয়া ইমারত উঠে গেল আকাশের দিকে। ফোর্ড থেকে ডাটসন। ভল্ল আর বর্ম থেকে মিরাজ, ফ্যান্টম, আণবিক ক্ষেপনাস্ত্র। বিদেশি শোষকের বদলে স্বদেশী শোষক। টিবির বদলে ক্যানসার। কলেরার বদলে জন্ডিস। অনাহার নাম পালটে সভ্য ম্যালনিউট্রিশান।
লাখ লাখ পিএইচডি, ডি লিট তবু বধূর গায়ে কেরোসিন, গলায় শাড়ি। নাটকে বিস্ফোরণ, যাত্রায় রণহুঙ্কার, সংগীতে সমুদ্রের দোলা, গণনৃত্য, গণমিছিল আবার গণধর্ষণ। টাই আঁটা সেমিনার ফাইলবাঁধা রিপোর্ট। সাপের সেই একই সর্পিল চলন, লাঠির সেই একই উদ্যত ভঙ্গি। কেউ কাউকে স্পর্শ করে না। আমসত্ব দুধে ফেলি /তাহাতে কদলি দলি/ পিপড়া কাঁদিয়া যায় পাতে। অধিকারীর জগতে অধিকারীর আইনই সাব্যস্ত। অনধিকারীদের শুধু মেনে নেওয়া আর মানানো। পৃথিবী এক অদ্ভুত স্থান।
এই সবুজ শ্যামল ভূখণ্ড
আর অগাধ জলরাশি,
অথবা ধু ধু মরু
আর শিলা সারি সারি
ঞ্চল আলোকিত জনপদ
অন্ধকার গ্রাম আর নিবিড় বনানী
আমরা সবাই জানি।
পর্যটক ঘুরে ঘুরে সবই দেখেছে।
পৃথিবীতে আর কোনো স্থান নেই
যেখানে কলম্বাস দিতে পারে পাড়ি।
এইবার!
আর এক পৃথিবীর খবর
আমি দিতে পারি
এই গোলকেরই আদলে
কায়ার পাশে ছায়ার মতো
মহাশূন্যে ভাসছে।
এই পৃথিবীরই এক ছায়া ছায়া
বিষণ্ণ বীভৎস রূপ
সেখানে হায়নারা ধরেছে
মানুষের কায়া
তস্কর পরেছে সাধুর বেশ,
জননী ডাকিনী সেজে
সন্তানের শোণিতে করে
তৃষ্ণা নিবারণ।
সে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল
দূষিত বাষ্পে ভরা
সেখানে চুম্বন শুধু
মৃত্যুর নিশানা
আমি সেইনভোচর
মহাশূন্যে নভোযান থেকে
রাতে,
দেখেছি সেই ছায়া ছায়া
বিষাক্ত দ্বিপদে ভরা
ধূমায়িত আর এক পৃথিবী।
আলো
সেকালটাই ছিল মজার কাল। সবেতেই মজা। বাড়িতে চোর পড়লেও মজা। চোরেরাও ছিল অন্যরকম। প্রকৃতই অভাবী মানুষ। পেটের দায়ে চোর। ছিচকে চোর। ঘটি, বাটি, গামছা, জামা, লোহার বালতি, তোলা উনুন, কেরোসিন তেলের বোতল, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাইতেই সন্তুষ্ট। কোনওক্রমে রান্নাঘরে ঢুকতে পারলে সেই মাঝরাতেই হাপুসহুপুস করে খানিক পায়েস খেয়ে নিলে।
কোনও ইজ্জত ছিল না তাদের। চরিত্রে আত্মসম্মান বোধটাই অনুপস্থিত। সেকালের চোর ধরা পড়লে গণপিটুনিতে মরত না। ভোর হওয়ার আগেই চড়চাপড় দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হত। সে ছিল শান্তির কাল।
একদিন মাঝরাতে চোর এসেছে! জ্যাঠামশাইয়ের ঘরে। খাটের কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখছে, ঘুম কতটা গভীর! জ্যাঠামশাইয়ের ভরাট মুখে অসাধারণ এক জোড়া গোঁফ ছিল, ইংরেজিতে। যাকে বলে, ‘হ্যান্ডলবার মুস্ট্যাশ।’ গোঁফ জোড়া দেখে চোর মুগ্ধ। আলতো করে টেনেছে।
জ্যাঠামশাই ঘুমোতে-ঘুমোতেই বলছেন—আসল, আসল। বিরক্ত না করে ডিবেতে কাশীর জর্দা দেওয়া পান আছে, দুটো খিলি মুখে পুরে চলে যা।
চোর বললে—কত্তা, রাতে খাওয়াই জোটেনি। শুধু-শুধু পান খেয়ে কী করব!
খুব রেগে গিয়ে জ্যাঠামশাই বলছেন—হতচ্ছাড়া! রাতের খাবারটাও জোটাতে পারিস না, চুরি করতে এসেছিস!
বালিশের তলা থেকে একটা পাঁচ টাকার নোট বের করে চোরকে দিয়ে বললেন—নে ধর।
পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে চোখ বুজিয়ে।
চোর বললে কত্তা, মাথাটা একটু তুলুন না, দেখি বালিশের তলায় আর কী আছে!
জ্যাঠামশাই বললেন—সমান দুভাগ করেছি। বউয়ের তবিল থেকে দশ ঝেড়েছিলুম, তোর পাঁচ আমার পাঁচ। একেবারে ন্যায়বিচার। ওই পাঁচ-ও দিতে পারি যদি আমার পা-দুটো টিপে দিস!
সে আমি দিচ্ছিখন। তোমার ঘরে খাবারদাবার কিচ্ছু নেই?
গাছপাকা দুটো আতা আছে তাকে। খবরদার ঘরের মেঝেতে বিচি ফেলবি না।
রাত আড়াইটের সময় আতা খেয়ে চোর পা টিপতে বসল। আবার জিগ্যেস করল কাল কী এই টাইমে আসব?
দুঃখ মেশানো গলায় জ্যাঠামশাই বললেন—সুখের দিনের আজই শেষ রাত্তির। কাল সকালেই ফিরে আসছেন বাপের বাড়ি থেকে। তুই বরং একটা কাজ করতে পারিস, এক ফাঁকে এসে বলে যেতে পারিস, টাকা দশটা তুই নিয়েছিস।
চোর বলল—মাপ করো কত্তা। মা ঠাকুরুনকে আমরা খুব চিনি। টাকা তুমি ফিরিয়ে নাও।
আর আতা!
কত্তা! সে তো খেয়ে ফেলেছি। এই লাইটারটা কাল চুরি করেছিলুম। তুমি রাখো। যা হয় কোরো।
আর একদিন চোর মাঠের ওপর দিয়ে দৌড়োচ্ছে, পেছন-পেছন আমার বলশালী কাকাবাবু ছুটছেন, ব্যায়ামবীর। তার পেছনে আমরা। ওপাশে চোর মুখ ঘুরিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে, এপাশে আমার কাকাবাবু। মাঝখানের ব্যবধান হাত পঞ্চাশ। এতক্ষণ হচ্ছিল দৌড়ের অলিম্পিক। এবার রেস্টলিং।