দুই কৃতকর্মভোগী কৃতী পুরুষ পাঁচুবাবুর রকে বসে ভাঁড়ের চা খাচ্ছে। মশা তাড়াচ্ছে। নর্দমার চাপা গন্ধ শুকছেন আর মনে মনে বলছেন, একেই বলে, বাঁশ কেন ঝাড়ে আয় মোর হিন্দিস্থানে। ভাঁড়টাকে সাবধানে পায়ের তলার বদ্ধ নর্দমায় বিসর্জন দিয়ে ভবেশ বললে, ভট করে চা খেয়ে। ফেললুম, বড় বাইরে পেলে মরব।
মরবে কেন? বাড়িতে গিয়ে নামিয়ে আসবে।
বাথরুম খালি পেলে তো! বারোটা শর্করারোগী মিনিটে মিনিটে ছুটছেন, আর প্রতিবার হাতে জল নিয়ে সেইখানে আর গোড়ালিতে শাস্ত্রসম্মত ঝাপটা মারছেন। চোখ বুজিয়ে বাথরুমের অবস্থাটা একবার অবলোকন করার চেষ্টা করো ভাই। কর্পোরেশনও লজ্জা পাবে।
তোমার বাথরুম? আমি মানসচক্ষে আমার বসার ঘর দেখছি আর আঁতকে আঁতকে উঠছি।
দীনবন্ধুর বসার ঘর ঠেসে গেছে। অনাহূতরা সারি সারি বসে আছেন বিশিষ্ট অভ্যাগতদের মতো। কাউকেই ফেরাবার উপায় নেই। শত্রুতা বেড়ে যাবে। বলে বেড়াবে বেটার অহংকার হয়েছে। ভগবানের গুনছুঁচ যেদিন বেলুন ফুটো করে দেবে সেদিন চামচিকির মতো চুপসে গাবগাছের তলায় পড়ে থাকবে। দীনবন্ধুর স্ত্রী শাপশাপান্তকে ভীষণ ভয় পায়। লাল আলোয়ান গায়ে ওই যে বসে আছেন মিনুর দিদিমা। দু-হাঁটুতে বাত। অন্য সবাই মেঝেতে কার্পেটের ওপর থেবড়ে আছেন, তিনি বসেছেন সোফায়। মুখপোড়া বাত আর জায়গা পেলে না, ধরল এসে হাঁটুতে। কত্তা যাবার সময় ওইটি দিয়ে গেলেন। গোবিন্দের মা কোণের দিক থেকে বললেন, ওকথা বলছেন কেন, কত্তা একটা বাড়ি রেখে গেছেন, তিনটি ছেলে দিয়ে গেছেন, চার মেয়ে। আর কী চাই?
আ মোলো কথার ছিরি দেখ। আমরা আজকালের বিবি ছিলুম না তোদের মতো। সারা জীবন পেটে একটা কিছু না থাকলে আমাদের কালো শরীরটা খালি খালি মনে হত। কত্তা গর্ব করে বলতেন, সুখদা আমার দুরকল, একটু ঠুকরেছ কী অমনি ঝপাং। হাত ঠেকালেই সোনা। তোমরা হলে ফাঁকিবাজ। একটা কি দুটো, অমনি ছুটলে। কাটিয়ে কুটিয়ে ফাঁকা হয়ে ফিরে এলে।
দীনবন্ধুর স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলল, কী হচ্ছে দিদিমা? বাচ্চারা বসে আছে।
তুমি আর সাউকুড়ি করতে এসো না। ওরা সব বাচ্চার বাবা। দেখলে না ঠুলির বিজ্ঞাপনের সময়। কীরকম হাসাহাসি করছিল! তুমি মা এযুগের মেয়ে। তুমি ওসব বুঝবে না। তোমরা হলে মেয়েমানুষ। আমাদের কালে মুতের কাঁতা শুকোতে পেত না। দাও এক গেলাস জল দাও। আ মর, সিনেমা বন্ধ করে মাগি সেই থেকে বকেই মরছে। আহা কী রূপের ছিরি! চুলে বব করে বসে আছেন। বুকের দিকে না তাকালে ছেলে কি মেয়ে বোঝে কার বাপের সাধ্য!
বুলডগের মতো মুখ করে মিনুর দিদিমা পাগলে পাগলে হাওয়া খেতে লাগলেন।
একেবারে লাগোয়া বাড়ির চার বউ রেলের পিস্টনের মতো আসা-যাওয়া করছেন! স্থির হয়ে বসার উপায় আছে কি? পাশে ছড়ানো সংসার। টিয়াপাখির ঠুকরে ঠুকরে পেয়ারা খাওয়ার কায়দায় চার বউয়ের টিভি দেখা চলেছে। ব্যোমে পায়রা বসার মতো। বড় বউ যেন দিশি গোলাপায়রা। বয়সের মাঝসমুদ্রে বয়ার মতো শরীর। তিনি একটি বেতের মোড়া দখল করেছেন।
তাঁর সন্তান-সন্ততিতে চারপাশে গোল করে মাকে ঘিরে রেখেছে। বসতে-না-বসতেই তাঁর খেয়াল হল, আলমারির গায়ে চাবিটা ঝুলিয়ে রেখে এসেছেন। সৃষ্টি পড়ে আছে আলমারিতে। দিনকাল ভালো নয়। বড়মেয়েকে বললেন, চাবিটা নিয়ে আয় তো। বড়মেয়ে ছবিতে মশগুল। প্রেমিক প্রেমিকাকে নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে গান ধরেছে, এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন। হত? লাল্লা লালা লালা। বড় বললে, থাক না। মা একটা চাপা হুঙ্কার ছাড়লেন, টিভি দেখা ঘুচিয়ে দেব তোর। মেয়ে অন্যমনস্কে উত্তর দিল, যাও যাও, সব করবে। মা হুঙ্কারে বললেন, দেখবি?
মিনুর দিদিমা বললেন, দুটোকেই বের করে দাও।
বড়বউ মুখ বেঁকিয়ে ভেংচি কেটে বললেন, কত বড় সাহস! যার ধন তার ধন নয় নেপোয় মারে দই। আপনি বের করে দেবার কে?
মিনুর দিদিমা হুঙ্কার ছাড়লেন দীনবন্ধুর স্ত্রীকে, বউমা, বউমা।
বড়বউ ততোধিক জোরে বললেন, বউমা কী করবে? বউমা এসে আমার মাথা কেটে নেবে?
টিভির পর্দায় নায়ক-নায়িকারা তখন কোরাসে চেল্লাচ্ছেন, লা লালা, লাল্লা, লাল্লা।
মেজোবউটি যেন সিরাজু পায়রা। লাট খেতে খেতে এলেন, এসেই বললেন, যাও, দেখগে যাও, তোমার নতুন সুজনিতে হোটর ছেলে পেচ্ছাব করেছে।
তোশক ভিজছে, তোশক ভিজেছে? বড়বউ মোড়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেই, ধাক্কায় মোড়া কাত হয়ে মহাদেবের ডম্বরুর মতো গড়াতে গড়াতে গদাইয়ের মার কোলের ছেলেটার মাথায় গিয়ে খোঁচা মারল। আঁচলচাপা ছেলে চুকুর চুকুর দুধ খাচ্ছিল। অষ্টপ্রহর তিনি চুষতে না পেলে চিল্লে বাড়ি মাথায় করেন, মোড়ার খোঁচায় বোঁটা ছেড়ে তিনি হাইফাই স্পিকারের মতো ওঁয়া ওঁয়া, হোঁয়া…ওঁয়াও করে মিউজিক ছাড়লেন। প্রেমিক-প্রেমিকার তুমি, তুমি, হুইসপার চাপা পড়ে গেল। মেজো পুতুলনাচের ধসে-পড়া পুতুলের মতো জমির হাতখানেক ওপর দিয়ে লাট খেয়ে একপায়ে ঝপাৎ করে বসে পড়ে বললেন, কার মিউজিক? কার মিউজিক রে?
পম্পা, শম্পা, চম্পা তিন বোন। বাপ-মা দুজনেই চাকুরে। মাথায় মাথায় তিন বোন। পম্পা শরীরের চেয়েও ঘেরে বড় ম্যাক্সি পরে, একবার করে আসছে, বসছে, আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। আসা আর যাওয়ার পথে পোশাকের ধাক্কায় সাইক্লোন বয়ে যাচ্ছে। প্রথমে উলটে গেল। টেবিলল্যাম্প। শেডফেড ছিটকে চলে গেল। মিনুর দিদিমা বললেন, দীনুর কাণ্ড দেখ। মাথার ওপর এত আলো, তাতে হচ্ছে না। ব্যাঙের ছাতার মতো আলো গজিয়েছে মেঝে থেকে।