কোন অপরাধে! নিজের স্ত্রীর কাছে থাকার অপরাধে? যে স্ত্রী একটা আধবুড়ো লোককে এনে নিজের শোবার ঘরে তোলে তার স্বামী বাইরের ঘরে ব্রথেল কীপারের মতো বসে বসে সিগারেট টানে।
ছাদের লোক দুটো কোথা থেকে এল? ওরা কার অপেক্ষায় ছিল?
আমার অপেক্ষায়।
মানে?
মানে খুব সহজ, আজ এখানে আমাকে আসতে বলা হয়েছিল। অ্যান্ড দে লেভ আউট এ নাইস মার্ডার প্ল্যান অর ট্র্যাপ। প্রফেশনাল মার্ডারারকে ছাদে মজুত রেখেছিল।
বিকাশমল্লিক বললেন, আমার কাছে খবরটা গেল কী করে! হু ইনফর্মড মি?
বিকাশ সুধেন্দুর হাতে একটা চিমটি কাটলেন; অর্থাৎ চুপ থাকো।
লোকটি একটু নার্ভাস হলেন। একটু ইতস্তত করলেন, সিগারেট ধরা হাত একটু কাঁপল। বিকাশের নজর এড়াল না। অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসাররা এই মুহূর্তে অপরাধীকে চেপে ধরেন। দুর্বল মুহূর্ত।
লোকটি বললেন, দ্যাটস মাই গুড ফরচুন। আপনি খবর পেয়েছিলেন বলে আমি এখনও বেঁচে আছি।
আপনার সব খবর, আপনার আসল উদ্দেশ্য সব আমরা জেনে গেছি। আপনি যাদের ওপর। নির্ভর করেছেন তারা খুব বেসামাল মানুষ। আপনার এই যুক্তি আদালত মানবে তো!
লোকটি আধখাওয়া সিগারেট অ্যাশট্রে-তে চেপে রেখে বাঁ দিকে একটু কাত হলেন। সেই অবস্থা থেকে সোজা হতে হতে বললেন, এই যুক্তিটা তো মানবে যে, আমি সত্যিই তনুকাকে। ভালোবাসি। আর, ভালোবাসা আর ঘৃণার খুব তফাত নেই মিঃ অফিসার। আমি যে গভীরতায় যে ইনটেনসিটিতে ঘৃণা করি, ঠিক সেই ইনটেনসিটিতে ভালোবাসি। আমি পাইলট, আকাশ আমার ঠিকানা।
লোকটি চকিতে রগে রিভলভার চেপে গুলি করলেন। সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েও কিছু করা গেল না।
তনুকা ছিটকে সামনে এসে দাঁড়ালেন। একেবারে স্থির পাথরের মূর্তি। সেই মূর্তির তলায় একটি নিহত মানুষ। আকাশযার ঠিকানা। দুর্বোধ্য মানব সংসারের মাথার ওপর বিশাল এক ছাদের মতো। কখনও নীল, কখনও কালো।
আজ আছি কাল নেই
কে, দীনবন্ধু নাকি? এখানে অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে আছ?
আরে ভবেশনাকি? তুমি এ সময়ে! কোথায় চললে? বাড়ি ঢুকলে না? আমার পাশ দিয়েই তো দুরমুশ করতে করতে গেলে, বেরিয়ে এলে কেন? অফিস থেকে ফিরলে, চা-জলখাবার খাবে। কুশল বিনিময় করবে সারাদিনের পর। এমন আধলা ইট-খাওয়া লেড়ি কুকুরের মতো মুখ কেন গো?
তোমার পাশে একটু স্থান হবে ভাই?
হবে, বারোয়ারি রক, ধুলো ঝেড়ে বোসো। বেশি ওপাশে যেয়ো না। কেলো এইমাত্র বেপাড়ার এক মস্তান কুকুরের সঙ্গে চুলাচুলি করে এসে সবে ন্যাজ গুটিয়ে শুয়েছে। মেজাজ চড়ে আছে। ঘাঁক করলেই তলপেটে চোদ্দোটা। ফুঁ হুঁ করে ধুলো উড়িয়ে ভবেশ বসে পড়ল। বসার সময় হাতের আঙুলে কী একটা ঠেকল। দীনবন্ধুর বাজারের ব্যাগ। কপি, মুলো, ভিজে ভিজে পালংশাক চারপাশে ছেদরে আছে। দীনবন্ধু অফিস থেকে ফেরার পথে রোজই বাজারটা সেরে আসে। অভ্যাসটা মন্দ নয়। শীতের ছোট্ট সকালে খানিক সময় বেরোয়। একটু তারিয়ে তারিয়ে দাড়ি কামানো যায়। নয়তো তাড়াহুড়োয় ধরো আর মারো টান। ছাল-চামড়া গুটিয়ে সাফ।
ভবেশ বলল, একী, বাজার নিয়ে বসে আছ? দু-কদম এগোলেই তো বাড়ি। বাজারটা রেখে এলেই পারতে। এই নোংরায় ফেলে রেখেছ? পালং-এ ইনফেকশান ঢুকবে।
দীনবন্ধু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হাতে ঘড়ি নেই, কটা বাজল তোমার ঘড়িতে?
আটটা বাজতে দশ।
উঃ এখনও ঝাড়া দেড় ঘণ্টা।
বুঝতে তাহলে পেরেছ কেন বসে আছি?
হ্যাঁরে ভাই পেরেছি একটু চা হলে মন্দ হত না।
এখান থেকে হেঁকে বিভূতিকে বলো, ভাঁড়ে দুটো চা। দুটো লেড়ো বিস্কুটও দিতে বলো।
দীনবন্ধু আর ভবেশ খানছয় বাড়ির ব্যবধানে থাকে। দুজনেই ভালো চাকরি করে। নির্বিরোধী ভদ্রলোক বলে পাড়ায় যথেষ্ট সুনাম আছে। এ তল্লাটে সস্তায় জমি পেয়ে দুজনেই বাড়ি তৈরি করে। স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে সংসারধর্ম পালন করছে। সেই কথায় আছে, খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে, কাল হল তাঁতির হেলে গরু কিনে। দুজনেরই বাড়ির ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে পাঁচটি করে অ্যালুমিনিয়ামের আঙুল আকাশের গায়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ খুঁজছে। চ্যাটালো তার বেয়ে সেই আশীর্বাদ ভেন্টিলেটার গলে কাচের পর্দায় কখনও নৃত্যে, কখনও কথকতায়, কখনও সংগীতে গলে গলে পড়ে। সবচেয়ে মারাত্মক দিন শনিবার। সেদিন হয় বাংলা, না হয় হিন্দি ছায়াছবি। গেরস্থের আর্তনাদ, পাঁচু প্রাণ যায়।
অদ্য সেই শনিবার। বাংলা ছায়াছবির আসর, অশ্রুসিক্ত ছবি। খটখটে ছবি হলেও দর্শকের অভাব হয় না। পালে পালে পিলপিল করে আসতে থাকেন নেণ্ডিগেণ্ডি, পুঁচিপেঁটকি নিয়ে। দীনবন্ধু টিভি কিনেছিল এরিয়ারের টাকায় স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে। আহা। একা একা বাড়িতে থাকে, সন্ধেটা তোমার ভালোই কাটবে। স্ত্রীও খুব নেচেছিল। টিভি আসবে শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে কচুরি ভেজে স্বামীকে খাইয়েছিল। জুট কার্পেট পাতা লবিতে টিভি সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। ছাদে ফোঁস করে ফুঁসে উঠল টিভিঙ্গুলি। সারা পাড়াকে জানান দিতে লাগল, আমি এসেছি, আমি এসেছি। তোমরা এসো হে। একবার বুঝিয়ে দিয়ে যাও, কত ধানে কত চাল।
ভবেশ টিভি কিনেছিল গৃহবন্দি, অবসরভোগীবৃদ্ধ পিতার সান্ধ্যসঙ্গী হিসেবে। দোতলায় পিতার সুবৃহৎ শয়নকক্ষে নীল পর্দা আঁটা সেই যন্ত্র এখন শক্তিশালী যন্ত্রণা। ডজনখানেক বিভিন্ন স্বভাবের বুদ্ধের পীঠস্থান। তাঁদের হাঁচি, কাশি, নাসিকাঝর্তন, কলহ, মতামত প্রকাশের ঘনঘটায় প্রতিটি। সন্ধ্যা ভবেশকে স্মরণ করিয়ে দেয়, য পলায়তি স জীবতি।