দুজনে সন্তর্পণে সিঁড়ি গুনে গুনে দোতলায় উঠলেন। অন্ধকার থইথই। বড় বড় ঘর তালাবন্ধ। কেবলই মনে হচ্ছে, অন্ধকারে ঘাপটি মেরে কেউ বসে আছে, এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে। বাথরুমের দরজাটা হাটখোলা। সুধেন্দু ফিশফিশ করে বললেন, দেখছ কাণ্ড! এর চেয়ে ভালো এন্ট্রি পয়েন্ট আর কী আছে! ঘোরানো সিঁড়ির দিকের দরজাটাও খোলা।
সুধেন্দু এক মুহূর্ত দেরি না করে তনুকার হাত ধরে বাথরুমে টেনে নিয়ে দু-পাশের দরজাই বন্ধ করে দিলেন। বাথরুমের আলোর সুইচ বাইরে।
তনুকা বললেন, কী ব্যাপার!
কেউ একজন দোতলায় আছে ঘাপটি মেরে। দোতলার সব ঘরই কী তালা বন্ধ?
না, দুটো ঘর খোলা আছে।
এই সার্ভিস ডোরটা খোলা কেন?
জানি না।
জমাদার আসে এখানে?
না।
তাহলে?
কাল একজন এসেছিল, ইলেকট্রিশিয়ান, গিজারের লাইন দেখতে।
তুমি আসতে বলেছিলে?
না, নিজের থেকেই এসেছিল।
কত দিনের লোক!
ওর পরিচিত।
আই সি।
আমাদের এখানে কতক্ষণ থাকতে হবে?
যতক্ষণ না পুলিশ এসে বাড়ি ক্লিয়ার করছে। তুমি এই গিজার ব্যবহার করবে না। আমার লোক এসে যতক্ষণ না ওকে বলছে।
বাথটবের পাড়ে দুজনে কোনওক্রমে বসলেন। নিস্তব্ধ অন্ধকার রাত। কোথাও সামান্য শব্দ হলেও শোনা যাচ্ছে। বাথরুমের বাইরে খুব সন্তর্পণে চলাফেরার শব্দ হল। তনুকা ভয়ে সুধেন্দুকে জড়িয়ে ধরলেন। জমাদার আসার দরজাটা বাইরে থেকে কে যেন ঠেলল একবার। লোহার সিঁড়িতে জুতোর তলায় বালি মাড়াবার শব্দ। দুটো প্রাণী আবদ্ধ খাঁচায়, বাইরে হায়নার দল। শুকছে, আঁচড়াচ্ছে।
বোঝা যাচ্ছে না–পুলিশের দল, এল কি এল না। টাইমিং ঘড়িতে দুটো বাজল। পুলিশের তো এসে পড়া উচিত। বাড়িটা সার্ভে করবে। তখন ঘোরানো লোহার সিঁড়িটানজরে পড়বেই। তনুকার শরীরটা ক্রমশ বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে সুধেন্দুর শরীরে এলিয়ে আসছে। সুধেন্দুর খুব। মায়া হল। মেয়েদের জীবন বড় কষ্টের। বড় হলে বাবা, মা ভাবে পর, আর স্বামী যদি শয়তান হয় ঘাটে ঘাটে ভেসে বেড়ানো। প্রকৃত বিশুদ্ধ ভালোবাসা দেওয়ার কেউ নেই। না ঘরকা, না ঘাটকা। এর ফলে মেয়েরা ক্রমশই মারমুখী, তিরিক্ষি স্বভাবের হয়ে উঠছে।
সুধেন্দুর প্রখর শ্রবণশক্তি। বহু দূরে একটা গাড়ির শব্দ হল। শব্দটা শুনেই মনে হল, একটা ভ্যান। বাঁধুনী আলগা। বহু ব্যবহারে পুলিশের গাড়ি যেমন হয়। সুধেন্দু আশ্বস্ত হলেন। বিকাশের ফৌজ এসেছে, এখন দেখা যাক অপারেশনটা কীভাবে চালায়। দেখা তো যাবে না, শব্দ শুনে বুঝতে হবে।
ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পরপর কয়েকজন ছাদের দিকে গেল। শব্দে তাই মনে হল। বাথরুমের মাথার ওপর ছাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ধস্তাধস্তির শব্দ। বাথরুমের বারান্দার বাইরে একটা শব্দ হল। কেউ একজন পালাচ্ছে নীচের দিকে। সুধেন্দু সার্ভিস ডোরটা সাবধানে খুললেন, নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অন্ধকারে দুজন দাঁড়িয়ে আছেন। সুধেন্দু বললেন, বিকাশ কোথায়!
এই তো আমি। কে সুধেন্দু?
হ্যাঁ উঠে এসো, ভেতরে একজন আছে।
দাঁড়াও, নীচের ব্যারিকেডটা তৈরি করি। সে ব্যাটা বাথরুমের জমাদারদের দরজা দিয়েই পালাবার চেষ্টা করবে।
বিকাশ মল্লিক অবশেষে দোতলার বাথরুমে এসে উঠলেন।
শেষে এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলে? জায়গাটা বেশ ভালোই।
কী করব, তা না হলে মেয়েটাকে মেরে ফেলত। তুমি দরজাটা খুলে ভেতরে যাও। আমি নীচের দিকে পালাবার শব্দ শুনেছি।
পুলিশের পাকা অফিসার বিকাশ বললেন, তোমরা দুজনে বাথটাবে শুয়ে পড়ো। ফায়ার করলেও সেফ থাকবে। সুধেন্দু আর তনুকাকে আদেশ মানতেই হল। বিকাশদরজার পাল্লাটা খুলতে খুলতে পাশে সরছেন। হঠাৎ গুলি করলেও গায়ে লাগবে না। বাইরে বেরিয়ে করিডরের আলো সব জ্বেলে দিলেন। কেউ কোথাও নেই। নীচে নেমে এলেন। পেছনে তাঁর সতর্ক প্রহরী।
সব শেষে তাঁরা এলেন বাইরের ঘরে। ফটফট করছে আলো। ফনফন করে পাখা ঘুরছে। সোফায় দিব্যি আরামে ঠ্যাং তুলে একজন স্বাস্থ্যবান লোক বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে।
বিকাশ তাঁর সহকারী, সুধেন্দু আর তনুকা ঘরে। সোফায় আরাম করে বসে আছে যে, সে কে!
বিকাশই প্রশ্ন করলেন, আপনি কে?
আলোর দিকে ধোঁয়া ছেড়ে লোকটি বললে, প্রশ্নটা তো আমারই করা উচিত, আমার বাড়িতে এই শেষ রাতে আপনারা কারা?
বিকাশ বললেন, মানে? আপনার বাড়ি মানে?
স্ত্রীর বাড়ি মানে স্বামীরই বাড়ি। সব দেশের আইনে সেই কথাই বলে মিস্টার পুলিশ অফিসার!
বিকাশ তনুকাকে জিগ্যেস করলেন, এঁকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ, একসময় আমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঠিকই, তবে আমি ডিভোর্স চেয়ে মামলা করেছি। সেই মামলা চলছে।
আপনারা যখন বাথরুমে ছিলেন, তখন ইনি কোথায় ছিলেন? এইখানে?
না।
তাহলে কোথায় ছিলেন?
জানি না।
সুধেন্দু এগিয়ে এসে বললেন, আমি বলছি, ইনি বাড়ির ছাদ দিয়ে দোতলায় ঘাপটি মেরে বসেছিলেন। উদ্দেশ্য খুব একটা সাধু ছিল না বলে মনে হচ্ছে। তুমি ছাদে যে-দুটোকে ধরেছ তাদের জেরা করলেই জানতে পারবে। যে লোকটা দোতলায় ঘুরছিল সেই তোমার তাড়া খেয়ে নীচে এসে না পালিয়ে এইখানে এসে জমিয়ে বসে পড়েছেন।
ধীরে-সুস্থে আর একটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে সেই লোকটি বললেন, আপনারা বসুন না, দাঁড়িয়ে কেন চা কফি কিছু খাবেন কি!
বিকাশ বললেন, সে পরে হবে, আপাতত আমরা আপনাকে একটু কষ্ট দেব, আমাদের সঙ্গে লালবাজারে যেতে হবে। সেখানেই আমরা আপনাকে চা খাওয়াব!