সুধেন্দু বললেন, এইবার আমি বিদায় হই। আপনি বিশ্রাম করুন।
সুধেন্দু উঠে দাঁড়ানো মাত্রই কেমন যেন একটা অনুভূতি হল। একটা শীত শীত ভাব। অনুভূতিটা পায়ের দিক থেকে উঠছে। সুধেন্দু জানেন, কী হতে চলেছে! আগেও কয়েকবার এমন হয়েছে। একটা সতর্কবাণী আসছে। কোনও একটা জরুরি খবর আসছে। কোথা থেকে আসছে, কী ভাবে আসছে জানা নেই। সুধেন্দুর মনে হয় হিমালয়ের সেই মহাত্মা, তিনি যেখানেই থাকুন, যে-ভাবেই থাকুন, সুধেন্দুকে জানিয়ে দেন, সাবধান হও। বিপদ আসছে। একবছর আগে একটা শুটিং-এর সময় এইরকম হয়েছিল। দৃশ্যটা ছিল, নায়ক রেগে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবে। সব রেডি, ক্যামেরা রেডি, লাইট, সাউন্ড রেডি। সুধেন্দু বলতে যাচ্ছেন—টেক—হঠাৎ সেই অনুভূতি। সুধেন্দু শুনতে পেলেন অদৃশ্য সেই শক্তি বলছে রিভলভারে গুলি আছে। সুধেন্দু সঙ্গে সঙ্গে রিভলভার চেয়ে নিয়ে পরীক্ষা করলেন। যথার্থই তাই। চেম্বারে গুলি। অর্থাৎ ঘোড়া টেপা মাত্রই অবধারিত মৃত্যু! কার কীর্তি, কে মারতে চেয়েছিল বাংলা সিনেমার টপ হিরোকে কোন স্বার্থে, অনুমান করা গেলেও কেউ অ্যারেস্ট হল না। যে প্রপার্টি সাপ্লায়ার সুধেন্দুকে মাল সাপ্লাই দিতেন, সুধেন্দু তাকে বাতিল করে দিলেন। চক্রান্তটা ওইদিকেই হয়েছিল, কারণ সুধেন্দুর সহকারীরা সবাই পুরোনো ও বিশ্বস্ত। নায়কের মৃত্যু হলে সুধেন্দুর জেল হত।
আর একবার একটা ক্রেন ছিঁড়ে নায়িকার ঘাড়ে পড়ত। সেবারেও সুধেন্দু এইভাবেই সতর্কবার্তা পেয়েছিলেন। একবার নয়, বারবার এমন ঘটনা ঘটতে থাকায় সুধেন্দু বুঝে গেছেন একটা শক্তি কাজ করছে। আজও সেই কারণে সোফায় বসে পড়লেন চোখ বুজিয়ে।
তনুকা ভয় পেয়ে জিগ্যেস করলেন, কী হল! শরীর খারাপ লাগছে! একটুব্র্যান্ডি দোব?
সুধেন্দু ইঙ্গিতে থামতে বললেন।
মিনিট পাঁচেক পরে চোখ খুলে জানতে চাইলেন, টেলিফোন আছে?
ওই তো আপনার পাশেই।
তনুকা দেখছেন, সুধেন্দু একটা নম্বর ডায়াল করছেন। কোথায় করছেন জিগ্যেস করার সাহস হল না। মানুষটা কেমন যেন বদলে গেছেন কয়েক মিনিটে। মুখে-চোখে অদ্ভুত একটা উত্তেজনার ভাব।
সুধেন্দু লাইন পেয়েছেন, হ্যালো লালবাজার! কে বিকাশ বলছ; আমি সুধেন্দু। শোনো, তোমাকে এখুনি একটা কাজ করতে হবে। তোমার কয়েকজন টাফ ম্যানকে, প্লেনের কথা বলছি না, প্লেন। ড্রেসে, যে ঠিকানাটা বলছি সেইখানে পাঠাও। প্রত্যেকেই যেন আর্মড থাকে।
সুধেন্দু তনুকাকে জিগ্যেস করলেন, আপনার ঠিকানা?
তনুকা একটু ইতস্তত করছেন। লালবাজার কেন? ঠিকানা কেন?
সুধেন্দু বললেন, কুইক, কুইক। টাইম ইজ রিয়েলি শর্ট।
তনুকা যথেষ্ট অবাক হয়ে বললেন, বাষট্টি।
সুধেন্দু আবার টেলিফোনে ফিরে গেলেন, শোনো বিকাশ, তোমাকে যা করতে হবে মন দিয়ে শোনো, খুব সাইলেন্টলি, স্টিলদিলি আসতে হবে। একেবার চোরের মতো, বেড়ালের মতো। তোমাদের গাড়িটা অনেক দূরে রাখবে। গাড়ির যেন কোনও শব্দ না হয়। এইবার বাড়িটাকে। নিঃশব্দে ঘিরে ফেলবে, আর চারজনকে যে ভাবেই হোক ছাদে পাঠাবে। সেখানে দেখবে দুটো আর্মড লোক বসে আছে, তাদের ইনটেনশান হল মার্ডার। এই বাড়িতে একজনই থাকে, মহিলা, তাকে মার্ডার করবে। আমি কেন এখানে? এর উত্তর আমিও জানি না। প্রভিডেনসিয়াল বলতে পারো। জাস্ট আই কেম। জাস্ট লাইক এ টম ক্যাট। পরে বলব। পরে বলব। আমার আসার মধ্যে রহস্য কিছু নেই, আবার আছেও।
সুধেন্দু ফোন রেখে ঘরের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। ফিলম ডিরেকটারের সন্ধানী। চোখ। তিনটে জানলা, দুটো বাইরের দিকে, একটা ভেতর দিকে। বাইরের দুটোর একটা রাস্তার ওপর, আর একটার ওপাশে সংলগ্ন বাড়ি। সেখানে একটা বারান্দা। বাড়িটার কোথাও আলো জ্বলছেনা। ভূতের মতো অন্ধকারের স্তূপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দশ বিশ গজ দূরে। বাড়িটার। চারপাশ বাগান দিয়ে ঘেরা। সুধেন্দু যে বাড়িতে বসে আছেন, সেটারও তিন দিক বাগান ঘেরা। পেছনের অনেকটা জমি, সেখানে একটা গ্যারেজ আছে। গাড়িও একটা আছে, কালেভদ্রে চলে। পেছনে বিশাল গেট আছে। গাড়ি সেই পথেই বেরোয়-ঢোকে। ওদিকে একটা কুখ্যাত বস্তি আছে। যত রকম পাপ আছে, সবই ওখানে অভ্যাস করা হয়।
সুধেন্দু নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বাইরের দিকের জানলা দুটো সাবধানে বন্ধ করে ছিটকিনি দিয়ে দিলেন।
তনুকার মুখ-চোখ দেখলে মনে হবে ভয় পেয়েছেন। সুধেন্দুর বুকের কাছে সরে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, চাপা গলায়।
কী হয়েছে?
তোমাকে খুন করার প্ল্যান হয়েছে।
কে করেছে?
তোমার স্বামী।
সুধেন্দু তুমিতে নেমে এসেছেন। আর আপনি বলতে পারছেন না। তনুকা এখন তার কেয়ারে। তার প্রপার্টি। অন্তত এই রাতটুকুর জন্যে। সুধেন্দু বললেন, ভয় পেয়ো না। একটা কথা, ছাদ থেকে নেমে আসার কোনও দরজা খোলা আছে কি?
না, সব বন্ধ।
দরজাগুলোর স্ট্রেংথ কেমন?
ভালোই।
তনুকা একটু জোরে কথা বলে ফেলেছিল। সুধেন্দু বললেন, আস্তে। তোমাদের বাড়ির পেছনে একটা ঘোরানো সিঁড়ি আছে তিনতলার ছাদ পর্যন্ত?
আছে। বাথরুমে ঢোকার জন্যে। বাবার আমলে জমাদাররা আসত।
ওপর আর নীচের বাথরুমের দরজা বন্ধ?
নীচেরটা বন্ধ, ওপরেরটা মনে পড়ছে না।
দেখে আসতে হবে।
আমার ভয় করছে, ভীষণ ভয়!
চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। আলো জ্বালবে না। অন্ধকারে পা টিপে টিপে।