হ্যা হ্যা হ্যা শালাকী কাণ্ড!
তবে কী জানেন এ ভালো হচ্ছে, ভালোই, সেক্স সম্বন্ধে আগেভাগেই জ্ঞান হয়ে গেলে অনেক ঝামেলা কমে যায়।
কী জানি মশাই! আমার বিয়ের আগে পর্যন্ত প্রজনন সম্বন্ধে কোনও জ্ঞানই ছিল না। আমি মনে করতুম, ছি ছি, এখন এই দু-ছেলের বাপ হয়ে বলতে লজ্জাই করে—মুখ দিয়ে কিছু খেলে তবেই বোধ হয়?
থাক থাক আর বলতে হবে না। পশ্চিম আকাশের রং বদলাচ্ছে, কটা বাজল বলুন তো?
আর কী? হয়ে গেল। এইবার ফেরার পালা। এইবার আমরা সব চলে যাব।
আচ্ছা কী ব্যাপার বলুন তো? ওই ভদ্রলোক তখন থেকে ক্রমান্বয়ে ওদের ছবি তুলে যাচ্ছেন নানা দিক থেকে!
কী করে বলব বলুন। আমিও তো আপনার মতোই এখানে আউটিং-এ এসেছি।
দিস ইজ ভেরি অবজেকশানেবল—কী বলেন? ওরা না হয় মশগুল হয়ে আছে, কিন্তু টের পেলে ক্যামেরা-ফ্যামেরা ভেঙে বারোটা বাজিয়ে দেবে। কেসও করতে পারে।
ওই দেখুন ওরা উঠে দাঁড়িয়েছে। আরেব্বাস—এবার একেবারে ম্যাক্সিমাম। ওই দেখুন, ওই দেখুন মেয়েটা কেমন বর্ষার উন্মুক্ত ফুলের মতো মুখ তুলেছে আর ছেলেটা যেন বৃষ্টির জলের। মতো ওর মুখের দিকে ঠোঁট নামিয়ে আনছে।
ইশ, দৃশ্যটা যা হয়েছে যেন ছবি! মশাই জীবনে যে এমন ঘটনা ঘটে, কারওর জীবনে ঘটে এ ধারণা আমার ছিল না।
এইবার দেখছেন, ক্যামেরা ভদ্রলোক যেন খেপে গেছেন। ওরা যেমন জড়িয়ে জড়াজড়ি করছে ইনিও তেমনি জমিয়ে ছবি তুলছেন।
দাঁড়ান, ভদ্রলোককে একটু চেক করে দিই।
কী মশাই—এত ছবি তোলার কী আছে অ্যাঁ?
এইসব ব্যাপার কি এনকারেজ করার জিনিস! বয়স থাকলে মশাই ওই দুটোকে পিটিয়ে ঢিবি ছাড়া করতুম। মশাই ছেলেমেয়ে নিয়ে এলুম একটা নৈসর্গিক দৃশ্য দেখব বলে। মশাই তাকানো যায় না।
ইয়ে ইয়েস, আর একটু…একটু ফাইন স্ন্যাপ। যা এল না, মারভালাস! আরে থামুন মশাই, কানের কাছে বকবক করবেন না। এইবার বাআআস কমপ্লিট। হ্যাঁ বলুন কী বলছিলেন?
বলছিলাম, ছবি তুলছিলেন, মানে ছবি তুলছিলেন কেন?
সে কী মশাই! হাঃ হাঃ সিগারেট চলবে? সারাদিন যা পরিশ্রম গেল, বাপস! এইটা হল লাস্ট শট —ফাইন এসেছে মশাই। পেছনে ব্রোঞ্জ রঙের আকাশ, আর সামনে সিলুয়েট হিরো-হিরোইন। এমনি করে দাঁড়িয়ে, টেরিফিক! যেমন ডিরেকশন, তেমনি ক্যামেরা। ইস্টম্যান কালার।
মানে এটা নিয়ে কী বলে সিনেমা হবে?
তবে কী? জলছবি, ছায়াছবি, জলছবি, ছায়াছবি, হুহু। প্যাক আপ কল্যাণ। স্ট্রেট টু হোটেল। একটু সরে দাঁড়ান স্যার—অ্যা অ্যাদ্যাটস ফাইন।
আরে মশাই দেখেছেন! জীবন সার্থক। অতবড় হিরো-হিরোইনকে চোখের সামনে এতক্ষণ দেখলুম। ছি ছি, আমরা এতক্ষণ কী যা তা বলছিলুম অ্যাঁ!
আমি আগেই বলেছিলাম—এসব সাধারণ লোক নয়। আরে ভাই দেশ এখনও অত অনাচারী হয়ে ওঠেনি। কী জেনুইন অভিনয়, তাই না, যেন রিয়েল লাইফ ড্রামা!
আমার স্ত্রী ওদিকে ছিলেন তা না হলে দেখতেন, ও ভীষণ ফ্যান, একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। সত্যি কথা বলতে কী আমার একটু জেলাসিই আছে। আমি ওই নায়কের বই সাধারণত দেখতে চাই না।
আমার ছেলে মশাই বাচ্চা, খুব বড় নয়। একদিন দেখি কী মশাই ওর জামার পকেট থেকে বেরোল একটা ছবি, সে ছবি মশাই ওই হিরোইনের।
ওই দেখুন সাদা বিরাট বড় গাড়িতে ওরা চলে গেল। যেন একটা সাদা হাঁস। কী জীবন তাই না!
কিন্তু দেখছেন জীবনটা ভীষণ হলো। এই অভিনয় করছে, হাসছে, কাঁদছে, কিন্তু কোনওটাই রিয়েল নয়, যেন আলুনি তরকারি।
মানে অনেকটা এই যখন আমরা সব একে একে চলে যাব তখন যেমন এই বিশাল প্রান্তর শূন্য পড়ে থাকবে, তেমনি ওদের মন—একেবারে ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই।
তাহলে আমরা এবার উঠতে পারি। এই পলিথিন-মলিথিন সব গুটিয়ে ফেলা যাক। আবার কোনওদিন আসব আমরা এইখানে সূর্য্যাস্ত দেখতে।
একটি-দুটি করে গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলে গেল। কাঁধে ক্যামেরা, বাইনোকুলার অথবা ফ্লাস্ক কিংবা সাইডব্যাগ ঝোলানো কিছু মেয়ে-পুরুষ সেই ঝাপসা অন্ধকারে অস্পষ্ট গুঞ্জন তুলে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
দিন চলে যায়
আমি যে হারানোর কথা বলছি তার জন্যে কেউ কখনও সংবাদপত্রের হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ স্তম্ভে বিজ্ঞাপন দেবেন না। এই হারানো আমাদের জীবনে এতই অনিবার্য যার জন্যে আমাদের স্থায়ী কোনও ক্ষোভ নেই। সময় সময় এমনই উদাসীন, কী হারাল বুঝেও বুঝি না, ভেবেও ভাবি না। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্ত হারিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে দিনে। গাছের পাতা যেমন ঝড়ে যায় তেমনি আবার নব কিশলয়ে নবীন হয়ে ওঠে। কিন্তু জীবন থেকে যে মুহূর্ত প্রতিনিয়ত সময়ের স্রোতে অনন্তের দিকে ভেসে চলেছে, তারা কোথায় গিয়ে কোন সাগরের মোহনায় পাললিক ব-দ্বীপ তৈরি করছে, জীবন জানে না। জীবনের ঘূর্ণাবর্তে পড়ে হারিয়ে যাওয়াই হল এর ধর্ম।
যে-কোনও মানুষই জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গেই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য। এর কিছুটা আপেক্ষিকভাবে স্থিতিশীল, কিছুনশ্বর। যেমন, যে বাড়িতে জন্মেছিলাম, সেই বাড়িটা এখনও আছে, আরও শখানেক বছর হয়তো থাকবে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে কিছু প্রাচীন হয়েছে, যৌবনের চেকনাই হয়তো নেই, তবু পুরোনো বাড়িটা তার অস্তিত্ব বজায়। রেখেছে। উত্তরের দিকের দৌড়-বারান্দা, যে বারান্দায় আমি শৈশবে ট্রাইসাইকেল চালাতাম, সেই বারান্দাটা যেমন ছিল তেমনই আছে। কিন্তু শৈশবে ঠিক বেলা তিনটের সময় মুখে পান দোক্তার খিলি পুরে যে দুর্গার মা বারান্দা মুছত সে আর নেই। ট্রাইসাইকেলটাও নেই। আমি কিন্তু আছি। এখন বলাইয়ের মা বারান্দা মোছে। তখন যেন ক্ষণিকের জন্যে অতীত উঁকি দিয়ে যায়। অস্পষ্ট, ঝাপসা শৈশব, জল উড়ে যাওয়া আয়নায় হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে আবার ঝাপসা হয়ে যায়। বলাইয়ের মাকে দুর্গার মা বলে ভাবতে ইচ্ছে করে।