অপরেশের মনে আজকাল একটা ক্ষীণ আপোশ ধূপের ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে ওঠে। জীবন কোনও প্রতিশ্রুতির সীমানা চিহ্ন থেকে শুরু হয়নি। সাধারণ শিক্ষার সাধারণ কেরানি। অল্পসল্প লেখার বাতিক ছিল। খ্যাতি এল অতি ধীর পায়ে। জীবনের মধ্য সীমানা। রমলাকে যখন বিয়ে করলেন তখন জীবনে রমলাকে বেমানান মনে হয়নি, মেনে নিতে কোনও অসুবিধে হয়নি। এখন কিন্তু একটু অন্যরকম মনে হয়। মনে হয় সংসারে কাজের লোক পেয়েছেন, সন্তানের জননী পেয়েছেন, সেবার মানুষ পেয়েছেন, কিন্তু মনের কোনও সঙ্গী পাননি। শিলাবতীকে রমলার। আসনে বসালে কেমন হয়? ট্রেনের কামরার ওপ্রান্তে নয়, একেবারে অপরেশের পাশে, কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে। পরিপাটি পরিচয্যায় ফুরফুর তৈলবিহীন চুল হাওয়ায় উড়ে মাঝে মাঝে মুখে এসে লাগছে। সিল্কের শাড়ির আঁচল উড়ে উড়ে আসছে। গাঢ় নীল ব্লাউজের আবরণ পেরিয়ে শরীরের চিকন শুভ্র অংশে অপরেশের চোখ পড়ছে। অবাঙালি তিনজন কী এক রসের কথায় হইহই করে হেসে উঠলেন। বাঙালি ভদ্রলোক দুজনের একজন ব্রিফকেস খুললেন, ফটফট করে শব্দ হল, বন্দুকের গুলির মতো! ভদ্রমহিলা বই থেকে চোখ তুললেন। চোখাচোখি হল অপরেশের সঙ্গে। অপরেশ একটু অপ্রস্তুত হলেন।
বাইরেটা আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। অন্ধকার নদীপ্রান্তর দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে আলোর বিন্দু আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। অপরেশ চোখ বুজলেন। শিলাবতী কি রমলার আসনে বসতে পারবে! ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় ভালোই মানাবে। কিন্তু কলকাতার বাড়িতে? কাকডাকা ভোরে স্নান সেরে শিলাবতী কি বেড-টি দিতে পারবে? পারবে তার পঙ্গু মা-র সেবা করতে? পারবে অপরেশের পাঞ্জাবি কেচে পরিপাটি করে ইস্ত্রি করে দিতে?
শিলাবতীকে জননীর আসনে, গৃহকত্রীর আসনে বসাতে অপরেশের কষ্ট হল। শিলাবতী কমরেড, শিলাবতী স্ত্রী, শিলাবতী জননী নয়। অসম্ভব! প্রকৃতির নিয়মে শিলাবতী হয়তো গর্ভবতী হবে, জননী হবে না। হতে পারে না। শিলাবতীর স্থান তাহলে কোথায়! সাহিত্যিক অপরেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। শিলাবতীকে নিয়ে তিনি কী করবেন! কলকাতার কোনও নামজাদা। হোটেলে উঠবেন। কিংবা আলিপুরের কোনও বাড়িতে! নিজের জীবনধারায় শিলাবতীকে স্থান। দিতে পারলেন না অপরেশ। তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানকে শিলাবতীর গলা জড়িয়ে ধরতে দিয়ে অপরেশ মনের চোখে দৃশ্যটা ভাবার চেষ্টা করলেন, ভালো লাগল না। শিলাবতী পোষা কুকুরের উপদ্রব সহ্য করবে কিন্তু নিজের সন্তানের গ্রাম্য আদরে অতিষ্ট হয়ে উঠবে। ঝকঝকে গাড়ির পেছনের আসনে কুকুর রেখে শিলাবতী পশু চিকিৎসালয়ে যেতে পারে, কিন্তু তোয়ালে মুড়ে নিজের সন্তানকে কোলে ফেলে রিকশা চেপে রাজপথ দিয়ে কোনও হাসপাতালের আউটডোরে যেতে পারে না যাওয়া উচিতও নয়। অপরেশ অবশেষে হাল ছেড়ে দিতে চাইলেন। রমলাকে সামনে রেখে তিনি চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেন, কল্পনাকে প্রসারিত করতে পারেন; শিলাবতীকে নিয়ে। নয়। শিলাবতীর জীবন পরিকল্পনার কোনও খবরই তাঁর জানা নেই। অপরেশ আবার চোখ বুজলেন। একটু তন্দ্রার মতো আসছে। অনেক ভোরে তিনি ঘুম থেকে উঠেছেন।
ইয়ার্ডে ট্রেন ঢুকছে। অজস্র আলোর লাল চোখ সাঙ্কেতিক ভাষায় ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছে। অদৃশ্য কলকজার চাপে এক লাইন থেকে আর এক লাইনে ট্রেন পাশে হেঁটে হেঁটে প্ল্যাটফর্ম ছুঁতে চলেছে। রাত প্রায় দশটা। দূরপাল্লার অধিকাংশ ট্রেন বেরিয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মে তেমন ভিড় নেই। শিলাবতী আগে আগে চলেছেন। কাঁধে ফ্লাস্ক, হাতে দামি সুটকেস। অপরেশ পিছনে। শিলাবতীর চালচলন, ব্যক্তিত্বের ছাপ মনে ধরে রাখতে চাইছেন। দৃশ্যটা চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে। হঠাৎ দেখা, আবার মিলিয়ে যাওয়া।
স্টেশনের বাইরে একটা মেরুন রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। নতুন ঝকঝকে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধ। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ঋজু বনেদি চেহারা। হাতে ওয়ালনাটের ছড়ি। পায়ে ভেলভেটের চটি। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন একজন মহিলা। কোলে একটি ফুটফুটে দুরন্ত শিশু। মুখের ভাবে শিলাবতীর আদল আসে। শেষ দৃশ্যটা দেখার জন্যে অপরেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
শিলাবতী দ্রুত বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে পায়ে হাত দিয়ে বৃদ্ধকে প্রণাম করলেন। বৃদ্ধ বুকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত রাখলেন। বুদ্ধের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে শিলাবতী মহিলাকে। চুম্বন করার ভঙ্গি করলেন, শিশুটিকে ছিনিয়ে নিলেন নিজের কোলে। শিশুটি একহাতে শিলাবতীর চুল খামচে ধরল। কষ্টে কেশ মুক্ত করে শিশুটিকে আদরে আদরে অস্থির করলেন। শিশুটি কেঁদে ওঠায় সকলে সমস্বরে হেসে উঠলেন। মিলন পর্ব শেষ হল। গাড়ির দরজা খোলা ও বন্ধের শব্দ হল। বৃদ্ধই গাড়ি চালাবেন।
অনেকক্ষণ হল গাড়িটা চলে গেছে। পেছনের লাল আলো অপস্রিয়মাণ স্মৃতির মতো পথের বাঁকে মিলিয়ে গেল। নির্জন রাস্তায় অপরেশদাঁড়িয়ে। মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। একটা খালি ট্যাক্সির প্রয়োজন কিন্তু শিলাবতীদের চিন্তায় এতই আচ্ছন্ন যে দৌড়ঝাঁপ করার শক্তিটাই যেন চলে গেছে। কাপড়ের কোঁচা লুটোচ্ছে পায়ের কাছে।
ধূপের ধোঁয়ার মতো ক্ষীণ আক্ষেপ যেন হঠাৎ দাউদাউ করে জ্বলে উঠছে। শিলাবতীকে সহজেই রমলার আসনে বসানো যায়। বসন্তকালের মতো হাওয়া দিচ্ছে। অপরেশের মনে হল সে যেন কতকালের বিরহী। দুঃসহ একটা বেদনার বোঝা নিয়ে রাজপথে মধ্যরাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই অবস্থায় কেউ যদি তাকে হাত ধরে নিয়ে যায় ভালো হয়। শিলাবতীকে নিয়ে সে উপন্যাস লিখবে। তার পরবর্তী কাহিনির নায়ক হবে অপরেশ, নায়িকা শিলাবতী। কী নাম রাখবে? সারাটা পথ একটা নামের সন্ধানে কখন ফুরিয়ে গেল অপরেশ টের পেলেন না। মনে হল সময় ইদানীং বড় সংক্ষিপ্ত।
জলছবি
আমরা তখন সকলে সবিস্ময়ে সেই উঁচু ঢিবির দিকে তাকিয়ে রইলুম। দিগন্তে তখন সূর্য অস্ত যেতে বসেছে। সারা আকাশ তামাটে লাল। সেই সূর্য্যাস্তের দিকে মুখ করে ওরা দুজনে বসে আছে। মেয়েটির মাথা রয়েছে ছেলেটির কাঁধে। ছেলেটির হাত মেয়েটির কোমর জড়িয়ে রয়েছে। আমরা যারা ছুটি কাটাবার জন্যে সেই প্রান্তরে সমবেত হয়েছিলাম, কাঁধে জলের ফ্লাস্ক, হাতে খাবারের বাস্কেট নিয়ে, তারা এই অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যথেষ্ট রোমান্টিক অথচ একেবারে নির্লজ্জ সেই দৃশ্য দেখে মুখে ছিঃ ছিঃ করলেও মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। আমরা অনেকেই সে মুহূর্তে কল্পনায়, ছেলেটিকে মেয়েটির পাশ থেকে সরিয়ে নিজেদের পাশে বসাবার চেষ্টা করছিলাম।