মনটা ভারাক্রান্ত হল। পুত্রলাভের আনন্দের অনেকটাই পুত্রশোকের ব্যথায় যেন মিলিয়ে গেল।
—আমার জন্যেই হল ভাই।
—দুর দাদা, কী যে বলেন, ও তো হবেই। আমরা এই আছি এই নেই। আপনি কিছু ভাববেন না। এখন শালা ডেডবডি বার করাই মহা হ্যাপা, পোস্টমর্টেম হবে, মর্গে যাবে। সেই বডি পচে ফুলে উঠবে, তবে শালারা ছাড়বে।
—তোমরা একদিন এস ভাই একটু মিষ্টিমুখ করে যাবে।
—কী যে বলেন দাদা। আমাদের চেনেন না তাই। পাড়ার খবর তো রাখেন না। আমাদের সঙ্গে বেশি দোস্তি মানেই জানেন তো—এই। পিন্টু গলার কাছে হাতের চেটো নেড়ে একটা ভঙ্গি করল যার মানে—জবাই। পিন্টু সিগারেট খেতে খেতে করিডরের আলোছায়ায় মিলিয়ে গেল।
চরিত্র
ট্রেন ছেড়ে দিল। ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম পেছনের দিকে সরে যাচ্ছে। অপরেশ জানালার ধারে গুছিয়ে বসলেন। স্টেশনে যাঁরা বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাঁদের হাসিজড়ানো সসম্রম মুখের দিকে অপরেশ শেষবারের মতো তাকালেন। জোড়া জোড়া হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে এখনও বুকের সামনে ঝুলছে। অপরেশ তাঁর মুচকি হাসি, ছড়ানো প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে:নিলেন। সবই তাঁর মাপা। সময়ের ফিতে তাঁর পকেটে ঘোরে। তাঁর সাহিত্যও ওই একই গুণে সমৃদ্ধ।
অপরেশ পকেট থেকে একটা দামি লম্বা সিগারেট বের করে ধরালেন। দুটো দিন অনেক সভা সমিতি করলেন। সাহিত্যের আলোচিত-অনালোচিত বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক সারগর্ভ কথা এই শহরের মানুষকে শুনিয়ে গেলেন। কজন বুঝেছে সন্দেহ। এই সব শিল্পশহরের যান্ত্রিক মানুষ সাহিত্যের কিছু বোঝে বলে মনে হয় না। খায়দায়, বংশবৃদ্ধি করে আর প্রসাধনের মতো মাঝে মাঝে সাহিত্য শিল্প ধর্ম আদর্শকে পাউডারের মতো ঘাড়ের কাছে লেপটে ঘুরে বেড়ায়। মহান। সাহিত্য, মহৎ শিল্পকর্ম, দর্শনের গাম্ভীর্য বোঝার ক্ষমতা হাজারে একজনের হয়তো থাকে, তাঁরা কেউ এই ধরনের সভায় আসেন না। তবু এই সব সভায় আসতে হয়, তা না হলে জনপ্রিয়তা থাকে না। জনপ্রিয়তা না থাকলে বই বিক্রি হয় না। জানালার বাইরে দৃষ্টি ফেলে রেখে অপরেশ এই সব ভাবছিলেন। তাঁর আশে-পাশে কারা বসে আছেন ভ্রক্ষেপ করার প্রয়োজনও বোধ। করেননি। মানুষ সম্পর্কে চিরকালই তাঁর একটা উপেক্ষার ভাব আছে।
সন্ধে হয়ে এল। বাইরেটা ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে। প্রথম শ্রেণির কামরা। আদৌ ভিড় নেই। বসার সময় অপরেশ একপলকে যেটুকু দেখেছিলেন, সারা কামরায় জনা ছয় যাত্রী বসে আছেন। তিনজন অবাঙালি, মনে হয় ব্যবসায়ী। দুজন বাঙালি। হয়তো উচ্চপদে চাকরি করেন। আর একজন মহলা। বাঙালিও হতে পারেন, অবাঙালিও হতে পারেন। আধুনিকাদের জাত বোঝা
অপরেশ ভেবেছিলেন অবাঙালি তিনজন না হলেও বাঙালি দুজন এতক্ষণে যেচে তাঁর সঙ্গে আলাপ করবেন। ট্রেন ছাড়ার প্রাক্কালে সকলেই তাঁর বিদায়পর্ব লক্ষ করেছেন। অপরেশ যে অবশ্যই একজন মানী-গুণী মানুষ তা-ও বুঝেছেন। অপরেশনিজে আলাপ করেননি; করবেনও না; কিন্তু সহযাত্রীদের করা উচিত ছিল। অবাঙালি তিনজন ব্যবসার কথা বলে চলেছেন। বাঙালি দুজন অফিসের কথা। ভদ্রমহিলা ট্রেন ছাড়ার আগেই হ্যাডলি চেজ খুলে বসেছেন। কোনও দিকেই তাঁর দৃকপাত নেই।
অপরেশ ভদ্রমহিলার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। সামনে আয়না নেই। তবু মনে হল তাঁর দৃষ্টিতে হয়তো একটু লোভ, কিংবা কোনও আকাক্ষা চুইয়ে পড়তে চাইছে। যে দৃষ্টি শিশুর চোখের মতো উদাস নয়, অর্থহীন নয়, তেমন দৃষ্টি দিয়ে কোনও সুন্দরী মহিলাকে দেখা অপরাধ। অপরেশ চেষ্টা করলেন কিন্তু পারলেন না। একটা সুডৌল, সুগৌর হাতের ওপর তাঁর চোখ দুটো আটকে রইল।
কী নাম হতে পারে মহিলার! অপরেশ একটা নাম রাখলেন—শিলাবতী। তাঁর পরবর্তী কোনও উপন্যাসের চরিত্রে শিলাবতীকে প্রতিষ্ঠিত করতে আপত্তি কী! বয়স পঁচিশ থেকে ছাব্বিশের মধ্যে। ইংরেজিতে এম.এ। কলকাতার বাইরে কোনও কলেজের অধ্যাপিকা। অবিবাহিতা। এর পর কী হবে! ছক বাঁধা রাস্তায় কোনও সহকর্মী প্রেম নিবেদন করবেন। প্রত্যাখান। আত্মহত্যা। অপরেশ নিজের কল্পনার দীনতায় মনে মনে একটু হাসলেন। জীবন থেকে কাহিনি কত দূরে সরে যেতে চায়! অপরেশ একটু অপ্রস্তুত হয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। মহিলা পাশে রাখা একটা ফ্লাস্কের দিকে হাত বাড়ালেন।
অপরেশ যখন আবার তাকালেন মহিলা তখন ছোট ছোট চুমুকে চা খাচ্ছেন। অপরেশের মনে হল তিনি একটা সুখের ছবি দেখছেন। চলন্ত ট্রেনে বই পড়া। চা খাওয়া। ঈষৎ আয়েশ করে বসা। যে জীবনে সুখ আছে, যে জীবনে ভ্রমণ আছে, রহস্য উপন্যাস আছে, ফ্লাস্কের চা আছে, সে জীবন। প্রেমের ফাঁদে পড়বে না। প্রেমে সুখ নেই। প্রেম আষ্টেপৃষ্টে দুঃখের ফাঁদে বাঁধা। শিলাবতীর জীবন শুরু করবেন বিবাহের পর থেকে। ডাক্তারের স্ত্রী শিলাবতী। কলকাতায় চলেছে মার্কেটিং-এ। শিলাবতীর প্রাক-বিবাহিত জীবনের ছবি আঁকার ক্ষমতা বা অভিজ্ঞতা—কোনওটাই নেই অপরেশের।
অপরেশ চায়ের একটা ভীষণ তৃষ্ণা অনুভব করলেন। প্রথম শ্রেণিতে বসে প্ল্যাটফর্মের ভাঁড়ের চা খাওয়া চলে না। অপরেশ চায়ের আশা ছেড়ে দিলেন। চা জুটবে আবার কাল সকালে। ভোরবেলা বিছানার কাছে টিপয়ের ওপর রমলা এক কাপ চা রেখে যাবে। আজ বিশ বছর ধরে এর কোনও ব্যতিক্রম হয়নি। কী শীত কী গ্রীষ্ম। রমলা অপরেশের নিতান্ত সাদামাঠা স্ত্রী। তিন সন্তানের জননী। অপরেশ খ্যাতিমান সাহিত্যিক না হয়ে কোনও কারখানার শ্রমিক হলেও রমলার কিছু এসে যেত না। নিতান্তই সাংসারিক স্ত্রী। সংসারধর্ম ছাড়া তার বাড়তি কোনও আকাঙ্ক্ষাও নেই। মোটাসোটা শ্যামবর্ণ নিতান্তই এক মহিলা। ইদানীং একটু সন্দেহপ্রবণও বটে। রং এবং শরীরের জন্যে একটু হীনমন্যতাও বোধহয় দেখা দিয়েছে। কোনও পাঠিকা প্রশংসা করে চিঠি লিখলে রমলা আজকাল কেমন যেন কঠোর হয়ে ওঠে। কোনও সুন্দরী পাঠিকা হঠাৎ অপরেশের সঙ্গে দেখা করতে এলে রমলা প্রথমে কিছু বলে না, পরে গভীর রাতে বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এ এক ভালো জ্বালা হয়েছে!