—পন্টু, দাদা কী বলছে রে! কী করতে হবে আমাদের?
—একটা গাড়ি ভাই। কোনও রকমে আমার স্ত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছে দিতে হবে। আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। তোমরা ছাড়া।
—ঠিক আছে, বিশু তুই ঝট করে একটা রিকশা ধরে নিয়ে আয়। শালারা এমনি আসতে চাইবে। জোর করে ধরে আনবি। কাছাকাছি যে ডাক্তাররা আছে তাদেরও তো পাবি না, সব লকার এ বসে আছে। শালা প্রাণের কী মায়া! একটা গোঙানির আওয়াজ আসছে?
—ওই তো, ওই তো আমার স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছে।
—শালা ঠিক মার্ডার করলে যেমন আওয়াজ হয় তেমনি হচ্ছে।
—পন্টু, তোর কোনও বুদ্ধি নেই, একে বলে প্রসববেদনা। আমাদের মায়েদেরও এমনই হয়েছিল, বুঝেছিস!
বিশু নামক ছেলেটি একটা রিকশা ধরে নিয়ে এল। ঘুম জড়ানো চোখ অথবা নেশার ঘোরে রিকশাওয়ালা জিগ্যেস করল কোথায় যেতে হবে? হাসপাতালে। দাদা, সময় আমাদের কম, বউদিকে নামান, গোটা কতক বালিশ আনবেন, বেশ করে সাজিয়ে বউদিকে আরামে বসান, কিংবা কোলে নিন। একলা নামাতে পারবেন?
দেখি চেষ্টা করে।
ওরা পাঁচজন নীচে দাঁড়িয়ে রইল, আর আমি একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে গেলুম। কাবেরীর তখন অন্তিম অবস্থা। যন্ত্রণা যে কত ভয়ানক! একটা প্রাণ পৃথিবীতে আসতে চাইছে, সে যে কী অসহ্য দৃশ্য, জন্ম যে এত বেদনাদায়ক, আমার জানা ছিল না।
কাবেরীকে কোনওরকমে পাঁজাকোলা করে তুলে সবে সিঁড়িতে পা রেখেছি প্রচণ্ড শব্দে একটা বোমা ফাটল, কাবেরী চমকে উঠল, যন্ত্রণা যেন সাময়িকভাবে অপসৃত হল, অন্যরকম একটা আতঙ্কে। বারুদের গন্ধ এল নাকে, একটা আগুনের ঝিলিক, কিছু শক্ত কঠিন জিনিস দেওয়ালে, কাচে লাগল। সিঁড়ির শেষ ধাপে দরজার সামনে তখন ধোঁয়ার কুণ্ডলি।
কিন্তু এ কী! দরজার সামনে বিশু পড়ে আছে রক্তাক্ত। ক্ষতবিক্ষত, জীবন আছে কি নেই বোঝা যাচ্ছে না। রিকশা দাঁড়িয়ে আছে, রিকশাওয়ালা নেই, নেই আর চারটি ছেলে। কাবেরীর যন্ত্রণা আবার ফিরে এল। আমার জামাটা খামচাতে লাগল, দাঁত দিয়ে টুকরো টুকরো করল শাড়ির আঁচল। ভাবছি এখন কী করব! তারা কোথায়? হঠাৎ অন্ধকার থেকে পন্টু বেরিয়ে এল—ভাববেন না কিছু বউদিকে বসান রিকশায়।
—কিন্তু বিশু, বিশুকে তো আগে হাসপাতালে নেওয়া দরকার। ও কি বাঁচবে? দৃশ্য দেখে কাবেরী তখন মূৰ্ছিত।
—আপনি কিছু ভাববেন না দাদা, আমরা মরতেই জন্মেছি, ওকে আমরা কাঁধে করেই নিয়ে যাব। আর সময় নেই, আপনি উঠে বসুন, ব্যাটা রিকশাওয়ালা ভয়ে ভেগেছে, আশেপাশেই আছে ধরে আনছি।
ইতিমধ্যে অন্ধকার ঠেলে ঠেলে আর তিনটে ছেলে ফিরে এল।
—শালা, ওরা তিনজন ছিল। দুটো পালিয়েছে, একটাকে খতম করেছি। শালা, কী রক্ত মাইরি, যেন পিচকারি। মানুষের শরীরে এত রক্ত থাকে! দেখ, জামা-প্যান্টের কী অবস্থা।
—তুই আর এগোসনি, বউদি ভয় পেয়ে যাবে। তোরা একজন রিকশাওয়ালাকে ধরে নিয়ে আয়, তারপর চল, বিশুটাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাই। যদি বাঁচে।
রাত তখন কটা! হাসপাতাল যেন ক্লান্ত; মৃদু আলোকিত করিডর, সারি সারি নিদ্রিত রোগী। কোথাও কোনও রোগী আধবসা, ঘুম তার আসছে না, কেউ কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়। ওয়ার্ড খালি, কোথায় নার্স, কোথায় হাউস সার্জেন। কিন্তু এতদূরে যখন আসতে পেরেছি তখন বাকিটারও ব্যবস্থা করতে হবে।
কে যেন বলল—রাত তখন তিনটে। উনিশনম্বর মারা গেছে। একটু জল, নার্স আমাকে একটু জল।
আপনি কি ডাক্তার ভাই! আমার স্ত্রী, একেবারে শেষ অবস্থা। কী কেস? ডেলিভারি কেস। এখানে কী? তবে? চলুন চলুন, ডেলিভারি ওয়ার্ডে। সার্জেন–কী হয়েছে সিস্টার? এমারজেন্সি ওয়ার্ডে আর একটা এসেছে। কিছু নেই, একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, বম্ব ইনজুরি। এখনও প্রাণ আছে। তাপসকে বলুন, অ্যাটেন্ড করতে এখুনি, স্যলাইন রেডি করুন। আমার হাতে ডেলিভারি কেস।
ডেটল, ইথার, ইউরিন্যাল, সব মিলিত, মিশ্রিত গন্ধ। বড় বড় চওড়া করিডর, খোলা-গরাদহীন জানালা, উঁচু উঁচু ছাদ, সারি সারি লোহার খাট, সরু সরু লম্বারডে পাখা ঝুলছে, ঘুরছে, হাইহিল জুতোর খটখট, চকচকে, বড় বড় বেঞ্চি, কাবেরী এখন ওই ডেলিভারি লেখা দরজার ওপাশে। কী হচ্ছে সিস্টার, এত দেরি কেন? সিস্টার, ওই যে ছেলেটি এল বললেন, সব ঝাঁঝরা, ওর নাম কি বিশু? সিস্টার তাপসবাবু কি ওকে অ্যাটেন্ড করেছে?
খবর আছে? কী হল কাবেরীর? সিস্টার—শিইজ অল রাইট। ভালো আছে সে, আপনার একটা ছেলে হয়েছে, সাড়ে ছপাউন্ড ওজন। ঠিক চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে জন্মেছে। না, এখন দেখতে পারবেন না। সকাল আটটায় আসবেন।
সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নামছি। পুবের আকাশে আলোর ছোঁয়া লেগেছে। ছেলে হয়েছে! প্রথম সন্তান! কার মতো দেখতে হয়েছে কে জানে। কী নাম রাখব। সময়টা নিশ্চয়ই ভালো ছিল। কেমন হবে! নিশ্চয়ই খুব বড় হবে। হাউস স্টাফদের মিষ্টি খাওয়াব, আর ওই ছেলেদের! ওরা না থাকলে কী করতুম!
—দাদা, একটা সিগারেট দেবেন?
—কে পিন্টু তুমি?
—হ্যাঁ দাদা, কী হল আপনার, বউদি ভালো আছেন তো?
—হ্যাঁ ভাই, ছেলে হয়েছে; কিন্তু বিশু? সে কেমন আছে?
পিন্টু ধোঁয়া ছেড়ে প্রচণ্ড একটা দার্শনিকের মতো বলল—নাঃ বাঁচল না, একেবারে ফর্দাফাই হয়ে গেছে, চারটে পঞ্চান্ন মিনিটে সব শেষ হয়ে গেল। শালা বোমাটা বেশ জবরদস্ত ছিল। ওর মাটার বড় কষ্ট হবে; ওই একটাই তো ছেলে। যাকগে, অতসব ভাবলে চলে না।