পুরোনো কথা। আমরা সবাই গিয়েছিলুম। তোকে প্রাইভেটলি বলছি—শিখা আর সেই বাজারের মেয়েদের কোনও তফাত খুঁজে পাই না ইদানীং। সেই একই ছলাকলা। সেই অনাবৃত ফালি কোমর, কাপড় কীভাবে রেখেছে সেই জানে। ব্লাউজের হাতা দুটো কেটে বাদ দিয়েছে। ব্রা-র ফিতে কাঁধের পাশে উঁকি দিচ্ছে। সেই খোঁপার বাহার। তফাত কোথায়! কিছু আদায় করার দরকার হলেই সেক্স ছুড়ে মারবে। সেই এক ধরন, সেই এক মোডাস অপারেন্ডি।
চা-টা বেশ গরম ছিল! চা গরম হলেই হল। ফ্লেভার-টেলভার আর কোথায় পাবি? চল্লিশটাকা পাউন্ডের চা হলে তবে হয়তো কিছু গন্ধ পাওয়া যাবে।
মাটির গন্ধের কাছে আর কিছু লাগে না। কেমন ভিজে ভিজে সোঁদা সোঁদা গন্ধ। অসাধারণ!
রেবেকার কথা মনে পড়ে? কী একটা বিলিতি সেন্ট মাখত। খুব ফিকে অথচ কেমন একটা গুমোট গন্ধ। গন্ধ আর রেবেকা, রেবেকা আর গন্ধ যেন অনেকটা, ওই কী যেন বললি—মাটি আর গন্ধের মতো।
রেবেকার কথা এখনও ভুলতে পারছিস না?
চাষা কি মাটির কথা ভুলতে পারে–না ভুলে থাকতে পারে।
কোথায় চাষা, কোথায় মাটি আর কোথায় রেবেকা! পাগল হয়ে গেছিস।
মেয়েরা মাটির মতো উর্বর আর শ্যামল। মনে পড়ে সেই নিরঞ্জনের কথা। ভোরবেলা আমরা তাকে খুঁজে পেলুম। হাত-পা ছড়িয়ে কেমন নিশ্চিন্তে শিশির ভেজা মাটির ওপর ঘাড় গুঁজে পড়েছিল। রেবেকার বুকে মুখ গুঁজে আমার মাটির কথা, মাটির গন্ধের কথা মনে হত। মনে হত গুড়ো গুড়ো হয়ে রেবেকার শরীরে মিশে যাই।
আরও তিনটে চা দাও হে। বেশ যেন গরম থাকে।
কী অসাধারণ শরীর দেখ মেয়েটার। পোড়া পোড়া রং। রোদে ঝলসানো। রিয়েল সানট্যান। কী মনে হচ্ছে জানিস—যেন মাল্টি ভিটামিন ট্যাবলেট।
শিখার কথা মনে আছে। ঠোঁটে সাদা সাদা দগদগে ঘায়ের মতো লিপস্টিক, পাছা ল্যাপটানো। শাড়ি, ঘাড়ের ওপর টেনে তোলা খোঁপা, ভিজে টয়লেটের মতো একটা ঘিনঘিনে ভাব হত ওকে দেখলে।
কটা বাজল?
কী হবে সময় দেখে? এখনও অনেক সময় আছে।
কী নাম বললে তোমার?
এজ্ঞে সুকুমার।
আর একটু চিনি আন তো খুকি।
হাসছে দেখ ফিকফিক করে। মেয়েদের খুকি বললেই হাসে। আসলে ও খুকি নয় কিশোরী। দেহের পাপড়ি খুলছে, মন উড়ছে তার চারপাশে ভ্রমরের মতো।
কী নাম বললে তোমার? সুকুমার? কোথায় দেশ ছিল?
ওপার বাঙলায়।
ঠিক ধরেছি শরণার্থী, না হয় উদ্বাস্তু। যা হয় একটা কিছু হবে। আমাদের মতোই এ অঞ্চলে প্রক্ষিপ্ত। না ঘরকা না ঘাটকা। তা বেশ করেছ, বসে না থেকে লড়ে যাও।
এজ্ঞে লড়াই খুব হয়েছে। খান সেনাদের সঙ্গে খুব লড়েছি আমরা। আমার বড় ছেলে এজ্ঞে মুক্তিফৌজ।
কী শয়তান দেখ। প্রথম ধাক্কাতেই হয়তো হুড়মুড় করে পালিয়ে এসেছে। এখন ওই মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে হিরো হতে চাইছে। গাছেরও খাবে তলারও কুড়োবে।
তুই ভয়ানক সিনিক। লোকটা সাফার করেছে। আরে লড়াই একটা সামগ্রিক ব্যাপার সকলকেই তা কোনও না কোনওভাবে স্পর্শ করে যায়।
তা অবশ্য ঠিক। চা-টা ভীষণ কম দিয়েছে। দু-চুমুকেই শেষ। কীরকম প্রফিটিয়ারিং টেনডেনসি, দেখেছিস। শেখাতে হয় না, শিখে যায়। ওই ব্যাপারে কি গ্রামের মানুষ, কি শহরের মানুষ ফাদার দে আর অন দি সেম বোট-হাঃ হাঃ হাঃ।
অত জোরে হাসলি কী রে? ফুসফুসে যদি কোনও ডিফেক্ট থাকে শালা পাংচার হয়ে পটল তুলবি। তারপর ক্লেম কবি হাম ভি শহিদ।
দেখবি সেক্সের ব্যাপারেও সবাই সমান। গ্রেট ইকুয়ালাইসার। দেখলি না ওদেশেকী হল? মরতে-মরতে মারতে-মারতে মেয়েগুলোকে নিয়ে কী কাণ্ড করলে? দেখবি শক্তি আর ব্যভিচার যেন জড়িয়ে মুড়িয়ে আছে।
তা বলতে পারিস। শিখাকে ওই একটা সময়েই যেন ভালো লাগে, অন্য সময় যেন মনে হয় একটা ডার্টি টাওয়েল।
কতক্ষণ বসে আছি আমরা?
কপয়সা হল তোমার সুকুমারবাবু?
এখন আমাদের কিছু সুবিধে হবে—কী বলিস? ভালো ভালো মাছ আসবে—যশোরের কই, সিরাগঞ্জের রুই। বাজারে মাছের দাম হু-হু করে কমবে।
শুধু মাছ কেন রে, চাল, নারকেল, তরি-তরকারি। অসাধারণ ব্যাপার হবে, কী বলিস?
রেপ অফ বাংলাদেশ তোরাই সম্পূর্ণ করবি। তোমরা সব আস্তিন গুটিয়ে পঙ্গপালের মতো গিয়ে পড়বে। মনের আনন্দে সব বাগিয়ে-টাগিয়ে, খেয়ে-দেয়ে, গায়ে-গতরে হয়ে সাফারিং হিউম্যানিটির জন্যে গলা ছেড়ে কাঁদবে। সুবিধাবাদী শয়তানের দল!
মূর্খ, দুটো দেশের মধ্যে একটা ট্রেড ডেভলাপ করবে না? ইডিয়ট। মাটির ফসল, জলের মাছ, মানুষের শ্রমের উৎপাদন কি জমিতে পড়ে পচবে?
আমরাও কি কম সাফার করেছি? ওই শরণার্থীদের চাপ, এইট্যাক্সেশান, এই যুদ্ধ, সেই পার্টিশান, এই বেকারি, ওই রাজনৈতিক খুনোখুনি কী সব অসাধারণ সময়ের মধ্য দিয়ে এই দেহতরি দুলে দুলে চলেছে।
অনেক দিন দেহতত্বের কোনও গান শোনা হয়নি। এদিকে খুব ভোরে এলে হয়তো কোনও বাউল-টাউলের গান শোনা যেত।
ওরা এখন সব আমেরিকায় চলে গেছে। কলকাতায় আসর মারছে—কোথায় পাবি তারে তোর মনের মানুষ যেরে।
দেহতত্ব বড় শক্ত জিনিস রে! মনে আছে নিখিল কতবার অ্যানাটমিতে ফেল করেছিল? কী সব শক্ত নাম দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সোলার প্লেকসাস, মেডুলা অবলঙ্গেটা, দাঁত ভেঙে যায়।
দুর, দেহতত্ব ব্যাপারটা অন্যরকম। বুঝেছিস—সেটা খুব কোমল, অনেকটা নরম একটা কাবুলি বেড়ালের গায়ে হাত বোলাবার মতো অনুভূতি।