মহামায়া ধীরে ধীরে স্বামীকে খাটে শুইয়ে দিলেন। কাঁদো-কাঁদো স্বরে বললেন, ইস ডান গালটার কী অবস্থা করেছে!
প্রকাশবাবু বললেন, আমি একটু জল খাব।
শর্মিলা দরজার কাছে। মহামায়া বললেন, বউমা এক গেলাস ঠান্ডা জল দাও। ফুল স্পিডে। পাখা ঘুরছে। সত্যেনবাবু একপাশে বসে স্বামী-স্ত্রী-র অপূর্ব লীলা দেখছেন। শর্মিলা ফ্রিজ খুলে জলের বোতল বের করে ভাবতে লাগল, শুধু জলে তো অনশন ভঙ্গ হয় না। ফলের রস দিতে হয়। এক বোতল আঙুরের রস আছে। গোটা চারেক মুসুম্বি আছে। প্রশান্ত একটা ক্রাশার কাম মিক্সার কিনে এনেছে কাল। আজই তার উদ্বোধন হোক। মিক্সার চলছে ঘির ঘির করে। মুসুম্বির নরম শরীর ঘেঁতো হচ্ছে। দলা পাকাচ্ছে। রস বেরোচ্ছে। শর্মিলার হঠাৎ মনে হল—এরই নাম সংসার। যত চটকাবে তত রস বেরোবে। সব যেন ঘানির সরষে। পেষাই না হলে তেল বেরোয় না।
হাইওয়ে
আমরা তখন হাঁটতে হাঁটতে সেই দোকানে গিয়ে বাঁশের বেঞ্চির ওপরে তিনজন বসলুম। বেশ ক্লান্ত। আমাদের তিনজনেরই কপালে ঘাম জমেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। সেই কোন সকালে বেরিয়েছি। বলতে গেলে সূর্য ওঠার আগে। প্রথমে আমাদের হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল। চারিদিকে গাছগাছালি। মাঝে মাঝে পাখি ডাকছে। শহরের সীমানার শেষে এই গ্রাম্য পরিবেশ। একটা-দুটো পুকুর। একটা-দুটো পাতিহাঁস। একদিক দিয়ে চওড়া সড়ক বেরিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দূর পথের যাত্রীবাহী বাস হু-হু করে ছুটে চলে যাচ্ছে। মালবাহী লরি। কোনও কোনও ড্রাইভার স্ফুর্তিতে গান গাইতে গাইতে চলেছে।
প্রথম প্রথম আমরা পরস্পর অল্প অল্প কথা বলছিলুম। তারপর যত রোদ চড়েছে, পায়ের ডিম চলার ক্লান্তিতে শক্ত হয়েছে, কথাও ফুরিয়েছে। কী দরকার ছিল এত হাঁটার। সোজা বাসে করে এলেই চলত।
পথের পাশের দোকান—তার একটা আলাদা আকর্ষণ। বাঁশের বেঞ্চির তলায় দূর্বাঘাসের জাজিম বিছানো। দোকানির উনুনে চায়ের জল ফুটছে কালো কেটলিতে। দূরে একটা বাচ্চা মেয়ে গাছের ভাঙা ডাল কুড়োচ্ছে। খড় বোঝাই গরুর গাড়ি মন্থর গতিতে চলেছে। চাকায় তেল শুকিয়েছে, ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ উঠছে। দোকানের দিকে পেছন ফিরে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা তিনজন বসেছি। দূরে সবুজ মাঠ আকাশের কোলে গিয়ে মিশেছে। মাঝে মাঝে রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিচ্ছি। ঝিরঝিরে হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে।
দোকানির দিকে না ফিরেই সুব্রত বললে—
তিনটে চা দাও, বিস্কুট-টিস্কুট কিছু আছে?
এজ্ঞে সে যা আছে তা কি আপনাদের চলবে?
আরে চালালেই চলবে, দুখানা করে দিয়ে দাও।
বুঝলি নৃপেন—দূর মাঠের দিকে চোখ রেখে সুব্রত বললে—এসব দেশি বিস্কুটের একটা আলাদা টেস্ট।
সে তো বুঝলুম,—পরেশ একটু খুঁতখুঁতে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে তো কথাই নেই। সাজ পোশাক সব কিছুতেই ভীষণ পিটপিটে। এই রাস্তার ধারের চা, ধুলোভর্তি বিস্কুট সে খাবে হয়তো পাল্লায় পড়ে কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে তার ভিতরে একটা দ্বন্দ্ব চলবে। পরেশ তার আপত্তিটা একটু ঘুরিয়ে প্রকাশ করল—আমি একবার একটা ছোট বেকারি দেখেছিলুম বুঝলি—সে একবারে। নরক। হেলথ অ্যান্ড হাইজিনের কোনও বালাই নেই। শালা পা দিয়ে ময়দা ঠাসছে। বুঝলি ময়দা আর ভেলিগুড়ের বস্তা পাশাপাশি। বর্ষায় রাস্তার নোগ্রা জল ঢুকে একাকার।
আরে রাখ তোর একাকার। খিদে পেলে হাতের কাছে যা পাবি পেটে পুরবি। আজ আর তোর নিস্তার নেই। পড়েছ মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।
দোকানির মেয়ে চা আর সাদা সাদা বিস্কুট রেখে গেল আমাদের পাশে। ছোট ছোট গ্লাসে কালচে কালচে চা।
চায়েরই কত রকম রূপ দেখ। গ্র্যান্ডের প্রিনসেসের চা, ময়দানের টি-বোর্ডের গাড়ির চা, তোমার বাড়ির মাসিমার সেই গঙ্গাজলের চা, স্টেশনের চা…
তুই একটু থামবি পরেশ। তোর চা-তত্ব, ওটা টি-বোর্ডে গিয়ে শোনাস, চায়ের শতনাম।
সুব্রত একটা চুমুক দিয়ে বলল,—অসাধারণ। শালা কী সুপারফাইন টেস্ট। বিস্কুটটা যেন নিরেট এক টুকরো শুকতলা।
এখানে কীসের চাষ বেশি হয়?
এজ্ঞে আলু। আলুই তো এ অঞ্চলের সেরা ফসল।
পয়সা থাকলে একটা কোল্ড স্টোরেজ করতুম। ভীষণ লাভ বুঝলি। মনে আছে সেই আমাদের সঙ্গে কলেজে একটা ছেলে পড়ত। বাবার কোল্ড স্টোরেজ ছিল। ছেলে দু-হাতে পয়সা ওড়াত। কম কাঁঠাল ভেঙেছি আমরা তার মাথায়, মনে আছে তোর?
তুই কোল্ড স্টোরেজ করলে আমরা সব কিছু ছেড়ে আলুর চাষে নেমে পড়ব। তোর কোল্ড স্টোরেজ আমাদের আলু। অসাধারণ ব্যাপার, কী বলিস?
তুই শহরে বাড়ি করবি হাল ফ্যাশানের, সুইমিং পুলে তোর ওই ভুড়িদাস চেহারা কস্টিউম পরে ভাসবে। গ্যারেজে ঝকঝকে গাড়ি, কলকাতার মেয়েমানুষ, মদের বোতল। শালা আইডিয়াল শিল্পপতি। আর আমরা কাদামাখা চাষা আলুর চাষ করে মরব।
আর আমি ক্রেতা, তোরা দুজনে বাজারে আলুর দাম বাড়াবি-কমাবি, তোদের কেরামতিতে অসাধারণ আনন্দে থাকব।
কোথায় শুরু করেছিলুম কোথায় চলে এলি। একে বলে ডে ড্রিমিং—একটা মনস্তাত্বিক বিকার। মেয়েটা দেখ। যেন টাটকা পালংশাক। দেখেছিস সুব্রত কী ন্যাচারাল বিউটি!
তুই দেখ। আমি দেখব না! আমার স্ত্রী শুনলে রাগ করবে।
খুব সাধু হয়েছিস। বলব তোমার কথা? ভাঙব হাটে হাঁড়ি? তুমি কী বলেছিলে একদিন। কোথায় গিয়েছিলে!