এটা ঠিক ধর্মীয় নয়। বলতে পারেন স্বাস্থ্যের জন্য। উপবাসে শরীর আর মন দুটোই খুব শুদ্ধ হয়। লাগাতার উপবাসে নির্বাণ লাভ হয়।
এ আপনার কার কথা, বুদ্ধদেবের?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
সত্যেনবাবু ঢ্যাঁপা ঢ্যাঁপা খাস্তা কচুরি খাচ্ছেন। বড় প্রিয় জিনিস তাঁর। প্রকাশবাবুরও প্রিয়। কে যে বস্তুটি আবিষ্কার করেছিলেন? তাঁর নামে একটি মঠ দেওয়া উচিত।
সত্যেনবাবু কচুরির তারিফ করে বললেন, আপনার সামনে বসে খাচ্ছি, আর নিজেকে কেবলই মনে হচ্ছে বিধর্মী।
ও সব ভাববেন না। আহারের সঙ্গে ধর্মের কোনও যোগ নেই।
কথায় কথায় আহারাদি শেষ হল। মহামায়া একটি লালপাড় শাড়ি পরেছেন। কপালে সিঁদুরের গোল টিপ। মুখটা খুব শুকনো লাগছিল বলে ছোট্ট একটা খিলি পান পুরেছেন। চুলে সামান্য পাক ধরেছে। ফরসা টকটকে রং। টিকানো নাক। পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালে বাগবাজারের মা জগদ্ধাত্রীর কথা মনে পড়ে।
প্রকাশবাবু স্ত্রীকে দেখে মনে মনে তারিফ করেই, মন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলেন। স্বার্থপর! এর নাম অনশন! মুখে পানের খিলি! দুপুরে শরবত-টরবতও চলেছে বোধহয়। হেঁশেল যার হাতে, তার আর ভাবনা কী। রাগ থিতোলে অভিমান হয়। প্রকাশবাবুর ভেতরে অভিমানের বান। ডেকে গেল। দুপুরে আর একবার খোশামোদ করলেই অনশন ভঙ্গ হয়ে যেত। এতবড় অহংকারী মেয়েমানুষ গোঁ ধরে বসে রইল। অঃ, রোজগেরে ছেলের অহংকারে দেমাকে মাটিতে যেন পা পড়ছে না! বুড়ো ব্যাটা মরলেও ছেলে সিংহাসনে বসিয়ে তো দেবে।
মহামায়া সত্যেনবাবুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। প্রকাশবাবু পেছন পেছনে চলেছেন। গুমরোতে গুমরোতে। এখন সন্দেহ হচ্ছে, সদাহাস্যময় ভোজনবিলাসী ওই বণিকটি কার টানে প্রায়ই ছুটে আসেন! নীচ ভাবনা হলেও ভাবতে হচ্ছে।
গাঢ় নীল রঙের ঝকঝকে গাড়ি, গুমোরে যেন গুম মেরে আছে। সাদা উর্দিপরা চালক। পেছনের দরজা খুলে সত্যেনবাবু মহামায়াকে বললেন, উঠুন বেয়ান।
প্রকাশবাবুর ভেতরটা রাগে কষকষ করছে। বেয়ানের খাতির দেখো! বেয়াইটা যেন ফেউ! বানের জলে ভেসে এসেছে।
সত্যেনবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন, বেয়াইমশাই আসুন, আসুন।
প্রকাশবাবু বেশ কঠিন গলায় বললেন, আমি সামনে বসব।
আপনারা দুজনে আরাম করে পেছনে বসুন।
না, না, হর-পার্বতীকে পেছনে রেখে আমি চলব সামনে। আসুন, আসুন।
প্রকাশবাবু আরও কঠিন গলায় বললেন, পেছনে বসায় আমার একটু অসুবিধে আছে। বেয়াইমশাই। আপনারা দুজনে বসুন, আমি সামনে যাচ্ছি। আর তাতেও যদি অসুবিধে হয়, আমি ফিরে যাই।
সত্যেনবাবু গাড়ির খোলা দরজায় হাত রেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহামায়া ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে এলেন। এগিয়ে গেলেন বাড়ির দরজার দিকে। সিঁড়ির কাছাকাছি এসে আর পারলেন না। সিঁড়ির হাতলে মাথা রেখে কান্নায় ফুলতে লাগলেন। এই চওড়া লালপাড় শাড়ি, গহনা, জাপান, পালঙ্ক—সবই একটা মানুষের মর্জি। যখন খুশ মেজাজে তখন তুমি আমার সোহাগের স্ত্রী। মেজাজ বিগড়ালেই মানসিক নির্য্যাতন! ঠিক ওই কথাটাই মনে এল মহামায়ার— স্ত্রী হল প্রয়োজনের পিকদান।
সত্যেনবাবু তাড়াতাড়ি দৌড়ে এলেন, কী হল বেয়ান! নেমে এলেন কেন? কাঁদছেন কেন?
মহামায়া কোনওক্রমে বললেন, আমি যাব না।
প্রকাশবাবু দু-পাদূরে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যেনবাবু সেই দিকে তাকিয়ে বললেন, মেয়েদের মনে দুঃখ দেন কেন? আপনি পণ্ডিতমানুষ এইটুকু বোঝেন না, যেসংসারে মেয়েরা হাসতে পারে না, সে সংসারের কখনও উন্নতি হয় না। মরুভূমি হয়ে যায়।
মহামায়া ধীরে ধীরে ওপরে উঠতে লাগলেন। পেছন পেছন এলেন সত্যেন আর প্রকাশ। প্রকাশের মনে খুব লেগেছে। বড় নীচ হয়ে গেছেন তিনি। অপমানিত মহামায়ার করুণ মুখ বড় দাগ কেটেছে মনে। সারাজীবন অনেক টর্চার করেছেন। নির্য্যাতন করে এক ধরনের আনন্দ পেয়েছেন। আমি এক ঘৃণ্য স্যাডিস্ট।
ধীরে ধীরে পা থেকে চটি খুললেন। ডান হাতে তুলে নিলেন একপাটি চটি। সত্যেনবাবু অবাক হয়ে মানুষটিকে দেখছেন। লম্বা বারান্দা ধরে মহামায়া এগিয়ে চলেছেন পায়ে পায়ে।
প্রকাশবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।
সত্যেনবাবু আতঙ্কের গলায় বললেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, সে কী কথা!
জুতো, জুতোই তোমার দাওয়াই।
নিজের গালে পটাপট জুতো মারতে লাগলেন।
এ কী, এ কী করছেন আপনি? সত্যেনবাবু হাত চেপে ধরেও সামলাতে পারছেন না। শরীরে অসুরের শক্তি এসে গেছে।
জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দাও। এই নিন আর একপাটি। পটাপট মারুন।
মহামায়া দ্রুতপায়ে ঘুরে এলেন, এ কী করছ তুমি? এ কী পাগলামি!
ক্ষিপ্ত প্রকাশবাবু নেচে উঠলেন, মারো, মারো, পটাপট মারো। ডাকো প্রশান্তকে, ডাকো বউমাকে। সবাই মিলে পেটাও। এই অত্যাচারী বুড়োটাকে জুতোও, জুতোও। জুতিয়ে সিধে করো। মহামায়া স্বামীকে জাপটে ধরলেন। হু-হু করে কাঁদছেন আর বলছেন, তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেলে? মহামায়ার শীতল আলিঙ্গনে প্রকাশবাবুর শরীর ক্রমশ শিথিল হয়ে এল। শরীরের সমস্ত রক্ত মাথায় উঠেছে। ঘোর লেগে গেছে। মহামায়াকে আর মহামায়া বলে মনে হচ্ছেনা। বহুকাল আগের এক অনুভূতি ফিরে আসছে। উনিশশো চুয়াল্লিশ সাল। টাইফয়েড হয়েছে। দাওয়ায় বসিয়ে মাথায় জল ঢেলে, মা বুকে জড়িয়ে ধরে, ধীরে ধীরে ঘরের দিকে নিয়ে চলেছেন।