প্রকাশবাবু বেশ গোছগাছ করে, গম্ভীর হয়ে চেয়ারে বসলেন। পাশের টেবিল থেকে একটি ম্যাগাজিন তুলে নিলেন। যে-সে ম্যাগাজিন নয়, বেদান্তকেশী। এক ঢোঁক জল খেয়ে শুকনো। ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে মুখে একটি লবঙ্গ ফেলে রাখলেন। কুটুম মানুষ। পারিবারিক কেচ্ছা জেনে ফেললে বড় লজ্জার হবে। মহামায়াকেই ভয়। হাঁউ হাঁউ করে সব বলে না ফেলে। এমনভাবে বলবে, সব দোষ যেন আমার। যত বুড়ো হচ্ছি ততই নাকি ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছি। স্বার্থপর সংসারের বিরুদ্ধে এ আমার একক সংগ্রাম! করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে। কিন্তু আমি কী করতে চাইছি, সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।
সংশয়ে প্রকাশবাবুর সংগ্রামের শক্তি যেন দুর্বল হয়ে পড়ল।
বাইরে জুতোর শব্দ শোনা গেল। বেয়াইমশাই আসছেন। খুব মজলিশী মানুষ। গল্পে-গানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে পারেন। চতুর্দিকে ফলাও ব্যবসা। প্রচুর অর্থ। মধুপুর, শিমুলতলায় বাড়ি। খানদুয়েক গাড়ি। দক্ষিণ কলকাতায় হাল ফ্যাশানের বাড়ি।
সত্যেনবাবু দরজার বাইরে চটি ছেড়ে হাসি হাসি মুখে ঘরে ঢুকলেন। দুই বেয়াই প্রায় সমবয়সি। ইনি একটু হৃষ্টপুষ্ট, উনি শীর্ণ। ইনি আনন্দপ্রধান, উনি রাগপ্রধান।
চেয়ার টেনে বসতে বসতে সত্যেনবাবু বললেন, কেমন আছেন বেয়াইমশাই?
ওই চলছে একরকম। চলে যাচ্ছে কোনওরকমে।
আপনি কি কোনওদিন ভালো বলবেন না?
যে টেকনিকে ভালো বলা যায়, সেই সিলভার টনিক আমার আয়ত্তের বাইরে। আমার পৃথিবী হল অ্যানিমিক পৃথিবী। দিনগত পাপক্ষয় করে চলে যাওয়া।
সব সময় অমন বেসুরো বাজেন কেন বেয়াইমশাই! একটু সুরে বেজে দেখুন না, বেশ ভালো। লাগবে। সব সহজ হয়ে যাবে। এখানে কাঁদতে এসেছি, না হাসতে এসেছি?
মশাই, আপনার চোখে এক রকম চশমা, আমার চোখে আর এক রকম চশমা। দুজনের দেখা কি সমান হতে পারে?
আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের সঙ্গে কথায় আমি পারব না। দয়া করে গাত্রোখান করুন। ধুতি পাঞ্জাবিটা চড়িয়ে নিন।
কেন বলুন তো! আজ আর আমি আপনার কোনও অনুরোধ রাখতে পারব বলে মনে হয় না। একটু বেএক্তার হয়ে আছি।
সেই জন্যেই ঈশ্বর মনে হয় আমাকে পাঠালেন। উঠুন উঠুন। আপনার কোথায় কী আছে বলুন, হাতের কাছে এনে দিই।
না, না, সে কী কথা। কিন্তু ব্যাপারটা কী বলুন তো?
জীবনে আপনি এমন সুন্দর কীর্তন কখনও শোনেননি। মম্মমহাপ্রভু জগৎসুন্দর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা যাওয়ার পথে চৈতন্যআশ্রমে একটি মাত্র অনুষ্ঠান করে যাচ্ছেন। রাত আটটায় শুরু। জন্মাষ্টমীর প্রাককালে একটি রজনী। চলুন, চলুন, মনটাকে একটু ভিজিয়ে আসি। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু…
সত্যেনবাবু আপন মনে গান ধরলেন। গলা শুনলেই বোঝা যায় একসময় সংগীতচর্চা করতেন। দু-লাইন গেয়ে গান থামিয়ে সত্যেনবাবু বললেন, বেয়ানের কী হল! আজ নীরব কেন কবি, ফুলের জলসায়!
উদাত্ত কণ্ঠে বেয়ান, বেয়ান করতে করতে সত্যেনবাবু অন্দরের দিকে এগোলেন। বাবার গলা শুনে শর্মিলা এগিয়ে এল, তুমি কখন এলে?
তা মিনিট পনেরো হবে। কত্তার সঙ্গে কথা বলে এলুম। আমার বেয়ান কোথায়?
মা শুয়ে আছেন।
অ্যাঁ, সে কী রে! ভর সন্ধেবেলা শুয়ে থাকার মানুষ তো তিনি নন। হ্যাঁ রে, শরীর ঠিক আছে তো!
শর্মিলা কী আর বলবে। আমতা আমতা করে বলল, এই উপোসটুপোস চলছে তো!
উপোস? অম্বুবাচি তো হয়ে গেছে?
আঃ বাবা, কী বলছ তুমি? অম্বুবাচি বিধবারা করেন।
আই অ্যাম সরি। আই অ্যাম অফুলি সরি।
ওদিকে প্রকাশবাবু ঝট করে একটুকরো কাগজে লিখলেন, দয়া করে বাইরের কুটুমের সামনে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে ফেলোনা। লজ্জায় তা হলে মাথা কাটা যাবে। ফিশফিশ করে বুড়োকে বললেন, যা চুপিচুপি তোর দিদার হাতে গুঁজে দিয়ে আয়।
মহামায়া চিরকুটটা পড়ে হু: করে একটি শব্দ ছাড়লেন। শর্মিলা ঘরে ঢুকে বললে, বাবা এসেছেন।
শুনেছি।
মহামায়া মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরের বাইরে এলেন।
সত্যেনবাবু বললেন, বেয়ান, ঝট করে রেডি হয়ে নিন। কত্তাকে খাড়া করেছি কোনও রকমে।
মহামায়া মৃদু গলায় বললেন, শরীরটা আজ তেমন জুতের নেই।
শরীর? সত্যেনবাবু হইহই করে হেসে উঠলেন, শরীর ঠিকই আছে বেয়ান। মনটা গোলমাল করছে। সেই মনের দাওয়াই মিলবে এখুনি। আমার সঙ্গে চলুন।
কোথায়?
উপাদেয় কীর্তন। জীবনে হয়তো আর শোনার সৌভাগ্য হবে না। নিন, নিন, গেট রেডি।
মহামায়া ধরা ধরা গলায় বললেন, বউমা, একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।
সত্যেনবাবু বেয়াইয়ের কাছে এসে বসলেন। প্রকাশবাবু জামা-কাপড় পরে ফেলেছেন। পেট জ্বলছে। গলা শুকনো। ঠোঁট খসখসে। ছাত্রজীবনে শিবরাত্রির উপবাস করেছিলেন একবার। সেই স্মৃতি মনে পড়ল। রাতের দিকে কাহিল অবস্থা। নির্জলা উপবাস। পুজোয় বসে আচমনের নামে কোষাকুষি থেকে ঢোঁকে ঢোঁকে গঙ্গাজল গিলতে লাগলেন। আজ যেন সেই শিবরাত্রির উপবাস।
সত্যেনবাবু বললেন, চলুন, এবার পুজোয় সকলে মিলে, মধুপর কি শিমুলতলা ঘুরে আসি।
মনে মনে ভাবলেন, ততদিনে ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। আজ ঘুরছি। কাল শয্যা নেব। পরশু খাবি খাব। পরের দিন পরপারে।
শর্মিলা বাবার জন্যে চা আর জলখাবার নিয়ে এল।
বেয়াইমশাই আপনার?
আজ্ঞে, আজ আমার উপবাস, আপনি গ্রহণ করুন।
ও, স্বামী স্ত্রী দুজনেরই উপবাস। আজ কী বার? শনিবার। ভালো, খুব ভালো। আমারও খুব ইচ্ছে করে একটা কিছু পালন করি। করি করি করে করা আর হয় না।