মাত্র দু-দিন। তোমার মাকে খেচকে খেচকে, অনেক জল ঘোলা করে, মাত্র দু-দিনের কুলখ কড়াই ভেজানো জল পেয়েছি। প্রতিদিন খাবার কথা। বুঝলে কিছু?
আজ্ঞে হ্যাঁ, কাজের চাপে মা ভুলে গেছে।
মাই সন, কাজের চাপ নয়, শিয়ার নেগলেকট। আমার মরা-বাঁচায় তার কিছু এসে-যায় না। বুঝলে? এই হল সংসার। ছিলুম দুধেল গরু। এখন আমি গোবরে গরু। একেবারেই ওয়ার্থলেস। যাক, তোমার অনেকটা সময় নষ্ট করে দিলুম। এবার তুমি যেতে পারো।
২.
মহামায়া ডাকলেন, বউমা!
দিশাহারা বউমা গুটিগুটি শাশুড়ির সামনে এসে দাঁড়াল, বলুন মা।
আমার চাল নিয়েছ নাকি?
ভাত এখনও বসাইনি।
সে কী, খোকা তা হলে কী খেলে গেল?
এক গেলাস জল।
বাঃ, তোমার হাতে ছেলেটাকে তুলে দিয়ে ভালোই হয়েছে দেখছি।
আমার কী দোষ বলুন! কিছুতেই খেতে চাইলে না। বললে অশান্তির অন্নের চেয়ে উপবাসই ভালো।
ভালোই করেছে। আমিও কিছু খাব না। অনশনের প্রতিবাদে অনশন।
কী যে আপনারা করছেন মা!
বুড়োকে আমিও টাইট দিতে জানি। ভেবেছে সবাই ছাত্র।
বুড়ো বলবেন না মা। বিশ্রী শোনায়।
বুড়োকে বুড়ো বলব না তো কি ছোকরা বলব! সারাটা জীবন একা পেয়ে শুধু ধামসে গেল। আমি যেন সাঁওতালদের ধামসা রে। শরীরে দয়া, মায়া, মমতা বলে কিছুই নেই। শুধু রাগ, আর অভিমান। বাপের এক ছেলে যে, একলাফেঁড়ে তো হবেই। তোমার বয়েস হয়েছে। কচি খোকাটিও নও। কোথায় পাঁচজনকে নিয়ে হেসে-খেলে থাকবে, তা নয়, নিত্য নতুন ফ্যাঁকড়া বের করে বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। ধিকিয়ে ধিকিয়ে জ্বলার চেয়ে এবারে একেবারে জ্বলেপুড়ে যাক।
মা, আপনার শরীর কিন্তু ভালো নয়, লো প্রেশার। খাওয়া বন্ধ করে দিলে শরীর আরও খারাপ হবে।
সে কথাটা আমাকে না বলে তোমার দুর্বাসা শ্বশুরকে বলো।
আমার সে সাহস নেই।
তাহলে যা করছ তাই করো গে যাও। কেবল বাচ্ছাটাকে উপোস করিয়ে রেখো না।
মাগুর মাছের ঝোলভাত করে ওকে খাইয়ে দিই?
আর তুমি?
অনশন।
এই সময়টায় তোমার ভালো খাওয়াদাওয়া করা উচিত। নিজে মরো ক্ষতি নেই। পেটেরটা মেরো না। বুড়োর সঙ্গে আমার লড়াই! তোমরা এর মধ্যে জড়িয়ে পোড়োনা।
সংসারে আগুন লাগলে সকলকেই পুড়ে মরতে হবে। কী আর করা যাবে মা!
বেশ, তবে তাই হোক। ওই ওরা বলে, চলছে চলবে, আমরা বলি জ্বলছে জ্বলবে। কত্তাকে শুধু বলে দিও, আমিও আমৃত্যু অনশন চালিয়ে যাব। দেখি কার কত হিম্মত।
মহামায়া গোটাতিনেক গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার আর রুমাল নিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন। আজ শুধু ধুয়ে যাব সারাদিন। দেখি লালকে সাদা করা যায় কি না?
প্রকাশবাবু এদিকে দাবার ছকে খুঁটি সাজিয়ে বই দেখে চাল রপ্ত করছেন। মনটাকে ঘোরাতে না পারলে মনটা ভীষণ খাই খাই করছে। মানুষের জীবনে খাওয়া বিশ্রী একটা বদভ্যাস। সারা। জীবন তো এত খেলি প্রকাশ, আর কত খাবি!
নিজেকেই নিজে শাসন করলেন। নাতিটি এসে পাশে বসেছে। আপেলের মতো টুকটুকে দুটি গাল। খরগোশের মতো ঝকঝকে দুটি চোখ। নাতি বললে, তুমি তাহলে কী খাবে দাদু?
হরিমটর।
এই যে তুমি বললে কিছু খাবে না। মটর কী করে চিবোবে দাদু, তোমার যে দাঁত নেই!
হরিমটর চিবোতে হয় না। গিলেই খাওয়া যায়।
দিদাও হরিমটর খাবে?
দিদা কোন দুঃখে খাবে! দ্যাখো গে যাও, এতক্ষণে একগাদা চচ্চড়ি নিয়ে বসে গেছে চিবোতে।
এ রাম, তুমি কিছুই জানোনা। দিদাও তোমার মতো অনশন করেছে। আজ তো রান্নাই হয়নি।
অ্যাঁ, সে কী রে? তুই কী খেলি?
আমি ঝোল-ভাত খেয়েছি।
আর ওরা?
নাতি বুড়ো আঙুলটি দাদুর সামনে নাচাতে নাচাতে বললে, কাঁচকলা, কাঁচকলা।
অ্যাঁ, বলিস কী? বুড়ির যে আবার লো প্রেশার? শেষে বুড়ি মেরে খুনের দায়ে পড়ব নাকি?
দাদু, তুমি একটা লজেন্স খাবে?
নো-ও
বাব্বা কী রাগ!
হ্যাঁ, রাগ। রাগই হল পুরুষের ভূষণ, বুঝলি বুড়ো।
যাই, দিদাকে একটা লজেন্স খাইয়ে আসি।
তোমার দিদা এখন কোথায়?
ও-ঘরে শুয়ে আছে।
কী বলছে?
পাকা পাকা কথা বলছে। বলছে, এবার আমার যেতে পারলেই ভালো। সারাজীবন একটা লোকের অত্যাচার আর কত সহ্য করা যায়! লোকটা কে দাদা?
আমি জানি। নাতি বিজ্ঞের মতো বললে, সে লোকটা হলে তুমি।
বুড়ো ছুটে পালাল। প্রকাশবাবু দাবার ছকে খুঁটি নাড়াতে নাড়াতে অনুভব করলেন, রাগ ক্রমশ পড়ে যাচ্ছে। আর রাগ যতই কমে আসছে ততই কিছু একটা খাবার ইচ্ছে প্রবল হচ্ছে। চারটে প্রায় বাজল। চায়ের সময়। মনটা ফসফস করছে। কিছু নেশা জীবনটাকে একেবারে নষ্ট করে। দিয়েছে। চা-সিগারেট। মহাত্মা গান্ধীর এসব নেশা ছিল না। তাই অনশন অত সাকসেসফুল হত। ফুলকো ফুলকো চিঁড়েভাজা খেতে ইচ্ছে করছে। নাঃ, রাগটাকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। রেগে না গেলে মানুষের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। রাগে দুর্বল মানুষও অনায়াসে জানালার শিক বাঁকিয়ে ফেলতে পারে। কী নিয়ে রাগা যায়! কার ওপর রাগা যায়! কেউ যে ধারেকাছে ঘেঁষতে চাইছে না। প্রকাশবাবু ঢক ঢক করে আবার খানিকটা জল খেলেন।
জল খেয়ে খেয়ে পেট ফুলে উঠল। ভালোই হচ্ছে, ওয়াটার থেরাপি। জলই তো জীবন। এই সময় কেউ খাওয়ার অনুরোধ করতে এলে আবার একবার রেগে ওঠা যায়। কেউ যে আসছেই না।
ছটার সময় বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। বেয়াইমশাই এলেন। বড় অমায়িক, আলাপী মানুষ। আজ না এলেই পারতেন। এ তো রাজনৈতিক অনশন নয় যে, নেতারা আসবেন লেবুর জল খাওয়াতে। এ হল পারিবারিক অনশন।