প্রশান্ত রাগ রাগ গলায় বললে, আপনি অকারণে আমাকে তিরস্কার করছেন। আমাকে যতটা ঘৃণিত ভাবছেন, আমি ততটা ঘৃণিত নই।
না না, ঘৃণিত হবে কেন? তুমি যথেষ্ট সম্মানিত, বড় চাকরি করো, মোটা টাকা মাইনে পাও। তুমি আধুনিক যুগের একজন সম্মানিত, অতিসম্মানিত সফল মানুষ। আরও উঠবে, আরও ওপরে উঠবে। তোমার গাড়ি হবে, তোমার বাড়ি হবে। হয় তো পদ্মভূষণ খেতাবও পেয়ে যাবে। তোমার সুন্দরী স্ত্রী অহংকারে মটমট করবে। তবে একটা কথা কি জানো, কেউ কেউ তোমাকে স্বার্থপর সঙ্কীর্ণ উদাসীন ভাববে।
সে কেউয়ের মধ্যে অবশ্যই আপনি একজন।
আমার ভাবায় কী এসে-যায় প্রশান্ত? আমার সব দুধ সংসার দুয়ে নিয়েছে। শুকনো গরু গোয়ালে পড়ে আছি। দু-বেলা দুটি জাবনা পাই। চারপেয়ে গরু হলে কসাইখানায় দিয়ে আসতে। তা যখন পারলে না, তখন অবহেলা, অশ্রদ্ধা, উপেক্ষা, অবমাননা দিয়ে, এক এক দিনে একশো দিনের পথ এগিয়ে দিচ্ছ। সেই মহাকসাইখানার দিকে হু-হু করে ছুটে চলেছি।
এসব কথা আপনি বলতে পারছেন?
অবশ্যই পারছি।
উপেক্ষা? আপনাকে আমরা উপেক্ষা করি? অপমান করি?
মজাটা কী জানো প্রশান্ত, তোমরা এতই উদাসীন, কী করো তা বোঝবার মতো তোমাদের বোধশক্তিও নেই। একটা উদাহরণ দেব?
নিশ্চয়ই দেবেন
আজ থেকে সাতদিন আগে তোমাকে একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ আনতে বলেছিলুম। মনে পড়ছে? তুমি সে ওষুধ এনেছিলে?
প্রশান্ত করুণ মুখে বলল, আজ্ঞে সাত কাজে ভুলে গেছি।
অবশ্যই ভুলে যাবে। ভুলতে তোমাকে হবেই! তুমি যে আমার পুত্র। তোমাকে আমি পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি। কিন্তু তোমার বউ যদি কিছু আনতে বলত, তুমি ভুলতে না, ভুলতে পারতে না। সারাদিন জপ করতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে।
আপনার এই ধারণা ঠিক নয়। আমার ভুলো মন। একটা কাজ সাতদিনের চেষ্টায় করি। মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়।
রাইট ইউ আর। আমি জানতুম তুমি ওই ফাঁক দিয়েই গলতে চাইবে। মহাঅস্ত্র তোমার হাতেটু আর ইজ হিউম্যান টু ফরগিভ ডিভাইন। তা হলে তোমার দু-নম্বর ক্যালাসনেসটা শোনো, মনে আছে, তোমাকে একদিন বলেছিলুম, কানে আমি একটু কম শুনছি, মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে। সঙ্গে সঙ্গে তুমি খুব বোলচাল ছাড়লে। পটপট কয়েকজন স্পেশ্যালিস্টের নাম বললে। বললে কালই আমি ব্যবস্থা করছি। দু-মাস হয়ে গেল। কাল সমুদ্রে চলে গেল। প্রশান্ত সামান্য বিব্রত হয়ে বললে, আপনি একটু সুস্থ আছেন দেখে আমি একটু সময় নিচ্ছিলুম।
সুস্থ আছি! এ খবর তোমাকে কে দিলে?
মা।
ও, তুমি আজকাল ঘোড়ার মুখে ঘাস খাও বুঝি! তোমার সঙ্গে কি আমার ভাসুর-ভাদ্রবউ সম্পর্ক! আমাকে একবার জিগ্যেস করতে কী হয়েছিল? কে আর ঝককি-ঝামেলা নেয়, কী বলো? বুড়ো তো বেশ আছে! ঘুরছে-ফিরছে, বসে বসে জাবর কাটছে। আমি তো তোমার শ্যালিকা নই। চিংড়ির মালাইকারি খেয়ে ঠোঁট চুলকে উঠল বলে সঙ্গে সঙ্গে বত্রিশটাকা ফিয়ের ডাক্তার এসে গেল।
কী বলছেন আপনি?
ট্র, ব্ল্যাটান্ট টুথ। নির্ভেজাল সত্য। স্বার্থ ছাড়া এ দুনিয়ায় আর কিছু নেই। ওই ছোট ছেলেটা, যার এখনও পুরোপুরি জ্ঞান হয়নি, সেও স্বার্থ বুঝেছে। স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও নড়ে না।অন্দর থেকে মহামায়ার তর্জনের গলা শোনা গেল, খোকা চলে আয়, কথায় কথা বাড়ে, টাকায় বাড়ে সুদ। চলে আয়।
প্রকাশবাবু ভুরু কুঁচকে ছেলেকে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, সরে পড়ো। বার্ধক্য বড় ছোঁয়াচে ব্যাধি, স্মল পক্সের মতো। মশারি ফেলে দিন গুণতে হয়। হ্যাঁ, যাওয়ার আগে আমার অভ্যন্তর ভাগটি অবলোকন করে যাও।
প্রকাশবাবু জামা তুলে গেঞ্জিটি দেখালেন, কী বুঝলে?
আজ্ঞে একটু লালচে হয়ে আছে।
লালচে নয় কালচে। তোমার শাসনব্যবস্থায় সাবানের বড়ই অভাব ঔরঙ্গজেব। আর তোমার গর্ভধারিণী! তাঁর কথা না বলাই ভালো। আর তোমার অর্ধাঙ্গিনী! তিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে, আধুনিক, কমরেড।
মহামায়া আবার বললেন, চলে আয় খোকা। ঘাঁটাসনি।
প্রকাশবাবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলে যাও। বিষ্ঠাবৎ পরিত্যাজ্য। যত ঢিল মারবে, তত গন্ধ বেরোবে। যাওয়ার আগে আর একটা জিনিস দেখে যাও। এইদিকে এসো।
প্রশান্ত পিতার সঙ্গে ঘরের কোণে তাকের কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। প্রকাশবাবু একটা মুখ ফাঁদালো শিশি দেখিয়ে বললেন, এটা কী জানো?
আজ্ঞে না, কড়াই-টড়াই হবে।
রাইট ইউ আর। একে বলে কুলখ কড়াই। সামান্য জিনিস অথচ এর ওপর আমার জীবন অনেকখানি নির্ভর করছে।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আজ্ঞে হ্যাঁ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
এই তো চাই, হ্যাঁ আর না, এই দিয়েই জীবনটা চালিয়ে যাও।
হোয়্যার ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস, দেয়ার ইট ইজ ফলি টু বি ওয়াইজ।
আমার কিডনি দুটো একটু দুর্বল হয়ে পড়েছে জানো কি?
আজ্ঞে সেই রকমই শুনেছি।
তার জন্যে তোমার কোনও দুশ্চিন্তা আছে?
আজ্ঞে অবশ্যই আছে?
যাক শুনে সুখী হলুম। তোমার মায়ের কোনও দুশ্চিন্তা আছে, না বিধবা হবার জন্যে নাচছে?
ছিঃ ছিঃ, এ আপনি কী বলছেন?
তর্কশাস্ত্র কি বলছে জানো, কার্য দেখে কারণ অনুমান করা যায়।
আজ্ঞে, ও শাস্ত্রটা আমার তেমন পড়া নেই। আপনি যখন বলছেন, তখন তাই হয়তো হবে।
এইবার এদিকে এসো।
প্রকাশবাবু ছেলেকে নিয়ে দেওয়াল ক্যালেন্ডারের সামনে দাঁড়ালেন।
এটা কী মাস?
আগস্ট।
কত তারিখ?
সাতাশ।
কটা লাল ঢ্যারা দেখছ?
আজ্ঞে পয়লা তারিখে একটা ঢ্যারা, আর পনেরোতে একটা ঢ্যারা।