তোমার মায়ের তিলকে তাল করা অভ্যাস। বৃদ্ধদের হ্যান্ডেল করার আলাদা কায়দা আছে। অনেকটা ট্রানজিস্টার রেডিওর মতো, শুধু টিউনিং নব ঘোরালেই হয় না। ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করতে হয়।
যাও তাহলে। এখন দক্ষিণমুখো বসে আছেন, পুব কি পশ্চিমমুখো করে দ্যাখো।
বলেছ ভালো। এবারে পুজোয় পশ্চিমে নিয়ে যাব, সেই কথাটাই বলি। হয়তো চিত্ত প্রফুল্ল হবে।
প্রকাশবাবুর বড় ছেলের নাম প্রশান্ত। বড় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজিকিউটিভ। দু-এক মাসের মধ্যে রাশিয়া যাওয়ার কথা আছে। তাই চিবুকের তলায় দাড়ির চাষ করছে, সযত্ন সম্পাদনায়। দাড়ির একটা আলাদা অ্যারিস্টোক্র্যাসি আছে। সেকালের জারেদের দাড়ি ছিল, একালের পলিটিশিয়ানদের থাকে। টলস্টয়ের দেশেদাড়ি ছাড়া যাওয়া যায়! প্রশান্তর সবে বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী-র নাম ঊর্মিলা। মিষ্টি স্বভাবের সুন্দরী মেয়ে। প্রকাশবাবুরই নির্বাচন। পুত্রবধূ পাশে পাশে, কাঁধে কাঁধে থাকবে, মিহি মিহি হাসবে, বাবা বাবা করবে—প্রকাশবাবুর মনে এইরকম একটা বাসনা ছিল। তা সংসার বধূটিকে গ্রাস করে ফেলেছে। সারাদিনে বারকয়েক দেখা হয়। জমবার আগেই মহামায়া নামক শত্ৰুটি ডেকে সরিয়ে নেয়। সম্প্রতি হোমিওপ্যাথির চর্চা শুরু করেছেন। রুগি তেমন আসে না। খুঁজে খুঁজে বের করেন। স্ত্রী মহামায়ার হোমিও ধরবে না। পান দোক্তা খেয়ে খেয়ে সিস্টেমটাকে চড়িয়ে ফেলেছে। হোমিওপ্যাথির জন্যে নরম, সাত্বিক জমি। চাই। যুধিষ্ঠির জীবিত থাকলে আদর্শ রুগি হতে পারতেন। এক পুরিয়া ওষুধে পাশা খেলার নেশা ছুটে যেত। অতবড় কুরুক্ষেত্র আর হত না। মহাভারত লেখা হত অন্যভাবে। ভীমকে আর একটু রোগা করে দিতেন। অর্জুনের নার্ভাস ব্রেকডাউন সেরে যেত বায়োকেমিকে। কৃষ্ণ বড় টকেটিভ ছিলেন, মনে হয় ডিপ্রেশনে ভুগতেন, তারও ওষুধ ছিল। দুর্যোধন, দুঃশাসন ছিলেন। ওভারসেক্সড। এক ডোজ মাদার টিংচার ছাড়লে দ্রৌপদী বেচারির ওই অবস্থা হত না। গান্ধারীকে দিতেন ব্যার্থ কনট্রোলের দাওয়াই। হ্যানিম্যান সায়েব যে বড় দেরিতে জন্মালেন। ভেবেছিলেন পুত্রবধূটিকে মনের মতো রুগি তৈরি করবেন, তা আর না। আজ পর্যন্ত একবারও ফ্যাঁচ করে হাঁচল না। বিয়ের জল পড়ে বরং…না থাক, ওসব কথা না ভাবাই ভালো। কন্যাসমা।
এখন একমাত্র সম্ভবনাপূর্ণ রুগি মেয়ের ছেলে ওইনাতিটি। একমাত্র রোগ পেটের গোলমাল। এন্তার খাচ্ছে আর হজমের একমাত্র রোগ পেটের গোলমালে সব এলোমেলো করে ফেলছে। এ রুগিও বেশিদিনের নয়। গরমের ছুটি শেষ হলেই মিরাটে পালাবে।
প্রকাশবাবু হাঁক মারলেন, বুড়ো।
বুড়ো এই ডাকটির অপেক্ষাতেই ছিল। ছেলে এই বয়সেই অনেক কথা শিখেছে। দু-পক্ষ জোরে জোরে কথা বলে খিচাইন হচ্ছে। দাদু আর দিদা এতক্ষণ জোরে জোরে কথা বলছিল বলে ঘরে ঢোকেনি। এখন পুতুলটিকে বুকে চেপে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল,
কী বলছ দাদা?
এদিকে এসো।
তুমি কি খুব রেগে আছ?
তা একটু আছি।
তাহলে পরে আসব।
কেন?
এখন তো তুমি কিছু দেবে না।
অ, পৃথিবীতে কেবল দাও আর দাও, তাই না বুড়ো? শুধু দাও, কেবল দিয়ে যাও। আচ্ছা, তোমাকে আর কোনওদিন আসতে হবে না। মায়া, মায়া, সব মায়া!
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশবাবু তিনবার টুসকি মারলেন। এক সময় অল্পস্বল্প সংগীতচর্চা করতেন। গুনগুন করে গান ধরলেন, ভিখারি বাসনা করি হইতে চায় লক্ষপতি, লক্ষপতি হলেও সে হইতে চায় কোটিপতি। আরও দু-চার লাইন এগোতে ছেলে প্রশান্ত ঢুকে ভাব চটকে দিল। এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা প্রকাশবাবুর অসহ্য লাগে। রাখতে হয় পুরো রাখো ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির মতো, নয়তো মেরে সাফ করে দাও। এ কী ধরনের ক্ষৌরী!
যাক, মুখ নীচু করে থাকাই ভালো। সংসরের কোনও কিছুর দিকে আর তাকাবেন না। প্রতিজ্ঞা। গীতা বলছেন, উদাসীন বাচরেত। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তবাবু দাঁড়িয়ে। রইলেন। গানের পরের লাইনটা মনে ভাসছে, কোটিপতি হলেও সে ইন্দ্রত্ব লভিতে চায়।
প্রশান্ত একগাল হেসে বললে, কী, মর্নিংওয়াকে যাচ্ছেন?
কানের পাশে সাবান শুকিয়ে আছে। নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা-দুটো খুসকি উড়ে যাচ্ছে। দাড়ির যত বাড়বাড়ন্ত চুলের ততটা নয়। সামনের দিকে পাতলা হয়ে এসেছে। শ্যাম্পু করে ফুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রশান্তর দেহগত ত্রুটি আজ পিতার চোখে ধরা পড়ছে। স্বার্থপরের মতো নেওয়াপাতি একটি ভুঁড়ি নামছে। আলোচাল খাওয়া বিধবাদের মতো চোখমুখ ফুলো ফুলো। ভোগীর চেহারা। এ চেহারা ত্যাগীর নয়।
প্রকাশবাবু কাটা কাটা গলায় বললেন, কেন বলো তো? বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলে তোমাদের সুবিধে হয়?
প্রশান্ত হকচকিয়ে গেল। স্নিগ্ধ প্রাতঃকাল। পাখি ডাকছে। দিবসের এই সময়টিতে কারওর মেজাজ এমন উত্তপ্ত হয়ে থাকলে পরিবেশের সঙ্গে মেলে না। আমতা আমতা করে বললে:
আপনি আমাকে ভুল বুঝলেন।
তোমার ধারণা বুঝি সেইরকম। নিজেকে ঠিকমতো চেনো কি? কখনও অ্যাসেস করে দেখেছ? দেখার চেষ্টা করেছ কোনওদিন! পার্সেন্টেজ অফ স্বার্থপরতা কত, উদাসীনতার পার্সেন্টেজ কত, লোভ কত, লালসা কত, ভণ্ডামি কত! সময় পেলে একবার খতিয়ে দেখো।
কথা শুনে প্রশান্তর পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে উঠল। আশ্চর্য! ভদ্রলোক অকারণে খোঁচা মারছেন। খেতে একটু ভালোবাসি। সে আসক্তি তো ওঁরও ছিল। এখনও আছে লালসা? সে বস্তুটা কী? মানেটা ঠিক জানা নেই। অভিধান দেখতে হবে। স্বার্থপরতা? স্বার্থপরতার কী দেখলেন? দক্ষিণের ঘরটা তো নিজেই ছেড়ে দিলেন। পশ্চিমের ঘরে সব তুলে নিয়ে এলেন। কারওর কথা শুনলেন না। এখন সারা দুপুর রোদের তাপে কষ্ট পান। শুনিয়ে শুনিয়ে বলেন, লোডশেডিং অর নো লোডশেডিং আমার সেই এক অবস্থা। পাখার বাতাস যেন ব্লাস্টফার্নেসের ঝাপটা। ভণ্ডামি? ভণ্ডামি মানে? তিলক সেবা করে কীর্তনও করি না, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা বব-ববম হুঙ্কার ছাড়ি না।