না, খাব না। আমি খ্যাচাখ্যাচি করতে চাই না, নাকে কাঁদতে চাই না, আমি সাবেকপন্থী শান্তিপ্রিয় মানুষ, আমরণ অনশনের আমার সিদ্ধান্ত। তুমি এখন যেতে পারো। যাওয়ার সময় তোমাদের এই হতচ্ছেদ্যার পিঁপড়ে ভাসা, সর ভাসা, কেলে গামছা নিঙড়োনো গরম জলটা নিয়ে যাও।
মহামায়া চেয়ার ছেড়ে উঠে চায়ের কাপের সামনে ঝুঁকে পড়লেন, তারপর স্বামীর দিকে ফিরে বললেন, কোথায় তোমার পিঁপড়ে আর সর! দেখাও তো! আর বর্ণ? এমন সোনার বর্ণ চা। তোমাকে গ্র্যান্ড হোটেলও দিতে পারবে না। না দেখেই ধেই ধেই নাচ। সারা জীবন ছাত্র ঠেঙিয়ে…।
প্রকাশ স্ত্রীকে কথা শেষ করতে দিলেন না, নিজেই টেনে নিলেন গাধা হয়ে গেছি, গাধা। ধোপার গাধা হলে তবু পরিত্রাণের পথ ছিল, স্ত্রী-র গাধা হয়ে মরেছি। ইহকাল, পরকাল দুটোই গেল।
আমি তোমাকে গাধা বলেছি?
ওই কথার পর অবধারিত ওই কথাটাই আসে। আমার বয়স হয়েছে, ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না।
দ্যাখো, সকালবেলা শুধু শুধু ঝগড়া কোরো না। কোথায় তোমার পিঁপড়ে আর সর। তুমি দেখাও।
প্রকাশ চশমা পরে চায়ের কাপ সামনে টেনে নিয়ে প্যাথোলজিস্টের মতো চা পরীক্ষা করতে লাগলেন। মহামায়া বিজয়িনীর মতো হাসছেন, পাবে না, পাবে না, ব্যর্থ চেষ্টা।
প্রকাশ বললে, ছিল, থাকতে থাকতে গলে গেছে।
গলে গেছে? মহামায়া ছেলেমানুষের মতো খিলখিল করে হেসে উঠলেন।
হেসো না, হেসো না। ডোন্ট লাফ। আজ হয়তো নেই ভাগ্যক্রমে অথবা ছিল, অন্যদিন গোটাকতক পিঁপড়ের লাশ, বাসি দুধের সর থাকবে। বুডোর ব্রেকফাস্ট।
অন্যদিনের কথা আমি জানি না। বউমা কী করে আমি বলতে পারব না।
অ, তোমার বউমা তাহলে যা খুশি তাই করতে পারে! সাত খুন মাফ।
আঃ, কেন পরের মেয়েকে মিথ্যে মিথ্যে দোষী করছ?
অ, আমি হলুম মিথ্যেবাদী, তুমি হলে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। এ সংসারে তোমরা দলে ভারী বলে দিনকে রাত করবে?
বউমা তোমার যথেষ্ট সেবা করে। শ্রদ্ধা করে। ভয়ও করে। কেন পরের মেয়ের নামে মিথ্যে বলো সব!
আমি অন্যের সেবা নেব কেন? তুমি আমার জন্যে কী করো? এই বেওয়ারিশ বুড়োর জন্যে!
আমি কিছু না করলে এতদিনে ভেসে যেতে।
তার মানে তোমার আদরের বউমা কিছু করে না!
উঃ আচ্ছা জ্বালায় পড়া গেল তো। এগোলেও নির্বংশের ব্যাটা, পেছলেও নিবংশের ব্যাটা। তুমি কি আগুন জ্বালাতে চাচ্ছ, শুধু শুধু অকারণে?
আগুনটাগুন নয়, আমার পথ শান্তির পথ। আমরণ অনশন। ধীরে ধীরে নিবে যাওয়া। অনেকদিন এসেছি মহামায়া। পুরোনো হয়ে গেছি। গরুর দুধ চলে গেলে গোয়ালা কসাইখানায় দিয়ে আসে। তখনও তার দু-পয়সা কামাই হয়। দুর্ভাগ্য তোমার, আমি গরু নই।
হোল ফ্যামিলি তোমার জন্যে তটস্থ তবু তোমার মন পায় না।
এরপর আমাদের আর কিছু বলার নেই।
অই, অই সেই শব্দ। আমাদের, তার মানে তোমরা একটা দল, অনেকটা একালের মাস্তান পার্টির মতো। আর আমি হলুম গিয়ে একা মাইনরিটি। শাসনের নামে দুঃশাসন চলেছে। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। লাশ পড়ে যাবে। মেজরিটি যা করবে মুখ বুজে সহ্য করতে হবে। নইলে তুমি খিটখিটে বুড়ো, একলাষেড়ে, বাহাত্তরে ধরেছে, চিরকালের স্বার্থপর। দে বেটাকে একঘরে করে। ধোপা-নাপিত সব।
মহামায়া হাত-পা নেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, মাস্টার না হয়ে তোমার উকিল হওয়া উচিত ছিল। নাম করতে পারতে, দুটো পয়সার মুখও দেখা সম্ভব হত। আমরা মানে, আমরা যারা তোমার সেবা করছি।
প্রকাশবাবু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, সেবা? তোমরা আমার সেবা করছ! গোপাল সেবা? সিংহাসনে একবার করে ওঠাচ্ছ আর শোয়াচ্ছ। শালগ্রামের শোয়াও যা বসাও তাই। বোঝার উপায় নেই, বসে আছি না শুয়ে আছি। যুগ যুগ জিও।
এটা কী ভাষা?
যুগের ভাষা।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, বুঝলে? সব নাটবল্ট ঢিলে হয়ে গেছে। সারা জীবন ছাত্র ঠেঙালে হয়।
কী হয়—গাধা?
সে কথা বলেছি?
সব কথা কি আর বলতে হয়? বলার আগেই বুঝে নিতে হয়।
এ বুড়োটা তো মহা ঝগড়াটে!
অ, আমি এখন বুড়ো, আর নিজে ভারি যুবতী? যৌবনে শরীর একেবারে মাখামাখি।
মহামায়া রাগে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন, চা খেতে হয় খাও, না খেতে হয় ফেলে দাও। সাতসকালে এই হুলো বেড়ালের মতো ঝগড়া আমার ভালো লাগে না। বয়েস বাড়ছে না কমছে?
বাতের ব্যথা ভুলে মহামায়া দুম দুম করে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলেন। নাতিটা দালানের একপাশে পুতুল নিয়ে খেলছিল। দিদাকে দেখে বললে একটু চুন-হলুদ করে দেবে দিদা, আমার এই গুন্ডা ছেলেটা পা মচকে ফেলেছে।
অন্যদিন হলে কোলে তুলে নিতেন, আজ মেজাজ ভালো নেই, বললেন, তোমার মামিকে বলো।
নাতি আপনমনেই বললে, বাবা মেজাজ একেবারে টপ।
ছেলে দাড়ি কামাচ্ছিল, মহামায়া বললেন, তোর বাবা সকাল থেকেই অনশন শুরু করলেন, আমৃত্যু।
বাবা! গান্ধী রিলিজ হতে না হতেই সত্যাগ্রহ? কীসের দাবিতে অনশন?
ওঁকে নাকি আমরা সবাই উপেক্ষা করছি। কুকুর-বেড়ালের চেয়েও অধম জ্ঞান করছি।
বৃদ্ধরা একটু অভিমানী হয় মা। কী করেছিলে?
কী আবার করব?
কোনও খোঁচাখুঁচি করোনি তো?
না রে বাবা, দুর্বাসা মুনিকে খোঁচাতে হয় না, পান থেকে চুন খসলেই তেলে-বেগুনে।
ঠিক আছে। তুমি আর নাড়াচাড়া করতে যেও না, আমি যাচ্ছি। এই ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি নিয়েই হয়েছে সমস্যা।
বাড়ির যা অবস্থা, ওটাকে এখন নামিয়ে দেনা বাবা।