একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিয়ে, কাঁপা কাঁপা, দুরুদুরু বুকে যতটা সম্ভব দ্রুত স্থানত্যাগ। একটা টাটকা মৃত্যু। দুশ্যটা অসহনীয়। মাত্র পনেরো-কুড়ি মিনিট আগের ঘটনা। জনশূন্য স্থান। সকলেই নিজের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত। সকলেই স্থান ত্যাগ করেছে। আমিও করছি। এ ছাড়া কী করার আছে! পশু হলে হয়তো মৃতদেহের পাশে এসে শুকে দেখতুম, বিলাপ করতুম। চকাচকি পাখির গল্প শুনেছি। কাকের মৃত্যুও দেখেছি। মানুষ আজকাল পথে-ঘাটে নিঃসঙ্গে মরে। মৃত্যুর আর যেন সেই গ্ল্যামার নেই।
সেই নির্জন রাস্তায় হঠাৎ কিছু চরিত্রের আবির্ভাব হল। চার-পাঁচটি ছেলে, প্রত্যেকেরই দু-হাতে গোলাকার পদার্থ। মৃতদেহের কাছাকাছি এসে, একটা গলির মধ্যে, সেই বিস্ফোরক দু-একটা ছুড়ে দিল। আমি একটু ভয় পেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম আমার শবদেহের ওপর দিয়েই চলে যেতে চাইবে। কিন্তু আমাকে তারা উপেক্ষা করল। আমার শরীর একটু ঘর্মাক্ত হল। আমার গতি দ্রুত হল। আমার কণ্ঠতালু শুষ্ক হল। এখন কি কোনও রিকশা পাওয়া যাবে? আমার পথের সঙ্গী? কোথায় কী! পথ জনশূন্য। যতদূর দৃষ্টি চলে, সরীসৃপ রাস্তা প্রসারিত। সেই প্রসারিত রাস্তায়, মৃত্যুকে সঙ্গী করে আমি যেন কত যুগ ধরে চলেছি। অবশেষে পৌঁছেছি আমার সেই কোমল, কমনীয় গৃহের গণ্ডিতে।
কাবরী উৎকণ্ঠিত। তুমি আসছ না কেন? আমি ভাবছি। চারটে বলেছিলে। তারপর কী গোলমাল এইদিকে। তুমি এসেছ! কাবেরী আনন্দে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আরও কীসব করে ফেলল আবেগের মুহূর্তে। একবার মনে হল সেই পথের চার মোহনায় যে পড়ে আছে, তারও জন্যে হয়তো এমনই কেউ জানলার গরাদে মাথা রেখে অপেক্ষা করছে। আমার অক্ষত ফিরে আসার পুরস্কার এই আদর, এই চুম্বন। অবশেষে গরম কফি, কিছু সুস্বাদু ভাজা। জীবনের ছোট ছোট অথচ গভীর সুখ।
রান্নাঘর থেকে প্রেসার কুকারের স্টিম মাংসের সুগন্ধ নিয়ে আসছে। ভাগ্যিস ওইসব গোলমাল শুরু হওয়ার আগেই কিনে এনেছিলাম। কাবেরী যেন বিজয়ীর হাসি হাসল। মানুষ কত অল্পে কত তৃপ্ত। মাংস কেনা আর রাজ্য জয় করা যেন দুটো সমান ওজনদার জিনিস। মাংস না পেলেই বাকী অসুবিধে হত! কিছুই না, ডিম ছিল। কাবেরী একটু ছড়িয়ে বসল। শরীর বেশ ভারী। হয়েছে। এই সময়টা মেয়েদের কেমন যেন ক্লান্ত অথচ পূর্ণ দেখায়। কফি খেতে খেতে কথা হচ্ছে। কিছু অপ্রাসঙ্গিক। চারদিক নিস্তব্ধ। রাস্তা অন্ধকার, জনশূন্য। আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনও বাড়িতে একটা রেডিও বাজছে না। একটা থমথমে আবহাওয়া। কখন কী ঘটে যায়! একটু আগে জীবনকে মেডেলের মতো গলায় ঝুলিয়ে ওই পথে যে এসেছি এ যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আশে-পাশে এখনও অনেকে ফিরতে পারেনি। কিন্তু তাতে আমাদের কফি খাওয়া অথবা ছোট ছোট গল্পের কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। কারণ আমি তো ফিরে এসেছি, যারা। আসেনি তারা আসবে, হয়তো আসবে না। কী করা যাবে। আজকাল আর কিছু করা যায় না। ঘটনার স্রোতকে প্রতিরাধ করা যায় না। চারদিক অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। তা না হলে হয়তো গান গাওয়া যেত কিংবা রেডিওগ্রামে কিছু রেকর্ড বাজানো যেত। কিন্তু ইস্পাতের পাতের মতো এই দুর্ভেদ্য নিস্তব্ধতাকে শব্দ দিয়ে ভেদ করতে ইচ্ছে করছে না।
তোমাকে আজ সকাল সকাল আসতে বলেছিলুম, তা না হলে, কী হত বলো তো! যত রাত বাড়ত ততই গোলমাল বাড়ত। পথঘাট বিপজ্জনক হত। আর আমি একলা এই শরীরে কেবল ঘরবার করতুম। তা ঠিক। তবে কী জানো, তুমি কোনওদিন ফুটবাথ নিয়েছ? প্রথমে গরম জলে পায়ের তলা ছ্যাঁক করে ওঠে। পা তুলে নিতে হয়, তারপর সইয়ে সইয়ে আস্তে আস্তে আধখানা পা সহজেই চলে যায় জলের তলায়। এখন যদি ওই অন্ধকার ঘন রাতে, ঘাতকদের মধ্যে দিয়ে আমাকে আসতে হত, উপায় নিশ্চয়ই একটা বের করে নিতুম। ছায়ায় ছায়ায় মিশে মিশে, বিপদকে ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে রেখে, দেখতে ঠিকই এসে উঠেছি তোমার এই ঘরে। দেখবে আমার পরেও এমনিভাবে অনেকে এসেছে।
এর পর আমাদের সেই শান্ত গৃহকোণে বাইরের জগতের নানা খবর ভেসে আসতে লাগল। অনেক ঘুরে অনেক বিপদের ঝুঁকি নিয়ে, হাত মাথার ওপর তুলে অনেকে ফিরে এলেন। দোকান পুড়ছে। বাড়ি জ্বলছে। অসংখ্য ক্ষিপ্ত মানুষ অনেক মৃত্যু দিয়ে একটি মৃত্যুর ক্ষোভ ভুলতে চাইছে। কে যাবে, কে থাকবে বলা শক্ত। অনেকে এমন কথাও বললেন, আমরা নাকি কেউই। নিরাপদ নই। কাবেরী যেন আমার খুব কাছাকাছি এসে একটু নিরাপত্তা খুঁজতে চাইছে। সে যেন এই মুহূর্তে জানালা, ঘরের কোণে কোণে, এমনকী শিলিং-এ পর্যন্ত অসংখ্য কালো কালো মুখ দেখছে।
রান্না বেশ ভালো হয়েছে। আয়োজনে কোনও ত্রুটি নেই। সাজানো খাবার টেবল, পরিষ্কার টেবল-ঢাকা, দুগ্ধশুভ্র চিনেমাটির পাত্রে ভোজ্যসামগ্রী। ফিকে ধোঁয়ায় মৃদু গন্ধ ভাসছে। এই হল গার্হস্থ্য সুখ। পরিবেশ, বিপ্লব কিংবা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ অথবা অনেক কৃচ্ছসাধনের কথা। ভুলিয়ে দেয়। জৈবিক আর আধ্যাত্মিকের অপূর্ণ সমন্বয়। যৌবনবতী নারী উষ্ণ, কমনীয়। সুস্বাদু ভোজ্যসামগ্রী। একটা সৌন্দর্যঘেরা পরিবেশ। কিছু সৃজনী প্রতিভা, দুটো বিচারশীল মন।
কিছু মানুষ হয়তো এখনও বাইরে, মর্গে, কিংবা হাসপাতালের এমারজেন্সি বিভাগে অথবা অপারেশন টেবিলে কিংবা ক্রিমেটোরিয়ামে—এমন সমস্ত পরিবেশে যেখানে দৈহিক সুখ নেই, মানসিক স্থৈর্য নেই; কিন্তু আমরা এখন দুজনে পরম নিশ্চিন্তে একটি সুকোমল শয্যায় ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি। এর পর ঘুম আসবে দু-চোখ জুড়ে নিঃশব্দে, একরাশ পাখির মতো, ডানা নেড়ে নেড়ে।