বিকাশকে জিগ্যেস করলুম, কী মনে হচ্ছে? তোমার ষষ্ঠ অনুভূতি কী বলছে?
পড়তি!
আর পড়বে না, এখন একটা জায়গায় এসে আটকেছে। আর তোমার তো দাবিদাওয়া নেই।
দাবি না থাক, এই ভাঙা গোয়ালে কে বাসর পাতবে। সাপে কামড়ালে কে বাঁচাবে ভাই! লক্ষীন্দরের বাসর হয়ে যাবে। আমার ষষ্ঠ অনুভূতি বলছে, এই বাড়িতে কম সেকম এক হাজার জাতসাপ আছে।
বিকাশের কথায় গা জ্বলে গেল। আমাদের সঙ্গে রকে বসে আড্ডা মারত। চা, চপ খেত। হঠাৎ ভালো একটা চাকরি পেয়ে মাথা বিগড়ে গেছে। ধরাকে সরা জ্ঞান। মনে মনে বললুম—যা ব্যাটা মরগে যা। বিকাশের ওপর আমার একটা ঘৃণা আসছে।
ভদ্রলোক নিজেই একটা ট্রে দু-হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তার ওপর সাধারণ দুটো কাচের গেলাস। গেলাসে ডাবের জল। ট্রেটা সামনে রেখে সাবধানে গেলাস দুটো আমাদের হাতে তুলে দিলেন। বিকাশ ডাঁট মারতে শুরু করেছে। গেলাসটা এমন ভাবে নিল, যেন দয়া করছে। কার্পেটের একপাশে রেখে ভারিক্কি গলায় বললে, এই সব ফর্মালিটি ছেড়ে, কাজের কাজ সারুন! আমার অনেক কাজ আছে।
ভদ্রলোক সবিনয়ে বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়! তবে দূর থেকে আসছেন, গরমকাল, এখনও কিছু পিতার আমলের নারকেল গাছ আছে। খেয়ে দেখুন, খুব মিষ্টি জল!
ও জলটল পরে হবে, দেখাদেখিটা সেরে নিন।
ভদ্রলোক বিষণ্ণ, বিব্রত মুখে ভেতরে চলে গেলেন। আমি বিকাশকে বললুম, তোর সঙ্গে আর আমি যাব না কোথাও। এবার তুই ছোটলোকমি শুরু করেছিস।
ছোটলোকমির কী আছে! আমার এই রোগা রোগা চেহারার পড়তি বড়লোকদের বিশ্রী লাগে। বিনয়ের আদিখ্যেতা। স্পষ্ট উচ্চারণে নীচু গলার কথা।
তা হলে এলি কেন, খামোখা একটা মানুষকে অপমান করার জন্যে?
জানব কী করে?
একটা চেয়ার নিয়ে ভদ্রলোককে আসতে দেখে এগিয়ে গেলুম। ভারী চেয়ার। একা সামলাতে পারছেন না।
সরুন আমি নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বইছেন কেন! আর কেউ নেই?
না, আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। আমার চেহারা দেখে আপনি বুঝতে পারবেন না।
আমি খুব খাটতে পারি।
চেয়ারটাকে জানালার পাশে আমাদের দিকে মুখ করে রাখা হল। কিছু পরেই তিনি পাত্রীকে নিয়ে এলেন। সাজগোজের কোনও ঘটা নেই! ফিকে নীল শাড়ি। হাতাওয়ালা সাদা ব্লাউজ। চুলে একটা এলো খোঁপা। কপালের মাঝখানে ছোট্ট একটি টিপ।
মেয়েটি নমস্কার করে চেয়ারে বসল। পুরো ব্যাপারটাই অস্বস্তিকর! বোকা বোকা হৃদয়হীন নির্দয় একটা ব্যাপার। দু-জোড়া চোখ প্রায় অসহায় একটি মেয়েকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে! আমি সেভাবে না দেখলেও বিকাশ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে দেখছে। মাপজোক করছে। সুন্দরী বউ চাই। ডানাকাটা পরি চাই। লেখাপড়ায়, চাকরিতে বাল্যবন্ধু সোমেন মেরে বেরিয়ে গেছে। হেরে আছে একটা জায়গায় বিয়েতে। পেয়েছে খুব, কিন্তু বউ নিখুঁত সুন্দরী নয়! বিকাশ বউ দিয়ে মেরে বেরিয়ে যাবে।
মেয়েটি মুখ নীচু করে বসে আছে। ভদ্রলোকের মুখের আদলের সঙ্গে মেয়েটির মুখ মেলে— ধারালো অভিজাত মুখ। চাঁপা ফুলের মতো গাত্রবর্ণ। লম্বা ছিপছিপে বেতসলতার মতো চেহারা। ভারি সুন্দর। বেশ একটা মহিমা আছে। অন্তত আমার চোখে। মেয়েটি খুব নম্র। ভীরু মনে হল। বসে আছে অসহায় অপরাধীর মতো।
ভদ্রলোক বলতে লাগলেন, ছেলেবেলায় দিদি আর জামাইবাবু মারা যাবার পর আমার এই ভাগনি আমার কাছেই মানুষ। তখন আমাদের সাংঘাতিক দুরবস্থা। তবু আমি আমার কর্তব্য করে গেছি। পড়িয়েছি। গান শিখিয়েছি। সভ্যতা, ভদ্রতা, সংসারের যাবতীয় কাজ শিখিয়েছি। একটাই আমি পারিনি। তা হল ভালো করে খাওয়াতে পারিনি। তার জন্যে দায়ী আমাদের অভাব। আমার রোজগার করার অক্ষমতা। তবে এই গ্যারান্টি আমি দিতে পারি, এমন মেয়ে সহজে পাবেন না। দুঃখের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বড় হয়েছে। ওদিকে বড় ঘরের সংস্কারও কাজ করেছে। মেয়েটিকে আপনারা গ্রহণ করুন। আমার শরীর ক্রমশই ভেঙে আসছে।
বিকাশ ফট করে উঠে পড়ল। একেবারে আচমকা।
ভদ্রলোক অপদস্থ হয়ে বললেন, কী হল! আমি কি কোনও অন্যায় করে ফেললুম!
বিকাশ একেবারে গুলি ছোড়ার মতো করে বললে, যে মাল বিজ্ঞাপনের জোরে বিকোতে হয় সে মাল ভালো হয় না।
মেয়েটি শিউরে উঠল।
ভদ্রলোক বললেন, এ কী বলছেন আপনি!
ঠিকই বলছি। আপনার ভাগনির স্ত্রী-রোগ আছে।
আমার পক্ষে সহ্য করা আর সম্ভব হল না। সমস্ত শক্তি এক করে বিকাশের ফোলা ফোলা গালে ঠাস করে এক চড় মারলুম। আর একটা চড় তুলেছিলুম। ভদ্রলোক ছুটে এসে আমার হাত চেপে ধরলেন। উত্তেজনায় কাঁপছেন। বিকাশের নিতম্বে কষে একটা লাথি মারার বাসনা হচ্ছিল।
বিকাশমুখে অহংকারী, শরীরে দুর্বল। হন হন করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
আমি ফিরে তাকালুম! ভীরু মেয়েটির ঠোঁট ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। বড় বড় পাতাঘেরা চোখে জল টলটলে! সেই মুহূর্তে ভেতরের বাড়িতে শাঁখ বেজে উঠল। পুজো হচ্ছে গৃহদেবতার। ঘণ্টা বাজছে টিং টিং করে। আমি পিছোতে পিছোতে চৌকিটার ওপরে গিয়ে বসলুম। আমার ভীষণ একটা তৃপ্তি হয়েছে। একটা অসভ্য একটা ইতরকে আমি আঘাত করতে পেরেছি। অসীম সুখে আমার মন ভরে গেছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে যখন শাঁখ আর ঘণ্টা বাজছে পুজোর ঘরে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সাংঘাতিক একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললুম। ভদ্রলোককে বললুম আপনি দিন দেখুন, আমি বিয়ে করব। আমি বড় চাকরি করি না, তবে মানুষ। বিয়ে এখন বড়লোকের ব্যবসা, তবু আমি এই ঝুঁকি নেব। আমর পিতা এলে পাকা কথা বলে যাবেন। হ্যাঁ তার আগে আপনার ভাগনিকে জিগ্যেস করুন আমাকে পছন্দ কি না?