অসম্ভব! তোর বিয়ে হওয়া অসম্ভব। হলেও ডিভোর্স হয়ে যাবে। এই সব ডিফেকট একটা মেয়ের খুব কাছে না এলে ধরা যায় না।
ধরার চেষ্টা করতে হবে। বউ করব বাজিয়ে। এ তো প্রেম করা নয়, যে মেনে নিতে হবে প্রেমের প্রলেপ দিয়ে। আমি সব শুনে রাখলুম। মনে মনে হাসলুম। এমন মেয়ে মানুষের বাড়িতে মেলা অসম্ভব। কুমোরটুলিতে অর্ডার দিতে হবে। স্বয়ং মা দুর্গাও হয়তো অসুর মারার সময় ঘেমেছিলেন।
রবিবারের এক বিকেলে আমরা রামরাজাতলায় মেয়ে দেখতে গেলুম। বেশ বড় সাবেক আমলের বাড়ি। গ্যারেজ আছে। বিকাশ ঢুকতে ঢুকতে বললে, আমার ষষ্ঠ অনুভূতি বলছে, এই বাড়িই আমার শ্বশুরবাড়ি।
হলেই ভালো। তবে তোমার যা চাহিদা!
বৈঠকখানায় আমরা বসলুম। বসতে না বসতেই মেয়ের বাবা সবিনয়ে এসে হাজির। মোটাসোটা এক ভদ্রলোক। ঢোলা পাঞ্জাবি পরিধানে। ভুঁড়িটা সামনে ফুটবলের মতো উঁচু হয়ে আছে। ভদ্রলোক সোফায় বসামাত্র বিকাশ উঠে দাঁড়াল।
ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, কী হল আপনার?
আমার পছন্দ হল না। বিকাশের সরাসরি উত্তর।
কী করে! আপনি তো আমার বোনকে এখনও দেখেননি।
বিকাশ একটু থতমতো খেয়ে গেল। আমরা দুজনেই ভদ্রলোককে পিতা ভেবেছিলুম। মেয়ের দাদা বললেন, আমার বোনকে আগে দেখুন, তারপর তো পছন্দ-অপছন্দ!
বিকাশ বললে, শুধু শুধু আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই। আপনাকে দেখেই আমার ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে আপনার মতোই হবে। আপনারই স্ত্রী-সংস্করণ।
ভদ্রলোক বেশ আহত হয়ে বললেন, ছিঃ চেহারা তুলে কথা বলবেন না। এটা এক ধরনের অসভ্যতা।
আমি বললুম, আমার বন্ধুর কোনও দাবি-দাওয়াও নেই, পছন্দ হলেই পত্রপাঠ কাজ সারবে। তবে ওর একটাই শখ, বউ যেন সুন্দরী হয়।
ভদ্রলোক বললেন, আমাকে দেখে আমার বোন সম্পর্কে কোনও ধারণা করলে ভুল করবেন। সে কিন্তু প্রকৃতই সুন্দরী।
বিকাশ বললে, ও ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারলে না। আমি শুধু সুন্দরী মেয়েই চাই না, আমি চাই সুন্দরের বংশ। আপনি আমার শ্যালক হলে পরিচয় দিতে পারব না। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাবে।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে বললেন, গেট আউট। আভি নিকালোহিয়াসে।
আমরা এক দৌড়ে রামরাজাতলার রাস্তায়। ভদ্রলোক এই ভদ্রতাটুকু অন্তত করলেন, যে রাস্তা পর্যন্ত তেড়ে এলেন না। এলে পাবলিক আমাদের পিটিয়ে লাশ করে দিত। বেশকিছু দূরে একটা চায়ের দোকানে বসে, চা খেতে খেতে বিকাশকে বললুম, তাহলে আরও কিছু নতুন শর্ত যোগ হল?
হলই তো। একটা পয়সাও যখন নেব না, তখন বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বিয়ে করব। অনেকে কী করে জানিস তো, মেয়ের এক একটা ডিফেক্টের জন্যে টাকা দাবি করে। একটু খাটো মাপের, দু-হাজার। নাক থেবড়া, পাঁচ হাজার। চাপা রং তিন হাজার। সামনের দাঁত উঁচু, সাত হাজার। পৃথিবীটা লোভী মানুষে ছেয়ে গেছে। অনেকে দেখবি ওই কারণে ওই রকম মেয়েই খোঁজে। বিয়ে নয়, ব্যবসা।
তুই মেয়েটিকে না দেখে ওইরকম একটা অভদ্র কাণ্ড করলি কেন?
শোন লুঙ্গি পরা শ্বশুর, ভুড়িঅলা শালা, দাঁত বড় শাশুড়ি—এই সব আমার চলবে না। আমি যে বাড়ির জামাই হব সে বাড়িতে যেন চাঁদের হাটবাজার হয়।
বাড়িতে লুঙ্গি পরা চলবে না?
না, লুঙ্গি অতি অশ্লীল জিনিস। আমার শ্বশুরকে ড্রেসিং-গাউন পরতে হবে।
বেশ ভাই, যা ভালো বোঝো তাই করো।
সব সময় একটু দূর ভবিষ্যতের দিকে তাকাবি। ধর বিয়ের পর আমাদের একটা গ্রুপফোটো তোলা হল। আমার পাশে হিড়িম্বা, আমার ওপাশে সূর্পনখা, পেছনে ঘটোৎকচ, তার পাশে হিরণ্যকশিপু। কেমন লাগবে?
বেশ কিছুদিন কেটে যাবার পর শুকচরে আবার একটি মেয়ে দেখতে যাওয়া হল। সেও বেশ সাবেককালের বাড়ি বনেদি বাড়ি। লোকজন নেই বললেই চলে। বাড়ির আকার-আকৃতি দেখলে মনে হয়, শতাব্দীর শুরুতে এই গুহ ছিল শতকণ্ঠে মুখর। উঠোনের পাশে ভেঙে পড়া একটি বাড়ির কাঠামো দেখে মনে হল, এখানে একসময় একটি আস্তাবল ছিল। আমার অনুমান সত্য প্রমাণ করার জন্যে পড়ে আছে কেরাফি গাড়ির দুটি ভাঙা চাকা। বিকাশের কী মনে হচ্ছিল জানি। না, আমার মনে ভিড় করে আসছিল অজস্র মুখস্মৃতি। মনে হচ্ছিল আমি যেন ইতিহাসে ঢুকে পড়েছি। আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। সামনেই চণ্ডীমণ্ডপ। ভেঙে এলেও, অস্তিত্ব বজায়। রেখেছে। পরিচ্ছন্ন। দেয়ালে টাটকা স্বস্তিকা চিহ্ন দেখে বুঝতে পারলুম এখনও পূজাপাঠ হয়। উঠানের একপাশে ফুটে আছে একঝাঁক কৃষ্ণকলি আর নয়নতারা। ভীষণ ঘরোয়া ফুল। দেখলেই মনে হয় দুঃখের মধ্যে সুখ ফুটে আছে। যে সব পরিবার, বড় পরিবার ভেঙে গিয়েও নতুন করে বেঁচে আছে, নতুন ভাবে, তাঁদের সেই অতীত বর্তমানের জমিতে ফুটে থাকে কৃষ্ণকলি হয়ে। বিশাল দরজা, ততোধিক বিশাল উঠান পেরিয়ে আমরা চলেছি। তখনও মানুষজন চোখে পড়েনি। ভেতরের বাড়িতে সবাই আছেন। দূরে কোথাও একটা গরু পরিতৃপ্ত গলায় ডেকে উঠল। এই ডাক আমার চেনা—এ হল গরবিনী গাভীমাতার ডাক। আমি জাতিস্মর নই, তবু মনে হত লাগল এই বাড়ি আমার অনেককালের চেনা।
ভেতর বাড়িতে পা রাখামাত্রই শীর্ণ চেহারার এক ভদ্রলোক ছুটে এলেন। শীর্ণ কিন্তু সুশ্রী। ভদ্রলোকের পরিধানে পাজামা ও পাঞ্জাবি। মুখে ভারি সুন্দর হাসি। এক মাথা ঘন কালো চুল। ভেতরের বাড়িটা যাকে বলে চকমেলানো বাড়ি, হয়তো সেই বাড়িই ছিল এক সময়। দেখেই মনে হল বাড়িটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। ভদ্রলোক আমাদের নীচের তলার ঘরে নিয়ে এলেন। বিশাল বড় ঘর। শ্বেতপাথরের মেঝে। ঘরে তেমন আসবাবপত্র নেই। কাপের্ট ঢাকা একটা চৌকি পাতা। ভদ্রলোক আমাদের বসিয়ে দ্রুতপায়ে ভেতরে চলে গেলেন।