সোমেন নামক হীরকখণ্ডটি প্রায় তিন লাখে বিকিয়ে গেল। জাহাজ থেকে মাল খালাসের বিজনেস ছিল শ্বশুরমশাইয়ের। বেহালায় বিশাল বাগানবাড়ি। সেই বাগানে আবার ফোয়ারা। মার্বেল। পাথরের উলঙ্গ নারীমূর্তি। সোমেনের বাবার সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল। বড়লোকের কন্যাটি অসুন্দরী ছিল না; তবে যাদের ঘরে ছ-ছটা গরু থাকে তাদের ছেলেমেয়েরা একটু গায়েগতরে হবেই। আর বড়লোকেরা একটু মোটাসোটা না হলে মানায় না। মেদ হল অর্থের বিজ্ঞাপন। ঘেঁকুরে বড়লোক হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না। কাগজে বিজ্ঞাপন লাগাতে হবে। বড়লোকের নানা শরীর-লক্ষণ থাকা উচিত। কর্তার পঞ্চাশের পর রক্তে চিনি। চায়ের কাপে আয়েশ করে। স্যাকারিনের পুঁচকি ট্যাবলেট ফেলতে ফেলতে বলবেন, একটু বেড়েছে, একশো আশি। অর্থাৎ ওদিকে ব্যাংকে যত বাড়ছে, সেই অনুপাতে এদিকেও বাড়বে। মানি হল হানি। টাকা হল সুগার কিউব। রক্ত তো বটেই। তা না হলে রক্তের চাপ বাড়ে কেন? চল্লিশের পরেই গৃহিণীর বাত। বাতের জন্যেই রাজহংসীর মতো চলন। মেয়েটি সুন্দরী কিন্তু মোটা। সোমেনের বাবা। কোনওরকমে একতলা একটা বাড়ি করেছিলেন। প্লাস্টার আর রং ছিল না। বেয়াইমশাই। মেয়েকে পাঠাবার আগে একদল কন্ট্রাকটার পাঠালেন। তাঁরা এক মাসে আড়াইতলার একটা ছবি খাড়া করে দিলে। কটক থেকে মালি এসে চারপাশের খোলা জায়গায় ফুল ফুটিয়ে দিলে। দু তিন লরি ফার্নিচার ঢুকে পড়ল হইহই করে। তারপর বাজল সানাই। সে কী সুর কালোয়াতি! পাড়া-প্রতিবেশীর বুকের চাপাকান্না যেন বাতাসে কাঁপছে। প্রতিবেশীরা কাঁদবেই তো। সোমেনের বাবা ছিলেন সামান্য মানুষ। অবস্থা তেমন ভালো না। জীবনের প্রথম দিকটায় খুচখাচ ব্যবসা করতেন। শেষটায় করতেন ঘটকালি। সেই মানুষ কীভাবে একটা একতলা বাড়ি করলেন! আধা গেঁচড়া হলেও মাথার ওপর ছাদ তো! সেইটাই তো প্রতিবেশীর কাছে বিশাল এক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তো, নিজেদের প্রশ্ন, আমরা কেন পারলুম না! যেই মনে হল, আমরা কেন পারলুম না, অমনি ভেতরে শুরু হল শৃগালের কান্না। যাক, সোমেনদের বাড়ি হওয়ার ক্ষত শুকোতে না শুকোতে, সোমেনের এমএ-তে ফার্স্টক্লাস ফাস্ট হওয়া। সে যেন পুরোনো ক্ষতে। নুনের ছিটে। একটা ছেলে চোখের সামনে তরতর করে সৌভাগ্য আর প্রতিপত্তির দিকে এগিয়ে যাবে—এ তো সহজে সহ্য করা যায় না। এর পরের মস্ত আঘাত হল সোমেনের আইএএস হওয়া। যাঃ সর্বনাশ! এ ছেলেকে তো শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনায় সাধারণের স্তরে
আটকে রাখা গেল না। এ তো অফিসার হবেই। গাড়ি, কোয়ার্টার, মোটা মাইনে, প্রতিপত্তি, ক্ষমতা সবই তার হাতের মুঠোয়। চিন্তায় চিন্তায় একপাড়া লোক রোগা হয়ে গেল। আমরা তখন সোমেনকে বয়কট করলুম। যে ছেলে অসামাজিক হয়ে যাবে, তার সঙ্গে খাতির রেখে আর লাভ কী? শেষ আঘাত সোমেনের বিয়ে। আমরা নিমন্ত্রিত হওয়া সত্বেও, না গেলুম বরযাত্রী, না গেলুম বউভাতে। যে ছেলে বিয়েতে শ্বশুরকে দোহন করে পণ নেয়, উপহার নেয়, সে একটা নির্লজ্জ লোভী। তার অনুষ্ঠানে যাওয়াটাও পাপ। বড়লোকের আবার না চাইতেই কিছু তাঁবেদার জুটে যায়। সোমেনের পক্ষে অনেকে বলতে লাগলেন, শ্বশুরের আছে তাই দিয়েছে, সে তত আর চায়নি। চেয়েছে কি চায়নি বুঝল কী করে?
বিকাশ বললে, সোমেনের মতো আমি চামার নই। একটা পয়সাও আমি নেব না। তবে হ্যাঁ, আমার একটা শর্ত আছে মেয়েটি সুন্দর হওয়া চাই। বউ নিয়ে বুক ফুলিয়ে যেন রাস্তায় হাঁটতে পারি। বিকাশের মা বললেন, হ্যাঁ বাবা, ছেলেকে আমি নিলামে চড়াব না। তবে মেয়ে পক্ষ যদি মেয়েকে ঘর সাজিয়ে দিতে চান, তাহলে আমি রোজগেরে ছেলের অহংকারে অপমান করতে পারব না। লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা। অহংকার একেবারে সহ্য করতে পারেন না।
শনিবার-রবিবার বিকাশের কাজই হল আমাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে বেরোনো। একটা ব্যাপার লক্ষও করছি, ছেলেরা যখন বেকার থাকে তখন সে প্রেমিক। প্রেম করে বেড়ায়। যেই সে ভালো চাকরি পেল, অমনি তার প্রেম ঘুচে গেল। তখন তার আটঘাঠ বেঁধে, ঠিকুজি-কোষ্ঠী মিলিয়ে বউ আনার তাল। বিকাশের একজন প্রেমিকা ছিল, তাকে আর পাত্তাই দেয় না। আমি জিগ্যেস করেছিলুম, ব্যাপারটা কী। প্রথমে বলতেই চায় না, শেষে বললে, আমি একটু ভালো মেয়ে চাই। আর এখন আমার চাইবার অধিকারও এসেছে। প্রেমের আবেগে বোকামি করলে আমাকেই পস্তাতে হবে। সারা জীবনের ব্যাপার। সারা জীবন প্রেমের চশমা পরে একটা মেয়ের দিকে তাকানো সম্ভব নয়। বাস্তব হল অঙ্কের মতো।
তোর প্রেমিকাটি তো ভালোই দেখতে।
ভালো দেখতে হলে কী হবে, ভীষণ ঘামে আর সর্দির ধাত।
আমি হাঁ করে বিকাশের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। পৃথিবীতে কত রকমের মাল আছে ভগবান!
জিগ্যেস করলুম, একটা মেয়েকে বাইরের দেখায় তুই রূপটা দেখলি, অন্তরঙ্গ খবর পাবি কী করে! ঘামে কি না, সর্দি হয় কি না! তোকে তাহলে অবজেকটিভ টেস্টের মতো প্রশ্নপত্র বিলি করতে হবে রে! তুই কী চাস বল তো!
অনেক মেয়ে আছে খাওয়াদাওয়ার পর ঢেউ করে গ্যাসের রুগির মতো সেঁকুর তোলে।
তারপর?
সেফটিপিন দিয়ে দাঁত খোঁটে। হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মোছে। চিৎকার করে কথা বলে। দুমদুম করে সিঁড়ি ভাঙে। কথা বলার সময় গায়ে ধাক্কা মারে। দু-দণ্ড স্থির হয়ে বসতে পারে না, পা নাচায়। খাওয়ার সময় চ্যাকোর চ্যাকোর শব্দ করে। ঠুকে জিনিস রাখে। চিরুনিতে চুল ওঠে। মাথায় খুসকি হয়। পেটে হুড়হুড় গুড়গুড় শব্দ হয়। জ্বর হলে উ আঁ করে। ধনুকের মতো বেঁকে। শোয়। হাঁউ হাঁউ করে হাই তোলে। নির্জনে নাক খোঁটে। খেতে বসে আঙুল চোষে। দাঁত দিয়ে নখ কাটে।