তিন-চার ফোঁটা চোখের জল টপাটপ আমার গালে কপালে পড়ল।
আমি আমার অবশ হাত দুটো তোলার চেষ্টা করলুম। প্রথমে পারছিলাম না। পরে পারলুম। পারলুম মনের আবেগে। মন তো আর হৃদয়ে থাকে না। মেয়েটাকে আস্তে আস্তে পিঠের দিক থেকে জড়িয়ে ধরলুম। রাতের ধরিত্রীর মতো ঠান্ডা শীতল একটি শরীর। ধীরে ধীরে আমার হাতে চাপ বাড়ছে। কাছে টানছি, কাছে, আরও কাছে। আমার অর্ধ অঙ্গকে। অদ্ভুত এক অনুভূতি, যেন হরিদ্বারের গঙ্গায় স্নান করছি। হাপুস কাঁদছে আমার বউ। আমি কথা বলার চেষ্টা করলুম। পারলুম। আমার বাক্য ফিরে এসেছে। বললুম, ‘মাইরি বলছি, আমার একটা মাইলড স্ট্রোকই হয়ে গেল। আমি আজ ঘুগনি খাইনি, কিছুই খাইনি। স্রেফ তোমার জন্যেই আমার হৃদয়ের বাধা খুলে গেল।’
আমার বুকের ওপর বউয়ের মাথা। চুলের আর সে শোভা নেই। দেহে আর সে উত্তাপ নেই, কিন্তু চোখে অনেক জল এসেছে। ভেতরে একটা সমুদ্র তৈরি হয়েছে।
আমি জিগ্যেস করলুম, ‘তুমি আমাকে ভালোবাসো?
আমাকে আঁকড়ে ধরে আমার চির বালিকাবউ ধরা ধরা গলায় বললে, ‘বুঝতে পারো না বোকা!’ আমার চোখের সামনে খেলে গেল অতীতের দৃশ্য, একটা গাছ, এক টুকরো জমি, সবুজ ঘাস, এক তরুণ আর তরুণী, কাঁধে মাথা হাতে হাত। অদৃশ্য এক স্টার্টার বাঁশি বাজিয়ে দিলেন, শুরু হল চলা। আজও চলছি। কোথায় সেই লাল ফিতে! কত দূরে। মনে মনে আমার ছেলেকে বললুম —’কী প্রেম করিস তোরা? দেখে যা প্রেম কাকে বলে? চোখের জল ছাড়া প্রেম হয়!’ একটা হৃদয় হলে আজ যবনিকা পড়ে যেত। দুটো হৃদয় মিলেছিল বলেই রয়ে গেলুম। থাকি না আর কিছুকাল।
বিকাশের বিয়ে
বিকাশ আমার বন্ধু। বিকাশ বিয়ে করবে। না করে উপায় নেই। ব্যাংকে ভালো চাকরি পেয়েছে। পরিবারের একটি মাত্র ছেলে। নিজেদের বাড়ি আছে। বাবা মারা গেছেন। মায়ের বয়েস হয়েছে। বিকাশের বিয়ে অবশ্যম্ভাবী। আত্মরক্ষার জন্যেও বিয়ের প্রয়োজন। এদেশে অবিবাহিতা মেয়ের অভাব নেই। সকলেই যে প্রেম করবেন তা-ই বা আশা করা যায় কী করে! মেয়ের বাপ-মাকেই ভালো পাত্র ধরার জন্যে উদ্যোগী হতে হয়। বিকাশের হয়েছে মহা বিপদ। বিকাশ যেন তাজা ফুলকপি। বিকাশ যেন গঙ্গা থেকে সদ্য তোলা একটি ইলিশ মাছ। যাঁরা তাকে চেনেন, জানেন সকলেই তাঁকে ওই দৃষ্টিতে দেখেন। ঝোলাতে হবে, মেয়ের হাতের ইলিশ করে।
দু-চার কথার পরেই তাঁদের প্রশ্ন ইলিশের তেলের খোঁজে চলে যায়। কড়ায় ছাড়লে বিকাশ কতটা তেল ছাড়বে! ব্যাংকের চাকরি? বাঃ বাঃ। কোন ব্যাংক? ন্যাশন্যালাইজড? এখন পাচ্ছ। কত? পাকা চাকরি? বেড়ে বেড়ে কোথায় উঠবে? প্রোমোশান আছে? বাঃ বাঃ। তা ছুটিছাটার দিন। এসো না একদিন। একটু ফ্রায়েডরাইস, চিকেন। রবীন্দ্রসংগীত নিশ্চয় ভালোবাসো। উমা আজকাল ভীষণ ভালো গাইছে। পল্লব সেনের প্রিয় ছাত্রী। তুমি ছবি ভালোবাসো না, ছবি? মেয়েটার আঁকার হাত দুর্দান্ত। নিজের মেয়ের প্রশংসা করা উচিত নয়। তবু না বলে পারছি না।
বিবাহযোগ্যা বাঙালি মেয়ের মা-বাবার, বিশেষ করে মায়েদের যে কী উৎকণ্ঠা আর উদ্বেগের দিন কাটাতে হয় তা আমি জানি। কারণ আমার একটি বোন আছে। আমার মায়ের ঘুম চলে গেছে। এই বুঝি মেয়ে প্রেম করে বসল! এই বুঝি কোনও পাড়াতুতো মাস্তান মেয়ের হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল। আমার মায়ের যত রকমের উদ্ভট চিন্তা! আমার বাবার জীবন অতিষ্ঠ। বাবা অফিস। থেকে ফেরামাত্রই প্রথম প্রশ্ন, কী খোঁজ নিয়েছিলে?
সারাদিন অজস্র কাজের চাপে বাবার কিছু মনেই নেই, ফলে মিথ্যে বলে কি অভিনয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেন না। পালটা প্রশ্ন, কী খোঁজ বলো তো?
ব্যস লেগে গেল ধুমধাড়াক্কা। ওই মেয়ে যখন তোমার মুখে চুনকালি মাখাবে তখন বুঝবে। সেইদিন তুমি বুঝবে। সেইদিন তোমার শিক্ষা হবে। কেউ বলবে না তখন আমার মেয়ে। সবাই তোমার নাম করে বলবে, ওমুকের মেয়ে।
বাবার আর জামাকাপড় ছাড়া হল না, বিশ্রাম হল না, চা খাওয়া হল না। রেগে বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, আজ আমি যাকে পাব তাকেই ধরে আনব।
খামোখা মাইলতিনেক অকারণ হেঁটে ধুকতে ধুকতে ফিরে এলেন রাত দশটায়। এই ভ্রমণের নাম প্রাতভ্রমণ নয়, পাত্রভ্রমণ। এ তো হল গিয়ে রাগের পাত্রভ্রমণ। ঠান্ডা মাথায় পাত্রভ্রমণ অহরহই চলছে। ভালো চাকুরে, অবিবাহিত ছেলেরা ঠিক ধরতে পারে। ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা মাছ ধরতে বেরিয়েছেন। বগলে অদৃশ্য ছিপ। ছিপের সুতোয় ঝুলছে টোপ-গাঁথা বঁড়শি। মেয়ের গুণের টোপ, বংশপরিচয়ের টোপ, ভালোমন্দ দেয়াটেয়ার টোপ। অনেকে আবার একটু বেশি দুঃসাহসী। চোখ দিয়ে দেহ জরিপ করেন, বুকের ছাতি, গলার মাপ। কেউ কেউ আবার কায়দা করে হাতের গুলি মেপে নেন। এই তো চাই, ফাইন ইয়াং ম্যান। এই তো চাই। সাহস, কারেজ, হেলথ। ওপর বাহুটা কথা বলতে বলতে ধরে, তাগার মতো মেপে নিলেন। দেখে নিলেন কতটা তাগড়া। বিয়ের ধাক্কা, সংসারের ধাক্কা সামলাতে পারবে কি না। ক্ষইতে কতটা সময় নেবে বাবাজীবন। পরে হয়তো একটু উপদেশ যোগ করলেন—ব্যায়ামট্যায়াম করো, একটু ভালোমন্দ সময়মতো খাও, শরীরম আদ্যম। শরীরটাই সব।
বাজারের মাছ আর ব্যাগের মাছের যা পার্থক্য। কোনওক্রমে একটা ব্যাগে ঢুকে গেলে, আর দরদস্তুর নেই। কানকো তুলে তুলে দেখা নেই। বিকাশ সেই কারণেই ব্যাগে ঢুকে পড়তে চায়। ছেলে ভালো। তেমন লোভী নয়। শ্বশুর মেরে হন্ডা চাপতে চায় না। সেরকম বন্ধুও আমার আছে। সোমেন। সে তো প্রায় দফতর খুলে বসেছিল, রাজনৈতিক নেতাদের মতো। পার্টি-অফিস। ঠিক সে খোলেনি। খুলেছিলেন তার পিতা। ছেলের পেছনে ভদ্রলোকের যথেষ্ট ইনভেস্টমেন্ট ছিল। অভাব সত্বেও ছেলেকে সাংঘাতিকভাবে মানুষ করেছিলেন। ছেলেও সরেস ছিল। শেষে। আইএএস হয়ে পাড়া-প্রতিবেশীকে তাক লাগিয়ে দিলে। এম.এ-তে ফার্স্টক্লাস পাবার পরই আমাদের সঙ্গে ব্যবধান বাড়তে লাগল। আইএএস হবার পর আমাদের কোনওরকমে একটু চিনতে পারত। ভালো পোস্টিং হয়ে যাবার পর পথেঘাটে দেখা হলে, চোখে চোখে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিত। টর্চলাইট ফেলার মতো। সোমেনের বাবা বলতেন, ছেলে হল হিরে। কত খুঁজে তোলা হল। তারপর অভিজ্ঞ হাতে কাটাই-ছাঁটাই। কম খরচ! তারপর নিলাম। একলাখ বিশ! দেড় লাখ! তিন লাখ! কে হাঁকবে দর? মেয়ের বাবারা।