চিত হয়ে মেঝেতে পড়ে আমি। শরীর অবশ। দম পড়ছে, আবার বন্ধ হচ্ছে। একটু বাতাসের জন্য মানুষের কী ছটফটানি। আমার বউ এতক্ষণ জেগে জেগে মশকরা করছিল। বিধবা শব্দটায় চাঁদমারি হল। আচ্ছন্ন চেতনা নিয়েই বুঝতে পারছি, অন্ধকারে উঠে বসেছে। প্রথম প্রথম বিধবা হতে সকলেরই ভয় লাগে। ওই অবস্থাতেও নিজেকে হিরো মনে হচ্ছে। ফেলেছি তুরুপের তাস। খেলো, নন্দিনী, খেলো। আমি রামায়ণের রাম। আবার এ-ও মনে হচ্ছে—চলে যেতে হবে পৃথিবী ছেড়ে। আবার একটা গানের লাইনও মনে পড়ছে সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী। মরে যাবার সময় মানুষের কত কী মনে পড়ে। মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। ভীষণ ভালোবাসা পায় মনে।
আমার বউ আমার বুকে ভর রেখে মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল। যেন বারান্দার রেলিং-এ হাতের ভর রেখে রাস্তার লোক দেখছে। বেশ মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করলে—’কোথায় রেখেছ?’
এই সময় এই প্রশ্নের একটাই অর্থ, পাশবই, চেকবই, সেভিংস এইসব রেখেছ কোথায়? তুমি তো চললে। সেখানে গিয়ে তো আর তুড়ুম ঠুকতে পারব না। তখনও আমার একেবারে বাক্যরোধ হয়ে যায়নি। অস্পষ্ট হলেও স্মৃতি আর চেতনা দুটোই কাজ করছে। আমি। কোনওরকমে বললুম ‘ভেবো না তুমিই নমিনি, কাগজপত্র, চেকবই, পাসবই সবই আলমারির লকারে আছে। চাবিটা আছে মাটির যে গোপালমূর্তি, তার ভেতরে। রুমালে জড়ানো।’ এর পর আর আমার মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরুল না, গোঁ করে উঠলাম। আমার বউ বললে—’যাও, তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলব না, মানুষকে কেবল তোমার কামড়ানো স্বভাব।’ আমি মনে মনে বললুম—’হায় রে। এখনও তুমি বুঝলে না, আর হয়তো পনেরো মিনিট পরেই তোমাকে প্রথামতো ডুকরে কেঁদে উঠতে হবে। তুমি ভাবছ আমি বোধ হয় অভিনয় করছি, তা কিন্তু নয়, একেই বলে হার্ট অ্যাটাক! অব্যর্থ পরোয়ানা।’ ভাবলুম, কিন্তু বলতে পারলুম না কিছু। কোঁক, কোঁক শব্দ হল কয়েকবার। তখন আমার বউ সরে এসে বললে, ‘তোমার সেই অম্বলের ওষুধটা কোথায়? অফিসে আজ কী গিলে মরেছিলে? হার্ট অ্যাটাক না হাতি! একে বলে গ্যাস।’
আমি বলতে চাইলুম—’পাগলি, সবাই গ্যাসই ভাবে। মরলে তবেই বোঝা যায় গ্যাস না। করোনারি।’ প্যাঁক করে একটা শব্দ বেরোল মাত্র। আমার বউ তখন উঠে আলো জ্বালাল। আমার দিকে তাকিয়েই ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। স্বপ্নের ঘোরে যেন দেখছি সব। ছেলেকে ডাকছে। ভদ্রমহিলার হইহই করা স্বভাব। এমনভাবে ডাকছে বাড়িতে যেন ডাকাত পড়েছে। আমার ছেলের ঘুম সহজে ভাঙে! তার ওপর সবে বিয়ে করেছে। এক সময় ছেলের গলা পাওয়া গেল। ঘুম জড়ানো, বিরক্তি মেশানো গলায় বলছে—’এত রাতে ডাক্তার, তোমার মাথা খারাপ। হয়েছে নার্সিংহোম? গাড়ি পাবে কোথায়! কোনওরকমে ভোর পর্যন্ত ম্যানেজ করো, তারপর যা হয় করা যাবে। বাবাকে তো চেনো! তিলকে তাল করা স্বভাব। এর আগেও তো দেখেছ!’
মনে মনে বললুম, ‘তাই না কি সোনা! বাবারা বুঝি তোমাদের সেবার জন্যে অমর হবে। খালি ফুয়েল ঢেলে যাবে সোনা, আর তোমরা শুধু কপচে যাবে! পাখি সব করে রব।’
তিন জোড়া পায়ের শব্দ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। চারপাশে বাবুরা এসে গেছেন। আমার ছেলে আবার জাত আমেরিকান। জিনস পরেই ঘুমোয়। উবু হয়ে বসতে পারছে না। এখুনি পেছন ফেঁড়ে যাবে। পুত্রবধূ আমার বুকের উপর হাত রেখে বারে বারে ডেকেই যাচ্ছে, ‘বাবা, বাবা, ও বাবা!’ যেন হার্ট অ্যাটাকের এইটাই চিকিৎসা, বাবা, বাবা করলেই হৃদয় খুলে যাবে।
আমার বউ বলছে, নিশ্চয় আজ ঘুগনি খেয়েছে। ঘুগনি দেখলে তো আর লোভ সামলাতে পারে না। আজ তো সোমবার। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছি। আজ ওদের অফিস ক্যান্টিনে ঘুগনির ডেট।
আমি সব শুনছি, আর মনে মনে হাসছি। এত যন্ত্রণাতেও হাসি। কেন হাসব না! ছেলেবেলায় কত আবৃত্তি করেছি—জীবন-মৃত্যু, পায়ের ভৃত্য।
ছেলে বলছে—’এই অবস্থা কতক্ষণ হয়েছে?’
‘তা প্রায় আধঘণ্টা।’
ছেলে আমার হেসে উঠল। ‘আধঘণ্টা! তাহলে জেনে রাখো ব্যাপারটা হার্টের নয়, পেটের। হার্ট হলে কী হত জানো, পাকা আমটির মতো, টুপ করে খসে যেত। এ তোমার ঘুগনি কেস। তলপেটে নারকেল তেল, সাবান আর জল মিশিয়ে ডলতে থাকো। পায়ের তলায় নখ দিয়ে কুডু কুডু করে দ্যাখো তো!’
আমার বউ বললে, ‘মাগো, সাতজন্ম পায়ে সাবান দেয় না, ওই পায়ের তলায় আমি মরে গেলেও হাত দোব না।’
মনে মনে বললুম—’পিটপিটে বামনী, এখুনি মরলে ওই পায়েই তো আলতা মাখিয়ে ছাপ তুলবে।’
ছেলে বললে, ‘তোমার আবার বেশি বেশি। আমি যে প্যান্টের জন্যে নীচু হতে পারছি না।’
বউমা বললে, ‘আমি দেখছি।’
আঙুলে বড় বড় নখ। সেই নখ দিয়ে আঁচড়াতে লাগল। আমি ঝড়াক করে পা টেনে নিলুম।
ছেলে বললে, ‘বুঝেছি, এ তোমার মাকে টাইট দেবার চেষ্টা। থ্রম্বোসিস হলে পায়ে কোনও সাড় থাকত না। চলে এসো সুমিতা। ও স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, নিজেরাই ফয়সালা করে নিক।’
মনে মনে বললুম, ‘ও হে ছোকরা, তোমার বউয়ের আঙুলে যে ফ্যাশানের নখ, অ্যালসেশিয়ানকেও হার মানায়। ওই আঁচড়ে মরা মানুষও ঠ্যাং সরাবে বাপ। পায়ে সাড় থাকলে কী হবে, শ্বাস যে এদিকে বন্ধ হয়ে এল। পালসটা দ্যাখো, বিট মিস করছে কি না!’
আমি তিনবার ব্যাঙের মতো কোঁক কোঁক করলুম। ল্যাভেন্ডার পাউডারের গন্ধ উড়িয়ে নবদম্পতি বিদায় নিল। পড়ে রইলুম আমি আর আমার বোকা বউ। পঁচিশ বছরের পোড় খাওয়া একটি জীব। কোথা থেকে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনে তলপেটে চেপে ধরল। ফ্যাঁস ফাঁস করে একটু কাঁদল। বউটার ধৈর্য একটু কম। কোনও কাজ একটানা বেশিক্ষণ করতে পারে না। এমনি মানুষটা বেশ ভালো, তবে অবুঝ। বয়েস হলে কী হবে, বালিকার স্বভাব। আমি চলে গেলে বুড়িটার কী হবে! ছেলের সংসারে আয়াগিরি করতে হবে। ভাবতে ভাবতে আমার চোখেই জল এসে গেল। আমার বউ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললে, ‘তুমি চলে গেলে আমি আত্মহত্যা করব, মাইরি বলছি, আমি আত্মহত্যা করব, আমার কে আছে বলো!’