যাক, যারা আমার গৌরবোজ্জ্বল অতীত দেখতে পায় না, দেখলেও দেখতে চায় না, তাদের আমার কিছু বলার নেই। বাঙালি ইতিহাসবিমুখ জাতি, আমরা সবাই জানি। এরা ইতিহাস বলতে বোঝে আকবর বাদশার ইতিহাস। সিনেমার ‘ফ্লাশব্যাক’ দেখবে, একটা জ্যান্ত মানুষের ফ্লাশব্যাক শুনবেও না, বিশ্বাস করবে না। আমাদের যেন অতীত থাকতে নেই। আমরা সব বর্তমানের সরীসৃপ। আবার বইয়ের পাতা ওলটাতে লাগলুম। এবার মলাটে চোখ পড়ল। র্যাক থেকে ভালো বই টেনেছি—গীতা মাহাত্ম। এই বয়েসে যে বইয়ের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। স্ত্রী, পুত্র, পরিবার, সংসার সবের ছিরি তো দেখছি। কতদিন ভাবি সন্ন্যাসী হয়ে কেটে পড়ব, পারি। অন্য কিছুর জন্যে নয়, শুধু মাত্র বাথরুমের ভয়ে। গৃহত্যাগের সময় নিজের বাথরুমটাকে তো আর নিয়ে যেতে পারব না। যত্রতত্র আমার পোষায় না। ঘেন্না করে।
দরজার কাছ থেকে আমার রাখওয়ালের একটু চড়া গলা শোনা গেল—’কী হল, মশারির চারটে কোণ আর দয়া করে খাটাতে পারছনা, গতরটা একটু নাড়াও! না পরের গতরে যতটা হয়ে যায়!’
আবার সেই অশ্লীল শব্দটা। উঠে বসলুম। গতর বললেই, লুঙ্গি পরা, বিশাল ভূঁড়ি আর পাছাওলা একটা নির্বোধ ভোগীর চেহারা ভেসে ওঠে। বিছানায় শুয়ে যারা মিঠি মিঠি গলায় গুন গুন করে ডাকে, ‘কই গো, কই গো, তোমার হল।’ বউ তেলানো পাটি। আমি সব অর্থে তার বিপরীত। জীবনে বউকে হ্যাঁ গা, কই গা, শুনছ বলিনি। সেন্টার ফরোয়ার্ডের স্ট্রেটকাট কথা। পায়ে বল নাও, ছ’বার ড্রিবল করে ঢুকিয়ে দাও নেটে। আর তাকাতাকি নেই, ফিরে এসো মাঝ-মাঠে। আমার গুরু আমাকে জপের মন্ত্র দিয়েছিলেন, ‘অ্যাটাক, অ্যাটাক’। আমি ঝাঁঝেই বললুম:
দ্যাখো গতর গতর বলবে না। গতর হয় মেয়েদের। আমার মতো খেলোয়াড়দের হয় ফিগার। আমার একেবারে কঞ্চির মতো শরীর। মশারি আজ আমি খাটাব না, খাটাব না, খাটাব না। দিস ইজ নট মাই জব।’
‘খাটিয়ো না, খাটিয়ো না।’
গলা তো নয় গোলা। একেবারে সংলগ্ন বাড়ির প্রতিবেশী মশারি ফেলা অন্ধকার ঘর থেকে দাবড়ে উঠলেন, ‘আয় চোপ।’ ভদ্রলোক সূর্য ডোবার পর থেকেই চড়াতে থাকেন। এখন তিনি পুরো চড়ে আছেন। আমি কিছু মনে করলুম না। জানি সকালেই তিনি বিনীত গলায় বলবেন—’কী দাদা, বাজারে চললেন?’ আমরা জানি, মাতালে কী না বলে, ছাগলে কী না খায়।
আমার ছেলে। ওই একটি মাত্রই ছেলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললে—’আশ্চর্য, দিন দিন। তোমাদের বয়েস বাড়ছে না কমছে?’ বলেই সরে পড়ল। সবে প্রেম করে বিয়ে করেছে। মৌতাতে আছে। নতুন বউমা বিয়ের পর দিনসাতেক মশারি খাঁটিয়ে পরিপাটি বিছানা করে শ্বশুর, শাশুড়ির সেবা করেছিল। তারপর শোনা গেল স্পন্ডিলোসিস হয়েছে। হাতের খিল জ্যাম হয়ে গেছে। ওপর দিকে আর উঠছে না। যা পারছে তলার দিক থেকে সব হাতড়ে নিচ্ছে। মানুষের কপাল মন্দ হলে যা হয়। কে কাকে সেবা করে! এখন বধূ আর পুত্রবধূ দুজনের সেবা করে প্রারব্ধ ক্ষয় করি। ছেলে তো বিয়ে করেই দায় সেরেছে। একালের ছেলেদের তো কোনও কর্তব্যবোধ নেই। প্রেম করার সময় খিদমত খাটত তা আমি জানি। তখন মাছ খেলছিল, এখন মাছ জালে। আর তো কোনও ভয় নেই। এখন খাও দাও আর বগল বাজাও। নিধিকেষ্ট হয়ে ঘুরে বেড়াও।
পাখার স্পিড বাড়িয়ে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। প্রথমত রেগে আছি, অভিমানে একেবারে টসটসে। দ্বিতীয়ত, স্ত্রী, পুত্র, পরিবারের হুল যে সহ্য করতে পারে, মশা তার কী করবে। সেই আছে না, সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়! নিদ্ৰাতেই মানুষের সব দুঃখের অবসান। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লুম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। রাত কত তা জানি না। ঘরে গুমোট গরম। পাখা বন্ধ। কানের কাছে ঝাঁক ঝাঁক মশার কালোয়াতি। রাস্তার আলো শোওয়ার আগে জ্বলছে দেখেই শুয়েছি। এখন চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তার মানে লোডশেডিং। মেঝেতে। আপাদমস্তক সাদা চাদর ঢাকা একটা লাশ পড়ে আছে। আমার পঁচিশ বছরের প্রাচীন অভিমানী বউ। যত বয়েস বাড়ছে, তত মেদ বাড়ছে। তত বাড়ছে রাগ আর অভিমান। এইটুকু বুঝলুম ইলেকট্রিক সাপ্লাই চলে বউদের নির্দেশে। তানা হলে ঠিক এইসময়ে লোডশেডিং হবে কেন? আমাকে অন্যায় রণে হারিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র। যেমন কুরুক্ষেত্রে কর্ণের রথের চাকা বসে গেল।
যাই হোক, সামান্য একটু যা ঘুমিয়েছি তাইতেই আমার রাগ জল হয়ে গেছে। আমি খাটে, বউটা আমার মেঝেতে। মনটা গুমরে উঠল, আহা পরের মেয়ে! বাপ নেই, মা নেই। মেরেছ কলসির। কানা, তা বলে কি প্রেম দোব না। খাট থেকে অন্ধকারে ঠাহর করে করে নামলুম। তারপর খুঁজে খুঁজে গোল গোল হাত দুটো ধরে তোলার চেষ্টা করলুম। ও বাবা, এ যেন এক পেল্লায় বোয়াল। মাছ, পিছলে যায়। একবার এ-পাশ একবার ও-পাশ। আবার আমার রাগ চড়ছে। কী উঠবে না? মার টান। হেঁইয়ো, মারি হেঁইয়ো, আউর থোড়া হেঁইয়ো, বয়লট ফাটে হেঁইয়ো, ঘাস বিচুলি। হেঁইয়ো। হাতখানেক তুলি তো, থ্যাস করে শুয়ে পড়ে। আমার বউ যে এত ভারী জানা ছিল না। যেন জগদ্দল পাথর। বোম্বে ছবির নায়িকা হলে হিরোর ভাত মারা যেত, কারণ একটা-দুটো সিন এইরকম থাকতই যেখানে নায়ক নায়িকাকে দু-হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে বনের ধারে পাগলের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে আর গাইছে—মেরা পেয়ার ঝুলতা রহে, ঝুমঝুম। বোম্বে ছবির নায়করা তো সব প্রেমে আধপাগলা মতো হয়ে যায়। তা এই নায়িকাকে কে তুলবে? এক গব্বর সিং পারতে পারে। যাই হোক, আমার রোক চেপে গেল—কী? স্বামী হয়ে স্ত্রীকে খাটে তুলতে পারব না! কত ছোবড়ার ওজনদার গদি আমি তুলেছি একা। অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ান ওয়েট লিফটারদের স্মরণ করে, মারলুম আর এক টান। চাগাবার চেষ্টা করলুম। আর তখনই বুকের ডানপাশে যেন ওয়ার্ল্ড হেভি ওয়েট চ্যাম্পিয়ানের এক ঘুসি পড়ল। নিথর নিস্পন্দ হয়ে এল শরীর। পরাজিত মুষ্টিযোদ্ধা যেভাবে স্লো-মোশানে রিং-এর মধ্যে পড়ে যায় আমিও সেইভাবে। পড়ে যেতে যেতে বললুম—’যাঃ সুধা, তুমি বিধবা হলে। হার্ট-অ্যাটাক।’ আর কোনও বড় কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই। উঃ, হৃদয় আটকে গেলে, মানুষের কী যে হয়! কোথায় রেল রোকো, বাংলা বনধ। হৃদয় বন্ধের মতো কিছু নেই।