পরের দিনই দিব্যেন্দু ফিরে গেল উত্তরবঙ্গে। বসন্ত ফেটে পড়েছে শহরতলির বনস্থলীতে। দূর আকাশের পাহাড়ে অভ্ররেখা। সারাদিন কাজে কর্মে বেশ তবু কেটে যায়। রাতে, আটটার মধ্যে শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে। তখন! তখনই দিব্যেন্দু তার নিরালা ঘরে বসে ভাবতে থাকে। দুটো প্রশ্ন —প্রেম আছে? না প্রেম নেই? পরক্ষণেই হু-হু পাহাড়ি বাতাসে দুলে ওঠে জানলার পরদা, সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে দ্বিতীয় প্রশ্ন—ভূত আছে? না নেই? কেউ বলে আছে, কেউ বলে নেই। মৃণালের ছোট্ট লেডিজ রুমাল দিয়ে চশমার কাচ মুছে, দিব্যেন্দু কারওকে একটা চিঠি লেখার চেষ্টা করে। কাকে লিখবে?
ফল্গু
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় আড় হয়ে কী একটা বই নাড়াচাড়া করছি। আজকাল এইরকমই হয়েছে। কী খাচ্ছি, কী পড়ছি, কিছুই আর তেমন খেয়াল থাকে না। খেয়াল করিও না। কিছুটা অভ্যাস, কিছুটা সংস্কার এইভাবেই জীবন চলছে। অভ্যাসে বাজার যাই। অফিসে ছুটি। সংস্কারে বই টেনে নিই। পাতা ওলটাই। বয়েস বেড়ে গেছে। চোখের তেজ কমেছে। তেমন দেখতে পাচ্ছি না। উঠে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসব, সে শক্তিও যেন নেই। রোজই ওইরকম হয়। দু-চার পাতা নাড়াচাড়া করতে না করতেই শরীর খ্যাস করে নেতিয়ে পড়ে। রোজই এই সময়টায় আমার এক সমস্যা হয়—কে মশারি খাটাবে! আমি না আমার বউ? এদিকে সাংঘাতিক মশার উপদ্রব। মশারি ছাড়া এক মুহূর্ত শোবার উপায় নেই। আর রোজ রাতেই এই মশারি-পলিটিক্স হয়। বউ বলবে—’চারটে কোণ খাঁটিয়ে তুমি শুয়ে পড়ো। আমার সৃষ্টি-কাজ পড়ে আছে, আমার অপেক্ষায় থেকো না। গতরটা একটু নাড়াতে শেখো। এই গতর শব্দটা শুনলেই আমার মাথায় খুন চেপে যায়। মেয়েদের জগতের বিশ্রী একটা শব্দ। অশ্লীল তো বটেই। আজ আমি অপেক্ষায় আছি। কাল, পরশু, তার আগের দিন পর পর তিনদিন আমি মশারি খাঁটিয়েছি। আজ আর আমি নেই। মরে গেলেও নেই। বইটার পাতা ওলটাচ্ছি আর মনে মনে বলছি—এ লড়াই জিততে হবে। আজ আর আমি নেই। আর ঠিক সেই সময় রান্নাঘর থেকে চিৎকার ‘এলিয়ে না থেকে মশারিটা ফেলে চারপাশ ভালো করে গোঁজো। জীবনে একটা কাজ অন্তত ভালো করে করতে শেখো।’
‘পর পর তিনদিন আমি মশারি ফেলেছি, আজ আমি মরে গেলেও ফেলব না।’
‘তাহলে মরো, মশার কামড় খেয়েই মরো। যখন ম্যালেরিয়া হবে তখন বুঝবে ঠেলা।’
‘হলে তোমার আমার একসঙ্গেই হবে, এক যাত্রার তো আর পৃথক ফল হয় না।’
‘ওই আনন্দেই থাকো, মেয়েদের ম্যালেরিয়া হয় না। হলে অম্বল হয় বাত হয়, পিত্তপাথুরী হয়। স্বামীদের কামড়ে জলাতঙ্ক হয়।’
‘আচ্ছা।’ আমি সুর টানলুম।‘
হাওয়া বইছে এলোমেলো। রাত সাড়ে এগারোটা-বারোটার সময় আমি আর ফাটা কাঁসি নিয়ে তরজা শুরু করতে চাই না। এ পাড়ায় আমার একটা সম্মান আছে। অনেকেই প্রণাম-ট্রণাম করে। বাড়ির লোক ঝাঁটা মারলে কী হবে বাইরে আমার অল্প-বিস্তর খাতির। একসময় ভালো ফুটবল খেলতুম, ফরোয়ার্ড লাইনে। সেকালে ফুটবলের তেমন কদর ছিল না, একালের ছেলেরা তো। বল-পাগল। সেই কারণেই অতীতের গোলন্দাজ হিসেবে একালে আমার খাতির। আমার পায়ে বল মানেই গোল। এই তো গত দুর্গাপূজায় পাড়ার ক্লাব আমাকে সংবর্ধনা জানালে। একটা টিনের ট্রে, তার ওপর ছোট সাইজের একটা নারকেল, ছোট বাক্সে চারটে সন্দেশ। সে যাই হোক, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার কোনও মূল্য হয় না। গলায় একটা রজনীগন্ধার শুকনো শুকনো মালা পরিয়ে দিল টুলটুলে একটা মেয়ে। মালাটা আমি সঙ্গে সঙ্গে তার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলুম। একেই বলে মহানুভবতা। লোককে দেখানো, আমি কতটা নির্লোভ, নিরহঙ্কারী। সবার আগে একটু বড় একটা মেয়ে প্রদীপ দিয়ে আমাকে বরণ করেছিল। মেয়েটি মনে হয় আমার ব্যক্তিত্বে ভয় পেয়ে। গিয়েছিল, তা না হলে আমার গোঁফে ছ্যাঁকা দিয়ে দেবে কেন? আমার এক গোছা ঝোলা ঝোলা গোঁফ পড়পড় করে পুড়ে গেল। সে যাক, দোষটা আমারই। একালে কেউ অত বড় গোঁফ রাখে। না। সেই যে আমি গোঁফ কামালুম, এখন আমার ঠোঁট সাফ। বয়সটাও যেন অনেক কমে গেছে। আগে অচেনা লোকমাত্রই কিছু জিগ্যেস করার হলে কথা শুরু করত হিন্দিতে। এখন বাংলাতেই করে। সভার সভাপতি মহাশয় গলায় একটা পাট করা মাদ্রাজি চাদর পরিয়ে দিলেন। আমাকে। আবার দু-চার কথা বলতে হল। আমি বলেছিলুম—ফুটবলই আমাদের জীবন। দুটো পা যেন স্বামী-স্ত্রী জুটি; আর বল হল গোল, মানে বিশ্ব। এই বিশ্ব হল স্বামী-স্ত্রীর খেলা। ঠিক বোঝাবুঝি, মেলামেশা হল তো, খেলা হয়ে গেল কবিতা। দুটো পায়ের আন্ডারস্ট্যান্ডিংই হল খেলোয়াড়ের সাফল্যের মূল কথা। উঃ, সে কী হাততালি! তিন মিনিটে হিরো! অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে শ’খানেক তরুণ তেড়ে এল। যার খাতা নেই সে এগিয়ে ধরল ঠোঙা। মনে হয় বাদামটাদাম খাচ্ছিল। সই করতে করতে আমার জান কয়লা। ফড়াক ফড়াক ছবি তুললেন ফটোগ্রাফার। এক নেতা এসে বললেন—নেক্সট ইলেকশানে আমরা আপনাকে পার্টির টিকিট দেব। যদি জিততে পারেন, যদি আমরা মিনিস্ট্রি ফর্ম করতে পারি, জেনে রাখুন আপনি হবেন ক্রীড়া-মন্ত্রী। আমি। সেই গ্যাস খেয়ে বাড়িতে এসে একটা উলটো-পালটা করে ফেললুম। মন্ত্রীদের মতো মেজাজ। দেখাতে গিয়েছিলুম। সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়। আমার একমাত্র স্ত্রীর সঙ্গে একমাস বাক্যালাপ বন্ধ ছিল। টিনের ট্রে-টা দেখে বলেছিল, আজকাল এক প্যাকেট বড় সার্ফ কিনলে ওইরকম ট্রে ফ্রি পাওয়া যায়। চাদরটা দেখে বলেছিল, ব্যান্ডেজ হিসেবে ভালোই। নারকেলটা হাতে নিয়ে বলেছিল, একটা মোচা নিয়ে এলে ছোলা দিয়ে ঘন্ট করা যাবে। সংবর্ধনার নারকেলে কি ঘণ্ট করা উচিত? এই সংশয় আমার ছিল। এ তো ভাবের নারকেল। ভালোবাসার উপহার। ভালোবাসার ঘণ্ট হবে! মোচার দাম কম নয়। এর পর সংবর্ধনায় যাঁরা নারকেল দেবেন, তাঁরা যদি একটা করে মোচাও দেন তো বেশ হয়। আমার বউ আবার হিসেব করে ছেলেকে বুঝিয়ে দিলে বুড়ো বয়সে তার বাপের কীরকম ভীমরতি ধরেছে। একশো এক টাকা চাঁদা কানমলে নিয়ে গিয়ে কুড়ি টাকার মাল ঠেকিয়েছে, পরের বছরের জন্যে গলায় পরিয়ে দিয়েছে ব্যান্ডেজ। গামছার সিম্বল। ওরে আমার বড় পেলোয়াররে! সারা রাত বাতের যন্ত্রণায় কোঁ-কোঁ করে। তিন পা হেঁটে সাতবার হাপরের। মতো হাঁপায়।