আজকাল ট্যাক্সি কিংবা অফিসের গাড়ি পাড়ায় ঢুকতে চায় না। মানুষের নিরাপত্তা ক্রমশই কমছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন জঙ্গল এখন শহরের চেয়ে অনেক নিরাপদ। বাঘ অথবা হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের গতিবিধি অথবা আচার-আচরণের একটা বাঁধা নিয়ম আছে, কিন্তু মানুষের চালচলনের নাকি আজকাল কোনও ঠিক নেই। সেই গল্পের সিংহ, যে উপকারীর উপকার মনে রেখেছিল। এরেনার সমস্ত মানুষ রুদ্ধনিশ্বাস। বন্দি আর ক্ষুধার্ত সিংহ মুখোমুখি। সিংহ বন্দির পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ল। কারণ একদা এই বন্দিই তার পা থেকে কাঁটা বের করে দিয়েছিল। কিন্তু মানুষ! বিদ্যাসাগরমশাই বলেছিলেন—অমুকে আমার সম্বন্ধে যা-তা বলছে কেন, কই আমি তো তার কোনও উপকার করেছি বলে মনে পড়ছে না। যুগ তো পালটায়নি। মানুষের স্বভাব সেই একই আছে।
নিউ মার্কেট থেকেই পরদার কাপড় কিছু কিনে নিই। একটা বাথ টাওয়েল। আর একটা বিলিতি সেন্ট। কাবেরীকে একটু সারপ্রাইজ দিয়ে দেব। কেনাকাটা সাধারণত বিনা দর-দস্তুরে হয় না। ভারতবর্ষে একটা জিনিসের ঠিক কী দাম, বোঝবার উপায় নেই। মুনাফার পরিমাণ কত কেউ বলতে পারবে না। বিক্রেতাদের মেজাজ অত্যন্ত চড়া পরদায় বাঁধা। বেশি কথা বলারও উপায় নেই।
কেনাকাটা শেষে একবার ট্যাক্সির চেষ্টা করে দেখতে ইচ্ছে হল যদি পেয়ে যাই। দুটো ট্যাক্সি। ফ্ল্যাগ ডাউন করে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে গেল। আমার মতো যাত্রীর আবেদন অথবা অনুরোধ শোনার কোনও ইচ্ছেই দেখা গেল না। একজন থামলেন, কিন্তু তিনি আমি যেদিকে যেতে চাই তার। উলটোদিকে ছাড়া যাবেন না। আর একজন বললেন তিনি খাওয়া-দাওয়া না করে এক পা-ও নড়বেন না এবং সেই আহারপর্ব কখন কোথায় শেষ হবে তিনি জানেন না। এর পর ট্যাক্সি করে বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছে বিসর্জন দিতে হল। যদিও সেই সপ্তাহ ছিল ট্যাক্সিচালকদের সৌজন্য সপ্তাহ।
চৌরঙ্গির মোড়ে তখন জমজমাট অবস্থা। চারদিক থেকে পতাকাধারী মানুষের মিছিল একের পর এক আসছে। কোনও যানবাহনই চলার রাস্তা পাচ্ছে না। এই শতকের মানুষ প্রায়শই। সমস্যাগুলোকে দার্শনিকের চোখে দেখে থাকেন। কোনও কিছুই আর তেমন করে মনে দাগ কাটে না। মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে না। অন্য সময় হলে আমিও এতটা ছটফট করতুম না বাড়ি যাওয়ার জন্যে। কাবেরী এখন এই সময়টা আমার সঙ্গ চায়। আমার অভিজ্ঞতা কম কিন্তু শুনেছি মেয়েদের এই সময়টায় নানারকম মানসিক উপসর্গ দেখা দেয়। বলতে পারে না মুখ ফুটে। শরীর অপটু হয়, মনের মধ্যে সাগরের ঢেউ আছড়া-আছড়ি করে। বাড়িতে মা, অথবা বর্ষীয়ান কোনও মহিলা থাকলে এইসময়, ঠিক এই সময়ে হয়তো অনেক সাহায্যে আসতেন। অন্য সময় হলে এই ভীষণ বিভ্রান্তিকর অবস্থা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করতুম। কোনও একটা সিনেমার যে কোনও মূল্যের একটা টিকিট কেটে ঢুকে বসে থাকতুম। ইতিমধ্যে মিছিলের মানুষ, জমে থাকা অসংখ্য যানবাহন, ঘরমুখো মানুষ, সময়ের ভেলায় চেপে এই কেন্দ্রস্থরঙ্গমঞ্চ ছেড়ে যে যার দিকে চলে যেত। হয়তো বাস, ট্রাম অথবা অন্যান্য যানবাহন বন্ধ হয়ে যেত। বেশি রাতে হয় হেঁটে না হয় ভাগের ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরে যেতুম।
হঠাৎ একটা প্রায়-খালি আমার রুটের গাড়ি মোড় ঘুরছে দেখে অনেকটা জীবনের মায়া ছেড়েই লাফিয়ে উঠে পড়লাম এবং একটা বসার জায়গাও পাওয়া গেল। এই সব ছোটখাটো ঝুঁকি। অনিচ্ছা সত্বেও নিতে হয় অথচ এর থেকে যে কোনও মুহূর্তে বড় রকমের বিপদ ঘটতে পারে। অবশ্য জীবন মানেই ঝুঁকি। এর পর গাড়ি চলবে শম্বুকগতিতে। জ্যামে আটকাবে। কয়েকবার রাস্তা পালটাবে। আকণ্ঠ মানুষ বোঝাই করবে। যেখানে খুশি থামবে। টিকিটের পয়সা নিয়ে। ঝগড়া হবে। যাত্রীদের মধ্যে ফাটাফাটি হবে। এ এক চলমান রঙ্গমঞ্চ। এরই মধ্যে চোখ বুজিয়ে বসে থাকা। ঝিমুনি আসতে পারে। কখনও বিরক্ত হয়ে নেমে যাওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। অবশেষে নিজের গন্তব্যস্থানে পৌঁছে যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি। কিন্তু আজ আর গন্তব্যে পৌঁছোনো গেল না। তার আগেই যাত্রা শেষ। বাস যাবে না। নেমে যান। কে একজন ভয়ে ভয়ে ফিশফিশ। করে বলল—সামনেই মার্ডার হয়েছে, ভারী লিডার ছিল। অনেক আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠের প্রশ্ন—কে, কে? কী নাম? হেঁটে যাওয়া যাবে তো ভাই সামনে? এসব প্রশ্নের তো কোনও উত্তর নেই। সকলেই পালাতে চাইছে।
প্যাকেট ইত্যাদি নিয়ে নেমে পড়তে হল। এসব ঘটনা এই শহরজীবনে বেশ গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমি তো মরিনি, এখনও বেঁচে আছি, অতএব ভাববার কী আছে। জীবনটাকে একটা মোড়কের মতো করে সাবধানে বাড়ি অবধি নিয়ে যেতে হবে। হয়তো কোনও সময় ফসকে পড়ে যেতে পারে, কিন্তু সেই হারাবার মুহূর্তে সাময়িক একটা আপশোশ, খুব অল্প সময়ের জন্যে। কেউ কেউ অবশ্য হারাতে হারাতেও ফিরে পেয়ে যেতে পারেন। সে এক ভীষণ অভিজ্ঞতা!
কিন্তু যতই এগোচ্ছি রাস্তা নির্জন, থমথমে, সমস্ত দোকান বন্ধ। এখনও দিনের আলো নেভেনি। দিন আর রাত্রির সন্ধিক্ষণ। ঘটনার কেন্দ্রস্থল থেকে সকলেই যেন দূরে চলে যেতে চাইছে। ভীত পশুর মতো। জানি, জিগ্যেস করলে কোনও উত্তর পাওয়া যাবে না। সামনে হয়তো কিছু দূরে। মানুষের কোনও প্রতিনিধি ধুলোয়, রক্তে গড়াগড়ি যাচ্ছে। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনও শোক নেই, কোনও করুণা নেই। কারণ আমরা এখন প্রকৃতই দার্শনিক। সেই মৃত্যুর জন্যে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করাও উচিত নয়। প্রশ্ন—আমার নিরাপত্তা আছে কি না। আমি ওই পথ দিয়ে সোজা, অক্ষত আমার সাজানো সুন্দর ফ্ল্যাটে পৌঁছোতে পারব কি না, যেখানে আমার জীবনের অনেক নরম মুহূর্ত আমার অপেক্ষায় রয়েছে।