একটু ঘুম বোধহয় এসেছিল। কীসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকার পক্ষের রাত। বাইরে পাগল হাওয়া উঠেছে। মাঝরাতে পৃথিবীটা কেমন অচেনা হয়ে যায়। নিজের পরিচিত ঘরটাও তখন বিশালে হারিয়ে যেতে চায়। মহাকাশে ড্যাব ড্যাবা তারা। সমুদ্র থেকে মেঘ উঠছে। চারপাশ নিস্তব্ধ। মাঝে-মধ্যে কুকুরের আর্তনাদ। পাশেরই কোনও বাড়িতে রোগের যন্ত্রণায় কেউ ওঁ ওঁ শব্দ করছে। নিঃশব্দে আকাশ গুটিয়ে পুব থেকে পশ্চিমে। এত অন্ধকার, যেন জানলার বাইরে হাত বাড়ালে হাতে কালো রং লেগে যাবে।
ছেলেবেলা থেকেই আমার একটু ভূতের ভয় আছে। একা একা শুতে পারি না। একবার কৃষ্ণনগরে গিয়ে তিন রাত ঠায় বিছানায় জেগে বসে কাটিয়েছি। এই যে ঘুম ভেঙে গেল আর আসবে না। এইবার একে একে তারা আসবে। হারু গলায় দড়ি দিয়েছিল। সেই হারু আসবে। এখুনি। নিত্যর মা পুড়ে মরেছিল। সেই কালো, পোড়া কাঠের মতো নিত্যর মা আসবে। বসন্ত খুন হয়েছিল। সে আসবে স্কন্ধকাটা হয়ে। সেই ছেলেটি জলে ভেসে উঠবে। গঙ্গায় যে ভাসছিল প্যান্ট-জামা পরে উপুড় হয়ে। সবাই আসবে একে একে। শেষে এমন অবস্থা হবে ইচ্ছে হলেও বাথরুমে যাওয়ার সাহস থাকবে না। এতখানি বয়েস হল তবু ভূতের ভয় আর গেল না। ইদানীং আবার চোরের ভয় ঢুকেছে। বাইরে সামান্য শব্দ হলেই মনে হচ্ছে কেউ পা টিপে টিপে হাঁটছে।
তবু বেশ কিছুক্ষণ মন শক্ত করে বিছানায় পড়ে রইলুম। চোখ বন্ধ। তবে বেশ জানি ঘরে আমি আর একা নই। অনেকে এসে গেছে। মন আর কোনও যুক্তি মানতে চাইছে না। রাত যে অচেনা! সত্য, মিথ্যা, লৌকিক, অলৌকিক সব ঢেকে দিয়েছে। বউয়ের সঙ্গে লড়াই আমি চালাতে পারব না। রাতে আমি বড় অসহায়। নরওয়ে হলে পারতুম, সেখানে ছ-মাস দিন, ছমাস রাত। দিনের ছ-মাস অন্তত ভূতের হাত থেকে নিষ্কৃতি। সাবিত্রী সত্যবানকে আগলে রেখেছিল বলে যমেও। ছুঁতে পারেনি। স্ত্রী পাশে থাকলে ভূতে কী করবে গো। হাজার চেষ্টা করলেও আমার গলা দিয়ে এখন শব্দ বেরোল না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ও ঘরেও কি যেতে পারব? খাটের নীচে কী। আছে কে জানে। পা নামালেই যদি টেনে ধরে। ভয়! কীসের ভয় তা জানি না। ভূত আছে কি নেই স্ট্যাম্প পেপারে লিখে দিতে পারবে কি? যার কাছে আছে তার কাছে আছে।
এইবার মনে হচ্ছে খাটের তলায় কে যেন ধীরে ধীরে তালে তালে টোকা মারছে। দূরে একটা কুকুর মড়াকান্না কাঁদছে। আর নয়। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ও সব বান্ধবী-টান্ধবী কেউ কিছু নয়। বউই সব। প্রকৃতির বেগে, ভূতের তাড়ায় মানুষ সব পারে। গ্রাম্য কথাতেই আছে হাগার নেই বাঘার ভয়। পাশের ঘরে কোনও মতে গিয়ে মশারির দড়িমড়ি ছিঁড়ে হুড়মাড় হুড়মাড় করে সেই রাগিণীদেবীর ঘাড়ে গিয়ে পড়লুম।
শীতের চেয়ে, ভূতের চেয়েও ঠান্ডা গলা ভেসে এল, ‘এলে তা হলে? পারলে না শেষ পর্যন্ত?’
‘না, পারলুম না!’
‘ঘেন্না করছে না?’
‘না, ও ছিল কথার কথা। অন্তরের কথা নয়।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ গো হ্যাঁ।’ মনে হল মাঝরাতে সিনেমার রামকৃষ্ণ কথা বলে উঠলেন।
‘এঘরে ভীষণ ঠান্ডা। উত্তরের ঘর ড্যাম্প, ওঘরে চলো। রাতের যেটুকু বাকি আছে সেইটুকু অন্তত ঘুমিয়ে নাও।’
এত স্নেহ কোথায় ছিল চকমকি? ঘষা না লাগলে বুঝি আগুন বেরোয় না!
সকালে একেবারে সোনার পাতের রোদ উঠেছে। কোথায় কী? ভূতটুত এখন সব ভাগলবা। গরম গরম চা চলছে। মন আর মেঘলা নেই। বর্ষার পরেই তো শরৎ আসে। বাঁ পাশে বসে আসে। ছেলে। সে খুব দুঃখের গলায় বলল, ‘এ বারেও হেরে গেলে?’
ডানপাশে বসে মেয়ে। সে খুব ভারিক্কি চালে, লেডি ডাক্তারের গলায় বললে, ‘এবারেও ভূতের ভয়?’
ছেলে বললে, ‘তা ছাড়া আবার কী?’
মেয়ে বললে, ‘তোমাকে পাঁচু ঠাকুরের কাছ থেকে একটা মাদুলি এনে পরিয়ে দিতে হবে।’
ছেলে জিগ্যেস করলে, ‘তোমরা এবারে ক’দিন ঠান্ডা থাকবে?
এর উত্তর আপাতত আমার জানা নেই। তোমাদের যখন বিয়ে হবে তোমরাও এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে না। তবে জীবনের সার কথা মনে হল এতদিনে বুঝতে পেরেছি। ভাগ্যের চুল্লি থেকে নিশিদিন জোড়ায় জোড়ায় পেয়ালা পিরিচ বেরিয়ে আসছে ডিজাইনে মিলিয়ে। একটি গেলে আর একটি খোঁড়া। যার সঙ্গে যা। যেমনটি মিলিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। ঠুংঠাং করতে করতে একদিন একটা ভাঙবেই। তখন অন্যটা পড়ে থাকবে সংসারের এক কোণে অবহেলায়। যতক্ষণ জোড়ে আছে দাপটে আছে। হাতে হাতে ঘুরছে। জীবনের নির্যাসে ভরা সেই পেয়ালা পিরিচ থেকে জীবনের সুগন্ধ বেরোচ্ছে। কখনও অসাবধানে ছলকে পড়ে গেলেও পিরিচেই জমা। থাকছে। একদিন একটা ভাঙবেই। তবে কোনদিন কোনটা—আমিই জানি না তা তোমাদের বলব কী?
প্রেম আর ভূত
অনেক শুকনো পাতা পড়ে আছে পার্কের বেঞ্চে। বছরের এই সময়টায় গাছ পাতা ঝরায়, নতুন সাজে সাজবে বলে। জলের ধারে ধারে কচি কচি ঘাস গজিয়েছে। লেকের জলেও কিছু শুকনো পাতা আনমনে ভাসছে। দিব্যেন্দু বেঞ্চে ছড়িয়ে থাকা শুকনো পাতার ওপরেই বসে পড়ল। দুপুরের রোদ হলুদ নেশার মতো ঝিমঝিম করছে চারপাশে। লেক এখন ফাঁকা। বাতাসে শীত শেষের গরম হলকা। আজ তো আর ছুটির দিন নয়। কারা আর আসবে এখন এই লেকে বেড়াতে! দূরে একটা গাছের তলায় একটা ছেলে আর মেয়ে পাশাপাশি বসে আছে গায়ে গা লাগিয়ে। নতুন প্রেম। দেখলেই বোঝা যায়। যা কথা ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। হাতে হাত রেখে। দুজনে বসে আছে। বড় ক্লান্ত, বড় শ্রান্ত।