বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হল। দশটা-টশটা হবে। শোওয়ার ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে গেলুম। এতদিনের জোড়া খাট সিঙ্গল হয়ে গেছে। ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা দেখাচ্ছে। শব্দ করলে। প্রতিধ্বনি হচ্ছে। ছেলে আর মেয়ে দুজনেই ঘরে ছিল। বড়সড় হয়েছে। বুঝতে-সুঝতে শিখেছে। মেয়ে বলল, ‘কী গো তোমার রাগ কমেছে?’
ছেলে বলল, ‘কক ফাইটের ভয়ে রাত করে ফিরলে?
আরে তাই তো, বেরোবার সময় বলে যেতে ভুলেই গেছি, আমার নিমন্ত্রণ ছিল। অবাক হয়ে আমাকে ঘরের এপাশে-ওপাশে ঘুরতে দেখে ছেলে বললে, ‘আর ফাইট করতে পারবে না। মাতাঠাকুরানি আলাদা হয়ে গেছে।’
মেয়ে বললে, ‘ফিমেল খাটটা মেল খাটকে ডাইভোর্স করেছে।’
আজকাল ছেলেমেয়েরা কী সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে! ভালো ভালো। যত তাড়াতাড়ি বুঝতে টুঝতে শেখে ততই ভালো। আগে যাত্রা শুরু করলে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে। জামা খুলতে খুলতে জিগ্যেস করলুম, ‘কী ব্যাপার, তোমরা দুটিতে এখনও বসে?
মেয়ে বললে, ‘তোমাদের একটু হেল্প করার জন্যে বসে আছি।’
‘হেল্প মানে?’
‘এখন তো দিনকতক তোমাদের কথা বন্ধ থাকবে তাই আমরা দূতের কাজ করব।’
ছেলে বললে, ‘একবার দেখে নাও হাতের কাছে ঠিক আছে কি না। আমরা তো জানি না তোমার কী লাগে না লাগে।’
মেয়ে বলল, ‘যতটা জানি সব গুছিয়ে রেখেছি। মাকে তোমার এখন কিছু বলার আছে?’
‘হ্যাঁ আছে। বলে দাও, বাবা কিছু খাবে না।’
ছেলে বললে। ‘জানতাম, তুমি আজ খাবে না।’
ফিশফিশ করে জিগ্যেস করলে, ‘বাইরে ভালো করে খেয়ে এসেছ তো? তুমি লড়ে যাও। আমরা তোমাদের পেছনে আছি।’
মেয়ে বললে, ‘মায়ের সকাল থেকে উপোস চলেছে। আমাদের মাছের ভাগ বেড়ে গেছে।’
ছেলে বললে, ‘তা হলে তুমি এক গেলাস জল খেয়ে এবার শুয়ে পড়া। বেশ শীত পড়েছে। ওষুধ-টষুধ কিছু খাবে? এ সময় আবার জ্বরে পড়ে হেরে যেয়ো না যেন। প্রত্যেকবার তুমিই হারো। এবার কিন্তু জিতবে হবে।’
‘না, ওষুধটষুধ লাগবে না। এ ঠান্ডায় জ্বর হবে না।’
‘তুমি সোয়েটারটা পরলে না কেন? একটু বোকা আছ। ছোটমামা তোমার কী নেবে? নিয়ে পার পাবে? আমরা আছিনা! মামার বাড়ি যাই আর আসার সময় ভালো প্যান্টটা, জামাটা, যা পাই বাগিয়ে আনি। তুমিও যেমন! এই তো ও মাসির দুখানা শাড়ি নিয়ে চলে এসেছে।’
মেয়ে বললে, ‘আর তিনখানা আনতে পারলেই সমানে সমান হয়ে যাবে রে দাদা।’
‘ও মায়ের বুঝি পাঁচখানা নিয়ে গেছে? চল তা হলে আর একবার যাই!
মেয়ে এক গেলাস জল এনে চাপা দিয়ে রেখে গেল। মশারি-টশারি বেশ পরিপাটি করে খাটানো। ছেলে মাকে বলছে শুনলাম, ‘তোমার কিছু বলার আছে মা?’
‘আছে। খাবে না যখন আগে বলতে কী হয়েছে? পয়সা কি সস্তা?’
ছেলে ও ঘর থেকে হেঁকে বললে, ‘পয়সা কি সস্তা? মেয়ের বিয়ে, ছেলের পড়ার খরচ। পয়সা কি সস্তা?’ তারপর মাকে বলছে শুনলুম, ‘কী কী খেতে হবে বলো, আমরা দুজনে সাবাড় করে দিয়ে যাই। নষ্ট হওয়াটা ঠিক নয় মা। যা বাজার, কী বলো? ভাগ্যিস আমরা ছিলুম?’
আমাদের কথাই ওদের দিক থেকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে। জীবনের অংশীদার বেড়ে গেছে। একা একা আর কিছু করা যাবে না। সব স্বাধীনতা চলে গেছে এমনকী মান-অভিমানের স্বাধীনতাও। যাক, যা হওয়ার তা হয়েছে। পা পিছলে গেলে পড়ে যেতে হয়। জীবন পিছলে গেলে সংসার স্রোতে এইভাবেই ভেসে যেতে পারে। সাঁতার জানলেও কোনও লাভ হয় না।
বিছানায় শুয়ে পড়েছি। ছেলেমেয়ে বাইরে থেকে সমস্বরে বলে উঠল, ‘গুড নাইট।’
‘গুড নাইট।’
মেয়ে বললে, ‘তোমার আবার একা শুতে ভয় করবে না তো?’
‘ভয়ের কী আছে? ভয় করবে কেন?’
ছেলে বললে, ‘যদি ভয় করে তা হলে তুমি যেন আবার মায়ের বিছানায় এসে ঢুকো না। আমাদের ঘরে চলে আসবে? কেমন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ হয়েছে। অনেক উপদেশ ঝেড়েছিস, এবার শুয়ে পড়।’
অন্যদিন আলো জ্বেলে বেশি রাত পর্যন্ত পড়ার উপায় থাকে না। আর একজনের চোখে আলো লাগে। সারাদিন কী ভীষণ খাটুনি! ঘুমের ব্যাঘাত হয়। আমাদের সারাদিন তো কোনও পরিশ্রম হয় না। অফিসে আমরা আড্ডা মারতেই যাই। ফুর্তি করতে যাই। আজ আলো জ্বেলে ইচ্ছে করলে সারা রাত পড়া যায়। জীবন ছোট হয়ে আসছে। বরফের টুকরোর মতো ক্রমশই গলে যাচ্ছে। কত কী পড়ার আছে, জানার আছে। কত দেশ আছে। কত রকমের জীবন আছে। পিঁপড়ের পিঠে খাওয়ার মতো এক কোণে ধরে একটা ফুটোফাটা করে সরে পড়া। সেই এক
মহিলা, এক কণ্ঠস্বর, এক বাড়ি, এক ঘর, এক রাস্তা, এক অফিস। একই জগতে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে, থাকা আর না-থাকার তফাতটাই ভুলে গেছি।
হ্যাঁ, অনেক জ্ঞান লাভ হয়েছে। আজ শুয়েই পড়া যাক। বিছানা ছোট হয়ে গিয়ে ঘরটা বড় হয়ে গেছে। কতকটা নতুন জায়গা বেরিয়েছে। আলমারিটা যেন দূরে সরে গেছে। টেবিল আর চেয়ারটা যেন ছোট দেখাচ্ছে। যে দিকে খুশি ইচ্ছেমতো পা ছুড়ছি, কারওর গায়ে লাগছেনা। অন্ধকারে কোনও প্রতিবাদ ভেসে আসছে না। বিছানাটাও কেমন যেন বেশি শীতল মনে হচ্ছে। এতদিনের অভ্যাস, পাশে একটা প্রতিরোধ নিয়ে ঘুমোনো! (মেছুনিকে রাজবাড়ির শয্যায় শুতে দেওয়া হয়েছিল। কিছুতেই ঘুম আসে না। শেষে মাঝরাতে আঁশের ঝুড়িটাকে জল ছিটিয়ে মাথার পাশে রেখে তবেই ঘুমোতে পারল।)
ঘুম আর কিছুতেই আসতে চায় না। সারাদিন না খেয়ে আছে। এ দিকে আমি একপেট ভালোমন্দ খেয়ে শুয়ে আছি। না, আমি খোশামোদ করে খাওয়াতে পারব না। অসম্ভব। আমার বান্ধবী এখন কী করছে? নিশ্চয়ই শুয়ে পড়েছে। কার পাশে শুয়েছে? সেই শয়তান লোকটার পাশে? তিনি নাকি অন্য এক মহিলাতে আসক্ত। সে শয়তান, আমি শয়তান, স্ত্রী শয়তান; দেবতারা কোথায় গেল কে জানে? না, পরস্ত্রী-র কথা চিন্তা করা উচিত নয়। নির্জন, অন্ধকার ঘরে, একা শয্যায় অন্য নারীর চিন্তা আক্ষেপ বাড়িয়ে তোলে। জীবনকে আরও অসহনীয় করে তোলে। অনেক বয়েস হয়েছে। আমার এক বন্ধু বলেছিল, পুণ্য করার জন্যে সাহসের দরকার হয় না। পাপ করতে গেলে সাহস চাই। জেনুইন লম্পট হওয়া খুব শক্ত। সন্ন্যাসীকে যেমন সব ছাড়তে হয়, লম্পটকে তেমনি সব। ছাড়তে হয়। লজ্জা, ঘৃণা, ভয়—তিন থাকতে নয়। আমার বউটাকে ঈশ্বর যদি একটু বুদ্ধি দিতেন। বেশ হত। সবসময় যেন কাঁকড়াবিছের মতো খরখর করে বেড়াচ্ছে।